সুপ্রিম কোর্ট সম্প্রতি বলেছে, কেরলের শবরীমালা মন্দিরে দশ থেকে পঞ্চাশ বছর বয়সি মহিলাদের প্রবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা কত দূর সংবিধানসম্মত, তা খতিয়ে দেখা উচিত। ভারতে ধর্মীয় ঐতিহ্য এবং সংবিধানের সংস্কারমুখী প্রবণতার মধ্যে যে টানাপড়েন চলে আসছে, সর্বোচ্চ আদালতের এই অভিমত সেটাই দেখিয়ে দেয়। ধর্মীয় ঐতিহ্য বা লোকাচারের সংস্কারের প্রয়োজন আছে কি না, সে বিষয়ে যখনই আদালতকে বিচারকের আসনে বসতে হয়েছে, তখনই এই টানাপড়েনের সূত্রপাত ঘটেছে। এই দ্বন্দ্ব অবশ্যই শুধু ভারতের ব্যাপার নয়, অন্যত্রও আছে। কিন্তু ভারতে এটা এক বিশেষ মাত্রা অর্জন করে, কারণ ভারতীয় সংবিধানের ২৫(২) নম্বর ধারার জোরে ধর্মীয় ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করার ক্ষেত্রে ভারতীয় আদালতের একটা ঐতিহাসিক প্রবণতা রয়েছে।
বিভিন্ন ধর্মীয় আচার ও বিধান যাচাই করার জন্য ভারতীয় বিচারব্যবস্থা কালক্রমে তথাকথিত ‘অত্যাবশ্যক প্রথা’র মাপকাঠি তৈরি করেছে, যা দিয়ে স্থির হবে, কোন কোন প্রথা অত্যাবশ্যক (সুতরাং মান্য)। কয়েকটি ধরনের মামলার বিচার করতে গিয়ে আদালত মাপকাঠি ব্যবহার করেছে। যেমন, কোন ধরনের ধর্মীয় আচরণগুলি সাংবিধানিক নিরাপত্তা পাওয়ার যোগ্য, তা নির্ধারণের জন্য, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলি পরিচালনার জন্য প্রণীত আইনের বৈধতা আছে কি না, তার মীমাংসা করার জন্য এবং বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠী বা সংগঠন কত দূর স্বাধীনতা ভোগ করতে পারে, তার বিচারের জন্য আদালত এই পরীক্ষা প্রয়োগ করেছে। বিশেষ করে প্রথমটি শবরীমালা-র ক্ষেত্রে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। কারণ এখানে মন্দির কর্তৃপক্ষ যুক্তি দিয়েছেন যে, মহিলাদের ওপর চাপানো নিষেধাজ্ঞা আদতে তাঁদের ধর্মীয় ঐতিহ্যেরই একটা অংশ।
এই ধরনের মামলার একটা দীর্ঘ তালিকা রয়েছে। এর শুরু হয়েছে ১৯৫৪ সালের ‘শিরুর মঠ’ সংক্রান্ত মামলার রায় দিয়ে। এখানে ‘মাদ্রাজ হিন্দু রিলিজিয়াস অ্যান্ড চ্যারিটেবল এনডাওমেন্ট’-এর অধিকার চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছিল। এবং তার মীমাংসা করতে গিয়ে ধর্ম মানে কী, সেই মৌলিক প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আদালতকে এগিয়ে আসতে হয়েছিল। শিরুর মঠের ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্ট মন্তব্য করেছিল যে, ‘কোন কোন আচার এবং অনুষ্ঠানগুলি অত্যাবশ্যক, সেটা স্থির করার বিষয়ে ধর্মীয় গোষ্ঠী এবং সংগঠনগুলোর সম্পূর্ণ স্বাধিকার আছে... এবং বাইরের কারও কোনও এক্তিয়ারই নেই তাদের এই সিদ্ধান্তে হস্তক্ষেপ করার।’ একই সঙ্গে, আদালত স্পষ্ট করে দিয়েছিল যে, যখনই এই ধরনের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান জনজীবনের শৃঙ্খলা, স্বাস্থ্য এবং নৈতিকতার পরিপন্থী, এবং যখনই সেগুলি— ধর্মাচরণের সঙ্গে যুক্ত হওয়া সত্ত্বেও— চরিত্রে অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক বা রাজনৈতিক, তখন রাষ্ট্র বৈধ ভাবেই তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে।
১৯৫০-এর দশকে আর একটি ঐতিহাসিক রায়ে সুপ্রিম কোর্ট গৌড় সারস্বত ব্রাহ্মণদের এক আবেদন খারিজ করে দেয়। কর্নাটকে শ্রীবেঙ্কটরমন মন্দিরে দলিত এবং অনগ্রসর মানুষদের প্রবেশাধিকার মঞ্জুর করে যে আইন জারি হয়েছিল, এই সম্প্রদায়টি সেই আইন মানা থেকে রেহাই চেয়ে মামলা করে। এ ক্ষেত্রে আদালত সংবিধানের ২৫ নম্বর ধারাটির সংস্কারমূলক দিকটিকে ২৬ নম্বর ধারায় প্রদত্ত গোষ্ঠী-অধিকারের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিল। ধর্মীয় সংগঠনের স্বাধীনতার দাবি এবং ধর্মীয় রীতিনীতি নিয়ন্ত্রণে রাষ্ট্রের ক্ষমতা, এই দুইয়ের টানাপড়েন নিয়ে বার বারই ভারতীয় বিচারব্যবস্থাকে ভাবতে হয়েছে।
যে সব ধর্মীয় প্রথা বা বিধান সাংবিধানিক রক্ষাকবচ পাওয়ার যোগ্য, ১৯৬০-এর দশক থেকে সুপ্রিম কোর্ট ক্রমশই সেগুলির সংখ্যা কমিয়ে এনেছে। যেমন, ‘দরগা কমিটি’ মামলায় আদালত রায় দিয়েছিল, ‘ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান নিছক অন্ধবিশ্বাস থেকেও জন্ম নিতে পারে। সে ক্ষেত্রে এমন হতেই পারে যে, বাইরে থেকে যোগ করা প্রথাটি ধর্মের পক্ষে আবশ্যক ছিল না।’ আরও বলা হয়েছিল, যদি না এই ধরনের রীতিনীতিকে ‘ধর্মের এক অত্যাবশ্যক এবং অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা’ করা না যায়, তা হলে তাদের সাংবিধানিক নিরাপত্তার দাবি খুব সতর্কতার সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে।
শবরীমালা মন্দিরের ক্ষেত্রে আদালতকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, মন্দিরে নারীর প্রবেশাধিকারের ওপর নিষেধাজ্ঞা যথার্থ ধর্মীয় রীতি কি না (মন্দির পরিচালন কর্তৃপক্ষ তেমনটাই দাবি করেছেন), এবং এই নিষেধাজ্ঞা ‘অত্যাবশ্যক প্রথা’র মাপকাঠিতে উত্তীর্ণ হয়েছে কি না। লক্ষণীয়, যে সমস্ত জায়গায় প্রথা (কাস্টম) বা প্রচলনবিধি (ইউসেজ) অনুযায়ী উপাসনাস্থলে নারীর প্রবেশ নিষিদ্ধ হয়েছে, ‘কেরল হিন্দু প্লেসেস অব পাবলিক ওয়ারশিপ (অথরাইজেশন অব এন্ট্রি) রুলস, ১৯৬৫’ সে ক্ষেত্রে ওই নিষেধাজ্ঞাকে অনুমোদন করেছিল। কেরল হাইকোর্টের এক রায়েও বলা হয়েছে, মহিলাদের ওপর এই