Friday, 10 June 2016

নাগা সাধু, আখড়া এবং...

$image.name

নাগা সাধু, আখড়া এবং...

২৮ মে, ২০১৬, ০০:০৫:০০
kubha
প্রতি কুম্ভে এ রকম লাখো লাখো নাগা সাধু কোথা থেকে আসেন? অনেকের বিশ্বাস, এঁরা হিমালয়ের গহনে থাকেন। কুম্ভে দর্শন দেন। কিন্তু এই ধারণার বাস্তব ভিত্তি নেই। এত হাজার হাজার নাগা সাধু হিমালয়ে থাকলে সেখানেও ভিড়ের মৌরসিপাট্টা।
কথা বলে জানা গেল, অন্য সময়ে এঁরা গেরুয়া পরেই থাকেন। গ্রামের মন্দিরে, বটগাছের নীচে যে সব সাধু স্বাভাবিক ভাবে সারা বছর থাকেন, শাহি স্নানের জুলুসে এসে তাঁরাই কেউ কেউ নাগা।
কুম্ভ তো শুধু স্নান নয়, সাধুদের উৎসব। প্রতি চার বছর অন্তর কুম্ভে আখড়ার পদাধিকারীদের নির্বাচন হয়। কে হবেন শ্রীমোহান্ত বা প্রধান, কে হবেন আখড়ার ট্রেজারার বা ‘কারোবারি’ সবেরই নির্বাচন এই কুম্ভে। মোহান্ত, কারোবারি ছাড়াও নির্বাচিত হন ‘কোতোয়াল’ ও ‘পুজারি’।
পুজারির কাজ পুজো করা। কোতোয়াল আখড়ায় শান্তিরক্ষা করেন, সাধুদের বিবাদ-বিসংবাদ মেটান। আমাদের, সাধারণ মানুষের মতোই সামাজিক ব্যবস্থাপনা। আখড়ার প্রধান সন্ন্যাসীরা মনে মনে বিমুক্ত হলেও নাগাবেশ ধারণ করে থাকেন না।
নাগা সন্ন্যাসীদের এক-একটি আখড়ায় এক-এক জন ইষ্টদেবতা। নিরঞ্জনী আখড়ার ইষ্টদেব হলেন কার্তিকেয়। বাঙালির শৌখিন, ফ্যাশনদুরস্ত কার্তিক ঠাকুর নন, দেব সেনাপতি কার্তিকেয়। জুনা আখড়ার ইষ্টদেব মহাযোগী দত্তাত্রেয়। ইনি রুদ্রের আর এক রূপ। আনন্দ আখড়ার ইষ্টদেব সূর্য, অটল আখড়ার গণপতি।
এই আখড়াগুলির সম্পত্তি প্রচুর। বারাণসীতে জুনা আখড়ার আলাদা মঠ ও ঘাট, প্রয়াগে রয়েছে নিরঞ্জনী আখড়ার সদর দফতর। বড় বড় সন্ন্যাসী ও সন্ন্যাসিনীরা আলাদা আশ্রমে থাকেন, কিন্তু শাহি স্নানে সকলেই থাকবেন নিজস্ব আখড়ার সঙ্গে। যেমন, পাইলটবাবা। একদা পাইলট ছিলেন, এখন ডাকসাইটে সাধু। অজস্র দেশি, বিদেশি ভক্তমণ্ডলী। কিন্তু তিনি সবসময় শাহি স্নানে থাকবেন জুনা আখড়ার সঙ্গে। সেখানকারই সদস্য তিনি। শ্রীঅমরনাথ শ্রাইন বোর্ডের মোহান্ত দীপেন্দ্র গিরি আবার নিরঞ্জনী আখড়ার। বাঙালি কনখলে আনন্দময়ী মা-র আশ্রম চেনে। সন্ন্যাস-কুলুজিতে তিনি মহানির্বাণী আখড়ার মহামণ্ডলেশ্বর ছিলেন।
আর রথে, ঘোড়ায় চেপে তলোয়ার, বল্লমকে স্নান করাতে আনা হয় কেন? ঐতিহাসিকদের মত, মুঘল আমলের শেষ দিক থেকে এই আখড়াগুলির রমরমা। এঁদের গজির মোহান্তদের ভূসম্পত্তি ছিল, উপরন্তু টাকা ধার দিতেন। রাজা-রাজড়াদের যুদ্ধে ভাড়াটে সৈন্য হিসাবেও সার্ভিস দিতেন। নিরঞ্জনী আখড়া যেমন বলে, তাদের প্রতিষ্ঠা ৯০৪ খ্রিস্টাব্দে। অগ্নি আখড়া বলে, ৪৫৭ খ্রিস্টাব্দে তাদের শুরু। ইতিহাসবিদ যদুনাথ সরকার এই দুই মতের কোনওটাই স্বীকার করেননি। তাঁর মতে, নিরঞ্জনী আখড়ার শুরু ১৯০৪ সালে। অগ্নি আখড়া ৪৫৭ নয়, ১৪৫৭ সালে আরম্ভ। নাগা সন্ন্যাসীরা মানুন বা না-মানুন, আধুনিক ইতিহাস কিন্তু যদুনাথের সমর্থনেই।

http://www.anandabazar.com/supplementary/patrika/naga-sadhu-akhra-and-their-stories-1.397119

উজ্জয়িনী উজ্জয়িনী

$image.name

উজ্জয়িনী উজ্জয়িনী

২৮ মে, ২০১৬, ০০:০৪:০০

patrika
মহাকুম্ভ নয়। ধ্রুপদী সংস্কৃত ও পালি সাহিত্যে উজ্জয়িনীর খ্যাতি একেবারেই অন্য কারণে। এখানকার প্রাসাদগুলি সুন্দর, মেয়েরা আরও বেশি। প্রেমের শহর, নষ্টামির শহর….
প্রথমে মহাকবি কালিদাস। ‘মেঘদূত’-এ যক্ষ কেন মেঘকে উজ্জয়িনী ঘুরে যেতে বলছে?
বিজন রাজপথে আঁধার ঠেলে মেয়েরা চলেছে প্রণয়ীর ভবনে। স্নিগ্ধ বিদ্যুতের আলোয় মেঘ যেন সেই সুন্দরীদের পথ দেখায়, অযথা বর্ষণ বা গর্জন না করে। তা হলে সেই সুন্দরীরা ভয়ার্ত হয়ে উঠবে।
যে সুন্দরী নগরনটীরা মেখলায় নিক্কন তুলছে, তারাও আকাশে প্রথম মেঘ দেখে ‘মধুকর-পঙ‌্ক্তি’ চাউনি হানবে। কারণটা শরীর সম্ভোগের, আঁচড়-কামড়ের উদ্দন্ড প্রেম। ‘নখক্ষতে পরশে আনে সুখ প্রথম বৃষ্টির বিন্দু।’
শূদ্রকের ‘মৃচ্ছকটিকম্’ নাটকের পটভূমি এই উজ্জয়িনী শহর। সেখানে নগরনটী বসন্তসেনা দরিদ্র ব্রাহ্মণ চারুদত্তের প্রেমে মুগ্ধ। রাজার শ্যালককেও সে ফিরিয়ে দেয়।
চারুদত্তের স্ত্রী আছেন, আছে একটি বালক পুত্রও। সে মাটির খেলনা গাড়ি নেবে বলে কান্নাকাটি করে। কিন্তু চারুদত্ত ও তাঁর স্ত্রীর সেই পয়সা নেই। তখন সোনার গয়নায় ভর্তি করে একটা মাটির গাড়ি সেখানে পৌঁছে দেওয়ার বন্দোবস্ত করে বসন্তসেনা।
এ দিকে চারুদত্তের ভৃত্য আবার বসন্তসেনার সঙ্গিনী মদনিকার প্রেমে আতুর। সব মিলিয়ে জমজমাট এক নাটক।
কয়েকটি পুরাণ বলে, ঊর্বশী ও পুরুরবার প্রেম মহাকাল মন্দিরের পাশে মহাকালবনে।
স্বর্গের অপ্সরা ঊর্বশী পুরুবংশের রাজা পুরুরবার প্রেমে পড়েছিলেন। মানুষ ও অপ্সরার সেই বিয়েতে সন্তানাদিও হয়। তবু ঊর্বশী স্বর্গে ফিরে যান। তাঁকে যে ইন্দ্রের রাজসভায় ফিরতে হবেই।
এই প্রেম নিয়ে পরবর্তী কালে অনেক রোম্যান্টিক গল্পগাথা। গল্পটি প্রথম অবশ্য ঋগ্বেদে পাওয়া যায়। সেখানে মহাকালের উল্লেখ নেই, ঊর্বশীর স্বর্গে যাওয়ার কারণটিও অন্য।
দিনে তিন বার করে রাজার সম্ভোগেচ্ছায় বিরক্ত হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। সে ক্ষেত্রে প্রথম ‘ম্যারিটাল রেপ’-এর গল্প এই ঊর্বশী-পুরুরবা।
এটি বাস্তব দুনিয়ার গল্প। ঋগ্বেদ, কালিদাস কারও সঙ্গে সম্পর্ক নেই। মগধের সম্রাট বিন্দুসার তাঁর ছেলে অশোককে বিদিশার শাসনভার দিয়ে পাঠান। অশোক এসে প্রথমে উজ্জয়িনীতে দেব নামে এক ধনী বণিকের আতিথেয়তা নেন। তাঁর মেয়ে দেবীর সঙ্গে অশোকের এতটাই প্রেম হয় যে, তাকে বিয়ে করে বিদিশায় নিয়ে যান তিনি।
দু’জনের মহেন্দ্র নামে একটি পুত্র ও সংঘমিত্রা নামে একটি মেয়ে হয়। এর পর স্ত্রীকে বিদিশায় রেখে ছেলেমেয়েদের নিয়ে অশোক মগধে ফিরে যান।
পরে বৌদ্ধ হয়ে এই মহেন্দ্র আর সংঘমিত্রাকেই সিংহলে ধর্মপ্রচারে পাঠান তিনি।
সবচেয়ে চরম বেতাল পঞ্চবিংশতির শেষ গল্পটি। শ্মশানের তান্ত্রিক ছদ্মবেশী রাজা বিক্রমাদিত্যকে গাছে বাঁধা একটি শব আনতে পাঠিয়েছেন। বিক্রমাদিত্যের পিঠে চড়ে আসতে আসতে সেই শব তাঁকে নানা গল্প বলে। শর্ত একটাই। প্রতিটি গল্পের শেষে সে প্রশ্ন করবে, রাজা উত্তর দেবেন।
উত্তর জানা সত্ত্বেও নিরুত্তর থাকলে রাজার মাথা ফেটে চৌচির হয়ে যাবে।
শেষ গল্প এ রকম: এক রাজা যুদ্ধে নিহত, তাঁর স্ত্রী ও রাজকন্যা জঙ্গলে চলে গিয়েছেন। এ বার ভিনদেশি এক রাজা ও রাজপুত্র সেই জঙ্গলে এসে হাজির। এর পর রাজা বিয়ে করলেন রাজকন্যাকে, রাজপুত্র রানিকে।
বেতালের প্রশ্ন: মহারাজ, এই দু জনের সন্তান হলে তাদের কী সম্পর্ক দাঁড়াবে?
বিক্রমাদিত্য উত্তর না দিয়ে হেসেছিলেন। সংস্কৃত ঐতিহ্যের নীতিশিক্ষা এতটাই শক্তিশালী ছিল যে সব সম্পর্ককে সে নাম দেওয়ার চেষ্টা করেনি, একটি ধূসর জায়গা ছেড়ে রেখেছিল।

http://www.anandabazar.com/supplementary/patrika/stroy-of-ujjain-1.397121

সাংবাদিকের সামাজিক দায়িত্ব ও কাঙাল হরিনাথ

$image.name

সাংবাদিকের সামাজিক দায়িত্ব ও কাঙাল হরিনাথ

উনিশ শতকের সামাজিক আন্দোলনে কাঙাল হরিনাথের ভূমিকা আবার বিচার বা মূল্যায়ন করে দেখার সময় এসেছে। লিখছেন জয়ন্ত ঘোষাল

