খবরের কাগজে আবার গুজরাত গণহত্যা। এ বার গুলবর্গ সোসাইটি মামলার রায়। ২০১২’র ২৯ অগস্ট, নারোদা-পাটিয়া মামলার রায় ঘোষিত হয়েছিল, যে ঘটনার চার্জশিটে ৯৬ জনকে মৃত বলা হয়েছিল, যদিও প্রত্যক্ষদর্শীদের হিসেবে মৃতের সংখ্যা ছিল ১২৬। এক জন প্রাক্তন মন্ত্রী সহ ৩২ জনের সাজা ঘোষণা করা হয় এই মামলায়।
গুজরাত ২০০২-এর একক বড় ঘটনা হিসেবে নারোদা-পাটিয়ার পরেই আসে গুলবর্গ সোসাইটির হত্যাকাণ্ড। আমদাবাদের মেঘানিনগর মহল্লায় গুলবর্গ সোসাইটি। সেই আবাসনের ৬৯ জনকে হত্যা করা হয়, ৩১ জন নিখোঁজ। এখানে থাকতেন কংগ্রেসের প্রাক্তন সাংসদ এহসান জাফরি। তাঁর গৃহে ছিল হিন্দু-মুসলমান সকলের অবাধ যাতায়াত। তাঁর বাড়ি আক্রান্ত হলে প্রবীণ মানুষটি হাত জোড় করে আক্রমণকারীদের থামাতে চেয়েছিলেন। সেই জোড় করা হাতের ওপর তরোয়ালের কোপ পড়ে। এ ঘটনা আমার রেহানার কাছে শোনা। তিনি ওই বাড়িতেই প্রাণভয়ে লুকিয়ে ছিলেন। দরিয়াখান ক্যাম্পে বসে তিনি আমাকে বার বার বলেছিলেন, ‘আব্বা’কে তিনি বাঁচাতে পারলেন না। (এহসান জাফরিকে আব্বা ডাকতেন রেহানা।) অঞ্চলে আক্রমণকারীরা ঢুকে পড়ার পরে জাফরি সাহেব পুলিশের কর্তা থেকে মন্ত্রী, এমনকী দিল্লিতেও ফোন করেন। ফল হয়নি। বেলা সাড়ে এগারোটা থেকে সাড়ে তিনটে গোটা সোসাইটি এবং মেঘানিনগর চার-পাঁচ হাজার সশস্ত্র গুন্ডার দখলে ছিল। পুলিশকর্তারা খবর পেয়েও যাননি। সওয়াল-জবাবের সময় এ সব কথা উঠে এসেছে। দীর্ঘ সময় ধরে লুঠপাট, অগ্নিসংযোগ, হত্যা ও ধর্ষণের তাণ্ডব চলে। এমনও শুনেছি, প্রচণ্ড মারের পর, এক জায়গায় ফেলে গাদা করে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। পুড়ে গেলেও প্রাণে মারা যাননি এমন মানুষেরও সাক্ষাৎ পেয়েছি।
আর একটি মামলা এখনও বিচারাধীন। এহসান জাফরির স্ত্রী জাকিয়া জাফরি সেই মামলাটি দায়ের করেছেন। গোটা গুজরাত জুড়ে তিনশো ঘটনাকে চিহ্নিত করা এবং সেই সব ঘটনায় প্রশাসনের দায়ভাগ নির্ধারণ করার দাবি জানিয়েছেন তিনি।
২৮ ফেব্রুয়ারি ২০০২ গোধরার ঘটনা। মে মাসের প্রথম সপ্তাহে আমরা তিন জন (আমি, কৃষ্ণা বন্দ্যোপাধ্যায় ও কবিতা পাঞ্জাবি) আক্রান্ত শিশুদের সম্পর্কে অনুসন্ধানের জন্য আমদাবাদ যাই। তখনও বিপর্যস্ত পরিবারগুলির ঘরে ফেরা হয়নি। ক্যাম্পগুলি ঘুরে ঘুরে আমরা রিপোর্ট তৈরি করেছিলাম। সেই অভিজ্ঞতা অবিস্মরণীয়। মানুষের আকুল কান্না শুনেছি, তাঁরা জানিয়েছেন অকল্পনীয় নিষ্ঠুরতার কাহিনি। শুনেছি, কপালে তিলক কেটে, আকণ্ঠ মদ্যপান করে গুন্ডারা রামের নাম নিয়ে ছুটে এসেছে, মেয়েদের ধর্ষণ করেছে, খুন করেছে, আগুন লাগিয়েছে তাদের একক বা স্তূপীকৃত দেহে। শুনেছি প্রশাসনের ন্যক্কারজনক ভূমিকার কথা। নারোদা-পাটিয়ায় দেখেছি, কী নিপুণ হিসেবে একই বাড়ির পাশাপাশি দুটি ফ্ল্যাটের যেটিতে মুসলমান থাকেন সেটি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, পাশের হিন্দুর ফ্ল্যাটটি অক্ষত। মসজিদে আশ্রয় নিয়েছিলেন বহু মানুষ, মসজিদেই আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। পুড়ে মরতে আপত্তি থাকলে বাইরে তরোয়ালধারীরা প্রস্তুত।
