এক শট মে একই গোল হোতা হ্যায়, কভি দো নেহি!
ষাট বছর আগে শোনা কথাটা এখনও আমার জীবনে সেরা ফুটবল টিপস!
উনিশ বছরে ভারতীয় ফুটবল দলের জার্সি গায়ে চড়ানো থেকে শুরু করে অবসরের পর দীর্ঘ পঁচিশ বছরের কোচিং জীবনে যত অসংখ্য টিপস পেয়েছি, তেমনি প্রচুর টিপস দিয়েছি। বাঘা সোমের টিপস পেয়েছি। রহিম সাহেবের পেয়েছি। ডেটমার ক্র্যামার। পরে নিজে কোচ হয়ে সুধীর থেকে চিমা, গৌতম থেকে ভাইচুংকে টিপস দিয়েছিও।
কিন্তু উনিশশো পঞ্চান্নয় ঢাকার ধানমন্ডির হোটেলের ঘরে সেই সন্ধের টিপসটা আজ পর্যন্ত ভুলতে পারিনি। জীবদ্দশায় ভুলবও না। কারণ, সেটা যেমন নাটকীয় পরিবেশে পাওয়া, তেমনি এক প্রবাদপ্রতিমের থেকেও পাওয়া আমার!
ইস্টবেঙ্গল তাঁবুতে বিরোধী শিবিরকে ফালা ফালা করতে পিকে-র ‘নকশী কাঁথা’
তাঁর নামটা বলার আগে গল্পটা বলার লোভ সামলাতে পারছি না। আসলে পঞ্চান্নর সেই এশিয়ান কোয়াড্রাঙ্গুলারের কিছু দিন আগেই রাশিয়া থেকে ইন্ডিয়া টিম খুব খারাপ রেজাল্ট করে ফিরেছিল। একটা ম্যাচে দশ গোলও খেয়েছিল। যার ধাক্কায় শৈলেন মান্না-আমেদ খান সুদ্ধ একঝাঁক পুরনো মুখ পাল্টে জাতীয় দলে নতুন রক্ত আমদানির চেষ্টায় থঙ্গরাজ, কেম্পিয়া, আমার মতো কয়েকজন তরুণ ফুটবলারকে একসঙ্গে ঢাকার দলে সুযোগ দেওয়া হয়েছিল।
আর ঢাকায় প্রথম ম্যাচেই আমার দু’টো গোলের শটেই জাল ছিঁড়ে যাওয়ার পর সেখানে আমাকে নিয়ে বেশ আগ্রহ তৈরি হয়। কিন্তু তা বলে অমন একটা বিস্ময় আমার জন্য অপেক্ষা করে আছে ধারণাই করতে পারিনি সে দিন।
সন্ধের দিকে হোটেলের ঘরে বসে আছি। হঠাত্‌ সাত্তারদা প্রায় ছুটতে ছুটতে আমার ঘরে এসে ঢুকল। চোখমুখ একেবারে চকচক করছে।
“বড়দা আসছে বোধহয় এই হোটেলে... বড়দা!”
সাত্তারদা উত্তেজনায় হাঁফাচ্ছে। কে বড়দা? আমার মুখ দিয়ে যেন অজান্তেই অস্ফুটে বেরিয়ে এল!
