উনি তো সচরাচর কোনও সভা-সমিতিতে যেতেন না। সে বার ‘কলিকাতা সাহিত্যিকা’-র অধিবেশনে গিয়েছেন নতুন গল্প পড়তে।
পড়তে উঠে ব্যাগ খুলে হঠাৎ বললেন, ‘‘ওই যাঃ! আমার গল্পটা ঠিক রাস্তায় পড়ে গেছে! আজই লিখেছি। ব্যাগে ভরেওছি! কোথায় যে পড়ে গেল! এখন... কী পড়ি!’’
মায়ের কথা শুনে সবাই ভাবছেন, ‘আশাপূর্ণা দেবী পথে গল্প হারিয়ে ফেললেন। তা হলে কি ওঁর গল্পপাঠ শোনা যাবে না!’
সংস্থার সভাপতি স্বপনবুড়ো মানে অখিল নিয়োগী বললেন, ‘‘আজই যখন গল্পটা লিখেছেন, তখন গরম-গরম মনে আছে নিশ্চয়। মুখে মুখেই বলে দিন না।’’
শ্রোতাদের নিরাশ করেননি। শাশুড়ি মা সে দিন স্মৃতি থেকে মুখে মুখেই পুরো গল্পটা শুনিয়েছিলেন!
কত যে স্মৃতি!  মাকে নিয়ে বলতে বসলে সব কেমন এলোমেলো হয়ে যায়!
প্রথম আলাপের কথা বলি। তখন ক্লাস নাইনে পড়ি। মা-মাসিদের সঙ্গে একদিন পাড়াতে ওঁর বাড়ি বেড়াতে গিয়েছি।
পাড়া মানে, তখন বেলতলা। সে সময় সপরিবার আশাপূর্ণা দেবী ভাড়া থাকতেন ৭৭ বেলতলা রোডে। ওঁর বেশ নাম। আমরা খুব অবাক হয়েছিলাম। প্রথম আলাপে আত্মীয়তা হল আমাদের সঙ্গে। উনি নিজে হাতে সাধারণ মেয়েদের মতো আতিথেয়তা করেছিলেন।
সেই শুরু। বিয়ের আগে আরও কয়েক বার গিয়েছি ওই বাড়িতে।
যখন আঠারো হলাম, আমার বাবা-মা আশাপূর্ণাদেবীর ছেলে সুশান্তর সঙ্গে আমার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে গেলেন। উনি এককথায় রাজি।
বলেছিলেন, ‘‘হ্যাঁ, মেয়েটিকে তো আমি দেখেছি।’’ সেই ১৯৫৬ সালে বিয়ে হয়ে গেল আমাদের। লেখিকা আশাপূর্ণা আমার শাশুড়ি মা হলেন। তখন লেডি ব্রেবোর্ন কলেজে ইন্টারমিডিয়েট ক্লাসে পড়ছি। চিন্তা ছিল, যৌথ পরিবারে বিয়ের পরে পড়তে দেবেন তো?
বিন্দুমাত্র বাধা দেননি। বরং উৎসাহ দিয়েছেন। আমাদের সঙ্গে ওই বাড়িতে স্ত্রী ও পুত্র-কন্যাদের নিয়ে খুড়শ্বশুর থাকতেন। আর আমরা চারজন। উনি খেয়াল রাখতেন, কেউ যেন আমার ত্রুটি নিয়ে সমালোচনা না করতে পারে। বিয়ের পরে যত দেখেছি, মনে হয়েছে আর পাঁচজন সাধারণ গৃহস্থ পরিবারের মতো গিন্নিই ছিলেন উনি। ব্যক্তিজীবনে ছিলেন নিতান্তই এক আটপৌরে মা ও গৃহবধূ।
তবে কী শোকে, কী আনন্দে, কী অভাবে আশ্চর্যরকম স্থির থাকতেন।
বাইশ-তেইশ বছরের ছেলের মৃত্যুও তাঁকে সইতে হয়! শোক তাঁকে বহু দিন বিপর্যস্ত করে রেখেছিল। কিন্তু তাতে সংসারে দৈনন্দিন কাজে কখনও অবহেলা করেননি। যে দিন শ্বশুরমশাই চলে গেলেন, তখনও দেখেছি ভাঙা মন নিয়েও নিত্যদিনের কাজে ফিরে এসেছেন দ্রুত!  মায়ের জীবন জুড়ে গভীর আধ্যাত্মিকতা ছিল। দুঃসহ শোকেও বলতে শুনতাম, ‘ঠাকুর, তোমার কত দয়া’!                                                                                       