১৮ মে, ২০১৬, ০০:০৩:১৮
Kangal Harinath
সাংবাদিকতা নিয়ে গোটা দেশ জুড়েই নানা প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে। সাংবাদিকতার নৈতিকতা, সাংবাদিকের পেশাদারি কর্তব্য এবং জাতীয়তাবাদী দায়িত্ব নিয়ে বিতর্ক চলছে। পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের সময় সাংবাদিকের ভূমিকা কতটা নিরপেক্ষ, কতটা কায়েমি স্বার্থ পরিচালিত এ সব নিয়ে বিতর্ক আছে। আবার পেশাদারি সাংবাদিকতার চলও এখন গোটা দেশে বেড়েছে। সাংবাদিকরা রাজ্যে রাজ্যে বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছেন। এমনকী, রাষ্ট্র শুধু প্রবীণ নয়, বয়সে নবীন সাংবাদিকদেরও পদ্মশ্রী, পদ্মভূষণ খেতাব দিয়ে সম্মান জানাচ্ছে।
এই রকম একটা সময়ে আজ শাহি দরবারে আমি আপনাদের এমন এক সাংবাদিকের সঙ্গে পরিচয় করাতে চাই যিনি ভারতের গ্রামীণ সাংবাদিকতার জগতে সম্ভবত প্রথম সফল কাণ্ডারী। মানুষটি প্রয়াত হয়েছিলেন ১৮৯৬ সালের ১৬ এপ্রিল। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে ১৯ শতকী বাংলার পীত সাংবাদিকতার বিরুদ্ধে সত্য এবং তথ্য-ঋদ্ধ সাহসী গ্রামীণ সাংবাদিকতার আদি ও প্রবাদ পুরুষটিকে আমরা এই প্রজন্ম অনেকেই জানি না। মানুষটির নাম কাঙাল হরিনাথ। আসল নাম হরিনাথ মজুমদার। তাঁর ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’ ছিল সে সময় ভারতের তমসাচ্ছন্ন গ্রামজীবনের কণ্ঠস্বর। এহেন হরিনাথ তৎকালীন বাংলার জাগ্রত বিবেক বিস্মৃতির অন্ধকারে। হরিনাথ জন্মেছিলেন পাবনা জেলার কুমারখালি গ্রামে। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির জমিদারির অন্তভুর্ক্ত ছিল এই কুমারখালি। খুব গরিব মানুষ ছিলেন। লেখাপড়া শিখেছিলেন খুব কষ্ট করে। বাবার কাছ থেকে কোনও সম্পত্তি পাননি। স্থানীয় স্কুলের হেডমাস্টার মশাই কিছু দিন বিনা বেতনে পড়ার সুযোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি এতটাই দরিদ্র 
ছিলেন যে পরনের বস্ত্র পর্যন্ত থাকত না। কোনও এক ধনী ব্যক্তির বই এক রাতে নকল করে দিয়ে পারিশ্রমিক হিসেবে তিনি একটি বস্ত্র গ্রহণ করেছিলেন। কুমারখালিতে অনেক নীলকুঠি ছিল। কিছু দিন নীলকর সাহেবের কাছে কাজ করেছিলেন। কিন্তু নীল চাষিদের উপর অত্যাচার দেখে সেটাও ছেড়ে দেন। চাকরি ছাড়ার পর মনোযোগ দিয়ে গ্রামীণ সাংবাদিকতা শুরু করেন। মৃত্যুর শেষ দিন পর্যন্ত সেটাই করে গিয়েছেন। তবে স্ত্রী-শিক্ষার জন্য তিনি একটি পৃথক সংগঠন তৈরি করেছিলেন।
তাঁর সংবাদপত্রে তিনি এক দিকে যেমন মেয়েদের ইংরেজি শিক্ষার প্রসারের দাবি দিনের পর দিন তুলেছেন, অন্য দিকে জমিদার, নীলকর, মহাজন ও পুলিশের অত্যাচারের বাড়াবাড়ির কাহিনি সাহসের সঙ্গে তাঁর সংবাদপত্রে প্রচার করে গিয়েছেন। তাঁর বাড়ির চণ্ডীমণ্ডপ গৃহে একটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। স্বয়ং হরিনাথ আবার শিলাইদহের ঠাকুর-জমিদারদের অত্যাচার ও নিপীড়নের সাক্ষী ছিলেন। তাঁর সংবাদপত্রে তিনি দ্বিধাহীনতার সঙ্গে ঠাকুরবাড়ির প্রজাবিরোধী অত্যাচারী ভূমিকার তথ্যভিত্তিক রিপোর্ট প্রকাশ করে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিলেন। এমনকী, কাঙাল হরিনাথ লিখেছিলেন, ‘‘দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর মহর্ষি হওয়ার পূর্বে প্রজাদের দুঃখ নিবেদনের সংবাদ তাঁর কিছুটা কর্ণগোচর হলেও মহর্ষি হওয়ার পর প্রজার হাহাকার তাঁহার কর্ণে প্রবেশ করিতে অবসর পায়নি।’’
হরিনাথের অভিযোগ বাস্তব তথ্যের সঙ্গে মেলানো যেতে পারে। যাকে আমরা সাংবাদিকরা বলি ‘ক্রস-চেক’। লর্ড বেন্টিঙ্ক সতীদাহের বিরুদ্ধে মত দিয়ে সেটি নিষিদ্ধ করেছিলেন ১৮২৯ সালের ৪ ডিসেম্বর। রামমোহন ১৮৩০ সালের ১৬ জানুয়ারি অর্থাৎ ৪৩ দিন পর অভিনন্দন জানিয়েছিলেন বেন্টিঙ্ককে। ঠিক তার এক দিন পরে, ১৭ জানুয়ারি ধর্মসভা গঠিত হয় এর প্রতিবাদে। এর পর রামমোহন বিলেত চলে যান। ব্রাহ্মসমাজের দায়িত্ব দিয়ে যান ঠাকুরবাড়ির কাছে। ইংল্যান্ডেই রামমোহনের মৃত্যু হয়। মজার ব্যাপার, কাঙাল হরিনাথ ব্রাহ্ম ছিলেন না বটে, কোনওদিন লন্ডন যাওয়াও তাঁর হয়নি। কিন্তু তাঁর গ্রামীণ সংবাদপত্রে সতীদাহর বিরুদ্ধে তিনি সোচ্চার ছিলেন। হরিনাথ গান লিখতেন। তাঁর একটি জনপ্রিয় গান হল, ‘ওহে, দিন তো গেল, সন্ধ্যা হল, পার করো আমারে’।
২০১৬ সালে যখন আধুনিক সাংবাদিকতা বিজয়পতাকা ওড়াচ্ছে, প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক থেকে ডিজিটাল মিডিয়া, তখনও কিন্তু এ দেশের গ্রামে গ্রামে বহু নাম না জানা সাংবাদিক আজও সাধ্যমতো গ্রামীণ সাংবাদিকতা করে চলেছেন। আজ এত বছর পরে উনিশ শতকের সামাজিক আন্দোলনে কাঙাল হরিনাথের ভূমিকা আবার বিচার বা মূল্যায়ন করে দেখার সময় এসেছে। প্রফুল্ল কুমার সরকার বলেছিলেন, কাঙাল হরিনাথের নাম নব্য বাংলার ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবে। দেশ পত্রিকার প্রাক্তন সম্পাদক বঙ্কিমচন্দ্র সেন বলেছিলেন, কাঙালের গ্রামবার্ত্তা পত্রিকা থেকে আমি আমার সাংবাদিক জীবনযাপনের অনুপ্রেরণা পেয়ে থাকি।
দুর্ভাগ্য আমাদের, এর পরেও হরিনাথকে অন্ধকার থেকে আলোয় আনা তেমন কোনও চেষ্টা আজ দেখি না।

http://www.anandabazar.com/supplementary/sahisomachar/kangal-harinath-and-social-responsibilities-of-a-journalist-1.389308

Thursday, 9 June 2016

শুধু কালীসাধক নন, সমাজ সচেতক কবিও রামপ্রসাদ

শুধু কালীসাধক নন, সমাজ সচেতক কবিও রামপ্রসাদ

বিভূতিসুন্দর ভট্টাচার্য

২১ নভেম্বর, ২০১৫, ০০:০২:০০

তিনি সাধক-কবি বলেই পরিচিত। মাতৃসাধনার পাশাপাশি তিনি বাংলা গানের এক নতুন ধারার স্রষ্টা। আবার বাংলা সাহিত্যে তিনি একটা নাম। তাঁর গানের ভক্তিরসের অভূতপূর্ব আবেদনে শ্মশানবাসিনী কালী প্রবেশ করলেন বাঙালির ঘরে ঘরে। করালবদনী হয়ে উঠলেন আদরিনী শ্যামা। তিনি শুধুমাত্র কালীসাধক নন, এক যুগসন্ধিক্ষণের সমাজ সচেতক এক কবিও— রামপ্রসাদ সেন।
জাতিভেদ এবং ধর্মান্ধতাকে উপেক্ষা করে তাঁর কণ্ঠে ধবনিত হয়েছিল দেশমাতৃকার বন্দনা। সে কারণে তাঁর জীবন নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে অতিবাহিত হয়েছিল।
রামপ্রসাদ সেনের জন্ম ও মৃত্যু সাল নিয়ে মতান্তর রয়েছে। যদিও অনেকেই মনে করেন ১৭১৮-এর ১৯ ফেব্রুয়ারি তাঁর জন্ম হয়েছিল। ঠাকুরদা রামেশ্বর সেন ও বাবা রামরাম সেন দু’জনেই ছিলেন চিকিৎসক। তৎকালীন কুমারহট্টে (হালিশহরে) তাঁদের ভাল নামডাক ছিল। রামপ্রসাদের মায়ের নাম সিদ্ধেশ্বরী দেবী।
ছোটবেলায় প্রাথমিক শিক্ষা শেষ হলে তিনি বাংলা, ফার্সি ও সংস্কৃত ভাষায় জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। মাত্র ১৩ বছর বয়সে রামপ্রসাদের বিয়ে হয় সর্বাণীদেবীর সঙ্গে। তাঁদের চার সন্তান ছিল। মাতৃ সাধনায় বিভোর রামপ্রসাদের সাংসারিক জীবন ছিল টানাপড়েনে ভরা।
বাবা-মায়ের মৃত্যুর পরে রামপ্রসাদ সেন উপার্জনের আশায় কলকাতায় এসেছিলেন। তাঁর বৈমাত্রেয় ভাই নিধিরাম তাঁর চাকরির ব্যবস্থা করেছিলেন গরানহাটায় দুর্গাচরণ মিত্রের কাছারিতে। আনুমানিক ১৭৩৯-এ তিনি দুর্গাচরণের কাছারিতে কাজে নিযুক্ত হয়েছিলেন। তবে জাগতিক কাজকর্মে তাঁর মন ছিল না। কাজের সময় কেমন যেন আনমনা হয়ে থাকতেন। এ ভাবেই এক দিন হিসেবের খাতায় লিখলেন, ‘আমায় দে মা তবিলদারী আমি নিমকহারাম নই শঙ্করী।’ ক্রমেই সেরেস্তার হিসেবের খাতা হয়ে উঠল রামপ্রসাদের গানের খাতা। ব্যাপারটা যখন মিত্র মশায়ের কাছারিতে জানাজানি হল তখন সকলে ভেবেছিলেন এই বুঝি রামপ্রসাদের চাকরিটা গেল। হিসেবের খাতায় লেখা সেই সব গানের মাহাত্ম্য বুঝতে দেরি হয়নি বিচক্ষণ দুর্গাচরণের। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন রামপ্রসাদ কোনও এক মহাসাধক। রামপ্রসাদে কণ্ঠে কয়েকটি গান শুনে তাঁর অনুমান আরও দৃঢ় হয়েছিল। দুর্গাচরণই প্রথম তাঁকে ‘কবিরঞ্জন’ বলে সম্বোধন করেছিলেন। শুধু তাই নয়, তিনি রামপ্রসাদকে হালিশহরে ফিরে যেতে বলেন এবং মাসিক তিরিশ টাকা বৃত্তি সেখানে পাঠিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।
তবে ঠিক কার বাড়িতে কলকাতায় তিনি কাজ করতেন তা নিয়েও মতান্তর রয়েছে। কোনও কোনও গবেষক মনে করেন তৎকালীন সময় হালিশহর ছিল সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের জমিদারির অন্তর্গত। তাই কবিরঞ্জন উপাধি নাকি তাঁরাই দিয়েছিলেন।
এর পরে শোনা যায়, রামপ্রসাদ হালিশহরে ফিরে গিয়ে মাতৃসাধনায় মগ্ন হয়েছিলেন। দুর্গাচরণের পাঠানো বৃত্তিতে কয়েকটা বছর ভালো ভাবে কাটলেও এই বৃত্তি বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। কেননা ১৭৪১-এ দুর্গাচরণ নবাব আলিবর্দী খাঁ-র সভায় জহুরি রূপে যোগ দিয়েছিলেন। এবং তার পরের বছর বর্গী হামলার সময় তিনি মুর্শিদাবাদে থাকায় সেই বৃত্তি বন্ধ হয়। আবারও আর্থিক সঙ্কটে পড়তে হয়েছিল রামপ্রসাদকে।

