উত্তমসমগ্র
নিজের লেখালেখিতে ধরা এ কোন মহানায়ক! ভারাক্রান্ত। উত্তেজিত। অভিমানী। একা। ২৪ জুলাই তাঁর চলে যাওয়ার সাড়ে তিন দশক। লিখছেন দেবশঙ্কর মুখোপাধ্যায়
আমার চারপাশে ঘন অন্ধকার। নিকষ কালো অন্ধকার। অথচ আমি দাঁড়িয়ে আছি একটি আলোকিত বৃত্তের মধ্যে।…
কিন্তু আমি জানি, এই আলো এই উজ্জ্বলতা কিছুই দীর্ঘস্থায়ী নয়। যে কোনও মুহূর্তে নিভে যেতে পারে।…
আমাকে নিক্ষেপ করতে পারে আরও গভীর, গভীরতর অন্ধকারে। … এই… অন্ধকারের ওপারেই আছে আলোর জগৎ। …
এক দিন সেই আলোর জগৎ থেকেই আমি এসেছিলাম। এসেছিলাম অনেক অন্ধকার পেরিয়ে।…
কথাগুলো তাঁরই।
তত দিনে তিনি শুধুই নায়ক নন, প্রায় মহানায়ক।
১৯৬৮ সাল। ‘শাপমোচন’, ‘সাগরিকা’, ‘পথে হল দেরী’, ‘হারানো সুর’ পেরিয়ে প্রায় সওয়া শো’রও বেশি ছবি করে ফেলেছেন।
তবু, ফেলে আসা জীবনের জলজ্যান্ত সংলাপ লিখতে বসে এতটাই ভাবাবেগ তাঁর!—
‘‘মনে পড়ছে, আস্তে আস্তে সব মনে পড়েছে। কী দুঃসহ অপমান লাঞ্ছনা সহ্য করতে হয়েছে সে দিন।’’
নরেশ মিত্রর ‘বৌঠাকুরাণীর হাট’-এর কাজ চলছে। হাতে এল অন্য আর একটি ছবি।—
‘‘বাজারে কিছু নাম-ধামও হয়েছে। কনট্র্যাক্ট ফর্মে সইটুকু কেবল বাকি। ছবির মহরতের দিন ঠিক হল। আমাকে দিয়েই মহরত দৃশ্যটি গ্রহণ করা হবে। যথা সময়ে স্টুডিয়োতে গিয়ে দেখলাম আমার জায়গায় মেকআপ নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন আর একজন শিল্পী।
ক্ষোভে দুঃখে অপমানে চোখ ফেটে জল বেরিয়ে এসেছিল। লজ্জায় কারও দিকে তাকাতে পারিনি। আস্তে আস্তে বেরিয়ে এসেছিলাম সেখান থেকে।’’
এক লাঞ্ছনার কথা লিখতে বসে আরও এক লাঞ্ছনা মনে পড়ে যায়।
অনেক পরীক্ষার পর কোনও একটি ছবিতে নির্বাচিত হয়েছেন। সে বারও কনট্র্যাক্ট ফর্মে সই করার মুহূর্তে খবর পেলেন, ‘‘আমার সইয়ের প্রয়োজন ফুরিয়েছে। আমার থেকেও অনেক বড় একজন শিল্পীকে তাঁরা রাজি করিয়েছেন। এত দিন তাঁর সঙ্গে বনছিল না বলেই এঁরা দয়া করে আমায় সুযোগ দিয়েছিলেন।’’
কিন্তু আমি জানি, এই আলো এই উজ্জ্বলতা কিছুই দীর্ঘস্থায়ী নয়। যে কোনও মুহূর্তে নিভে যেতে পারে।…
আমাকে নিক্ষেপ করতে পারে আরও গভীর, গভীরতর অন্ধকারে। … এই… অন্ধকারের ওপারেই আছে আলোর জগৎ। …
এক দিন সেই আলোর জগৎ থেকেই আমি এসেছিলাম। এসেছিলাম অনেক অন্ধকার পেরিয়ে।…
কথাগুলো তাঁরই।
তত দিনে তিনি শুধুই নায়ক নন, প্রায় মহানায়ক।
১৯৬৮ সাল। ‘শাপমোচন’, ‘সাগরিকা’, ‘পথে হল দেরী’, ‘হারানো সুর’ পেরিয়ে প্রায় সওয়া শো’রও বেশি ছবি করে ফেলেছেন।
