‘কণ্ঠই তাঁর পরিচয় বহন করে’
বিভূতিসুন্দর ভট্টাচার্য
২১ জানুয়ারি, ২০১৬, ০০:০৩:০০
তখন বৃষ্টি নামল। তার মাঝেই দূত মারফত একটা চিরকুট এসে পৌঁছলো সেই শ্যামলা, লাজুক, শান্ত মেয়েটির কাছে। তাতে লেখা ‘শিগগির চলে এসো। নতুন গান শিখবে। দেখো যেন বৃষ্টিতে ভিজে আবার অসুখ বাঁধিয়ে বোসো না।’ সেই চিরকুটে এমনটাই লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ আর পাঠিয়েছিলেন কনক দাসকে। শিখিয়েছিলেন ‘ধরণীর গগনের মিলনের ছন্দে’ গানটি।
তিনি রবীন্দ্রসঙ্গীতের এক কিংবদন্তি। সে কালের শিক্ষিত, সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়েদের কাছে গান গাওয়াটা ছিল প্রায় নিষিদ্ধ ব্যাপার। ঠিক তেমনই এক সময়ে সঙ্গীত জগতে কনক দাসের আবির্ভাব। রেকর্ড করেছিলেন অসংখ্য গান এবং কালক্রমে হয়ে উঠেছিলেন রবীন্দ্রসঙ্গীতের অন্যতম জনপ্রিয় শিল্পী।
তিনি গাইতেন মনের আনন্দে। নিজের গান গাওয়ার সম্পর্কে বলতেন, ‘‘গান আমারে শিখতে হয় নাই। পরিবারের মধ্যেই গান ছিল... ছোটবেলা থেকেই গান এসে গেছে আমাদের। চেষ্টা করতে হয় নাই।’’ এই গান গেয়েই মিলেছিল রবীন্দ্রনাথের বিরল প্রশংসা। সেই প্রশংসাই হয়ে উঠেছিল তাঁর জীবনের যাত্রাপথের আনন্দগান।
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর প্রথম সাক্ষাতের সময় কিন্তু কনক গান করেননি। সেই নিয়েও রয়েছে একটি ঘটনা। কনক দাস সম্পর্কে সাহানা দেবীর পিসতুতো বোন হতেন। এক দিন সাহানা দেবী তাঁকে রবীন্দ্রনাথের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেখানে গিয়ে লাজুক কনক কেমন যেন আড়ষ্ট হয়ে গেল। সাহানা দেবী রবীন্দ্রনাথকে বললেন, যে তার বোন ভাল গান করতে পারে। এই শুনে রবীন্দ্রনাথ সেই শ্যামলা কিশোরীটিকে সস্নেহে বললেন, একটি গান শোনাতে। কিন্তু মেয়েটি বলে বসল যে সে গান গাইতে পারে না। সে বার না হলেও জীবনে বহুবার তিনি রবীন্দ্রনাথকে গান শুনিয়েছিলেন।
ঢাকার মেয়ে কনক দাসের জন্ম কিন্তু কলকাতায় ১৯০২-এর ৩ নভেম্বর একটি ব্রাহ্ম পরিবারে। ঢাকার ইডেন হাই স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন শেষ করে তিনি কলকাতায় এসে ভর্তি হয়ে ছিলেন বেথুন কলেজে। তাঁর মাতামহ ছিলেন কালীনারায়ণ গুপ্ত। ব্রাহ্মসমাজে তিনি পরিচিত ছিলেন ভক্ত কালীনারায়ণ নামে। তিনি বহু ব্রহ্মসঙ্গীতের গীতিকার ও সুরকার ছিলেন। কনক দাস গান শিখেছিলেন গিরিজাশঙ্কর চক্রবর্তী, দীনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, সত্যকিঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, যামিনী গঙ্গোপাধ্যায় দিলীপকুমার মুখোপাধ্যায়, হিমাংশু দত্ত প্রমুখের কাছে। রবীন্দ্রসঙ্গীত ছাড়াও রেকর্ড করেছিলেন অতুলপ্রসাদ সেন ও সুরসাগর হিমাংশু দত্তের গানও। এক সময় বেশ কিছু দিন শান্তিনিকেতনে কাটিয়েছিলেন। সেই সময় রোজ দিনু ঠাকুরের কাছে গান শিখতে যেতেন।
তাঁর প্রথম রেকর্ড প্রকাশিত হয়েছিল ১৯২৭ সালে। তবে গান রেকর্ড করলেও সচরাচর কোনও অনুষ্ঠান তো দূরের কথা, শোনা যায় পরিচিত, বন্ধু এমন কী আত্মীয় স্বজনের সামনেও গান করতে চাইতেন না স্বভাবে লাজুক কনক দাস। পরে অবশ্য ব্রাহ্মসমাজের অনুষ্ঠানে তিনি গান করতেন।