হালিশহরে রামপ্রসাদ ঘাটের তোরণ
পরে নদিয়ার মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায় রামপ্রসাদকে সভা কবি হওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু, রামপ্রসাদ বিনীত ভাবে তা প্রত্যাখ্যান করেন। যদিও রাজার দেওয়া জমি তিনি গ্রহণ করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে ছিল আন্তরিক ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক। কৃষ্ণচন্দ্রের অনুরোধেই তিনি বিদ্যাসুন্দর কাব্য রচনা করেছিলেন।
রামপ্রসাদ যে সময়ের মানুষ সেই সময়টা নানা কারণেই ঘটনাবহুল। সমাজে এসেছিল নানা বিপর্যয় এবং পরিবর্তন। ১৭৩৯-এর মহাপ্লাবন, ১৭৪২ এবং ১৭৫২-এর বর্গী হানা, ১৭৫৭-এর পলাশির যুদ্ধ আর ১৭৬৯-এর মন্বন্তর। এ সবের ভয়াবহ প্রভাব পড়েছিল বাংলার কৃষি জীবন ও সাধারণ মানুষের উপর। এমনই এক সময় রামপ্রসাদের গান হয়ে উঠেছিল মানুষের বড় একটা আশ্রয়।
অষ্টাদশ শতকে বাংলার যে দু’জন কবি বিশেষ ভাবে পরিচিত তাঁরা রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র রায় এবং রামপ্রসাদ সেন।
অনেকেই মনে করেন যে রামপ্রসাদ সেন কখনওই যুগপুরুষ হয়ে ওঠেননি। তৎকালীন সমাজব্যবস্থার জন্য নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে তাঁর জীবন অতিবাহিত হয়েছিল। জীবনের নানা সময়ে কঠিন দারিদ্রতার সম্মুখীন হতে হয়েছিল তাঁকে।
তবু আজও রামপ্রসাদী গানের জনপ্রিয়তার কারণ তাঁর গান মাটির কাছাকাছি থাকা সাধারণ মানুষকে প্রভাবিত করেছে সে কাল থেকে এ কাল। আর তাই তাঁদের মুখে মুখে বেঁচে রয়েছে গানগুলি।
শুধু তাই নয় সমাজে প্রচলিত নানা কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন রামপ্রসাদ। রামমোহন রায় সতীদাহ প্রথা রোধ করার বহু আগেই রামপ্রসাদ সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে বলেছিলেন, ‘নহে শাস্ত্রসমত্বা সমত্বা সহমৃতা।’ রামপ্রসাদ সেন মাটির মূর্তি গড়ে কালী পুজো করলেও অনেকেই মনে করেন তিনি ছিলেন নিরাকারে বিশ্বাসী ও একেশ্বরবাদী। তার প্রমাণও মেলে তাঁর কাব্যে— ‘ভবানী শঙ্কর বিষ্ণু এক ব্রহ্ম তিনভেদ করে সেই মূঢ় জন প্রজ্ঞা হীন।’
খোদ কলকাতা শহরে তাঁকে নিয়ে প্রচলিত রয়েছে কিছু কিংবদন্তি। একটি কিংবদন্তি অনুসারে এক বার কলকাতা থেকে হাঁটা পথে হালিশহর ফেরার পথে রামপ্রসাদকে বন্দি করেছিল চিতে ডাকাতের উত্তরপুরুষ বিশু ডাকাত তার উপাস্য দেবী চিত্তেশ্বরীর সামনে বলি দেওয়ার জন্য। হাঁড়িকাঠের সামনে মৃত্যু আসন্ন জেনে রামপ্রসাদ দেবীস্তুতি শুরু করেছিলেন। তখনই বিশু নিজের ভুল বুঝতে পেরে রামপ্রসাদের কাছে ক্ষমা চেয়ে তাঁকে মুক্ত করেছিলেন।
তেমনই এই মন্দিরের পাশেই চিত্তেশ্বরী সর্বমঙ্গলার মন্দিরকে নিয়ে রয়েছে অন্য একটি কাহিনি। মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত দেবী নাকি আগে দক্ষিণমুখী ছিলেন। এক দিন সাধক কবি রামপ্রসাদ সেন নৌকায় গান গাইতে গাইতে যাচ্ছিলেন। তাঁর গান শোনার জন্য দেবী নাকি পশ্চিমমুখী হয়েছিলেন। তেমনই জয়নারায়ণ ঘোষাল প্রতিষ্ঠিত দুর্গা পতিতপাবনীকে দেখে রামপ্রসাদ গেয়ে উঠেছিলেন “পতিতপাবনী পরা, পরামৃত ফলদায়িনী স্বয়ম্ভূশিরসি সদা সুখদায়িনী।” তিনিই এই স্থানটির নামকরণ করেন ভূকৈলাস।
আর্থিক অনটনে ভরা জীবনে পরিবারের প্রতি তিনি ছিলেন কর্তব্যপরায়ণ। কখনও গৃহত্যাগী হয়ে সন্ন্যাসী হয়ে যাননি। শোনা যায়, ১৭৮৭-র বৈশাখী পূর্ণিমার দিনে তাঁর প্রতিষ্ঠিত মাটির কালীমূর্তি গঙ্গায় বিসর্জন দিয়ে তিনি নিজেও গঙ্গায় বিলীন হয়ে যান।
তাঁর মৃত্যুর পরে ক্রমেই সেই সিদ্ধপীঠ আগাছায় জঙ্গলে ভরে গিয়েছিল। তাঁর মৃত্যুর শতবর্ষে হালিশহরবাসীর চেষ্টায় রামপ্রসাদের ভিটে ও পঞ্চমুণ্ডির আসন সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়। পরে ১৯৫৭-এ সেই সিদ্ধপীঠে কালীমূর্তি প্রতিষ্ঠা করা হয়। 

http://www.anandabazar.com/supplementary/kolikata/atitertara/%E0%A6%B6-%E0%A6%A7-%E0%A6%95-%E0%A6%B2-%E0%A6%B8-%E0%A6%A7%E0%A6%95-%E0%A6%A8%E0%A6%A8-%E0%A6%B8%E0%A6%AE-%E0%A6%9C-%E0%A6%B8%E0%A6%9A-%E0%A6%A4%E0%A6%95-%E0%A6%95%E0%A6%AC-%E0%A6%93-%E0%A6%B0-%E0%A6%AE%E0%A6%AA-%E0%A6%B0%E0%A6%B8-%E0%A6%A6-1.245443

‘কণ্ঠই তাঁর পরিচয় বহন করে’ (On Kanak Das)

‘কণ্ঠই তাঁর পরিচয় বহন করে’

বিভূতিসুন্দর ভট্টাচার্য

২১ জানুয়ারি, ২০১৬, ০০:০৩:০০

1
তখন বৃষ্টি নামল। তার মাঝেই দূত মারফত একটা চিরকুট এসে পৌঁছলো সেই শ্যামলা, লাজুক, শান্ত মেয়েটির কাছে। তাতে লেখা ‘শিগগির চলে এসো। নতুন গান শিখবে। দেখো যেন বৃষ্টিতে ভিজে আবার অসুখ বাঁধিয়ে বোসো না।’ সেই চিরকুটে এমনটাই লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ আর পাঠিয়েছিলেন কনক দাসকে। শিখিয়েছিলেন ‘ধরণীর গগনের মিলনের ছন্দে’ গানটি।
তিনি রবীন্দ্রসঙ্গীতের এক কিংবদন্তি। সে কালের শিক্ষিত, সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়েদের কাছে গান গাওয়াটা ছিল প্রায় নিষিদ্ধ ব্যাপার। ঠিক তেমনই এক সময়ে সঙ্গীত জগতে কনক দাসের আবির্ভাব। রেকর্ড করেছিলেন অসংখ্য গান এবং কালক্রমে হয়ে উঠেছিলেন রবীন্দ্রসঙ্গীতের অন্যতম জনপ্রিয় শিল্পী।
তিনি গাইতেন মনের আনন্দে। নিজের গান গাওয়ার সম্পর্কে বলতেন, ‘‘গান আমারে শিখতে হয় নাই। পরিবারের মধ্যেই গান ছিল... ছোটবেলা থেকেই গান এসে গেছে আমাদের। চেষ্টা করতে হয় নাই।’’ এই গান গেয়েই মিলেছিল রবীন্দ্রনাথের বিরল প্রশংসা। সেই প্রশংসাই হয়ে উঠেছিল তাঁর জীবনের যাত্রাপথের আনন্দগান।
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর প্রথম সাক্ষাতের সময় কিন্তু কনক গান করেননি। সেই নিয়েও রয়েছে একটি ঘটনা। কনক দাস সম্পর্কে সাহানা দেবীর পিসতুতো বোন হতেন। এক দিন সাহানা দেবী তাঁকে রবীন্দ্রনাথের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেখানে গিয়ে লাজুক কনক কেমন যেন আড়ষ্ট হয়ে গেল। সাহানা দেবী রবীন্দ্রনাথকে বললেন, যে তার বোন ভাল গান করতে পারে। এই শুনে রবীন্দ্রনাথ সেই শ্যামলা কিশোরীটিকে সস্নেহে বললেন, একটি গান শোনাতে। কিন্তু মেয়েটি বলে বসল যে সে গান গাইতে পারে না। সে বার না হলেও জীবনে বহুবার তিনি রবীন্দ্রনাথকে গান শুনিয়েছিলেন।
ঢাকার মেয়ে কনক দাসের জন্ম কিন্তু কলকাতায় ১৯০২-এর ৩ নভেম্বর একটি ব্রাহ্ম পরিবারে। ঢাকার ইডেন হাই স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন শেষ করে তিনি কলকাতায় এসে ভর্তি হয়ে ছিলেন বেথুন কলেজে। তাঁর মাতামহ ছিলেন কালীনারায়ণ গুপ্ত। ব্রাহ্মসমাজে তিনি পরিচিত ছিলেন ভক্ত কালীনারায়ণ নামে। তিনি বহু ব্রহ্মসঙ্গীতের গীতিকার ও সুরকার ছিলেন। কনক দাস গান শিখেছিলেন গিরিজাশঙ্কর চক্রবর্তী, দীনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, সত্যকিঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, যামিনী গঙ্গোপাধ্যায় দিলীপকুমার মুখোপাধ্যায়, হিমাংশু দত্ত প্রমুখের কাছে। রবীন্দ্রসঙ্গীত ছাড়াও রেকর্ড করেছিলেন অতুলপ্রসাদ সেন ও সুরসাগর হিমাংশু দত্তের গানও। এক সময় বেশ কিছু দিন শান্তিনিকেতনে কাটিয়েছিলেন। সেই সময় রোজ দিনু ঠাকুরের কাছে গান শিখতে যেতেন।
তাঁর প্রথম রেকর্ড প্রকাশিত হয়েছিল ১৯২৭ সালে। তবে গান রেকর্ড করলেও সচরাচর কোনও অনুষ্ঠান তো দূরের কথা, শোনা যায় পরিচিত, বন্ধু এমন কী আত্মীয় স্বজনের সামনেও গান করতে চাইতেন না স্বভাবে লাজুক কনক দাস। পরে অবশ্য ব্রাহ্মসমাজের অনুষ্ঠানে তিনি গান করতেন।
কনক দাস একাধিক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, এত সব গান রেকর্ড করার নেপথ্যে ছিল প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশের ভাই, প্রফুল্ল মহলানবীশের (বুলাদা) উৎসাহ। তিনিই গ্রামোফোন কোম্পানির প্রতিনিধি ভগবতীচরণ ভট্টাচার্যের কাছে গান রেকর্ড করার জন্য কনক দাসকে নিয়ে যান। সে কালে গান রেকর্ড করা হত গ্রামোফোন কোম্পানির বেলেঘাটার স্টুডিওতে। বিশেষ উল্লেখযোগ্য ব্যাপার, সে কালে বেশির ভাগ মহিলাশিল্পী বসে গান করতেন। তবে কনক দাসকে দাঁড়িয়ে গান করতে দেখে অবাক হয়ে ছিলেন সে কালের সাহেব রেকর্ডিস্ট। সে কালে তাঁর গানের সঙ্গে যন্ত্রানুসঙ্গের আতিশয্য ছিল না। বেশ কিছু গানের সঙ্গে অর্গান বাজিয়ে ছিলেন ইন্দিরা দেবীচৌধুরানী, পিয়ানো বাজাতেন সুজাতা দেবী। এ ছাড়াও যন্ত্রসঙ্গীতের শিল্পীদের মধ্যে ছিলেন সুজিত নাথ, দক্ষিণামোহন ঠাকুর, পরিতোষ শীল, অসিতবরণের মতো কিছু শিল্পী।
এক সময় মাঝে মধ্যেই জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি থেকে গান গাইতে যাওয়ার ডাক পড়ত। সেখানেই তো প্রথম ‘বর্ষামঙ্গল’ অনুষ্ঠানে তিনি গেয়েছিলেন ‘অশ্রুভরা বেদনা’ গানটি। এক বার বেলজিয়ামের মহারানি এসেছিলেন। সেই উপলক্ষে ঠাকুরবাড়ির মেয়েরা অভিনয় করেছিলেন ‘নটীর পূজা’। সেখানেই সত্যজিৎ রায়ের স্ত্রী বিজয়া রায়ের সঙ্গে দ্বৈতকণ্ঠে গেয়েছিলেন, ‘বন্ধু রহো রহো সাথে’ গানটি। সে সময় ঠাকুরবাড়িতে যে কোনও উৎসব অনুষ্ঠানের আগে দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের তত্ত্বাবধানে চলত রিহার্সাল। এক বার কোনও এক অনুষ্ঠানের আগে তিনি কনক দাসকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন গান শেখানোর জন্য। তবে বিশেষ অসুবিধে থাকায় কনক সেখানে যেতে পারেননি। অগত্যা টেলিফোনেই সে যাত্রা গান শিখেছিলেন কনক। আজকের দিনে সামান্য ঘটনা হলেও ব্যাপারটা সে কালে মোটেই সামান্য ছিল না। শোনা যায় রবীন্দ্রনাথ তাঁর গাওয়া বেশ কিছু গানের প্রশংসা করেছিলেন। তেমনই ‘জীবনে পরম লগনে’ গানটি রেকর্ড করার পরে টেস্ট রেকর্ড শুনে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘‘পাসড উইথ অনার্স।’’
এক বার শান্তিনিকেতনে পুরনো লাইব্রেরির দোতলায় বর্ষার গানের আসর বসেছিল। আশ্রমিকদের গানের পরে সভায় উপস্থিত রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘‘এতক্ষণ আমরা গান করলেম। এবার যিনি গান শোনাবেন তাঁর নামের ঘোষণার প্রয়োজন নেই, তাঁর কণ্ঠ তাঁর পরিচয় বহন করে।’’
১৯৪৩-এর ডিসেম্বর মাসে তাঁর সঙ্গে অজয়কুমার বিশ্বাসের বিয়ে হয়। ১৯৬২ সালে স্বামীর মৃত্যুতে দাম্পত্য জীবনে যবনিকার পতন ঘটেছিল। দেবব্রত বিশ্বাস সম্পর্কে তাঁর দেওর হতেন। তাঁর সঙ্গে চারটি ডুয়েট গানও রেকর্ড করেছিলেন। গানগুলি সে যুগে দারুণ জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। নবীন গায়ক গায়িকাদের সব সময় তিনি উৎসাহ দিতেন। ‘গীতবিতান’ সঙ্গীত প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তিনি আমৃত্যু যুক্ত ছিলেন। রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রথম যুগের শিল্পীদের মধ্যে তিনি আজও অবিস্মরণীয়।
http://www.anandabazar.com/supplementary/kolikata/atitertara/special-write-up-on-singar-kanak-das-by-bibhuti-sundar-bhattacharya-dgtl-1.290662

