২০১১’য় যা ছিল প্রাকৃতিক বা স্বাভাবিক, ২০১৬’য় তা অনিশ্চিত এবং অনেকের মতে অস্বাভাবিক। কিন্তু ২০১৬-র নির্বাচনে রাজনৈতিক বিহ্বলতা এমন সর্বব্যাপী এবং সর্বগ্রাসী হয়ে উঠল কী করে? রাজনৈতিক বোধ প্রায় পূর্ণগ্রাসে চলে গেল কী করে?
অনিশ্চয়তা এক দিকে একটা মানসিকতা, অন্য দিকে নয়া উদারনৈতিক প্রশাসনিকতায় এবং অর্থনীতি ও রাজনীতিতে এক ধরনের পুঁজিও বটে। নির্বাচন কমিশন এ বারে ছ’দফা নির্বাচনী কর্মসূচি প্রস্তুত করেছিলেন কেন, তা শুধু কেন্দ্রীয় সরকারি মহলের অলিন্দে যাঁরা ঘোরাফেরা করেন, তাঁরা বলতে পারবেন। প্রথম দফা আবার দুই পর্বে। জঙ্গলমহলকে পৃথক চিহ্নিত করার কারণই বা কী ছিল? জঙ্গলমহল তো কোনও উপদ্রুত এলাকা নয়। ৪০ কোম্পানি আধা-সামরিক বাহিনীর শক্তিকে ধাপে ধাপে বাড়িয়ে নিয়ে আসা হল ৭০০ কোম্পানিতে। ৭০ হাজার সৈন্য নিয়ে নির্বাচন পরিচালনা নির্বাচনের সামরিকীকরণের চিহ্ন। কাশ্মীর, উত্তর–পূর্বাঞ্চলে এ ভাবেই নির্বাচন হয়। এর সঙ্গে যুক্ত হল পরিদর্শক, উপপরিদর্শক ও অন্যান্য অফিসারবাহিনী। নতুন সফটওয়্যার, আরও নানা ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে যা ঘটল, তাকে বলা চলে নির্বাচনের সামরিকীকরণ এবং নিরাপত্তায়ন।
কত সৈন্য কবে লাগবে, কোন কোন তারিখে কোথায় ভোট হবে, কত বুথ বসানো হবে, কত পরিদর্শক লাগবে, নানা ধরনের খবর কোথা থেকে কোথায় পৌঁছবে, দিল্লি থেকে নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি কী হবে, কত অফিসার বদলি হবে, অনুযোগ-অভিযোগের দ্রুত তদন্ত হবে কী করে, কার ওপর নজর রাখা হবে— এ সব হল নয়া উদারনৈতিক যুগে নির্বাচন সংগঠনের পদ্ধতি। নির্বাচন এখন হল ‘লজিসটিক্স’-এর ব্যাপার। ‘লজিসটিক্স’-এর কেতাবি অর্থ সরবরাহ ব্যবস্থা পরিচালনার বিদ্যা। ভোটবাজারে নানা সরবরাহ লাগে। নির্বাচন যত সরবরাহ পরিচালনা শাস্ত্রের অধীন হয়েছে, ততই তার সামরিকীকরণ এবং নিরাপত্তায়ন হয়েছে। বাঙালি বুদ্ধিজীবী এবং রাজনৈতিক নেতারা যত নির্বাচন কমিশন-নির্ভর এবং কেন্দ্রীয় সরকার ও রাষ্ট্রের মুখাপেক্ষী হয়েছেন, তত তাঁরা এই সামরিকীকরণ এবং নিরাপত্তায়ন প্রক্রিয়ার ক্রীড়নকে পর্যবসিত হয়েছেন।
বলা হয়, ধনতন্ত্রে এক ধরনের আদিম স্পৃহা বা অ্যানিমাল স্পিরিট লাগে পুঁজি বৃদ্ধির জন্য। আশ্চর্য কী যে, নির্বাচনকে পণ্যবাজারে পরিণত করে এই আদিম স্পৃহার প্রদর্শন এ রকম উন্মত্ত হয়ে উঠেছিল! বাদ সেধেছেন সেই অবাধ্য, অশিক্ষিত জনসাধারণ। যাঁরা এই প্রক্রিয়ায় সায় দেননি, তাঁরা বাঁচার ন্যূনতম উপায় যেখানে পেয়েছেন, যেখানে তাঁদের বলার অঙ্গীকার লাভ করেছেন, শত দোষ সত্ত্বেও তাঁদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। এই দিক থেকে ২০১৬-র ঘটনা আরও সংঘাতপূর্ণ, আরও তীব্র এবং দ্বন্দ্বসংকুল।