শাহ আলম ক্যাম্পটি ছিল সবচেয়ে বড়। বারো হাজার শরণার্থী। অবিবাহিত এক বৃদ্ধার সঙ্গে অনেক কথা হয়েছিল সেখানে। রক্ষণশীল মুসলমান পরিবারের মেয়ে, কর্মজীবনে নার্স ছিলেন। গাঁধীজির ডাকে ও বাবার উৎসাহে স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দেন। বলেছিলেন ক্যাম্পে উদ্ধারকারীদের আনা অল্পবয়সি মেয়েদের কথা। অনেককেই অজ্ঞান অবস্থায় আনা হয়েছে, গণধর্ষণে চেতনা হারিয়েছেন তাঁরা। অনেকের যৌনাঙ্গে কাঠের টুকরো ইত্যাদি গোঁজা, অনেকের শরীর অর্ধদগ্ধ। যাঁদের জ্ঞান আছে, তাঁরা আর্ত চিৎকার করছেন। সেই মেয়েদের শুশ্রূষা করেছেন তিনি। খুব ধীরে ধীরে কথা বলছিলেন, মৃদু স্বরে আমায় বললেন, ‘আল্লা কি এই কাজের জন্য আমায় বাঁচিয়ে রেখেছেন?’ গর্ভবতী মেয়েদেরও রেহাই মেলেনি। শাহ আলম ক্যাম্পে এসে সন্তান প্রসব করেছেন অনেকেই।
৪৬ ডিগ্রি গরমে শাহ আলম ক্যাম্পের খোলা মাঠে গাছের তলায় শিশুদের নিয়ে পড়াশোনা করাচ্ছেন বড়রা। এক তরুণী শিক্ষিকা বলেছিলেন, ‘অনেকেই মা-বাবাকে হারিয়েছে। একটু বইখাতা নিয়ে বসলে মনটা তবু অন্য দিকে যাবে।’ জুহুপুরা ক্যাম্পে এক মা বালক সন্তানের প্রশ্নে বিব্রত হয়ে জানতে চেয়েছিলেন, ‘কী উত্তর দেব আপনারাই বলে দিন।’ সে বলেছিল, ‘আমরা কী করেছি মা? আমাদের পাকিস্তানে চলে যেতে বলছে কেন? পাকিস্তানে তো কেউ থাকে না আমাদের! কার কাছে থাকব, খাব আমরা?’
প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা, তখনকার শিক্ষামন্ত্রী আনন্দীবেন পটেল সহ, আমাদের কাছে গোটা ব্যাপারটাকে ‘দাঙ্গা’ প্রতিপন্ন করতে চাইছিলেন। দাঙ্গায় পাল্টা মারের ধারণা থাকে। বার বার বলেছেন ওঁরা, ‘হিন্দুরাও ক্যাম্পে আছে।’ হিন্দুদের জন্য একটি ক্যাম্প ছিল শাহপুরায়। গিয়েছিলাম সেখানে। ১২০টি পরিবার ছিলেন। তাঁরাই আমাদের বলেছিলেন, তাঁদের কোনও জিনিসপত্র খোয়া যায়নি, আগুনও লাগানো হয়নি তাঁদের বসতি বা ঝোপড়িতে। তিন-চারটি এলাকা থেকে লোক এসেছিলেন শাহপুরা ক্যাম্পে, কারণ তাঁদের অঞ্চলের বিধায়ক বা কাউন্সিলর এসে ক্যাম্পে গিয়ে থাকতে বলেছিলেন তাঁদের। প্রতিবেশী বা সহপাঠী বা কাজের লোক, কোনও হিসেবেই মুসলমানদের আচরণ নিয়ে তাঁদের কারও কোনও অভিযোগ ছিল না। বরং ক্যাম্পে থাকতে হচ্ছে বলে একটু বিরক্তই দেখেছিলাম তাঁদের।
