বন্ধু মল্লিক
হাতে বেল্ট। মুখে চাবকে লাল করে দেওয়ার হুঙ্কার। অথচ মূর্তিমান ভদ্রলোক। তিনি রঞ্জিত মল্লিক। বাংলা ছবির একটি চলমান সময়। লিখছেন ঋজু বসু
ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল
টালিগঞ্জের ইন্দ্রপুরী স্টুডিয়োর ফ্লোরে দাঁড়িয়ে ঘামছেন এক সুদর্শন তরুণ।
কয়েক হাত দূরেই কৈশোরের স্বপ্নের নায়িকা। পূর্ণ, ভারতী-তে লাইন দিয়ে দশ আনার টিকিট কেটে যাঁর নতুন ছবি দেখার জন্য মুখিয়ে থাকতেন!
তাঁর সঙ্গে রোম্যান্টিক পার্ট করা কি চাট্টিখানি কথা?
‘দেবীচৌধুরানী’-র সেটে সে-যাত্রা ‘প্রফুল্ল’ই ‘ব্রজেশ্বর’-এর ত্রাতা হয়েছিলেন!
চার দশক বাদে সেই ব্রজেশ্বর হাসেন, ‘‘আমি তো ওঁর গায়ে হাত দোব, সেটাই ভাবতে পারছিলাম না! ফুলশয্যা-র ওই সিনে আমার যে রোম্যান্সটা করার কথা ছিল, শেষমেশ সুচিত্রা সেনই সেটা আমার সঙ্গে করলেন।’’
হিরো আড়ষ্ট!
দেখে সুচিত্রাই ওঁকে কাছে টেনে নিয়ে ম্যানেজ করেন।
এর পরে গোটা বইটা শ্যুটিং করার সময় পরিচালক দীনেন গুপ্ত ওরফে ‘খোকাবাবু’কে ডেকে রসিকতা করে গিয়েছেন মহানায়িকা। ‘‘কী গো, তোমার হিরো যে আমার সঙ্গে কথাই বলে না!’’
কে জানত, এর এক দশকেরও কম সময়েই বাংলা ছবিতে ধারালো ডায়ালগের প্রতীক হয়ে উঠবেন, সেই মুখচোরা যুবক!
উত্তমকুমারের মৃত্যুর পরে তখন খাবি খাচ্ছে টালিগঞ্জের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি। ছবি চলছে না। ছবি হচ্ছে না।
কাগজে ছবি বেরোচ্ছে টলিপাড়ার জনহীন স্টুডিয়োয় নেড়িকুত্তা চরে বেড়াচ্ছে। এই সময়েই খেলাটা ঘুরিয়ে দিল ‘শত্রু’।
বাংলা ছবির এমন বন্ধু আর কে আছেন!
একান্নবর্তী বাঙালি পরিবারের প্রতিবাদী মুখও তিনিই।
ঠিক যেন বাড়ির বড়দা। যিনি সবাইকে ভালবেসে কাছে টেনে রাখেন। যে কোনও ত্যাগ স্বীকার করতে পিছপা হন না। আবার দরকারে পিটিয়ে শিক্ষা দেন! ভবানীপুরের মল্লিক-বাড়ির উপেন মল্লিকের পাঁচ ছেলের মধ্যে চতূর্থ রঞ্জিত মল্লিক।
আপনি মানেই জয়েন্ট ফ্যামিলি
কয়েক বছর আগে ফোন করে কথাটা বলেছিলেন তরুণ মজুমদার।
ছবির নাম ‘চাঁদের বাড়ি’। হিটলার বউয়ের স্বামী তথা বাড়ির প্রবীণ গৃহকর্তার ভূমিকায় আর কে এমন জুতসই হবেন?
তখন ছবি করা অনেক কমিয়ে দিয়েছেন রঞ্জিত।
তনুবাবু বললেন, ‘‘জয়েন্ট ফ্যামিলির ব্যাপার... আপনাকেই এটা করে দিতে হবে।’’
ইকমিক কুকার-খ্যাত ইন্দুমাধব মল্লিকের নাতি অগত্যা রাজি। ‘‘অনেস্টলি বলছি, নানা রকমের রোল করার রসদ আমি আমাদের জয়েন্ট ফ্যামিলি থেকেই পেয়েছি।’’ ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, জজ, ব্যারিস্টার, চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট, সায়েন্টিস্ট, উকিল, প্রোফেসর— সব বাড়িতেই মজুত।
এই জয়েন্ট ফ্যামিলি ছেড়ে কে থাকবে?
