Sunday, 31 July 2016

অপরাজিত ( On Bibhutibhushan)

$image.name

অপরাজিত

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। শুধু সাহিত্য নয়, তাঁর নারীপ্রেম। প্রেতচর্চা। চূড়ান্ত অর্থাভাব। মৃত্যুমাসে ইছামতীর ধারে, কলকাতার মেসে, ভাগলপুরে তাঁকে খুঁজলেন আবীর মুখোপাধ্যায়

২৮ নভেম্বর, ২০১৫, ০০:০৩:০০
1

চিত্রণ: বিমল দাস

জাহাজের কেবিনে বসেই ‘পথের পাঁচালী’র খসড়া করলেন সত্যজিৎ রায়!
তখন মাঝসমুদ্রে।
সফেন ঢেউ কেটে কেটে এগিয়ে চলেছে জলযান।
পারি, ভেনিস, সলজবুর্গের সোনালি দিন। কার্জন সিনেমায় ‘আ নাইট অ্যাট দ্য অপেরা’, ‘বাইসাইকেল থিফ’ দেখার স্মৃতি। বৃষ্টির মধ্যে দুর্গার আত্মহারা নাচ। কুয়াশা ভোরে ইন্দির ঠাকরুনের শবযাত্রা। কাশবনে অপু-দুর্গার রেলগাড়ি দেখার মতো নিরুপম ফ্রেমে সেলুলয়েড নির্মাণের স্বপ্ন নিয়ে দেশে ফিরছেন সত্যজিৎ।
দেশে ফিরে তাঁর খেয়াল হল, পারম্পর্য বজায় রেখে স্কেচ হয়ে গিয়েছে, অথচ উপন্যাসের চিত্রস্বত্বই কেনা হয়নি!
সে সব নিয়ে কথা বলতে যাবেন, তার আগেই হঠাৎ চলে গেলেন খোদ পাঁচালি-কার, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়!

*****

ফেরালেন না বিভূতিভূষণের স্ত্রী রমা, অর্থাৎ কল্যাণীদেবী। জানালেন, ‘পথের পাঁচালী’র সংক্ষিপ্ত সংস্করণের জন্য মানিকের করা অলঙ্করণ তাঁর খুব ভাল লেগেছে।
এবার আশায় বুক বাঁধলেন সত্যজিৎ। ছুটলেন বিভূতিভূষণের শেষবেলার কর্মক্ষেত্র গোপালনগরে।
উদ্দেশ্য, ‘পথের পাঁচালী’র নিশ্চিন্দিপুরের পরীক্ষামূলক শট নেওয়া। ধার করা ক্যামেরায়, ষোলো মিলিমিটারেই ফ্রেমবন্দি হল অপুর ছেলেবেলার গাঁ-ঘর, পল্লি-প্রকৃতি।
সেই সব ফ্রেমের আবহে যেন তারসানাইয়ে বিভূতিভূষণের ব্যক্তিজীবন-এর সকরুণ সুর।

*****

বিভূতির তখন পাঠশালায় যাওয়ারও বয়স হয়নি। সকাল হলেই বাবা মহানন্দ বেরিয়ে পড়েন রুজির খোঁজে। কথকতা ফেরি করেন মেহেদি নকশার মতো মেঠোপথে গঞ্জে।
একদিন।
‘হরি দুঃখ দাও যে জনারে/ যার কপালে নাই সুখ...।’
‘‘কে যায়, কথকঠাকুর নাকি?’’
‘‘আজ্ঞে মহানন্দ।’’
‘‘আহা, কী সুর লাগিয়েছ ঠাকুর। পিলু?’’
‘‘আজ্ঞে, আড়াচৌতালে। ‘বিধাতা বৈমুখ/ দুঃখের উপর দুঃখ দাও যে তারে।’’’
‘‘তা হে তোমার নাটকের কত দূর?’’
‘‘শেষ হয়ে এল এই। নাম ঠিক করেছি ‘ভুবনমোহিনী’। আজ উঠি কত্তা, নিশিভোরে সুন্দরপুর, মাধবপুর ছাড়িয়ে সেই নিশ্চিন্দিপুর যেতে হয়েছিল। বিভুর জ্বর দেখে বেরিয়েছি।’’
গাঁয়ের পথে নেমে নীলকন্ঠের লেখা কথায় ফের সুর ছাড়লেন উন্মনা মহানন্দ।
‘হরি দুঃখ দাও যে জনারে।’
গলায় চাদর।
কোঁচা দুলিয়ে ছাতা হাতে ফিরছেন মহানন্দ।
গামছায় বাঁধা সের দুই আতপচাল। কাঁঠালি কলা। পান-সুপারি।
কবরেজ তারিণীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় নিজের এই সবেধন নীলমণি পুত্রটিকে কবিরাজিতে মতি করে দিয়ে যেতে পারেননি। মহানন্দ যে নিজেকে উদ্ধব শিরোমণির শিষ্য বলেন!
পদ্মবীজের মালা গলায় ঝুলিয়ে নিত্য সন্ধ্যারতির সময় গাঁ-ঘরে কথকতা না করলে তাঁর স্বস্তি হয় না। দাশু রায়, শ্রীধর কথক, নীলকন্ঠ— কত জনের ঢপ-টপ্পা গান যে তিনি জানেন! উলুরবে ভাসে সন্ধে।
হাঁটছেন মহানন্দ।
ক্লান্ত অবসন্ন পা যে আর চলে না। বাড়িতে লোক বলতে বিধবা দিদি মেনকা আর ছোটবউ মৃণালিনী।
কে জানে খোকা কেমন আছে!
খোকা? বিভূতি!
ছেলের জন্মদিনেই পয়ারে কুল পরিচয় লিখেছিলেন মহানন্দ।—
‘বিভূতিভূষণ নাম আমি বন্দ্যঘাঁটি।/খড়দহ মেলে থাকি কুলে বড় খাঁটি।।/সবাই সন্তান দুই ভঙ্গ সবে জানে।/সভায় বসিলে আগে দশে মোরে মানে।।/কুলীনের পরিচয় আর কত চাও।/মনে ধরে ভালো মেয়ে বিয়ে দিয়ে যাও।।’

*****

বিভূতির সব কেমন মনে পড়ে যায়!
গোটা বাল্যকাল জুড়ে যেন চুঁইয়ে চুঁইয়ে শীত-বসন্ত। ভালবাসার মাছপাখি। অশ্রুমোহর।
সত্যজিতের চিত্রনাট্যেও সেই দুখের বারমাস্যা—
‘‘রাত। ইন্দিরের দাওয়া। প্রদীপের আলোয় ইন্দির বাচ্চাদের গল্প বলে। দুর্গা পিসির কোলে মাথা রেখে শুয়ে, অপু দুর্গার গা ঘেঁষে।
ইন্দির: তখন একটা রাক্ষুসি এসে বলে কি... আমার মন্দিরে কে জাগে?
হরিহর বাড়ি ফেরে। তার গলা শোনা যায়।
হরিহর: দুর্গা, দুর্গা-দরজাটা খোল, মা...!’’

*****

জীবনের শেষবেলায় ইছামতীর ধারে এসে দাঁড়ালে, বিভূতির কানে যেন ভেসে আসে বাবা মহানন্দর পাঁচালির সুর।
স্মৃতির শামিয়ানা সরিয়ে বিভূতিভূষণ দেখতে পান, দারিদ্রে-কষ্টে দীর্ণ তাঁদের ভিটে-পরিবারকে। দুঃখ গোপন করতে করতে কখনও বাবার উপর রেগে যেতেন মা মৃণালিনী। অতগুলো পেটের খিদে মেটানো কি সহজ কথা!
সংসার নিয়ে মহানন্দ চলে গিয়েছিলেন ব্যারাকপুর ছেড়ে। হুগলির শা’গঞ্জ-কেওটায়। সেই বয়সেই বিভূতি হারিয়েছে তার ছোট ভাই ইন্দুভূষণকে। ইন্দুর মৃত্যুর পর বাবাকে সে কান্নায় ভেঙে পড়তে দেখেছে। তারপর থেকে বিভূতিই তাঁর বুকের ধন!
আবার ফিরতে হল ব্যারাকপুরেই। বোন জাফরি আর বাবা-মার সঙ্গে। সেই প্রসন্ন মোদকের কাঁঠালতলার পাঠশালা।
এখনও নদীর ওপার থেকে যেন সেই পাঠশালারই সুর শুনতে পান বিভূতিভূষণ।
সহপাঠী ইন্দু ব্যঙ্গ করছে তাকে—
‘‘তুই মাইনে দিবিনে বিভু?’’
ইন্দুর কথার ফেরে কে যেন বলে ওঠে—
‘‘উঁহু, ওর মাইনে নেই। দেখলিনে, হরিপোড়া হাত ঘুরিয়ে বোঝাল ফো-ক-কা!’’
সহপাঠীদের এমন প্রশ্ন, প্রতি-প্রশ্ন আর আঁকাবাঁকা কথায় কুঁকড়ে যেত স্বভাব-লাজুক সে। কেই-বা জানত বাল্যের এই দারিদ্রই তাঁকে বইতে হবে চিরজীবন!
দিন যত এগোয়, বয়স যত বাড়ে, দুঃখ যেন তত বিশ্বস্ত সঙ্গী হয়ে ওঠে তাঁর!

*****

দুঃখ ভুলতে একখানা বাঁশের কঞ্চি হাতে দিনমান টইটই করে ঘোরে ইস্কুল-পালানো বিভূতি। কখনও ইছামতীর পাড়ে। কখনও বনসিমতলার ঘাট। দেখে রোদ্দুরে পাকা ধান।
দিগম্বর পাড়ুইয়ের নৌকো বাওয়ার ছলাৎ ছলে তার মন। নৌকো-ভাসা ইছামতীর স্রোত বুঝি তাঁকে নিয়ত ডাকে।
শিখে নেয় নৌকো বাওয়া। বাবার কাছে গল্পে গল্পে জেনে নেয়,  নীলকুঠির ইতিহাস।
ইউ পি স্কুলের পাঠ শেষ করে এও বুঝতে পারে, বাবার শরীর ভাঙছে। পড়াতে পারবেন না বলেই তিনি বিভুকে যজমানি করাতে চান।
চেয়ে-চিন্তে সংসার চলে তাঁদের। দুঃখ চেপে, বিভু বাড়ি ফিরে কুলুঙ্গিতে রাখা বাবার হাতে লেখা পশ্চিম ভ্রমণের ডায়েরিখানাই পড়ে।
কখনও বাবার লাল মলাটের ‘সঙ্গীতসার’ খাতা খুলে বসে। কত জনের কত পদ! কথার পর কথার গায়ে কত ছবি!
নিশুত রাতে স্বপ্নে তারও কানে সুদূর থেকে ভেসে আসে পথের ডাক! এই ডাকেই তো সে কোথাও বাঁধা পড়তে চায় না।
তাকে বাঁধতে পারেনি সুপ্রভা, রত্না, খুকু... কেউ, কেউ না! তাঁরা যে বিভূতি পদাবলী প্রেম-জীবনের ‘রাধা’।

