‘‘গৌরীকে দেখাবেন? আমার গৌরী! একটি বার শুধু দেখা করিয়ে দিন!’’
প্রথম স্ত্রী গৌরীর মৃত্যুর পর শোকে ভেঙে পড়ে বিভূতিভূষণ এমন আকুতিই করেছেন দিনের পর দিন!
স্ত্রীর মৃত্যুর কিছু দিন পর বোন মণিও মারা যান। ব্যারাকপুরের বাড়িতে পর পর দুটি আঘাতে পাগল হয়ে যাওয়ার দশা হয় বিভূতির। কলেজের বন্ধুরা একরকম জোর করে তাঁকে কলকাতা নিয়ে আসে।
একদিন টালিগঞ্জের দিকে একলা ঘুরতে ঘুরতে তাঁর দেখা হয় এক সন্ন্যাসীর সঙ্গে। তিনিই বিভূতিকে অশরীরী আত্মার বিচরণ সম্পর্কে ব্রহ্মসূত্রের কথা বলেন। বিভূতি অবাক হয়ে শোনেন, বৃহদারণ্যকে জনকসভায় মহর্ষি আত্মা-তত্ত্বের কী ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন।
সেই শুরু।
সারা জীবন বিভূতিভূষণ বিশ্বাস করে এসেছেন আত্মা-চর্চায়। আত্মাকে ডাকলে তাকে পাওয়া যায়। শুধু ডাকার মতো ডাকতে জানা চাই।
মৃত গৌরীকে দেখতে চেয়ে সন্ন্যাসীর কাছেই শিখেছিলেন ‘মণ্ডল’। অর্থাৎ প্ল্যানচেটে আত্মাকে ডাকা।
যেখানেই গিয়েছেন, আমৃত্যু সেই সাধনা করেছেন। দরজা-জানলা বন্ধ করে, ধূপ-ধুনো জ্বালিয়ে ডেকেছেন গৌরীকে। কথা বলেছেন একা একা গভীর নিশীথে। কান্নায় প্রিয়তমার শোকে আকুল হয়েছেন।
সন্ন্যাসীর কাছ থেকে আত্মা-আবাহনের কৌশলটি রপ্ত করার পর কয়েক দিন তুমুল মেতেছিলেন তিনি। বিস্তৃত এই পরলোকচর্চার স্বাদ পেয়ে, নাম লিখিয়েছিলেন কলেজ স্কোয়ারের থিওসফিক্যাল সোসাইটিতেও। এক সময় যার সভাপতি ছিলেন প্যারীচাঁদ মিত্র। তিনিও স্ত্রীর মৃত্যুর পর মেতে উঠেছিলেন আত্মার সঙ্গে নিভৃত সংলাপে।
সোসাইটির সদস্য হয়ে বিভূতি যেন নতুন দিগন্তের সন্ধান পেলেন। জানা হল চক্রাধিবেশন। ধীরে ধীরে জানলেন, তাঁর কল্পলোকের দেবতা রবিঠাকুরও প্ল্যানচেট করেছেন। এও জানলেন, বিদ্যাসাগর যে দিন চলে যান, বৃন্দাবনের আকাশে তাঁর আত্মা দেখেছিলেন বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী! শুনলেন, স্বামী বিবেকানন্দকে কোনও আত্মা এসে তাঁর পিণ্ড দানের অনুরোধ করেন।
বিভূতির সেই সময়ের প্রিয় বন্ধু নীরদ সি চৌধুরী লিখেছেন, বিভূতিভূষণের পরলোকচর্চার মতিগতি।
নীরদ মনে করতেন, বিভূতির পরলোকে বিশ্বাস ঠিক ‘বিশ্বাস’ নয়, কুসংস্কার হয়ে উঠেছিল।
নিছক তাই কি?