তাই বম্বেয় কেরিয়ার গড়ার অফারও আমল দেননি।— ‘‘ভবানীপুরে আমরা মোর দ্যান টু হান্ড্রেড পিপল ইউজড টু স্টে টুগেদার!’’
পাঁচ ঠাকুরদার শাখার উত্তরাধিকারীদের বাড়ি গায়ে-গা লাগিয়ে! খ্যাতির মধ্যগগনেও রঞ্জিত মল্লিকের কাছে বরাবর সন্ধে মানেই ফ্যামিলি টাইম।
একবার প্রফেশনাল বোর্ডের নাটক করার সময়ে তো মহামুশকিল।
মল্লিকবাড়ির ছেলে হাসেন, ‘‘আমি বললাম, ডাবল শো করা অসম্ভব! সন্ধের আগে ফিরতেই হবে। আমার বাড়িতে পুজো...সন্ধ্যারতি হয়! ক-ত লোক আসেন, ওইটা আমি স্যাক্রিফাইস করতে পারব না।’’
রঞ্জিত মল্লিকের জন্যই সে-যাত্রা ডাবল শোয়ের টাইম পাল্টে গিয়েছিল। সেটাও রেকর্ড। দুপুর একটার শোয়েও হাউজফুল।
এখন টালিগঞ্জের গল্ফ ক্লাব রোডের লন-ঘেরা বাড়ির বাসিন্দা। তবে পুজোর সময়ে ঠিকানা সেই ভবানীপুর।
ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল
ছিঃ ছিঃ আপনার এই কাজ
একবার সেই তিনিই বাড়ির বড়দা-র ইমেজটা ভাঙতে চেয়েছিলেন!
ভিলেন করবেন।
বইয়ের নাম ‘ঈশ্বর পরমেশ্বর’!
জমিদারবাড়ির কর্তা।
নারীলোলুপ, মাতাল!
ছবি রিলিজের পর ত্রিবেণীতে ছুটি কাটিয়ে ফেরার সময়ে হাতেগরম রিঅ্যাকশন মিলল পাবলিকের। কোনও একটা লেভেল ক্রসিংয়ে তখন আটকেছে গাড়িটা।
কোনও চায়ের দোকান থেকে পাড়াগেঁয়ে মহিলা দেখতে পেয়ে উঠে আসেন!— ‘‘ছিঃ ছিঃ আপনি এ সব করলেন, খুব দুঃখ পেয়েছি! কী করে পারলেন, এ সব করতে?’’
হতভম্ব ভিলেনের ভিলেনি সেই শেষ। আর ও পথ মাড়াননি!
তবে স্নেহশীল দাদা তো আবার প্রতিবাদীও। সেটা কী করে হল?
‘‘দেখুন অনেস্টলি বলি, অন্যায় আমি সহ্য করতে পারি না! অ-সম্ভব রাগ হয়। সত্যিই! একটা চরিত্র আমার করা হয়নি। শরৎচন্দ্রের পল্লীসমাজ-এর রমেশকে মনে আছে? আমার ফেভারিট।’’
আজকের সৌম্য প্রবীণ আত্মগত, রমেশের মধ্যে কত দয়া, মায়া, মানুষের জন্য কত কী করে! কিন্তু সে যখন রেগে গিয়ে মারতে শুরু করে...তার চেহারার একটা ডেসক্রিপশন, চোখ দু’টো যেন আগুনের ভাঁটার মতো জ্বলছে!
রঞ্জিত (উত্তেজিত স্বরে): একবার যদি কেউ ভুল করে, ঠিক আছে! সেকেন্ড টাইম ভুল করলে না-মারলে হবে না, এটা আমি মনে-প্রাণে বিশ্বাস করি, আই বিলিভ...