শাশুড়ি মায়ের কাছে ওঁর বালিকাবেলার বহু গল্প শুনেছি।
উনি ছোটতে খুব ডাকাবুকো ছিলেন। ঘুড়ি যেমন ওড়াতেন, তেমনই বাধ্য মেয়েও ছিলেন। মায়ের জন্ম উত্তর কলকাতায়, পটলডাঙায় মামাবাড়িতে। বাবা হরেন্দ্রনাথ গুপ্ত ছিলেন সে যুগের শিল্পী। মা সরলাসুন্দরীর ছিল বই-অন্ত প্রাণ। বৃন্দাবন বসু লেনের শরিকি বাড়ি থেকে হরেন্দ্রনাথ যখন তাঁর পরিবার নিয়ে আপার সার্কুলার রোডে উঠে এলেন, আশাপূর্ণার বয়স তখন সাড়ে পাঁচ বছর। ভাইবোন মিলিয়ে ঘরে নয়জন। তিনি ছিলেন পঞ্চম।
স্বামীর সঙ্গে । এ পাতার দু’টি ছবি: দেবীপ্রসাদ সিংহ

বৃন্দাবন বসু লেনের বাড়িতে ছেলেদের জন্য মাস্টারমশাই আসতেন। মেয়েদের অবশ্য নিষেধ ছিল সেই পাঠে যোগ দেওয়ায়।
কখনও উল্টো দিকে বসে, কখনও পাশের ঘরে থেকে সেই শুনতে শুনতেই বালিকা আশাপূর্ণার পড়া শেখা। সঙ্গে চলত মায়ের বইয়ের তাক থেকে বই টেনে-টেনে পড়া। তাতে কোনও নিষেধ ছিল না।
উনি বলতেন, ‘‘সব পড়তাম। সে বুঝতে পারি বা নাই পারি।’’
সে সময় সাধনা, প্রবাসী, ভারতবর্ষ, বসুমতী প্রভৃতি পত্রিকা বাড়িতে আসত। সরলাসুন্দরী ছিলেন বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ, জ্ঞানপ্রকাশ লাইব্রেরি ও চৈতন্য লাইব্রেরির সদস্য। মায়ের সেই পড়ার জগতেই বুঝি বালিকা আশাপূর্ণার মনের তার সাহিত্যের ভুবনে বাধা হয়ে গিয়েছিল। ১৫৭/১, আপার সার্কুলার রোডের এই বাড়ি থেকেই কয়েক বছর পরে তিনি ডাকে লেখা পাঠাবেন।
ভাইবোনেদের মধ্যে সর্বক্ষণের মেলামেশা ছিল দিদি রত্নমালা ও বোন সম্পূর্ণার সঙ্গে। ওঁর কথায় যেন, ‘একটি অখণ্ড ট্রিলজির অংশ। এক মলাটে তিনখানি গ্রন্থ।’
বাংলা ১৩২৯, মায়ের যখন তেরো বছর বয়স, বোনেদের সঙ্গে লেখা নিয়েই একবার প্রতিযোগিতা।
‘বাইরের ডাক’ নামে একটি কবিতা লিখে পাঠিয়ে দিলেন ‘শিশুসাথী’ পত্রিকায়। প্রকাশিতও হল। সে দিন গোটা পাড়া জুড়ে আনন্দ। তখন তো এমনই ছিল। দুঃখ-আনন্দ সবাই পড়শির সঙ্গে ভাগ করে নিত। সহ-সম্পাদক রাজকুমার চক্রবর্তী চিঠি দিয়েছিলেন প্রশংসা করে। লিখেছিলেন, ‘‘তুমি গল্প লেখো। আমাদের পাঠাও।’’ সেই উনি লিখতে শুরু করলেন।
সে সময় আশাপূর্ণা ও সম্পূর্ণার পছন্দের খেলা পদ্য মুখস্থ।
কার কত আগে হয় মুখস্থ, সেই নিয়ে জোর প্রতিযোগিতা। বাড়ির লোকজনের কান ঝালাপালা হওয়ার জোগাড়। এই ‘গান্ধারীর আবেদন’ তো ওই শোনা গেল ‘কর্ণ কুন্তী সংবাদ।’
একদিন এক কাণ্ড! দুই বোন সবার চোখ এড়িয়ে শান্তিনিকেতনের ঠিকানায় চিঠি পাঠালেন রবীন্দ্রনাথকে! আবদার, “নিজের হাতে আমাদের নাম লিখে একটি উত্তর দেবেন।” চিঠি পাঠিয়েছিলেন রবিঠাকুর। সাদা, বড় খামে নিজের হাতে দুই বোনের নাম লিখেই!