*****

বনগাঁ হাই ইংলিশ স্কুল থেকে পাশ করে বিভূতি গেল মায়ের কাছে। সে কলকাতায় পড়তে চায়। মা মৃণালিনী নিষেধ করে বলে বসলেন, ‘গরিবের ঘরে এর চেয়ে বেশি পড়াশুনো হয় না খোকা। তুই চাকরি খুঁজে নে!’
মায়ের কথা শোনেনি বিভু।
ম্যাট্রিকের প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে পাস করে সে ভর্তি হল কলকাতার রিপন কলেজে। ঠাঁই হল, হিন্দু হস্টেলের কাছে ২৪/১ মদনমোহন সেন লেনের মেসবাড়ি।
কিন্তু টাকা দেবে কে?
মনে আছে, যেদিন বনগাঁর স্কুলে ভর্তি হতে গিয়েছিল, মা লক্ষ্মীর ঝাঁপি ভেঙে পয়সা দিয়েছিলেন। শেষ সম্বল মহানন্দর সিঁদুর পরানো টাকাটাও বিক্রির জন্য তুলে দিয়েছিলেন ছেলের হাতে!
আর আজ? এই কলেজবেলায়? সেই মা-র আশ্রয় এখন মামাবাড়ি। মুরাতিপুরে।
কলেজে মাইনে বাকি। মেসে বাকি। বন্ধুদের কাছে বাকি! মেসে খেতে বসলেই ম্যানেজার তাগাদা দেয়। গলা দিয়ে যেন ভাত নামে না বিভূতির।
একদিন দুপুরবেলা। রুমমেটের পরামর্শে দু’জনে জানলা গলে পালাতে গিয়ে ধরা পড়ে গেল! মহল্লা জুড়ে চিৎকার, ‘চোর, চোর’! চুরির অপবাদে অপমানে নুয়ে পড়ল বিভু। 
এই দুঃখ, দহিত জীবন নিয়ে ইন্টারমিডিয়েটে প্রথম বিভাগে পাশ করে বিএ ক্লাসে ভর্তি হল। আবার সেই এক চিন্তা! অর্থের জোগান।
এ বার সহায় হলেন প্রফুল্লচন্দ্র রায়। আশার আলো দেখলেন মহানন্দ-সন্তান।
বিভূতিভূষণের নতুন ঠিকানাও হল, ৮/১ স্বর্ণময়ী রোড। এও এক মেসবাড়ি।

*****

প্রিয় ইছামতীর ঘাটে বসে জলের দিকে চেয়ে আছেন বিভূতি। এই পড়ন্তবেলায় আজকাল কিচ্ছু ভাল লাগে না তাঁর। নীলকুঠির মাঠে শুয়েই কাটিয়ে দেন সারা দিনমান। আনমনে ছেলেবেলার অভ্যাসে দাঁতে কাটেন ঘাসপাতা। আর ভাট ফুলে চোখ রেখে ফিরে ফিরে যান শৈশবে, যৌবনে।
বিভূতির তখন তেইশ।
বিয়ে হয়ে গেল পানিতরের মোক্তার কালীভূষণ মুখোপাধ্যায়ের মেয়ের সঙ্গে। পাত্রী সবে চোদ্দো।
কী নাম?
বিভূতিভূষণের জীবনীকার কিশলয় ঠাকুরের লেখা পড়তে পড়তে চুপি চুপি কান পাতি। বিভূতির বিয়ের বাসরে। স্বামী-স্ত্রীর সলাজ সংলাপ।
‘‘তোমার নাম কী?’’
‘‘বারে, আপনি বুঝি শোনেনি!’’
‘‘তবু তোমার মুখ থেকে শুনব বলো।’’
‘‘কুমারী গৌরীরানী মুখোপাধ্যায়।... কী যেন আমি ভুল বলেছি— তাই না?’’
‘‘হাঁ, আজ থেকে আর তুমি মুখোপাধ্যায় নও, বন্দ্যোপাধ্যায় হলে।’’
‘‘ইশ...! আর ভুল হবে না। বলছি— কুমারী গৌরীরানী—’’
‘‘উঁ হু হু। বরের জোর হাসি। ... আর কুমারীও নও তুমি!’’

(বাঁ দিক থেকে) পটনায় প্রভাতী সংঘের অনুষ্ঠানে পরিমল গোস্বামী, বিভূতিভূষণ, বনফুল, সজনীকান্ত ও অন্যরা

সুখের নাগরদোলায় ছুটি ফুরোয় বিভূতির। ফিরতে হবে কলকাতায়।
ফিরল, কিন্তু মন পড়ে রইল ব্যারাকপুরে।
বিয়ের পর গৌরীকে মায়ের কাছেই রেখে এসেছে যে!
ছুটি-ছাটায় বাড়ি এলে বালিকা বউ বায়না ধরে। পুজোর ছুটিতে বাড়ি এসে বিভূতি মাকে লুকিয়ে বউকে শাড়িও উপহার দিল। দুটিতে সারারাত কথা বলে। রাত ফুরিয়ে ইছামতীর উপর আকাশ ফরসা হয়। তখনও কথা ফুরোয় না বিভূতি-গৌরীর!
সে-সুখও সইল না কপালে!
পুজোয় বাপের বাড়ি গিয়ে বরের দেওয়া শাড়ি দেখাতেই মুখ পুড়ল গৌরীর!
তার দোষ? বিভূতির দেওয়া শাড়ির পাড়ের রং কালো! ও যে বিধবার সাজ!
লজ্জায়, অপমানে স্বামীকে চিঠি লিখলেন গৌরী নিতে আসার জন্য। বিভূতি এলেন। কিন্তু কালীভূষণ মেয়েকে পাঠালেন না। ব্যারাকপুরে মায়ের কাছে একলা ফিরলেন বিভূতি।
তার কিছু দিন পর, পানিতর থেকে দুঃসংবাদ।
বিভূতির শাশুড়ির শরীর খারাপ।
ছুটলেন জামাই। পানিতরে। শ্বশুরঘরের কাছে এসেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল বিভূতি!
কিশলয় ঠাকুর লিখছেন—
‘‘একটা মর্মভাঙা চিৎকারে থমকে দাঁড়ালো বিভূতিভূষণ। বড় শ্যালক ভবানীপ্রসাদ আস্তে আস্তে কাছে এগিয়ে এলো। সারা মুখে যেন কে কালি ঢেলে দিয়েছে। চোখ দুটো জবা ফুলের মতো লাল। বিভূতিভূষণের হাত দুটো চেপে ধরে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলো, বড় দেরি করে এলে ভাই! ভিড় সরে গেল। বিভূতিভূষণ চেয়ে দেখল, পাশাপাশি দুটি দেহ— প্রাণহীণ, নিস্পন্দ, নির্বাপিত। মা আর মেয়ে। বিভূতিভূষণের শাশুড়ি কামিনীদেবী আর... আর গৌরী!’’
গৌরীর পরনে ছিল বিভূতির দেওয়া সেই কালো পেড়ে নতুন শাড়িটি! 

*****

গৌরীও চলে গেল!
পিছু পিছু গেল বোন মণি। তার পর মা! শোকে আর স্মৃতির এলো ঝড়ে মাঝে মাঝে দুঃসহ লাগে নিজেকে।
নদীর ধারে এক সময় দিন গড়িয়ে বিকেল নামে। সব ছারখার। বিবর্ণ বাতাস।
বিকেলে ইছামতীর জলে ছায়ারা দীর্ঘ হয়।
কার কথা ভাবছেন বিভূতিভূষণ?
গৌরী?
গৌরীকে দেখতে চেয়ে তো সে থিয়োসফিক্যাল সোসাইটির সদস্য হয়ে আত্মা-নামানোতেও মেতেছিলেন। তবু শান্তি মিলল কই! শান্তি আর কোথায়!
সারাক্ষণ বুক পকেটে গৌরীর শেষ চিঠি দুটো রাখা। সঙ্গে বনফুলের পাপড়ি।
কখনও সারারাত জেগে গৌরীর অপেক্ষায় ধূপ জ্বালিয়ে রাখেন।
গৌরী কি আসে?
সন্ধে রাতে ইছামতীর সর্বস্বান্ত করা হাওয়ায় কি থাকে, কেউ কী জানে?
শিরশির করে বিভূতির শরীর।
অদূরে শরবনে হাওয়ার মাতনে শিরশিরানি যেন বাড়ে তাঁর বুকের গহনে।

*****

চিৎ হয়ে আকাশের দিকে মুখ করে শুয়ে থাকেন বিভূতিভূষণ। অনন্ত নক্ষত্রবীথির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তাঁর মনে পড়ে হরিনাভি-রাজপুরের কথা।
বন্ধুর স্ত্রী নিভা। তার মেয়ে ফুলির কথা।
কলকাতায় মেসে বেকারির জ্বালায় যখন আঁতিপাতি করে ‘কর্মখালি’ দেখছে, সেই আচার্য রায়ই এগিয়ে এসেছিলেন। সুপারিশ লিখে হরিনাভি পাঠিয়েছিলেন পঞ্চাশ টাকার শিক্ষকতায়। সে চাকরিও করতে পারেননি বিভূতি।
পরকীয়ার অপবাদে মাথা নিচু করে ফিরতে হয়েছে তাঁকে। তার অপরাধ, বন্ধুপত্নী নিভাননীকে নিয়ে গল্প লিখেছেন তিনি। প্রবাসী পত্রিকায় সে-গল্প ‘উপেক্ষিতা’ প্রকাশের পরই তাঁকে নিয়ে গুঞ্জন, হরিনাভিতে।
পরের গল্প ‘উমারানী’। সে-গল্প বন্ধুর মেয়ে ফুলিকে নিয়ে!
আড়াল-আবডালে নয়। প্রকাশ্যে লোকে বলেছে, ‘কে উমারানী? আবার কাকে নিয়ে গল্প ফেঁদেছে মাস্টার? কে আবার? প্রথম গল্প মাকে নিয়ে, এবার মেয়েকে নিয়ে নিশ্চয়!’
নদীর বাতাসে যেন প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে ফিরে আসে কথাগুলো!
নিজের অজান্তেই কানে হাত দেন বিভূতি।
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দুঃসহ স্মৃতির পাতাগুলো নদীর হাওয়ায় উজানে ঠেলতে ঠেলতে কখন জানি ঘুমিয়ে পড়েন বিভূতিভূষণ।

*****

৪১, মির্জাপুর স্ট্রিট। মেস বাড়ি।
ঘরে ঢুকে মেস-বন্ধু নীরদচন্দ্র চৌধুরী দেখলেন অঘোর ঘুমে বিভূতি।
‘‘বিভূতিবাবু... ও বিভূতিবাবু? বলি শুনছেন, উঠুন!’’
‘‘কে! ও নীরদ! কখন ফিরলেন। ক’দিন স্নান-খাওয়া নেই। চোখটা একটু লেগে গিয়েছিল! আসলে বনগাঁ থেকে ফিরে ...’’
‘‘আরে উঠুন উঠুন মশাই, দেশ-ঘরের কথা পরে হবে। আগে স্নান করে চাট্টি খেয়ে নিন। ঠাকুরের রান্নাও সারা। বেলা করলে কলতলায় লাইন পড়বে কিন্তু।’’
‘‘সত্যি, আপনার কাছে আমার ঋণের শেষ নেই। জানি না, এ জীবনে শোধ করে যেতে পারব কিনা!’’
‘‘‘প্রবাসী’-তে ‘উপেক্ষিতা’ আর ‘উমারানী’-র খাওয়াই তো বাকি। চলুন মেসবাড়ি ছেড়ে কাছেপিঠে কোথাও ঘুরে আসি। ঘোরাও হবে, খাওয়া-দাওয়া হবে। দেখবেন মনটাও একটু ভাল হয়েছে আপনার। তা নতুন লেখায় হাত দিলেন নাকি? শোনাবেন কিন্তু।’’
‘‘নীরদ, আর যে ভাই পেরে উঠছিনে। কিছু একটা না জোটাতে পারলে না-খেয়ে মরতে হবে।’’

