Sunday, 11 June 2017

আজ ইস্টবেঙ্গল জনতার কাছে ক্ষমা চান বড়ে মিঞা

আজ ইস্টবেঙ্গল জনতার কাছে ক্ষমা চান বড়ে মিঞা

ময়দানের এককালীন দাপুটে নবাব। এখন স্বেচ্ছানির্বাসিত। হায়দরাবাদে। ষাটোর্ধ্ব মহম্মদ হাবিবের ডেরায় বসে পুরনো সাম্রাজ্যের অলিগলি হয়ে নয়া জমানা নিয়ে তাঁর গর্জন শুনে এলেন সুপ্রিয় মুখোপাধ্যায়। সঙ্গী আলোকচিত্রী উৎপল সরকার। আজ দ্বিতীয় কিস্তি

৪ জুলাই, ২০১৫, ০০:০৩:৫২
2

গোলকোন্ডায় নবাব

দূর থেকে আজানের স্বর ভেসে আসছে। আল্লা…আ…আ…

জানকী নগরের বাড়িতে সোফায় বসা মিঞার চোখ তখন সিলিঙের দিকে।

থমথমে মুখ। সফেদ পাঞ্জাবি গায়ে। কালো চশমার আড়ালটা আজ আর নেই। ঈষৎ ফ্যাকাশে লাগছে যেন তাঁকে।

মধ্য সত্তরের এক বিতর্কিত অধ্যায় তোলার পর প্রথমে হেসে উঠেছিলেন। তার পরই যেন শব্দ হারিয়ে ফেললেন।

অনেক বাদে অস্ফুট স্বরে বললেন, ‘‘কসুর মেরা ভি থা দাদা। লেকিন উও লোগ সব্ বেকার কর্ দিয়া!’’

কী বলতে চাইছেন মহম্মদ হাবিব? তখনও বুঝে উঠতে পারিনি।

১৯৭৫। টানা ছ’বার কলকাতা লিগ জিতে নতুন রেকর্ড গড়ার মুখে ইস্টবেঙ্গল।
অথচ সে বারই লালহলুদ জনতাকে ভাসিয়ে দিয়ে ইস্টবেঙ্গল ছেড়ে মহমেডানে চলে গেলেন মহম্মদ হাবিব। তা’ও আবার একা নয়। সঙ্গে আকবর, লতিফুদ্দিন, মহম্মদ নাজির।
টানা পাঁচ বার লিগ জেতার পুরনো গৌরব তখনও মহমেডানের দখলে।
ময়দানে রটেছিল, কট্টর মৌলবাদী হাবিব চাননি মহমেডানের সে রেকর্ড ভেঙে যাক। তাই এই চলে যাওয়া।
এমনকী হাবিবের মহাগুরু তখনকার ইস্টবেঙ্গল-কোচ পিকেও নাকি ঘরোয়া আড্ডায় এই সম্ভাবনার কথা উড়িয়ে দেন না।

সাদা হাবিব-কালো হাবিব
১৯৭০-’৭৪ হাবিব যখন ইস্টবেঙ্গলে, এক হাজার ন’শো বত্রিশ দিন মোহনবাগানের কাছে হারেনি লাল-হলুদ।
লিগ-শিল্ড-ডুরান্ড-রোভার্স মিলিয়ে ওই পাঁচ বছরে জিতেছেন ১৩টা ট্রফি। পাঁচটা ফাইনালে গোল তাঁর।
তা সত্ত্বেও ‘মিস্টার ফাইটার’ বলতে ভারতীয় ফুটবল বরাবর যাঁকে বোঝে, সেই হাবিবের বিরুদ্ধে ’৭৫-এর সেই অভিযোগ আজও। এখনও।
হায়দরাবাদের বাড়িতে তাঁর সামনেই কথাটা তোলার আগে ভাবছিলাম এ বার নির্ঘাৎ
রাগে ফেটে পড়বেন। টেপরেকর্ডার বন্ধ-টন্ধ করিয়ে সটান বলে দেবেন, ইন্টারভিউ এখানেই শেষ!
কিন্তু দু’হাজার পনেরোর হাবিব কী করলেন?
হো-হো করে হাসতে লাগলেন। সাতষট্টির প্রৌঢ় শরীরটা সোফায় প্রায় গড়িয়ে পড়ার জোগাড় (আগের সংখ্যায় তাঁর বয়স একষট্টি ভুল লেখা হয়েছিল)। ‘‘আরে দাঁড়ান, দাঁড়ান। এটা তো জানতাম না! হাবিব ফান্ডামেন্টালিস্ট? হাবিব?’’ আবার অট্টহাসি!
খানিকটা হতভম্ব হয়েই তাকিয়ে রয়েছি। এক পলক থেমে বড়ে মিঞা বলতে শুরু করলেন, ‘‘আমি যদি সত্যিই এতটা গোঁড়া মুসলিম হতাম তা হলে তো সবচেয়ে বেশি মহমেডানে খেলতাম। অথচ আসল ঘটনা তো ঠিক তার উল্টো। ওখানেই সবচেয়ে কম সিজন খেলেছি। ইস্টবেঙ্গলে আট বছর। মোহনবাগানে সাত। মোহনবাগানেও ’৭৬-’৭৮ তিন বছরে লিগ, শিল্ড, ডুরান্ড, রোভার্স মিলে আটটা ট্রফি আছে আমার।’’
এর পরই হঠাৎ ভীষণ সিরিয়াস। এক্কেবারে চুপ। সিলিঙের দিকে চোখ রেখে যেন কথা হারিয়ে ফেললেন। বহু ক্ষণ বাদে গম্ভীর গলায় বললেন, ‘‘আসলে কী জানেন? পঁচাত্তরে যে ইস্টবেঙ্গল ছেড়েছি, তার জন্য আজ চল্লিশ বছর পরেও আমি কষ্ট পাই। এত বছর পরেও ওই ভুলের জন্য নিজেকে মাফ করতে পারি না। তার আগের পাঁচ বছর ইস্টবেঙ্গলকে অত সার্ভিস দিলাম। অথচ রেকর্ডের বছরটাতেই থাকতে পারলাম না! ছিঃ!’’
হাবিবের ছোট্ট ড্রইংরুমটা তখন যেন কেমন থমথম করছে। পাশে সোফায় তাঁর বিবি। গালে হাত দিয়ে বসে। এক মনে মিঞার কথা শুনছেন।
‘‘আমার ভুলে আকবরেরও ক্ষতি হয়েছে। একটা বিরাট রেকর্ডের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে রাখতে পারত ও।  পারেনি। এই একটা ব্যাপারে ভাইয়ের কাছেও আমি দোষী। পরে আমি আর আকবর বারদুয়েক আলাদা ক্লাবে খেলেছি। আমি মোহনবাগানে, ও মহমেডানে। ও ইস্টবেঙ্গলে, আমি মহমেডানে। কিন্তু সেই পঁচাত্তরে আকবর আমার সঙ্গে এক টিমে ছাড়া কলকাতার বড় ক্লাবে খেলার সাহস পেত না। ওর তখন ক্যালকাটার বড় টিমে খেলার অভিজ্ঞতা মাত্র তিন-চার বছরের। যে জন্য আকবরও আমার সঙ্গে মহমেডানে গিয়েছিল। কিন্তু আমি না গেলে ও কি আর যেত?’’ একটানা নিজের দোষ কবুল করলেন মিঞা।
এই হাবিব যন্ত্রণাকাতর হাবিব! কথা বলতে বলতেই হঠাৎ উঠে পড়লেন। বাড়ি থেকে রাস্তায় বেরিয়ে এলেন। উল্টো দিকের ফুটপাথে একটা রক। তার ওপরই বসে পড়লেন ময়দানের এককালের নবাব।
‘‘তা হলে আসল কথাটা শুনুন! কলকাতায় ফিরে প্রদীপদাকে চেপে ধরলেও জানতে পারবেন। মিলিয়ে নেবেন আমার কথা,’’ আবার সে দিনের ঘটনায় ফিরে গেলেন।
যা বললেন, তা অনেকটা এমন— পঁচাত্তরে দলবদল শুরু হবে। ইস্টবেঙ্গলেরই কয়েকজন অফিশিয়াল সুযোগ পেলেই নাকি তখন তাঁর কানের কাছে ঘ্যানঘ্যান করতেন। — ক্লাব এ বার আর দুই ভাইকে রাখবে না। মহমেডানের রেকর্ড ভাঙতে চলেছে ইস্টবেঙ্গল। তাতে তাঁদের ধারণা, দাদা-ভাই মিলে স্যাবোটাজ করতে পারে!
‘‘ভুলটা আমারই হয়েছিল, আমি ওদের কথাতে নেচে প্রচণ্ড অভিমান আর রাগে প্রদীপদার সঙ্গেও এক দিন ঝগড়া করে বসেছিলাম। যার জন্য কোচও ওই সময় একটু বিরক্ত ছিলেন আমার উপর। আমি যদি ওই ফালতু কর্তাগুলোর কথাকে পাত্তা না দিতাম তা হলে অত বড় ভুলটা হত না। এখনও ভাবি, ইস, যদি এক বার সোজা ডাক্তারদাকে (ডা. নৃপেন দাস, তখনকার ইস্টবেঙ্গল-সচিব) গিয়ে জিজ্ঞেস করতাম!’’ আফশোস আজও যাওয়ার নয় তাঁর।
এই সময় হাবিবকে এক বার দেখতে হয়। কোথায় সেই ‘বাঘের বাচ্চা’ ইমেজ? হঠাৎ যেন কুঁকড়ে গিয়ে মাটিতে মিশে যেতে পারলে বাঁচেন। 
এর পরই কিন্তু স্বমহিমায়। পাল্টা অভিযোগে বোমা ফাটানো, ‘‘শুনুন, ইস্টবেঙ্গল কর্তাদেরই একটা অংশ চায়নি ক্লাব টানা ছয় বছর লিগ পেয়ে রেকর্ড করুক। ডা. নৃপেন দাসের গোষ্ঠী আরও পপুলার হোক। আরও ক্ষমতা পাক।’’