সারা জীবনই মা কবিকে শ্রদ্ধা করেছেন। মায়ের প্রিয় ছিল মোহর, সুচিত্রা, হেমন্তর গাওয়া রবীন্দ্রনাথের গান। খুব প্রিয় ছিল ওই গানটা, ‘যে ধ্রুবপদ দিয়েছ বাঁধি।’ শুনতে চাইতেন ‘ধায় যেন মোর সকল ভালোবাসা’, ‘জড়ায়ে আছে বাধা ছাড়ায়ে যেতে চাই’। কেউ এলেই গাইতে বলতেন উনি। ইচ্ছে ছিল, ফিরবেন শান্তিনিকেতনেই। শেষ সময় থাকবেন। হয়নি!
শাশুড়ি মায়ের যখন ১৫ বছর বয়স, কৃষ্ণনগরের কালী দাশগুপ্তের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। বিয়ের পর প্রথমে ওঁর খুব মন ভেঙে যায়। কলকাতাই যে প্রাণ! এ দিকে  শ্বশুড়বাড়ি কৃষ্ণনগর।
ভেবেছিলেন, বই পড়া-লেখালিখির বুঝি ইতি টানতে হবে। গিয়ে দেখলেন, বাড়িতে বই বলতে কেবল পঞ্জিকা! উনি বলতেন, ‘‘মনের দুঃখে আমি সেই পঞ্জিকাখানি উল্টে-পাল্টে দেখতাম!’’
আমার শ্বশুরমশাই ওঁর আগ্রহ দেখে কলকাতা থেকে বই, পত্র-পত্রিকা কিনে-কিনে নিয়ে যেতেন।
এক সময় সংসার উঠিয়ে নিয়ে তিনি কলকাতায় চলে এলেন। প্রথমে রমেশ মিত্র রোডে ভাড়ায় উঠলেন। পরে ঠিকানা বদলে গেল বেলতলা রোডে। আর সে বাড়িতেই দীর্ঘ ৪০ বছর ছিলেন।
স্বামীর উৎসাহেই সাহিত্য জগতে প্রবেশ করেন তিনি। দুই ছেলে প্রশান্ত-সুশান্ত আর এক মেয়েকে নিয়ে ওঁদের তখন ভরা সংসার। তবুও লেখা থামেনি।
বিয়ের পরে এসে দেখেছি উনি সর্বময়ী কর্ত্রী। সারা দিন সংসারের কাজ করতেন। রাত্তিরে অন্তঃপুরের মেয়েদের কথা, নারীমুক্তির কথা লিখে যেতেন।
রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে ভিজে হাতখানি আঁচলে মুছতে-মুছতে লিখতে যেতেন। ওঁর লেখার ভঙ্গিটি এখনও খুব মনে আছে। ঠিক ছবির মতো। আধশোয়া। উপুড় হয়ে ছোট্ট একটা কাঠের ডেস্কে নিজের প্যাডে লিখে যেতেন। কতবার হয়েছে, লিখতে লিখতে ভোর।
লিখেওছেন, ‘‘লেখা শেষ করে যখন শুতে যাচ্ছি, রাস্তায় জল দিচ্ছে।’’ নাগাড়ে লিখেছেন। হয়তো কেউ এসেছেন, তাঁর সঙ্গে কথা বলছেন লেখা থামিয়ে। চলে যেতেই ফের লিখতে বসলেন। কখনও পড়তেন। বঙ্কিম-শরৎ-রবীন্দ্রনাথের লেখা। বলতেন, ‘‘ওঁদের প্রণাম করে লেখা শুরু করি।’’ আমি জিজ্ঞেস করতাম, ‘‘মা আপনি প্লটের কথা ভাবেন কখন?’’ উনি বলতেন, ‘‘লেখার ভাবনা সব সময়ই চলে।’’
এক সময় বেলতলা রোড থেকে গোলপার্কের ফ্ল্যাটবাড়িতে মায়ের সঙ্গে আমরা উঠে এলাম।
