সুচিত্রা সেনের সব ছবি: ধীরেন দেব
সুচিত্রা সেন এক বছর হল নেই।
তবে চলে যাওয়ার আগেও প্রায় ত্রিশ-বত্রিশ বছর তিনি থেকেও ছিলেন না। যোগাযোগ ও প্রচারের বাইরে চলে গিয়ে নিজের এক অদৃশ্য উপস্থিতি রচনা করেছিলেন সিনেমা জগতে, হলিউডের গ্রেটা গার্বোর মতো। যদিও অন্তরালবর্তিনী হওয়ার সময় তিনি গার্বোর এই সুদীর্ঘ আড়ালের জীবন (১৯৪১ থেকে) সম্পর্কে বিশেষ কিছুই জানতেন না। কালে কালে এই তুলনা উঠতে থাকায় জেনেছিলেন। ১৯৯০-এ গার্বোর মৃত্যুর পর (তত দিনে সুচিত্রার নিজেরও সাত বছর হল দেখা নেই) তুলনাটা দানা বাঁধে।
লোকচক্ষু থেকে হারিয়ে যাওয়াটাই কিন্তু গার্বো-সুচিত্রার একমাত্র সাদৃশ্য নয়। মাত্র কুড়ি বছরে চৌত্রিশটা ছবি (আট সুইডিশ, ছাব্বিশ ইংরেজি) করে গার্বো যে-কুহকিনী ভাবমূর্তি ও ডিভা স্টেটাস তৈরি করে নিয়েছিলেন নিজের, সুচিত্রাও অনুরূপ এক প্রভাব ও মায়া সঞ্চার করেছিলেন তাঁর পঁচিশ বছরের নায়িকাজীবনে তিপ্পান্নটি বাংলা ও সাতটি হিন্দি ছবি করে।
সুচিত্রাই কি বাংলা ছবির প্রথম ও শেষ ডিভা? হয়তো। আবার ‘হয়তো’ কেন? নিশ্চিতই। উত্তমকুমারের চেয়েও যাঁর স্টার বিলিং এগিয়ে থাকত, বেড়ে থাকত পারিশ্রমিক, স্টুডিয়ো ফ্লোর তটস্থ থাকত যাঁর মেজাজমর্জি, খেয়ালের ব্যাপারে, প্রযোজকরা সন্ত্রস্ত, তিনি কিন্তু ওই গার্বোর মতোই হিটের পর হিট দিয়ে (বাহান্নতম বাংলা ছবি ‘দত্তা’-ও তেইশ সপ্তাহ চলে বিনিয়োগের দ্বিগুণ লাভ জুগিয়েছে) কেরিয়ারের শেষ অবধি নিজের জায়গা কায়েম রেখে গেছেন।
কায়েম তো রেখেছিলেনই, কিন্তু আরও বেশি করে যেটা ভাবায় তা হল কী ভাবে? প্রযোজক ধরে ছবিতে নেমে নয়, ছবি প্রযোজনা করেও নয়, প্রচারমাধ্যমকে কাজে লাগিয়েও নয়। ওঁর সেরা সময়ের দশটা বছরের ছবিগুলোর নাম পর পর সাজিয়ে দিচ্ছি, দেখুন গায়ে কাঁটা দেয় কি না, অবিশ্বাস্য ঠেকে কি না। নিন... ‘হারানো সুর’, ‘চন্দ্রনাথ’, ‘পথে হল দেরি’, ‘জীবনতৃষ্ণা’, ‘রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত’, ‘ইন্দ্রাণী’, ‘সূর্যতোরণ’, ‘চাওয়াপাওয়া’, ‘দীপ জ্বেলে যাই’, ‘হসপিটাল’, ‘স্মৃতিটুকু থাক’, ‘সপ্তপদী’, ‘বিপাশা’, ‘সাত পাকে বাঁধা’, ‘উত্তরফাল্গুনী’, ‘সন্ধ্যাদীপের শিখা’ ও ‘গৃহদাহ’।