সিংহবিক্রমে বার্ধক্যের থাবা
হাবিবের বয়স এখন ঠিক কত? ঠিক কোন সালে তিনি অর্জুন হয়েছেন?
তিন দিনে তিন বার জিজ্ঞেস করে তিন রকম উত্তর পাওয়া গেল।
চার দশক আগের ডাকসাইটে ফুটবলার এখন এতটাই আত্মভোলা! এক বার বললেন, ‘‘একষট্টি চলছে।’’
আর এক দিন বললেন, ‘‘আমার নাইনটিন ফর্টিনাইনে জন্ম।’’ তা হলে তো এখন ছেষট্টি!
হাবিব অর্জুন হয়েছেন গুরদেব সিংহেরও পরে! ফেডারেশনের চিরকালীন তুঘলকি কাজকারবারের সে এক চরম নিদর্শন।
তা বলে রাষ্ট্রপতির হাত থেকে অর্জুন নেওয়ার সাল-তারিখ ভুলে যাবেন হাবিব! এতটা বার্ধক্য কি ধরে গেল মহাদাপুটে ফুটবলারের মনে?
অর্জুনটা কোথায়? এ বাড়িতে, না আগের বাড়িতে?
এ প্রশ্ন করলেও প্রশ্নকর্তা নিজেই অস্বস্তিতে পড়বেন! কারণ হাবিবের উত্তর হবে, ‘‘কে জানে! বিবি বোধহয় জানে। শেষ বার তো ওটা পুরনো বাড়ির আলমারিতেই দেখেছিলাম, যদ্দূর মনে হচ্ছে!’’
হাবিব অর্জুন হয়েছিলেন ১৯৮০-তে। গুরদেবের দু’বছর পরে! কিন্তু অবলীলায় বলে দিলেন, ‘‘আমার শাদি তিয়াত্তরে। আর তার পরের বছরই অর্জুন!’’
এর পরে এই মানুষের বাকি সব ট্রফি, মেমেন্টোর খোঁজ নেওয়ার মানে হয়! কিন্তু ওই যে, আগের সংখ্যায় লিখেছিলাম— এক সাক্ষাৎ কনট্রাডিকশন ভরা আজকের এই মহম্মদ হাবিব! আমাদের ক্যালকুলেশেন যাঁর বয়স এখন সাতষট্টি।
পরক্ষণেই বলে উঠলেন, ‘‘তবে বছর চারেক আগে মমতাদিদির হাত থেকে পাওয়া ‘মহমেডান কা শান’ পুরস্কারটা এ বাড়িতেই রয়েছে। দেখুন, আমার সিধা বাত। জীবনে সবচেয়ে বেশি ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগানে খেললেও ওরা কেউ আমাকে লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট প্রাইজ দেওয়ার কথা ভাবেনি। কিন্তু মহমেডান ভেবেছে। যাদের হয়ে আমি সবচেয়ে কম খেলেছি। তেমন সাকসেস দিতে পারিনি। কী প্লেয়ার, কী কোচ— কোনও ভাবেই না। তাই এটা পেয়ে আমি সেদিন অভিভূত হয়েছিলাম। কলকাতা থেকে আমার পাওয়া সেরা সম্মান ওটাই।’’
হাবিবরা পাঁচ ভাই-ই মেরেকেটে দু’-তিন বছরের ছোট-বড়। আকবর যেমন হাবিবের চেয়ে আ়ড়াই বছরের ছোট। কথায়, হাবেভাবে এই আকবর কিন্তু তুলনায় অনেক গোছানো। স্মার্ট।
ছিয়াত্তরে মোহনবাগানে সই করার পর শৈলেন মান্না আকবরকে জিওলজিক্যাল সার্ভেতে চাকরির ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। যেখানে বাগানের মান্না নিজেও বরাবর চাকরি করেছেন। জিএসআই থেকে বছর তিনেক আগে অবসর নিয়েছেন আকবর। থাকেন হাবিবের জানকীনগরের বাড়ি থেকে অল্প দূরে। অলোকনাথ কলোনিতে।
মাঠের বাইরে গিয়ে আজও ‘থ্রু’টা বাড়িয়ে যান তাঁর আকবর ভাইয়াকে
পরের দিন সকাল ন’টাতে আকবর জানকীনগরের বাড়িতে এসে পড়ার পর অদ্ভুত একটা কাণ্ড ঘটল। এতক্ষণের অগোছালো হাবিব এ বার যেন ধীরে ধীরে কিছুটা স্বচ্ছন্দ। দাদা-ভাইয়ের পুরনো দিনের সেই তালমিল আজও তা হলে বহাল!
‘‘আকবরভাইয়া, তোর সাল-তারিখ ভাল ইয়াদ থাকে। এদের বল তো! আমি গুলিয়ে ফেলছি,’’ এক গাল হেসে প্রৌঢ় এ বার যেন এক কিশোরের ভূমিকায়।

হাবিব = গোল + ট্রফি
অত শত তারকার ভিড়ে কী ভাবে অসংখ্যবার নিজে মহাতারকা হয়ে ফুটে উঠতেন তার ব্যাখ্যাও রয়েছে হাবিবের কাছে।
টলি চৌকির উপর অত সাতসকালেও ক্যাঁচোরম্যাচোরে ভরা রেস্তোরাঁয় বসে মশালা ধোসার এক টুকরো মুখে পুরে বললেন, ‘‘এই দোকানটা দেখতে সাধারণ। কিন্তু খাবারটা অসাধারণ। স্পেশ্যাল। নিজের ফুটবলজীবনের যেন মিল পাই এখানে খেতে খেতে।’’
ঠিক বোঝা গেল না, বলাতে হাবিব হেসে ফেললেন। ‘‘বুঝলেন না? আমার জ্ঞানবুদ্ধিতে যতটুকু সম্ভব তেমনই একটা উদাহরণ দিলাম আর কী!’’
খাওয়া শেষ করে চায়ের কাপে একটা আরামের চুমুক দিলেন হাবিব। মুখে আলতো হাসি। বললেন, ‘‘মানে আমার ফুটবল দেখতে সাধারণ ছিল, কিন্তু রেজাল্টটা ছিল স্পেশ্যাল।’’
পাশের চেয়ারেই বসে আকবর। হঠাৎ যেন বড়ে মিঞা তাকে দেখে ‘থ্রু’ দিয়ে ফেললেন, ‘‘বল না, কত গোল করেছি ইম্পর্ট্যান্ট সব ম্যাচে!’’
বড় দাদার স্ট্যাটিসটিক্স ভাইয়ের ঠোঁটের গোড়ায় ঘোরে। ভেতরে ভেতরে একটু খালি গুছিয়ে নিলেন নিজেকে। দাদার লম্বা পাস পেয়ে  বক্সের মাথায় যেমন করে যত্নে নামাতেন, অনেকটা তেমনই যেন।
আকবরের লম্বা ফিরিস্তি এক চুম্বকে এ রকম— সব মিলিয়ে ৫০টা টুর্নামেন্ট জিতেছেন হাবিব। ইস্টবেঙ্গলের ইতিহাসে প্রথম পাঁচ টপ স্কোরারের এক জন। ৬২টা গোল আছে লাল-হলুদ জার্সি গায়ে। শুধু বাহাত্তরের ডুরান্ডেই ৭ ম্যাচে ১২ গোল। ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান ডার্বিতে হাবিবের ১০টা গোল সর্বকালীন সর্বোচ্চ গোলের তালিকায় চার নম্বরে। তবে অদ্ভুত, ওই ১০ টাই ইস্টবেঙ্গলের হয়ে মোহনবাগান জালে পাঠানো।
‘‘ওটা লিখে আমাকে আবার বেশি ইস্টবেঙ্গল ফুটবলার বলে দেখানোর চেষ্টা করবেন না! আসলে হয়তো মোহনবাগানের হয়ে ইস্টবেঙ্গল ম্যাচ খেলার সময় প্রদীপদাই বলুন কিংবা অমলদা—আমাকে নিজে গোল করার চেয়ে বেশি অন্যকে দিয়ে গোল করানোর কাজে লাগিয়েছেন। সবুজ-মেরুন জার্সিতে বড় ম্যাচে তাই আমার কোনও গোল নেই।’’ নিজামের শহরে বিখ্যাত গোলকুন্ডা ফোর্টের বিশাল উঠোনে পায়রার ঝাঁক ওড়াতে-ওড়াতে বলছিলেন সত্তরের দশকে ময়দানের শাহেনশা।
লাল-হলুদ, সবুজ-মেরুনের  মতোই ভারতের নীল জার্সি গায়েও অনেক গুরুত্বপূর্ণ গোল আছে। বয়স কুড়িতে ছোঁয়ার আগেই জাতীয় দলে নিয়মিত। টানা দশ বছর।
ছেষট্টি থেকে তিনটে এশিয়াড খেলেছেন। সত্তরে ব্রোঞ্জজয়ী পিকের ভারতের প্রথম ম্যাচে তাইল্যান্ডের সঙ্গে ০-২ পিছিয়ে থাকা ম্যাচে হাবিবের কীর্তি আজও ভোলার নয়। ২০ গজ দূর থেকে ভলিতে নিজে গোল করলেন। ২-১। তার পর সুভাষ ভৌমিককে দিয়ে দ্বিতীয় গোল। অবিশ্বাস্য ভাবে ম্যাচ ২-২ ড্র।
একাত্তরে পেস্তা সুকান চ্যাম্পিয়ন ভারতের হয়ে ইন্দোনেশিয়া আর মালয়েশিয়ার উল্টো দিকে পড়ে পর পর দু’ম্যাচে জোড়া গোল। উনসত্তরের সন্তোষ ফাইনালে সার্ভিসেসকে বাংলার হাফডজন গোলের মধ্যে হাবিবেরই পাঁচটা!
বিদেশি ক্লাব দেখলেও একই ভাবে জ্বলে উঠেছেন। পেলের কসমস। শিল্ডের ইতিহাসে সম্ভবত সবচেয়ে শক্তিশালী বিদেশি টিম আরারাত। দুটো ম্যাচেই গোল রয়েছে হাবিবের।
ডিসিএমে সাত জন নর্থ কোরিয়ান বিশ্বকাপার ভরা ডক রো গ্যাংয়ের সঙ্গে তো দুর্ধর্ষ কাণ্ড ঘটিয়েছিলেন প্রায় একা। ফরোয়ার্ড আর হাফলাইনের মাঝে পিভট হাবিব সে ম্যাচে তুখড়। পর পর দু’দিন ফাইনাল গোলশূন্য ড্র রাখার পর বিদেশিরা ‘পালিয়ে’ গেল। ট্রফি ইস্টবেঙ্গলের হাতে তুলে দিয়েছিলেন উদ্যোক্তারা।  
কত অজস্র মণিমাণিক্য নিজের ফুটবল ক্যাবিনেটে জ্বলজ্বল করছে। তা সত্ত্বেও ২০১৫-র হাবিব কিন্তু বলছেন, ‘‘এগুলো একটাও নয়। আমার সেরা ম্যাচ আটষট্টির সন্তোষ ট্রফিতে পঞ্জাবের সঙ্গে রিপ্লে সেমি‌ফাইনালটা। তার আগের দিন মাঠ থেকে আমার লাশ কবরে ঢোকার কথা! তার বদলে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে আমি ম্যান অব দ্য ম্যাচ।’’
বড়েমিঞা বলে দিচ্ছেন, কোনও প্লেয়ারের জীবনে এ রকম আজব ঘটনা ঘটেনি!

http://www.anandabazar.com/supplementary/patrika/footballer-mohammed-habib-recalls-his-memories-with-east-bengal-and-kolkata-football-1.169181?ref=archive-new-stry

আজও হাবিবের অন্ধ ভালবাসা ভাই আকবর

$image.name

আজও হাবিবের অন্ধ ভালবাসা ভাই আকবর

ময়দানের এককালীন দাপুটে নবাব। এখন স্বেচ্ছানির্বাসিত। হায়দরাবাদে। ষাটোর্ধ্ব মহম্মদ হাবিবের ডেরায় বসে পুরনো সাম্রাজ্যের অলিগলি হয়ে নয়া জমানা নিয়ে তাঁর গর্জন শুনে এলেন সুপ্রিয় মুখোপাধ্যায়। সঙ্গী আলোকচিত্রী উৎপল সরকার। আজ তৃতীয় কিস্তি