পরলোক নিয়ে এত অগাধ পড়াশোনার পর সেও কি সম্ভব! কেন না, বিভূতি তো ঘোর বাস্তববাদী ছিলেন।
চর্চা এখানেই থেমে রইল না।
জাঙ্গিপাড়া দ্বারকানাথ হাইস্কুলে যখন পড়াতে গেলেন, তাঁকে ঘিরে কয়েকজন ঠিক জুটে গেল পরলোকচর্চায়।
অন্ধকার ঘরে টেবিল পেতে তাঁরা মোমবাতি জ্বালিয়ে বসলেনও।
বিভূতি এক একদিন ডেকে আনতেন পরলোক থেকে প্রিয়দের। কিন্তু এই প্রেতচর্চাই কাল হল তাঁর।
জাঙ্গিপাড়ার হাওয়ায় নানা কথা রটল।
স্কুলবাড়িতে মাস্টার প্রেত নামায়, কথাটা অভিভাবকরা ভালভাবে নিলেন না। ছাত্র কমতে লাগল। বিপদ বুঝে, স্কুল কমিটি বিভূতিকে স্কুল থেকে তাড়িয়ে দিল। তবু সরে আসেননি বিভূতি প্রেতচর্চা থেকে।
হরিনাভি-রাজপুরে যখন অ্যাংলো স্যানসক্রিট ইনস্টিটিউশনে পড়াতে গেলেন, সেখানেও অল্প বিস্তর জানাজানি হয় তাঁর পরলোকচর্চার খবর।
ক্রমশ পরলোক নিয়ে তাঁর বিশ্বাসও ঢুকে পড়ে লেখা গল্পে, উপন্যাসে। কখনও সখনও তা নিয়ে সচেতন হয়ে ছেঁটেও ফেলেছেন মূল লেখা থেকে সেই আধি-ভৌতিক প্রসঙ্গ। তবু শেষ রক্ষে হয়নি!
বিভূতিভূষণের দ্বিতীয় স্ত্রী কল্যাণীদেবীর বাবা ষোড়শীকান্ত তান্ত্রিক ছিলেন। দীক্ষাও নিয়েছিলেন এক ভৈরবীর কাছে। তাঁকে নিয়েই বিভূতি ‘তারানাথ তান্ত্রিক’ লিখেছিলেন।
জামাইয়ের পরলোক নিয়ে অতি উৎসাহে অবাকই হতেন ষোড়শীকান্ত। জীবনের শেষ পর্বে যখন ব্যারাকপুরে রয়েছেন দেখা মিলল এক ভৈরবীর। বিভূতি মেতেও উঠেছিলেন তাঁর সঙ্গে।
ভৈরবী শবসাধনা করতে এসেছে জেনে, বিভূতিও নিত্য যাতায়াত বাড়ায়। রেগে যেতেন কল্যাণী। তবু কী এক মায়ায় নাছোড় বিভূতিকে আগলে রাখতে পারতেন না! রাতভর সাধনায় মেতে থাকতেন স্ত্রী-সংসার ভুলে।
তাঁর দিনলিপির পাতায় পাতায় পরলোক নিয়ে বিশ্বাসের কথা রয়েছে। তারই সংশ্লেষ ‘দেবযান’ উপন্যাস।
মৃত্যুর পর আত্মার উপস্থিতি নিয়ে বিভূতির বিশ্বাস যেন প্লটের বাঁকে বাঁকে।
মৃত্যুর পর কোথায় থাকে আত্মা?
শবের কাছেই কি দাঁড়িয়ে থাকে?
কী ভাবে উড়ে যায়?
ফিরে আসে কি?