আমি সাধারণ মানুষ, কেবল গান গাই


$image.name

আমি সাধারণ মানুষ, কেবল গান গাই

৯ জুন, ২০১৬, ০০:০০:০০
দুরুদুরু বুকে শ্রীরাধা এসেছেন মদন ঘোষ লেনে মান্নাদা’র বাড়িতে। বয়স তখন নিতান্তই কম। সবে এমএ পড়ছে। এমন সময় এক অভাবনীয় সুযোগ এসে গেল মান্না দে’র সুরে প্লে-ব্যাক করার। গান লিখেছেন পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়। পরিচালক দীনেন গুপ্ত। ছবির নাম ‘কত ভালবাসা’। স্বভাবতই শ্রীরাধা খুবই উত্তেজিত। মান্নাদা সুরটা শেখাচ্ছেন: ‘চলতে চলতে মন বলছে’। গাইছেন, যত বার গাইছেন, সুর ততই খেলছে। মুগ্ধ হয়ে মান্নাদা’র গাওয়া গান শুনছেন শ্রীরাধা। হঠাৎ সংবিৎ ফিরল মান্নাদা’র। বললেন, ‘‘আরে, তুমি চুপচাপ বসে আছ কেন? আমার সঙ্গে গানটা গাও, নইলে শিখবে কী করে?’’ শ্রীরাধার সঙ্গে কথা হচ্ছিল লেকটাউনের স্টুডিও ফিলিং-এ। হাসতে হাসতে বললেন, ‘‘আমি তো মুগ্ধ হয়ে মান্নাদা’র গান শুনছি। কী গায়কি! কী ইম্প্রোভাইজেশন! গান শুনতে শুনতে আমি ভুলেই গিয়েছি যে গানটা আমাকে শিখতে হবে, গাইতে হবে। অসাধারণ শিক্ষক মান্নাদা! খুব যত্ন করে গানটা শেখালেন। শুধু মান্নাদা’র গাওয়া ফলো করলেও অনেক কিছু শেখা যায়।’’
সব দিকে ওঁর নজর। সে দূর্বাদল চট্টোপাধ্যায়ের মিউজিক অ্যারেজমেন্ট হোক বা বাদ্যযন্ত্রীদের মহড়া। সব কিছুর উপরেই মান্নাদা’র সতর্ক দৃষ্টি। উদ্দেশ্য একটাই। গানটাকে ভাল, আরও ভাল করতে হবে। ১৯৯২। রেকর্ডিং হল সল্টলেকের রূপায়ণ-এ। মান্নাদার সুরে শ্রীরাধার সারা জীবনের সম্পদ হয়ে রইল এই গানটি। মান্নাদা’র সুরে এই ছবিতে সুদেব দে’ও গেয়েছিলেন ‘দময়ন্তী, দময়ন্তী’। তিনি এ গানের জন্যই পেয়েছিলেন শ্রেষ্ঠ প্লে-ব্যাক সিংগারের পুরস্কার। সুদেব তো প্রকাশ্যেই বলেন, ‘‘এর কৃতিত্ব অনেকটাই কাকার। সুর আর শেখানোর মধ্যেই কাকা আসল কাজটা করে দিয়েছিলেন।’’
যে কোনও কাজেই মান্নাদা ছিলেন ১০০ শতাংশ সিরিয়াস। সে গানের ক্ষেত্রে বা দৈনন্দিন জীবনযাপনে। মদন ঘোষ লেনের বাড়িতে সিটিং চলছে। নতুন গানের রেকর্ডিং। যন্ত্রসংগীত পরিচালক প্রয়োজনীয় নোট নিচ্ছেন। মান্নাদা সব কিছু বিশদে বুঝিয়ে দিচ্ছেন। কোথায় কোন বাদ্যযন্ত্র কী সুরে বাজবে, রিদমের প্যাটার্নটা কেমন হবে, এই সব আর কী। কাজের সময় মান্নাদা কাউকে অ্যালাউ করতেন না। ঘরের দরজা ভেজানো ছিল। এই সময় দরজা ফাক করে একটি মেয়ে মুখ বাড়াল। ‘‘কে, কে, কী ব্যাপার? এভাবে ঢুকে পড়লেন?’’ মেয়েটি থতমত খেয়ে বলল, ‘‘গুঁড়ো সাবান বিক্রি করতে এসেছি, বাড়িতে কোনও মহিলা নেই?’’ মান্নাদা’র মেজাজ তো প্রচণ্ড খারাপ হয়ে গেছে। বললেন, ‘‘না, কেউ নেই! দয়া করে আপনি এখন আসুন।’’ মেয়েটি চলে গেল। মান্নাদা আবার কাজে বসলেন। ও দিকে মেয়েটি তো বাড়ি বাড়ি গুঁড়ো সাবান বিক্রি করার জন্য ঘুরছে। ঘুরতে ঘুরতে অনেক সময় খেয়াল থাকে না, কোন পাড়ায় কা’র বাড়িতে চলে এল। খানিকক্ষণ বাদে কেমন মনে হল— আচ্ছা, যে-ভদ্রলোক গান গাইছিলেন তাঁকে যেন মান্না দে’র মতো মনে হল! সত্যিই মান্না দে নয় তো? তবে যেমন ধমক খেয়েছে, মেয়েটি জানে আবার যদি ওখানে যায় তো কপালে দুর্ভোগ আছে। তবুও কেমন কৌতূহল হয়। মনেহয়, যা হয় হবে। ফলে মেয়েটি আবার ফিরে এসে সটান ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ল। এ দিকে মেয়েটিকে ফের ফিরে আসতে দেখে মান্নাদা তো খুবই বিরক্ত হলেন। বললেন, ‘‘কী আশ্চর্য আপনি আবার ফিরে এলেন?’’ মেয়েটি অবাক চোখে মান্নাদাকে দেখতে দেখতে শুধু বলল, ‘‘না, কিছু কিনতে হবে না। শুধু বলুন, আপনিই কি মান্না দে?’’ জবাব এল, ‘‘হ্যাঁ আমিই মান্না দে। কিন্তু কী হয়েছে তাতে?’’ মেয়েটি বলল, ‘‘না, কিছু হয়নি। শুধু একটা প্রণাম করব?’’ এই সব ঘটনার কথা বলতে বলতে মান্নাদা’র চোখে জল এসে যেত। বলতেন, ‘‘সামান্যই গাইতে পারি। তার জন্য সবার এত ভালবাসা?’’
জীবনযাপনে মান্নাদা’র দৃষ্টিভঙ্গি সবার দৃষ্টান্ত হতে পারে। মান্নাদা’র মূলমন্ত্র হচ্ছে, সময়ের কাজ সময়ে করো। মান্নাদা শেষ জীবনে থাকতেন বেঙ্গালুরুর কল্যাণনগরে। এখানেই ডা. গণেশ শেঠি এবং তাঁর স্ত্রী ডা. অঞ্জলি শেঠির ডেন্টাল ক্লিনিকের চেম্বার। দুজনেই মান্নাদার গানের অসম্ভব ভক্ত। মান্নাদাও ওঁদের খুব পছন্দ করেন। এই দুই ম্যাঙ্গালোরিয়ান ডাক্তার অনেক বার মান্নাদাকে অনুরোধ করেছেন, ‘‘দাঁতে কোনও সমস্যা হলে জাস্ট একটা ফোন করে দেবেন, আমরাই চলে যাব।’’ আসলে চেম্বারটার খাড়া সিঁড়ি। এই বয়সে মান্নাদা’র উঠতে কষ্ট হয়। কিন্তু কে কার কথা শোনে! মান্নাদা নিজেই তাঁর প্রিয় সাদা অল্টো গাড়ি চালিয়ে চলে আসতেন আর সিঁড়ি বেয়ে উঠতেন চেম্বারে। ডা. শেঠি যথারীতি বলতেন, ‘‘আপনি কেন এত কষ্ট করে এলেন? আমরাই তো যেতে পারতাম!’’ মান্নাদা তখন ৮৫+— তবু মজা করে বলতেন, ‘‘ঠিক আছে, ঠিক আছে, বুড়ো হই, তার পর দেখা যাবে!’’ 
একবার মান্নাদা এসেছেন, দাঁতে সামান্য শিরশির করছে। ডা. শেঠি দেখলেন। একটা মাত্র ওষুধ দিলেন। সমস্যার সমাধান খুব সহজেই হয়ে গেল। এই প্রসঙ্গটা ডা. শেঠি অনেককেই গল্প করতেন। যখনই একটু কোনও অসুবিধা হত, মান্নাদা চলে আসতেন ডাক্তারের কাছে। সুস্থ হতে সময় লাগত না। আর আমরা তো যে কোনও রোগ পাকিয়ে তার পর ডাক্তারের কাছে যাই। মান্নাদা ছিলেন এমনই। কোনও কাজই ফেলে রাখতেন না।
একটি বিষয় থেকে মান্নাদাকে কেউ নিরস্ত্র করতে পারেনি। ‘সময়ের কাজ সময়ে করো’ যেমন মান্নাদা’র মূল মন্ত্র ছিল, তেমনই আর একটি মন্ত্র ছিল ‘নিজের কাজ নিজে করো’। এই অভ্যাস সেই বম্বে থেকেই। ইলেকট্রিক বিল, টেলিফোন বিল, ধোপার বাড়ি—সব কিছুই মান্নাদা করতেন নিজের হাতে। বাড়ির লোকদের কথা কিছুতেই শুনতেন না। বলতেন, ‘‘নিজের কাজ নিজে করছি, এতে সমস্যা কোথায়?’’ হ্যাঁ, সমস্যা তো হতই, মান্নাদা যখন কোনও অফিসে যেতেন। ভেবে দেখুন, টেলিফোন অফিসে কাউন্টারে বসা ভদ্রলোক দেখছেন, মান্নাদা নিজে এসেছেন বিল জমা দিতে! কেমন বিব্রত অবস্থা! সবাই কত বার মান্নাদাকে অনুরোধ করেছেন, একটু খবর দিলেই আমরা আপনার বাড়ি চলে যাব—আপনি কেন কষ্ট করে আসেন! আমাদের যে খুব অস্বস্তি হয়! মান্নাদা অবাক হয়ে ভাবতেন, ওরা এ রকম বলে কেন? আমি তো অতি সাধারণ একজন মানুষ! কিছু গান গাইতে পারি এই যা।
নিজের গাড়ির উপর মান্নাদার ভীষণ মায়া ছিল। ২০১০ সাল পর্যন্ত (তখন ৯১ বছর বয়স) বেঙ্গালুরুর রাস্তায় নিজেই গাড়ি চালাতেন। তার পর ওঁর স্ত্রী ভয়ংকর অসুস্থ হওয়ার পর অবশ্য নিজে আর চালাতেন না। ২০১৩ সালের জুন মাস নাগাদ মান্নাদা ভর্তি হন দেবী শেঠির ‘নারায়ণা হৃদয়ালয়’ হাসপাতালে। আর ফেরেননি। মাঝে মাঝেই বাড়ির লোকদের বলতেন, ‘‘তোমরা মাঝে মাঝে গাড়িটাকে স্টার্ট দিও। নইলে বসে যাবে।’’ বড় মায়াময় মন। বহু দিন ওই গাড়ি মান্নাদাকে সঙ্গ দিয়েছে। তখনও চিন্তা, গাড়িটাকে ঠিক রাখতে হবে।
কিছু কিছু ঘটনা একজন মানুষকে বুঝতে সাহায্য করে। অন্যের জন্য মান্নাদা কতটা ভাবতেন, এ রকম একটা ঘটনা বলি। মান্নাদা মিষ্টি খেতে খুব ভালবাসেন—এ কথা সবাই জানেন। কলকাতার মতো মিষ্টি বেঙ্গালুরুতে আর কোথায় পাবেন! কল্যাণনগরে কমল দাস নামে একজন বাঙালির মিষ্টির দোকান ছিল। সাদামাঠা দোকান। ট্র্যা়ডিশনাল একই রকম কিছু মিষ্টি বানিয়ে বিক্রি করতেন। মান্নাদা ছিলেন তাঁর নিয়মিত খরিদ্দার। কমলবাবুকে তিনি একদিন বললেন, ‘‘যুগ পাল্টে গেছে। দোকানের চেহারাটা এ বার বদলাতে হবে। নইলে কাস্টমারদের নজর পড়বে কী করে? মিষ্টির মধ্যেও একটু ভ্যারাইটি আনুন মশাই! এখানকার লোকেরা কী চায় সেটা দেখুন। ছেলে দুটোকে তো ভাল ভাবে মানুষ করতে হবে!’’ ভেবে দেখুন, কোথায় ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গায়ক মান্না দে—আর কোথায় সামান্য এক মিষ্টিওয়ালা! তিনি যদিও মান্নাদার কথামতোই এর পর ওই দোকান আর তার মিষ্টির সংস্কার করেছিলেন সাধ্যমতো।
মান্নাদা চিরতরে চলে যাওয়ার পর কমলবাবু এক প্যাকেট মিষ্টি নিয়ে এসেছিলেন মান্নাদার বাড়িতে। মান্নাদা নেই তো কী হয়েছে, তাঁর বাড়ির লোককে আজ সেই মিষ্টি নিতেই হবে এবং এর জন্য কোনও দাম নেবেন না তিনি। কেননা, আজ তাঁর বড় ছেলে নেভিতে অফিসার, আর ছোট ছেলে সফটওয়্যার কোম্পানিতে ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে ভাল চাকরি পেয়েছে।  

http://www.anandabazar.com/supplementary/anandaplus/i-am-an-ordinary-one-i-can-only-sing-1.406314#

