ওঁর ঘরে বসে লতা মঙ্গেশকর
সেই প্রথম আরতি
সঙ্গীতকার সুশীল বন্দ্যোপাধ্যায়, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যর বিশেষ বন্ধু। তিনি তাঁর ছাত্রীকে নিয়ে এলেন ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যর কাছে। সকাল এগারোটা-সাড়ে এগারোটা বাজে। গরমকাল। ফ্রক পরা একরত্তি মেয়েটির গলায় মাফলার। মাম্পস্ হয়েছে।
সুশীলবাবু আলাপ করিয়ে দিলেন, ‘‘ওর নাম আরতি। এ বারে মারফি রেডিয়োর প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছে। তোমায় প্রণাম করবে। আশীর্বাদ করো। তোমায় গানও শোনাতে চায়।’’ সেই প্রথম আরতি মুখোপাধ্যায়ের ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যকে কাছ থেকে দেখা।
ধনঞ্জয় বললেন, ‘‘তুমি গান গাইতে পারবে? গলায় যে ব্যথা!’’ ক্ষীণ গলায় উত্তর, ‘‘পারব।’’ তখন ‘মামলার ফল’ ছায়াছবির কাজ চলছে। পরের পর দিন রেকর্ডিং। ধনঞ্জয় তখনই ফোন করলেন ছবির সঙ্গীত পরিচালককে, ‘‘আমার সঙ্গে একটি বাচ্চা মেয়ে ডুয়েট গাইবে। আপনি পরিচালক-প্রযোজকের সঙ্গে কথা বলে জানান।’’
পরক্ষণেই পরিচালকের ফোন, ‘‘কী ব্যাপার দাদা?’’ বললেন সব। উত্তর এল, ‘‘কিন্তু ছবিতে এমন কোনও সিচ্যুয়েশন নেই যে!’’ ধনঞ্জয় বললেন, ‘‘নেই তো কী হয়েছে! তৈরি করে নিন।’’
ওই এক কথাতেই স্ক্রিপ্ট পাল্টে গেল। বাবার গলায় গাইলেন ধনঞ্জয়। তাঁর বাচ্চা ছেলের লিপে আরতি মুখোপাধ্যায়। আরতি তখন এতই ছোট, রেকর্ডিং-এর সময় টেবিলের ওপর তাকে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হল মাইকের সামনে মুখ ধরতে।
সেই প্রথম আরতি মুখোপাধ্যায়ের সিনেমায় গান করতে যাওয়া।
কলেজ স্ট্রিটে লতা
বিদ্যাপতি ছবির কাজ হচ্ছে। ভি বালসারা সঙ্গীত পরিচালক। ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য গাইছেন। লতা মঙ্গেশকরও গাইবেন। রেকর্ডিং-এর দিন ধনঞ্জয় গান গেয়ে বাড়ি ফিরে এসেছেন। তার দু’দিন পর টেলিফোন। পুরুষকণ্ঠ। পরিচয় দিলেন, ‘‘হৃদয়নাথ মঙ্গেশকর। দিদি আপনার কাছে যাবে দাদা।’’ পর দিনই লতা মঙ্গেশকর এলেন। বালসারার অ্যাসিসটেন্ট গাড়ি করে নিয়ে এলেন। ধনঞ্জয় বলে রেখেছিলেন বাড়িতে, কেউ যেন লতাকে গান গাইতে না বলে। লতা এলেন। ঘরে বসে এ কথা, সে কথা। কিছুক্ষণ বাদে ধনঞ্জয়-জায়া রেখাদেবী অন্য সবার জোরাজুরিতে বলে ফেললেন, ‘‘বহিনজি, তুমি আমার বাড়িতে এলে অথচ গান শুনব না!’’ লতা হেসে বললেন, ‘‘আমার যে গানের বই লাগবে।’’ রেখাদেবী বললেন, ‘‘বই তো নেই। তুমি তো শুনেছি ঠাকুরের কাছে রোজ গান গাইতে বসো। সে-গানই করো না।’’ তাই-ই শোনালেন লতা মঙ্গেশকর। পাশে বসে হারমোনিয়ামে সঙ্গত করলেন ধনঞ্জয়। ঘণ্টা দুই থেকে চলে গিয়েছিলেন লতা মঙ্গেশকর।