১১ জুলাই, ২০১৫, ০০:০৩:৫৪
2

নিজেকে আজ আড়ালে রাখতেই ভালবাসেন নবাব

‌আগুনটা আর জ্বলে না।
বয়েস নয়, তাঁকে তাড়া করছে আজ শুধুই ক্লান্তি!
পেনাল্টি বক্সে বারবার ছোবল মারা সেই ছোট্ট শরীরটা এখন নির্বিষ। নিস্তেজ। ঘরবন্দি।
কথায় কথায় বোবা মেরে যান। নৈঃশব্দ্য ভাঙতে চাইলে অস্ফুটে বলে ওঠেন, ‘‘আর কেন, আমার ‘আমি’টার যখন মৃত্যু হয়েছে, অহেতুক এই খুঁড়তে চাওয়া কীসের?’’
এ কোন হাবিব!
হায়দরাবাদে তিন দিন ওঁকে দেখেছি। যত বার দেখেছি স্মৃতির উথালপাথাল ঝড়ে উড়ে গিয়ে বিস্ময়ের তল খুঁজে পাইনি কিছুতেই।

• আমার আসল ‘আমি’
সে ছিল এক দীর্ঘ সময়। মাঠ-ময়দানে যে কাউকে চাগিয়ে দিতে কোচ-কর্তা-গ্যালারি ধার নিত মতি নন্দীর গল্পের ক্ষিদ্দার সেই অবিস্মরণীয় চিৎকার!— ফাইট, কোনি ফাইট।
কিন্তু হাবিব কোনও উপন্যাসের নয়। সিনেমায়ও নয়। নিজেই যে স্বয়ং ঘামরক্তের চিৎকার! যখন-তখন যাঁকে একেবারে মাঠের ভেতর স্বচক্ষে দেখা যায়।
ষাটের দশকের সন্তোষ ট্রফি সেমিফাইনাল যেমন। বাংলা বনাম পঞ্জাব। ইন্দর, গুরকৃপাল, মনজিত, ভাটিয়া, গুরদেব, কিষেন— সব সিংহদের ঝাঁকে ঝাঁকে স-বুট লাথি নেমে আসছে হাবিবের ছোটখাটো শরীরের উপর।
মিঞা কিন্তু ছোড়নেওয়ালা নন। বল নিয়ে বারবার বক্সে ঢুকে পড়েছেন। পঞ্জাবি ফুটবলারের ট্যাকলের নামে সটান মারা লাথি খেয়ে মাঠে লুটিয়ে পড়ছেন। আবার উঠে দাঁড়াচ্ছেন।
কখনও সেন্টার লাইন পেরোলেই লাথি, চোরাগোপ্তা ঘুসি, কনুইয়ের বিপজ্জনক আক্রমণ হামলে পড়ছে হাবিবের পা, কোমর, ঘাড়, মুখে। প্রায় সারা গায়ে কালশিটের দাগ। রক্তাত্ত!
তবু পুরো সময় খেলেছিলেন হাবিব। কিন্তু মাঠ থেকে বেরিয়েই জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়েছিলেন। হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে সারা রাত স্যালাইন দেওয়া চলল বেহুঁশ হাবিবকে।
পরের দিন।
আগের দিনের ড্র সেমিফাইনালের রিপ্লে। হাসপাতালে ভর্তি থাকা হাবিবকে বাদ দিয়ে বাংলার গেমপ্ল্যান চলছে টিম হোটেলে। আচমকা সেখানে হাজির অকুতোভয় বড়ে মিঞা! ভূত দেখার মতো চমকানোর অবস্থা গোটা টিমের।— ‘‘আরে তুই! এখানে কী করে?’’ গোটা টিমের মহাবিস্মিত প্রশ্নের জবাবে হাবিবের সাফ কথা, ‘‘ও লোগ শালা কাল মুঝে বহুত মারা। আজ উসকো মারকে মুঝে জিতনা হ্যায়। বেঙ্গল কো জিতানা হ্যায়।’’
কিন্তু শরীরের এই অবস্থায় হাসপাতাল থেকে ছুটি মিলল কী করে?
‘‘কী ভাবে আবার? সোজা স্যালাইনের সুচ হাত থেকে খুলে হাসপাতালকে পার্সোনাল বন্ড দিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে একটা ট্যাক্সি ডেকে চলে এলাম এখানে।’’ যেন লাঞ্চ করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে সিনেমা হলে চলে এলেন— হাবিবের বলার ভঙ্গিটা এমনই!
এখানেই শেষ নয়। আরও আছে। এর পর মাঠে নেমে সেই ইন্দর-গুরকৃপালদেরই নাস্তানাবুদ করে ছাড়লেন হাবিব। গোল করলেন। বাংলাকে জেতালেন। ম্যান অব দ্য ম্যাচ হলেন।


• সেরা পাস আকবরকে অন্যদের হসপিটাল পাস
অভিযোগটা হাবিবের বিরুদ্ধে বরাবরের। চার দশক পরেও। এখনও।
‘‘একদম গলত বাত হ্যায় দাদা,’’ একেবারে গোড়াতেই অভিযোগ অস্বীকার করলেন বড়েমিঞা।
‘‘আমি তো বরং বলব, আমার পাসটাসগুলো ভৌমিক, শ্যাম, মানস-বিদেশ, সুরজিৎদের চেয়ে আকবর অনেক বেশি বুঝতে পারত। বেশি কাজে লাগাত। আর সে জন্যই মনে হত সবচেয়ে ভাল পাসটা আমি ভাইকে বাড়িয়েছি। কিন্তু আসল ঘটনা অন্য,’’ ভাইয়ের পাশে দাঁড়াতে গিয়ে দাদার গলা যেন হঠাৎ চনমনে।
হাবিবের পাশেই তখন বসে আকবর। একটু যেন সলজ্জ ভাবে। চোখেমুখে সামান্য সংকোচ! ‘‘আরে তুম ভি বোলো আকবরভাইয়া,’’ বলে ভাইকে পিঠে একটা খোঁচা মেরে বসলেন বড় ভাই।
তার পর নিজেই বলতে লাগলেন, ‘‘তা হলে শুনুন। আকবর গোলের জন্য পেনাল্টি বক্সের ভেতর মরে যেতেও রাজি ছিল। পাঁচ ফুট নয় হাইট। দারুণ ভাল পজিশন নিত। প্রায় নিখুঁত। দু’পায়েই দুর্দান্ত ভলি। পাওয়ারফুল হেডিং। ফলে আমার গ্রাউন্ডেড থ্রু পাস বলুন কিংবা উঁচু ক্রস— সব মিট করত। গোল তো পাবেই।’’
ম্যাচে দাদার পাস ধরে গোল করার মতোই এ বার আকবর গড়গড় করে বলে চললেন, ‘‘দেখুন, হাবিবভাইয়ের সঙ্গে এক টিমে খেলে আমি তিন বার কলকাতা লিগে হায়েস্ট স্কোরার হয়েছি। বাহাত্তর আর চুয়াত্তরে ইস্টবেঙ্গলে। ছিয়াত্তরে মোহনবাগানে। ওই তিন বারই তো আরও অনেক ভাল ভাল ফরোয়ার্ড আমাদের টিমে ছিল। তারা তা হলে হায়েস্ট স্কোরার হতে পারেনি কেন, বলুন?’’
আকবরও যেন এ বার একটু উত্তেজিত। দাদার মতোই।— ‘‘শিল্ডে মালয়েশিয়ার সেলাঙ্গর। ইন্ডিয়া টিমের রাশিয়া ট্যুর। এ রকম কয়েকটা ম্যাচে এমনও হয়েছে হাবিবভাইয়ের পাস থেকে ভৌমিক কিংবা শ্যাম ভলি মেরেছে। বল পোস্টে লেগে ফিরেছে। আমি সেই রিবাউন্ড থেকে গোল করেছি। বক্সের ভেতর এতটাই মরিয়া ভাবে বল ফলো করতাম আমি।’’
এর পর রীতিমতো চমকে দিয়ে আকবর বলে দিলেন, ‘‘এই ব্যাপারটা শ্যামের ভেতরেও ছিল। তবে আমি মনে করি আমার মতো অতটা নয়,’’ ভাইয়ের পাশে বসে হাবিবও সমর্থনসূচক মাথা নাড়ছেন তখন। 


• বড়েমিঞা ওয়ান, বড়েমিঞা টু
বড়েমিঞা। নামটা কার দেওয়া? উত্তর পাওয়া গেল কিন্তু দু’রকম। হাবিব বললেন এক, তো আকবর আরেক।
‘‘জ্যোতিষদা (গুহ) আমাকে প্রথম বড়েমিঞা বলেছিলেন। ছেষট্টিতে ইস্টবেঙ্গলে সই করে প্রথম মোহনবাগান ম্যাচেই গোল পেলাম। তার পর থেকেই জ্যোতিষদা বড়েমিঞা ডাকতেন। আর একটা কথা বলি, জ্যোতিষদাকে আমি প্রথম দিন থেকেই দাদা ডাকতাম, জানেন তো? নইম গুহসাব বলত, আমি কিন্তু দাদা,’’ এক মুখ হাসি খেলে গেল মিঞার মুখে।
পাশে বসা আকবর দেখি তখন উশখুশ করছেন। দাদার কথা শেষ হলেই ভাই বলতে লাগলেন, ‘‘ইস্টবেঙ্গলে আসল বড়েমিঞা ছিলেন আমেদ খান। তাঁকেই জ্যোতিষ  গুহ প্রথম বড়েমিঞা ডেকেছিলেন আদর করে। আমি পরে কলকাতায় শ্রীমানীদার (অজয় শ্রীমানী) থেকে শুনেছি, হাবিবভাইকে জ্যোতিষ গুহ নাকি বলেছিলেন, তুম ইস্টবেঙ্গল কা নয়া বড়েমিঞা।’’
ভ্রু তুলে আকবরের দিকে চাইলেন হাবিব। মুখে কিছু বললেন না। আমি তখন ভাবছি, আকবরের কথা যদি ঠিক হয় তো, ময়দানে বড়েমি়ঞা তা হলে দু’জন। ওয়ান আর টু। অনেকটা ভারতীয় ক্রিকেটের দুই লিটল মাস্টারের মতো।
জ্যোতিষ গুহর কথা ওঠায় পুরনো একটা ঘটনা মনে পড়ে যাচ্ছিল।
ছেষট্টি সাল। ইস্টবেঙ্গলের প্রাণপুরুষ তখন জ্যোতিষ গুহ। বড় ক্লাবের দলবদল সে কালে রীতিমতো প্রেস্টিজ-ফাইট। অসম্ভব রেষারেষির। সে বছর অসীম মৌলিক, চন্দ্রেশ্বর প্রসাদের মতো একঝাঁক তারকাকে তুলে নিল মোহনবাগান।
তখন টিমে নতুন রক্ত আমদানি করতে হায়দরাবাদি ফুটবলের ত্রিমূর্তিকে লাল-হলুদে আনলেন জ্যোতিষ গুহ।
নইম, হাবিব, আফজল।
তিন জনই তার আগের বছর কেরলের মাটিতে সন্তোষ ট্রফি ফাইনালে বাংলাকে নাকানিচোবানি খাইয়েছেন। চ্যাম্পিয়ন হয়েছে অন্ধ্রপ্রদেশ। সেই ম্যাচ স্বচক্ষে দেখে জ্যোতিষবাবু সঙ্গী ইস্টবেঙ্গল কর্তা অজয় শ্রীমানীকে বলেছিলেন, ‘‘প্লেয়ার চিনতে আমার যদি ভুল না হয়, তা হলে মিলিয়ে নিও হাবিবই ভবিষ্যতের সেরা ভারতীয় ফুটবলার।’’