কনক দাস একাধিক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, এত সব গান রেকর্ড করার নেপথ্যে ছিল প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশের ভাই, প্রফুল্ল মহলানবীশের (বুলাদা) উৎসাহ। তিনিই গ্রামোফোন কোম্পানির প্রতিনিধি ভগবতীচরণ ভট্টাচার্যের কাছে গান রেকর্ড করার জন্য কনক দাসকে নিয়ে যান। সে কালে গান রেকর্ড করা হত গ্রামোফোন কোম্পানির বেলেঘাটার স্টুডিওতে। বিশেষ উল্লেখযোগ্য ব্যাপার, সে কালে বেশির ভাগ মহিলাশিল্পী বসে গান করতেন। তবে কনক দাসকে দাঁড়িয়ে গান করতে দেখে অবাক হয়ে ছিলেন সে কালের সাহেব রেকর্ডিস্ট। সে কালে তাঁর গানের সঙ্গে যন্ত্রানুসঙ্গের আতিশয্য ছিল না। বেশ কিছু গানের সঙ্গে অর্গান বাজিয়ে ছিলেন ইন্দিরা দেবীচৌধুরানী, পিয়ানো বাজাতেন সুজাতা দেবী। এ ছাড়াও যন্ত্রসঙ্গীতের শিল্পীদের মধ্যে ছিলেন সুজিত নাথ, দক্ষিণামোহন ঠাকুর, পরিতোষ শীল, অসিতবরণের মতো কিছু শিল্পী।
এক সময় মাঝে মধ্যেই জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি থেকে গান গাইতে যাওয়ার ডাক পড়ত। সেখানেই তো প্রথম ‘বর্ষামঙ্গল’ অনুষ্ঠানে তিনি গেয়েছিলেন ‘অশ্রুভরা বেদনা’ গানটি। এক বার বেলজিয়ামের মহারানি এসেছিলেন। সেই উপলক্ষে ঠাকুরবাড়ির মেয়েরা অভিনয় করেছিলেন ‘নটীর পূজা’। সেখানেই সত্যজিৎ রায়ের স্ত্রী বিজয়া রায়ের সঙ্গে দ্বৈতকণ্ঠে গেয়েছিলেন, ‘বন্ধু রহো রহো সাথে’ গানটি। সে সময় ঠাকুরবাড়িতে যে কোনও উৎসব অনুষ্ঠানের আগে দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের তত্ত্বাবধানে চলত রিহার্সাল। এক বার কোনও এক অনুষ্ঠানের আগে তিনি কনক দাসকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন গান শেখানোর জন্য। তবে বিশেষ অসুবিধে থাকায় কনক সেখানে যেতে পারেননি। অগত্যা টেলিফোনেই সে যাত্রা গান শিখেছিলেন কনক। আজকের দিনে সামান্য ঘটনা হলেও ব্যাপারটা সে কালে মোটেই সামান্য ছিল না। শোনা যায় রবীন্দ্রনাথ তাঁর গাওয়া বেশ কিছু গানের প্রশংসা করেছিলেন। তেমনই ‘জীবনে পরম লগনে’ গানটি রেকর্ড করার পরে টেস্ট রেকর্ড শুনে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘‘পাসড উইথ অনার্স।’’
এক বার শান্তিনিকেতনে পুরনো লাইব্রেরির দোতলায় বর্ষার গানের আসর বসেছিল। আশ্রমিকদের গানের পরে সভায় উপস্থিত রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘‘এতক্ষণ আমরা গান করলেম। এবার যিনি গান শোনাবেন তাঁর নামের ঘোষণার প্রয়োজন নেই, তাঁর কণ্ঠ তাঁর পরিচয় বহন করে।’’
১৯৪৩-এর ডিসেম্বর মাসে তাঁর সঙ্গে অজয়কুমার বিশ্বাসের বিয়ে হয়। ১৯৬২ সালে স্বামীর মৃত্যুতে দাম্পত্য জীবনে যবনিকার পতন ঘটেছিল। দেবব্রত বিশ্বাস সম্পর্কে তাঁর দেওর হতেন। তাঁর সঙ্গে চারটি ডুয়েট গানও রেকর্ড করেছিলেন। গানগুলি সে যুগে দারুণ জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। নবীন গায়ক গায়িকাদের সব সময় তিনি উৎসাহ দিতেন। ‘গীতবিতান’ সঙ্গীত প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তিনি আমৃত্যু যুক্ত ছিলেন। রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রথম যুগের শিল্পীদের মধ্যে তিনি আজও অবিস্মরণীয়।
http://www.anandabazar.com/supplementary/kolikata/atitertara/special-write-up-on-singar-kanak-das-by-bibhuti-sundar-bhattacharya-dgtl-1.290662
No comments:
Post a Comment