চিত্রণ: বিমল দাস
জাহাজের কেবিনে বসেই ‘পথের পাঁচালী’র খসড়া করলেন সত্যজিৎ রায়!
তখন মাঝসমুদ্রে।
সফেন ঢেউ কেটে কেটে এগিয়ে চলেছে জলযান।
পারি, ভেনিস, সলজবুর্গের সোনালি দিন। কার্জন সিনেমায় ‘আ নাইট অ্যাট দ্য অপেরা’, ‘বাইসাইকেল থিফ’ দেখার স্মৃতি। বৃষ্টির মধ্যে দুর্গার আত্মহারা নাচ। কুয়াশা ভোরে ইন্দির ঠাকরুনের শবযাত্রা। কাশবনে অপু-দুর্গার রেলগাড়ি দেখার মতো নিরুপম ফ্রেমে সেলুলয়েড নির্মাণের স্বপ্ন নিয়ে দেশে ফিরছেন সত্যজিৎ।
দেশে ফিরে তাঁর খেয়াল হল, পারম্পর্য বজায় রেখে স্কেচ হয়ে গিয়েছে, অথচ উপন্যাসের চিত্রস্বত্বই কেনা হয়নি!
সে সব নিয়ে কথা বলতে যাবেন, তার আগেই হঠাৎ চলে গেলেন খোদ পাঁচালি-কার, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়!
*****
ফেরালেন না বিভূতিভূষণের স্ত্রী রমা, অর্থাৎ কল্যাণীদেবী। জানালেন, ‘পথের পাঁচালী’র সংক্ষিপ্ত সংস্করণের জন্য মানিকের করা অলঙ্করণ তাঁর খুব ভাল লেগেছে।
এবার আশায় বুক বাঁধলেন সত্যজিৎ। ছুটলেন বিভূতিভূষণের শেষবেলার কর্মক্ষেত্র গোপালনগরে।
উদ্দেশ্য, ‘পথের পাঁচালী’র নিশ্চিন্দিপুরের পরীক্ষামূলক শট নেওয়া। ধার করা ক্যামেরায়, ষোলো মিলিমিটারেই ফ্রেমবন্দি হল অপুর ছেলেবেলার গাঁ-ঘর, পল্লি-প্রকৃতি।
সেই সব ফ্রেমের আবহে যেন তারসানাইয়ে বিভূতিভূষণের ব্যক্তিজীবন-এর সকরুণ সুর।
*****
বিভূতির তখন পাঠশালায় যাওয়ারও বয়স হয়নি। সকাল হলেই বাবা মহানন্দ বেরিয়ে পড়েন রুজির খোঁজে। কথকতা ফেরি করেন মেহেদি নকশার মতো মেঠোপথে গঞ্জে।
একদিন।
‘হরি দুঃখ দাও যে জনারে/ যার কপালে নাই সুখ...।’
‘‘কে যায়, কথকঠাকুর নাকি?’’
‘‘আজ্ঞে মহানন্দ।’’
‘‘আহা, কী সুর লাগিয়েছ ঠাকুর। পিলু?’’
‘‘আজ্ঞে, আড়াচৌতালে। ‘বিধাতা বৈমুখ/ দুঃখের উপর দুঃখ দাও যে তারে।’’’
‘‘তা হে তোমার নাটকের কত দূর?’’
‘‘শেষ হয়ে এল এই। নাম ঠিক করেছি ‘ভুবনমোহিনী’। আজ উঠি কত্তা, নিশিভোরে সুন্দরপুর, মাধবপুর ছাড়িয়ে সেই নিশ্চিন্দিপুর যেতে হয়েছিল। বিভুর জ্বর দেখে বেরিয়েছি।’’
গাঁয়ের পথে নেমে নীলকন্ঠের লেখা কথায় ফের সুর ছাড়লেন উন্মনা মহানন্দ।
‘হরি দুঃখ দাও যে জনারে।’
গলায় চাদর।
কোঁচা দুলিয়ে ছাতা হাতে ফিরছেন মহানন্দ।
গামছায় বাঁধা সের দুই আতপচাল। কাঁঠালি কলা। পান-সুপারি।
কবরেজ তারিণীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় নিজের এই সবেধন নীলমণি পুত্রটিকে কবিরাজিতে মতি করে দিয়ে যেতে পারেননি। মহানন্দ যে নিজেকে উদ্ধব শিরোমণির শিষ্য বলেন!
পদ্মবীজের মালা গলায় ঝুলিয়ে নিত্য সন্ধ্যারতির সময় গাঁ-ঘরে কথকতা না করলে তাঁর স্বস্তি হয় না। দাশু রায়, শ্রীধর কথক, নীলকন্ঠ— কত জনের ঢপ-টপ্পা গান যে তিনি জানেন! উলুরবে ভাসে সন্ধে।
হাঁটছেন মহানন্দ।
ক্লান্ত অবসন্ন পা যে আর চলে না। বাড়িতে লোক বলতে বিধবা দিদি মেনকা আর ছোটবউ মৃণালিনী।
কে জানে খোকা কেমন আছে!
খোকা? বিভূতি!
ছেলের জন্মদিনেই পয়ারে কুল পরিচয় লিখেছিলেন মহানন্দ।—
‘বিভূতিভূষণ নাম আমি বন্দ্যঘাঁটি।/খড়দহ মেলে থাকি কুলে বড় খাঁটি।।/সবাই সন্তান দুই ভঙ্গ সবে জানে।/সভায় বসিলে আগে দশে মোরে মানে।।/কুলীনের পরিচয় আর কত চাও।/মনে ধরে ভালো মেয়ে বিয়ে দিয়ে যাও।।’
*****
বিভূতির সব কেমন মনে পড়ে যায়!