Wednesday, 8 June 2016

রাজনীতি নিয়ে নতুন চিন্তার সুযোগ এসেছে (II)

রাজনীতি নিয়ে নতুন চিন্তার সুযোগ এসেছে

নিচুতলার জনসাধারণের আকাঙ্ক্ষার উপর ভিত্তি করে যে জনপ্রিয়তাবাদ গড়ে উঠছে, তার অর্থনৈতিক সম্ভাবনা যত কমবে, রাজনৈতিক বৈচিত্র ততই বাড়বে।

রণবীর সমাদ্দার

২৭ মে, ২০১৬, ০০:০০:০০
people
২০১১’য় যা ছিল প্রাকৃতিক বা স্বাভাবিক, ২০১৬’য় তা অনিশ্চিত এবং অনেকের মতে অস্বাভাবিক। কিন্তু ২০১৬-র নির্বাচনে রাজনৈতিক বিহ্বলতা এমন সর্বব্যাপী এবং সর্বগ্রাসী হয়ে উঠল কী করে? রাজনৈতিক বোধ প্রায় পূর্ণগ্রাসে চলে গেল কী করে?
অনিশ্চয়তা এক দিকে একটা মানসিকতা, অন্য দিকে নয়া উদারনৈতিক প্রশাসনিকতায় এবং অর্থনীতি ও রাজনীতিতে এক ধরনের পুঁজিও বটে। নির্বাচন কমিশন এ বারে ছ’দফা নির্বাচনী কর্মসূচি প্রস্তুত করেছিলেন কেন, তা শুধু কেন্দ্রীয় সরকারি মহলের অলিন্দে যাঁরা ঘোরাফেরা করেন, তাঁরা বলতে পারবেন। প্রথম দফা আবার দুই পর্বে। জঙ্গলমহলকে পৃথক চিহ্নিত করার কারণই বা কী ছিল? জঙ্গলমহল তো কোনও উপদ্রুত এলাকা নয়। ৪০ কোম্পানি আধা-সামরিক বাহিনীর শক্তিকে ধাপে ধাপে বাড়িয়ে নিয়ে আসা হল ৭০০ কোম্পানিতে। ৭০ হাজার সৈন্য নিয়ে নির্বাচন পরিচালনা নির্বাচনের সামরিকীকরণের চিহ্ন। কাশ্মীর, উত্তর–পূর্বাঞ্চলে এ ভাবেই নির্বাচন হয়। এর সঙ্গে যুক্ত হল পরিদর্শক, উপপরিদর্শক ও অন্যান্য অফিসারবাহিনী। নতুন সফটওয়্যার, আরও নানা ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে যা ঘটল, তাকে বলা চলে নির্বাচনের সামরিকীকরণ এবং নিরাপত্তায়ন।
কত সৈন্য কবে লাগবে, কোন কোন তারিখে কোথায় ভোট হবে, কত বুথ বসানো হবে, কত পরিদর্শক লাগবে, নানা ধরনের খবর কোথা থেকে কোথায় পৌঁছবে, দিল্লি থেকে নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি কী হবে, কত অফিসার বদলি হবে, অনুযোগ-অভিযোগের দ্রুত তদন্ত হবে কী করে, কার ওপর নজর রাখা হবে— এ সব হল নয়া উদারনৈতিক যুগে নির্বাচন সংগঠনের পদ্ধতি। নির্বাচন এখন হল ‘লজিসটিক্স’-এর ব্যাপার। ‘লজিসটিক্স’-এর কেতাবি অর্থ সরবরাহ ব্যবস্থা পরিচালনার বিদ্যা। ভোটবাজারে নানা সরবরাহ লাগে। নির্বাচন যত সরবরাহ পরিচালনা শাস্ত্রের অধীন হয়েছে, ততই তার সামরিকীকরণ এবং নিরাপত্তায়ন হয়েছে। বাঙালি বুদ্ধিজীবী এবং রাজনৈতিক নেতারা যত নির্বাচন কমিশন-নির্ভর এবং কেন্দ্রীয় সরকার ও রাষ্ট্রের মুখাপেক্ষী হয়েছেন, তত তাঁরা এই সামরিকীকরণ এবং নিরাপত্তায়ন প্রক্রিয়ার ক্রীড়নকে পর্যবসিত হয়েছেন।
বলা হয়, ধনতন্ত্রে এক ধরনের আদিম স্পৃহা বা অ্যানিমাল স্পিরিট লাগে পুঁজি বৃদ্ধির জন্য। আশ্চর্য কী যে, নির্বাচনকে পণ্যবাজারে পরিণত করে এই আদিম স্পৃহার প্রদর্শন এ রকম উন্মত্ত হয়ে উঠেছিল! বাদ সেধেছেন সেই অবাধ্য, অশিক্ষিত জনসাধারণ। যাঁরা এই প্রক্রিয়ায় সায় দেননি, তাঁরা বাঁচার ন্যূনতম উপায় যেখানে পেয়েছেন, যেখানে তাঁদের বলার অঙ্গীকার লাভ করেছেন, শত দোষ সত্ত্বেও তাঁদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। এই দিক থেকে ২০১৬-র ঘটনা আরও সংঘাতপূর্ণ, আরও তীব্র এবং দ্বন্দ্বসংকুল।

জনপ্রিয়তাবাদ

জনপ্রিয়তাবাদের সামাজিক ভিত্তি সর্বত্র এক নয়। কোথাও এই জনপ্রিয়তাবাদ একেবারেই ধনিক শ্রেণির, কোথাও বামপন্থী সংস্কার মানসিকতার সৃষ্ট, কোথাও আবার আকস্মিক ভাবে আবির্ভূত হয়েছে সমাজের নিচুতলার আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন রূপে। ইন্দিরা গাঁধী হয়তো প্রথম ধরনের জনপ্রিয়তাবাদী রাজনীতির চর্চা করেছেন। বামফ্রন্ট প্রশাসন তার প্রথম দিকে, অন্তত আশির দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত দ্বিতীয় ধরনের জনপ্রিয়তাবাদী রাজনীতি অনুসরণ করেছেন। সে সময় বামফ্রন্টের মুখ্যমন্ত্রী বার বার বলতেন, বামফ্রন্ট আমূল পরিবর্তন আনতে পারবে না, কিন্তু কিছু উপকার জনগণের করতে পারে— কিছু নিরাপত্তা প্রদান, কিছু রক্ষা, কিছু সীমিত সংস্কার। তাই বেকার ভাতা প্রদানও কর্মসূচির অঙ্গ ছিল। আজ এটা পরিহাসের ব্যাপার। যে পদক্ষেপের জন্য বামপন্থী বুদ্ধিজীবীরা বামফ্রন্টের প্রশংসা করতেন, সেই একই ধরনের, বরং আরও অনেক বেশি মাত্রায় সেই ধরনের পদক্ষেপকে তাঁরা ডোল বা খয়রাতি বলে নিন্দা করেন, তির্যক মন্তব্য করেন। তৃণমূল প্রশাসন, দল এবং তার নেত্রী তৃতীয় ধরনের জনপ্রিয়তাবাদের উদাহরণ।
এই জনপ্রিয়তাবাদের মধ্যে কি ফাঁকফোকর, দোষ, গভীর বিভাজনরেখা নেই? নিশ্চয়ই আছে। দুর্বৃত্তায়ন নেই? দুর্নীতি নেই? আছে। এ সবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, সমালোচনা চলা উচিত, এবং চলবে। কিন্তু দুটো জিনিস এ ক্ষেত্রে মাথায় রাখতে হবে, যদি রাজনৈতিক বোধের পরিচয় দিতে হয়। নইলে শুধু অনুশোচনা, খেদোক্তি আর কপাল চাপড়ানো ভবিতব্য হয়ে দাঁড়াবে।
এক, সাধারণ মানুষের রাজনৈতিক বিচারে এই দুর্বৃত্তায়ন অথবা দুর্নীতির কোনও সমালোচনা নেই? আছে। কিন্তু কী সেই সামগ্রিক রাজনৈতিক বোধ, যাতে সাধারণ মানুষ এই দুর্বৃত্তায়ন ও দুর্নীতি সত্ত্বেও অন্যান্য সংসদীয় রাজনৈতিক শক্তির চেয়ে তৃণমূলকে অধিক সমর্থন করে? বিশেষত দরিদ্র মানুষ?
দুই, শুধু সংস্কারকেন্দ্রিক কর্মসূচি ও কর্মকাঠামোয় কি এই দুই ব্যাধি বন্ধ হবে? প্রবল রাজনৈতিক শক্তি রূপে বামফ্রন্টের শেষ হয়ে যাওয়া, এবং দল ও উপদলসর্বস্ব জনসমাবেশের ক্ষমতা শূন্যে পৌঁছনোর পর, নতুন জনসমাবেশ রীতির অনেক ভাল দিকের পাশাপাশি এ এক নিহিত অভিশাপ। ক্ষুদ্র উৎপাদন-প্রধান অর্থনীতি, নির্মাণশিল্প-নির্ভর অর্থনৈতিক প্রসার, ব্যাপক বেকারত্ব থেকে এ অবস্থা জন্ম নেবেই। এই অবস্থার মধ্যে থেকে রাজনীতি করলে তবেই তা প্রাসঙ্গিক হবে।
বিশ্বায়ন, উদারনীতিকরণ, রাষ্ট্রিক ব্যয়সংকোচ ও আর্থিক সংস্কারের যুগে নীচের মহলের জনপ্রিয়তাবাদের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা সীমিত। বাজারই এখন আসল কথা, জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধি গায়ত্রীমন্ত্র। জনকল্যাণকামী সীমিত নীতি ও পদক্ষেপ কত দিন কত দূর চালানো যাবে বলা শক্ত। যদিও অভিনব নানা পদক্ষেপে তৃণমূল প্রশাসন এই পরিস্থিতিতেও সামাজিক উপকাঠামোর প্রসার ঘটিয়েছেন।
কিন্তু নিচুতলার জনসাধারণের আকাঙ্ক্ষার উপর ভিত্তি করে যে জনপ্রিয়তাবাদ গড়ে উঠছে, তার অর্থনৈতিক সম্ভাবনা যত কমবে, তত তার রাজনৈতিক অভিনবত্ব ও বৈচিত্র বাড়বে, বিশ্বায়ন এবং নয়া উদারনৈতিক আয়োজনের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ তত জনপ্রিয়তাবাদী পথ ও পদ্ধতিকে সমর্থন করবে, আঁকড়ে ধরবে। নানা রূপে জনপ্রিয়তাবাদের উদ্ভাবন ঘটাবে।  আজকের ভারত তার জীবন্ত নিদর্শন।
এই স্ববিরোধিতার তাৎপর্য বিচারে না আনলে, সমাজের গতির বস্তুবাদী প্রকৃতিকে গণ্য না করলে কীসের বামপন্থা? তার বদলে দেখব শুধু রক্ষণশীল সমাজশাস্ত্র ও জ্ঞানচর্চা। বামপন্থী আদর্শ, কর্মপন্থা বা কর্মসূচির প্রয়োজন নেই তা নয়। কিন্তু ২০১১ ও ২০১৬ যে দ্বান্দ্বিক দৃষ্টির প্রয়োজনের ইঙ্গিত দিয়েছে, তার আলোয় দেশের, অন্তত বাংলার রাজনীতি নিয়ে নতুন করে ভাবার সুযোগ এসেছে। জনসাধারণ দুই-দুই বার এই সুযোগ করে দিয়েছেন। সেটা কাজে লাগানো উচিত। সমালোচনা চলুক, কিন্তু বিচারবোধকে ত্যাগ না করে। (শেষ)

সমাজবিজ্ঞানী, ক্যালকাটা রিসার্চ গ্রুপ। মতামত ব্যক্তিগত

http://www.anandabazar.com/editorial/new-thinking-in-a-true-politics-1.396247

‘পরিবর্তন’কে এ বার বোঝা দরকার (I)

‘পরিবর্তন’কে এ বার বোঝা দরকার

২০১১ সালে যে পরিবর্তন পশ্চিমবঙ্গে এল, ২০১৬-র আয়নায় তার রূপ আজ অনেক পরিষ্কার। তার স্বরূপ অনুসন্ধান না করে বিনাশ-ধ্বংস-নৈরাজ্যের আতঙ্কে বন্দি থাকলে বাস্তবকে বোঝা যাবে না।