হেরে গেলে চলবে না
এই তো সে-দিন পার্ক স্ট্রিটের রেস্তোরাঁয় ড্রাইভারকে আটকানো নিয়ে ফেসবুক-বিতর্কেও তাঁর নাম শোনা গিয়েছে। নেটের সচিত্র রসিকতা, রঞ্জিত মল্লিক না কি বেল্ট হাতে যাচ্ছেন, অন্যায়ের প্রতিকার করতে।
রঞ্জিত মল্লিক ফেসবুকে নেই! ফেসবুক রঞ্জিত মল্লিকে আছে। ড্রয়িং রুমের সোফায় গা এলিয়ে হা-হা হাসেন টলিউডি নায়ক।—
‘‘বোধহয় ‘সঙ্কল্প’ বলে একটা বই করছিলাম তখন! কোয়েল হব-হব করছে। বুঝে নিই, রোম্যান্টিক হিরোর থেকে এই প্রতিবাদী ইমেজটাই আমায় বেশি স্যুট করবে।’’
অঞ্জন চৌধুরীর সঙ্গে রঞ্জিত মল্লিকের যুগলবন্দি তখন টালিগঞ্জে আশীর্বাদ হয়ে নেমে আসে।—
‘‘উ-ফ ট্রিমেন্ডাস স্ক্রিপ্ট লিখতেন অঞ্জনবাবু, কীহ্ ডায়ালগ!’’ ‘শঠে শাঠ্যং’, ‘সঙ্কল্প’, লাল গোলাপ’ থেকে ‘শত্রু’-র দিনগুলোয় ফিরে গিয়েছেন ইন্ডাস্ট্রির সে-দিনের ত্রাতা।
‘শত্রু’র পরেও ‘নবাব’, ‘ইন্দ্রজিৎ’, ‘বিদ্রোহ’, ‘বিদ্রোহী’ অজস্র হিট...!
‘‘ভাবতে পারেন, নর্থ ক্যালকাটার দু’টো হলে পাশাপাশি ‘শত্রু’ চলছে। দুটো শো-ই হাউজফুল। ওপরওয়ালার আশীর্বাদ আমি ছবিটা করেছিলাম।’’
ছবিটার স্ক্রিপ্টরিডিংয়ের সময়েই রঞ্জিত মল্লিক ধরে ফেলেছিলেন, এ বই বাম্পার হিট হবে!—
‘‘তত দিনে ফিল্মে অ্যাক্টিংয়ের স্টাইলটাও আমি ধরে নিয়েছি।’’
সেটা কী রকম?
‘‘শুধু ক্যারেক্টারটা হলেই হবে না, অডিয়েন্সকে মাতিয়েও রাখতে হবে।’’
আরও বুঝেছিলেন, রঞ্জিত মল্লিককে হেরে গেলে চলবে না!— ‘‘ধরুন আমায় বাঘে তাড়া করেছে, তখনও কমন পাবলিকের মতো নয়...রঞ্জিত মল্লিকের মতো পালাতে হবে।’’
‘জীবন যে রকম’-এ ওয়াহিদার সঙ্গে। ছবি: সমর দাস
বাপেরও বাপ
‘চাবকে লাল করে দেব’ আর ‘বাপেরও বাপ আছে’ তাঁর ট্রেডমার্ক ডায়ালগ।
‘‘কত লোককে যে বেল্ট খুলে মেরেছি! একবার বুম্বাকেও...ছোট বউ-তে, স্ত্রীর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছিল। ভাগ্যিস লেগেটেগে যায়নি।’’
তখন বহু ছবির ডিরেক্টর, প্রোডিউসার কাস্টিং ঠিক করে হিরোরও আগে রঞ্জিত মল্লিকের ডেট আছে কি না দেখে নিতেন। অডিয়েন্স দেখত উনি আছেন, ঠিক আছে! ওঁর ডায়লগ মুখে মুখে ফিরত।
হাল্কা জড়ানো বাচনভঙ্গি, তাতে কমেডির মোচড় দেওয়া খোঁচা। সেটাই রঞ্জিত মল্লিক-স্পেশাল।
পরের প্রজন্মের হিরো জিৎ একবার ওঁর সামনেই একটু নকল করে দেখিয়েছিলেন। ‘‘আমি ডায়লগগুলো নিয়ে অঙ্কের মতো ভাবতাম। রেগে বলব? না হেসে বলব? না কি সারকাস্টিক্যালি বলব? লোকের কাছে হায়েস্ট অ্যাপিল কোনটায় হবে? শট তো হলে একটাই দেখা যাবে, সুতরাং বেস্টটা বেছে নিতে হবে।’’
রঞ্জিতবাবু এখনও অনায়াসে তিন যুগ আগের হিট সংলাপ মুখস্থ বলেন। ‘গুরুদক্ষিণা’য় কিপটে অসৎ ফ্যাক্টরি মালিকের ন্যায়নিষ্ঠ পুত্র।
মেশিনে হাত-কাটা কর্মচারীকে দেখতে যাওয়ার সময়ে বাবা বলছেন, ‘‘যাচ্ছ যাও, ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা বলো না, তোমার জন্য লাভের গুড় সব পিঁপড়েয় খেয়ে গেল!’’