১৯৫৭-৬৭ অবধি এ এক অবিরাম হিটযাত্রা যা গ্ল্যামারাস সুচিত্রাকে একটু একটু করে অভিনেত্রী ও ডিভা করে তুলেছে। এর অধিকাংশই তো নায়িকাপ্রধান ছবি নয়, উত্তমকুমারের মতো নায়কের সঙ্গে প্রাধান্য ভাগ করে নিতে হয়েছে (কখনও অশোককুমার, সৌমিত্র, বসন্ত ও বিকাশ), কিন্তু সব ছবিতেই সুচিত্রা আছেন সুচিত্রাতেই। মানে উপস্থিতি, মানে তীব্র আকর্ষণ, স্ক্রিনজোড়া লাবণ্য এবং কখনও কখনও চমকে দেবার মতো অভিনয়। মনে করুন ‘সাত পাকে বাঁধা’, ‘উত্তরফাল্গুনী’ বা ‘চন্দ্রনাথ’। যা বাঙালি দর্শককের মনের ব্যথা ও চোখের জলের সঙ্গে মিশে আছে এতকাল।
পর্দায় উপস্থিতিটাও যে অভিনয়ের এক মস্ত অঙ্গ তা সুচিত্রার মতো আর কোনও অভিনেত্রী প্রমাণ করতে পেরেছেন কি না জানি না, শুধু গ্ল্যামার দিয়ে এ কাজ সেরে ফেলা যায় বলেও মনে হয় না। গ্রেটা গার্বোর মৃত্যুতে অনন্যা অভিনেত্রী বেটি ডেভিস যেটা বলেছিলেন তা সুচিত্রা সম্পর্কে বললেও বলা যেতে পারে: “হার ইন্সটিংক্ট, হার মাস্টারি ওভার দ্য মেশিন ওয়জ পিওর উইচক্র্যাফট।” ওঁর প্রবৃত্তি মেশিনের ওপর ওঁর কতৃত্ব ছিল বিশুদ্ধ ডাকিনীবিদ্যা।
সুচিত্রা গ্ল্যামারসর্বস্ব ও অভিনয়ে শিথিল এমন একটা প্রচার তাঁর সমকালীন ও ঈষৎ পরবর্তী কালের অভিনেত্রীরা জারি রেখেছিলেন। সেটা কতখানি ঈর্ষাপ্রসূত আর কতটা ন্যায্য বিচার তা সুচিত্রার ছবিগুলো চালিয়ে দেখলেই পরিষ্কার হয়ে যায়। প্রথম দিককার ছবিতে তিনি বেজায় আড়ষ্ট, কিন্তু তার কারণ ঠাওরানো খুব কঠিন কাজ নয়। পাবনার মেয়ে বিয়ে হয়ে কলকাতায় এসেছেন, আকাঙ্ক্ষা যদি কিছু থেকে থাকে তো সেটা গানের রেকর্ড করার। গানের গলাটা ছিল মিষ্টি এবং ঝোঁক ছিল রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রতি। কিন্তু বিধি অন্য রকমটি ভেবেছিলেন।
স্বামী দিবানাথ সেনের উচ্চাভিলাষই (হয়তো রূপসী বৌয়ের মধ্যে আগামী নক্ষত্র দেখেছিলেন!) কারণ হল, রমা সেনের সিনেমায় নামার। ওজরআপত্তি কম করেননি রমা, কিন্তু তত দিনে ওঁর হয়ে অ্যাক্টিঙের অ্যাডভান্সও নেওয়া হয়ে গেছে উদ্যোগী স্বামীর। ফলে একদিন রাশভারী শ্বশুর আদিনাথ সেনের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে হয়েছিল রমাকে পারমিশন জোগাড়ের জন্য। ফলে যাকে বলে একজন রিলাকট্যান্ট