তবু, ফেলে আসা জীবনের জলজ্যান্ত সংলাপ লিখতে বসে এতটাই ভাবাবেগ তাঁর!—
‘‘মনে পড়ছে, আস্তে আস্তে সব মনে পড়েছে। কী দুঃসহ অপমান লাঞ্ছনা সহ্য করতে হয়েছে সে দিন।’’
নরেশ মিত্রর ‘বৌঠাকুরাণীর হাট’-এর কাজ চলছে। হাতে এল অন্য আর একটি ছবি।—
‘‘বাজারে কিছু নাম-ধামও হয়েছে। কনট্র্যাক্ট ফর্মে সইটুকু কেবল বাকি। ছবির মহরতের দিন ঠিক হল। আমাকে দিয়েই মহরত দৃশ্যটি গ্রহণ করা হবে। যথা সময়ে স্টুডিয়োতে গিয়ে দেখলাম আমার জায়গায় মেকআপ নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন আর একজন শিল্পী।
ক্ষোভে দুঃখে অপমানে চোখ ফেটে জল বেরিয়ে এসেছিল। লজ্জায় কারও দিকে তাকাতে পারিনি। আস্তে আস্তে বেরিয়ে এসেছিলাম সেখান থেকে।’’
এক লাঞ্ছনার কথা লিখতে বসে আরও এক লাঞ্ছনা মনে পড়ে যায়।
অনেক পরীক্ষার পর কোনও একটি ছবিতে নির্বাচিত হয়েছেন। সে বারও কনট্র্যাক্ট ফর্মে সই করার মুহূর্তে খবর পেলেন, ‘‘আমার সইয়ের প্রয়োজন ফুরিয়েছে। আমার থেকেও অনেক বড় একজন শিল্পীকে তাঁরা রাজি করিয়েছেন। এত দিন তাঁর সঙ্গে বনছিল না বলেই এঁরা দয়া করে আমায় সুযোগ দিয়েছিলেন।’’
অপমান! এ ভাবেই। বারবার। তবু থেমে যাননি। এক দরজা থেকে ধাক্কা খেয়ে অন্য কারও কাছে ছুটে গিয়েছেন।— ‘‘দয়া করে সুযোগ দিন। আমায় প্রমাণ করতে দিন আমি অযোগ্য নই।’’
লিখতে লিখতে এক-এক সময় উঠে আসছে অভিমান, অনুযোগও। সহশিল্পীদের জন্য।— শুধু প্রযোজকদের দোষ দিয়ে কী লাভ! অন্যের সঙ্গে কথা পাকা হয়ে গেছে জেনেও এক জন শিল্পী কী করে সেই একই ছবির অফার ঈশ্বরের আশীর্বাদের মতো প্রসন্নচিত্তে নিয়ে ফেলেন— অবিশ্বাস্য লেগেছে তাঁর! ভদ্রতা হিসেবেও তো জিজ্ঞেস করা উচিত, কেন বাদ পড়লেন তিনি!
লিখছেন, ‘‘এখানে যে যার নিজের স্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত। কিন্তু এ ভাবে কত দিন চলবে? সৌমিত্র, অনুপ, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়কে এগজিবিটররা বয়কট করতে চাইছে, তাতে উত্তমকুমারের কী ক্ষতি! তাকে তো আর বয়কট করেনি কেউ। তবে কী দরকার তার ও সব নিয়ে মাথা ঘামিয়ে?
এই সহজ সরল কথাটা তো একটা শিশুতেও বুঝতে পারে। কিন্তু উত্তমকুমার চট্টোপাধ্যায় বুঝতে পারছে না কেন? তাঁকে যে দিন দরজা থেকে দরজায় মাথা কুটে, অপমান আর লাঞ্ছনা সর্বাঙ্গে মেখে ফিরে আসতে হয়েছে, সে দিন তো কেউ তার জন্য মাথা ঘামায়নি।’’
•••
কখনও ফিরে গেছেন প্রথম দিনে।
‘‘তুমি বিয়ে করতে এসেছ। তোমাকে মেরে ভাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ভাল করে বুঝে নাও, কেমন?’’