*****

বিভূতির কাজ একটা হল বটে, তবে সেটা কাউ-প্রোটেকশন লিগে!
কেশোরামের গো-রক্ষিণী সভার প্রচারক। ছ’মাসের জন্য। দেশজুড়ে। ভ্রাম্যমাণ সেই প্রচারে পথে নামলেন ‘পথের পাঁচালী’-র বিভূতিভূষণ। মাসিক বেতন ৫০ টাকা।
কোথায় না গিয়েছেন— ফরিদপুর, বরিশাল, কক্সবাজার, চাটগাঁ, মংডু। টেবিল পেতে গো-ধন রক্ষার সপক্ষে যুক্তি দিয়েছেন। ছ’মাসে ‘অভিযাত্রিক’-এর রসদে দিনলিপি যেন পূর্ণ হল।
মেয়াদ ফুরিয়ে সেই মির্জাপুর স্ট্রিটের চার দেওয়ালের মেসে ফিরলেন বিভূতি।
প্রকাশিত হল আরও একটি গল্প ‘মৌরীফুল’। ‘প্রবাসী’ পুরস্কার দিল লেখককে। নগদ ২৫ টাকা। কিন্তু ওতে আর কত দিন চলে!
আবার সেই বেকারির জ্বালা!
ভেবে ভেবে দিন যায়। মেসবাড়ি দুপুরবেলা নিরিবিলি হলে, বিভূতি কাগজ-কলম নিয়ে বসেন। শত ঝরনায় নিজেকে সমর্পণ করেন।

*****

নীলের উপর সাদা ডোরাকাটা প্রিয় পার্কার পেনটিতে কতক্ষণ লিখছেন, নিজেই জানেন না।
ভাগলপুর। ইসমাইলপুরের কাছারিবাড়ি।
জঙ্গলের ভিতর খড়ের ছাউনি। মাটির দেওয়াল। বাইরে বেশ ঠান্ডা।
ঘোরের মধ্যেই লিখে চলেছেন বিভূতিভূষণ।
কাজ খুঁজতে খুঁজতে অমৃতবাজার-এ বিজ্ঞাপন দেখে গিয়েছিলেন পাথুরেঘাটায়। জমিদার খেলাতচন্দ্র ঘোষের নাতি  সিদ্ধেশ্বরবাবুর ভাগ্নেকে টিউশন পড়াতে।
দায়িত্বজ্ঞান দেখে সিদ্ধেশ্বর ঘোষ তাঁকে জমিদারির কাজে পাঠালেন। যখন ভাগলপুর এলেন, তখন এদিকে সবে শীত পড়ছে। আর এখন হাড় কাঁপানো হিম।
কিন্তু তাঁর কাজ তো শহরের পাকাবাড়িতে নয়। তাঁর মহাল, ‘উত্তরে আজমবাদ থেকে দক্ষিণে কিষেণপুর, পুবে ফুলকিয়া-লবটুলিয়া-নাঢ়া বইহার আর পশ্চিমে মুঙ্গের জেলার সীমান্ত প‎র্যন্ত।’
এরই মধ্যে ক’দিন ঘুরে গেল বোন জাফরি। মাঝে মধ্যে ছোটভাই নুটুও আসে।
একদিন ভাগলপুরে আলাপ জমল সাহিত্য-সাধক উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে। তাঁর বাড়িটি শরৎ-স্মৃতির জুঁই গন্ধে মাখা। নিয়মিত সাহিত্যের আড্ডাও বসে। জুড়ে গেলেন বিভূতি।
সাহিত্যের আড্ডার সঙ্গে সঙ্গে জঙ্গল আবাদ, জমির বিলি বন্দোবস্ত, তহসিল-তহবিলে দিন যায়। ঘোড়া ছুটিয়ে চাঁদনি রাতে আদিগন্ত বনভূমিতে ঘোরেন বিভূতিভূষণ।
সরস্বতীকুণ্ডের জলে তেমন মায়া-রাতে একা একা স্নানরতা হুরি-পরি দেখতেও চলে যান। 
যত দেখছেন অরণ্যের দিনরাত্রি, দিনলিপির পাতা যেন তত ভরে উঠছে কথার ভারে। মাঝে মাঝে বনগাঁর জন্য বেদনায় ভরে ওঠে মন। কেমন আছে ইছামতী, বনশিমতলা, নীলকুঠির মাঠ? দূর থেকে নাকে এসে লাগে স্মৃতির-ঘ্রাণ। বনপথে ছাতিম ফুলের গন্ধে জাগে ছায়ানিবিড় ভিটে-ঘরের স্মৃতি। কানে বাজে প্রিয়জনের সংলাপ!—
‘‘ও মা… মা?’’
স্মৃতির ভিতর দরজা খুলে যায়।
‘‘কে? বিভূতি?’’
মৃণালিনী দুয়ার খুলে দাঁড়ান। পাশে বোন মণি, জাফরি, ভাই নুটু। মহানন্দ কাশতে কাশতে দাওয়া থেকে নামছেন, ‘‘খোকা এলি? ছোটবউ খোকা? ও কার সঙ্গে কথা বলো...!’’

*****

স্মৃতির দেরাজ থেকে কলমটি নিয়ে লিখে চলেন বিভূতি।
আজ কী লিখছেন তিনি?
দিন কয়েক আগে লেখা, ১৯২৫-এর ৩ এপ্রিলের পাতায় বিভূতির সংকল্প। ডায়েরির পাতা উল্টে পড়ে নিই।
‘‘বাবার পশ্চিম ভ্রমণের ডায়েরিটা ঠাকুরের পিঁড়িতে রেখে ফুলচন্দন মাখালেম। তিনি কি জানতেন তাঁর মৃত্যুর প্রায় পনের বছর পর প্রথম যৌবনে তাঁর ছেঁড়া-খোঁড়া লেখা খাতাখানি বিহারের এক নির্জন কাশবনের চরের মধ্যে ফুলচন্দনে অর্চিত হবে?’’
এ যেন আশীর্বাদ নেওয়া। আর তারপরই পথের পাঁচালি লেখার সংকল্প!
কেমন সে লেখা?
বিভূতি লিখছেন, ‘হরিহরের পূর্বের ভিটায় খড়ের ঘরখানা অনেকদিন বে-মেরামতি অবস্থায় পড়িয়া আছে। এই ঘরটাতেই বুড়ী থাকে।’
কয়েক পাতা লিখেই কলকাতা চলে এলেন মির্জাপুর স্ট্রিটে। পরম বন্ধু নীরদ জড়িয়ে ধরলেন বিভূতিকে। বললেন, ‘‘চালিয়ে যান বিভূতিবাবু, অসাধারণ হবে।’’

রমাদেবী ও ছোট্ট তারাদাসের সঙ্গে

‘আরণ্যক’ মহালে ফিরে, ভাগলপুর শহরেই সদর কাছারিতে থাকতে শুরু করলেন। নাগাড়ে লিখে চলেন। সারা টেবিল লেখাপাতায় ঢেকে যায়। জানলার পাশে নিম গাছের হাওয়ায় কখনও সখনও সব কেমন এলোমেলো হয়ে যায়। বিভূতি লিখতে লিখতে দোতলার জানলা দিয়ে অদূরে বয়ে চলা গঙ্গার দিকে তাকিয়ে তাঁর ইছামতীর কথা ভাবেন।
মহালের কাজে বার হলেও লেখা থামে না। আজমবাদ কাছারিতে লিখছেন তো, কখনও প্রান্তরের মাঝে। টিলার গায়ে বনফুলের ঝোপের ধারে বসে লিখছেন। একদিন উপেনবাবুরা জোর করে লেখা শুনতে চাইলেন। লেখা শুনে প্রশংসা ছড়াল। সকলেই আরও শুনতে চায় বাকি অংশ!
তখনও উপন্যাসে অপু আছে। নিশ্চিন্দিপুর আছে। মা-বাবা-পিসিমা, প্রসন্ন মাস্টার আছে। মহানন্দও আছেন। কেবল দুর্গা নেই!
হঠাৎ ভাগলপুরে একটি মেয়েকে দেখে উদাস হলেন বিভূতি। মেয়েটির উড়ো চুলে যেন ইছামতীর উজান-হাওয়া।
নতুন করে লিখলেন ‘পথের পাঁচালী’। অপু তার দিদিকে পেল। জন্ম হল দুর্গার!
শেষ হল একদিন অপুর পাঁচালি। পনেরো কিস্তিতে ছাপাও হয়ে গেল, উপেনবাবুর ‘বিচিত্রা’ পত্রিকায়। প্রথম যে সংখ্যাটিতে ছাপা শুরু হল, সে সংখ্যায় ছিল রবীন্দ্রনাথেরও ধারাবাহিক উপন্যাস। ‘যোগাযোগ’। ছিল তাঁর কবিতাও। ‘সুসময়’। রম্যরচনা ‘তেল আর আলো’। আর ‘ভানুসিংহের পত্রাবলী’।
এত শতর ভিড়েও রীতিমতো শোরগোল পড়ে গেল বাংলা সাহিত্যের বাজারে। ‘পথের পাঁচালী’ নিয়ে।
সুখ্যাতি আর যশের মুখ দেখলেন বিভূতিভূষণ।

*****

কিন্তু বিধি বাম!
ছাপা তো হল, বই ছাপবে কে? বিভূতি যখন মেসবাড়িতে থেকে কলকাতার এক প্রকাশক থেকে অন্য প্রকাশকের দরজায় দরজায় পথের পাঁচালীর পাণ্ডুলিপি নিয়ে ঘুরছেন, শুনতে হচ্ছে, ‘গাঁটের কড়ি খরচ করে কে আর পাঁচালী-ফাঁচালি ছাপতে যায় বলুন?’ কোনও প্রকাশক বলছেন, ‘না মশাই, প্রেম নেই, খুন নেই, কেচ্ছা নেই—ও বই চলবে না’!
পথ দেখালেন সেই নীরদ সি চৌধুরী।
কিশলয় ঠাকুর লিখেছেন, ‘‘একানব্বুই নম্বর সারকুলার রোডের প্রবাসী-র আড্ডায় এসে ক্ষোভে ভেঙে পড়লেন নীরদ। সব শুনে সজনীকান্ত দাস বললেন, দাঁড়াও, পড়ে দেখি।... গভীর রাত পর্যন্ত একটানা পড়ে চললেন। সে পড়ার অভিজ্ঞতা তিনি আত্মস্মৃতিতে এভাবে লিখেছেন, ‘বেশ বুঝিতে পারিলাম রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্রের বাঙলা সাহিত্যে অভিনবের আবির্ভাব হইয়াছে।... উত্তেজনায় শেষ রাত্রিটা প্রায় বিনিদ্র কাটিল।’

*****

রাতারাতি খোলা হল সজনীর প্রকাশন সংস্থা রঞ্জন! চুক্তি হল লেখক আর প্রকাশকের মধ্যে। সাক্ষী, নীরদ চৌধুরী, গোপাল হালদার। সাহিত্যের আড্ডায় হল দরাদরিও।
সজনী তিনশো দেবেন।
বিভূতি পথের পাঁচালী-র দর দেন, আরও পঁচিশ! সজনী তাতেই রাজি।
অগ্রিম, নগদ পঁচিশ!
বাবাকে উৎসর্গ করা বই যেদিন হাতে পেলেন, বুকে চেপে সজনীকান্তর সামনে দাঁড়িয়ে রইলেন চোখ বন্ধ করে।
১৯২৯, অক্টোবরের ২ তারিখ সেই রাতের দিনলিপিতে বিভূতি লিখছেন, ‘‘আজ মহালয়া, পিতৃতর্পণের দিন। তিল তুলসীতে আমি বিশ্বাস করিনে। বাবার অসম্পূর্ণ কাজ আমি যদি শেষ করতে পেরে থাকি, তার চেয়ে সত্যতর কোন তর্পনের খবর আমার জানা নেই।’’
একে একে প্রকাশিত হল ‘অপরাজিত’, ১০টি গল্পের সংকলন ‘মেঘমল্লার’। ক্রমশ পত্র-পত্রিকায় নানা আলোড়ন।
প্রশংসা করলেন বিভূতির স্বপ্নের মানুষ রবিঠাকুরও!
জুটল সংবর্ধনা!