রণবীর সমাদ্দার

২৬ মে, ২০১৬, ০০:৪০:২২
mamata

সূচনা। রাজ্য মন্ত্রিসভার শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান, ২০ মে ২০১১।

এখনও আমরা বিশ্লেষণ করে উঠতে পারিনি ২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গে ঠিক কী ঘটেছিল। এর পর পাঁচ বছর কেটে গেল। সংবাদপত্র, শিক্ষিত শ্রেণির অন্যান্য মতপ্রকাশ মাধ্যম, বিশেষত টিভি-র পর্দায় আর বিদগ্ধ প্রবন্ধে একটাই প্রশ্ন উঠতে লাগল এই পাঁচ বছর ধরে: এ কী ধরনের পরিবর্তন? একই অনাচার বা আরও বেশি অনাচার, অনাসৃষ্টির জন্য আমরা তৃণমূল সরকারকে ক্ষমতায় আনলাম? এই সব খেদোক্তির মধ্যে ২০১১’য় ঠিক কী ঘটেছিল, তা আজ আমাদের স্মৃতি ও চিন্তার পিছনে চলে গেছে। ২০১৬-র দ্বিগুণ ধাক্কা শিক্ষিত শ্রেণিকে আরও বিহ্বল করেছে। হয়তো ২০১৬ না ঘটলে ২০১১-র তাৎপর্য বোঝা আরও দুরূহ হত।
ভদ্রজনেরা বললেন, ২০১১-র পরিবর্তন ফাঁকা। অন্তঃসারশূন্য এই পরিবর্তনকে মানুষ প্রত্যাখ্যান করেছে। দুর্নীতি, বাহুবল প্রদর্শন, দান খয়রাতি দিয়ে লোক কিনে নেওয়া— এ সবই ছিল পাঁচ বছরের কাহিনি। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ সেটা বুঝেছে, সাময়িক উন্মাদনা থেকে সরে এসেছে। বাংলা এক বিপর্যয়ের কিনারায় পৌঁছেছিল। ২০১৬ তাকে সুস্থ মানসিকতায় ফিরিয়ে আনবে। ২০১১ নামক দুঃস্বপ্নকে মুছে ফেলা যাবে।
কিন্তু ২০১৬-র ঘটনা শুধু ২০১৬’য় কী ঘটল তা নিয়েই আমাদের ভাবতে বাধ্য করবে না, ২০১১’য় কী ঘটেছিল, সে নিয়েও বিশ্লেষণে উৎসাহ দেবে। রাজনৈতিক বিশ্লেষণে পক্ষপাত থাকবেই। অভিজ্ঞতার তারতম্য এবং শ্রেণিচরিত্রভেদ বিশ্লেষণকে এক এক মাত্রায় ঠেলে দিতে বাধ্য। তাই মতের সংঘাত চলতেই থাকবে। এবং শিক্ষিত শ্রেণি ও সাধারণ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য কমবে, এ আশা ক্ষীণ।
শুরু থেকে শুরু

পশ্চিমবঙ্গে কায়েম হওয়া রাজনৈতিক ব্যবস্থাটির অন্তর্জলি যাত্রার শুরু ২০০০-০১ থেকে, যখন রাজ্যে খাদ্যোৎপাদন বৃদ্ধির হার কমে গেল, দারিদ্র হ্রাসের হার কমতে শুরু করল, অনাহার-মৃত্যুর পুনরাবির্ভাব ঘটল। এ-ও বোঝা গেল যে, পঞ্চায়েত ব্যবস্থা দিয়ে গণসক্রিয়তা উন্মোচনের সম্ভাবনা শেষের দিকে। একটা বড় কারণ ছিল আশি-নব্বইয়ের দশক জুড়ে চটকল-সহ নানা শিল্পের অধোগতি, শ্রমিক-সংখ্যা ও উৎপাদন সংকোচন এবং শহুরে মধ্যবিত্ত-নির্ভর নগর অর্থনীতি। এতে বাজারের যে সংকোচন ঘটল, তাতে ক্ষুদ্র উৎপাদনভিত্তিক কৃষি আর উপযুক্ত সরবরাহ ক্ষেত্র রূপে কাজ করতে পারছিল না। সংক্ষেপে বলা যায়, দুই মৃত্যু দিয়ে এই অন্তর্জলি যাত্রার প্রকাশ: ভিখারি পাসোয়ান এবং পটু মূড়ার মৃত্যু।
শিল্পসংকট, ক্ষুদ্র জোতভিত্তিক কৃষি উৎপাদন, ক্ষুদ্র উৎপাদনের আরও প্রসার, মাঝারি স্তরের ব্যবসা এবং ফড়ে-দালালদের সংখ্যা বৃদ্ধি, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের নিয়ত মূল্যবৃদ্ধি, মধ্যবিত্তনির্ভর অর্থনীতির প্রসার, গ্রামীণ ঋণের বোঝা, ক্ষুদ্র সঞ্চয়ের ওপর একান্ত নির্ভরতা এবং সর্বোপরি বহু শ্রমজীবী মানুষের অনিয়মিত অসংগঠিত দিনযাপন পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতিকে এক কোণে ঠেলে দিয়েছিল, যা থেকে বামফ্রন্ট প্রশাসন বেরিয়ে আসতে চেয়েছিল বাইরে থেকে যে-কোনও মূল্যে বিনিয়োগ এনে। কৃষকের জমি জবরদখল, নানা অবাস্তব উপায়ে উন্নয়নের চেষ্টা এবং খাদ্যসংকট সম্পর্কে চিন্তাভাবনার অভাব, যা ২০০৭-০৮-এর ‘রেশন বিদ্রোহ’ নামক প্রতিবাদের মূলে, এ সবই বামফ্রন্টের প্রশাসনিক রাজনীতিকে বিপর্যয়ের মুখে ফেলে দিল।
লালগড়, উত্তরবঙ্গের খাদ্য-আন্দোলন, সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম, রাজারহাট, আয়লা বিপর্যয় এবং খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থার অবনতির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ বাংলায় এক অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি সৃষ্টি করল, যা নানা দিক দিয়ে ১৯৬৫-৬৬-র সঙ্গে তুলনীয়। ১৯৬৫-৬৬ থেকে পরবর্তী প্রায় দশ বছর যে গণপ্রতিবাদ চলেছিল, তার অবসান ঘটে জরুরি অবস্থার ঘোষণায়, স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। অন্য দিকে, ২০০১ থেকে নানা প্রতিবাদ, প্রতিঘাত, সংকট এবং দ্বন্দ্বের অবসান বাংলায় এল ২০১১ সালে এক জনপ্রিয়তাবাদী রাজনীতির আধিপত্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে।
যাঁরা মনে করেন, নাগরিক সমাজের কিছু পদযাত্রার মধ্য দিয়ে নয়া-উদারনৈতিক বামফ্রন্ট শাসনের অবসান ঘটেছিল, তাঁরা এক দশকের তীব্র সামাজিক দ্বন্দ্ব এবং সমাজের নিচুতলার শ্রেণিসমূহের অসন্তোষকে লঘু করে দেখেছেন। ২০১১-র নির্বাচন তাই তাঁদের কাছে এখনও এক অকল্পনীয় অঘটন এবং বিফল ঘটনা। এঁরা অনেকেই ৩৪ বছরের বামপন্থী শাসনে লালিত। ষাট-সত্তরের দশকের সামাজিক রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের ইতিহাস এঁদের মনে গভীর রেখাপাত করেনি। এঁরা প্রায় সকলেই বামফ্রন্টের সংঘাতহীন এক মানসিকতার সৃষ্টি এবং স্বাক্ষরবাহী— আমি অন্যত্র যার নাম দিয়েছি বাংলার নিস্তেজ বিপ্লব (প্যাসিভ রেভলিউশন)। সমাজের দ্বন্দ্বে এঁরা বিচলিত হন, নৈরাজ্যের দুঃস্বপ্ন এঁদের তাড়া করে।
নীচের মহল

২০১১ সালে জনপ্রিয়তাবাদী জোয়ারে যে পরিবর্তন পশ্চিমবঙ্গে এল, ২০১৬-র আয়নায় তার রূপ আজ অনেক পরিষ্কার। রাজ্যের অর্থনীতিতে ব্যাপক অসংগঠিত শ্রমজীবী মানুষের উপস্থিতি, কলকাতা-সহ নানা নগর শহরের পরিবর্তন, সাবেকি শিল্পের সূর্যাস্তকাল, কৃষকের সংকট, সরকারি ব্যয় সংকোচ-সহ নানা উপাদানের ভিত্তিতে এই জনপ্রিয়তাবাদ গড়ে উঠেছে— যার সামাজিক ভিত্তি সমাজের দরিদ্রতর অংশসমূহের মধ্যে, ম্যাক্সিম গর্কি যার নাম দিয়েছিলেন ‘লোয়ার ডেপ্থ্স’ বা নীচের মহল।
এই নীচের মহলে যেমন শ্রমজীবী মানুষের ব্যাপক উপস্থিতি আছে, তেমনই আছে নানা ক্লেদ, সংকীর্ণতা, ভবঘুরেপনা এবং ক্রোধ ও হিংসা। পরিচ্ছন্ন শ্রেণিবিভাজন করে ভালটা বেছে খারাপটা সরিয়ে রেখে বামপন্থী কেতাবি রাজনীতি করার সুযোগ নেই। বিশ্বায়নের বিরুদ্ধে জীবন-জীবিকা রক্ষার নিরন্তর প্রয়াস থেকে যে জনপ্রিয়তাবাদের জন্ম, তাতে অমৃত এবং গরল দুই-ই থাকবে।
এক দশক ব্যাপী সামাজিক বিরোধ এবং সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে অসংগঠিত জনসাধারণের যে ইচ্ছা এবং সক্রিয়তা ২০১১’য় দেখা গেছে, তার শ্রেণিভিত্তি এবং সামাজিক অন্তর্বস্তুকে অস্বীকার করলে রাজনৈতিক বিচারবোধ এবং বিচক্ষণতার পরিচয় দেওয়া হয় না। কেন জনসাধারণের ব্যাপক অংশ ২০১১’য় তৃণমূলকে সমর্থন করেছিল, কেন এই সরকারের নানা নীতি তার নেত্রী এবং নেতৃত্বকে জনপ্রিয় করেছে, তার অনুসন্ধান না করে ‘গণতন্ত্র বাঁচাতে হবে’ ঘোষণায় এবং বিনাশ-ধ্বংস-নৈরাজ্যের আতঙ্কে বন্দি থাকলে আমরা লোকের প্রহসনের পাত্র হয়ে যাব।
অনিশ্চয়তা এবং আতঙ্ক থেকে স্থিরবুদ্ধি চলে যায়। সে নিয়তি যদি বাঙালি শিক্ষিত শ্রেণি, বিশেষত বুদ্ধিজীবীদের এড়াতে হয়, তবে গত পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতার নিরিখে কিছু প্রশ্ন ভাবতেই হবে।
কী ভাবে বা কোন যুক্তিতে তৃণমূল এবং হিন্দুত্ববাদীদের সমভাবাপন্ন মনে করা হল? কোন নিরিখে কংগ্রেস তৃণমূল অপেক্ষা অধিক গ্রহণীয় হল? তৃণমূলের সমালোচনায় এ রকম ভারসাম্যহীন দৃষ্টিভঙ্গি এল কী করে, যাতে সদর্থক পদক্ষেপগুলোও স্বীকৃত হল না? সাধারণ মানুষের উপকারে লাগে যে-সব পদক্ষেপ, তাতেও এত ঈর্ষার আবির্ভাব ঘটল কী করে? কেন এই রূঢ় সত্য অস্বীকার করার উদগ্র চেষ্টা, যে, জনপ্রিয়তাবাদী রাজনীতির মধ্যে জন-উপাদান, সাধারণ মানুষের জীবনরক্ষার আকাঙ্ক্ষা আছে? কেন মনে হল যে তৃণমূল সরকার ফ্যাসিবাদী, যখন দেখা যাচ্ছে এই সরকার সংখ্যালঘুদের রক্ষা করছে, অভিবাসী (ধরে নেওয়া যাক) বাংলাদেশি শ্রমজীবী মানুষকে নির্যাতনে রাজি হচ্ছে না, উত্তরবঙ্গ দক্ষিণবঙ্গের সাবেকি বিভেদ মেটাতে চাইছে? ফ্যাসিবাদের সংজ্ঞা কী?
এমন নানা প্রশ্ন ভাবতে অস্বীকার করার পিছনে যেমন আছে সামাজিক বাস্তবতা সম্পর্কে বামপন্থী দলগুলির অনীহা আর যে-কোনও মূল্যে সরকারে প্রত্যাবর্তনের প্রবল আকুতি, তেমনই বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে রয়েছে হৃত সামাজিক ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা। তাই প্রথম তরফে সামাজিক অন্তর্বস্তুহীন গণতন্ত্রের ডাক, দ্বিতীয় ক্ষেত্রে স্বকল্পিত ব্যাখ্যা ও এক রক্ষণশীল সমাজবিজ্ঞানের প্রয়োগ।
কোন সময় থেকে বুদ্ধিজীবী নামক সামাজিক স্তরের মানুষের মনে হল যে তাঁরা সমাজের হয়ে কথা বলতে পারেন? রাজনীতি, অর্থনীতি, পলিসি, নন্দনতত্ত্ব, বিশ্বচরাচরের সব বোঝেন? তাঁরা জনসাধারণের ব্যাখ্যাতা, তাঁদের ভুল-ঠিকের ঠিকাদার? জাতির বিবেক হয়ে ওঠার এই প্রবণতার জন্ম কবে? রাজনীতিকরা রাজনীতির চর্চা করেন, তাঁরা রাজনীতির কথা বলবেন, এটা স্বাভাবিক। কিন্তু কবে থেকে বামপন্থী রাজনীতিকরা বুদ্ধিজীবী-পরিচালিত হতে শুরু করলেন? আমার ধারণা, এই অহমিকার শুরু আশির দশক  থেকে, যখন সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা বুদ্ধিজীবীদের সামাজিক সমালোচনাবোধকে ভোঁতা করে দিল। তার ওপর যোগ হয়েছে নয়া উদার নীতি এবং বিশ্বায়নের দৌলতে বুদ্ধিজীবীদের রমরমা। তাঁরা এখন সামাজিক উপদেষ্টা, সাধারণ বোধের ব্যাখ্যাতা, নানা বিষয়ে জ্ঞান আমদানি-রফতানির দায়িত্বে।                  (চলবে)

http://www.anandabazar.com/editorial/people-need-to-understand-the-changed-government-1.395410