অ্যাকট্রেস, সে রকম এক অনিচ্ছুক শিল্পী হিসেবে ওর টালিগঞ্জ স্টুডিয়ো পাড়ায় প্রবেশ। দ্বিতীয় ছবি ‘সাড়ে চুয়াত্তর’-এ সাফল্যের মাপজোক হয় না, কিন্তু সে সাফল্যের কিছুই প্রায় বর্তায় না সুচিত্রায়। কিন্তু চতুর্থ ছবি ‘ভগবান শ্রীচৈতন্য’-য় রূপের সঙ্গে এক মরমিয়া উপস্থিতি জুড়তে শুরু করে দিয়েছেন সুচিত্রা। হয়তো ওইখানেই আমরা প্রথম আভাস পাই পরবর্তী কালের ‘চন্দ্রনাথ’ ও ‘কমললতা’র সুচিত্রার। প্রথম ছবি ‘সাত নম্বর কয়েদি’ থেকে শেষ ছবি পর্যন্ত সুচিত্রা যে ক্রমান্বয়ে সিনেমার রোল ধরে ধরে নিজেকে শুধরেেছেন ও গড়েছেন, তা চোখে না পড়ে যায় না। তাতে কতটা কী পেরেছেন, না পেরেছেন তা নিয়ে তর্ক চলতেই থাকবে।
যুবতী মুনমুনের সঙ্গে মা
তবে মনের মতো ছবি ধরে ধরে যে তিনি এগোতে পেরেছেন, সেটা সম্ভব হয়েছিল তিনি নিজের পছন্দের এবং নিজের শর্তে কাজ করতে পেরেছিলেন বলেই। কত ছবির কাজ যে তিনি ফিরিয়ে দিয়েছলেন, তা নিয়েও একটা গল্প তৈরি হয়ে যায়। অজস্র কাজের অফার এলেও সে সব স্ক্রিনিং করার জন্য কোনও সেক্রেটারি রাখেননি। তরুণকুমারকে বলেছিলেন যে প্রতিদিন সেক্রেটারির সঙ্গে এক-দেড় ঘণ্টা পরামর্শ চালানো বড় সমস্যা। তবে আসল কারণ হয়তো এই যে তিনি কাহিনি ও কাজ নিজেই সরাসরি বুঝে নেওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন।
ছবির কাহিনি, প্রযোজক ইত্যাদি বাছাইয়ের ধরনে সুচিত্রা একটা একক ঘরানা তৈরি করেছিলেন বাংলায়। খুবই মেজাজি, হয়তো বদমেজাজিও কিন্তু কোনও মতেই খামখেয়ালি নন। ‘আঁধি’র শু্যটিঙের সময় মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় ওঁর সঙ্গে দেখা করতে গেলে ওঁকে উপদেশ দিয়েছিলেন, “সব সময় মাথা উঁচু করে কাজ করবে।”
সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে কাজের অফারও ফিরিয়েছেন সুচিত্রা। সত্যজিৎ ওঁর ‘দেবী চৌধুরাণী’ ছবির জন্য টানা ডেট চেয়েছিলেন নায়িকার। কিন্তু তা করতে হলে আরও ক’জন প্রযোজকের থেকে ডেট ফেরত নিতে হত। সুচিত্রা সেটা করতে চাননি। ফলে ‘দেবী চৌধুরাণী’ আর হয়নি। এই আক্ষেপ আজ অনেকেরই। আবার সেই সঙ্গে আরেক আক্ষেপও প্রায়ই শোনা যায়: ‘হায়, নায়ক-নায়িকার এই আভিজাত্য আর কি কখনও ফিরবে না?”