গোটা বাল্যকাল জুড়ে যেন চুঁইয়ে চুঁইয়ে শীত-বসন্ত। ভালবাসার মাছপাখি। অশ্রুমোহর।
সত্যজিতের চিত্রনাট্যেও সেই দুখের বারমাস্যা—
‘‘রাত। ইন্দিরের দাওয়া। প্রদীপের আলোয় ইন্দির বাচ্চাদের গল্প বলে। দুর্গা পিসির কোলে মাথা রেখে শুয়ে, অপু দুর্গার গা ঘেঁষে।
ইন্দির: তখন একটা রাক্ষুসি এসে বলে কি... আমার মন্দিরে কে জাগে?
হরিহর বাড়ি ফেরে। তার গলা শোনা যায়।
হরিহর: দুর্গা, দুর্গা-দরজাটা খোল, মা...!’’
*****
জীবনের শেষবেলায় ইছামতীর ধারে এসে দাঁড়ালে, বিভূতির কানে যেন ভেসে আসে বাবা মহানন্দর পাঁচালির সুর।
স্মৃতির শামিয়ানা সরিয়ে বিভূতিভূষণ দেখতে পান, দারিদ্রে-কষ্টে দীর্ণ তাঁদের ভিটে-পরিবারকে। দুঃখ গোপন করতে করতে কখনও বাবার উপর রেগে যেতেন মা মৃণালিনী। অতগুলো পেটের খিদে মেটানো কি সহজ কথা!
সংসার নিয়ে মহানন্দ চলে গিয়েছিলেন ব্যারাকপুর ছেড়ে। হুগলির শা’গঞ্জ-কেওটায়। সেই বয়সেই বিভূতি হারিয়েছে তার ছোট ভাই ইন্দুভূষণকে। ইন্দুর মৃত্যুর পর বাবাকে সে কান্নায় ভেঙে পড়তে দেখেছে। তারপর থেকে বিভূতিই তাঁর বুকের ধন!
আবার ফিরতে হল ব্যারাকপুরেই। বোন জাফরি আর বাবা-মার সঙ্গে। সেই প্রসন্ন মোদকের কাঁঠালতলার পাঠশালা।
এখনও নদীর ওপার থেকে যেন সেই পাঠশালারই সুর শুনতে পান বিভূতিভূষণ।
সহপাঠী ইন্দু ব্যঙ্গ করছে তাকে—
‘‘তুই মাইনে দিবিনে বিভু?’’
ইন্দুর কথার ফেরে কে যেন বলে ওঠে—
‘‘উঁহু, ওর মাইনে নেই। দেখলিনে, হরিপোড়া হাত ঘুরিয়ে বোঝাল ফো-ক-কা!’’
সহপাঠীদের এমন প্রশ্ন, প্রতি-প্রশ্ন আর আঁকাবাঁকা কথায় কুঁকড়ে যেত স্বভাব-লাজুক সে। কেই-বা জানত বাল্যের এই দারিদ্রই তাঁকে বইতে হবে চিরজীবন!
দিন যত এগোয়, বয়স যত বাড়ে, দুঃখ যেন তত বিশ্বস্ত সঙ্গী হয়ে ওঠে তাঁর!
*****
দুঃখ ভুলতে একখানা বাঁশের কঞ্চি হাতে দিনমান টইটই করে ঘোরে ইস্কুল-পালানো বিভূতি। কখনও ইছামতীর পাড়ে। কখনও বনসিমতলার ঘাট। দেখে রোদ্দুরে পাকা ধান।
দিগম্বর পাড়ুইয়ের নৌকো বাওয়ার ছলাৎ ছলে তার মন। নৌকো-ভাসা ইছামতীর স্রোত বুঝি তাঁকে নিয়ত ডাকে।
শিখে নেয় নৌকো বাওয়া। বাবার কাছে গল্পে গল্পে জেনে নেয়, নীলকুঠির ইতিহাস।
ইউ পি স্কুলের পাঠ শেষ করে এও বুঝতে পারে, বাবার শরীর ভাঙছে। পড়াতে পারবেন না বলেই তিনি বিভুকে যজমানি করাতে চান।
চেয়ে-চিন্তে সংসার চলে তাঁদের। দুঃখ চেপে, বিভু বাড়ি ফিরে কুলুঙ্গিতে রাখা বাবার হাতে লেখা পশ্চিম ভ্রমণের ডায়েরিখানাই পড়ে।
কখনও বাবার লাল মলাটের ‘সঙ্গীতসার’ খাতা খুলে বসে। কত জনের কত পদ! কথার পর কথার গায়ে কত ছবি!
নিশুত রাতে স্বপ্নে তারও কানে সুদূর থেকে ভেসে আসে পথের ডাক! এই ডাকেই তো সে কোথাও বাঁধা পড়তে চায় না।
তাকে বাঁধতে পারেনি সুপ্রভা, রত্না, খুকু... কেউ, কেউ না! তাঁরা যে বিভূতি পদাবলী প্রেম-জীবনের ‘রাধা’।
*****
বনগাঁ হাই ইংলিশ স্কুল থেকে পাশ করে বিভূতি গেল মায়ের কাছে। সে কলকাতায় পড়তে চায়। মা মৃণালিনী নিষেধ করে বলে বসলেন, ‘গরিবের ঘরে এর চেয়ে বেশি পড়াশুনো হয় না খোকা। তুই চাকরি খুঁজে নে!’
মায়ের কথা শোনেনি বিভু।
ম্যাট্রিকের প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে পাস করে সে ভর্তি হল কলকাতার রিপন কলেজে। ঠাঁই হল, হিন্দু হস্টেলের কাছে ২৪/১ মদনমোহন সেন লেনের মেসবাড়ি।
কিন্তু টাকা দেবে কে?
