শেষ বারের মতে বিশ্বভারতীর জন্য বাজাতে এলেন পণ্ডিত রবিশঙ্করজি। এলমহার্স্ট ইন্সটিটিউট অব কমিউনিটি স্টাডিজ-এর সভায় যোগ দেওয়ার পর চলে এলেন কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি।
ওই বাড়িতে আমার বেড়ে ওঠা। ওঁকে ‘মাসি’ বললেও মায়ের চেয়ে কিছু কম ছিল না।মাসি আমায় ‘তানাজি’ বলে ডাকত।
পণ্ডিতজি এলেন। মাসিকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “মোহর, কেমন আছো? তুমি তো সেই আগের মতোই সুন্দরী রয়েছ।’’ ঘরে তখন বিশ্বভারতীর লোক জন। মাসি এতটাই লজ্জা পেল যে, অভ্যেসবশত শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ ঢাকল। পণ্ডিতজির সঙ্গে কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্পর্কটাই ছিল চিঠি দেওয়া-নেওয়ার। উভয়ই উভয়ের রূপে-গুণে মুগ্ধ! ওঁকে মাসি বলত, ‘জ্যোতির্ময় পুরুষ’। আসা যাওয়া তো ছিলই। মনে আছে, যখন পণ্ডিতজি মাসির চৌকাঠ পেরোচ্ছেন তখন বলে গেলেন, ‘‘মোহর, দেখা হবে। চাই এখানে, চাই এখানে (ওপরে আঙুল দেখিয়ে) ।’’
চিঠিই যেন মাসির জীবনে সুর চালাচালি করেছে। শিলং থেকে এক অজানা শ্রোতার চিঠি ওর জীবনের প্রথম প্রাপ্তি। ১৯৪০-এর ২৪ জুলাই-এ শুরু হল বোলপুর স্টেশন কেন্দ্র। সূচনা করলেন রবীন্দ্রনাথ। গান শেখালেন মোহর-কে। ‘ওগো তুমি পঞ্চদশী’। রেডিয়োয় সেই গান শুনে এল চিঠি। মাসি বলত, “ওই চিঠি বাইরের জগৎকে প্রথম আমার কাছে নিয়ে এল। গানকে আঁকড়ে ধরলাম।’’ ১৯২৪-এর ১২ অক্টোবর বাঁকুড়ার সোনামুখীতে জন্ম হলেও শান্তিনিকেতনই ছিল তার আসল জন্মস্থান। রবীন্দ্রনাথ মাসির ‘অণিমা’ নামটিকে ‘কণিকা’ করে দিয়েছিলেন। সেই ওর দ্বিতীয় জন্ম!
এক চৈত্রের কালবৈশাখী। কালো মেঘ দেখে মাসি বলতে শুরু করল, ‘‘মেঘ বৃষ্টি ঝড়ের দিনগুলো খুব ভাল লাগত আমার। ঝেঁপে বৃষ্টির সঙ্গে সুর মিলিয়ে গান। গুরুপল্লি থেকে লম্বা ছুটে উত্তরায়ণ, সেখান থেকে সপসপে ভেজা গায়ে শ্যামলীর দালানে। সে রকমই এক দিনে নজরে এলেন তিনি। সাদা চুল, সাদা দাঁড়ি-গোঁফ। বড় বড় চোখ। চোখের মধ্যে বিশ্ব লোকের চাবি! রবীন্দ্রনাথ। বললেন, ‘গান জানিস?’ আমি ডগমগ হয়ে শুনিয়ে দিলাম গান। শান্তিনিকেতনের মাটিতে কোনও লজ্জা ছিল না আমার।” তার পর থেকেই নতুন গান তোলার জন্য ডাক পড়ত মোহরের। কখনও উদীচি-তে বড়দের সঙ্গে ‘সুমঙ্গলী বধূ’। কখনও বর্ষামঙ্গলে ‘ছায়া ঘনাইছে’।
 ১৯৩৭ সাল। তেরো বছর বয়সে কলকাতার ছায়া সিনেমা হলে প্রথম অনুষ্ঠান। জোড়াসাঁকোর বাড়িতেই রিহার্সাল হতো। কণিকা চলে যেতেন অবনীন্দ্রনাথের কাছে। যিনি মোহরের নাম দিয়েছিলেন ‘আকবরী মোহর’। ‘নটীর পূজা’-য় রত্নাবলীর চরিত্রে ছিলেন কণিকা। বিয়েতে তাই ‘নটীর পূজা’-র ছবি এঁকে দিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
বর্ষামঙ্গলের সেই রিহার্সালে আসতেন কলকাতার সুন্দরীরা। মাসি বলত, ‘‘আমি হাঁ করে দেখতাম। বুঝেছিলাম কলকাতার মেয়েরা গায়ে সেন্ট মাখে! আর আমার তখন শ্রীনিকেতনের সাদামাঠা শাড়ি। চটাস চটাস চপ্পলের শব্দ নেই, খালি পা। গয়না বলতে কানে গোজা রঙ্গন বা সাদা ফুল।’’ এমনিতেই শহুরে আদব কায়দা দেখে আড়ষ্ট কণিকা। অনুষ্ঠানের দিন রবীন্দ্রনাথের চেয়ারের হাতল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ধরলেন ‘ছায়া ঘনাইছে’। এক সময় রবীন্দ্রনাথও গাইতে শুরু করেছেন!