প্রথম বার ক্যামেরার সামনে দাঁড়ানোর আগে পরিচালকের মুখে এমন কথা শুনে বেজায় ঘাবড়ে গিয়েছিলেন।
‘‘ওরা আমাকে খুব জোরে মারবে না তো?’’
শুনে ফ্লোরের সকলের কী হাসি! পরিচালক বললেন, ‘‘না, না, এটা বাস্তব না। একে বলে সিনেমার মার।’’
হিন্দি ছবি ‘মায়াডোর’। মুক্তি পায়নি। কিন্তু সে-ছবিতেই প্রথম বার সুযোগ এসেছিল। একস্ট্রা-র পার্ট। দিনে পারিশ্রমিক পাঁচ সিকে। তখনও তিনি পোর্ট কমিশনার্সের চাকুরে অরুণ কুমার চট্টোপাধ্যায়। লিখছেন, ‘‘পর পর পাঁচ দিন শ্যুটিংয়ে আসতে হল। আর ওই ক’টা দিন আমার মাস-মাইনের অফিসটা নির্দ্বিধায় কামাই করে ফেললাম।’’
বাড়ির নীচের তলায় থাকতেন ‘গণেশদা’। গণেশ বন্দ্যোপাধ্যায়। বেতার নাটকের নিয়মিত অভিনেতা। তাঁর জন্যই ‘মায়াডোর’-এ সুযোগ। ‘গণেশদা’ সিনেমায় নামছেন শুনে আব্দার করে বসেন, ‘‘আমার একটা চান্স হবে না? একটু চেষ্টা করে দেখো না, গণেশদা।’’
‘‘তুই পার্ট করবি? … এক কাজ কর, কালই ভারতলক্ষ্মী স্টুডিয়োতে চলে আয়। আমি থাকব, দেখি কী করা যায়।’’
এর পরই ‘যায় যাবে যাক প্রাণ না কেন যদি হরি পাই’ বলে ট্রামে চেপে, সোজা ভারতলক্ষ্মী।
ছেলে সিনেমা করবে, মা প্রাণ ভ’রে আশীর্বাদ করেছিলেন। আর গৌরী? তখন গৌরীরানি গঙ্গোপাধ্যায়। ল্যান্সডাউনের বিখ্যাত ধনী চণ্ডীচরণ গঙ্গোপাধ্যায়ের মেয়ে। রমেশ মিত্র গার্লস স্কুলের ছাত্রী। সবে প্রেমের মুকুল ফুটেছে। তবু মনে হয়েছিল, গৌরীরও তো অনুমতি নেওয়া দরকার।
মহাজুটি
স্কুলের সামনে দেখা করতেই চুপি চুপি গৌরী বলল, ‘‘তুমি বাড়ি যাও, আজ আমি তোমাদের বাড়ি যাব।’’
এর পর ওঁরই লেখা থেকে—
‘‘আমি ভারাক্রান্ত মনে নিয়ে বাড়ি ফিরে এলাম। অপেক্ষায় রইলাম গৌরী আসবে, আমার দীর্ঘ প্রতীক্ষা।
গৌরী সে দিন কথা রেখেছিল। সোজা চলে এসেছিল আমার কাছে। কাছে এসে লজ্জাবনত মুখে দাঁড়াল।…
বললাম, ‘আমি সিনেমায় নামছি। তোমার মত কী গৌরী?’
বড় বড় দু’টো চোখ আমার ওপর রেখে বলল, ‘বেশ তো, এতে আবার আমার মতামত কী?’
সেই মুহূর্তে কোনও লজ্জা আমাকে ভর করেনি। কোনও সঙ্কোচ বোধ করেনি। আবার বললাম, ‘গৌরী বিশ্বাস করো, আমি তোমাকে ভালবাসি, আর ভালবাসি বলেই তোমার মতামত আমার একান্ত দরকার।’
গৌরী হাসল। প্রাণখোলা মিষ্টি হাসি। সে হাসি উচ্ছ্বাসের হাসি নয়।
হাসতে হাসতে বলল, ‘তুমি সিনেমায় নামলে আমি খুশি হব বেশি।’’’
•••
সময় গড়িয়েছে।
এক সময় দিনে ছবি, তো রাতে থিয়েটার। পরের পর অভিনয়।
আকাশ ছোঁওয়ার নেশা ধীরে ধীরে এতটাই!