মনে আছে, যেদিন বনগাঁর স্কুলে ভর্তি হতে গিয়েছিল, মা লক্ষ্মীর ঝাঁপি ভেঙে পয়সা দিয়েছিলেন। শেষ সম্বল মহানন্দর সিঁদুর পরানো টাকাটাও বিক্রির জন্য তুলে দিয়েছিলেন ছেলের হাতে!
আর আজ? এই কলেজবেলায়? সেই মা-র আশ্রয় এখন মামাবাড়ি। মুরাতিপুরে।
কলেজে মাইনে বাকি। মেসে বাকি। বন্ধুদের কাছে বাকি! মেসে খেতে বসলেই ম্যানেজার তাগাদা দেয়। গলা দিয়ে যেন ভাত নামে না বিভূতির।
একদিন দুপুরবেলা। রুমমেটের পরামর্শে দু’জনে জানলা গলে পালাতে গিয়ে ধরা পড়ে গেল! মহল্লা জুড়ে চিৎকার, ‘চোর, চোর’! চুরির অপবাদে অপমানে নুয়ে পড়ল বিভু।
এই দুঃখ, দহিত জীবন নিয়ে ইন্টারমিডিয়েটে প্রথম বিভাগে পাশ করে বিএ ক্লাসে ভর্তি হল। আবার সেই এক চিন্তা! অর্থের জোগান।
এ বার সহায় হলেন প্রফুল্লচন্দ্র রায়। আশার আলো দেখলেন মহানন্দ-সন্তান।
বিভূতিভূষণের নতুন ঠিকানাও হল, ৮/১ স্বর্ণময়ী রোড। এও এক মেসবাড়ি।
*****
প্রিয় ইছামতীর ঘাটে বসে জলের দিকে চেয়ে আছেন বিভূতি। এই পড়ন্তবেলায় আজকাল কিচ্ছু ভাল লাগে না তাঁর। নীলকুঠির মাঠে শুয়েই কাটিয়ে দেন সারা দিনমান। আনমনে ছেলেবেলার অভ্যাসে দাঁতে কাটেন ঘাসপাতা। আর ভাট ফুলে চোখ রেখে ফিরে ফিরে যান শৈশবে, যৌবনে।
বিভূতির তখন তেইশ।
বিয়ে হয়ে গেল পানিতরের মোক্তার কালীভূষণ মুখোপাধ্যায়ের মেয়ের সঙ্গে। পাত্রী সবে চোদ্দো।
কী নাম?
বিভূতিভূষণের জীবনীকার কিশলয় ঠাকুরের লেখা পড়তে পড়তে চুপি চুপি কান পাতি। বিভূতির বিয়ের বাসরে। স্বামী-স্ত্রীর সলাজ সংলাপ।
‘‘তোমার নাম কী?’’
‘‘বারে, আপনি বুঝি শোনেনি!’’
‘‘তবু তোমার মুখ থেকে শুনব বলো।’’
‘‘কুমারী গৌরীরানী মুখোপাধ্যায়।... কী যেন আমি ভুল বলেছি— তাই না?’’
‘‘হাঁ, আজ থেকে আর তুমি মুখোপাধ্যায় নও, বন্দ্যোপাধ্যায় হলে।’’
‘‘ইশ...! আর ভুল হবে না। বলছি— কুমারী গৌরীরানী—’’
‘‘উঁ হু হু। বরের জোর হাসি। ... আর কুমারীও নও তুমি!’’
(বাঁ দিক থেকে) পটনায় প্রভাতী সংঘের অনুষ্ঠানে পরিমল গোস্বামী, বিভূতিভূষণ, বনফুল, সজনীকান্ত ও অন্যরা
সুখের নাগরদোলায় ছুটি ফুরোয় বিভূতির। ফিরতে হবে কলকাতায়।
ফিরল, কিন্তু মন পড়ে রইল ব্যারাকপুরে।
বিয়ের পর গৌরীকে মায়ের কাছেই রেখে এসেছে যে!
ছুটি-ছাটায় বাড়ি এলে বালিকা বউ বায়না ধরে। পুজোর ছুটিতে বাড়ি এসে বিভূতি মাকে লুকিয়ে বউকে শাড়িও উপহার দিল। দুটিতে সারারাত কথা বলে। রাত ফুরিয়ে ইছামতীর উপর আকাশ ফরসা হয়। তখনও কথা ফুরোয় না বিভূতি-গৌরীর!
সে-সুখও সইল না কপালে!
পুজোয় বাপের বাড়ি গিয়ে বরের দেওয়া শাড়ি দেখাতেই মুখ পুড়ল গৌরীর!
তার দোষ? বিভূতির দেওয়া শাড়ির পাড়ের রং কালো! ও যে বিধবার সাজ!
লজ্জায়, অপমানে স্বামীকে চিঠি লিখলেন গৌরী নিতে আসার জন্য। বিভূতি এলেন। কিন্তু কালীভূষণ মেয়েকে পাঠালেন না। ব্যারাকপুরে মায়ের কাছে একলা ফিরলেন বিভূতি।
তার কিছু দিন পর, পানিতর থেকে দুঃসংবাদ।
বিভূতির শাশুড়ির শরীর খারাপ।
ছুটলেন জামাই। পানিতরে। শ্বশুরঘরের কাছে এসেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল বিভূতি!
কিশলয় ঠাকুর লিখছেন—
‘‘একটা মর্মভাঙা চিৎকারে থমকে দাঁড়ালো বিভূতিভূষণ। বড় শ্যালক ভবানীপ্রসাদ আস্তে আস্তে কাছে এগিয়ে এলো। সারা মুখে যেন কে কালি ঢেলে দিয়েছে। চোখ দুটো জবা ফুলের মতো লাল। বিভূতিভূষণের হাত দুটো চেপে ধরে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলো, বড় দেরি করে এলে ভাই! ভিড় সরে গেল। বিভূতিভূষণ চেয়ে দেখল, পাশাপাশি দুটি দেহ— প্রাণহীণ, নিস্পন্দ, নির্বাপিত। মা আর মেয়ে। বিভূতিভূষণের শাশুড়ি কামিনীদেবী আর... আর গৌরী!’’