এখন চালকের আসনে ভাই, দাদা ব্যাকসিটে
• খাঁটি টিমম্যান VS পেশাদার ফুটবলার
দু’বছর ইস্টবেঙ্গলে কাটিয়ে হাবিব-নইম জুটি আটষট্টিতে গিয়ে ওঠেন বাগানের পালতোলা নৌকায়।
তার পরের প্রায় দেড় যুগ নইম না হোক, হাবিবের ক্রমান্বয়ে মোহন-ইস্ট, ইস্ট-মোহন ঘোরাঘুরি করা। মাঝেমধ্যে মহমেডানও।
এত ঘনঘন দল পাল্টাতেন কেন? খাঁটি টিমম্যান বলতে তো ময়দান মহম্মদ হাবিবকেই বুঝে এসেছে!
‘‘এই একটা ব্যাপারে লোকে আমায় ভুল বোঝে। আসল কারণটা শুনুন। কাউকে বলিনি কোনও দিন। আপনাদের কাগজেই প্রথম বলছি,’’ সোফায় পায়ের উপর পা তুলে গুছিয়ে বসলেন হাবিব।
‘‘আমি কস্মিনকালে চাকরি করিনি। কে কী বলে জানি না। তবে নিজে মনে করি এ দেশে আমিই প্রথম একশোভাগ পেশাদার ফুটবলার। কেরিয়ারের গোড়ার দিকে হায়দরাবাদ টেলিফোনসে কিছু দিন খেলেছিলাম। তখনও ওদের ওয়ার্কার ছিলাম না। পেমেন্ট নিয়ে খেলতাম। কলকাতায় আসার পর প্রথম থেকেই ঠিক করেছিলাম, যেহেতু ফুটবল খেলাই আমার পেশা, তাই এটাকেই আমার অফিস ভাবব,’’ বলতে বলতে থামলেন হাবিব। পাশে বসা নিশ্চুপ আকবর তখন যেন তিন-চার দশক আগের সেই বাধ্য ভাইটি।
হাবিব বলে চললেন, ‘‘অফিসে যেমন নিজেকে নিংড়ে দিয়ে কাজ করব, তেমনই যেন মোটা মাইনে পাই সেটাও দেখব। সব লোকই যেমন করে, আর কী!’’ হাসলেন নবাব।
তার পর বললেন, ‘‘দেখুন, আমি নিজের সেরা পারফরম্যান্সটা করে দেখাতে পারব তখনই, যদি আমার সতীর্থরাও সেরা হয়। দেখবেন বড় বড় অফিস বেছে বেছে ভাল ভাল অফিসারকে চাকরি দেয়। ফুটবল টিমও আমার কাছে তাই। আমি সব সময় সেই সিজনে মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গলের মধ্যে যে দল বেটার বুঝতাম, সেখানেই খেলতাম।’’
ষাট-সত্তর-আশির ময়দানে পাক্কা টিমম্যান হাবিব এখন যেন পুরো প্রফেশনাল। শুধু আবেগ দিয়ে তো আর জীবন চলে না। কেরিয়ারের জন্য আরও কিছু লাগে। অত দিন আগে সাচ্ কথাটা কত সহজে বুঝে ফেলেছিলেন মহালড়াকু হায়দরাবাদি!
‘‘শুনো ভাই, মেরা সিধা বাত। আমার কোনও বিশেষ ক্লাবপ্রীতি কোনও কালে ছিল না। ছিল টিমপ্রীতি। তবে যে টিমের জার্সি গায়ে দিতাম সেটাকে নিজের মায়ের মতো সম্মান করতাম। সেই জার্সির জন্য নিজের প্রাণ দিতেও সব সময় রেডি থাকতাম,’’ থামলেন হাবিব।
হঠাৎ মনে হল, একেবারে হালের লিও মেসি-ফর্মুলা চার দশক আগে লোকটা কেমন হুবহু নিজের জীবনে  মিশিয়ে দিয়েছিলেন! মেসি যেমন বার্সেলোনা ছাড়ার কথা ভাবেন না। তিনি জানেন, রিয়াল বা ম্যান ইউ কিংবা বায়ার্নে গেলে পাশে জাভি-ইনিয়েস্তা-পিকে-নেইমার পাবেন না! সেই সময়ের হাবিবও অনেকটা যেন তাই।
মিঞার কথা তখনও শেষ হয়নি। বলে চলেছেন, ‘‘সত্তরের দশক জুড়ে দেখবেন আমি ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান যেখানেই খেলেছি, হাফে পিন্টু-গৌতম বা গৌতম-প্রসূন, উইংয়ে সুভাষ-সুরজিৎ, বা মানস-বিদেশ, সেকেন্ড স্ট্রাইকার হয় শ্যাম, না হয় আকবর, কিংবা সাব্বির থেকেছে। আর তার জন্য আমার কোনও লজ্জা নেই। কেননা দিনের শেষে নিজে উপলব্ধি করেছি, ওদের সঙ্গে এক টিমে খেলে আমিও নিজের কাজটা একশোভাগ ঠিকঠাক করতে পেরেছি। দলের হয়ে সেরাটা দিয়েছি।’’


• নেতাদেরও নেতা
বলিউডে স্টার থেকে সুপারস্টার এসেছে। সুপারস্টার ছাড়িয়ে এসেছে মেগাস্টার। কিন্তু দিলীপকুমার সম্পর্কে বলা হয় ‘অ্যাক্টর অব অ্যাক্টরস্’। অভিনেতাদেরও অভিনেতা!
সত্তর দশকের ময়দানে হাবিবও তেমনই। বড় দলে নেতাদের নেতা। ইস্টবেঙ্গলে যেমন, মোহনবাগানেও তাই। সু‌ধীর কর্মকার, সুভাষ ভৌমিক, গৌতম সরকার, সমরেশ (পিন্টু) চৌধুরী—একেক জন মহারথী ফুটবলার। কিন্তু তাঁদেরও ‘লিডার’ ছিলেন এক জন। তিনি মহম্মদ হাবিব।
গৌতমের খেলায় অবিশ্বাস্য টেনাসিটি কার আমদানি? কিংবা তরুণ বয়সেই হারিয়ে যেতে বসা সুভাষের অবিস্মরণীয় প্রত্যাবর্তনের মশলা জোগাল কে? দু’টোর উত্তরেই কোচ পিকের সঙ্গে দ্বিতীয় নাম উঠে আসে— টিমমেট বড়েমিঞার।
বছরের পর বছর, ম্যাচের পর ম্যাচে, মাঠের ভেতরে তো বটেই, দরকারে মাঠের বাইরেও সুভাষ-গৌতম এমনকী নিজের চেয়ে সামান্য সিনিয়র পিন্টু-সুধীরকেও লিড করেছেন হাবিব। সামলেছেন চার দশক আগের ময়দানের সবচেয়ে ‘দুষ্টু’ চতুষ্টয়কে।
‘‘উফ! ওদের বদ্তমিজির কথা মনে পড়লে এত বছর পরেও আমার হাসি পায়,’’ হায়দরাবাদের বাড়ির ড্রইংরুমে বসে কথাটা বলার সময় এত ক্ষণের ম্লান মুখের হাবিবের চোখেও তখন ইঙ্গিতবাহী হাসি!
‘‘এক বার তো রোভার্সে পিন্টুদের সামলাতে গিয়ে প্রদীপদা কেঁদেই ফেলেছিলেন। সে এক কাণ্ড বটে মুম্বইয়ের হোটেলে!’’

(চলবে পরের শনিবার)

http://www.anandabazar.com/supplementary/patrika/a-sweet-memorabilia-of-footballer-habib-1.172966?ref=archive-new-stry

কলকাতার সেই অপমান আজও ভোলেননি বড়েমিঞা (Habib)

$image.name

কলকাতার সেই অপমান আজও ভোলেননি বড়েমিঞা

ময়দানের এককালীন দাপুটে নবাব। এখন স্বেচ্ছানির্বাসিত। হায়দরাবাদে। ষাটোর্ধ্ব মহম্মদ হাবিবের ডেরায় বসে পুরনো সাম্রাজ্যের অলিগলি হয়ে নয়া জমানা নিয়ে তাঁর গর্জন শুনে এলেন সুপ্রিয় মুখোপাধ্যায়। সঙ্গী আলোকচিত্রী উৎপল সরকার। আজ চতুর্থ ও শেষ কিস্তি

১৮ জুলাই, ২০১৫, ০০:০৩:০৫
2

আজও টিমম্যান নাতি-নাতনিদের দলে

সত্যিকারের সম্রাটেরও কি এমনই হয়!
চিরকালের জন্য মুকুট, সিংহাসন, রাজবেশ, রাজপাট ছেড়ে আসার পরে?
কখনও শোকার্ত।
কখনও আবেগের ভারে টলমল।
নিঃসঙ্গ। নিরুত্তাপ।
শেষ বিকেলের অস্তরাগ মিলিয়ে যাওয়া ম্লান সন্ধের মতো।
প্রাণচঞ্চল লেগেছে এক-আধবারই। নাতি-নাতনি পরিবৃত সেই হাবিবকে দেখে মনে হয়েছে ঈশ্বরের বাগানে বসে আছি।
হঠাৎ আলোর ঝলকানিতে তখন মুহূর্তে ধুয়ে মুছে সাফ চারপাশে হামলে ওঠা যাবতীয় ক্লেদ।

• বড়েমিঞার দাদাগিরি
‘‘শালা, মজাক হ্যায়! কেয়া সমঝা? জিন্দেগি মে দোবারা অ্যায়সা চান্স হামকো মিলেগা?’’
সত্তর দশকের গোড়ার দিক। রোভার্স ফাইনালের দিন মুম্বইয়ে ইস্টবেঙ্গল টিম হোটেল। বেলা এগারোটা বাজতে চলেছে। আর সেই সময় কখনও সুধীর-পিন্টু, আবার কখনও গৌতম-সুভাষের ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে গর্জন করে চলেছেন হাবিব!
বড়েমিঞার সে এক রুদ্রমূর্তি তখন!
পিন্টু-গৌতমদের সকালে বারবার ডেকেও দরজা খোলাতে না পেরে কোচ পিকেও হাল ছেড়ে দিয়েছেন।
‘‘ওরে হাবিব, দেখ তো বাবা পারিস কি না বজ্জাতগুলোর ঘুম ভাঙাতে! ভোররাত পর্যন্ত ফুর্তি করবে তো, সকালে উঠবে কী করে? আজ ফাইনাল, সেই হুঁশটুকুও নেই!’’ বলতে বলতে পিকের চোখেও তখন জল বেরিয়ে আসার জোগাড়।
মহাগুরুর শেষ কথাটা শুধু মুখ থেকে বেরনোর অপেক্ষা! প্রিয়তম শিষ্য হাবিব তড়াক করে লাফিয়ে উঠলেন।
‘‘কেয়া বোলতা হ্যায় প্রদীপদা? শালা কো মজাক হ্যায় না কেয়া!’’ চিলচিৎকার করতে করতে হাবিব নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে ছুটলেন সুধীর-সুভাষদের ঘরের দিকে।
তার পর সেই রুদ্রমূর্তি। গর্জন। গালিগালাজের ঝড়। পারলে টিমমেটদের দরজা লাথি মেরে ভেঙে দেন! কয়েক মিনিটের মধ্যে সুধীর-পিন্টু-গৌতমরা যে যাঁর ঘর থেকে সুবোধ বালকের মতো বেরিয়ে এলেন। রেডি হয়ে সটান কোচের ঘরে টিম মিটিংয়ে। এবং একেবারে সঠিক সময়ে!