সেও চমৎকার সব দিন ছিল। মনে হয় এই তো সেদিন!  দেখতে পাই যেন। দু’জনে রিকশায় চলেছি নরেন্দ্র দেব, রাধারানি দেবের বাড়ি ‘ভালোবাসা’য়। কিংবা অন্য কোথাও। যেখানে যেতেন সঙ্গে করে আমাকে নিয়ে যেতেন। সে প্রেমেন্দ্র মিত্রের বাড়ি হোক বা বনফুল এলে, তাঁর কাছে। সব জায়গায়।
নরেন্দ্র দেবই সেই লোক, যিনি আমার শাশুড়িকে বাইরে বের করেছিলেন। সাহিত্যসভায়, অনুষ্ঠানে তিনি নিয়ে যেতেন বোনের মতো। উৎসাহ দিতেন। বলতেন, ‘‘তুমি ঘরবন্দি হয়ে থাকবে কেন? বাইরের জগতেও পরিচয় দরকার।’’ শুনে মা চুপিচুপি হাসতেন।
গোলপার্ক থেকে এলাম এই গড়িয়ার বাড়ি, ১৭ কানুনগো পার্কে। সেও এক গল্প।  উনি চাইতেন রাস্তার ধারের বাড়িতে থাকতে। সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় ওঁর কাছে একদিন জানতে চেয়েছিলেন, ‘‘গোলপার্ক থেকে গড়িয়ায় কেন?’’ উত্তরে মা বলেছিলেন, ‘আমার বরাবরের ইচ্ছে বড় রাস্তার উপরে থাকব। লোকজন দেখব। গাড়ি ঘোড়া দেখব।’  ঘরেও বলতেন, রাস্তার দিকের ঘরের জানলায় বসে থাকতে ইচ্ছে করে।
গৃহপ্রবেশে এলেন বিখ্যাত সব সাহিত্যিকরা। হাজার স্মৃতি। রবিবাসরের সভা বসেছে বহুবার। কে আসেননি সেই সভায়। তারাশঙ্কর থেকে বনফুল। উনি তো কোনও অতিথিকে না বলতেন না। বলতেন, ‘‘লোকই লক্ষ্মী।’’
একবার এলেন নাকতলার বাড়ি থেকে স্ত্রী প্রতিভা বসুকে সঙ্গে নিয়ে বুদ্ধদেব বসু।  গল্পে গল্পে অনেকটা সময় কাটিয়ে গিয়েছিলেন। ওঁর জন্মদিনে অনেকে দেখা করতে আসতেন। কেউ হয়তো বলল, ‘‘আশাদি দেখা করতে যাব।’’ উনি বলতেন, ‘‘ঠিক আছে ভাই। দুপুরে খেয়ে যেয়ো।’’  খাওয়াতে যে কী ভালবাসতেন! কেউ বেগুনি খাবেন। নিজেই রান্নাঘরে ঢুকতেন। আমাকে মাছের চপ করাতেন। খাওয়ানোটা যেন নেশার হয়ে গিয়েছিল ওঁর।
একসময় পর্যন্ত ওঁকে রান্নাঘরের লেখক হিসাবেই মনে করা হয়েছে।
কেন না, উনি মেয়েদের ঘরোয়া জীবনকে ছুঁয়েই কেবল লিখতেন। ১৯৭৫ সালে ওঁর জ্ঞানপীঠ পুরস্কার প্রাপ্তির সেই গল্প তো অনেকেরই জানা। ‘দেশ’-এ লিখেছিল নবনীতা।
সে বার বাংলাভাষার কমিটিতে ছিলেন অধ্যাপক প্রতুল গুপ্ত এবং অধ্যাপক অমলেন্দু বসু আর নবনীতা। নবনীতা সেখানে মায়ের ‘প্রথম প্রতিশ্রুতি’র কথা বললে, তাঁরা দু’জনেই অবাক হয়ে বলেছিলেন, ‘‘অনেক লিখলে বা মুখরুচিকর জনপ্রিয় লিখলেই মহৎ সাহিত্য হয় না।’’  শেষে নবনীতা ওঁদের পড়তে দিয়েছিলেন মায়ের উপন্যাসটা। পরে ওঁরা সিদ্ধান্ত বদলেছিলেন।
সারা জীবনে মা পুরস্কার তো কম পাননি। কিন্তু কোনও দিন দেখিনি নিজের সাদামাঠা জীবন থেকে সরে যেতে। 