*****

বিভূতির সাজের বহর দেখে মুখ চিপে হাসেন নীরদ আর তাঁর স্ত্রী অমিয়া। সাজ কী আর এমনি?
বেথুন কলেজের মেয়েরা সংবর্ধনা দিতে চায় বিভূতিকে!
সলাজ বিভূতি গেলেন। আলাপ হল অমিয়ার বান্ধবী, শিলংয়ের মেয়ে সুপ্রভার সঙ্গে। তার আগেই অবশ্য ‘পথের পাঁচালী’ পড়ে মুগ্ধ পাঠিকার চিঠি এসেছে শিলং পাহাড় থেকে!
রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষার পর এবার চোখেচোখ রাখা! দু’জনে হাঁটছেন, আঙুলে আঙুল জড়িয়ে কলকাতার নির্জন লেন-বাইলেনে।
বোটানিক্যাল গার্ডেনের গঙ্গা ফড়িং দুপুরে পথের কবি কবিতা লেখাও শেখাচ্ছেন পাহাড়ী মেয়ে সুপ্রভাকে। সরছে দ্বিধা, ভয়।
একটু পরেই হয়তো ওঁদের দেখা যাবে সভা-সমিতি-সিনেমা হলে। দু’জন পাশাপাশি। 
একে অপরের কানে কানে ফিসফিসিয়ে কথাও বলছেন।
গোপন-গহন কী কথা?
শুনি তেমন একদিনের কথা।
চিত্রা হলে ‘মুক্তি’ ছবি দেখছেন দু’জন।
এক সময় সুপ্রভা তাঁর নরম হাত রাখল বিভূতির হাতের মধ্যে! বিভূতি একটু অপ্রস্তুত। একটু পরে দেখল, তার হাতে একটি রুমাল।
সুপ্রভা নিজের হাতে কাজ করে উপহার দিল। এ সম্পর্কের রেশ সারা জীবন বয়ে বেড়িয়েছেন বিভূতি। পাগলের মতো বার বার সুপ্রভাকে দেখতে ছুটে গিয়েছেন শিলংয়ে। একা একা অপেক্ষা করেছেন পাইনের ছায়ায় বসে। সুপ্রভার গান তাঁকে বার বার ঘুমের মধ্যে জাগিয়ে রেখেছে। অথচ, সেই সুপ্রভার সঙ্গে যখন নীরদ-অমিয়া বাঁধতে চেয়েছেন তাঁকে, বিভূতি বলেছেন, ‘আমি মুক্ত পথিক’।
সুপ্রভার বিয়ে হয়ে গিয়েছিল অন্যখানে।

*****

কলকাতা ছেড়ে সে বার বেশ কিছু দিন ব্যারাকপুরে রয়েছেন বিভূতিভূষণ। বয়স চল্লিশ ছুঁই ছুঁই।
ইতিমধ্যে ‘অপরাজিত’-র প্রথম খণ্ড বেরিয়েছে। দেখা হয়ে গেল কিশোরী খুকুর সঙ্গে। খুকু স্কুলবেলার গণিতের শিক্ষক যুগলমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের মেয়ে।
দিন নেই, দুপুর নেই দুটিতে মশগুল পড়া পড়া খেলায়। খুকুর চুল, জামার গন্ধে ভুর ভুর বিভূতির বিকেল।
কত প্রশ্ন খুকুর! বিভূতি রাগে না। বার বার পড়া-লেখায় ভুল করে খুকু। বিভূতির ক্লান্তি নেই, শুধরে দেন। হাত ধরাধরি করে কুঠির মাঠে গিয়ে দাঁড়ায় দু’জন। না দেখে থাকতে পেরে এক জন ছাদে, তো অন্য জন পাশের মাঠে। গোল হলুদ থালার মতো চাঁদের রাতে ইছামতীর জল কেটে কেটে ডুবসাঁতার! বিভূতিকে লেখা সুপ্রভার চিঠি দেখে খুকুর রাগ হয়! রাগ ভাঙাতে উপহার দিলেন ‘চাঁদের পাহাড়’।
খুকু কলকাতা দেখতে চায়। নিয়ে এলেন বিভূতি। উঠলেন নীরদ-অমিয়ার কাছেই। দু’দিন কলকাতার হাওয়ায় খুব উড়লেন দুটিতে!
তেতে উঠল ব্যারাকপুর। সরগরম গালগল্প, রঙ্গব্যঙ্গ বিভূতি-খুকুকে নিয়ে!
অন্যত্র খুকুর বিয়ে ঠিক করলেন যুগলমোহন। আর খুকুকে লুকিয়ে সে-বিয়ের টাকার জোগান দিলেন বিভূতি।

*****

বিভূতিভূষণের জীবনে শুরু হল নতুন অধ্যায়। সেটা ১৯৩৯। বোন জাফরির মৃত্যুর পর ভাগ্নে-ভাগ্নিকে নিজের কাছে এনে রেখেছেন। সেই শোকের আবহেই পড়শি মেয়ে কল্যাণীর সঙ্গে পরিচয়। ঘনিষ্ঠতা গড়াতে নিজের বয়সের কথা ভেবে ভয় পেলেন।
এ এক আশ্চর্য দোটানা বিভূতিভূষণের! পথের নেশায় ঘোরেন, অর্থ চিন্তায় জর্জরিত, অথচ সেই মানুষ তিরিশের দশকেই ঘাটশিলায় বাড়ি কিনলেন গৌরীর স্মৃতিতে। কৃপণের মতো দিনযাপন করেন। কারও বাড়ি গেলে ছেঁড়া জুতো বাইরে লুকিয়ে রাখেন। আবার প্রকাশকদের কাছে হুটহাট হাজির হন কঞ্চি হাতে টাকা চেয়ে। বেশি টাকা হাতে পেলে ফিরিয়েও দেন!— ‘‘এত টাকা আমার কী হবে।’’
আশ্চর্য বৈপরীত্য!
অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান গণিকা দেখার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকেন! নিত্য নতুন প্রেমেও পড়েন। মেয়েদের কাছ থেকে প্রেমপত্র পেলে খুশি হন। অথচ বিয়ের কথা বললে, পালিয়ে যান ‘অপরাজিত’র লেখক!
পালাতে পারলেন না কেবল কল্যাণীর কাছ থেকে। চেয়েছিলেন পালাতে, কিন্তু কল্যাণী সব ভয়-ভাবনা উড়িয়ে জয় করে নিলেন বিভূতিকে।
কল্যাণীর প্রেমে রীতিমতো মজেছিলেন বিভূতি। প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর তেইশ বছর পর দ্বিতীয় স্ত্রী কল্যাণীকে জন্মদিনে উপহার দিলেন ‘সাবানদানি’! আর একবার?
দিলেন ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’।
ফি সপ্তাহে বনগাঁর শ্বশুরঘর এলেও, নিত্য চলত চিঠির লেনদেন। একবার তেমন এক চিঠিতে কল্যাণীর দাবি, ছবি চাই! অগত্যা বিভূতি ছুটলেন পরিমল গোস্বামীর কাছে।
‘‘বেশ একটা ছবি তুলে দাও তো।’’
‘‘আহা! সে না হয় হল, কিন্তু ছবি নিয়ে কী করবেন?’’
‘‘উপহার!’’
‘‘কাকে!’’
‘‘সে একজন আছে। তরুণী।’’
বুড়ো বয়েসে তরুণীর জন্য ছবি তোলাচ্ছেন বিভূতিভূষণ! শুনে থ’ পরিমল গোস্বামী। দাড়ি কেটে সাফসুতরো হয়ে ক্যামেরার সামনে এলেন ‘আরণ্যক’-সাহিত্যিক!
এক প্রৌঢ় আর তরুণীর প্রেম নিয়ে কত যে হাসি-ঠাট্টা উড়ল পথের হাওয়ায়!

*****

সেই বনশিমতলা, নীলকুঠির মাঠ, দাড়িঘাটার পুল, বকুলতলা... কিচ্ছুটি বদলায়নি।
শেষ বেলায় ব্যারাকপুরে কল্যাণীকে নিয়ে বিভূতিভূষণ নতুন করে ঘর পাতলেন। হাত ধরে চিনিয়ে দিলেন ছেলেবেলার গাঁ-ঘর। অপুর সংসার। পড়াতে শুরু করলেন গোপালনগরে হরিপদ ইনস্টিটিউশনে। পর পর সন্তান হারিয়ে তখন দিশেহারা, জন্ম হল তারাদাসের। সে সময়ের দিনলিপির পাতার পর পাতা শুধু বাবলুর কথা।
বেলা যত পড়ে এসেছে, শুধুই লিখেছেন। ‘মিসমিদের কবচ’, ‘অনুবর্তন’, ‘হীরামানিক জ্বলে’, ‘অশনি সংকেত’, ‘ইছামতী’।
একে একে প্রকাশিত হল, দিনলিপি ‘তৃণাঙ্কুর’, গল্প সংকলন ‘নবাগত’, ‘তালনবমী’, ‘উৎকর্ণ’।
এক প্রকাশক তাঁর জন্মদিনে উপহার দিলেন নতুন উপন্যাসের জন্য বাঁধানো লাল খাতা। তাতে লেখা ‘কাজল’!
‘অপরাজিত’-র শেষ খণ্ড ‘কাজল’-এর প্লটও ভেবেছিলেন। কিন্তু ফেরা হল না ঘাটশিলার গৌরীকুঞ্জ থেকে আর! 