পরক্ষণেই দরজায় টোকা আর কলিংবেলের একসঙ্গে বেজে ওঠা। সাত্তারদাই দরজাটা খুলতে গেল আর তার পরই তার চোখমুখ যা হল, এত-এত বছর পরেও স্পষ্ট মনে আছে আমার। যেটা বলে বা লিখে বোঝানো সম্ভব নয়।

সামাদসাব
“আদাব অর্জ হ্যায়...আদাব অর্জ হ্যায়,” বলতে বলতে বিহ্বল সাত্তারদা ঘরে পা রাখা সেই ছয় ফিট তিন-চার ইঞ্চি মানুষটাকে কী ভাবে যে অভ্যর্থনা করবে যেন বুঝে উঠতেই পারছে না। প্রায় দরজার সমান হাইট সেই মানুষটার। গায়ে লাহরি কুর্তা। গলায় একটা শাল জড়ানো। পায়ে জরি লাগানো চপ্পল।
সামাদসাব! অবিভক্ত ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ ফুটবলার।
ওঁর সঙ্গেই আসা দু’তিনজন লোক এ বার আমাকে দেখিয়ে সামাদকে বলল, “এ হি হ্যায়।” আমি তখন এ রকম এক জীবন্ত কিংবদন্তিকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করব, না কি সেলাম জানাব, বুঝতে পারছি না।
সামাদ কিন্তু আন্তরিক ভাবেই বললেন, “এ হি হ্যায় ও ছোকরা? দো গোল আচ্ছা কিয়া। লেকিন অউর দো গোল ছোড়া।”
এর পর সোজা আমার চোখে চোখ রেখে“তুম জাল ফোঁড়া। লেকিন এক শট মে একই গোল হোতা হ্যায়, কভি দো নেহি!”
কী অমূল্য টিপস! কিন্তু কী সহজ কথাটা! সত্যি বলতে কী, সে দিন আমার দুটো গোলের সময়ই শটের প্রচণ্ড পাওয়ারে জাল ছিঁড়ে যাওয়ায়, পরের দু’টো শটও খুব জোরে নিয়েছিলাম। সেই দু’টোতে গোল হয়নি। এত বছর পর এ-ও স্বীকার করছি, ওই দু’বারই নিজে শট না নিয়ে পাশে থাকা সতীর্থকে পাস দিলে হয়ত গোলের সুযোগ আরও বেশি থাকত।
পরবর্তী ফুটবলার জীবন আর কোচিং জীবনেও এই ধ্রুবসত্য মেনে চলেছি যে, গোলে প্রচণ্ড জোরে মারার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ নিখুঁত ভাবে মারা। বেশি জোরে মারলে একটার বদলে কখনও দু’টো গোল পাওয়া সম্ভব নয়। আমার অগুনতি ছাত্রের মধ্যে গোলে প্রচণ্ড জোরে শট প্রায় কেউই মারত না। ব্যতিক্রম ছিল এক বা দু’জন মাত্রসুভাষ ভৌমিক কিংবা চিমা। কারণ সামাদের টিপসই আমি কোচিং জীবনে আমার টিমকে দিতাম।
অথচ সামাদ কোনও অর্থেই আমার গুরু ছিলেন না। এক দিনের জন্যও তিনি আমাকে কোচিং দেননি। তা সত্ত্বেও ওঁর ওই একটা কথাই আমি নিজের জীবনে বেদবাক্য করে রেখেছি। আজও। এক-এক সময় মনে হয়, মডার্ন ফুটবলে যেমন টিপসের ক্ষেত্রেও অনেক নতুনত্ব এসেছে, তেমনি সাবেকি টিপসের এখনও গুরুত্ব আছে।
আমাকে সবাই বাঘা সোমের ছাত্র হিসেবে জানে। কিন্তু বাঘাদা সেই অর্থে খুব মনে রাখার মতো টিপস আমাকে কখনও দেননি। বরং আমার খেলায় ভুলভ্রান্তি দেখলে বেশি করে বকাঝকাটাই ছিল বাঘাদার স্টাইল। যদি না সেটাই কোনও টিপস হয়!