ওঁকে ডি লিট দিয়েছে চারটি বিশ্ববিদ্যালয়। পেয়েছেন পদ্মশ্রী, জ্ঞানপীঠ, দেশিকোত্তম... আরও অজস্র সম্মান, পুরস্কার। কিন্তু কখনও নিজেকে ‘সেলিব্রিটি’ মনে করেননি।  খুব সাধারণ পোশাকেই অভ্যস্ত ছিলেন। পোশাকের মধ্যে সাদা শাড়ি পরতে পছন্দ করতেন। বাইরে গেলে কুঁচি দিয়ে পড়তেন। নইলে আটপৌরে করেই পড়তেন। অথচ, খুব পরিচ্ছন্ন থাকতেন। গুছিয়ে রাখতেন ঘরদোর।
বিশ্বভারতী যখন ওঁকে ‘দেশিকোত্তম’ দিল, আমরা শান্তিনিকেতন গিয়েছিলাম।
একটা বাড়িও ছিল, পূর্বপল্লিতে। কবি নরেন্দ্র দেব বাড়ির নাম ঠিক করে দিয়েছিলেন ‘উজ্জয়িনী’।
বলেছিলেন, ‘‘বাড়িটি কালিদাসের, অতএব উজ্জয়িনীই হবে উপযুক্ত নাম।’’
পৌষমেলা, বসন্তোৎসবে কত গিয়েছি। মোহরদির মতো ওখানকার কত মানুষই যে আসতেন!
একবার শ্বশুরমশাই চাঁদের আলো দেখতে গিয়ে বাড়ির সামনে খোয়াইয়ে পড়ে গেলেন! কোমর ভেঙে গেল।  কিছু দিন পরে আমার স্বামী বদলি হয়ে গেলেন দিল্লি। দেখাশোনার অভাবে সে বাড়িও অন্য হাতে যায়। কত স্মৃতি ছিল ওই বাড়ি ঘিরে!
নিজের গল্প নিয়ে এত ছায়াছবি হয়েছে, কিন্তু একা ছবি দেখতে যেতেন না। সেও হয়তো আমিই জোর করে নিয়ে গিয়েছি। তবে সিনেমার জগতের বহু মানুষের সঙ্গে পরিচয় ছিল মায়ের। যেমন কাননদেবী। টেলিফোনে প্রায়ই কথা হত দু’জনের। দেখতাম, একে অপরকে ফুল পাঠাতেন। খুব যোগাযোগ ছিল হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গেও। বাড়িতে এসে রবীন্দ্রনাথের গানও শুনিয়েছিলেন একবার, মনে আছে। হেমন্ত যখন ‘অনিন্দিতা’ ছবি করলেন, চিত্রস্বত্ব নিতে এসেছিলেন। শ্যুটিং দেখতে গিয়েছিলাম। ছবির মহরতেও গিয়েছিলেন মা।
৭৭ বেলতলার বাড়িতে উত্তমকুমার এসেছিলেন। উনি তখন ‘অগ্নিপরীক্ষা’র হিন্দি ছবি করছেন। চুক্তি হল ‘ছোটিসি মুলাকাত’-এর।
উত্তমকুমারকে দেখতে গোটা পাড়া ভেঙে পড়েছিল। সারা বাড়ি জুড়ে কী ভিড়!
মা চলে যাওয়ার দু’তিন মাস আগেও লিখেছেন। হঠাৎ করেই শরীরটা ভেঙে পড়ল। বোঝা যেত, লিখতে কষ্ট হচ্ছে। তবু লিখতেন।
কোলের উপর প্যাড নিয়ে লেখার চেষ্টা করতেন। লাইনগুলো ছেড়ে ছেড়ে যেত। অক্ষর কেঁপে যেত। শেষ করলেন একটা গল্প ওইভাবেই। শেষের দিকে শুয়েই থাকতেন।
১৯৯৫ সালের যে দিন চলে গেলেন, সেটা ১৩ জুলাই। গহন রাতে ঘুমের মধ্যেই কখন যে সব শেষ হয়ে গেল!
অনুলিখন: আবীর মুখোপাধ্যায়

http://www.anandabazar.com/supplementary/patrika/some-unknown-stories-of-novelist-ashapoorna-devi-1.601230?ref=archive-new-stry