এক দিকে পর্দায় ‘অগ্নিপরীক্ষা’, ‘পথে হল দেরী’, ‘সবার উপরে’, ‘সাগরিকা’, ‘শিল্পী’, ‘চন্দ্রনাথ’…— সাফল্যের পর সাফল্য। অন্য দিকে মঞ্চে সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে জুটি বেঁধে তৈরি ‘শ্যামলী’ মৃতপ্রায় বাংলা থিয়েটারে ‘ফেনোমেনন’ হয়ে উঠল।
এর পরও আকাঙ্ক্ষা থামার নয়। একের পর এক ধাপ পেরিয়ে উঁচু, আরও উঁচুতে উঠতে চাওয়াতে ছাড় নেই কোনও! —
‘‘কেন জানেন? ছোট হয়ে ঢুকেছিলাম, কিন্তু সমালোচনা পেয়েছিলাম বিরাট। যে দেখে সেই গালাগাল দেয়। বলে, ‘এ আবার কোথা থেকে এল? হটাও ঝুটঝামেলা!’ …আজকাল এই ধরনের একটা কথা প্রায়ই শোনা যায়, ‘দ্য মোমেন্ট আই স হিম, আই নিউ আ গ্রেট অ্যাক্টর হ্যাজ অ্যারাইভড!’ আসলে কিন্তু ‘আই ডিড নট অ্যারাইভ। আই পুশড মাইসেলভ ইন!’’’— আমি, আমিই নিজেকে তুলে ধরেছি, কেউ না। আমি একাই।
পেরিয়ে আসা অমসৃণ সড়কের দিকে ফিরে তাকিয়ে নিজের আহত, ক্ষতবিক্ষত শরীরটা দেখে পাহাড়-ফাটা হুঙ্কার যেন! জিতে আসা মহাসৈনিকের মতো। নায়কোচিত।
আবার এই নায়কেরই শক্তপোক্ত মনটা কোথায় যেন চুর চুর করে ভেঙে পড়ে, যখন তিনি লেখেন, ‘‘শ্যামলী নাটককে সফল করে তুললাম। অনেক রেকর্ড হল। কিন্তু আমি কী পেলাম? একটা বিশ্রী গুজব যে আমি নাকি গোপনে কোনও নায়িকাকে বিয়ে করেছি! বাইরে অশান্তি— সবাই জিজ্ঞেস করে, এ কী করেছ তুমি? ঘরে অশান্তি!’’
শেষ নয় এখানেই!
রটে গিয়েছিল উত্তমকুমার একা কিছু নয়। সুচিত্রা আছে বলেই তাঁর এত কিছু। লিখছেন, ‘‘শুনে শুনে ভুল বোঝাবুঝির উপক্রম হত। ভাবতাম জুটি ভেঙে দেব, একলাই অভিনয় করব। এখানেও আকাঙ্ক্ষার তাড়না। সুচিত্রা ছা়ড়া অনেক অভিনয় হল। …রটনার মৃত্যু হল।’’
শুধুই আকাঙ্ক্ষা? তারই কারণে বারে বারে চড়াই টপকে টপকে যাওয়া?