সঙ্গীতকার সুশীল বন্দ্যোপাধ্যায়, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যর বিশেষ বন্ধু। তিনি তাঁর ছাত্রীকে নিয়ে এলেন ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যর কাছে। সকাল এগারোটা-সাড়ে এগারোটা বাজে। গরমকাল। ফ্রক পরা একরত্তি মেয়েটির গলায় মাফলার। মাম্পস্ হয়েছে।
সুশীলবাবু আলাপ করিয়ে দিলেন, ‘‘ওর নাম আরতি। এ বারে মারফি রেডিয়োর প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছে। তোমায় প্রণাম করবে। আশীর্বাদ করো। তোমায় গানও শোনাতে চায়।’’ সেই প্রথম আরতি মুখোপাধ্যায়ের ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যকে কাছ থেকে দেখা।
ধনঞ্জয় বললেন, ‘‘তুমি গান গাইতে পারবে? গলায় যে ব্যথা!’’ ক্ষীণ গলায় উত্তর, ‘‘পারব।’’ তখন ‘মামলার ফল’ ছায়াছবির কাজ চলছে। পরের পর দিন রেকর্ডিং। ধনঞ্জয় তখনই ফোন করলেন ছবির সঙ্গীত পরিচালককে, ‘‘আমার সঙ্গে একটি বাচ্চা মেয়ে ডুয়েট গাইবে। আপনি পরিচালক-প্রযোজকের সঙ্গে কথা বলে জানান।’’
পরক্ষণেই পরিচালকের ফোন, ‘‘কী ব্যাপার দাদা?’’ বললেন সব। উত্তর এল, ‘‘কিন্তু ছবিতে এমন কোনও সিচ্যুয়েশন নেই যে!’’ ধনঞ্জয় বললেন, ‘‘নেই তো কী হয়েছে! তৈরি করে নিন।’’
ওই এক কথাতেই স্ক্রিপ্ট পাল্টে গেল। বাবার গলায় গাইলেন ধনঞ্জয়। তাঁর বাচ্চা ছেলের লিপে আরতি মুখোপাধ্যায়। আরতি তখন এতই ছোট, রেকর্ডিং-এর সময় টেবিলের ওপর তাকে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হল মাইকের সামনে মুখ ধরতে।
সেই প্রথম আরতি মুখোপাধ্যায়ের সিনেমায় গান করতে যাওয়া।
কলেজ স্ট্রিটে লতা
বিদ্যাপতি ছবির কাজ হচ্ছে। ভি বালসারা সঙ্গীত পরিচালক। ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য গাইছেন। লতা মঙ্গেশকরও গাইবেন। রেকর্ডিং-এর দিন ধনঞ্জয় গান গেয়ে বাড়ি ফিরে এসেছেন। তার দু’দিন পর টেলিফোন। পুরুষকণ্ঠ। পরিচয় দিলেন, ‘‘হৃদয়নাথ মঙ্গেশকর। দিদি আপনার কাছে যাবে দাদা।’’ পর দিনই লতা মঙ্গেশকর এলেন। বালসারার অ্যাসিসটেন্ট গাড়ি করে নিয়ে এলেন। ধনঞ্জয় বলে রেখেছিলেন বাড়িতে, কেউ যেন লতাকে গান গাইতে না বলে। লতা এলেন। ঘরে বসে এ কথা, সে কথা। কিছুক্ষণ বাদে ধনঞ্জয়-জায়া রেখাদেবী অন্য সবার জোরাজুরিতে বলে ফেললেন, ‘‘বহিনজি, তুমি আমার বাড়িতে এলে অথচ গান শুনব না!’’ লতা হেসে বললেন, ‘‘আমার যে গানের বই লাগবে।’’ রেখাদেবী বললেন, ‘‘বই তো নেই। তুমি তো শুনেছি ঠাকুরের কাছে রোজ গান গাইতে বসো। সে-গানই করো না।’’ তাই-ই শোনালেন লতা মঙ্গেশকর। পাশে বসে হারমোনিয়ামে সঙ্গত করলেন ধনঞ্জয়। ঘণ্টা দুই থেকে চলে গিয়েছিলেন লতা মঙ্গেশকর।
টাকা নয়, মদনমোহন চাই
মীরাবাঈ ছবির গানের রেকর্ডিং। ভারতলক্ষ্মী স্টুডিয়োয়। রেকর্ডিং শেষে স্টুডিয়োর কর্ণধার বাবুলাল চুখানিকে ধনঞ্জয় বললেন, ‘‘আমার টাকা চাই না। আপনার দেওয়ালে ওই যে মদনমোহনের (গোপাল) ছবিটি টাঙানো আছে, ওটি আমায় দিয়ে দিন।’’ বাবুলাল কিছুতেই রাজি নন। ধনঞ্জয়ও নাছোড়। এক সময় তাঁর চোখে জল চলে এল। টাকা না নিয়েই স্টুডিয়ো ছেড়ে চলে গেলেন।
সন্ধের দিকে ঝমঝমে বৃষ্টি কলকাতায়। রাত আটটা কী ন’টা বাজে। বাবুলাল তাঁর ছেলেকে ডেকে বললেন, ‘‘জগদীশ, তুমি ছবিটা খুলে ওঁকে দিয়ে এসো। আমি ওঁর ভক্তির কাছে হার মেনেছি। পাগলটা ছবি না পেলে আজ সারা রাত হয়তো জেগেই বসে থাকবে।’’
জগদীশ গেলেন ধনঞ্জয়ের বাড়ি। মদনমোহন হাতে পেয়ে বুকে জড়িয়ে ধরলেন ধনঞ্জয়। যেন সাত রাজার ধন মানিক! বললেন, ‘‘জানো জগদীশ, আমি জানতাম, এ ছবি আমি পাবই।’’
মোহনবাগানি ধনঞ্জয়
ছিলেন পাঁড় মোহনবাগানি। মোহনবাগানের খেলা থাকলে মাঠে যাবেনই যাবেন। মোহন-ইস্ট ম্যাচের দিন অনুষ্ঠান থাকলে উদ্যোক্তারা প্রার্থনা করতেন, যেন মোহনবাগান জেতে, নইলে ধনঞ্জয় যে কী করবেন বলা মুশকিল!
ময়দানেও তাঁর ভক্ত কম ছিল না। পিকে বন্দ্যোপাধ্যায়, চুনী গোস্বামী কে না! কোচিং করার সময় মাঠ থেকে টেন্টে ফিরে নিজের ঘরে বসে নিজেকে হাল্কা করতে পিকে বন্দ্যোপাধ্যায় প্রায়ই ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যর গান ভাঁজতেন।