• আজম ‘অত্যাচার’
সত্তর দশকের ময়দানের মহারথী ফুটবলারদেরও লিডার। অথচ সেই হাবিবও হায়দরাবাদে ফিরলে দাদা আজমের ‘অত্যাচারের’ শিকার!
ভাবা যায়!
ওঁদের পাঁচ ভাইয়ের সবচেয়ে বড় আজম। সারা জীবন হায়দরাবাদ পুলিশ টিমে দাপটে খেলেছেন। পঞ্চাশের দশকে টানা পাঁচ বার রোভার্স চ্যাম্পিয়ন হায়দরাবাদ পুলিশ দলের এক জন। পরে দেশের অন্যতম সেরা ফুটবল রেফারি।
একই সঙ্গে ‘কুখ্যাত’ পুলিশ অফিসার!
হায়দরাবাদের বাড়িতে ড্রইংরুমে তখন হাবিব আমাদের সামনে একা বসে। বিবি, মেয়ে, পুত্রবধু, নাতি-নাতনিরা সব অন্দরমহলে। একটু যেন আমতা আমতা করেই আজম প্রসঙ্গে বলছিলেন মিঞা।—
‘‘এমনও কয়েক বার হয়েছে, কলকাতার বড় টিমের অ্যাডভান্স রাখতে আমি দু-এক দিনের জন্য হয়তো বাড়ি ফিরেছি। দাদা আমাকে ধমকে-চমকে সেখান থেকে বেশ কিছু টাকা নিয়ে নিয়েছে। নিজের দাদা তো! নিতেই পারে। কিন্তু কেড়ে নিত বলে আমার এখনও কষ্ট হয়!’’
একটু থেমে আরও বললেন, ‘‘খুব বদমেজাজি ছিল ও। সারা জীবন পুলিশে চাকরি করেছে তো! নিজে খেলোয়াড় হলেও বাকি সময়টা চোর-বদমাইশদের সঙ্গে কাটিয়ে বদমেজাজি হয়ে গিয়েছিল।’’
ফুটবলার আজম নিয়ে কিন্তু গভীর নস্টালজিক প্রৌঢ় হাবিব।—‘‘ছোটবেলায় ওর খেলা দেখেই তো ফুটবলের প্রেমে পড়া আমার,’’ বলে সখেদে আরও যোগ করলেন মিঞা। —‘‘জানেন, ইস্টবেঙ্গল জার্সিতে টানা পাঁচ বার লিগ চ্যাম্পিয়ন যে দিন হয়েছিলাম, প্রথমেই মনে হয়েছিল আজমভাইও এ ভাবেই টানা পাঁচ বার রোভার্স কাপ জিতেছে। ওফ! আমাকেও সে রকম একটা দুর্ধর্ষ সাফল্যের অনুভূতি দিলেন ইনসাআল্লাহ!’’

• হায়েস্ট পেইড রহস্য
গোটা সত্তর দশক তো বটেই। আশির দশকের গোড়ার দিকে অবসর নেওয়ার দু-এক মরসুম আগেও হাবিব ময়দানের হায়েস্ট পেইড ফুটবলারদের মধ্যে পড়তেন!
কী ভাবে নিজের দর এত উঁচুতে বেঁধে রাখতে পেরেছিলেন বুট জোড়া তুলে রাখার সামান্য আগে পর্যন্তও?
এত দিন পরে সেই রহস্যও হায়দরাবাদে বসে প্রথম ফাঁস করলেন বড়েমিঞা।
‘‘ও ভি এক গেমপ্ল্যান থা দাদা। ডাবল স্ট্রাইকার কা অ্যাটাক, দেখা হ্যায় তো, উসিকে য্যায়সা।’’ জানকীনগরের বাড়ির উল্টো দিকের রকে আড্ডার মেজাজে বসা হাবিবের ঠোঁটে তখন মুচকি হাসি। বিরল!
‘‘ওই সময় বেশির ভাগ সিজনে আমাকে আর আকবরকে একসঙ্গে নিতে চাইত কলকাতার বড় ক্লাব। আর আকবরের সঙ্গে আলোচনা করে নিয়ে আমাদের দরটা আমিই সিনিয়র হিসেবে দিতাম বড় ক্লাবের অফিশিয়ালদের। দু’জনের একসঙ্গে দর। তাতে আমার কত বা আকবরের কত, সেটা পরিষ্কার জানাতাম না। কিন্তু আসলে আমার পেমেন্টটা প্রায় প্রতি বছরই ময়দানে হায়েস্ট থাকত।’’
হাবিবের রহস্য ফাঁস করার  মুহূর্তেই বাইকে চেপে হাজির আকবর। দাদার কথা শেষ হলে ভাই বললেন, ‘‘মজার ব্যাপার কী হত জানেন? ওই ফর্মুলায় হাবিবভাই যদি কেরিয়ারের শেষের দিকেও আশি-নব্বই হাজারে বড় ক্লাবে খেলেছে, তো আমিও সত্তর-পঁচাত্তরের বেশি পেমেন্ট পেয়েছি। কয়েক বার তারও বেশি।’’