স্বীকার করছেন, হয়তো শুধুই তা নয়। তার চেয়েও আরও কিছু। বৈচিত্র খোঁজাটা আসলে জীবনে শেষ কথা হয়ে উঠেছিল তাঁর প্রত্যেকটি ধাপে। তার মধ্যেই বোধ হয় বেঁচে থাকার রসদ কুড়িয়ে নিতে নিতে এগিয়েছেন।
লিখছেন, ‘‘বৈচিত্র না থাকলে মানুষ বাঁচে না। বৈচিত্র ছিল না বলেই মেরিলিন মনরো আত্মহত্যা করেছে। গ্ল্যামারের একঘেয়েমি থেকে উদ্ধার করে কেউ যদি ওকে বৈচিত্রের সন্ধান দিতে পারত, ও আত্মহত্যা করত না। বেঁচে থাকত। একঘেয়েমি ওর জীবনের আকাঙ্ক্ষাকে নষ্ট করে দিয়েছিল। তাই ও কোনও দিন বিচার করেনি আকাশ কত উঁচু।’’
বৈচিত্রকে হারিয়ে ফেলার ছটফটানি কতটা যে তাঁকে গলা টিপে ধরত, বলছেন তা’ও!—
‘‘একই টাইপের ছবিতে অভিনয় করতে বাধ্য হচ্ছি আমি আজও। আমার দেবার ক্ষমতারও তো একটা সীমা আছে। আজ বারবার মনে হচ্ছে— তথাকথিত রোমান্টিক শিল্পী হিসেবে আমি নিঃশেষ হয়ে গেছি। ইচ্ছে হয়, ভাল ছবিতে ভিন্ন ধরনের চরিত্রে প্রাণ দিয়ে অভিনয় করার, কিন্তু সে পরিচালক কই? গল্প কই? সুযোগ কই?’’—
১৯৬০ সালে সাদা কালো অক্ষরে ক্লান্ত, বীতশ্রদ্ধ মহানায়কের এমনই স্বর শোনা গিয়েছিল। মনে মনে ‘মুক্তি’ খুঁজতে চাইছিলেন তখন।
এর বছর পাঁচ-ছয় বাদেই সত্যজিৎ রায়ের ‘নায়ক’। প্রাণ ফিরে পেলেন যেন মহানায়ক!— ‘‘আমি আমাকে এক নতুন ভূমিকায় খুঁজে পেলাম। মুক্তি হল আমার।’’
‘নায়ক’ অরিন্দমের ‘পাল্স’-এ নিজেকে দেখতে পেয়েছিলেন কি? তাই কি মহাকাঙিক্ষত সেই মুক্তি?
লিখছেন, ‘‘মনে হয়েছে অরিন্দমের সুখ আমার সুখ, অরিন্দমের দুঃখ আমার দুঃখ, অরিন্দমের জটিলতায় আমিও ভাবিত। অরিন্দমের সরলতায় কখনও আমিও মুগ্ধ।’’
‘নায়ক’ তৈরির সময় সত্যজিৎ রায় নাকি শুরুতে বলেছিলেন, ‘‘ওহে উত্তমকুমার, প্রথম সিনটা একটু ছবিবিক ঢঙে অভিনয় করতে হবে।’’ মানে, ছবি বিশ্বাসের মতো।
মনে ধরেনি। লিখেছেন, ‘‘ছবিবিক ঢঙে আমি কী অভিনয় করব? ছবিদা ছবিদার মতো অভিনয় করতেন, আমি আমার মতো করব।’’
ইগো? না, তা হয়তো নয়।
এক জায়গায় ছবি বিশ্বাসকে নিয়ে তিনি লিখছেন, ‘‘ওই একটা মাত্র লোক স্ক্রিনে থাকলে যেন তাঁর পর্বতপ্রমাণ গাম্ভীর্য আর ব্যক্তিত্বের কাছে আশেপাশের আর সমস্ত কিছু নস্যাৎ হয়ে যেত। … অমনটি ছিল না, আর হবেও না কোনও দিন।’’
তবু ‘নায়ক’-এ ‘ছবিবিক’ হতে চাননি। হোক না একটি মাত্র দৃশ্য, তা’ও না। ‘অরিন্দম’-এর মধ্যে এতটাই নিজের শরীর-মন দেখতে পেয়েছিলেন তিনি!