মোহনবাগানের ধীরেন দে এক বার তাঁকে ফুটবল-সচিব করবেন বলে উঠে পড়ে লেগেছিলেন। রাজি হননি ধনঞ্জয়। উঠতি অভিনেতা বিশ্বজিৎ চট্টোপাধ্যায় যখন হাতিবাগানের থিয়েটারে ‘এক্সট্রার’ রোল করছেন, থাকতেন মির্জাপুরের মেসে (যে মেসে জহর রায়ও থাকতেন)। ময়দানে খেলা দেখতে গেলে বিশ্বজিৎ ফিরতেন ধনঞ্জয়ের গাড়িতেই। ওঁর সঙ্গে ধনঞ্জয়ের সম্পর্ক ছিল দাদা-ভাইয়ের মতো। বিশ্বজিৎ যখন ‘ছোট্ট জিজ্ঞাসা’ (প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের প্রথম ছবি) করবেন, ওঁর স্ত্রী রত্নাদেবী কলকাতায় এসে এক বার শুধু বলেছিলেন, ‘‘দাদা আপনাকে কিন্তু গাইতে হবে।’’ এক কথায় ‘হ্যাঁ’ বলেছিলেন ধনঞ্জয়।
ডান হাতে ঘড়ি, গালে পান
’৪৬ কী ’৪৭ সাল। বাংলাদেশ। যশোরে অনুষ্ঠান। লঞ্চে করে অনেকটা গিয়ে, তবে গাড়িতে যেতে হবে। যশোরের ঠিক আগে কোত্থেকে এক দল ছাত্র এসে ধুপধাপ করে লঞ্চ দাপিয়ে বেড়াতে লাগল। যেন কাউকে ওরা খুঁজে বেড়াচ্ছে। পাচ্ছে না। হঠাৎ ধনঞ্জয় শুনলেন, ওদেরই কেউ বলছে, ‘‘এই লঞ্চেই আইতাসে। খুঁজ খুঁজ। দ্যাখ কেডার ডাইন হাতে ঘড়ি, গালে পান।’’
ধনঞ্জয়ের আর বুঝতে বাকি রইল না, ওরা কাকে খুঁজছে। ডান হাতে ঘড়ি, গালে পান যে তারই ট্রেডমার্ক। খুব ভয় পেয়ে গেলেন। কী করবে এরা! মেরে ফেলবে না তো? ঘড়ি ডান থেকে বাঁ হাতে নিলেন। গালের পান ফেলে দিলেন। কিছুক্ষণ বাদে যশোর চলে এল। হোটেলে নিয়ে ওঠালেন ওখানকার লোকজন। যত্নের কোনও ত্রুটি নেই। ভয়-আশঙ্কা তখন গেল।
সন্ধেয় অনুষ্ঠান। কাল ফিরে যাওয়া। স্ত্রী তখন সন্তানসম্ভবা। তাঁর জন্য চিন্তাতেও আছেন।
এ দিকে দুপুর থেকে শুরু হল বৃষ্টি। এত বৃষ্টি এত বৃষ্টি যে সে দিন অনুষ্ঠান হতেই পারল না। এ বার উদ্যোক্তাদের অনুরোধ, ‘‘দাদা কাইল থাইক্যা, প্রোগ্রাম কইরা পরশু যান।’’
সে কী করে সম্ভব! বাড়ির ওই অবস্থা। বললেন, ‘‘আপনারা টাকা ফেরত নিন। আমায় যেতে দিন।’’
কর্মকর্তারা তাতেও রাজি নন। এ বার সেই ছাত্রর দল হোটেলে চড়াও। — ‘‘আপনের তো খুব জেদ দ্যাখতাসি। প্রোগ্রাম করবেন না, ট্যাকাও ফিরত দিয়া দিবেন! দেখি আপনার যাওয়া কী কইরা হয়! আমরা শুইয়া পড়ুম রাস্তায়। যাইতে হইলে আমাগো পাড়াইয়া যাইতে হইব।’’
শেষে বাধ্য হলেন ধনঞ্জয়।
টাকা নিয়ে তবে ছাড় পেলেন। যখন লঞ্চে উঠছেন, দেখেন সেই ছাত্রর দল একটু দূরেই দাঁড়িয়ে। হাউ হাউ করে কাঁদছে ওরা।
টাকা নিয়ে তবে ছাড় পেলেন। যখন লঞ্চে উঠছেন, দেখেন সেই ছাত্রর দল একটু দূরেই দাঁড়িয়ে। হাউ হাউ করে কাঁদছে ওরা।
ওঁর চোখও ভেসে গেল জলে!
http://www.anandabazar.com/supplementary/patrika/life-and-works-of-singer-dhanajay-bhattacharya-1.206098?ref=archive-new-stry
No comments:
Post a Comment