• পিকে বনাম অমল
‘‘আমার মত যদি চান তা হলে বলব, এটা তুলনার বিষয়ই নয়।’’ প্রসঙ্গটা উঠতেই যেন নিজের পেনাল্টি বক্সের ভিতর বিপদের গন্ধ পেয়ে লম্বা ক্লিয়ারেন্স হাবিবের।
ততক্ষণে রক থেকে উঠে পড়ে ঘরে চলে এসেছেন। সোফায় পা তুলে বসে। তার পর কী মনে করে বলতে শুরু করলেন, ‘‘প্রদীপদাকে ক্লাব কোচের আগেও ন্যাশনাল কোচ পেয়েছিলাম আমি। সেই সত্তরের এশিয়াড থেকেই প্রদীপদার ফুটবল ফিলোজফি আমার আদর্শ। দেখেছি এই খেলাটাই ওঁর ধ্যানজ্ঞান।— ‘জিতনা হোগা ভাই, আওর জিতনে কে লিয়ে কোসিস করনা হোগা, হর্ টাইম সপনা দেখতে রহেনা পড়েগা।’ — আর এটা উনি আমার মধ্যে বুনে দিয়েছিলেন। দিনের পর দিন। প্রথমে ইন্ডিয়া টিমে। তার পর বাহাত্তর থেকে টানা প্রায় এক যুগ। কখনও ইস্টবেঙ্গলে, তো কখনও মোহনবাগানে।’’
মহাগুরু ‘প্রদীপদা’-কে নিয়ে হাবিবের কথা যেন ফুরোবার নয়! —‘‘ডিসিপ্লিন… হর্ ম্যাচ মে আগ কি তরহা জ্বলনে কা যো হিম্মত—  সব শেখা প্রদীপদার থেকে। প্র্যাকটিসে ফুটবলের সব কিছু অসাধারণ ডেমনস্ট্রেশন দিয়ে দেখিয়ে দিতেন নিজে। ‘পারব না’, ‘অসম্ভব’ শব্দ দুটো ওঁর মুখে কোনও দিন শুনিনি। যেটা নিজের মধ্যেও আমি ঢুকিয়ে নিয়েছিলাম।’’
পিকের প্রেরণা এতটাই হাবিবের উপর প্রভাব ফেলেছিল! বিস্তারিত করলেন মিঞা—
‘‘একাত্তরে ইন্ডিয়া টিমের রাশিয়া ট্যুর। মস্কো ডায়নামোর কাছে দু’গোলে পিছিয়ে আছি। বোধহয় সেকেন্ড হাফ হবে। হারব এক রকম পাকা। কিন্তু আমার অভ্যেস হারি-জিতি, প্রতিটা বলের পিছনে তাড়া করা। সেটা করতে গিয়েই একবার দেখি আট জন রাশিয়ান ফুটবলারের মাঝে আমি একা। বিশ্বাস করুন আট জন!
আর ওরা আমার সঙ্গে বলটা নিয়ে ‘মুরগি’ খেলা শুরু করল। এ ওকে পাস দেয়, ও তাকে পাস দেয়, সে আবার আরেক জনকে বলটা দিয়ে দেয়...। আর আমি যার কাছে বলটা যাচ্ছে, তার দিকে ছুটে বেড়াচ্ছি। এ ভাবে মিনিটখানেক চলল। মুখে ফেনা উঠে আসছে আমার। লেকিন ম্যায় ভি ছোড়নেওয়ালা নেহি। টিমমেটদের ডাকছি। জান দিয়ে চেঁচাচ্ছি... শালা তুম লোগ কাঁহা মর পড়া? আরে ভাই খুদা কসম। মেরা পাস আও! চেঁচাচ্ছি আর রাশিয়ানগুলোর পায়ে ডাইভ মারার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। সাচ বাত, এই করতে করতে সত্যিই এক  রাশিয়ানের থেকে বলটা কেড়ে নিয়ে ক্লিয়ার করে দিলাম। তার পর আছাড় মাটিতে। চিৎপটাং!’’
একটানা অনেকক্ষণ বলে হাবিব থামলেন। আর উল্টো দিকের সোফায় বসে দ্রুত বুঝলাম— ২০১৫ নয়, এখন এই ঘরে ১৯৭১ বিরাজ করছে!
হাবিব উত্তেজিত!— ‘‘ছাত্রদের এ ভাবে চাগিয়ে দেওয়াই তো গুরুর কাজ। প্রদীপদা সেটা পারতেন। আবার ওনার কোনও স্ট্র্যাটেজির সঙ্গে টিমের কোনও ফুটবলার একমত না হলেও কিছু মনে করতেন না। বরং ম্যাচে প্রদীপদার স্ট্র্যাটেজি ভুল প্রমাণ হলে নিজের টিমের প্লেয়ারের কাছে দোষ স্বীকার করার মতো স্পোর্টসম্যানও ছিলেন আমার গুরু।’’
এই যদি তাঁর ‘প্রদীপদা’ হন, তো অমল দত্ত ছিলেন তাঁর চোখে অসাধারণ ফুটবলপাণ্ডিত্য সম্পন্ন এক প্রবল মুডি কোচ। ইগো সর্বস্ব।—
‘‘অমলদার কোচিং জ্ঞান প্রদীপদার মতোই। অসাধারণ। ওই রকমই ফুটবলঅন্তপ্রাণ। কিন্তু ভীষণ ‘আমি আমি’ করতেন। প্রায় সবেতেই। আর ম্যান ম্যানেজমেন্ট খুব খারাপ ছিল। কখন যে কোন ফুটবলার সম্পর্কে কী বলে বসবেন!’’ খুল্লমখুল্লা হাবিব। 
বলে চললেন, ‘‘বড় ক্লাবে কোচিংয়ের চেয়েও বেশি দরকার গেমপ্ল্যান। আর ম্যান ম্যানেজমেন্ট। প্রচুর তারকাকে নিয়ে একসঙ্গে চলতে হয় সেখানে। প্রত্যেক স্টারকে আলাদা আলাদা ভাবে গুরুত্ব দিতে হয়। আবার টিমস্পিরিটও ধরে রাখতে হয়। সেটাই ম্যান ম্যানেজমেন্ট। অমলদা সেখানে নিজেই তারকাসুলভ হাবভাব নিয়ে চলতেন। অথচ ফুটবলার হিসেবে কিন্তু উনি প্রদীপদার পাশে কিছুই নন।’’
আবার ছোট্ট একটু থামা। তার পর যেন বোমা হয়ে ফাটলেন, ‘‘বলতে পারেন বিরাশিতে ইস্টবেঙ্গল টিমে অমলদার বিশ্রী ম্যান ম্যানেজমেন্টে তিতিবিরক্ত হয়েই আমার অবসর নেওয়ার চিন্তা জাগে প্রথম! পরের বছরই রিটায়ার করি।’’
চমকে যেতে হয় ওঁর কথায়। সে কেমন? খোলসা করলেন বড়েমিঞা।—
‘‘বিরাশিতে ইস্টবেঙ্গলের কী টিম! ভাস্কর থেকে বিশ্বজিৎ। সুধীর থেকে মনোরঞ্জন। তরুণ-অলোক। প্রশান্ত, অমলরাজ। মিহির, কার্তিক শেঠ, আকবর। সব পজিশনই দারুণ। অথচ বোধহয় লিগ ছাড়া কোনও ট্রফি নেই গোটা মরসুমে। এখনও মনে আছে, পরের বছরই ইস্টবেঙ্গল প্রদীপদাকে আবার কোচ করেছিল!’’
• কোচ হাবিব কা গুস্সা
টিএফএতে তিনি চুনী গোস্বামী-পিকে বন্দ্যোপাধ্যায়, দুই মেগাস্টার কোচেরই ডেপুটি। জামশেদপুরের অ্যাকা়ডেমিতে টানা পনেরো বছর ছিলেন ফুটবলার তৈরির কাজে। তখন ভারতীয় দলে আসল প্লেয়ার সাপ্লাই লাইন ছিল টিএফএ-ই।—
‘‘সেই চাকরিও ম্যাচিওরড্ হওয়ার কয়েক বছর আগে আমি ছেড়ে দিলাম। বেশ কিছু টাকা বোনাস, গ্র্যাচুইটির ক্ষতি করেও,’’ বললেন হাবিব। এই বলার সময় আগের সেই উত্তেজনা উধাও। বদলে আবার বিষণ্ণ।
‘‘তার কয়েক বছরের মধ্যে হাড়েহাড়ে টের পেয়েছিলাম কী ভুলটাই না করেছি! কেন যে ময়দানে বড় ক্লাবের কোচ হওয়ার লোভে পড়লাম,’’ আবারও মিঞার গলায় কষ্ট ঝরে পড়ছে।
নব্বই দশকের শেষের দিক। টিএফএ ছেড়ে দিয়ে মহমেডান স্পোর্টিং দলের দায়িত্ব নিয়েছিলেন হাবিব। কিন্তু অল্প সময়েই কর্তাদের ময়দানি রাজনীতির চক্করে পড়ে যান।
তখন মহম্মদ হাবিবের মতো চিরকালের লড়াকু, অসমসাহসী যোদ্ধাও বলতে গেলে মাটিতে ধরাশায়ী!
অথচ ফুটবলার জীবনে তিন প্রধানের ঝানু কর্মকর্তাদের দরকারে ‘টাইট’ দেওয়াটা হাবিবের কাছে ছিল জলভাত। অনেকটা আকবরকে পেনাল্টি বক্সে থ্রু বাড়ানোর মতো। মহমেডানে কোচ হয়ে এসে বড় ক্লাবের সেই কর্তাদেরই সামলাতে পারেননি বড়েমিঞা।
‘‘মাথা নিচু করে আজ স্বীকার করে নিচ্ছি ময়দানের বড় ক্লাবের কোচ হওয়ার যোগ্য আমি নই। কোনও দিন ছিলাম না,’’ সাফ বলে দিলেন নবাব।
তার পর একটু ভেবে আরও বললেন, ‘‘আধুনিক ময়দানের প্যাঁচপয়জার জানা না থাকলে ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগান, মহমে়ডানে কোচিং করা অসম্ভব।
এত নোংরা রাজনীতি ওখানে! আমাদের খেলার সময়েও যে এ সব ছিল না, তা নয়। তবে এতটা মারাত্মক বেশি ছিল না!’’
ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগানের বিরুদ্ধে সে বার হাবিবের মহমেডান তুখোড় ফাইট দিয়েছিল।—
‘‘কিন্তু টিমের ব্যাপারে যদি অফিশিয়ালরা অত বেশি নাক না গলাত, তা হলে আমি নিশ্চিত সে বার আমরা আরও ভাল রেজাল্ট করতাম। বলতে পারেন ময়দানের কর্তাদের নোংরা রাজনীতি দেখে ঘেন্নায় আমি কলকাতা থেকে পালিয়ে আসি!’’ —আবার সেই অবসন্ন সম্রাট।
‘‘কোচিং করানোর মতো শরীর এখনও আছে আমার। ইচ্ছেও আছে, যে ময়দান আমাকে এত দিয়েছে তাকে কিছু ফিরিয়ে দেওয়ার। প্রদীপদা যেমন ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু যত দিন না বড় ক্লাবে অফিশিয়ালদের নোংরা রাজনীতি বন্ধ হচ্ছে, কোচের উপর নন-টেকনিকাল লোকেদের খোদাগিরি থামছে, তত দিন ওই মুখো হব না, এই আমি আজ বলে দিলাম।’’ রাগ-যন্ত্রণা-দুঃখ সব তখন যেন মাখামাখি হয়ে নবাবের মুখে ফিকে হয়ে যাওয়া রামধনুর চেহারা নিয়েছে।
বড় বেদনার সেই রামধনু!
সত্তর দশকের ময়দান কাঁপানো নবাব এখন অসহায় রাগে মনে মনে গুমড়ে যান। বড়েমিঞা আজ হায়দরাবাদের বাড়িতে স্বেচ্ছাবন্দি।
তবু ফুটবল খেলাটার আস্ত গ্রিনরুমটাকে মনের কোটরে রেখে দিয়েছেন! সকলের আড়ালে। গোপনে।

http://www.anandabazar.com/supplementary/patrika/special-interview-of-mohammed-habib-1.176940?ref=archive-new-stry

উত্তমসমগ্র (On Uttam Kumar)

$image.name

উত্তমসমগ্র

নিজের লেখালেখিতে ধরা এ কোন মহানায়ক! ভারাক্রান্ত। উত্তেজিত। অভিমানী। একা। ২৪ জুলাই তাঁর চলে যাওয়ার সাড়ে তিন দশক। লিখছেন দেবশঙ্কর মুখোপাধ্যায়

১৮ জুলাই, ২০১৫, ০০:০৩:৩৪

1
আমার চারপাশে ঘন অন্ধকার। নিকষ কালো অন্ধকার। অথচ আমি দাঁড়িয়ে আছি একটি আলোকিত বৃত্তের মধ্যে।…
কিন্তু আমি জানি, এই আলো এই উজ্জ্বলতা কিছুই দীর্ঘস্থায়ী নয়। যে কোনও মুহূর্তে নিভে যেতে পারে।…
আমাকে নিক্ষেপ করতে পারে আরও গভীর, গভীরতর অন্ধকারে। … এই… অন্ধকারের ওপারেই আছে আলোর জগৎ। …
এক দিন সেই আলোর জগৎ থেকেই আমি এসেছিলাম। এসেছিলাম অনেক অন্ধকার পেরিয়ে।…