ব্রিটিশরা না এলে এই কুম্ভমেলা হত না

ব্রিটিশরা না এলে এই কুম্ভমেলা হত না

গৌতম চক্রবর্তী

৭ জুন, ২০১৬, ০০:০৪:০০
Maha-Kumbha

যা হইয়াছেন। ‘আন্তর্জাতিক বিচার মহাকুম্ভ’তে প্রধানমন্ত্রী। উজ্জয়িনী, ১৪ মে। ছবি: পিটিআই

আট বছর ধরে হরিদ্বার, প্রয়াগ ও উজ্জয়িনী কুম্ভমেলা দেখে দেখে মনে হল, ব্রিটিশ শাসনকে ধন্যবাদ। ওঁরা না এলে আধুনিক কুম্ভমেলা তৈরি হত না। ইলাহাবাদ, উজ্জয়িনী বা হরিদ্বারে রেল যোগাযোগ থেকে নাগা সাধুদের স্নান-মিছিলের নির্ঘন্ট, সবই ব্রিটিশ জমানার দান। ভিত্তিটা মুঘলদের তৈরি, তার উপরে পড়ল ব্রিটিশ প্রশাসনিকতার পলেস্তারা। স্বাধীন ভারতে কুম্ভে স্পেশাল ট্রেন, বাস, তাঁবুশহরের বন্দোবস্ত করে নেহরু থেকে মোদী, সবাই সেই ধাঁচাটিকেই অনুসরণ করেন।
এ বারের উজ্জয়িনী কুম্ভে আমাদের প্রধানমন্ত্রী, শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট, যোগগুরু রামদেব, সকলে মিলে ‘বিচার মহাকুম্ভ’ নামে একটি বক্তৃতার আসর বসালেন। প্রধানমন্ত্রী বললেন, ঐতিহ্যকে বজায় রেখেই আমাদের আধুনিক বিশ্ববাজারের বিপণন-উপযোগী হয়ে উঠতে হবে। ভাল কথা।
ভাল কাজটি অবশ্য করল শহরের কিছু মসজিদ। শুরুর দিকে এক শাহি স্নানে ঝড়ে অনেক তাঁবু ভেঙে পড়ে। বিদ্যুৎ চলে গিয়ে সব অন্ধকার। মসজিদের ছেলেরাই তীর্থযাত্রীদের খাবার, গরম দুধের ব্যবস্থা করে। রাজনীতিকদের বিচারকুম্ভ নয়, এটিই প্রকৃত কুম্ভ-ঐতিহ্য। 
১৯১০ সালে প্রয়াগের পূর্ণকুম্ভ। ঠিক হল, গওহরজান গান গাইবেন। হিন্দুরা ক্ষুব্ধ, ‘রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষণায় কুম্ভমেলায় বাইজির গান’ বলে প্রতিবাদপত্রও ছাপা হল। কিন্তু ব্রিটিশরা অনড়। তীর্থযাত্রীরা ঝেঁটিয়ে গওহরের গান শুনতে গেল। এ বার উজ্জয়িনীতে হেমা মালিনী নেচে গিয়েছেন, মনীষা কৈরালা শিপ্রা নদীতে স্নান করেছেন। এই সেলেবরা গওহরেরই উত্তরসূরি।
কোম্পানি আমল থেকেই ব্রিটিশরা কুম্ভমেলার এই পরিসরটি চিনত। ১৭৯০। মুঘল আমলের শেষ বেলা। উজ্জয়িনী তখন মরাঠা সিন্ধিয়াদের শাসনে। অওধের নবাব আসফ উদ্ দৌলাকে এক চিঠিতে সিন্ধিয়া জানাচ্ছেন, নবাবের কর্মচারী মীর মহম্মদ আমজাদ দাক্ষিণাত্য থেকে যাওয়া তীর্থযাত্রীদের খুব সাহায্য করেন। তাঁকে কি নবাব যাত্রীদের সুবিধার্থে এক মাস আগে প্রয়াগে পাঠিয়ে দিতে পারবেন?
এই পরিসরটিকে আজকের ভাষায় ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ ভাবলে কিন্তু ভুল হবে। ধর্মনিরপেক্ষতা, সাম্প্রদায়িকতা— এ-সব শব্দ বিশ শতকে তৈরি। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার ঐতিহ্য অন্য। ধর্ম, মেলা, তীর্থযাত্রা সবই থাকবে। তার সঙ্গে প্রাক্-আধুনিক কূটনীতিও! অযোধ্যার নবাব হিন্দু তীর্থযাত্রীদের সাদরে বরণ করে নেবেন। আজও প্রয়াগকুম্ভে স্নান সেরে বহু মানুষ প্রয়াগের দুর্গে যান। দুর্গের দরজা তখন খুলে দেওয়া হয়, একে-৫৬ হাতে সেনাদের পাশ দিয়ে তীর্থযাত্রীরা অক্ষয়বটে পুজো দিতে যান। ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দে মুঘল সম্রাট শাহ আলমের এক সনদে স্থানীয় এক পাণ্ডা এই দেবস্থানে পুজোর অধিকার পেয়েছিলেন। সনদ আজও চলছে।
অক্ষয়বট ঘিরে প্রয়াগের এই দুর্গটি ১৫৮৩ সালে আকবরের তৈরি। গঙ্গা, যমুনা সরস্বতীর ত্রিবেণীসঙ্গমে হাজার হাজার মানুষ তীর্থে আসেন, সেখানেই দুর্গ গড়ার ইচ্ছা ছিল তাঁর। মুঘল আমলে এ নিয়ে মিথ তৈরি হল: গত জন্মে আকবর ছিলেন মুকুন্দ ব্রহ্মচারী নামে এক সাত্ত্বিক সাধু। প্রয়াগসঙ্গমে সাধনভজন করতেন। এক দিন দুধ পান করতে গিয়ে কী যেন মুখের ভিতরে চলে গেল। গাল, দাঁত ও জিভ সুড়সুড় করছে। আতঙ্কিত মুকুন্দ দেখলেন, গরুর লোম ভাসছিল তাঁর দুধে। গো ভক্ষণের পাপ! প্রয়াগসঙ্গমে আত্মহত্যা করলেন মুকুন্দ। সেই পাপে পরজন্মে ম্লেচ্ছ হয়ে জন্মাতে হল। ম্লেচ্ছ, কিন্তু উচ্চকোটির পুণ্যফলে শাহেনশাহ আকবর। এমন মিথ জানব না? কুম্ভমেলায় বসে পরিবেশ-সচেতনতা, বিশ্ববাজার ইত্যাদি ভাল ভাল কথার খই ছড়ালেই হবে? কিন্তু আমাদের কাছে কুম্ভ মানে তো দেবাসুরের সংগ্রামশেষে অমৃত উপচে পড়ার উপকথা, কিংবা বল্লম তরবারি হাতে নাগা সাধুদের শাহি স্নানের ছবি!
উপকথায় আপত্তি নেই। কিন্তু তা নিয়ে ভাবতে হবে না? একে তো অমৃতকলস নামিয়ে ইন্দ্রের পুত্র জয়ন্ত না বিষ্ণুবাহন গরুড় কে বিশ্রাম করেছিলেন, তার হদিশ এক এক ভাষ্যে এক এক রকম। আবার, সংস্কৃত শ্লোকে মোক্ষদা সাত তীর্থ: ‘অযোধ্যা মথুরা মায়া কাশী কাঞ্চী অবন্তিকা/তীর্থ দ্বারাবতী চৈব সপ্তৈতে মোক্ষদায়িকা।’ মায়া বা হরিদ্বার, অবন্তিকা বা উজ্জয়িনী, দ্বারাবতী বা প্রয়াগের ধূসর অস্তিত্ব টের পাওয়া গেলেও নাসিক কোথায়? অযোধ্যা, মথুরা, কাশী, কাঞ্চীর মতো মোক্ষদায়িনী শহরেই বা বারো বছর অন্তর অমৃতকুম্ভ উপচে পড়ে না কেন?
এই সব শ্লোকের সঙ্গে আসলে কুম্ভমেলার কোনও সম্পর্ক নেই। কুম্ভমেলা আসলে তৈরি হয়েছে অনেক পরে। মুঘলদের অন্তিম কাল, মরাঠা ও ইংরেজ কোম্পানি ক্ষমতা বিস্তারের জন্য লড়ছে। নাসিক, উজ্জয়িনী তো বটেই, সাহারানপুর রাজ্যের হরিদ্বারও মরাঠা অধিকারে। রাজা-বাদশাহদের সৌজন্যে সন্ন্যাসী আখড়াগুলির ভূসম্পত্তি প্রচুর। সন্ন্যাসীরা ঘুরে ঘুরে বেড়ান, ব্যবসা করেন, চাষিদের সুদে টাকা ধার দেন। কেউ আবার কখনও আজ মরাঠা, কাল ব্রিটিশদের ভাড়াটে সৈন্য হন। এই অস্ত্রধারী সৈন্যরা নিজেদের শঙ্করাচার্য-প্রবর্তিত দশনামী সম্প্রদায়ের লোক বলে পরিচয় দেন। শঙ্করাচার্য জীবদ্দশায় নাগা সন্ন্যাসী, দশনামী সম্প্রদায় কিছুই সৃষ্টি করেননি। কিন্তু তুঙ্গভদ্রার তীরে হিন্দু বিজয়নগর সাম্রাজ্যের রাজগুরু বিদ্যারণ্য শৃঙ্গেরী মঠের শিষ্য, তাঁর আমল থেকেই ওই মঠের প্রতিপত্তি বাড়তে থাকে। শঙ্করাচার্যের নামের সঙ্গে নিজেদের গুঁজে দেওয়া, ব্যবসা করা, সবই সশস্ত্র সন্ন্যাসীদের ক্ষমতার লড়াই।
১৫৬৭ সালে পঞ্জাবে এক অভিযান শেষে আগ্রায় ফেরার পথে থানেশ্বরে এ রকমই এক লড়াই দেখেছিলেন মুঘল সম্রাট আকবর। আবুল ফজলের আকবরনামায় তার বিবরণ আছে। এক দিঘির দখল নিয়ে নাথ যোগীদের সঙ্গে নতুন-আসা পুরী সন্ন্যাসীদের বিবাদ। আকবরের বোঝানোতেও কাজ হল না। শেষে তরবারি, তিরধনুক, বল্লম নিয়ে দুই দল সন্ন্যাসীর লড়াই। নাথ যোগীরা হেরে গেলেন। শৈব পুরী সন্ন্যসীরা জিতলেন। হিন্দু-মুসলমান নয়। আকবরের সামনে জলাশয়ের অধিকার নিয়ে দুই দল সশস্ত্র হিন্দু সন্ন্যাসীর লড়াই!
১৯২০ নাগাদ ব্রিটিশ ওরিয়েন্টালিস্টরা জুনা আখড়া থেকে অন্য এক উপকথা উদ্ধার করলেন। কাশীর বাঙালি পণ্ডিত মধুসূদন বাচস্পতি আকবরের কাছে নালিশ করলেন, মুসলমান ফকিরেরা হিন্দু সন্ন্যাসীদের ওপর রাস্তাঘাটে অত্যাচার করে। আকবর হিন্দু সন্ন্যাসীদের অস্ত্র ব্যবহারের অনুমতি দিলেন।
উনিশ শতকের শুরুতেও হরিদ্বার বা উজ্জয়িনী কুম্ভে নানান রক্তগঙ্গার মূলে ছিল শৈব বনাম বৈষ্ণব সন্ন্যাসীদের লড়াই। সন্ন্যাসীরাই তখন মেলায় পসরা নিয়ে আসেন, কর আদায় করেন। মধ্য ভারতে মরাঠা, কোম্পানি ও সন্ন্যাসীদের লড়াইয়ের সেই ধূসর সময়ে ক্ষমতার পাল্লাও অস্থির। ব্রিটিশ শাসন এই সন্ন্যাসীদের নিস্তেজ করে দিল। তাঁরা আর কর আদায় করতে পারেন না, সামরিক শক্তিও ভেঙে চুরমার। ঠিক হল, শুধু কুম্ভ স্নানেই সন্ন্যাসীরা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে মিছিল করতে পারবেন।
কে আগে স্নান করবে? মহানির্বাণী ও নিরঞ্জনী আখড়া আগে স্নান করত, পরে জুনা আখড়া। নিরঞ্জনী ও জুনা আখড়ার মধ্যে তিরিশ কদম ব্যবধান থাকার কথা। কিন্তু সন্ন্যাসীসংখ্যা কমা-বাড়ার টানে সেই ব্যবধান নিয়েও টানাপড়েন চলত। আজও নিরঞ্জনী না জুনা, কে আগে স্নান করবে তা নিয়ে কুম্ভমেলায় মাঝে মাঝেই উদ্বেগ।
ভারতীয় রাজনীতির বড় ট্র্যাজেডি এই কুম্ভে। দেশের বামপন্থীরা একে ধর্মীয় পরিসর বলে অচ্ছুত করে রাখেন, আর হিন্দুত্ববাদীরা কাল্পনিক ধর্মীয় ঐতিহ্যে বিভোর থাকেন। কেউই বোঝেন না, মেলার এই পরিসরে বিশ্বাস-অবিশ্বাস, অর্থনীতি, সমরনীতি, গৃহী-সাধু সব একত্রে কয়েকশো বছর ধরে খেলা করেছে। কুম্ভে অমৃত আছে কি না, বড় কথা নয়। ইতিহাসের সামাজিক গতিময়তাটি সেখানে পরতে পরতে। সেই গতিময় ভাঁজগুলি ধরতে না পারলে বিশ্ববাজারও শূন্যকুম্ভ বাগাড়ম্বর।

http://www.anandabazar.com/editorial/kumbh-mela-would-not-have-hapen-if-britishers-didnt-arrived-1.404654#

