ব্রিটিশরা না এলে এই কুম্ভমেলা হত না
গৌতম চক্রবর্তী
৭ জুন, ২০১৬, ০০:০৪:০০
যা হইয়াছেন। ‘আন্তর্জাতিক বিচার মহাকুম্ভ’তে প্রধানমন্ত্রী। উজ্জয়িনী, ১৪ মে। ছবি: পিটিআই
আট বছর ধরে হরিদ্বার, প্রয়াগ ও উজ্জয়িনী কুম্ভমেলা দেখে দেখে মনে হল, ব্রিটিশ শাসনকে ধন্যবাদ। ওঁরা না এলে আধুনিক কুম্ভমেলা তৈরি হত না। ইলাহাবাদ, উজ্জয়িনী বা হরিদ্বারে রেল যোগাযোগ থেকে নাগা সাধুদের স্নান-মিছিলের নির্ঘন্ট, সবই ব্রিটিশ জমানার দান। ভিত্তিটা মুঘলদের তৈরি, তার উপরে পড়ল ব্রিটিশ প্রশাসনিকতার পলেস্তারা। স্বাধীন ভারতে কুম্ভে স্পেশাল ট্রেন, বাস, তাঁবুশহরের বন্দোবস্ত করে নেহরু থেকে মোদী, সবাই সেই ধাঁচাটিকেই অনুসরণ করেন।
এ বারের উজ্জয়িনী কুম্ভে আমাদের প্রধানমন্ত্রী, শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট, যোগগুরু রামদেব, সকলে মিলে ‘বিচার মহাকুম্ভ’ নামে একটি বক্তৃতার আসর বসালেন। প্রধানমন্ত্রী বললেন, ঐতিহ্যকে বজায় রেখেই আমাদের আধুনিক বিশ্ববাজারের বিপণন-উপযোগী হয়ে উঠতে হবে। ভাল কথা।
ভাল কাজটি অবশ্য করল শহরের কিছু মসজিদ। শুরুর দিকে এক শাহি স্নানে ঝড়ে অনেক তাঁবু ভেঙে পড়ে। বিদ্যুৎ চলে গিয়ে সব অন্ধকার। মসজিদের ছেলেরাই তীর্থযাত্রীদের খাবার, গরম দুধের ব্যবস্থা করে। রাজনীতিকদের বিচারকুম্ভ নয়, এটিই প্রকৃত কুম্ভ-ঐতিহ্য।
১৯১০ সালে প্রয়াগের পূর্ণকুম্ভ। ঠিক হল, গওহরজান গান গাইবেন। হিন্দুরা ক্ষুব্ধ, ‘রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষণায় কুম্ভমেলায় বাইজির গান’ বলে প্রতিবাদপত্রও ছাপা হল। কিন্তু ব্রিটিশরা অনড়। তীর্থযাত্রীরা ঝেঁটিয়ে গওহরের গান শুনতে গেল। এ বার উজ্জয়িনীতে হেমা মালিনী নেচে গিয়েছেন, মনীষা কৈরালা শিপ্রা নদীতে স্নান করেছেন। এই সেলেবরা গওহরেরই উত্তরসূরি।
কোম্পানি আমল থেকেই ব্রিটিশরা কুম্ভমেলার এই পরিসরটি চিনত। ১৭৯০। মুঘল আমলের শেষ বেলা। উজ্জয়িনী তখন মরাঠা সিন্ধিয়াদের শাসনে। অওধের নবাব আসফ উদ্ দৌলাকে এক চিঠিতে সিন্ধিয়া জানাচ্ছেন, নবাবের কর্মচারী মীর মহম্মদ আমজাদ দাক্ষিণাত্য থেকে যাওয়া তীর্থযাত্রীদের খুব সাহায্য করেন। তাঁকে কি নবাব যাত্রীদের সুবিধার্থে এক মাস আগে প্রয়াগে পাঠিয়ে দিতে পারবেন?