কথাগুলো তাঁরই।
তত দিনে তিনি শুধুই নায়ক নন, প্রায় মহানায়ক।
১৯৬৮ সাল। ‘শাপমোচন’, ‘সাগরিকা’, ‘পথে হল দেরী’, ‘হারানো সুর’ পেরিয়ে প্রায় সওয়া শো’রও বেশি ছবি করে ফেলেছেন।
তবু, ফেলে আসা জীবনের জলজ্যান্ত সংলাপ লিখতে বসে এতটাই ভাবাবেগ তাঁর!—
‘‘মনে পড়ছে, আস্তে আস্তে সব মনে পড়েছে। কী দুঃসহ অপমান লাঞ্ছনা সহ্য করতে হয়েছে সে দিন।’’
নরেশ মিত্রর ‘বৌঠাকুরাণীর হাট’-এর কাজ চলছে। হাতে এল অন্য আর একটি ছবি।—
‘‘বাজারে কিছু নাম-ধামও হয়েছে। কনট্র্যাক্ট ফর্মে সইটুকু কেবল বাকি। ছবির মহরতের দিন ঠিক হল। আমাকে দিয়েই মহরত দৃশ্যটি গ্রহণ করা হবে। যথা সময়ে স্টুডিয়োতে গিয়ে দেখলাম আমার জায়গায় মেকআপ নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন আর একজন শিল্পী।
ক্ষোভে দুঃখে অপমানে চোখ ফেটে জল বেরিয়ে এসেছিল। লজ্জায় কারও দিকে তাকাতে পারিনি। আস্তে আস্তে বেরিয়ে এসেছিলাম সেখান থেকে।’’
এক লাঞ্ছনার কথা লিখতে বসে আরও এক লাঞ্ছনা মনে পড়ে যায়।
অনেক পরীক্ষার পর কোনও একটি ছবিতে নির্বাচিত হয়েছেন। সে বারও কনট্র্যাক্ট ফর্মে সই করার মুহূর্তে খবর পেলেন, ‘‘আমার সইয়ের প্রয়োজন ফুরিয়েছে। আমার থেকেও অনেক বড় একজন শিল্পীকে তাঁরা রাজি করিয়েছেন। এত দিন তাঁর সঙ্গে বনছিল না বলেই এঁরা দয়া করে আমায় সুযোগ দিয়েছিলেন।’’
অপমান! এ ভাবেই। বারবার। তবু থেমে যাননি। এক দরজা থেকে ধাক্কা খেয়ে অন্য কারও কাছে ছুটে গিয়েছেন।— ‘‘দয়া করে সুযোগ দিন। আমায় প্রমাণ করতে দিন আমি অযোগ্য নই।’’
লিখতে লিখতে এক-এক সময় উঠে আসছে অভিমান, অনুযোগও। সহশিল্পীদের জন্য।— শুধু প্রযোজকদের দোষ দিয়ে কী লাভ! অন্যের সঙ্গে কথা পাকা হয়ে গেছে জেনেও এক জন শিল্পী কী করে সেই একই ছবির অফার ঈশ্বরের আশীর্বাদের মতো প্রসন্নচিত্তে নিয়ে ফেলেন— অবিশ্বাস্য লেগেছে তাঁর! ভদ্রতা হিসেবেও তো জিজ্ঞেস করা উচিত, কেন বাদ পড়লেন তিনি!
লিখছেন, ‘‘এখানে যে যার নিজের স্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত। কিন্তু এ ভাবে কত দিন চলবে? সৌমিত্র, অনুপ, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়কে এগজিবিটররা বয়কট করতে চাইছে, তাতে উত্তমকুমারের কী ক্ষতি! তাকে তো আর বয়কট করেনি কেউ। তবে কী দরকার তার ও সব নিয়ে মাথা ঘামিয়ে?
এই সহজ সরল কথাটা তো একটা শিশুতেও বুঝতে পারে। কিন্তু উত্তমকুমার চট্টোপাধ্যায় বুঝতে পারছে না কেন? তাঁকে যে দিন দরজা থেকে দরজায় মাথা কুটে, অপমান আর লাঞ্ছনা সর্বাঙ্গে মেখে ফিরে আসতে হয়েছে, সে দিন তো কেউ তার জন্য মাথা ঘামায়নি।’’
•••
কখনও ফিরে গেছেন প্রথম দিনে।
‘‘তুমি বিয়ে করতে এসেছ। তোমাকে মেরে ভাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ভাল করে বুঝে নাও, কেমন?’’
প্রথম বার ক্যামেরার সামনে দাঁড়ানোর আগে পরিচালকের মুখে এমন কথা শুনে বেজায় ঘাবড়ে গিয়েছিলেন।
‘‘ওরা আমাকে খুব জোরে মারবে না তো?’’
শুনে ফ্লোরের সকলের কী হাসি! পরিচালক বললেন, ‘‘না, না, এটা বাস্তব না। একে বলে সিনেমার মার।’’
হিন্দি ছবি ‘মায়াডোর’। মুক্তি পায়নি। কিন্তু সে-ছবিতেই প্রথম বার সুযোগ এসেছিল। একস্ট্রা-র পার্ট। দিনে পারিশ্রমিক পাঁচ সিকে। তখনও তিনি পোর্ট কমিশনার্সের চাকুরে অরুণ কুমার চট্টোপাধ্যায়। লিখছেন, ‘‘পর পর পাঁচ দিন শ্যুটিংয়ে আসতে হল। আর ওই ক’টা দিন আমার মাস-মাইনের অফিসটা নির্দ্বিধায় কামাই করে ফেললাম।’’
বাড়ির নীচের তলায় থাকতেন ‘গণেশদা’। গণেশ বন্দ্যোপাধ্যায়। বেতার নাটকের নিয়মিত অভিনেতা। তাঁর জন্যই ‘মায়াডোর’-এ সুযোগ। ‘গণেশদা’ সিনেমায় নামছেন শুনে আব্দার করে বসেন, ‘‘আমার একটা চান্স হবে না? একটু চেষ্টা করে দেখো না, গণেশদা।’’
‘‘তুই পার্ট করবি? … এক কাজ কর, কালই ভারতলক্ষ্মী স্টুডিয়োতে চলে আয়। আমি থাকব, দেখি কী করা যায়।’’
এর পরই ‘যায় যাবে যাক প্রাণ না কেন যদি হরি পাই’ বলে ট্রামে চেপে,  সোজা ভারতলক্ষ্মী।
ছেলে সিনেমা করবে, মা প্রাণ ভ’রে আশীর্বাদ করেছিলেন। আর গৌরী? তখন গৌরীরানি গঙ্গোপাধ্যায়। ল্যান্সডাউনের বিখ্যাত ধনী চণ্ডীচরণ গঙ্গোপাধ্যায়ের মেয়ে। রমেশ মিত্র গার্লস স্কুলের ছাত্রী। সবে প্রেমের মুকুল ফুটেছে। তবু মনে হয়েছিল, গৌরীরও তো অনুমতি নেওয়া দরকার।
মহাজুটি
স্কুলের সামনে দেখা করতেই চুপি চুপি গৌরী বলল, ‘‘তুমি বাড়ি যাও, আজ আমি তোমাদের বাড়ি যাব।’’
এর পর ওঁরই লেখা থেকে—
‘‘আমি ভারাক্রান্ত মনে নিয়ে বাড়ি ফিরে এলাম। অপেক্ষায় রইলাম গৌরী আসবে, আমার দীর্ঘ প্রতীক্ষা।
গৌরী সে দিন কথা রেখেছিল। সোজা চলে এসেছিল আমার কাছে। কাছে এসে লজ্জাবনত মুখে দাঁড়াল।…
বললাম, ‘আমি সিনেমায় নামছি। তোমার মত কী গৌরী?’
বড় বড় দু’টো চোখ আমার ওপর রেখে বলল, ‘বেশ তো, এতে আবার আমার মতামত কী?’
সেই মুহূর্তে কোনও লজ্জা আমাকে ভর করেনি। কোনও সঙ্কোচ বোধ করেনি। আবার বললাম, ‘গৌরী বিশ্বাস করো, আমি তোমাকে ভালবাসি, আর ভালবাসি বলেই তোমার মতামত আমার একান্ত দরকার।’
গৌরী হাসল। প্রাণখোলা মিষ্টি হাসি। সে হাসি উচ্ছ্বাসের হাসি নয়।
হাসতে হাসতে বলল, ‘তুমি সিনেমায় নামলে আমি খুশি হব বেশি।’’’
•••
সময় গড়িয়েছে।
এক সময় দিনে ছবি, তো রাতে থিয়েটার। পরের পর অভিনয়।
আকাশ ছোঁওয়ার নেশা ধীরে ধীরে এতটাই!
এক দিকে পর্দায় ‘অগ্নিপরীক্ষা’, ‘পথে হল দেরী’, ‘সবার উপরে’, ‘সাগরিকা’, ‘শিল্পী’, ‘চন্দ্রনাথ’…— সাফল্যের পর সাফল্য। অন্য দিকে মঞ্চে সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে জুটি বেঁধে তৈরি ‘শ্যামলী’ মৃতপ্রায় বাংলা থিয়েটারে ‘ফেনোমেনন’ হয়ে উঠল।
এর পরও আকাঙ্ক্ষা থামার নয়। একের পর এক ধাপ পেরিয়ে উঁচু, আরও উঁচুতে উঠতে চাওয়াতে ছাড় নেই কোনও! —
‘‘কেন জানেন? ছোট হয়ে ঢুকেছিলাম, কিন্তু সমালোচনা পেয়েছিলাম বিরাট। যে দেখে সেই গালাগাল দেয়। বলে, ‘এ আবার কোথা থেকে এল? হটাও ঝুটঝামেলা!’ …আজকাল এই ধরনের একটা কথা প্রায়ই শোনা যায়, ‘দ্য মোমেন্ট আই স হিম, আই নিউ আ গ্রেট অ্যাক্টর হ্যাজ অ্যারাইভড!’ আসলে কিন্তু ‘আই ডিড নট অ্যারাইভ। আই পুশড মাইসেলভ ইন!’’’— আমি, আমিই নিজেকে তুলে ধরেছি, কেউ না। আমি একাই।
পেরিয়ে আসা অমসৃণ সড়কের দিকে ফিরে তাকিয়ে নিজের আহত, ক্ষতবিক্ষত শরীরটা দেখে পাহাড়-ফাটা হুঙ্কার যেন!  জিতে আসা মহাসৈনিকের মতো। নায়কোচিত।
আবার এই নায়কেরই শক্তপোক্ত মনটা কোথায় যেন চুর চুর করে ভেঙে পড়ে, যখন তিনি লেখেন, ‘‘শ্যামলী নাটককে সফল করে তুললাম। অনেক রেকর্ড হল। কিন্তু আমি কী পেলাম? একটা বিশ্রী গুজব যে আমি নাকি গোপনে কোনও নায়িকাকে বিয়ে করেছি! বাইরে অশান্তি— সবাই জিজ্ঞেস করে, এ কী করেছ তুমি? ঘরে অশান্তি!’’
শেষ নয় এখানেই!  
রটে গিয়েছিল উত্তমকুমার একা কিছু নয়। সুচিত্রা আছে বলেই তাঁর এত কিছু। লিখছেন, ‘‘‌শুনে শুনে ভুল বোঝাবুঝির উপক্রম হত। ভাবতাম জুটি ভেঙে দেব, একলাই অভিনয় করব। এখানেও আকাঙ্ক্ষার তাড়না। সুচিত্রা ছা়ড়া অনেক অভিনয় হল। …রটনার মৃত্যু হল।’’
শুধুই আকাঙ্ক্ষা? তারই কারণে বারে বারে চড়াই টপকে টপকে যাওয়া?
স্বীকার করছেন, হয়তো শুধুই তা নয়। তার চেয়েও আরও কিছু। বৈচিত্র খোঁজাটা আসলে জীবনে শেষ কথা হয়ে উঠেছিল তাঁর প্রত্যেকটি ধাপে। তার মধ্যেই বোধ হয় বেঁচে থাকার রসদ কুড়িয়ে নিতে নিতে এগিয়েছেন। 
লিখছেন, ‘‘বৈচিত্র না থাকলে মানুষ বাঁচে না। বৈচিত্র ছিল না বলেই মেরিলিন মনরো আত্মহত্যা করেছে। গ্ল্যামারের একঘেয়েমি থেকে উদ্ধার করে কেউ যদি ওকে বৈচিত্রের সন্ধান দিতে পারত, ও আত্মহত্যা করত না। বেঁচে থাকত। একঘেয়েমি ওর জীবনের আকাঙ্ক্ষাকে নষ্ট করে দিয়েছিল। তাই ও কোনও দিন বিচার করেনি আকাশ কত উঁচু।’’