গৌরীর পরনে ছিল বিভূতির দেওয়া সেই কালো পেড়ে নতুন শাড়িটি!
*****
গৌরীও চলে গেল!
পিছু পিছু গেল বোন মণি। তার পর মা! শোকে আর স্মৃতির এলো ঝড়ে মাঝে মাঝে দুঃসহ লাগে নিজেকে।
নদীর ধারে এক সময় দিন গড়িয়ে বিকেল নামে। সব ছারখার। বিবর্ণ বাতাস।
বিকেলে ইছামতীর জলে ছায়ারা দীর্ঘ হয়।
কার কথা ভাবছেন বিভূতিভূষণ?
গৌরী?
গৌরীকে দেখতে চেয়ে তো সে থিয়োসফিক্যাল সোসাইটির সদস্য হয়ে আত্মা-নামানোতেও মেতেছিলেন। তবু শান্তি মিলল কই! শান্তি আর কোথায়!
সারাক্ষণ বুক পকেটে গৌরীর শেষ চিঠি দুটো রাখা। সঙ্গে বনফুলের পাপড়ি।
কখনও সারারাত জেগে গৌরীর অপেক্ষায় ধূপ জ্বালিয়ে রাখেন।
গৌরী কি আসে?
সন্ধে রাতে ইছামতীর সর্বস্বান্ত করা হাওয়ায় কি থাকে, কেউ কী জানে?
শিরশির করে বিভূতির শরীর।
অদূরে শরবনে হাওয়ার মাতনে শিরশিরানি যেন বাড়ে তাঁর বুকের গহনে।
*****
চিৎ হয়ে আকাশের দিকে মুখ করে শুয়ে থাকেন বিভূতিভূষণ। অনন্ত নক্ষত্রবীথির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তাঁর মনে পড়ে হরিনাভি-রাজপুরের কথা।
বন্ধুর স্ত্রী নিভা। তার মেয়ে ফুলির কথা।
কলকাতায় মেসে বেকারির জ্বালায় যখন আঁতিপাতি করে ‘কর্মখালি’ দেখছে, সেই আচার্য রায়ই এগিয়ে এসেছিলেন। সুপারিশ লিখে হরিনাভি পাঠিয়েছিলেন পঞ্চাশ টাকার শিক্ষকতায়। সে চাকরিও করতে পারেননি বিভূতি।
পরকীয়ার অপবাদে মাথা নিচু করে ফিরতে হয়েছে তাঁকে। তার অপরাধ, বন্ধুপত্নী নিভাননীকে নিয়ে গল্প লিখেছেন তিনি। প্রবাসী পত্রিকায় সে-গল্প ‘উপেক্ষিতা’ প্রকাশের পরই তাঁকে নিয়ে গুঞ্জন, হরিনাভিতে।
পরের গল্প ‘উমারানী’। সে-গল্প বন্ধুর মেয়ে ফুলিকে নিয়ে!
আড়াল-আবডালে নয়। প্রকাশ্যে লোকে বলেছে, ‘কে উমারানী? আবার কাকে নিয়ে গল্প ফেঁদেছে মাস্টার? কে আবার? প্রথম গল্প মাকে নিয়ে, এবার মেয়েকে নিয়ে নিশ্চয়!’
নদীর বাতাসে যেন প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে ফিরে আসে কথাগুলো!
নিজের অজান্তেই কানে হাত দেন বিভূতি।
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দুঃসহ স্মৃতির পাতাগুলো নদীর হাওয়ায় উজানে ঠেলতে ঠেলতে কখন জানি ঘুমিয়ে পড়েন বিভূতিভূষণ।
*****
৪১, মির্জাপুর স্ট্রিট। মেস বাড়ি।
ঘরে ঢুকে মেস-বন্ধু নীরদচন্দ্র চৌধুরী দেখলেন অঘোর ঘুমে বিভূতি।
‘‘বিভূতিবাবু... ও বিভূতিবাবু? বলি শুনছেন, উঠুন!’’
‘‘কে! ও নীরদ! কখন ফিরলেন। ক’দিন স্নান-খাওয়া নেই। চোখটা একটু লেগে গিয়েছিল! আসলে বনগাঁ থেকে ফিরে ...’’
‘‘আরে উঠুন উঠুন মশাই, দেশ-ঘরের কথা পরে হবে। আগে স্নান করে চাট্টি খেয়ে নিন। ঠাকুরের রান্নাও সারা। বেলা করলে কলতলায় লাইন পড়বে কিন্তু।’’
‘‘সত্যি, আপনার কাছে আমার ঋণের শেষ নেই। জানি না, এ জীবনে শোধ করে যেতে পারব কিনা!’’
‘‘‘প্রবাসী’-তে ‘উপেক্ষিতা’ আর ‘উমারানী’-র খাওয়াই তো বাকি। চলুন মেসবাড়ি ছেড়ে কাছেপিঠে কোথাও ঘুরে আসি। ঘোরাও হবে, খাওয়া-দাওয়া হবে। দেখবেন মনটাও একটু ভাল হয়েছে আপনার। তা নতুন লেখায় হাত দিলেন নাকি? শোনাবেন কিন্তু।’’
‘‘নীরদ, আর যে ভাই পেরে উঠছিনে। কিছু একটা না জোটাতে পারলে না-খেয়ে মরতে হবে।’’
*****
বিভূতির কাজ একটা হল বটে, তবে সেটা কাউ-প্রোটেকশন লিগে!