তখন রঞ্জিতের ডায়ালগ, ‘‘পিঁপড়ের ওইটুকু পেটে লাভের গুড় আর কতটা যাবে, বাবা! কিন্তু লোক ঠকিয়ে ঠকিয়ে যে পাপের পরিমাণটা বাড়িয়েছ, সেটা অন্তত কিছুটা কমবে!’’
কিংবা মেজ বউ-এর সেই ডায়ালগ। নিজের দজ্জাল বউকে বলছেন বড় ভাশুর, ‘‘বিয়ের আগে তো শুনেছিলাম, তুমি কত কী পাশ, আর এখন দেখছি, এ পাশ, ও পাশ আর ধপাস্!’’ শুনে এখনও শিরদাঁড়া টানটান হয়ে বসে গ্রামবাংলা!
লর্ডস থেকে ল্যাংচা
কিন্তু আপনার অভিনেতা জীবনের শুরুটা তো সৌরভের লর্ডসে সেঞ্চুরির মতোই চমকপ্রদ!
প্রথম ছবি মৃণাল সেনের ‘ইন্টারভিউ’। কার্লোভি ভ্যারিতে আন্তর্জাতিক পুরস্কার।
সেখান থেকে গ্রামবাংলার ভগবান!
এটা কি এক ধরনের ডিমোশন হল না?
(একটু থেমে) ‘‘আমার স্কুলকলেজের শিক্ষকদের যতটা শ্রদ্ধা করি, ততটাই শ্রদ্ধা করি গ্রামের চাষিদের! যাঁদের ভালবাসা আমায় খাইয়ে-পরিয়ে রেখেছে।’’
দোসরা অগস্ট তারিখটাকেও তবু ভোলেননি রঞ্জিত মল্লিক। প্রতি বছর ওই দিনটায় এখনও মৃণাল সেনের বাড়িতে যান। ওঁকে মিষ্টি খাইয়ে আসেন!
১৯৭২-এ ওই তারিখেই ইন্টারভিউ-এর জন্য ‘বেস্ট অ্যাক্টর’ অ্যাওয়ার্ড পেয়েছিলেন।
সত্যজিৎ রায়ের ‘শাখা প্রশাখা’য় কাজের সুযোগও হয়েছে। কিন্তু নিজে কারও কাছে পার্ট চাননি।
তবে আফশোসও আছে, একটু।
রঞ্জিত বলেন, ‘‘তপন সিংহের সঙ্গে কাজ করা হয়নি! উনিও আমার একজন ফেভারিট ডিরেক্টর! আর কিছু মনে রাখতে চাই না!’’
কেন?
‘‘অনেস্টলি বলছি, মানুষের কাছ থেকে যে ভালবাসা পেয়েছি, তাতে সব দুঃখ আমার ঘুচে গিয়েছে। বিশেষ করে মা, খুড়িমা, জেঠিমাদের যা ভালবাসা পেয়েছি! আমার চোখে জল এসে যায়!’’
বছর দুয়েক আগের একটি ঘটনা।
এ বাড়ির কেয়ারটেকার এসে ভরদুপুরে বলল, কারা দেখা করতে চায়!
গৃহকর্তা বিরক্ত: বলা নেই কওয়া নেই, কারা অসময়ে!