বিপুল তরঙ্গ: আকাশবাণী ছিল মুগ্ধতা ছবি: পরিমল গোস্বামী
এভাবেই নিজে হাতে লিখে রবীন্দ্রনাথ শিখিয়েছিলেন  ‘একদিন চিনে নেবে তারে’। অল্প বয়সে সেই হাতের লেখার মূল্য দিতে পারেননি কণিকা। খোয়া গেছে সেই চিরকুট। আর শুধুই কি গান? নাটকেও মাসি জায়গা করে নিয়েছিল রবীন্দ্রনাথের উৎসাহে। ‘তাসের দেশ’-এর দহলানী, ‘ডাকঘর’-এর সুধা, ‘মায়ার খেলা’র প্রমোদা একের পর এক মঞ্চ অভিনয়ে এক অন্য মোহরকে খুঁজে পেয়েছিল শান্তিনিকেতন। অভিনয় গান সবেতেই দাপিয়ে বেড়ালেও সমালোচনা শুনলেই কুঁকড়ে উঠত মাসি। আকাশবাণীতে একবার গেয়েছিল ‘মনে কী দ্বিধা’। সেটা শুনে এক পত্রিকায় লেখা হয়েছিল ‘বিশ্রী গলা’। মাসি রাগ করে বলেছিল, আর কলকাতায় যাব না! পরে যদিও ‘দক্ষিণী’-র শুভ গুহঠাকুরতার ডাকে মাসি কলকাতায় ছুটে যেতেন।
ভীষণ স্পর্শকাতর মন। সমালোচকরাও অনেক সময় সুযোগ বুঝে আক্রমণ করেছেন ওকে। যেমন সুচিত্রা-কণিকার লড়াই।
১৯৪১। শান্তিনিকেতন শূন্য। রবীন্দ্রনাথ চলে গেছেন। সেই সময় সুচিত্রা মাসি শান্তিনিকেতনে গান শিখতে এল। তখন ইন্দিরা দেবী পিয়ানো বাজিয়ে সঙ্গীত ভবনে গান শেখাচ্ছেন। বর্ষামঙ্গল হচ্ছে, শারদোৎসব হচ্ছে। প্রফুল্লকুমার দাস আছেন। আছেন নীলিমা সেন, অরুন্ধতী দেবী। চিনা ভবনের সান্ধ্য আসরে প্রথম দেখা! সুচিত্রা সে দিন গাইলেন ‘ওই যে ঝড়ের মেঘে’। সুচিত্রার স্মার্টনেস্, ফর্সা রং, স্কিনের চাকচিক্য নিয়ে সে সময় শান্তিনিকেতনের মাঠেঘাটে জল্পনা— ‘শহরে থাকলে রং ফর্সা হয়’, ‘নিশ্চই দামি ক্রিম মাখে’, ‘হাঁটা চলায় কী তেজ’। কথা নেই। কেবল দু’জনে দু’জনকে আড়চোখে দেখা। মাসি বলেছিল, ‘‘আমি সুচিত্রার সাজ-পোশাক দেখতাম আর নিজের দিকে তাকাতাম। আমার লাল মাটির খালি পা। শাড়ির নীচের দিকটায় লাল ধুলো। রোদে পোড়া তামাটে রং।’’ কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যেই সুচিত্রামাসি সকলের মন জয় করেছিল। সুচিত্রা মাসির গান গাওয়া, ছবি আঁকা, পুতুল গড়া, রান্না, সব দেখে মাসি একেবারে মুগ্ধ! খুব জমল দুজনের।