ধর্মপ্রতিষ্ঠান নিজেকে শোধরালে মঙ্গল (On religious customs under jurisdiction)

ধর্মপ্রতিষ্ঠান নিজেকে শোধরালে মঙ্গল

রণজয় সেন

৭ জুন, ২০১৬, ০০:০৪:০০
Tripti Deshai

সংগ্রাম। মন্দিরে প্রবেশের চেষ্টা করছেন তৃপ্তি দেশাই। নাসিক, মহারাষ্ট্র, ২৬ মে। ছবি: পিটিআই

সুপ্রিম কোর্ট সম্প্রতি বলেছে, কেরলের শবরীমালা মন্দিরে দশ থেকে পঞ্চাশ বছর বয়সি মহিলাদের প্রবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা কত দূর সংবিধানসম্মত, তা খতিয়ে দেখা উচিত। ভারতে ধর্মীয় ঐতিহ্য এবং সংবিধানের সংস্কারমুখী প্রবণতার মধ্যে যে টানাপড়েন চলে আসছে, সর্বোচ্চ আদালতের এই অভিমত সেটাই দেখিয়ে দেয়। ধর্মীয় ঐতিহ্য বা লোকাচারের সংস্কারের প্রয়োজন আছে কি না, সে বিষয়ে যখনই আদালতকে বিচারকের আসনে বসতে হয়েছে, তখনই এই টানাপড়েনের সূত্রপাত ঘটেছে। এই দ্বন্দ্ব অবশ্যই শুধু ভারতের ব্যাপার নয়, অন্যত্রও আছে। কিন্তু ভারতে এটা এক বিশেষ মাত্রা অর্জন করে, কারণ ভারতীয় সংবিধানের ২৫(২) নম্বর ধারার জোরে ধর্মীয় ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করার ক্ষেত্রে ভারতীয় আদালতের একটা ঐতিহাসিক প্রবণতা রয়েছে।
বিভিন্ন ধর্মীয় আচার ও বিধান যাচাই করার জন্য ভারতীয় বিচারব্যবস্থা কালক্রমে তথাকথিত ‘অত্যাবশ্যক প্রথা’র মাপকাঠি তৈরি করেছে, যা দিয়ে স্থির হবে, কোন কোন প্রথা অত্যাবশ্যক (সুতরাং মান্য)। কয়েকটি ধরনের মামলার বিচার করতে গিয়ে আদালত মাপকাঠি ব্যবহার করেছে। যেমন, কোন ধরনের ধর্মীয় আচরণগুলি সাংবিধানিক নিরাপত্তা পাওয়ার যোগ্য, তা নির্ধারণের জন্য, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলি পরিচালনার জন্য প্রণীত আইনের বৈধতা আছে কি না, তার মীমাংসা করার জন্য এবং বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠী বা সংগঠন কত দূর স্বাধীনতা ভোগ করতে পারে, তার বিচারের জন্য আদালত এই পরীক্ষা প্রয়োগ করেছে। বিশেষ করে প্রথমটি শবরীমালা-র ক্ষেত্রে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। কারণ এখানে মন্দির কর্তৃপক্ষ যুক্তি দিয়েছেন যে, মহিলাদের ওপর চাপানো নিষেধাজ্ঞা আদতে তাঁদের ধর্মীয় ঐতিহ্যেরই একটা অংশ।
এই ধরনের মামলার একটা দীর্ঘ তালিকা রয়েছে। এর শুরু হয়েছে ১৯৫৪ সালের ‘শিরুর মঠ’ সংক্রান্ত মামলার রায় দিয়ে। এখানে ‘মাদ্রাজ হিন্দু রিলিজিয়াস অ্যান্ড চ্যারিটেবল এনডাওমেন্ট’-এর অধিকার চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছিল। এবং তার মীমাংসা করতে গিয়ে ধর্ম মানে কী, সেই মৌলিক প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আদালতকে এগিয়ে আসতে হয়েছিল। শিরুর মঠের ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্ট মন্তব্য করেছিল যে, ‘কোন কোন আচার এবং অনুষ্ঠানগুলি অত্যাবশ্যক, সেটা স্থির করার বিষয়ে ধর্মীয় গোষ্ঠী এবং সংগঠনগুলোর সম্পূর্ণ স্বাধিকার আছে... এবং বাইরের কারও কোনও এক্তিয়ারই নেই তাদের এই সিদ্ধান্তে হস্তক্ষেপ করার।’ একই সঙ্গে, আদালত স্পষ্ট করে দিয়েছিল যে, যখনই এই ধরনের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান জনজীবনের শৃঙ্খলা, স্বাস্থ্য এবং নৈতিকতার পরিপন্থী, এবং যখনই সেগুলি— ধর্মাচরণের সঙ্গে যুক্ত হওয়া সত্ত্বেও— চরিত্রে অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক বা রাজনৈতিক, তখন রাষ্ট্র বৈধ ভাবেই তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে।
১৯৫০-এর দশকে আর একটি ঐতিহাসিক রায়ে সুপ্রিম কোর্ট গৌড় সারস্বত ব্রাহ্মণদের এক আবেদন খারিজ করে দেয়। কর্নাটকে শ্রীবেঙ্কটরমন মন্দিরে দলিত এবং অনগ্রসর মানুষদের প্রবেশাধিকার মঞ্জুর করে যে আইন জারি হয়েছিল, এই সম্প্রদায়টি সেই আইন মানা থেকে রেহাই চেয়ে মামলা করে। এ ক্ষেত্রে আদালত সংবিধানের ২৫ নম্বর ধারাটির সংস্কারমূলক দিকটিকে ২৬ নম্বর ধারায় প্রদত্ত গোষ্ঠী-অধিকারের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিল। ধর্মীয় সংগঠনের স্বাধীনতার দাবি এবং ধর্মীয় রীতিনীতি নিয়ন্ত্রণে রাষ্ট্রের ক্ষমতা, এই দুইয়ের টানাপড়েন নিয়ে বার বারই ভারতীয় বিচারব্যবস্থাকে ভাবতে হয়েছে।
যে সব ধর্মীয় প্রথা বা বিধান সাংবিধানিক রক্ষাকবচ পাওয়ার যোগ্য, ১৯৬০-এর দশক থেকে সুপ্রিম কোর্ট ক্রমশই সেগুলির সংখ্যা কমিয়ে এনেছে। যেমন, ‘দরগা কমিটি’ মামলায় আদালত রায় দিয়েছিল, ‘ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান নিছক অন্ধবিশ্বাস থেকেও জন্ম নিতে পারে। সে ক্ষেত্রে এমন হতেই পারে যে, বাইরে থেকে যোগ করা প্রথাটি ধর্মের পক্ষে আবশ্যক ছিল না।’ আরও বলা হয়েছিল, যদি না এই ধরনের রীতিনীতিকে ‘ধর্মের এক অত্যাবশ্যক এবং অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা’ করা না যায়, তা হলে তাদের সাংবিধানিক নিরাপত্তার দাবি খুব সতর্কতার সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে।
শবরীমালা মন্দিরের ক্ষেত্রে আদালতকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, মন্দিরে নারীর প্রবেশাধিকারের ওপর নিষেধাজ্ঞা যথার্থ ধর্মীয় রীতি কি না (মন্দির পরিচালন কর্তৃপক্ষ তেমনটাই দাবি করেছেন), এবং এই নিষেধাজ্ঞা ‘অত্যাবশ্যক প্রথা’র মাপকাঠিতে উত্তীর্ণ হয়েছে কি না। লক্ষণীয়, যে সমস্ত জায়গায় প্রথা (কাস্টম) বা প্রচলনবিধি (ইউসেজ) অনুযায়ী উপাসনাস্থলে নারীর প্রবেশ নিষিদ্ধ হয়েছে, ‘কেরল হিন্দু প্লেসেস অব পাবলিক ওয়ারশিপ (অথরাইজেশন অব এন্ট্রি) রুলস, ১৯৬৫’ সে ক্ষেত্রে ওই নিষেধাজ্ঞাকে অনুমোদন করেছিল। কেরল হাইকোর্টের এক রায়েও বলা হয়েছে, মহিলাদের ওপর এই নিয়ন্ত্রণ বহু শতাব্দীব্যাপী প্রচলিত এক ধারার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। কিন্তু, প্রথম দিকের মামলাগুলোর মতোই, সুপ্রিম কোর্ট সিদ্ধান্ত নিতে পারে যে, শবরীমালায় মহিলাদের প্রবেশের ওপর নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থাটি ‘অত্যাবশ্যক প্রথা’র মাপকাঠিতে উত্তীর্ণ হয়নি। এমনকী, ১৯৬৫ সালের উল্লেখিত বিধিটিকে সুপ্রিম কোর্ট এই যুক্তিতেও নাকচ করতে পারে যে, সেটি লিঙ্গ-বৈষম্যকে প্রশ্রয় দিচ্ছে এবং একই সঙ্গে মেয়েদের উপাসনার স্বাধীনতাকেও খর্ব করছে। এই দুটোই সংবিধানের পরিপন্থী।
কিছু দিন আগে মুম্বই হাইকোর্ট মহারাষ্ট্রের শনি শিংনাপুর মন্দিরে মহিলাদের প্রবেশের পক্ষে রায় দিয়ে এ বিষয়ে এক নজির সৃষ্টি করেছে। আদালত বলেছে, পুরুষরা যদি উপাসনা স্থানে প্রবেশের অনুমতি পেতে পারে, তা হলে নারীদেরও তা পাওয়া উচিত। দুই মহিলা আন্দোলনকারীর করা জনস্বার্থের মামলার প্রেক্ষিতে মুম্বই হাইকোর্ট এই রায় দেয়। ওঁরা দাবি করেছিলেন, উপাসনালয়ে মহিলাদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আসলে মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন ছাড়া কিছুই না এবং তা ‘মহারাষ্ট্র হিন্দু প্লেসেস অব পাবলিক ওয়ারশিপ (এন্ট্রি অথরাইজেশন) অ্যাক্ট, ১৯৫৬’-এর পরিপন্থীও বটে।
সুপ্রিম কোর্ট যে সিদ্ধান্তই নিক না কেন, এটা দুর্ভাগ্যজনক যে, যথার্থ ধর্ম কাকে বলে তা স্থির করার দায় বিচারব্যবস্থার কাঁধে এসে পড়ছে। রাজীব ধবন এবং ফলি নরিম্যানের মতো সংবিধান-বিশেষজ্ঞ আইনজীবীরা বলেছেন, বিচারকরা এখন ‘কার্যত ধর্মতত্ত্বের হর্তাকর্তায় পরিণত হয়েছেন, একটি ধর্মবিশ্বাসের পক্ষে কোন কোন ধারণা বা প্রথা ‘অত্যাবশ্যক’, সেটা তাঁরাই নির্ধারণ করছেন।’ এর কারণ হল, ভারতীয় রাষ্ট্র হিন্দুধর্ম এবং তার প্রতিষ্ঠানগুলি পরিচালনা ও সংস্কারের ভারপ্রাপ্ত প্রতিনিধি হয়ে উঠেছে। এই প্রেক্ষিতে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্রতাপভানু মেটার মন্তব্য তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি বলেছেন, ‘যদি সমস্ত কমিউনিটি ক্রমশ এটা স্বীকার করে নেয় যে, ব্যক্তিস্বাধীনতা, বৈষম্যমুক্ত আচরণ এবং সমতার অনুকূলে উত্তরণই নৈতিক এবং সামাজিক দাবি, বিশেষ করে মেয়েদের সমানাধিকার মেনে নেওয়া যে অত্যাবশ্যক’, তা হলেই মঙ্গল। যত দিন তা না হচ্ছে, তত দিন ধর্মীয় বিবাদকে আদালতে টেনে নিয়ে যাওয়ার এই প্রবণতা চলতেই থাকবে।
ইতিহাসবিদ, ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুর (এনইউএস)

http://www.anandabazar.com/editorial/on-the-way-to-redemption-1.404660#