কেশোরামের গো-রক্ষিণী সভার প্রচারক। ছ’মাসের জন্য। দেশজুড়ে। ভ্রাম্যমাণ সেই প্রচারে পথে নামলেন ‘পথের পাঁচালী’-র বিভূতিভূষণ। মাসিক বেতন ৫০ টাকা।
কোথায় না গিয়েছেন— ফরিদপুর, বরিশাল, কক্সবাজার, চাটগাঁ, মংডু। টেবিল পেতে গো-ধন রক্ষার সপক্ষে যুক্তি দিয়েছেন। ছ’মাসে ‘অভিযাত্রিক’-এর রসদে দিনলিপি যেন পূর্ণ হল।
মেয়াদ ফুরিয়ে সেই মির্জাপুর স্ট্রিটের চার দেওয়ালের মেসে ফিরলেন বিভূতি।
প্রকাশিত হল আরও একটি গল্প ‘মৌরীফুল’। ‘প্রবাসী’ পুরস্কার দিল লেখককে। নগদ ২৫ টাকা। কিন্তু ওতে আর কত দিন চলে!
আবার সেই বেকারির জ্বালা!
ভেবে ভেবে দিন যায়। মেসবাড়ি দুপুরবেলা নিরিবিলি হলে, বিভূতি কাগজ-কলম নিয়ে বসেন। শত ঝরনায় নিজেকে সমর্পণ করেন।
*****
নীলের উপর সাদা ডোরাকাটা প্রিয় পার্কার পেনটিতে কতক্ষণ লিখছেন, নিজেই জানেন না।
ভাগলপুর। ইসমাইলপুরের কাছারিবাড়ি।
জঙ্গলের ভিতর খড়ের ছাউনি। মাটির দেওয়াল। বাইরে বেশ ঠান্ডা।
ঘোরের মধ্যেই লিখে চলেছেন বিভূতিভূষণ।
কাজ খুঁজতে খুঁজতে অমৃতবাজার-এ বিজ্ঞাপন দেখে গিয়েছিলেন পাথুরেঘাটায়। জমিদার খেলাতচন্দ্র ঘোষের নাতি সিদ্ধেশ্বরবাবুর ভাগ্নেকে টিউশন পড়াতে।
দায়িত্বজ্ঞান দেখে সিদ্ধেশ্বর ঘোষ তাঁকে জমিদারির কাজে পাঠালেন। যখন ভাগলপুর এলেন, তখন এদিকে সবে শীত পড়ছে। আর এখন হাড় কাঁপানো হিম।
কিন্তু তাঁর কাজ তো শহরের পাকাবাড়িতে নয়। তাঁর মহাল, ‘উত্তরে আজমবাদ থেকে দক্ষিণে কিষেণপুর, পুবে ফুলকিয়া-লবটুলিয়া-নাঢ়া বইহার আর পশ্চিমে মুঙ্গের জেলার সীমান্ত পর্যন্ত।’
এরই মধ্যে ক’দিন ঘুরে গেল বোন জাফরি। মাঝে মধ্যে ছোটভাই নুটুও আসে।
একদিন ভাগলপুরে আলাপ জমল সাহিত্য-সাধক উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে। তাঁর বাড়িটি শরৎ-স্মৃতির জুঁই গন্ধে মাখা। নিয়মিত সাহিত্যের আড্ডাও বসে। জুড়ে গেলেন বিভূতি।
সাহিত্যের আড্ডার সঙ্গে সঙ্গে জঙ্গল আবাদ, জমির বিলি বন্দোবস্ত, তহসিল-তহবিলে দিন যায়। ঘোড়া ছুটিয়ে চাঁদনি রাতে আদিগন্ত বনভূমিতে ঘোরেন বিভূতিভূষণ।
সরস্বতীকুণ্ডের জলে তেমন মায়া-রাতে একা একা স্নানরতা হুরি-পরি দেখতেও চলে যান।
যত দেখছেন অরণ্যের দিনরাত্রি, দিনলিপির পাতা যেন তত ভরে উঠছে কথার ভারে। মাঝে মাঝে বনগাঁর জন্য বেদনায় ভরে ওঠে মন। কেমন আছে ইছামতী, বনশিমতলা, নীলকুঠির মাঠ? দূর থেকে নাকে এসে লাগে স্মৃতির-ঘ্রাণ। বনপথে ছাতিম ফুলের গন্ধে জাগে ছায়ানিবিড় ভিটে-ঘরের স্মৃতি। কানে বাজে প্রিয়জনের সংলাপ!—
‘‘ও মা… মা?’’
স্মৃতির ভিতর দরজা খুলে যায়।
‘‘কে? বিভূতি?’’
মৃণালিনী দুয়ার খুলে দাঁড়ান। পাশে বোন মণি, জাফরি, ভাই নুটু। মহানন্দ কাশতে কাশতে দাওয়া থেকে নামছেন, ‘‘খোকা এলি? ছোটবউ খোকা? ও কার সঙ্গে কথা বলো...!’’
*****
স্মৃতির দেরাজ থেকে কলমটি নিয়ে লিখে চলেন বিভূতি।
আজ কী লিখছেন তিনি?
দিন কয়েক আগে লেখা, ১৯২৫-এর ৩ এপ্রিলের পাতায় বিভূতির সংকল্প। ডায়েরির পাতা উল্টে পড়ে নিই।
‘‘বাবার পশ্চিম ভ্রমণের ডায়েরিটা ঠাকুরের পিঁড়িতে রেখে ফুলচন্দন মাখালেম। তিনি কি জানতেন তাঁর মৃত্যুর প্রায় পনের বছর পর প্রথম যৌবনে তাঁর ছেঁড়া-খোঁড়া লেখা খাতাখানি বিহারের এক নির্জন কাশবনের চরের মধ্যে ফুলচন্দনে অর্চিত হবে?’’
এ যেন আশীর্বাদ নেওয়া। আর তারপরই পথের পাঁচালি লেখার সংকল্প!
কেমন সে লেখা?