•••
লস এঞ্জেলস-এ ভাষণ দিতে গিয়েছিলেন। পরে সেই ভাষণের বাংলা তর্জমা প্রকাশিত হয়।
সেখানে দেখা যাচ্ছে, তাবড় সাহেব-সুবোদের সামনে দাঁড়িয়ে বাংলা সিনেমা নিয়ে প্রায় বোমা ফাটাচ্ছেন মহানায়ক।
বলছেন, ‘‘এক এক সময় মনে হয় কী জানেন— আমরা তো অনেক বড় আর্টিস্ট, নয় কেন? কেন নয়? আমরা যদি রবার্ট রেডফোর্ডকে বলি— আমরা যদি বার্টন সাহেবকে বলি— আমরা যদি পিটার ওটুলকে বলি— আমরা যদি টোপল সাহেবকে বলি যে আমাদের ওই জায়গায় টালিগঞ্জে গিয়ে এক ঘণ্টা শ্যুটিং করে আসুন না। পালিয়ে আসবেন। পরের দিনই টিকিট কেটে পালিয়ে আসেবেন।’’
সে কালের স্টুডিয়োর অবস্থা যে কতটা কুৎসিত, তা নিয়ে বিদেশের মাটিতে দাঁড়িয়েও কোনও লুকোছাপা নেই তাঁর।
দুটোর বেশি লেন্স নেই। ভাঙা ক্যামেরা। তা’ও বলতে গেলে ক্লাইভের আমলের। —‘‘সে এখনও চলছে ভাল রোমান্টিক সিনে— বেশ গদগদ নায়ক-নায়িকা। বেশ সুন্দর। পার্টটাও ভাল হচ্ছে। হঠাৎ কাট কাট।— কী ব্যাপার ফিল্ম জ্যামড্ হয়ে গেছে। আবার সেই নায়ক নায়িকা চোখ কুঁচকে মুখের ওপর বরফ লাগিয়ে ঠান্ডা জলটল লাগিয়ে আবার রেডি হচ্ছে— হয়তো ঠিক আগের মতো হল না।’’
অপর্ণা সেনের সঙ্গে অভিনয়। এক গাল দাড়ি, গোঁফ। হঠাৎ লোডশেডিং। গোটা বাংলায় যখন তখন সে ছিল এক নয়া উৎপাত। পরিচালক অজয় কর। —‘‘বললাম, অজয়বাবু আর হবে? উনি বললেন, একটু অপেক্ষা করো— দেখি। বসে আছি— কামড়। কীসের বলুন তো— মশার। প্রচণ্ড মশা।…এরই মধ্যে আমরা কাজ করছি।’’
কথায় বিদ্রুপ ছিল। ঠাট্টাও। কিন্তু যন্ত্রণাও কি ছিল না?
আর বেপাড়ায় গিয়ে, তার ঠাটঠমকে কুঁকড়ে না গিয়ে নায়কের মতোই চ্যালেঞ্জ দেওয়া?— ‘এক বার খেলে যান না এ মাঠে, দেখি কেমন পারেন!’
•••
‘‘প্রেম যেন অনেকটা নতুন শাড়ির গন্ধের মতো, দু’দিন পরলেই আর গন্ধটা থাকে না। না পরে বাক্সে তুলে রাখলেও গন্ধটা নষ্ট হয়ে যায়। আর প্রথম প্রেম? সম্ভবত কর্পূরের মতো উবে যায়।’’
লিখছেন তিনিই। বছর বছর ধরে যিনি কি’না ছিলেন লক্ষ লক্ষ কিশোরী-তরুণীর হার্টথ্রব।
প্রথম প্রেমে পড়েছিলেন স্কুলবেলায়। ধূমকেতুর মতো দেখা দিয়ে তা উধাও-ও হয়, ধূমকেতুর মতোই।
লিখছেন, ‘‘মেয়েটি এক দিন ভরপুরের হাজির হয়েছিল আমার ঘরে। মনে পড়ে, তখন আমি স্কুলের ছাত্র। কী কারণে স্কুলে যাইনি। খাওয়াদাওয়ার পাট চুকে গেছে। মা ওপরের ঘরে শুয়ে ঘুমোচ্ছেন। নীচতলায় আমার পড়বার ঘরে আমি একলা। খাতা কলম নিয়ে হিজিবিজি কী সব আঁকছি। ঠিক সেই সময়ে মেয়েটি এল। আমারই বয়সি, পাশের বাড়ির বাসিন্দা। আমি চোখ তুলে তাকালাম। মুহূর্তে মেয়েটির চোখের তারায় বিদ্যুৎ নেচে উঠতে দেখলাম। সে খিল খিল করে হেসে উঠল। হঠাৎ উপলব্ধি করলাম, এ হাসির যেন অনেক অর্থ। সেই প্রথম ওই নিঃশব্দ নিরালা মুহূর্তে পরম বিস্ময়ে অনুভব করলাম, এক অপরূপের আবির্ভাব ঘটেছে আমার চোখের সামনে। … ওরা ছিল দুই বোন। এক দিন দেখি, বড় বোনও আমায় প্রেম নিবেদন করতে চাইছে। সেই আমার প্রথম প্রেমের মৃত্যু হল।’’
•••
‘‘ছেলেটি বাড়িসুদ্ধ লোকের সামনে আমাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেলো।’’
লিখছেন নায়ক। ঘটনাটি মেদিনীপুরের। চাতরায়।
ফ্যানদের বিচিত্র সব কাণ্ড কারখানা দেখেছেন জীবনভর।
অভিজাত কুলবধূ মফস্সল থেকে শহরে এসে দেখা করে বলেছেন, ‘‘আমি আর ফিরব না।’’
সদ্য বিবাহিতা সব লাজলজ্জা ধুয়ে সটান হাজির হয়েছেন শুধু তাঁকে দেখবেন বলে।
ফ্যানলেটারের রকম বললে তো আড়েবহরে মহাকাব্যকে হার মানাবে।
তবু চাতরার সেই যুবকটি যেন সবার থেকে আলাদা।
লিখছেন, ‘‘আমার পুরনো দিনের বন্ধুর বাড়িতে গিয়েছিলাম নেমন্তন্ন খেতে। খাওয়া আর হল কই!’’