বেরিয়ে দেখেন, তিন মহিলা।
বাংলাদেশ থেকে এসেছেন। ট্যাক্সিতে একজন শুয়ে। ক্যানসারের রোগী, হয়তো মারাই যাবেন! ডাক্তার জবাব দিয়েছে, ওঁরা দেশে ফিরে যাচ্ছেন।
একজন বললেন, ‘‘উনি আপনাকে ভীষণ ভালবাসেন। একবারটি দেখতে চান।’’
‘‘এইটা আমার কাছে ঈশ্বরদত্ত মনে হয়! আমি খুব সাধারণ অ্যাক্টর, এটা আমি জানি! কিন্তু এটা কী করে হয় বলুন তো?’’
শক্তিগড়ে তাঁর ছবি দেওয়া রঞ্জিত মল্লিক-খ্যাত ল্যাংচার দোকানটিও খেয়াল করেছেন। একবার শান্তিনিকেতন থেকে ফেরার পথে তিনি সশরীরে হাজির হতে ওঁরা অপ্রস্তুত।
রঞ্জিত হাসেন, ‘‘আমি কিছু বলিনি! পারমিশন না-নিলেও ভালবেসেই তো আমার ছবি রেখেছেন। ল্যাংচা কিনে গাড়িতে উঠলাম। অভিনয়ের জন্যই তো এ ভালবাসা।’’
আমার ছেলেকে হেনস্থা করলেন
নিজের অভিনয়ে কোনও দুর্বলতা খুঁজে পাননি?
‘‘অনেস্টলি বলছি, আমি বিশাল বড় জায়গায় খেলে বেড়িয়েছি, তা তো নয়! শত্রু-র পুলিশ অফিসার করার সময়ে বেহালা থানায় যেতাম। পুলিশ অফিসারদের ম্যানারিজম, টুপিটা কখন পরেন, কখন খুলে রাখেন— সব দেখতাম! ইন্দ্রজিৎ-এর ভাল পুলিশের রোলের সময়ও তাই। কিন্তু ধরুন, একটা মাঝির চরিত্র যদি আমায় করতে হত? পারতুম না, বলছি না! তবে সময় দিতে হত। খাটতে হত। ইন্ডাস্ট্রিতে সব সময়ে যে সময়টা পাওয়া যায় না।’’
স্বয়ংসিদ্ধা ?
‘‘আর একটা বাম্পার হিট। কিন্তু ডায়াগনালি অপোজিট! একজন মেন্টালি রিটার্ডে়ড পার্সনের রোল করতে গিয়ে কিন্তু আমায় বেকায়দায় পড়তে হয়েছিল।’’
রঞ্জিত মল্লিকের কাছে এই চরিত্র সামলাতে পারাও ‘ওপরওয়ালার আশীর্বাদ’!
ভবানীপুরের বাড়ির বারান্দা থেকে এক দুপুরে বাঁদর খেলার ভিড়ের মধ্যে এক যুবককে খুঁজে পেয়ে যান।
বছর তিরিশের ছেলেটি ঠিক বাচ্চাদের মতো লাফাচ্ছে, হাসছে, বিহেভ করছে।
‘‘বুঝে নিই, ওই আমার ক্যারেক্টার!’’
তারপর পাড়ার ছেলেকে ডেকে দেখেদেখে অভিনেতার অনুশীলন। ওর হাঁটা, কথা বলা সব রপ্ত করা! সেই অভিনয় করলেও পরে মুশকিলে পড়তে হয়েছিল।
‘স্বয়ংসিদ্ধা’ নিয়ে এক টিভি ইন্টারভিউয়ের পরে এক মহিলা কাগজে চিঠি লিখলেন।
তাঁর একমাত্র ছেলেও ওই রকম। ওর বয়সি ছেলেরা সারাক্ষণ তাকে ভ্যাঙাত। ওকে কোথাও খেলতে পাঠাতে পারতেন না!
মহিলার বক্তব্য, এ ভাবে ওঁর ছেলেকে হেনস্থা করা হয়েছে।
রঞ্জিত: ‘‘আমি পার্সোনালি ওঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম। ওঁর কষ্ট, কান্নায় আমার বুক ভেঙে যাচ্ছিল। আমি ওঁকে বোঝাই, আমি অনেস্টলি ওঁকে আঘাত দেওয়ার জন্য এটা করিনি। পরে ভদ্রমহিলা আমায় ছোট ভাইয়ের মতো দেখতেন!’’