বিভূতি লিখছেন, ‘হরিহরের পূর্বের ভিটায় খড়ের ঘরখানা অনেকদিন বে-মেরামতি অবস্থায় পড়িয়া আছে। এই ঘরটাতেই বুড়ী থাকে।’
কয়েক পাতা লিখেই কলকাতা চলে এলেন মির্জাপুর স্ট্রিটে। পরম বন্ধু নীরদ জড়িয়ে ধরলেন বিভূতিকে। বললেন, ‘‘চালিয়ে যান বিভূতিবাবু, অসাধারণ হবে।’’
রমাদেবী ও ছোট্ট তারাদাসের সঙ্গে
‘আরণ্যক’ মহালে ফিরে, ভাগলপুর শহরেই সদর কাছারিতে থাকতে শুরু করলেন। নাগাড়ে লিখে চলেন। সারা টেবিল লেখাপাতায় ঢেকে যায়। জানলার পাশে নিম গাছের হাওয়ায় কখনও সখনও সব কেমন এলোমেলো হয়ে যায়। বিভূতি লিখতে লিখতে দোতলার জানলা দিয়ে অদূরে বয়ে চলা গঙ্গার দিকে তাকিয়ে তাঁর ইছামতীর কথা ভাবেন।
মহালের কাজে বার হলেও লেখা থামে না। আজমবাদ কাছারিতে লিখছেন তো, কখনও প্রান্তরের মাঝে। টিলার গায়ে বনফুলের ঝোপের ধারে বসে লিখছেন। একদিন উপেনবাবুরা জোর করে লেখা শুনতে চাইলেন। লেখা শুনে প্রশংসা ছড়াল। সকলেই আরও শুনতে চায় বাকি অংশ!
তখনও উপন্যাসে অপু আছে। নিশ্চিন্দিপুর আছে। মা-বাবা-পিসিমা, প্রসন্ন মাস্টার আছে। মহানন্দও আছেন। কেবল দুর্গা নেই!
হঠাৎ ভাগলপুরে একটি মেয়েকে দেখে উদাস হলেন বিভূতি। মেয়েটির উড়ো চুলে যেন ইছামতীর উজান-হাওয়া।
নতুন করে লিখলেন ‘পথের পাঁচালী’। অপু তার দিদিকে পেল। জন্ম হল দুর্গার!
শেষ হল একদিন অপুর পাঁচালি। পনেরো কিস্তিতে ছাপাও হয়ে গেল, উপেনবাবুর ‘বিচিত্রা’ পত্রিকায়। প্রথম যে সংখ্যাটিতে ছাপা শুরু হল, সে সংখ্যায় ছিল রবীন্দ্রনাথেরও ধারাবাহিক উপন্যাস। ‘যোগাযোগ’। ছিল তাঁর কবিতাও। ‘সুসময়’। রম্যরচনা ‘তেল আর আলো’। আর ‘ভানুসিংহের পত্রাবলী’।
এত শতর ভিড়েও রীতিমতো শোরগোল পড়ে গেল বাংলা সাহিত্যের বাজারে। ‘পথের পাঁচালী’ নিয়ে।
সুখ্যাতি আর যশের মুখ দেখলেন বিভূতিভূষণ।
*****
কিন্তু বিধি বাম!
ছাপা তো হল, বই ছাপবে কে? বিভূতি যখন মেসবাড়িতে থেকে কলকাতার এক প্রকাশক থেকে অন্য প্রকাশকের দরজায় দরজায় পথের পাঁচালীর পাণ্ডুলিপি নিয়ে ঘুরছেন, শুনতে হচ্ছে, ‘গাঁটের কড়ি খরচ করে কে আর পাঁচালী-ফাঁচালি ছাপতে যায় বলুন?’ কোনও প্রকাশক বলছেন, ‘না মশাই, প্রেম নেই, খুন নেই, কেচ্ছা নেই—ও বই চলবে না’!
পথ দেখালেন সেই নীরদ সি চৌধুরী।
কিশলয় ঠাকুর লিখেছেন, ‘‘একানব্বুই নম্বর সারকুলার রোডের প্রবাসী-র আড্ডায় এসে ক্ষোভে ভেঙে পড়লেন নীরদ। সব শুনে সজনীকান্ত দাস বললেন, দাঁড়াও, পড়ে দেখি।... গভীর রাত পর্যন্ত একটানা পড়ে চললেন। সে পড়ার অভিজ্ঞতা তিনি আত্মস্মৃতিতে এভাবে লিখেছেন, ‘বেশ বুঝিতে পারিলাম রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্রের বাঙলা সাহিত্যে অভিনবের আবির্ভাব হইয়াছে।... উত্তেজনায় শেষ রাত্রিটা প্রায় বিনিদ্র কাটিল।’
*****
রাতারাতি খোলা হল সজনীর প্রকাশন সংস্থা রঞ্জন! চুক্তি হল লেখক আর প্রকাশকের মধ্যে। সাক্ষী, নীরদ চৌধুরী, গোপাল হালদার। সাহিত্যের আড্ডায় হল দরাদরিও।
সজনী তিনশো দেবেন।
বিভূতি পথের পাঁচালী-র দর দেন, আরও পঁচিশ! সজনী তাতেই রাজি।
অগ্রিম, নগদ পঁচিশ!
বাবাকে উৎসর্গ করা বই যেদিন হাতে পেলেন, বুকে চেপে সজনীকান্তর সামনে দাঁড়িয়ে রইলেন চোখ বন্ধ করে।
১৯২৯, অক্টোবরের ২ তারিখ সেই রাতের দিনলিপিতে বিভূতি লিখছেন, ‘‘আজ মহালয়া, পিতৃতর্পণের দিন। তিল তুলসীতে আমি বিশ্বাস করিনে। বাবার অসম্পূর্ণ কাজ আমি যদি শেষ করতে পেরে থাকি, তার চেয়ে সত্যতর কোন তর্পনের খবর আমার জানা নেই।’’
একে একে প্রকাশিত হল ‘অপরাজিত’, ১০টি গল্পের সংকলন ‘মেঘমল্লার’। ক্রমশ পত্র-পত্রিকায় নানা আলোড়ন।
প্রশংসা করলেন বিভূতির স্বপ্নের মানুষ রবিঠাকুরও!