*****

বিভূতি পাশ ফিরে উদাস চোখে চেয়ে থাকেন দূরে। পড়ন্ত বিকেলের ইছামতীর চরের দিকে। দেখেন, দিগম্বর পাড়ুই যেন ওপার থেকে তাঁকে নিতে নৌকো নিয়ে ফিরছে। এক নদী-নৌকো।
সইমাদের বাড়ির পথ থেকে কুড়িয়ে আনা বকুল ফুলগুলো তিনি আলতো হাতে ছড়িয়ে দেন। মনে পড়ে গৌরী, সুপ্রভা, খুকুর কথা।
সারা জীবনজুড়ে পথের কত স্মৃতি আজ!  অদূরে ভিটে।
সন্ধে নামার একটু আগে বিভূতি যেন দেখেন, জনশূন্য বাড়িখানার কবেকার নিকোনো উঠোন। একটা কুকুর গোল হয়ে শুয়ে রয়েছে। ভাঙা ইটের গাদার ওপর দিয়ে একটা বাস্তু সাপ! চৌকাঠ পেরিয়ে সাপটা ঘরে ঢুকল!
একা, কার্তিকের সন্ধের অন্ধকারে কুঁকড়ে যান। বিভূতির মনে হয়, গরুর গাড়ি করে তাঁর বাবা মাকে নিয়ে কোথায় যেন চলল!
মা কি কাঁদছে...
আঁচল দিকে মুখ ঢাকছে কেন...
মায়ের পাশে বসে, কে ও! …অপু!

http://www.anandabazar.com/supplementary/patrika/%E0%A6%85%E0%A6%AA%E0%A6%B0-%E0%A6%9C-%E0%A6%A4-1.250453

মৃত স্ত্রীর আত্মার সঙ্গে কথা হত প্ল্যানচেটে ( On Bibhutibhushan)

মৃত স্ত্রীর আত্মার সঙ্গে কথা হত প্ল্যানচেটে

শুরু করেছিলেন প্রেতচর্চা। মৃত্যুর আগে বিভূতিভূষণের সে এক ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা!

২৮ নভেম্বর, ২০১৫, ০০:০৩:০০
4
‘‘গৌরীকে দেখাবেন? আমার গৌরী! একটি বার শুধু দেখা করিয়ে দিন!’’
প্রথম স্ত্রী গৌরীর মৃত্যুর পর শোকে ভেঙে পড়ে বিভূতিভূষণ এমন আকুতিই করেছেন দিনের পর দিন!
স্ত্রীর মৃত্যুর কিছু দিন পর বোন মণিও মারা যান। ব্যারাকপুরের বাড়িতে পর পর দুটি আঘাতে পাগল হয়ে যাওয়ার দশা হয় বিভূতির। কলেজের বন্ধুরা একরকম জোর করে তাঁকে কলকাতা নিয়ে আসে।
একদিন টালিগঞ্জের দিকে একলা ঘুরতে ঘুরতে তাঁর দেখা হয় এক সন্ন্যাসীর সঙ্গে। তিনিই বিভূতিকে অশরীরী আত্মার বিচরণ সম্পর্কে ব্রহ্মসূত্রের কথা বলেন। বিভূতি অবাক হয়ে শোনেন, বৃহদারণ্যকে জনকসভায় মহর্ষি আত্মা-তত্ত্বের কী ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন।
সেই শুরু।
সারা জীবন বিভূতিভূষণ বিশ্বাস করে এসেছেন আত্মা-চর্চায়। আত্মাকে ডাকলে তাকে পাওয়া যায়। শুধু ডাকার মতো ডাকতে জানা চাই।
মৃত গৌরীকে দেখতে চেয়ে সন্ন্যাসীর কাছেই শিখেছিলেন ‘মণ্ডল’। অর্থাৎ প্ল্যানচেটে আত্মাকে ডাকা। 
যেখানেই গিয়েছেন, আমৃত্যু সেই সাধনা করেছেন। দরজা-জানলা বন্ধ করে, ধূপ-ধুনো জ্বালিয়ে ডেকেছেন গৌরীকে। কথা বলেছেন একা একা গভীর নিশীথে। কান্নায় প্রিয়তমার শোকে আকুল হয়েছেন।
সন্ন্যাসীর কাছ থেকে আত্মা-আবাহনের কৌশলটি রপ্ত করার পর কয়েক দিন তুমুল মেতেছিলেন তিনি। বিস্তৃত এই পরলোকচর্চার স্বাদ পেয়ে, নাম লিখিয়েছিলেন কলেজ স্কোয়ারের থিওসফিক্যাল সোসাইটিতেও। এক সময় যার সভাপতি ছিলেন প্যারীচাঁদ মিত্র। তিনিও স্ত্রীর মৃত্যুর পর মেতে উঠেছিলেন আত্মার সঙ্গে নিভৃত সংলাপে।
সোসাইটির সদস্য হয়ে বিভূতি যেন নতুন দিগন্তের সন্ধান পেলেন। জানা হল চক্রাধিবেশন। ধীরে ধীরে জানলেন, তাঁর কল্পলোকের দেবতা রবিঠাকুরও প্ল্যানচেট করেছেন। এও জানলেন, বিদ্যাসাগর যে দিন চলে যান, বৃন্দাবনের আকাশে তাঁর আত্মা দেখেছিলেন বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী! শুনলেন, স্বামী বিবেকানন্দকে কোনও আত্মা এসে তাঁর পিণ্ড দানের অনুরোধ করেন।
বিভূতির সেই সময়ের প্রিয় বন্ধু নীরদ সি চৌধুরী লিখেছেন, বিভূতিভূষণের পরলোকচর্চার মতিগতি।
নীরদ মনে করতেন, বিভূতির পরলোকে বিশ্বাস ঠিক ‘বিশ্বাস’ নয়, কুসংস্কার হয়ে উঠেছিল।
নিছক তাই কি?
পরলোক নিয়ে এত অগাধ পড়াশোনার পর সেও কি সম্ভব! কেন না, বিভূতি তো ঘোর বাস্তববাদী ছিলেন।
চর্চা এখানেই থেমে রইল না।
জাঙ্গিপাড়া দ্বারকানাথ হাইস্কুলে যখন পড়াতে গেলেন, তাঁকে ঘিরে কয়েকজন ঠিক জুটে গেল পরলোকচর্চায়।
অন্ধকার ঘরে টেবিল পেতে তাঁরা মোমবাতি জ্বালিয়ে বসলেনও।
বিভূতি এক একদিন ডেকে আনতেন পরলোক থেকে প্রিয়দের। কিন্তু এই প্রেতচর্চাই কাল হল তাঁর।
জাঙ্গিপাড়ার হাওয়ায় নানা কথা রটল।
স্কুলবাড়িতে মাস্টার প্রেত নামায়, কথাটা অভিভাবকরা ভালভাবে নিলেন না। ছাত্র কমতে লাগল। বিপদ বুঝে, স্কুল কমিটি বিভূতিকে স্কুল থেকে তাড়িয়ে দিল। তবু সরে আসেননি বিভূতি প্রেতচর্চা থেকে।
হরিনাভি-রাজপুরে যখন অ্যাংলো স্যানসক্রিট ইনস্টিটিউশনে পড়াতে গেলেন, সেখানেও অল্প বিস্তর জানাজানি হয় তাঁর পরলোকচর্চার খবর।
ক্রমশ পরলোক নিয়ে তাঁর বিশ্বাসও ঢুকে পড়ে লেখা গল্পে, উপন্যাসে। কখনও সখনও তা নিয়ে সচেতন হয়ে ছেঁটেও ফেলেছেন মূল লেখা থেকে সেই আধি-ভৌতিক প্রসঙ্গ। তবু শেষ রক্ষে হয়নি!
বিভূতিভূষণের দ্বিতীয় স্ত্রী কল্যাণীদেবীর বাবা ষোড়শীকান্ত তান্ত্রিক ছিলেন। দীক্ষাও নিয়েছিলেন এক ভৈরবীর কাছে। তাঁকে নিয়েই বিভূতি ‘তারানাথ তান্ত্রিক’ লিখেছিলেন।
জামাইয়ের পরলোক নিয়ে অতি উৎসাহে অবাকই হতেন ষোড়শীকান্ত। জীবনের শেষ পর্বে যখন ব্যারাকপুরে রয়েছেন দেখা মিলল এক ভৈরবীর। বিভূতি মেতেও উঠেছিলেন তাঁর সঙ্গে।
ভৈরবী শবসাধনা করতে এসেছে জেনে, বিভূতিও নিত্য যাতায়াত বাড়ায়। রেগে যেতেন কল্যাণী। তবু কী এক মায়ায় নাছোড় বিভূতিকে আগলে রাখতে পারতেন না! রাতভর সাধনায় মেতে থাকতেন স্ত্রী-সংসার ভুলে। 
তাঁর দিনলিপির পাতায় পাতায় পরলোক নিয়ে বিশ্বাসের কথা রয়েছে। তারই সংশ্লেষ ‘দেবযান’ উপন্যাস।
মৃত্যুর পর আত্মার উপস্থিতি নিয়ে বিভূতির বিশ্বাস যেন প্লটের বাঁকে বাঁকে।
মৃত্যুর পর কোথায় থাকে আত্মা?
শবের কাছেই কি দাঁড়িয়ে থাকে?
কী ভাবে উড়ে যায়?
ফিরে আসে কি?
সব উত্তর যেন মিলে যায় যতীন চরিত্রটিকে নিয়ে এই লেখায়। তাঁর জীবনীকার কিশলয় ঠাকুর জানিয়েছিলেন, ‘‘যে সময় ‘দেবযান’ প্রকাশ হচ্ছে, তার বহু আগে থেকেই বনগাঁর বীরেশ্বর মুখোপাধ্যায় নামে এক ব্যক্তির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ান। তিনিও পুত্রশোকে কাতর ছিলেন। দুঃখ ভুলতে প্ল্যানচেটে ছেলের সঙ্গে কথা বলতেন। বীরেশ্বরবাবুর সংগ্রহে ছিল পরলোকচর্চার নানা বই। সে সব বইতে বিভূতি ডুবে থাকতেন। পাতায় পাতায় নিজের নোটও লিখে রাখতেন।’’
বিভূতিভূষণের পরলোকচর্চার বিষয়টি সে সময় লেখকদের অনেকেই খবর রাখতেন। বিভূতির জীবনকথা জানাচ্ছে, প্রমথনাথ বিশীর ছোট ভাই মারা গেলে, শোক-সন্তপ্ত গোটা পরিবার বিভূতির কাছে এসেছিল। বিভূতি শ্লেটে দাগ টেনে মৃত ব্যক্তির আত্মার গতিপথ দেখিয়েছিলেন। তাঁদের এও বুঝিয়েছিলেন, আত্মার জন্য শোক করতে নেই! তাতে আত্মার দহন বাড়ে!
দিন যত ফুরিয়ে এসেছে, পরলোকে বিশ্বাস যেন তত বেড়েছে বিভূতির।
ঘাটশিলার বসতবাড়ি
শেষবেলায় ছেলে তারাদাস অসুস্থ হয়ে পড়লে, একদিন স্নান সেরে ফিরে নাকি দেখেছিলেন, ছেলের মাথার কাছে বসে রয়েছে কেউ। বিভূতি বুকে জড়িয়ে নেন তারাদাসকে। বলেন, ‘‘ওকে দেব না।’’
সেই বিদেহী আগন্তুক তখন নাকি বলে ওঠে, ‘‘তোমার ছেলের আয়ু নেই। ওকে যেতে দাও আমার সঙ্গে।’’
বিভূতি সন্তানকে আঁকড়ে বলেন, ‘‘আমার আয়ু দিচ্ছি। তুমি চলে যাও।’’
শেষবার যখন ঘাটশিলা গেলেন, এক সংবর্ধনা সভায় বক্তব্য রাখতে গিয়ে নিজের মৃত্যুর ইঙ্গিত দিলেন যেন!
মনে করতেন, মানুষের সংবর্ধনা মানেই সময় ফুরিয়ে এসেছে। তার আগেই ‘শেষ লেখা’ গল্পে সেই দেবযান-এর সুর।
পরলোকে বিশ্বাসের শিকড় ক্রমশ এত গভীরে গাঁথা পড়েছিল, সর্বক্ষণ মরণের কথা ভেবে গিয়েছেন শেষের দিনগুলোয়।
বিভূতিভূষণের ভাই নুটুর স্ত্রী যমুনা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘উপল ব্যথিত গতি’-তে বিভূতির শেষ সময়ের একটি বিশেষ ঘটনার কথা মেলে।
যমুনা লিখেছেন, ঘাটশিলায় মৃত্যুর কয়েক দিন আগে ফুলডুংরি ঘুরতে গেলেন। সঙ্গে অনেকেই। দল থেকে আলাদা হয়ে একটি জায়গায় নাকি দেখেন ছেঁড়া কাপড়ের টুকরো ছড়িয়ে। খান কয়েক পাথর সাজানো। একটি শববাহী খাট ওল্টানো। আর একটি খাটিয়ায় মৃতদেহ ঢাকা দেওয়া। বনের মধ্যে, বিভূতিভূষণ গিয়ে টান মেরে ঢাকা সরিয়ে ফেলেন!
তার পরেই তাঁর আর্ত চিৎকার!
এ কার শরীর!
ধড়ের উপর যে মুখটি, সেটি অবিকল তাঁর!