এই পরিসরটিকে আজকের ভাষায় ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ ভাবলে কিন্তু ভুল হবে। ধর্মনিরপেক্ষতা, সাম্প্রদায়িকতা— এ-সব শব্দ বিশ শতকে তৈরি। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার ঐতিহ্য অন্য। ধর্ম, মেলা, তীর্থযাত্রা সবই থাকবে। তার সঙ্গে প্রাক্-আধুনিক কূটনীতিও! অযোধ্যার নবাব হিন্দু তীর্থযাত্রীদের সাদরে বরণ করে নেবেন। আজও প্রয়াগকুম্ভে স্নান সেরে বহু মানুষ প্রয়াগের দুর্গে যান। দুর্গের দরজা তখন খুলে দেওয়া হয়, একে-৫৬ হাতে সেনাদের পাশ দিয়ে তীর্থযাত্রীরা অক্ষয়বটে পুজো দিতে যান। ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দে মুঘল সম্রাট শাহ আলমের এক সনদে স্থানীয় এক পাণ্ডা এই দেবস্থানে পুজোর অধিকার পেয়েছিলেন। সনদ আজও চলছে।
অক্ষয়বট ঘিরে প্রয়াগের এই দুর্গটি ১৫৮৩ সালে আকবরের তৈরি। গঙ্গা, যমুনা সরস্বতীর ত্রিবেণীসঙ্গমে হাজার হাজার মানুষ তীর্থে আসেন, সেখানেই দুর্গ গড়ার ইচ্ছা ছিল তাঁর। মুঘল আমলে এ নিয়ে মিথ তৈরি হল: গত জন্মে আকবর ছিলেন মুকুন্দ ব্রহ্মচারী নামে এক সাত্ত্বিক সাধু। প্রয়াগসঙ্গমে সাধনভজন করতেন। এক দিন দুধ পান করতে গিয়ে কী যেন মুখের ভিতরে চলে গেল। গাল, দাঁত ও জিভ সুড়সুড় করছে। আতঙ্কিত মুকুন্দ দেখলেন, গরুর লোম ভাসছিল তাঁর দুধে। গো ভক্ষণের পাপ! প্রয়াগসঙ্গমে আত্মহত্যা করলেন মুকুন্দ। সেই পাপে পরজন্মে ম্লেচ্ছ হয়ে জন্মাতে হল। ম্লেচ্ছ, কিন্তু উচ্চকোটির পুণ্যফলে শাহেনশাহ আকবর। এমন মিথ জানব না? কুম্ভমেলায় বসে পরিবেশ-সচেতনতা, বিশ্ববাজার ইত্যাদি ভাল ভাল কথার খই ছড়ালেই হবে? কিন্তু আমাদের কাছে কুম্ভ মানে তো দেবাসুরের সংগ্রামশেষে অমৃত উপচে পড়ার উপকথা, কিংবা বল্লম তরবারি হাতে নাগা সাধুদের শাহি স্নানের ছবি!
উপকথায় আপত্তি নেই। কিন্তু তা নিয়ে ভাবতে হবে না? একে তো অমৃতকলস নামিয়ে ইন্দ্রের পুত্র জয়ন্ত না বিষ্ণুবাহন গরুড় কে বিশ্রাম করেছিলেন, তার হদিশ এক এক ভাষ্যে এক এক রকম। আবার, সংস্কৃত শ্লোকে মোক্ষদা সাত তীর্থ: ‘অযোধ্যা মথুরা মায়া কাশী কাঞ্চী অবন্তিকা/তীর্থ দ্বারাবতী চৈব সপ্তৈতে মোক্ষদায়িকা।’ মায়া বা হরিদ্বার, অবন্তিকা বা উজ্জয়িনী, দ্বারাবতী বা প্রয়াগের ধূসর অস্তিত্ব টের পাওয়া গেলেও নাসিক কোথায়? অযোধ্যা, মথুরা, কাশী, কাঞ্চীর মতো মোক্ষদায়িনী শহরেই বা বারো বছর অন্তর অমৃতকুম্ভ উপচে পড়ে না কেন?