নিয়ন্ত্রণ বহু শতাব্দীব্যাপী প্রচলিত এক ধারার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। কিন্তু, প্রথম দিকের মামলাগুলোর মতোই, সুপ্রিম কোর্ট সিদ্ধান্ত নিতে পারে যে, শবরীমালায় মহিলাদের প্রবেশের ওপর নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থাটি ‘অত্যাবশ্যক প্রথা’র মাপকাঠিতে উত্তীর্ণ হয়নি। এমনকী, ১৯৬৫ সালের উল্লেখিত বিধিটিকে সুপ্রিম কোর্ট এই যুক্তিতেও নাকচ করতে পারে যে, সেটি লিঙ্গ-বৈষম্যকে প্রশ্রয় দিচ্ছে এবং একই সঙ্গে মেয়েদের উপাসনার স্বাধীনতাকেও খর্ব করছে। এই দুটোই সংবিধানের পরিপন্থী।
কিছু দিন আগে মুম্বই হাইকোর্ট মহারাষ্ট্রের শনি শিংনাপুর মন্দিরে মহিলাদের প্রবেশের পক্ষে রায় দিয়ে এ বিষয়ে এক নজির সৃষ্টি করেছে। আদালত বলেছে, পুরুষরা যদি উপাসনা স্থানে প্রবেশের অনুমতি পেতে পারে, তা হলে নারীদেরও তা পাওয়া উচিত। দুই মহিলা আন্দোলনকারীর করা জনস্বার্থের মামলার প্রেক্ষিতে মুম্বই হাইকোর্ট এই রায় দেয়। ওঁরা দাবি করেছিলেন, উপাসনালয়ে মহিলাদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আসলে মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন ছাড়া কিছুই না এবং তা ‘মহারাষ্ট্র হিন্দু প্লেসেস অব পাবলিক ওয়ারশিপ (এন্ট্রি অথরাইজেশন) অ্যাক্ট, ১৯৫৬’-এর পরিপন্থীও বটে।
সুপ্রিম কোর্ট যে সিদ্ধান্তই নিক না কেন, এটা দুর্ভাগ্যজনক যে, যথার্থ ধর্ম কাকে বলে তা স্থির করার দায় বিচারব্যবস্থার কাঁধে এসে পড়ছে। রাজীব ধবন এবং ফলি নরিম্যানের মতো সংবিধান-বিশেষজ্ঞ আইনজীবীরা বলেছেন, বিচারকরা এখন ‘কার্যত ধর্মতত্ত্বের হর্তাকর্তায় পরিণত হয়েছেন, একটি ধর্মবিশ্বাসের পক্ষে কোন কোন ধারণা বা প্রথা ‘অত্যাবশ্যক’, সেটা তাঁরাই নির্ধারণ করছেন।’ এর কারণ হল, ভারতীয় রাষ্ট্র হিন্দুধর্ম এবং তার প্রতিষ্ঠানগুলি পরিচালনা ও সংস্কারের ভারপ্রাপ্ত প্রতিনিধি হয়ে উঠেছে। এই প্রেক্ষিতে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্রতাপভানু মেটার মন্তব্য তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি বলেছেন, ‘যদি সমস্ত কমিউনিটি ক্রমশ এটা স্বীকার করে নেয় যে, ব্যক্তিস্বাধীনতা, বৈষম্যমুক্ত আচরণ এবং সমতার অনুকূলে উত্তরণই নৈতিক এবং সামাজিক দাবি, বিশেষ করে মেয়েদের সমানাধিকার মেনে নেওয়া যে অত্যাবশ্যক’, তা হলেই মঙ্গল। যত দিন তা না হচ্ছে, তত দিন ধর্মীয় বিবাদকে আদালতে টেনে নিয়ে যাওয়ার এই প্রবণতা চলতেই থাকবে।
ইতিহাসবিদ, ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুর (এনইউএস)

http://www.anandabazar.com/editorial/on-the-way-to-redemption-1.404660#