http://www.anandabazar.com/supplementary/patrika/%E0%A6%AE-%E0%A6%A4-%E0%A6%B8-%E0%A6%A4-%E0%A6%B0-%E0%A6%B0-%E0%A6%86%E0%A6%A4-%E0%A6%AE-%E0%A6%B0-%E0%A6%B8%E0%A6%99-%E0%A6%97-%E0%A6%95%E0%A6%A5-%E0%A6%B9%E0%A6%A4-%E0%A6%AA-%E0%A6%B2-%E0%A6%AF-%E0%A6%A8%E0%A6%9A-%E0%A6%9F-1.250436

কবে তৃষিত এ মরু ছাড়িয়া যাইব ( On Rajanikanta Sen)

$image.name

কবে তৃষিত এ মরু ছাড়িয়া যাইব

২১ নভেম্বর, ২০১৫, ০০:০৩:৫৪
2
ব্ল্যাক বোর্ডের উপরে সংস্কৃতে লেখা দুটো মাত্র লাইন।
যার বাংলা তর্জমা করলে দাঁড়ায়—
‘আমি সকল শিক্ষকের স্বভাব চাই করিতে বর্ণন/এই দুঃসাধ্য কাজে নিলাম দেবী সরস্বতীর স্মরণ।’
ক্লাসে ঢোকামাত্র বোর্ডের দিকে এক ঝলক চেয়ে সহপাঠী সব্বাই বুঝে গেছে এ কাজটি কার! কিন্তু দামাল-দস্যি রজনীকান্তকে কারও কিচ্ছুটি বলার হিম্মত নেই।
ও দিকে মাস্টারমশাইয়ের কথা ভেবেও তাদের হাড় হিম।
লাস্ট বেঞ্চে বসে রজনী কিন্তু নির্বিকার। মাঝে মাঝে এপাশ-ওপাশ তাকাচ্ছে সে। আর মিটিমিটি হাসছে।
মাস্টারমশাই ক্লাসে আসার পরেও নিরুত্তাপ রজনী। বোর্ডে চোখ বোলালেন মাস্টার। এর পর তাঁর মুখচোখই বলে দিল কীর্তিমানটি কে, বুঝেছেন তিনি।
ডাক পড়ল রজনীর।
এই হল কিশোরবেলার রজনীকান্ত সেন। ক্লাসের মার্কামারা দুষ্টু ছেলে। পড়াশোনা, খেলাধুলোয় চ্যাম্পিয়ন। আবার দুষ্টুমিতেও পয়লা নম্বর।
গম্ভীর গলায় মাস্টার বললেন, ‘‘আমার স্বভাবই না হয় বর্ণনা করো তুমি। দেখি তোমার ক্ষমতা কেমন!’’
নির্বিকার রজনী হাসতে হাসতে বলল, ‘‘স্যার আপনার ক্লাসে এসে ঘুমোনোর কথাটা তো লিখিনি।’’
এ কথা শুনে সবাই ধরে নিয়েছিল, মারের চোটে রজনী এ বার আস্ত থাকলে হয়! উল্টে দেখল, তেমন কিছুই বললেন না গুরুমশাই।
আসলে রজনীর লেখালেখির অভ্যাস ছোট থেকেই। তাতে প্রশ্রয়ই দিতেন ওঁরা। পক্ষপাতিত্বও থাকত। এক এক সময় কোনও মাস্টারমশাইয়ের বিদায়-সভাতেও কবিতা লিখে শোনানোর ভার পড়ত রজনীর উপরই।
কিশোর রজনীকান্ত এ স্বভাব পায় তার বাবা-জ্যাঠার থেকে। বাবা গুরুপ্রসাদ সেন। জ্যাঠা গোবিন্দনাথ সেন।
দৌহিত্র দিলীপকুমার
বয়স তখন চোদ্দো কী পনেরো, সংস্কৃত কবিতা লিখে বন্ধু তারকেশ্বরের সঙ্গে দেওয়ানেওয়া করা ছিল রজনীর এক প্রিয় খেলা। এই তারকেশ্বর আবার, বলা যেতে পারে, রজনীর প্রথম সঙ্গীতগুরু।
এ নিয়ে তারকেশ্বর পরে এক জায়গায় বলেছিলেন, ‘‘চৌতাল, সুর ফাঁক প্রভৃতি একবার করিয়া তাহাকে দেখাইয়া দিতাম, তাহাতেই সে তাহা আয়ত্ত করিত এবং ওই সকল তালের মধ্যে আমাকে সে এমন কূট প্রশ্ন করিত যে আমার অল্পবিদ্যায় কিছুই কুলাইত না।’’
দুষ্টুমিতে প্রখর। অন্য দিকে সঙ্গীতে গুণপনা তাঁর ষোলো আনা। রজনীর গান শুনলে যেন সবার সম্মোহন হত। আবার গাইতে বসলে রজনীও যেন বাহ্যজ্ঞানশূন্য!
এক দিনের কথা।
রজনী তখন অবশ্য প্রাপ্তবয়স্ক। সন্তানের পিতাও বটে।
মজলিস বসেছে বৈঠকখানায়। বন্ধুরা হাজির। কটা সাহেব, দেবেন চক্রবর্তী…। বরাবরের মতো গাইতে বসে এ বারও হুঁশ নেই রজনীর।
এ দিকে ভিতর-বাড়িতে  তখন হুলুস্থূল কাণ্ড!
রজনীকান্তের এক ছেলে ঘোরতর অসুস্থ। বেশ কয়েক বার চাকরকে দিয়ে স্বামীকে ডাক পাঠিয়েছেন স্ত্রী হিরণ্ময়ী। গানে বিভোর রজনীর নাগাল পায়নি সে। বার বারই বৈঠকখানায় গিয়ে অপেক্ষা করে ফিরে যেতে হয়েছে তাকে।
তিন-চারবারের পর এক বন্ধুর নজরে এল। কে এক জন রজনীকে ডাকতে এসে ফিরে যাচ্ছে বারবার। তাঁর ঠ্যালাতেই এ বার ধ্যান ভাঙল যেন রজনীর। অন্দরে গেলেন তিনি।
দেখলেন, দালানে অসুস্থ ছেলে কোলে বসে হিরণ্ময়ী। অবসন্ন, অসহায় চোখে তাকিয়ে! কেঁদে চলেছেন অঝোর ধারায়। নিজেকে তখন মস্ত পাপীর মতো লাগছিল রজনীর!
পরে এই ঘটনাই বুকে ধরে রজনীকান্ত গান লিখেছিলেন—
‘স্নেহ বিহ্বল করুণা ছল ছল
শিয়রে জাগে কার আঁখি রে
মিটিল সব ক্ষুধা সঞ্জিবনী সুধা
এনেছে অশরণ লাগিরে।’
রজনীকান্তর জীবনে হিরণ্ময়ীর আসাটাও ভারী অদ্ভুত এক গল্প।
১২৯০ বঙ্গাব্দ। ৪ জ্যৈষ্ঠ।
ও দিনই বিয়ে হয় রজনীর। নাবালিকা হিরণ্ময়ীর সঙ্গে।
ঢাকা জেলার মানিকগঞ্জ মহকুমার স্কুল বিভাগের ডেপুটি ইন্সপেক্টর তারকনাথ সেন।  হিরণ্ময়ী তাঁর মেয়ে। তখন সবে ইস্কুলের ছাত্রী।
কন্যা সম্প্রদানের সময় এল।
চার হাত এক করতে চলেছেন পুরোহিত। ঠিক সেই সময় বাঁধল গোল।
রজনীর বাবা চিৎকার করে উঠলেন, ‘‘না না এ বিয়ে কিছুতেই হতে পারে না!’’
মেয়ে-বাড়ির লোকের মাথায় বজ্রাঘাত। মেয়ে লগ্নভ্রষ্টা হবে নাকি!
হট্টগোল লেগে গেল নিমেষেই। তখন কে কার কথা শোনে!
অত চিৎকারের মধ্যেই হিরণ্ময়ীর জ্যাঠা কোনও ক্রমে বললেন, ‘‘কেন, কোথায় কোন ত্রুটি পেলেন আপনারা? সব তো ঠিকই ছিল এতক্ষণ।’’
রজনীর জ্যাঠামশাই গোবিন্দনাথ এ বার গলা চড়িয়ে বলে উঠলেন, ‘‘মেয়ের হাতে শাঁখা পলা কই, এ কি ব্রাহ্ম বিয়ে হচ্ছে?’’
এত ক্ষণে বোঝা গেল আপত্তির কারণ!
মেয়ে-বাড়ির লোক হিরণ্ময়ীর লেসওয়ালা জ্যাকেটের হাতা থেকে লেস উঠিয়ে দেখালেন, সোনার গয়নার উপর জ্বলজ্বল করছে শাঁখা।
তখন শান্ত হল বরপক্ষ।
সে-সময়কালে চেলি আর চাদর ছাড়া অন্য কোনও বেশ পরে বিয়ে ছিল নৈব নৈব চ। মেয়ের বাড়ি এত নিয়মের ধার ধারেনি। কিন্তু রজনীর পরিবার যে গোঁড়া হিন্দু।
ফলে গোল বেঁধেছিল গোড়াতেই।
শেষে অবশ্য নির্বিঘ্নেই মিটল বিয়ে।
বাসর রাত।
নতুন জামাইবাবুকে ঘিরে ধরেছে শ্যালিকার দল।
গান না শুনে তাঁকে ছাড়া হবে না। ছোট থেকে যতই চঞ্চল হোক রজনী, ঈশ্বর-প্রেমে সে বরাবরই মশগুল।
শ্যালিকাদের মন রাখতে সে দিন জামাইবাবুটি যে গান ধরলেন, তা’ও ওই ঈশ্বরভক্তিরই।—‘‘মধুর হাসিনী মধুর ভাষিণী, শ্যাম বিলাসিনী রে।’’
বিয়ে মিটল।
কিন্তু ওই পর্যন্তই।
হিরণ্ময়ীকে থাকতে হল স্বামীর কাছে নয়,  দেশের বা়ড়িতে। রজনীকান্ত রাজশাহীতে, আইনের ছাত্র। স্বামী-স্ত্রীর যোগাযোগ বলতে তখন কালেভদ্রে এক-দুটো চিঠি!
পরে অবশ্য ‘বউমা’ হিরণ্ময়ীকে নিয়ে পাকাপাকি ভাবে রাজশাহীতে চলে এসেছিলেন রজনীর মা।
তখন রজনীকে দেখে কে!
তত দিনে তিনি ওকালতি ধরেছেন। কিন্তু নতুন বউকে পেয়ে শুরু হল কাজে ফাঁকি। আদালতের চেয়ে বাড়িতেই সময় কাটে বেশি।
আর হিরণ্ময়ী?
একগলা ঘোমটা টেনে বালিকা বধূ স্বামীকে খাবার দেয়। পান সেজে আনে। স্বামীর ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে আলগোছে সে-পান দিয়ে দেয়।
স্বামীর তাতে খুব গোঁসা।
বউয়ের সামনেই এক দিন রজনী মায়ের কাছে অনুযোগ করে বসলেন, ‘‘আমি কি এতই অস্পৃশ্য যে হাতে করে পানটিও দেওয়া যায় না?’’
লজ্জায় এক ছুট্টে বারান্দা ছেড়ে পালিয়ে বাঁচে হিরণ্ময়ী!