সব উত্তর যেন মিলে যায় যতীন চরিত্রটিকে নিয়ে এই লেখায়। তাঁর জীবনীকার কিশলয় ঠাকুর জানিয়েছিলেন, ‘‘যে সময় ‘দেবযান’ প্রকাশ হচ্ছে, তার বহু আগে থেকেই বনগাঁর বীরেশ্বর মুখোপাধ্যায় নামে এক ব্যক্তির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ান। তিনিও পুত্রশোকে কাতর ছিলেন। দুঃখ ভুলতে প্ল্যানচেটে ছেলের সঙ্গে কথা বলতেন। বীরেশ্বরবাবুর সংগ্রহে ছিল পরলোকচর্চার নানা বই। সে সব বইতে বিভূতি ডুবে থাকতেন। পাতায় পাতায় নিজের নোটও লিখে রাখতেন।’’
বিভূতিভূষণের পরলোকচর্চার বিষয়টি সে সময় লেখকদের অনেকেই খবর রাখতেন। বিভূতির জীবনকথা জানাচ্ছে, প্রমথনাথ বিশীর ছোট ভাই মারা গেলে, শোক-সন্তপ্ত গোটা পরিবার বিভূতির কাছে এসেছিল। বিভূতি শ্লেটে দাগ টেনে মৃত ব্যক্তির আত্মার গতিপথ দেখিয়েছিলেন। তাঁদের এও বুঝিয়েছিলেন, আত্মার জন্য শোক করতে নেই! তাতে আত্মার দহন বাড়ে!
দিন যত ফুরিয়ে এসেছে, পরলোকে বিশ্বাস যেন তত বেড়েছে বিভূতির।
ঘাটশিলার বসতবাড়ি
শেষবেলায় ছেলে তারাদাস অসুস্থ হয়ে পড়লে, একদিন স্নান সেরে ফিরে নাকি দেখেছিলেন, ছেলের মাথার কাছে বসে রয়েছে কেউ। বিভূতি বুকে জড়িয়ে নেন তারাদাসকে। বলেন, ‘‘ওকে দেব না।’’
সেই বিদেহী আগন্তুক তখন নাকি বলে ওঠে, ‘‘তোমার ছেলের আয়ু নেই। ওকে যেতে দাও আমার সঙ্গে।’’
বিভূতি সন্তানকে আঁকড়ে বলেন, ‘‘আমার আয়ু দিচ্ছি। তুমি চলে যাও।’’
শেষবার যখন ঘাটশিলা গেলেন, এক সংবর্ধনা সভায় বক্তব্য রাখতে গিয়ে নিজের মৃত্যুর ইঙ্গিত দিলেন যেন!
মনে করতেন, মানুষের সংবর্ধনা মানেই সময় ফুরিয়ে এসেছে। তার আগেই ‘শেষ লেখা’ গল্পে সেই দেবযান-এর সুর।
পরলোকে বিশ্বাসের শিকড় ক্রমশ এত গভীরে গাঁথা পড়েছিল, সর্বক্ষণ মরণের কথা ভেবে গিয়েছেন শেষের দিনগুলোয়।
বিভূতিভূষণের ভাই নুটুর স্ত্রী যমুনা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘উপল ব্যথিত গতি’-তে বিভূতির শেষ সময়ের একটি বিশেষ ঘটনার কথা মেলে।
যমুনা লিখেছেন, ঘাটশিলায় মৃত্যুর কয়েক দিন আগে ফুলডুংরি ঘুরতে গেলেন। সঙ্গে অনেকেই। দল থেকে আলাদা হয়ে একটি জায়গায় নাকি দেখেন ছেঁড়া কাপড়ের টুকরো ছড়িয়ে। খান কয়েক পাথর সাজানো। একটি শববাহী খাট ওল্টানো। আর একটি খাটিয়ায় মৃতদেহ ঢাকা দেওয়া। বনের মধ্যে, বিভূতিভূষণ গিয়ে টান মেরে ঢাকা সরিয়ে ফেলেন!
তার পরেই তাঁর আর্ত চিৎকার!
এ কার শরীর!
ধড়ের উপর যে মুখটি, সেটি অবিকল তাঁর!
http://www.anandabazar.com/supplementary/patrika/%E0%A6%AE-%E0%A6%A4-%E0%A6%B8-%E0%A6%A4-%E0%A6%B0-%E0%A6%B0-%E0%A6%86%E0%A6%A4-%E0%A6%AE-%E0%A6%B0-%E0%A6%B8%E0%A6%99-%E0%A6%97-%E0%A6%95%E0%A6%A5-%E0%A6%B9%E0%A6%A4-%E0%A6%AA-%E0%A6%B2-%E0%A6%AF-%E0%A6%A8%E0%A6%9A-%E0%A6%9F-1.250436
No comments:
Post a Comment