বাঘাদা বরঞ্চ ইস্টার্ন রেলে আমার একটু একা-একা খেলাকে প্রশ্রয় দিয়েছেন। বলতেন, “তুমি ইন্ডিয়া টিমে তোমার স্ট্যান্ডার্ডের টিমমেট পাও বলে টিমগেম খ্যালো, ঠিক আছে। কিন্তু অফিস ক্লাব টিমে সে রকম সতীর্থ তোমার কোথায়? অগত্যা একাই গোল করার চেষ্টা করো। তবে দেখো, তুমি একাই খেলো ধরে ফেলতে পারলে কিন্তু তোমার পিছনে বিপক্ষ লম্বা দাঁড়িয়ে যাবে, এক জনের পর এক জন।”
ইন্ডিয়া টিমে রহিম সাহেবের বরং কিছু টিপিক্যাল টিপস ছিল। যেমন, গোল করার ব্যাপারে স্বার্থপরতা ত্যাগ করলে নিজের নামের পাশেও অদৃশ্য গোলস্কোরার বসে জানবে। কিংবা, আমার দলে গোল সে-ই করবে, যে অপোনেন্ট বক্সে সবার চেয়ে বেশি ভাল স্কোরিং পজিশনে থাকবে।
সোজা কথা, রহিম সাহেব টিমগেমে ভীষণ বিশ্বাসী ছিলেন। যার জন্য বৈচিত্র আনতে চাইতেন টিমের খেলায়। আমি এমনিতে দু’পায়েরই আউটস্টেপ-ইনস্টেপ দিয়ে গোলে শট নিতে পারতাম। রহিম তার সঙ্গে আমাকে ইনসুইং মারতে শিখিয়েছিলেন। বল মাটিতে ড্রপ না খেতে দিয়ে ভলি শট মারাতেন।
থঙ্গরাজের হাতে বল গেলে তার সঙ্গে আমার সেই অদ্ভুত বোঝাপড়াও রহিম সাহেবের তৈরি করে দেওয়া।
যেমন থঙ্গরাজ বল ধরে এক বার ড্রপ দেওয়া মানে ও লম্বা থ্রো করবে। আর বল ধরে দু’বার ড্রপ দিল মানে উঁচু গোল কিক নেবে থঙ্গরাজ।

মেলবোর্ন অলিম্পিকে ভারতীয় দল। কোচ রহিমস্যার সামনের সারিতে (ডান দিক থেকে দ্বিতীয়)
একেবারে পিছনের সারিতে পিকে (বাঁ দিক থেকে চতুর্থ)
একবার কোয়াড্রাঙ্গুলারের একটা ম্যাচে থঙ্গরাজ বল মাটিতে দু’বার ড্রপ করতেই আমি নিজেদের মিডল থার্ড থেকে প্রচণ্ড দৌড়তে শুরু করে দিয়েছিলাম বিপক্ষ বক্সের দিকে। আর থঙ্গরাজের বিরাট উঁচু গোল কিকটা কাটা ঘুড়ির মতো আমার পায়ে এসে পড়ায় আমি শট নিয়ে আবিষ্কার করলাম, অবাক করে সেই শট ক্রসবারে লেগে ফিরে আসছে আমার দিকেই। আর তত্‌ক্ষণাত্‌ আমি সেই ফিরতি বলে হেড করে গোল করেছি! বল-এ বিপক্ষের কারও স্পর্শ ছাড়াই গোল করে ফেলার নিদর্শন আমার মতো মনে হয় খুব কম ফুটবলারের জীবনেই ঘটেছে।
আমিও নিজে কোচ হিসেবে ছাত্রদের খেলার নিজের-নিজের বিশেষত্ব বিশেষ পাল্টাতাম না। আমার টিপস ছিল, “নিজস্বতা হারিয়ো না কখনও। সে ফুটবল খেলায় হোক, কিংবা নিজের জীবনে। তাতে যে কাজটাই করা হোক না কেন, সেটা সুষ্ঠু ভাবে করা সম্ভব।”
উইঙ্গার হওয়া সত্ত্বেও সুরজিত্‌ সেনগুপ্তের ছিল সেন্টার ফরোয়ার্ডের লাইন বরাবর আক্রমণে যাওয়ার বিশেষত্ব। আবার মানস ভট্টাচার্যের মতো উইঙ্গার খুব বেশি কাট করে ভেতরে আসত না। তবু লিগে একই মরসুমে একুশ না বাইশটা গোল করেছে একবার! যা আমিও কোনও দিন করতে পারিনি।