রাজশাহীর বসতবাড়ি (অধুনা বিলুপ্ত)
বছর ঘুরল।
নতুন বউয়ের আড় কিছুটা যেন ভাঙল।
হিরণ্ময়ী তত দিনে রজনীর আদরের হিরু। তাও স্বভাব যে পুরোপুরি বদলে গেল, তেমন নয়।
এই সময়কালেরও পরের কথা রজনীকান্তের মেয়ে শান্তিলতাদেবীর লেখায়।
তিনি এক জায়গায় বলেছেন, “বাবা বারান্দায় চেয়ারে বসতেন কোর্ট থেকে এসে। সেই সময়টা ছিল আমাদের সবারই একটা আনন্দের সময়। সবাইকে এসে বসতেও হত।... ঠাকুমা তখন জলখাবার সাজিয়ে দিতেন মায়ের হাতে। মা সেই শ্বেতপাথরের রেকাবিতে সরভাজা, ছানার পায়েস, ক্ষীরের সন্দেশ, পাথরের গেলাসে বেলের শরবত বাবার সামনে এনে দিতেন। বাবা বলতেন, মা, রাঙা বউ এগুলি কাকে দিয়ে গেলেন তা তো বুঝতে পারলাম না।’’
•••
দেখতে শুনতে গম্ভীর লাগলেও রজনীকান্ত বরাবরই রসিক!
এমনকী প্রাপ্তবয়স্ক রজনীর এক-এক রসিকতায় মাঝে মাঝে তাঁর কৈশোর উঁকি মেরে যেত।
ছুটির দুপুরবেলা।
শোয়ার ঘরে গা এলিয়ে ঘুমোচ্ছেন হিরণ্ময়ীদেবী। সঙ্গে আরও অনেকে।
কারও হুঁশ নেই তেমন।
রজনীকান্ত হঠাৎ ঘরে ঢুকে কারও লম্বা চুল বেঁধে দিতেন খাটের পায়ার সঙ্গে। কিংবা এর চুলের সঙ্গে ওর হাত। ঘুম ভাঙলে খেয়াল পড়ত সকলের। তবে তাঁদের বুঝতে অসুবিধা হত না, এর পিছনে কার হাত!
সুযোগ বুঝে দোয়াত-কলম নিয়ে কারও গোঁফ বা কারও ত্রিনয়ন এঁকে দিতেও পিছপা হতেন না রজনীকান্ত।
এমনকী অপকাণ্ড ঘটিয়ে তার মজা দেখতে ঘরের এক কোনায় অপেক্ষা করতেন তিনি চুপিসাড়ে। সকলের ঘুম ভাঙলেই হাততালি দিয়ে হেসে গড়িয়ে এক ছুট্টে হাওয়া।
আরও আছে!
তার এক-আধটি তো রীতিমতো মারাত্মক!
হিরণ্ময়ীর সেমিজের মধ্যে হামেশাই পুকুর থেকে জোঁক এনে ছেড়ে দিতেন স্বয়ং রজনীকান্ত। অল্প দূরে দাঁড়িয়ে তারও ‘মজা’ দেখা চাই।
পিঠের দিকে ঠাণ্ডা কী একটা নড়ছে, বুঝে হিরণ্ময়ীর অস্বস্তি।
দেখে যেন ‘কী হয়েছে কিছুই জানেন না’, এমন ভাব করে এসে রজনীকান্ত এসে দাঁড়াতেন, ‘‘রাঙাবউ, অমন করছ কেন? কী হল পিঠে, দেখাও দেখি!’’
লজ্জায় আরক্ত হিরণ্ময়ীর আগল ভেঙে তাঁকে ‘জোঁক’মুক্ত করতেন প্রেমাতুর রজনী।
•••
রজনীর একটি গান নিয়ে একবার ভয়ানক অভিমান হিরণ্ময়ীর! 
রজনী লিখলেন, ‘কবে তৃষিত এ মরু ছাড়িয়া যাইব তোমারি রসালো নন্দনে।’
রেগে গিয়ে হিরণ্ময়ীদেবী বললেন, ‘‘শেষে কী না এই গান লিখলে? তোমার জীবনকে কি আমি এতই দুর্বিষহ করে তুলেছি, যে তা তৃষিত মরু হয়ে গিয়েছে?’’
রজনী কিন্তু অত কিছু ভেবে আদৌ লেখেননি। তবু আহত হিরণ্ময়ীর মন রাখতে কথা দিলেন তিনি, এই গানটি নিজে আর কোনও দিন গাইবেন না। শুধু ছেলেমেয়েদের শেখাবেন। যাতে তাঁরা গাইতে পারে।
হিরণ্ময়ী ছিলেন তাঁর এতটাই প্রাণ!
সংসারের দশটা পাঁচটার ঘড়ির সঙ্গে কোনও দিনই তাল মেলাতে পারেননি রজনী।
কোর্ট থেকে ফিরে মায়ের কাছে এসে বলতেন, “মা পকেট কিন্তু শূন্য। কোর্টে যাই আসি। কিছুই পাইনে। আমার মনে হচ্ছে ওকালতি আমার হবে না।’’
মা আশ্বাস দিতেন— “এত ব্যস্ত কি রজনী, টাকা অত সহজে আসে না। নাই বা এল? তোমার টাকা না হলে কি চলবে না?”
রজনীকান্তের এমন অনেক গল্পের ভাঁড়ার এখনও মজুত ওঁর নাতি দিলীপকুমার রায়ের কাছে।
আটানব্বই বছরের দিলীপকুমার থাকেন কলকাতার দক্ষিণে। বংশের অর্থাভাব তাঁকেও ছুঁয়ে গেছে এক সময়।
যে জন্য দাদামশাইয়ের নামে তিনি যেমন নত হন, তেমন অভিমানও লুকিয়ে রাখেন না।
ডোভার টেরাসে তাঁর বাড়ির এক তলায় বসে দিলীপবাবু বলছিলেন, ‘‘দেখেছি, মা-মাসি-মামারা কেমন অদ্ভুত চুপ থাকত দাদামশাইকে নিয়ে। এমনকী দিদিমাও তাঁকে নিয়ে খুব একটা কিছু বলতেন বলেও মনে পড়ে না। ছোটবেলায় একবার দিদিমাকে দাদামশাই নিয়ে অনেক কিছু জানতে চেয়েছিলাম। সে বার দেখলাম, হঠাৎ উনি রেগে গেলেন। বললেন, যাঁর মৃত্যুর পর দিন জানতাম না ছেলেমেয়েদের কী ভাবে মুড়িটুকু খেতে দেব, তাঁকে নিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করবি না!’’
পরে মায়ের কাছে অবশ্য দাদামশাইয়ের অনেক গল্প  পেয়ে ঝুলিতে রসদ পুরেছেন দিলীপবাবু।
তেমনই এক রজনী-কাহিনি শোনা ওঁর কাছে—
সকালবেলা তখনও ঘুমের আমেজ ভাঙেনি। গত রাতের আলিস্যি ছড়িয়ে রয়েছে বাড়ির এ দিক, ও দিক।
বারান্দায় বসে রজনী।
তামাক সাজিয়ে দিল বাড়ির কাজের লোক।
স্নান, পুজো সেরে মা-ও এসে বসেছেন ছেলের পাশে। এই সময়গুলো প্রায় দিন এমনই কাটত।
এক্কেবারে একান্তে মা আর ছেলের।
মা বললেন, ‘‘রজনী তোমার লেখা একটা গান গাও তো।’’
ছেলে আলবোলা সরিয়ে গান ধরলেন, ‘‘তুমি অরূপ স্বরূপ স্বগুণ নির্গুণ দয়াল ভয়াল হরি হে…।’’
—কেমন লাগল মা?
—কেমন লাগল কী বলব বাবা! এ কথা তুমি কোথায় পেলে? এ সুরই বা তোমাকে কে দিল? এতেই তুমি ডুবে থাকো বাবা। আমার আর বুঝবার কিছু নেই!
রজনী উঠে যেতেন খুশি হয়ে।
এতটাই মা-অন্ত রজনী, কোর্টে যাবার আগে জটিল মামলার বিষয়গুলো নিয়েও মা-র সঙ্গে কথা না বলে গাড়িতে উঠতেন না তিনি। মা না-ই বা হলেন উকিল, রজনীর তাতে কী’ইবা এসে যায়!
বিকেলে ফিরে সারাদিনের রোজগার তুলে দিতেন মায়ের হাতেই। আর ছেলেমেয়েদের জন্য বরাদ্দ ছিল  একটি করে  তামার পয়সা।
বড় মেয়ে শান্তিলতা বলেছেন, “যেগুলি রুপোর টাকার মতো ঝকঝক করত, সেগুলি বাবা আমাদের ছোটদের দিতেন। আমরা তাতেই খুব খুশি থাকতাম।’’
এক দিন মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গিয়েছে শান্তিলতার। ছোট্ট মেয়ে। মা-বাবার পাশেই ঘুমোত সে।
চোখ খুলতেই দেখে, বাবা নেই।
বাবা কোথায়!
ঘুমমাখা চোখে ঘরের মধ্যে ইতিউতি তাকাতেই শান্তিলতা দেখতে পেল, টেবিলে বসে বাবা কী যেন লিখছেন। তবে সেই ‘বাবা’ ঠিক যেন তার চেনা ‘বাবা’ নয়। অচেনা। দূরের কেউ। সাধকপুরুষেরা যেমন হন, তেমন।
আধো আলো। আধো অন্ধকার। তার মধ্যেই বিভোর হয়ে লিখে চলেছেন রজনীকান্ত। ঈশ্বর, সঙ্গীতসাধনা, মানবপ্রেমের এক আশ্চর্য দ্যুতি যেন তাঁকে ঘিরে রয়েছে।
শান্তিলতা পরে বলেছেন, ‘‘ভোর বেলায় বিছানায় বসেই সেই গানে সুর দিয়ে নিজেই গুনগুন করে গাইছেন (বাবা), এই অপূর্ব দৃশ্য, অপূর্ব অনুভূতি প্রত্যক্ষ করেছি।’’
অন্ধকারের পর্দা সরিয়ে তখন সবে মাত্র আলো ফুটছে। ঘুম ভাঙেনি কারও। রজনীকান্ত উঠে পড়ে ছেলেমেয়েদের ডাকলেন, “চলো। বেরোতে হবে।’’
সবাই অবাক।
—এখন! কোথায়?
তার বেশি প্রশ্ন করার ফুরসত পেল না কেউ। বাবার কথামতো রাস্তায় নেমে পড়ল সকলে।
বেরিয়ে দেখে আরও অনেকে ইতিমধ্যে হাজির হয়ে গিয়েছে। সদলবলে শুরু হল নগর পরিক্রমা। খঞ্জনি বাজিয়ে গান গেয়ে চলেছেন রজনীকান্ত, ‘‘আমরা নেহাত গরিব, নেহাত ছোট, তবু আছি সাত কোটি ভাই জেগে ওঠো।’’
গলা মেলালেন অনেকে।