জনপ্রিয়তাবাদ

জনপ্রিয়তাবাদের সামাজিক ভিত্তি সর্বত্র এক নয়। কোথাও এই জনপ্রিয়তাবাদ একেবারেই ধনিক শ্রেণির, কোথাও বামপন্থী সংস্কার মানসিকতার সৃষ্ট, কোথাও আবার আকস্মিক ভাবে আবির্ভূত হয়েছে সমাজের নিচুতলার আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন রূপে। ইন্দিরা গাঁধী হয়তো প্রথম ধরনের জনপ্রিয়তাবাদী রাজনীতির চর্চা করেছেন। বামফ্রন্ট প্রশাসন তার প্রথম দিকে, অন্তত আশির দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত দ্বিতীয় ধরনের জনপ্রিয়তাবাদী রাজনীতি অনুসরণ করেছেন। সে সময় বামফ্রন্টের মুখ্যমন্ত্রী বার বার বলতেন, বামফ্রন্ট আমূল পরিবর্তন আনতে পারবে না, কিন্তু কিছু উপকার জনগণের করতে পারে— কিছু নিরাপত্তা প্রদান, কিছু রক্ষা, কিছু সীমিত সংস্কার। তাই বেকার ভাতা প্রদানও কর্মসূচির অঙ্গ ছিল। আজ এটা পরিহাসের ব্যাপার। যে পদক্ষেপের জন্য বামপন্থী বুদ্ধিজীবীরা বামফ্রন্টের প্রশংসা করতেন, সেই একই ধরনের, বরং আরও অনেক বেশি মাত্রায় সেই ধরনের পদক্ষেপকে তাঁরা ডোল বা খয়রাতি বলে নিন্দা করেন, তির্যক মন্তব্য করেন। তৃণমূল প্রশাসন, দল এবং তার নেত্রী তৃতীয় ধরনের জনপ্রিয়তাবাদের উদাহরণ।
এই জনপ্রিয়তাবাদের মধ্যে কি ফাঁকফোকর, দোষ, গভীর বিভাজনরেখা নেই? নিশ্চয়ই আছে। দুর্বৃত্তায়ন নেই? দুর্নীতি নেই? আছে। এ সবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, সমালোচনা চলা উচিত, এবং চলবে। কিন্তু দুটো জিনিস এ ক্ষেত্রে মাথায় রাখতে হবে, যদি রাজনৈতিক বোধের পরিচয় দিতে হয়। নইলে শুধু অনুশোচনা, খেদোক্তি আর কপাল চাপড়ানো ভবিতব্য হয়ে দাঁড়াবে।
এক, সাধারণ মানুষের রাজনৈতিক বিচারে এই দুর্বৃত্তায়ন অথবা দুর্নীতির কোনও সমালোচনা নেই? আছে। কিন্তু কী সেই সামগ্রিক রাজনৈতিক বোধ, যাতে সাধারণ মানুষ এই দুর্বৃত্তায়ন ও দুর্নীতি সত্ত্বেও অন্যান্য সংসদীয় রাজনৈতিক শক্তির চেয়ে তৃণমূলকে অধিক সমর্থন করে? বিশেষত দরিদ্র মানুষ?
দুই, শুধু সংস্কারকেন্দ্রিক কর্মসূচি ও কর্মকাঠামোয় কি এই দুই ব্যাধি বন্ধ হবে? প্রবল রাজনৈতিক শক্তি রূপে বামফ্রন্টের শেষ হয়ে যাওয়া, এবং দল ও উপদলসর্বস্ব জনসমাবেশের ক্ষমতা শূন্যে পৌঁছনোর পর, নতুন জনসমাবেশ রীতির অনেক ভাল দিকের পাশাপাশি এ এক নিহিত অভিশাপ। ক্ষুদ্র উৎপাদন-প্রধান অর্থনীতি, নির্মাণশিল্প-নির্ভর অর্থনৈতিক প্রসার, ব্যাপক বেকারত্ব থেকে এ অবস্থা জন্ম নেবেই। এই অবস্থার মধ্যে থেকে রাজনীতি করলে তবেই তা প্রাসঙ্গিক হবে।
বিশ্বায়ন, উদারনীতিকরণ, রাষ্ট্রিক ব্যয়সংকোচ ও আর্থিক সংস্কারের যুগে নীচের মহলের জনপ্রিয়তাবাদের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা সীমিত। বাজারই এখন আসল কথা, জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধি গায়ত্রীমন্ত্র। জনকল্যাণকামী সীমিত নীতি ও পদক্ষেপ কত দিন কত দূর চালানো যাবে বলা শক্ত। যদিও অভিনব নানা পদক্ষেপে তৃণমূল প্রশাসন এই পরিস্থিতিতেও সামাজিক উপকাঠামোর প্রসার ঘটিয়েছেন।
কিন্তু নিচুতলার জনসাধারণের আকাঙ্ক্ষার উপর ভিত্তি করে যে জনপ্রিয়তাবাদ গড়ে উঠছে, তার অর্থনৈতিক সম্ভাবনা যত কমবে, তত তার রাজনৈতিক অভিনবত্ব ও বৈচিত্র বাড়বে, বিশ্বায়ন এবং নয়া উদারনৈতিক আয়োজনের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ তত জনপ্রিয়তাবাদী পথ ও পদ্ধতিকে সমর্থন করবে, আঁকড়ে ধরবে। নানা রূপে জনপ্রিয়তাবাদের উদ্ভাবন ঘটাবে।  আজকের ভারত তার জীবন্ত নিদর্শন।
এই স্ববিরোধিতার তাৎপর্য বিচারে না আনলে, সমাজের গতির বস্তুবাদী প্রকৃতিকে গণ্য না করলে কীসের বামপন্থা? তার বদলে দেখব শুধু রক্ষণশীল সমাজশাস্ত্র ও জ্ঞানচর্চা। বামপন্থী আদর্শ, কর্মপন্থা বা কর্মসূচির প্রয়োজন নেই তা নয়। কিন্তু ২০১১ ও ২০১৬ যে দ্বান্দ্বিক দৃষ্টির প্রয়োজনের ইঙ্গিত দিয়েছে, তার আলোয় দেশের, অন্তত বাংলার রাজনীতি নিয়ে নতুন করে ভাবার সুযোগ এসেছে। জনসাধারণ দুই-দুই বার এই সুযোগ করে দিয়েছেন। সেটা কাজে লাগানো উচিত। সমালোচনা চলুক, কিন্তু বিচারবোধকে ত্যাগ না করে। (শেষ)

সমাজবিজ্ঞানী, ক্যালকাটা রিসার্চ গ্রুপ। মতামত ব্যক্তিগত

http://www.anandabazar.com/editorial/new-thinking-in-a-true-politics-1.396247