এক জন ‘চিত্রাঙ্গদা’-য় কুরূপা তো আর এক জন সুরূপা। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গেও যেমন ‘শ্যামা’ রেকর্ডিং হল। শ্যামা আর বজ্রসেন মানেই তখন কণিকা-হেমন্ত জুটি। ’৬২ সালে এইচ এম ভি জনগণকে উৎসাহ দেওয়ার জন্য শিল্পীদের লরিতে গান গাওয়ার ব্যবস্থা করেছিল। সুচিত্রা মাসি শাড়ি পরে এক লাফে লরিতে। অন্য দিকে মাসি উঠতেই পারে না। কোনওমতে টুল পেতে ওঠাতে হয়েছিল। চরিত্রের মতো গানেও দু’জন দুটো ঘরানার ছিল। মাসি শৈলজারঞ্জন মজুমদারের আর সুচিত্রামাসি শান্তিদেব ঘোষের। আর এই ঘরানা নিয়েও সমালোচকরা দু’জনের মাঝে ফাটল সৃষ্টি করতে চেয়েছিল। মনোমালিন্য এমন হল যে, কবিপক্ষে রবীন্দ্রসদনে একই দিনে দুজনের গান। দুজন বসল দু’প্রান্তে। মাসি রেগে বলত, ‘‘সুচিত্রা অনুষ্ঠানে ১২ হাজার নিলে, আমায় ১ টাকা হলেও বেশি দিতে হবে।’’
দ্বিজেন (মুখোপাধ্যায়) জেঠুর কাছে আর একটা গল্প শোনা। কলকাতায় ‘মায়ার খেলা’ হবে। ঠিক হয়েছে কণিকা প্রমোদা আর সুচিত্রা শান্তা। দ্বিজেন জেঠু সুচিত্রা মাসিকে প্রস্তাবটা দিতেই সুচিত্রা মাসি বলেছিল, ‘‘আমি শান্তা করলে মোহর প্রমোদা করবে না।’’ দ্বিজেন জেঠু মাসিকে রাজি করাতে শান্তিনিকেতন পৌঁছলেন। মাসি জানতে চাইল, ‘‘শান্তা কে?’’ জেঠু বললেন ‘‘খুব ভাল গায় একটি সুন্দর মেয়ে।’’ কথামতো অনুষ্ঠানের আগে কলকাতায় রিহার্সাল করতে গিয়ে মাসি দেখল শান্তা আর কেউ নয়, স্বয়ং সুচিত্রা! মাসি তো আর গাইবে না। দ্বিজেন জেঠুর ওপর সব রাগ গিয়ে পড়ল! মাসিকে বোঝানো  হল, লোকে টিকিট কেটে বসে আছে সুচিত্রা-কণিকা শুনবে বলেই! অনুষ্ঠানের পর দুজনের গান শুনেই গলা জড়িয়ে দুজনের সে কী কান্না! সে এক দৃশ্য! মাসি চলে যাওয়ার পর সুচিত্রা মাসি আমায় বলেছিল, ‘‘মোহর চলে গেছে, আর শান্তিনিকেতনে যাব না।’’
শান্তিনিকেতনের বাইরে বেরিয়ে কিছু করার কথা কোনও দিনই ভাবেনি আমার মাসি। মাসিকে ঘিরেই ‘আনন্দধারা’ বাড়িটা যেন এক ছোটখাটো শান্তিনিকেতন হয়ে উঠত। ‘দেখি নাই ফিরে’ লেখার সময় সমরেশ বসু প্রায়ই আসতেন নানা রকম তথ্যের জন্য। রামকিঙ্কর সম্পর্কে জানতে চাইতেন মাসির কাছ থেকে। আর থেকে থেকেই মাসিকে বলতেন, ‘‘উপন্যাস শেষ হবে তো?’’