বৈচিত্রকে হারিয়ে ফেলার ছটফটানি কতটা যে তাঁকে গলা টিপে ধরত, বলছেন তা’ও!—
‘‘একই টাইপের ছবিতে অভিনয় করতে বাধ্য হচ্ছি আমি আজও। আমার দেবার ক্ষমতারও তো একটা সীমা আছে। আজ বারবার মনে হচ্ছে— তথাকথিত রোমান্টিক শিল্পী হিসেবে আমি নিঃশেষ হয়ে গেছি। ইচ্ছে হয়, ভাল ছবিতে ভিন্ন ধরনের চরিত্রে প্রাণ দিয়ে অভিনয় করার, কিন্তু সে পরিচালক কই? গল্প কই? সুযোগ কই?’’—
১৯৬০ সালে সাদা কালো অক্ষরে ক্লান্ত, বীতশ্রদ্ধ মহানায়কের এমনই স্বর শোনা গিয়েছিল। মনে মনে ‘মুক্তি’ খুঁজতে চাইছিলেন তখন।
এর বছর পাঁচ-ছয় বাদেই সত্যজিৎ রায়ের ‘নায়ক’। প্রাণ ফিরে পেলেন যেন মহানায়ক!— ‘‘আমি আমাকে এক নতুন ভূমিকায় খুঁজে পেলাম। মুক্তি হল আমার।’’
‘নায়ক’ অরিন্দমের ‘পাল্স’-এ নিজেকে দেখতে পেয়েছিলেন কি? তাই কি মহাকাঙিক্ষত সেই মুক্তি?
লিখছেন, ‘‘মনে হয়েছে অরিন্দমের সুখ আমার সুখ, অরিন্দমের দুঃখ আমার দুঃখ, অরিন্দমের জটিলতায় আমিও ভাবিত। অরিন্দমের সরলতায় কখনও আমিও মুগ্ধ।’’
‘নায়ক’ তৈরির সময় সত্যজিৎ রায় নাকি শুরুতে বলেছিলেন, ‘‘ওহে উত্তমকুমার, প্রথম সিনটা একটু ছবিবিক ঢঙে অভিনয় করতে হবে।’’ মানে, ছবি বিশ্বাসের মতো।
মনে ধরেনি। লিখেছেন, ‘‘ছবিবিক ঢঙে আমি কী অভিনয় করব? ছবিদা ছবিদার মতো অভিনয় করতেন, আমি আমার মতো করব।’’
ইগো? না, তা হয়তো নয়।
এক জায়গায় ছবি বিশ্বাসকে নিয়ে তিনি লিখছেন, ‘‘ওই একটা মাত্র লোক স্ক্রিনে থাকলে যেন তাঁর পর্বতপ্রমাণ গাম্ভীর্য আর ব্যক্তিত্বের কাছে আশেপাশের আর সমস্ত কিছু নস্যাৎ হয়ে যেত। … অমনটি ছিল না, আর হবেও না কোনও দিন।’’
তবু ‘নায়ক’-এ ‘ছবিবিক’ হতে চাননি। হোক না একটি মাত্র দৃশ্য, তা’ও না। ‘অরিন্দম’-এর মধ্যে এতটাই নিজের শরীর-মন দেখতে পেয়েছিলেন তিনি!
•••
লস এঞ্জেলস-এ ভাষণ দিতে গিয়েছিলেন। পরে সেই ভাষণের বাংলা তর্জমা প্রকাশিত হয়।
সেখানে দেখা যাচ্ছে, তাবড় সাহেব-সুবোদের সামনে দাঁড়িয়ে বাংলা সিনেমা নিয়ে প্রায় বোমা ফাটাচ্ছেন মহানায়ক।
বলছেন, ‘‘এক এক সময় মনে হয় কী জানেন— আমরা তো অনেক বড় আর্টিস্ট, নয় কেন? কেন নয়? আমরা যদি রবার্ট রেডফোর্ডকে বলি— আমরা যদি বার্টন সাহেবকে বলি— আমরা যদি পিটার ওটুলকে বলি— আমরা যদি টোপল সাহেবকে বলি যে আমাদের ওই জায়গায় টালিগঞ্জে গিয়ে এক ঘণ্টা শ্যুটিং করে আসুন না। পালিয়ে আসবেন। পরের দিনই টিকিট কেটে পালিয়ে আসেবেন।’’
সে কালের স্টুডিয়োর অবস্থা যে কতটা কুৎসিত, তা নিয়ে বিদেশের মাটিতে দাঁড়িয়েও কোনও লুকোছাপা নেই তাঁর।
দুটোর বেশি লেন্স নেই। ভাঙা ক্যামেরা। তা’ও বলতে গেলে ক্লাইভের আমলের। —‘‘সে এখনও চলছে ভাল রোমান্টিক সিনে— বেশ গদগদ নায়ক-নায়িকা। বেশ সুন্দর। পার্টটাও ভাল হচ্ছে। হঠাৎ কাট কাট।— কী ব্যাপার ফিল্ম জ্যামড্ হয়ে গেছে। আবার সেই নায়ক নায়িকা চোখ কুঁচকে মুখের ওপর বরফ লাগিয়ে ঠান্ডা জলটল লাগিয়ে আবার রেডি হচ্ছে— হয়তো ঠিক আগের মতো হল না।’’
অপর্ণা সেনের সঙ্গে অভিনয়। এক গাল দাড়ি, গোঁফ। হঠাৎ লোডশেডিং। গোটা বাংলায় যখন তখন সে ছিল এক নয়া উৎপাত। পরিচালক অজয় কর। —‘‘বললাম, অজয়বাবু আর হবে? উনি বললেন, একটু অপেক্ষা করো— দেখি। বসে আছি— কামড়। কীসের বলুন তো— মশার। প্রচণ্ড মশা।…এরই মধ্যে আমরা কাজ করছি।’’
কথায় বিদ্রুপ ছিল। ঠাট্টাও। কিন্তু যন্ত্রণাও কি ছিল না? 
আর বেপাড়ায় গিয়ে, তার ঠাটঠমকে কুঁকড়ে না গিয়ে নায়কের মতোই চ্যালেঞ্জ দেওয়া?— ‘এক বার খেলে যান না এ মাঠে, দেখি কেমন পারেন!’
•••
‘‘প্রেম যেন অনেকটা নতুন শাড়ির গন্ধের মতো, দু’দিন পরলেই আর গন্ধটা থাকে না। না পরে বাক্সে তুলে রাখলেও গন্ধটা নষ্ট হয়ে যায়। আর প্রথম প্রেম? সম্ভবত কর্পূরের মতো উবে যায়।’’
লিখছেন তিনিই। বছর বছর ধরে যিনি কি’না ছিলেন লক্ষ লক্ষ কিশোরী-তরুণীর হার্টথ্রব।
প্রথম প্রেমে পড়েছিলেন স্কুলবেলায়। ধূমকেতুর মতো দেখা দিয়ে তা উধাও-ও হয়, ধূমকেতুর মতোই।
লিখছেন, ‘‘মেয়েটি এক দিন ভরপুরের হাজির হয়েছিল আমার ঘরে। মনে পড়ে, তখন আমি স্কুলের ছাত্র। কী কারণে স্কুলে যাইনি। খাওয়াদাওয়ার পাট চুকে গেছে। মা ওপরের ঘরে শুয়ে ঘুমোচ্ছেন। নীচতলায় আমার পড়বার ঘরে আমি একলা। খাতা কলম নিয়ে হিজিবিজি কী সব আঁকছি। ঠিক সেই সময়ে মেয়েটি এল। আমারই বয়সি, পাশের বাড়ির বাসিন্দা। আমি চোখ তুলে তাকালাম। মুহূর্তে মেয়েটির চোখের তারায় বিদ্যুৎ নেচে উঠতে দেখলাম। সে খিল খিল করে হেসে উঠল। হঠাৎ উপলব্ধি করলাম, এ হাসির যেন অনেক অর্থ। সেই প্রথম ওই নিঃশব্দ নিরালা মুহূর্তে পরম বিস্ময়ে অনুভব করলাম, এক অপরূপের আবির্ভাব ঘটেছে আমার চোখের সামনে। … ওরা ছিল দুই বোন। এক দিন দেখি, বড় বোনও আমায় প্রেম নিবেদন করতে চাইছে। সেই আমার প্রথম প্রেমের মৃত্যু হল।’’
•••
‘‘ছেলেটি বাড়িসুদ্ধ লোকের সামনে আমাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেলো।’’
লিখছেন নায়ক। ঘটনাটি মেদিনীপুরের। চাতরায়।
ফ্যানদের বিচিত্র সব কাণ্ড কারখানা দেখেছেন জীবনভর।
অভিজাত কুলবধূ মফস্সল থেকে শহরে এসে দেখা করে বলেছেন, ‘‘আমি আর ফিরব না।’’
সদ্য বিবাহিতা সব লাজলজ্জা ধুয়ে সটান হাজির হয়েছেন শুধু তাঁকে দেখবেন বলে।
ফ্যানলেটারের রকম বললে তো আড়েবহরে মহাকাব্যকে হার মানাবে।
তবু চাতরার সেই যুবকটি যেন সবার থেকে আলাদা।
লিখছেন, ‘‘আমার পুরনো দিনের বন্ধুর বাড়িতে গিয়েছিলাম নেমন্তন্ন খেতে। খাওয়া আর হল কই!’’
তার মাঝেই অমন কাণ্ড!
‘‘দৃশ্যটা সবাই এনজয় করল বেশ। আমি এক্কেবারে বোকা বনে গেছি। ফিরে আসবার সময় ছেলেটির সঙ্গে আমার দেখা হল। রাস্তায়। গাড়ি থামিয়ে ছেলেটিকে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘বহু জায়গায় গিয়েছি, কিন্তু হঠাৎ এরকম একটা ব্যবহার।’… কয়েক সেকেন্ড চিন্তা করে খুব ক্যাজুয়ালি বলল, ‘দাদা, আপনার ওই বুকে তো অনেক নায়িকা পড়েছে। আমিও একবার পড়ে দেখলাম। বহু দিনের শখ ছিল। বিশ্বাস করুন, ওই জায়গাটার প্রতি আমার একটা দুর্বলতা ছিল এত দিন।’’’
•••
‘‘এত লোকের আগ্রহ আমি, উত্তমকুমার, আমারও ইচ্ছেপূরণ হয় না, অনেক ছোট আকাঙ্ক্ষা মেটে না।’’
এ কথা যখন লিখছেন, মনে হয়, এক রাশ ক্লান্তি চেপে ধরেছে যেন! এত মানুষ, এত আলো, এত রকমের চাওয়ার মাঝে ওঁর ছোট্ট ছোট্ট চাওয়াগুলো কেমন বুদবুদ কেটে ভেসে ওঠার আগেই মিলিয়ে যেত।
জগুবাবুর বাজারের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলেন। রাস্তায় এক ফুলওয়ালা গোলাপ নিয়ে বসে। নজর পড়ল বিশেষ একটি গোলাপের ওপর। নিজেই নামতে যাচ্ছিলেন। ড্রাইভারকেই পাঠাতে হল।
ড্রাইভার ফিরল অন্য একটি গোলাপ নিয়ে। পাল্টাতে বলবেন যে, উপায় নেই। ততক্ষণে গাড়ির সামনে, পিছনে সার সার লোক শুধু।—
‘‘গাড়ি চলতে শুরু করল, ফুলটা নিয়ে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি আমি।’’
লিখছেন—
ছোট ছোট এই ইচ্ছে, আকাঙ্ক্ষাগুলো আমাকে দংশন করে, যখন আমি একা, আমার চারপাশ গাঢ় অন্ধকার।
আসলে ছবির জগৎটাই তো এমনি। চারপাশের অন্ধকারেই ছবির জগৎ রোশনাইয়ের মতো জ্বলে। ছবির জগতের যাঁরা বাসিন্দা তাঁদের জীবনটাও এই রকম।
যতই চারপাশ অন্ধকার হবে ততই তাঁরা স্পষ্ট হবেন। নিজেদের জীবনের চারপাশের অন্ধকার নিয়ে তবেই তাঁরা জ্বলতে পারেন।
নায়কের স্বরও এত ম্রিয়মাণ, এত শুষ্ক, রিক্ত, প্রাণহীন হয়!

সূত্র: নায়কের কলমে (২৪ জুলাই, ২০১৫-য় প্রকাশিতব্য গ্রন্থ), সপ্তর্ষি প্রকাশন, সম্পাদনা: অভীক চট্টোপাধ্যায় (উদ্ধৃত কিছু অংশ সংক্ষেপিত, বানান পরিবর্তিত)

http://www.anandabazar.com/supplementary/patrika/debshankar-mukhopadhyay-writes-on-uttam-kumar-1.176947?ref=archive-new-stry