জুটল সংবর্ধনা!
*****
বিভূতির সাজের বহর দেখে মুখ চিপে হাসেন নীরদ আর তাঁর স্ত্রী অমিয়া। সাজ কী আর এমনি?
বেথুন কলেজের মেয়েরা সংবর্ধনা দিতে চায় বিভূতিকে!
সলাজ বিভূতি গেলেন। আলাপ হল অমিয়ার বান্ধবী, শিলংয়ের মেয়ে সুপ্রভার সঙ্গে। তার আগেই অবশ্য ‘পথের পাঁচালী’ পড়ে মুগ্ধ পাঠিকার চিঠি এসেছে শিলং পাহাড় থেকে!
রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষার পর এবার চোখেচোখ রাখা! দু’জনে হাঁটছেন, আঙুলে আঙুল জড়িয়ে কলকাতার নির্জন লেন-বাইলেনে।
বোটানিক্যাল গার্ডেনের গঙ্গা ফড়িং দুপুরে পথের কবি কবিতা লেখাও শেখাচ্ছেন পাহাড়ী মেয়ে সুপ্রভাকে। সরছে দ্বিধা, ভয়।
একটু পরেই হয়তো ওঁদের দেখা যাবে সভা-সমিতি-সিনেমা হলে। দু’জন পাশাপাশি।
একে অপরের কানে কানে ফিসফিসিয়ে কথাও বলছেন।
গোপন-গহন কী কথা?
শুনি তেমন একদিনের কথা।
চিত্রা হলে ‘মুক্তি’ ছবি দেখছেন দু’জন।
এক সময় সুপ্রভা তাঁর নরম হাত রাখল বিভূতির হাতের মধ্যে! বিভূতি একটু অপ্রস্তুত। একটু পরে দেখল, তার হাতে একটি রুমাল।
সুপ্রভা নিজের হাতে কাজ করে উপহার দিল। এ সম্পর্কের রেশ সারা জীবন বয়ে বেড়িয়েছেন বিভূতি। পাগলের মতো বার বার সুপ্রভাকে দেখতে ছুটে গিয়েছেন শিলংয়ে। একা একা অপেক্ষা করেছেন পাইনের ছায়ায় বসে। সুপ্রভার গান তাঁকে বার বার ঘুমের মধ্যে জাগিয়ে রেখেছে। অথচ, সেই সুপ্রভার সঙ্গে যখন নীরদ-অমিয়া বাঁধতে চেয়েছেন তাঁকে, বিভূতি বলেছেন, ‘আমি মুক্ত পথিক’।
সুপ্রভার বিয়ে হয়ে গিয়েছিল অন্যখানে।
*****
কলকাতা ছেড়ে সে বার বেশ কিছু দিন ব্যারাকপুরে রয়েছেন বিভূতিভূষণ। বয়স চল্লিশ ছুঁই ছুঁই।
ইতিমধ্যে ‘অপরাজিত’-র প্রথম খণ্ড বেরিয়েছে। দেখা হয়ে গেল কিশোরী খুকুর সঙ্গে। খুকু স্কুলবেলার গণিতের শিক্ষক যুগলমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের মেয়ে।
দিন নেই, দুপুর নেই দুটিতে মশগুল পড়া পড়া খেলায়। খুকুর চুল, জামার গন্ধে ভুর ভুর বিভূতির বিকেল।
কত প্রশ্ন খুকুর! বিভূতি রাগে না। বার বার পড়া-লেখায় ভুল করে খুকু। বিভূতির ক্লান্তি নেই, শুধরে দেন। হাত ধরাধরি করে কুঠির মাঠে গিয়ে দাঁড়ায় দু’জন। না দেখে থাকতে পেরে এক জন ছাদে, তো অন্য জন পাশের মাঠে। গোল হলুদ থালার মতো চাঁদের রাতে ইছামতীর জল কেটে কেটে ডুবসাঁতার! বিভূতিকে লেখা সুপ্রভার চিঠি দেখে খুকুর রাগ হয়! রাগ ভাঙাতে উপহার দিলেন ‘চাঁদের পাহাড়’।
খুকু কলকাতা দেখতে চায়। নিয়ে এলেন বিভূতি। উঠলেন নীরদ-অমিয়ার কাছেই। দু’দিন কলকাতার হাওয়ায় খুব উড়লেন দুটিতে!
তেতে উঠল ব্যারাকপুর। সরগরম গালগল্প, রঙ্গব্যঙ্গ বিভূতি-খুকুকে নিয়ে!
অন্যত্র খুকুর বিয়ে ঠিক করলেন যুগলমোহন। আর খুকুকে লুকিয়ে সে-বিয়ের টাকার জোগান দিলেন বিভূতি।
*****
বিভূতিভূষণের জীবনে শুরু হল নতুন অধ্যায়। সেটা ১৯৩৯। বোন জাফরির মৃত্যুর পর ভাগ্নে-ভাগ্নিকে নিজের কাছে এনে রেখেছেন। সেই শোকের আবহেই পড়শি মেয়ে কল্যাণীর সঙ্গে পরিচয়। ঘনিষ্ঠতা গড়াতে নিজের বয়সের কথা ভেবে ভয় পেলেন।
এ এক আশ্চর্য দোটানা বিভূতিভূষণের! পথের নেশায় ঘোরেন, অর্থ চিন্তায় জর্জরিত, অথচ সেই মানুষ তিরিশের দশকেই ঘাটশিলায় বাড়ি কিনলেন গৌরীর স্মৃতিতে। কৃপণের মতো দিনযাপন করেন। কারও বাড়ি গেলে ছেঁড়া জুতো বাইরে লুকিয়ে রাখেন। আবার প্রকাশকদের কাছে হুটহাট হাজির হন কঞ্চি হাতে টাকা চেয়ে। বেশি টাকা হাতে পেলে ফিরিয়েও দেন!— ‘‘এত টাকা আমার কী হবে।’’
আশ্চর্য বৈপরীত্য!
অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান গণিকা দেখার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকেন! নিত্য নতুন প্রেমেও পড়েন। মেয়েদের কাছ থেকে প্রেমপত্র পেলে খুশি হন। অথচ বিয়ের কথা বললে, পালিয়ে যান ‘অপরাজিত’র লেখক!
পালাতে পারলেন না কেবল কল্যাণীর কাছ থেকে। চেয়েছিলেন পালাতে, কিন্তু কল্যাণী সব ভয়-ভাবনা উড়িয়ে জয় করে নিলেন বিভূতিকে।
কল্যাণীর প্রেমে রীতিমতো মজেছিলেন বিভূতি। প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর তেইশ বছর পর দ্বিতীয় স্ত্রী কল্যাণীকে জন্মদিনে উপহার দিলেন ‘সাবানদানি’! আর একবার?
দিলেন ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’।
ফি সপ্তাহে বনগাঁর শ্বশুরঘর এলেও, নিত্য চলত চিঠির লেনদেন। একবার তেমন এক চিঠিতে কল্যাণীর দাবি, ছবি চাই! অগত্যা বিভূতি ছুটলেন পরিমল গোস্বামীর কাছে।
‘‘বেশ একটা ছবি তুলে দাও তো।’’
‘‘আহা! সে না হয় হল, কিন্তু ছবি নিয়ে কী করবেন?’’
‘‘উপহার!’’
‘‘কাকে!’’
‘‘সে একজন আছে। তরুণী।’’
বুড়ো বয়েসে তরুণীর জন্য ছবি তোলাচ্ছেন বিভূতিভূষণ! শুনে থ’ পরিমল গোস্বামী। দাড়ি কেটে সাফসুতরো হয়ে ক্যামেরার সামনে এলেন ‘আরণ্যক’-সাহিত্যিক!
এক প্রৌঢ় আর তরুণীর প্রেম নিয়ে কত যে হাসি-ঠাট্টা উড়ল পথের হাওয়ায়!
*****
সেই বনশিমতলা, নীলকুঠির মাঠ, দাড়িঘাটার পুল, বকুলতলা... কিচ্ছুটি বদলায়নি।
শেষ বেলায় ব্যারাকপুরে কল্যাণীকে নিয়ে বিভূতিভূষণ নতুন করে ঘর পাতলেন। হাত ধরে চিনিয়ে দিলেন ছেলেবেলার গাঁ-ঘর। অপুর সংসার। পড়াতে শুরু করলেন গোপালনগরে হরিপদ ইনস্টিটিউশনে। পর পর সন্তান হারিয়ে তখন দিশেহারা, জন্ম হল তারাদাসের। সে সময়ের দিনলিপির পাতার পর পাতা শুধু বাবলুর কথা।
বেলা যত পড়ে এসেছে, শুধুই লিখেছেন। ‘মিসমিদের কবচ’, ‘অনুবর্তন’, ‘হীরামানিক জ্বলে’, ‘অশনি সংকেত’, ‘ইছামতী’।
একে একে প্রকাশিত হল, দিনলিপি ‘তৃণাঙ্কুর’, গল্প সংকলন ‘নবাগত’, ‘তালনবমী’, ‘উৎকর্ণ’।
এক প্রকাশক তাঁর জন্মদিনে উপহার দিলেন নতুন উপন্যাসের জন্য বাঁধানো লাল খাতা। তাতে লেখা ‘কাজল’!
‘অপরাজিত’-র শেষ খণ্ড ‘কাজল’-এর প্লটও ভেবেছিলেন। কিন্তু ফেরা হল না ঘাটশিলার গৌরীকুঞ্জ থেকে আর!
*****
বিভূতি পাশ ফিরে উদাস চোখে চেয়ে থাকেন দূরে। পড়ন্ত বিকেলের ইছামতীর চরের দিকে। দেখেন, দিগম্বর পাড়ুই যেন ওপার থেকে তাঁকে নিতে নৌকো নিয়ে ফিরছে। এক নদী-নৌকো।
সইমাদের বাড়ির পথ থেকে কুড়িয়ে আনা বকুল ফুলগুলো তিনি আলতো হাতে ছড়িয়ে দেন। মনে পড়ে গৌরী, সুপ্রভা, খুকুর কথা।
সারা জীবনজুড়ে পথের কত স্মৃতি আজ! অদূরে ভিটে।
সন্ধে নামার একটু আগে বিভূতি যেন দেখেন, জনশূন্য বাড়িখানার কবেকার নিকোনো উঠোন। একটা কুকুর গোল হয়ে শুয়ে রয়েছে। ভাঙা ইটের গাদার ওপর দিয়ে একটা বাস্তু সাপ! চৌকাঠ পেরিয়ে সাপটা ঘরে ঢুকল!
একা, কার্তিকের সন্ধের অন্ধকারে কুঁকড়ে যান। বিভূতির মনে হয়, গরুর গাড়ি করে তাঁর বাবা মাকে নিয়ে কোথায় যেন চলল!
মা কি কাঁদছে...
আঁচল দিকে মুখ ঢাকছে কেন...
মায়ের পাশে বসে, কে ও! …অপু!
http://www.anandabazar.com/supplementary/patrika/%E0%A6%85%E0%A6%AA%E0%A6%B0-%E0%A6%9C-%E0%A6%A4-1.250453