বিশ্বের সেরা ফুটবল দেশগুলোর জাতীয় দলের ক্ষেত্রে কিংবা বিশ্বসেরা ক্লাবগুলোতে কোচের টিপস চিরকাল চালু ছিল-আছে-থাকবে! তবে ওদের টিম ম্যানেজার, যাকে আমরা কোচ বলে থাকি, আমাদের দেশের কোচেদের মতো বেশি বকে না। সোজা কথা, বেশি কথাই বলে না। তা ছাড়া, ওদের দেশে তো আট বছর বয়স থেকেই ক্লাবের অত্যাধুনিক সুযোগসুবিধে যুক্ত ফুটবল অ্যাকাডেমিতে প্লেয়াররা তৈরি হয়ে থাকে।
কখনও কি শুনেছেন বা পড়েছেন, ফার্গুসন, মোরিনহো, গুয়ার্দিওয়ালা কিংবা আন্সেলোত্তি-লুই এনরিকেরা কোনও ওয়েন রুনিকে, কিংবা কোনও রোনাল্ডো বা মেসিকে কিছু টিপস দিয়েছে? আসলে এই সমস্ত টপ কোচ/ম্যানেজাররা বেশি কথাই বলে না। যতটুকু বলেটলে সেটাও স্ট্র্যাটেজি-ট্যাকটিক্স সংক্রান্তই। কোনও নন-টেকনিক্যাল টিপস বোধহয় নয়।
ঢাকা দিয়ে শুরু করেছিলাম এই কিস্তির লেখা। ঢাকাতেই শেষ করছি। জীবনে প্রথমবার দেশের জার্সি গায়ে খেলা টুর্নামেন্টে আমাকে নিয়ে এতটাই আগ্রহের সৃষ্টি হয়েছিল যে, একটার পর একটা হাইকমিশন থেকে নেমন্তন্ন আসতে শুরু করেছিল ঢাকায়। এই আজ শ্রীলঙ্কা হাইকমিশনে নেমন্তন্ন, তো কালই নেপাল দূতাবাস থেকে আমন্ত্রণ। বাংলাদেশ তখন পূর্ব পাকিস্তান। তো সেখানকার পাকিস্তানি হাইকমিশনের নেমন্তন্ন এল পাকিস্তান ম্যাচের ঠিক আগের সন্ধেতে। কিন্তু ইন্ডিয়া টিম ক্যাপ্টেন মহম্মদ আজিজের আপত্তিতে আমার যাওয়া হল না।
আজিজ নিজে মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও আমাকে বলেছিল, “আমার ধর্ম যা-ই হোক না কেন, খেলার মাঠে আমি ভারতীয়। আমার পূর্ণ সত্তা জেগে থাকবে খেলার মাঠে আমার দেশভারতকে জয়ী দেখার জন্য। সে কারণে আমি টিমের ক্যাপ্টেন হিসেবে পাকিস্তান ম্যাচের আগের রাতে তাদেরই নিমন্ত্রণের ডাক রক্ষা করতে তোমাকে যেতে দিতে পারি না। সেটার অন্য মানে যেমন হতে পারে, তেমনি এত বড় গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচের আগে তোমাকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেওয়াও হবে। ঝুঁকি এত বড় ম্যাচের আগে কিছু উল্টোপাল্টা খেয়ে ফেলে শরীর খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা অবশ্যই আছে।
সে দিন প্রথম বুঝেছিলাম, খেলোয়াড়ের মধ্যেই বোধহয় সবচেয়ে বেশি স্বচ্ছতা, জাতীয়তাবোধ আর দেশপ্রেম থাকে। যা কোনও টিপস যেমন কখনও বাড়াতে পারে না, তেমনই পারে না কখনও কমাতেও!

http://www.anandabazar.com/searchresult/search-7.1090?q=patrika&page=7&short=desc&slab=1&tnp=84