পাশে মহানায়িকা। ছবি: ধীরেন দেব
দশ নম্বর ঘর
ফিল্মে অভিনয়ের আগে অভিজ্ঞতা বলতে তো বাড়ির পুজোর নাটকের পার্ট!
প্রথম ছবিটা মৃণাল সেনই পাখিপড়া পড়িয়েছিলেন। এর পরের শিক্ষা কিন্তু টালিগঞ্জের ফ্লোর থেকেই।
তেমনই এক ইস্কুল হল, এনটি ওয়ান স্টুডিয়োর দশ নম্বর ঘর।
‘‘তখন হিরো হিসেবে আলাদা ঘর পাই আমি! কিন্তু ওই ঘরেই পড়ে থাকতাম!’’
ওটাই সিনিয়র আর্টিস্টদের ঘর। রবি ঘোষ, উৎপল দত্ত, কালী বন্দ্যোপাধ্যায়, অনুপকুমাররা তখন রাজত্ব করছেন। রয়েছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।
‘‘কত আড্ডা, কত ইয়ার্কি! আমি চুপচাপ ওঁদের কথাগুলো গিলতাম। অনেস্টলি বলছি, অ্যাক্টিং নিয়ে ওই ঘর থেকেই কত কী জেনেছি! ’’
রঞ্জিত বলে চলেন, শ্যুটিং করার সময়ে নিজের শট না-থাকলেও, দেখতাম ওঁরা কী করছেন। অভিনয়ের সময়ে অনুপকুমার একটা ফল্স দিতেন, সেটা সাংঘাতিক ছিল...
আর উত্তমকুমার?
‘‘অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়ের ‘মৌচাক’-এর সময়ে ওঁর সঙ্গে কাজ করতে গিয়েও হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছিল। উনিই বুঝতে পেরে আমায় ইজি করলেন। এত ভদ্দরলোক, এত ভদ্দরলোক! আমার সবটা ভয় কাটিয়ে দিয়েছিলেন।’’
কোনও কোনও দিন সকালে ফ্লোরে এসেও উত্তম বলতেন, ওই শটটা আর একবার নেবেন প্লিজ।
ডিরেক্টর হয়তো বলছেন, ঠিকই তো আছে। তবু তিনি নাছোড়বান্দা! অভিনয়ের শিক্ষাগুরুদের কথা বলতে বলতে উচ্ছ্বসিত রঞ্জিত মল্লিক: আমি ভাবতাম, কী ডেডিকেশ! সারা রাত শটটা নিয়ে ভেবেছেন।
সৌমিত্র আর উত্তমের মধ্যে...
‘‘সৌমিত্রদা সুপার ফাইন অ্যাক্টর! দারুণ উইটিও! ওঁর সঙ্গে প্রচুর সময় কাটিয়েছি। কিন্তু স্টার বোধহয় উনি হতেও চাননি! উত্তমদা সুপার অ্যাক্টর প্লাস স্টার! তবে তার থেকেও বোধহয় বেশি ভাল মানুষ! অ্যান্ড আই কাউন্ট দ্যাট মোর...।’’
নায়িকা-সাংবাদ
সহ-অভিনেত্রীদের তিনি রেসপেক্ট করেন। শ্যুটিং ফ্লোরে কোনও প্রেমের ‘অভিযোগ’ তাঁর নামে নেই।
তবে রঞ্জিত মল্লিক বলেন, ‘‘অনেস্টলি বলছি, একটা মেয়ের সঙ্গে রোম্যান্টিক সিন করার সময়ে তাকে একটু ভালবাসতে হয়, একটা প্রেমের ভাব থাকতে হয়!’’
মনে করার চেষ্টা করেন, মহুয়ার সঙ্গেই বোধহয় সব থেকে বেশি কাজ। অপর্ণা সেন থেকে সুমিত্রা মুখোপাধ্যায় অনেকেই স্মরণীয়। স্ত্রী
দীপা পাশ থেকে বলেন, ‘‘সুমিত্রা তো বাড়িতেও আসতেন, তোমায় বন্ধু বলে ডাকতেন!’’