এই সব শ্লোকের সঙ্গে আসলে কুম্ভমেলার কোনও সম্পর্ক নেই। কুম্ভমেলা আসলে তৈরি হয়েছে অনেক পরে। মুঘলদের অন্তিম কাল, মরাঠা ও ইংরেজ কোম্পানি ক্ষমতা বিস্তারের জন্য লড়ছে। নাসিক, উজ্জয়িনী তো বটেই, সাহারানপুর রাজ্যের হরিদ্বারও মরাঠা অধিকারে। রাজা-বাদশাহদের সৌজন্যে সন্ন্যাসী আখড়াগুলির ভূসম্পত্তি প্রচুর। সন্ন্যাসীরা ঘুরে ঘুরে বেড়ান, ব্যবসা করেন, চাষিদের সুদে টাকা ধার দেন। কেউ আবার কখনও আজ মরাঠা, কাল ব্রিটিশদের ভাড়াটে সৈন্য হন। এই অস্ত্রধারী সৈন্যরা নিজেদের শঙ্করাচার্য-প্রবর্তিত দশনামী সম্প্রদায়ের লোক বলে পরিচয় দেন। শঙ্করাচার্য জীবদ্দশায় নাগা সন্ন্যাসী, দশনামী সম্প্রদায় কিছুই সৃষ্টি করেননি। কিন্তু তুঙ্গভদ্রার তীরে হিন্দু বিজয়নগর সাম্রাজ্যের রাজগুরু বিদ্যারণ্য শৃঙ্গেরী মঠের শিষ্য, তাঁর আমল থেকেই ওই মঠের প্রতিপত্তি বাড়তে থাকে। শঙ্করাচার্যের নামের সঙ্গে নিজেদের গুঁজে দেওয়া, ব্যবসা করা, সবই সশস্ত্র সন্ন্যাসীদের ক্ষমতার লড়াই।
১৫৬৭ সালে পঞ্জাবে এক অভিযান শেষে আগ্রায় ফেরার পথে থানেশ্বরে এ রকমই এক লড়াই দেখেছিলেন মুঘল সম্রাট আকবর। আবুল ফজলের আকবরনামায় তার বিবরণ আছে। এক দিঘির দখল নিয়ে নাথ যোগীদের সঙ্গে নতুন-আসা পুরী সন্ন্যাসীদের বিবাদ। আকবরের বোঝানোতেও কাজ হল না। শেষে তরবারি, তিরধনুক, বল্লম নিয়ে দুই দল সন্ন্যাসীর লড়াই। নাথ যোগীরা হেরে গেলেন। শৈব পুরী সন্ন্যসীরা জিতলেন। হিন্দু-মুসলমান নয়। আকবরের সামনে জলাশয়ের অধিকার নিয়ে দুই দল সশস্ত্র হিন্দু সন্ন্যাসীর লড়াই!
১৯২০ নাগাদ ব্রিটিশ ওরিয়েন্টালিস্টরা জুনা আখড়া থেকে অন্য এক উপকথা উদ্ধার করলেন। কাশীর বাঙালি পণ্ডিত মধুসূদন বাচস্পতি আকবরের কাছে নালিশ করলেন, মুসলমান ফকিরেরা হিন্দু সন্ন্যাসীদের ওপর রাস্তাঘাটে অত্যাচার করে। আকবর হিন্দু সন্ন্যাসীদের অস্ত্র ব্যবহারের অনুমতি দিলেন।
উনিশ শতকের শুরুতেও হরিদ্বার বা উজ্জয়িনী কুম্ভে নানান রক্তগঙ্গার মূলে ছিল শৈব বনাম বৈষ্ণব সন্ন্যাসীদের লড়াই। সন্ন্যাসীরাই তখন মেলায় পসরা নিয়ে আসেন, কর আদায় করেন। মধ্য ভারতে মরাঠা, কোম্পানি ও সন্ন্যাসীদের লড়াইয়ের সেই ধূসর সময়ে ক্ষমতার পাল্লাও অস্থির। ব্রিটিশ শাসন এই সন্ন্যাসীদের নিস্তেজ করে দিল। তাঁরা আর কর আদায় করতে পারেন না, সামরিক শক্তিও ভেঙে চুরমার। ঠিক হল, শুধু কুম্ভ স্নানেই সন্ন্যাসীরা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে মিছিল করতে পারবেন।
কে আগে স্নান করবে? মহানির্বাণী ও নিরঞ্জনী আখড়া আগে স্নান করত, পরে জুনা আখড়া। নিরঞ্জনী ও জুনা আখড়ার মধ্যে তিরিশ কদম ব্যবধান থাকার কথা। কিন্তু সন্ন্যাসীসংখ্যা কমা-বাড়ার টানে সেই ব্যবধান নিয়েও টানাপড়েন চলত। আজও নিরঞ্জনী না জুনা, কে আগে স্নান করবে তা নিয়ে কুম্ভমেলায় মাঝে মাঝেই উদ্বেগ।
ভারতীয় রাজনীতির বড় ট্র্যাজেডি এই কুম্ভে। দেশের বামপন্থীরা একে ধর্মীয় পরিসর বলে অচ্ছুত করে রাখেন, আর হিন্দুত্ববাদীরা কাল্পনিক ধর্মীয় ঐতিহ্যে বিভোর থাকেন। কেউই বোঝেন না, মেলার এই পরিসরে বিশ্বাস-অবিশ্বাস, অর্থনীতি, সমরনীতি, গৃহী-সাধু সব একত্রে কয়েকশো বছর ধরে খেলা করেছে। কুম্ভে অমৃত আছে কি না, বড় কথা নয়। ইতিহাসের সামাজিক গতিময়তাটি সেখানে পরতে পরতে। সেই গতিময় ভাঁজগুলি ধরতে না পারলে বিশ্ববাজারও শূন্যকুম্ভ বাগাড়ম্বর।
http://www.anandabazar.com/editorial/kumbh-mela-would-not-have-hapen-if-britishers-didnt-arrived-1.404654#
No comments:
Post a Comment