ফাংশানে ফাংশানে ফিতে কেটে লম্ফ জ্বেলে খবরে ওঠার দিকে কোনও দিনই ছিলেন না সুচিত্রা। স্টুডিয়ো ফ্লোর ও তার বাইরের জীবনের মধ্যে স্পষ্ট একটা দূরত্ব রক্ষা করতেন। এই বাইরের জীবনটার আবার অনেকখানি জুড়ে থাকত তাঁর পারিবারিক জীবন। যে-জীবনের কোনও প্রচারও তিনি চাইতেন না। এক আত্মীয় ফোটোগ্রাফার ধীরেন দেব ছাড়া ওঁর খোলা মেজাজের ছবিও খুব বেশি কারও নেই। জীবনের একেবারে শেষ দিকে তিনি যে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেন, সিনেমা ও সমাজ থেকে, তার প্রস্তুতি-পর্ব কিন্তু খুব কম দিনের নয়।
আজকের সিনেমা জগৎ মানেই তো শিল্পীদের সাক্ষাৎকার, সাক্ষাৎকার আর সাক্ষাৎকার। বলতে গেলে নেই কথার সাক্ষাৎকার। পঁচিশ বছরের ফিল্ম কেরিয়ার ও তারও পাঁচ বছর পর অবধি (অর্থাৎ অন্তরালবর্তিনী হওয়ার আগে) ক’টা সাক্ষাৎকার পাওয়া যায় সুচিত্রার?
বলা মুশকিল। ওঁর কথা হিসেবে যা মাঝে মধ্যে ছেপে বেরোত, তা ক্ষমাঘেন্না করে ছেড়ে দিতেন। বলতেন, ওঁদেরও তো কিছু করে খেতে হবে।
তাতে ফল হয়েছে এই, সুচিত্রা নিয়ে বৃত্তান্তের শেষ নেই। হয়তো এই কারণেই গল্পে গল্পে পাওয়া রহস্যে রহস্যে ওঁকে নিয়ে মানুষের কল্পনার উড়ানও স্তর-পরম্পরায় ঊর্ধ্বগামী। ফলে তুলনাটা ফের এসে যায় গার্বোর সঙ্গে। যাঁর মৃত্যুতে ‘ডেলি নিউজ’ পত্রিকায় মন্তব্য করা হয়েছিল, “হারস্ ওয়জ্ আ মিথ মেড বাই মেশিন, বাট ম্যানস্ ইমেজিনেশন টুক ইট ফ্রম দেয়ার টু ডিজিং হাইটস্।” মেশিন তৈরি করেছিল ওর কিংবদন্তি। কিন্তু মানুষের কল্পনাই সেটিকে উর্ধ্ব থেকে উর্ধ্বলোকে বয়ে নিয়ে গেছে।
সবে তো এক বছর হল, দিনে দিনে সব কাহিনি, সব স্মৃতিচারণা, সব বলাও শোনা যখন হয়ে পড়বে, তখন হয়তো সুচিত্রার সেরা ছবিটা আরও স্পষ্ট হবে। যে ছবি ওর সব সেরা ছবির স্থির চিত্রের মতো নীরব-মুখর, ওর উত্তরাধিকার। এই চিন্তাটা আসাতে, আরেকটি মর্মপীড়া থেকে উদ্ধার পেলাম। ১৯৮৯-৯০ সালে আনন্দবাজার পত্রিকার এক প্রস্তাব ছিল, ওঁর কন্যা মুনমুনকে সঙ্গে নিয়ে সুচিত্রার স্মৃতিকথা রেকর্ড করে লেখার। মুনমুন বারকয়েক সেই প্রস্তাব মা’র কাছে রাখেন। বারবারই এক উত্তর: “কী হবে? ছেড়ে দাও।”
http://www.anandabazar.com/supplementary/patrika/%E0%A6%8F%E0%A6%B2-%E0%A6%AE-%E0%A6%A6-%E0%A6%96%E0%A6%B2-%E0%A6%AE-%E0%A6%9A%E0%A6%B2-%E0%A6%97-%E0%A6%B2-%E0%A6%AE-1.105471
No comments:
Post a Comment