রঞ্জিত: খুব ভাল বন্ধু ছিল। দেখুন আমি মেকানিক্যাল নই, কাউকে ডিসলাইক করি, কিন্তু অ্যাক্টিং করে যাচ্ছি এটা পারব না।
রঞ্জিত-ঘরনি বলেন, ‘‘এটা আমিও বুঝতাম! ও কোনও দিনও বোঝায়নি, তবু বুঝতাম।’’
তবে যাই করেন, সাড়ে সাতটার পরে বাড়ি ফিরতেই হত তাঁকে। কেউ কেউ বলেন, বড় বাড়ির ছেলে, তাই কিছুটা সুখী অ্যাক্টর!
রঞ্জিত মল্লিক বলেন, ‘‘দেখুন আমি বেস্ট হওয়ার কথা ভাবিনি! যত ক্ষণ কাজ করেছি, মন দিয়ে করেছি। কিন্তু সন্ধের পরে ভাবতাম, পৃথিবীতে সিনেমার বাইরেও অনেক কিছু আছে। জীবনটাকে এ ভাবেই ভাগ করেছি।’’
কোয়েলের বাবা
‘‘রঞ্জিত মল্লিকের মেয়ে বলে লোকে তোমায় বড়জোর দু’টো বইয়ে দেখতে আসবে। তার বেশি নয়। সুতরাং আসলে তুমি একলা। যা করার তোমাকেই করতে হবে।’’—
মেয়েকে বলেছিলেন, বাবা!
একটা ছবির পিছনে এত টাকার স্টেক, ও পারবে তো? টেনশন ছিলই। হরনাথ চক্রবর্তী আশ্বাস দিয়েছিলেন।
বন্ধু বাবা না রাগী বাবা রঞ্জিত?
মেয়েকে কখনওসখনও বকেছেন, মারতে হয়নি কখনও।
‘‘বোধহয় ওর মাকেই বলেছিল, কাকে বিয়ে করতে চায়! আমাদের সময়ে এ সব বলতে আমরা হেজিটেট করতাম। এখন সময় পাল্টেছে (হাসি)। আমরা, আজকালকার বাবামায়েরা অন্য রকম!’’
মল্লিকবাড়ির মেয়ের অবাঙালি বাড়িতে বিয়ে নিয়ে কোনও দ্বিধা ছিল না?
‘‘ফ্র্যাঙ্কলি বলি, বাঙালি-অবাঙালি না! উই আর ইন্টারেস্টেড ইন আ গুড ছেলে! রানের বাবাকে তো কুড়ি বছর ধরে চিনি। ওদের ঘরের কত ছবি করেছি। শ্বশুর হিসেবেও আমি খুবই ফ্রেন্ডলি! ’’
সপরিবার। ছবি: গৌতম রায়
গোল্ডেন ডেজ
সেপ্টেম্বরের ২৮। ওঁর ৭২ বছরের জন্মদিন। মেয়ের বকুনিতে সিগারেট ছেড়ে দিয়েছেন। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে দমেরও কষ্ট হচ্ছিল।
তবে নিজেকে বাহাত্তুরে মনে হয় না।
এখন মন পড়ে থাকে, সেই ছোটবেলায়! হঠাৎ চলে যাওয়া পিঠোপিঠি সেজদা ‘ডাইদা’র সঙ্গে খুনসুটি, পুজোর ঢাকের তালে নাচ, কালীপুজোয় পটকা ফাটানোর দিনগুলো।— (ম্লান হাসি) ‘‘ওগুলোই গোল্ডেন ডেজ!’’
ফিল্ম থেকে প্রায় সরে এলেও কলকাতার শেরিফগিরি, ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব, কাজের অভাব ছিল না এত দিন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে শ্রদ্ধা করেন, তবে ভোটে দাঁড়াবেন না, বলে দিয়েছিলেন।— ‘‘অনেস্টলি, পলিটিক্স ইজ নট মাই কাপ অব টি!’’ তবে ‘হর’ (হরনাথ) আবার ধরেছে, তাই ফিল্মে ফেরার কথা ভাবছেন! কথা চলছে।
কেমন রোল করতে চান?
‘‘আর বেল্ট খুলে মারব না। সেটা বয়সোচিত হবে না! তবে অবশ্যই প্রতিবাদী চরিত্র।’’
http://www.anandabazar.com/supplementary/patrika/ranjit-mallik-the-actor-who-gave-tollywood-new-twist-and-turns-1.482948?ref=archive-new-stry
No comments:
Post a Comment