তখন গুজরাতে শিক্ষা অভিযানের কাজ শুরু হয়েছে। ওই টালমাটাল অবস্থাতেও শিক্ষা দফতরের তৎপরতা বিস্মিত করেছিল। যেখানে যেখানে ক্যাম্প হয়েছে, সেখানেই অস্থায়ী শিবির করে শিশুদের পড়ানোর কাজ চলছিল, কারণ অনেকেই স্কুল বা নিজের গ্রাম থেকে অনেক দূরে। আবার বিপরীত কাহিনিও শুনেছি। মহারাষ্ট্র ও গুজরাতে পুরসভার স্কুলগুলি খুব ভাল কাজ করে। গোধরা ক্যাম্পে প্রাথমিক শিক্ষক সিরাজ বলেছিলেন যেখানেই মুসলমান জনসংখ্যা বেশি সেখানে ধীরে ধীরে সরকারের সাহায্যের হাত সরিয়ে নেওয়ার কাহিনি। কোনও শিক্ষক অবসর নিলে নতুন কাউকে নিয়োগ না করা বা দিনের পর দিন প্রধান শিক্ষক না থাকা— এই ভাবে হাতে না মেরে ভাতে মারার ব্যবস্থা। ঘরের কাছের স্কুল তুলে দিলে বা অচল করে দিলে গরিব শিশুদের পড়াশোনা মার খাবে, সেটা বলে দেওয়ার অপেক্ষা রাখে না।
দরিয়াখান ক্যাম্পে এক হতদরিদ্র ঝোপড়িবাসী মাঝবয়সি মহিলার কথা খুব মনে পড়ে। অশ্রুপ্লাবিত মুখখানি তুলে ধরে তিনি বার বার বলছিলেন, মেয়ের বিয়ের জন্য গম আর টাকার জোগাড় করেছিলেন। টাকা লুঠ করে নিয়ে গেছে। গম পুড়িয়ে দিয়েছে। সারা জীবনের সঞ্চয় কত মানুষ যে হারিয়েছেন, তার ইয়ত্তা নেই।
মনে পড়ে যায় সাদ্দাম, জুনেদ, মুস্তাফাদের। মুস্তাফা, হালোল ক্যাম্পের সেই বালক। চোখের সামনে মা, দাদা, বউদিকে খুন হতে দেখেও যে বুদ্ধি হারায়নি। নিজের পাঁচ বছরের শিশু ভাই আর খুড়তুতো বোনকে নিয়ে ক্যাম্পে এসে উঠেছিল। নিরাবেগ কণ্ঠে, নিষ্পলক নয়নে আমাদের সেই কাহিনি বলেছিল সে। সেই নিরুত্তাপ ঔদাসীন্যে আমরাই কেঁপে উঠেছিলাম। ‘বাহাদুর ছেলে’ বলে একটু আদর করলাম, সে একই ঠান্ডা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকল। পরিবারের প্রায় সকলকে হারিয়ে শিবিরে এসেছিল সাদ্দাম। দেখলাম, সে সর্বক্ষণ হাসছে, দৌড়চ্ছে। তার সব সময় কিছু না কিছু খাবার চাই। শুধু রাত্রে ঘুমের মধ্যে থেকে থেকে চমকে ওঠে সে। আর তীব্র স্বরে কেঁদে ওঠে মাঝে মাঝে।
ওড় গ্রামের তরুণী মেয়েটি, তার নামও রেহানা। বলেছিল, পাড়ার হিন্দুদের সঙ্গে কী সদ্ভাব ছিল তাদের। নিজের বাড়িতে মাছমাংস ঢোকে না বলে অনেকেই ওদের এবং অঞ্চলের অন্য মুসলমানদের বাড়িতে এসে বিরিয়ানি খেতে চাইত। কিংবা অন্য কোনও আমিষ খাবার। সেই লোকেরাই নিজের হাতে তাদের বাড়িতে আগুন লাগিয়েছে, পুড়িয়ে দিয়েছে ধানের গোলা।
চোদ্দো বছর কেটে গিয়েছে। সাদ্দাম, জুনেদরা এখন তরুণ। যে সব সদ্যোজাতকে শাহ আলম শিবিরে দেখেছিলাম, তারাও অনেকটা বড় হয়ে গিয়েছে। কী রকম জীবন হয়েছে তাদের, জানি না। মুস্তাফার সেই অপলক দৃষ্টিটা আমাকে তাড়া করে

http://www.anandabazar.com/editorial/tale-not-much-decades-ago-merely-14-years-1.405429#