তার মাঝেই অমন কাণ্ড!
‘‘দৃশ্যটা সবাই এনজয় করল বেশ। আমি এক্কেবারে বোকা বনে গেছি। ফিরে আসবার সময় ছেলেটির সঙ্গে আমার দেখা হল। রাস্তায়। গাড়ি থামিয়ে ছেলেটিকে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘বহু জায়গায় গিয়েছি, কিন্তু হঠাৎ এরকম একটা ব্যবহার।’… কয়েক সেকেন্ড চিন্তা করে খুব ক্যাজুয়ালি বলল, ‘দাদা, আপনার ওই বুকে তো অনেক নায়িকা পড়েছে। আমিও একবার পড়ে দেখলাম। বহু দিনের শখ ছিল। বিশ্বাস করুন, ওই জায়গাটার প্রতি আমার একটা দুর্বলতা ছিল এত দিন।’’’
•••
‘‘এত লোকের আগ্রহ আমি, উত্তমকুমার, আমারও ইচ্ছেপূরণ হয় না, অনেক ছোট আকাঙ্ক্ষা মেটে না।’’
এ কথা যখন লিখছেন, মনে হয়, এক রাশ ক্লান্তি চেপে ধরেছে যেন! এত মানুষ, এত আলো, এত রকমের চাওয়ার মাঝে ওঁর ছোট্ট ছোট্ট চাওয়াগুলো কেমন বুদবুদ কেটে ভেসে ওঠার আগেই মিলিয়ে যেত।
জগুবাবুর বাজারের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলেন। রাস্তায় এক ফুলওয়ালা গোলাপ নিয়ে বসে। নজর পড়ল বিশেষ একটি গোলাপের ওপর। নিজেই নামতে যাচ্ছিলেন। ড্রাইভারকেই পাঠাতে হল।
ড্রাইভার ফিরল অন্য একটি গোলাপ নিয়ে। পাল্টাতে বলবেন যে, উপায় নেই। ততক্ষণে গাড়ির সামনে, পিছনে সার সার লোক শুধু।—
‘‘গাড়ি চলতে শুরু করল, ফুলটা নিয়ে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি আমি।’’
লিখছেন—
ছোট ছোট এই ইচ্ছে, আকাঙ্ক্ষাগুলো আমাকে দংশন করে, যখন আমি একা, আমার চারপাশ গাঢ় অন্ধকার।
আসলে ছবির জগৎটাই তো এমনি। চারপাশের অন্ধকারেই ছবির জগৎ রোশনাইয়ের মতো জ্বলে। ছবির জগতের যাঁরা বাসিন্দা তাঁদের জীবনটাও এই রকম।
যতই চারপাশ অন্ধকার হবে ততই তাঁরা স্পষ্ট হবেন। নিজেদের জীবনের চারপাশের অন্ধকার নিয়ে তবেই তাঁরা জ্বলতে পারেন।
নায়কের স্বরও এত ম্রিয়মাণ, এত শুষ্ক, রিক্ত, প্রাণহীন হয়!
সূত্র: নায়কের কলমে (২৪ জুলাই, ২০১৫-য় প্রকাশিতব্য গ্রন্থ), সপ্তর্ষি প্রকাশন, সম্পাদনা: অভীক চট্টোপাধ্যায় (উদ্ধৃত কিছু অংশ সংক্ষেপিত, বানান পরিবর্তিত)
http://www.anandabazar.com/supplementary/patrika/debshankar-mukhopadhyay-writes-on-uttam-kumar-1.176947?ref=archive-new-stry
No comments:
Post a Comment