শেষ জীবনে অসুস্থ রজনী
স্বদেশী। স্বাধীনতা।
রজনী জড়ালেন সেখানেও।
মায়ের কাছে দিলীপবাবু শুনেছেন, বিলিতি সাদা নুন নিষিদ্ধ ছিল তাঁদের বাড়িতে। বদলে চলত কালো কালো সৈন্ধব লবণ বা করকচ লবণ। চিনিও কাশীর চিনি। সে প্রায় ধুলোর মতো।
এক বার কলকাতায় এসেছেন রজনীকান্ত। কাজ সেরে ফিরে যাবার দিন দেখা হল আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের সঙ্গে।
কথায় কথায় তিনি বললেন, ‘‘শোনো রজনী, আমার ছেলেদের দিকে চাও! ওদের কিছু দাও। ওদের সামনে এসে দাঁড়াও।’’
ওখানেই উপস্থিত ছিলেন জলধর সেন। তিনিও গলা মেলালেন, ‘‘রজনী ভায়া একটা গান বেঁধে দাও এই ছেলেদের। এরা কিছু পাচ্ছে না। তুমি কথা দাও, সুর দাও। এদের হাতে দেশকে ভালোবাসার মন্ত্র দাও। এরা পথের নিশানা পাক।’’
নিঃশব্দে ঘরে গেলেন রজনী। লিখলেন। সুর দিলেন।
বাইরে বেরিয়ে সবার সামনে গলায় ধরলেন, ‘‘মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নেরে ভাই।’’
দীনদুখিনী মায়ের জন্য গলা মিলিয়ে পথে নামলেন ছেলেরা। একেবারে সামনের সারিতে রজনীকান্ত সেন।
শিয়ালদা হয়ে সারকুলার রোড ধরে মিছিল চলেছে। পা মেলাতে পাশে রইলেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীরা।
•••
সে দিনও ঠাকুরঘরে মায়ের সঙ্গে বসেছিলেন রজনীকান্ত। পুজো শেষে মায়ের দেওয়া পুজোর পান খেলেন এক খিলি।
পানের চুনে ঝাঁঝ লেগে রজনীকান্তের গলাটা একটু পুড়ে গেল যেন। এমন তো কতই হয়!
তখন কে জানত, সেই হল শেষের শুরু! কেউ বুঝতেও পারেনি ওই গলার ‘পোড়া’ আসলে জীবনটাকেই পুড়িয়ে খেতে আসছে!
দিব্যি গান গেয়ে চললেন রজনীকান্ত। বাড়তে লাগল গলার সেই ব্যথা। তার সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসাও।
ফল দিচ্ছিল না কিছুতেই।
দিলীপবাবু বললেন, ‘‘শুনেছিলাম তাঁর চিকিৎসায় এক বার কাশীতে এক মহারাজের কাছে গিয়েছিলেন সবাই। তখন এক অদ্ভুত কাণ্ড ঘটে। শোনা থেকে আজও অবধি সে-কথা ভুলতে পারিনি। ওখানেই নাকি হঠাৎ একদিন হারিয়ে গিয়েছিল দাদামশাইয়ের ছোট মেয়ে। আমার ছোট মাসি।’’
নৌকোয় করে একটু ঘুরবেন বলে সবাই মিলে বেরিয়েছিলেন সে দিন। কিন্তু কিছু দূর এসে দেখা গেল রজনীর ছোট মেয়ে পাশে নেই।
অতটুকু মেয়ে! কোথায় গেল সে! খোঁজ খোঁজ।
তখন সন্ধে হব হব প্রায়।
হঠাৎ দশাশ্বমেধ ঘাটের চওড়া সিঁড়িতে, একী! কে বসে...?
অবাক হয়ে সবাই দেখেন, এ যে তাঁদের সবার আদরের ছোট মেয়ে!
কী করে যে ওখানে চলে গিয়েছিল সে, কিছুই বলতে পারেনি পরে।
দিলীপবাবু বলছিলেন, ‘‘মায়ের কাছে শুনেছি ওই বয়সে ওই অবস্থাতে ছোট মাসি গান গাইছিল, বল দাও মোরে বল দাও, প্রাণে দাও মোরে শকতি!’’
স্ত্রী হিরণ্ময়ীদেবী
২৮ মাঘ, ১৩১৬।
সারা রাত যন্ত্রণার পরে অপারেশন টেবিলে নিয়ে যাওয়া হল রজনীকান্তকে। চিকিৎসকেরা জানিয়ে দিয়েছেন, ট্র্যাকিওটমি ছাড়া আর কোনও উপায় নেই।
মেডিকেল কলেজে ক্যাপটেন ডেনহাম হোয়াইট একটা বড়সড় দল নিয়ে গলায় অস্ত্রোপচার করতে ঢুকলেন রজনীকান্তের।
অপারেশন হয়ে গেল।
বেডে নিয়ে আসা হল রজনীকান্তকে।
জ্ঞান ফিরছে ধীরে ধীরে। গলায় ব্যান্ডেজ বাঁধা। সামনে লাগানো নল।
হিরণ্ময়ীকে দেখে ক্ষীণ স্বরে বললেন, ‘‘এই দেখো, কী রকম ব্যবস্থা করে যতীন আমাকে বাঁচিয়ে দিয়ে গেল। ডাক্তার দেবতা।’’  যতীন, চিকিৎসক যতীন দাশগুপ্ত, রজনীর আত্মীয়।
 ব্যাস! এটুকুই যা বলতে পেরেছিলেন। তার পর কে যেন অলক্ষ্যে এসে কণ্ঠ থেকে স্বরটুকু ছিঁড়ে নিয়ে গেল তাঁর।
সকলে স্তব্ধ।
সুরস্রষ্টার গলায় আজ শব্দটুকুও নেই! শেষ কয়েক মাস খাতা পেন্সিলই ছিল রজনীকান্তের কথা বলার একমাত্র সম্বল।
মেডিকেল কলেজের পাশেই ইডেন হাসপাতাল রোডের ১২ নম্বর কটেজ। ওখানেই কাটতে লাগল রজনীকান্তের পরের দিনগুলো।
দেখা করে যেতেন অনেকে।
একে একে। দল বেঁধে। রামতনু লাহিড়ীর ছেলে শরৎ কুমার লাহিড়ী, রামেন্দ্রসুন্দর, সুধীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দী, গিরিশ ঘোষ…।
থিয়েটার করে রজনীকান্তের চিকিৎসার জন্য টাকা তুলে দিলেন গিরিশ ঘোষ। তা জেনে লজ্জিত রজনী খাতার উপর পেন্সিল বুলিয়ে জানতে চাইলেন, ‘‘আমাকে বাঁচিয়ে রেখে কী লাভ বলতে পারিস?... ঋণী হয়ে রইলাম যে...।’’
১৩১৭, জৈষ্ঠ্য মাস।
অসুস্থ কবিকে দেখতে এলেন রবীন্দ্রনাথ। বহু বার দুই কবির দেখা হয়েছে সভা-সমিতি বা ব্রাহ্ম সমাজের নানা অনুষ্ঠানে। তবে শেষ দিনগুলোয় আবার রবি-সান্নিধ্য পাবার ইচ্ছে হয়েছিল রজনীকান্তের।  সে ইচ্ছেও পূরণ হল তাঁর।
কটেজের কাছে গাড়ি এসে থামল। রজনীকান্তের সামনে এসে দাঁড়ালেন রবীন্দ্রনাথ। দু’জনে দু’জনের দিকে নিঃশব্দে চেয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। আনমনা কবি এক সময় অস্ফুটে বলে উঠলেন, ‘‘এ কাকে দেখতে এসেছি। কাকে দেখছি!’’
রাজশাহীতে যখন পড়ছেন রজনীকান্ত, সে সময় রাজশাহী-থিয়েটারে রবীন্দ্রনাথের ‘রাজা ও রানী’ নাটকে রাজার ভূমিকায় অভিনয় করলেন তিনি।
‘...এ রাজ্যতে
যত সৈন্য, যত দুর্গ, যত কারাগার
যত লোহার শৃঙ্খল আছে, সব দিয়ে
পারে না কি বাঁধিয়া রাখিতে দৃঢ়বলে
ক্ষুদ্র এক নারীর হৃদয়।... ’
রজনীকান্তর ‘রাজা’ হৃদয় ছুঁয়েছিল রাজশাহীর। বড় সাধ ছিল সে সংলাপ স্বয়ং কবির সামনে বলবেন তিনি। সে আর পূরণ হল না।
মৃত্যুর রাজাসনে বসে তখন দয়ালের অপেক্ষা করছেন কান্তকবি!
বোলপুরে ফিরে রবীন্দ্রনাথ চিঠি লিখেছিলেন, ‘‘সে দিন আপনার রোগশয্যার পাশে বসিয়া মানবাত্মার একটি জ্যোতির্ময় প্রকাশ দেখিয়া আসিয়াছি।... শরীর হার মানিয়াছে কিন্তু চিত্তকে পরাভূত করিতে পারে নাই।... কাঠ যত পুড়িতেছে অগ্নি আরও তত বেশী করিয়াই জ্বলিতেছে।...’’
সেই অবশিষ্ট কাঠটুকুও এক দিন পুড়ে খাক হয়ে গেল!
২৮ ভাদ্র, ১৩১৭। রাত্রিবেলা।
কান্তকবির শেষ যাত্রায় পা মেলালেন ওঁর সুহৃদেরা।
হিরণ্ময়ীকে কথা দিয়েছিলেন, একটি গান সারা জীবনে তিনি গাইবেন না কখনও। তবে সে গান যেন তাঁর অন্তিম লগ্নে গাওয়া হয়।
এটুকুই ইচ্ছে ছিল তাঁর শেষ ইচ্ছা!
কবির দেহ বেরোল মেডিকেল কলেজের কটেজ থেকে।
সামনে জনতার ঢল।
সবাই গলা মিলিয়েছেন—
‘‘কবে তৃষিত এ মরু
ছাড়িয়া যাইব
তোমারই রসালো নন্দনে...
কবে তাপিত এ চিত
করিব শীতল
তোমারই করুণা চন্দনে।’’
তখন সবে সূর্যের প্রথম আলো দেখবে বলে আড় ভাঙছে আরও একটি দিন!

http://www.anandabazar.com/supplementary/patrika/%E0%A6%95%E0%A6%AC-%E0%A6%A4-%E0%A6%B7-%E0%A6%A4-%E0%A6%8F-%E0%A6%AE%E0%A6%B0-%E0%A6%9B-%E0%A6%A1-%E0%A7%9F-%E0%A6%AF-%E0%A6%87%E0%A6%AC-1.245175