দুজনে দেখা হল: সুচিত্রা মিত্রকে সম্বর্ধনা তাঁর ছবি: বিশ্বরঞ্জন রক্ষিত
আবার সরস্বতী পুজো, যাকে মাসি বলত ‘তানাজির পুজো’, সেখানে খিচুড়ি থেকে বিকেলের মুড়ি-আড্ডায় শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো মানুষেরা থাকতেন। সৈয়দ মুজতবা আলী এলেই মাসিকে নিজের হাতে রেঁধে খাওয়াতে হত। লতা মঙ্গেশকর এলেন একবার। দেশিকোত্তম নিতে। ‘ছুটি’ রিসর্টে উঠেছেন। মাসি বলেছিল, বাগানের ফুল দিয়ে এসো। ফুল নিয়ে গেলাম, দেখলাম তেল চিটচিটে বিনুনি ঝুলিয়ে গাউন পরে স্বয়ং সরস্বতী বসে আছেন। বললেন, ‘কণিকাজি নে ফুল ভেজা, হাম উনসে মিলনে যায়েঙ্গে।’
‘আনন্দধারা’য় এলেন লতাজি, সঙ্গে ঊষাজি। লতাজি চেয়েছিলেন মাসির কাছে থেকে রবীন্দ্রনাথের গান শিখবেন। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কাছ থেকে উনি মাসির প্রচুর গল্প শুনেছেন। তবে মাসি যেমন, ‘আমার শরীর খারাপ’ বলেই কাটিয়ে দিল। বড্ড খামখেয়ালি ছিল আমার মাসি। শেষের দিকে তানাজি, গোরা আর আমার মা রুনুই ছিল ওর সম্বল।
ফিরে ফিরে চাও: মাসি ও তানাজি 
সত্যজিৎ রায়ের ‘আগন্তুক’ ছবিতে সাঁওতাল নাচের ব্যবস্থা মাসিই করেছিল। ‘আনন্দধারা’-র দালানে নাচের শ্যুটিং হয়েছিল। এক বার জানতে চেয়েছিলাম, সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে গান করোনি কেন! মাসি হেসে বলেছিল, ‘‘সুযোগ হয়নি।’’ সত্যজিৎ বলেছিলেন, ‘আপনার কণ্ঠকে ব্যবহার করার মতো সে রকম জায়গা পাইনি’।’’
সব না পাওয়াই কি মাসি এ ভাবে হাসিমুখে মেনে নিত? হয়তো না। ভিতরে অনেক বেদনা জমে থাকত ওর। যেমন ক্লাসের সেই অরূপ নামের ছেলেটির জন্য মন কেমন। সে বলেছিল, চিঠি লিখব। চিঠি এসেছিল। যা পড়ে মোহর লজ্জায় লাল। কিন্তু অরূপ আর আসেনি! মাসি আচমকাই বলেছিল, ‘‘প্রেম অজান্তে আসে, আবার ফুরিয়েও যায়।’’
বসে আছি এক বৃষ্টিদিনে। হাওয়ায় ভিজে লাল মাটির গন্ধ। সেই গন্ধে পুরনো বন্ধুদের স্মৃতিতে মাসি পিছনে চলে যাচ্ছে। পিছনের রাস্তায় রবীন্দ্রনাথ (এক শ্রাবণে দেখা, আর এক শ্রাবণে শেষ)। প্রিয় পুরুষ রবিশঙ্কর। বন্ধু-স্বামী বীরেন বন্দ্যোপাধ্যায়। রুনু, গোরা, তানাজি…মাসির প্রিয় পিয়ন হরিহরদা। যিনি রকমারি স্ট্যাম্প এনে দিতেন। অন্ধ তরুণ প্রেমিক কালু…বৃষ্টির অন্ধকারে সব ঝাপসা। ‘আনন্দধারা’-র দেওয়ালও সাদা। সামনে খেলার মাঠ। মোহর ছুটছে ফ্রক পরে, পিছনের বোতাম খোলা। ছোটার শেষ নেই! রবীন্দ্রনাথ ডেকেছেন যে! আবারও নতুন গান তুলতে হবে।

অনুলিখন: স্রবন্তী বন্দ্যোপাধ্যায়

http://www.anandabazar.com/supplementary/patrika/some-unknown-stories-of-singer-kanika-banerjee-1.597696?ref=archive-new-stry