Saturday, 20 February 2016

মন কি বাতঃ এক দেশদ্রোহীর জবানবন্দী

মন কি বাতঃ এক দেশদ্রোহীর জবানবন্দী (দ্বিতীয় পর্ব)

আফজল গুরু। দেশের শত্রু। পার্লামেন্ট অ্যাটাকের মূল অভিযুক্ত।
আপনারা অনেকে দেখেছেন নিশ্চয়ই, ছোটবেলায় বাড়িতে মুরগি পোষা হত? কয়লার ঘরে, উঠোনে মুরগিটা খেলে বেড়াত বাড়ির লোকের সজাগ দৃষ্টির আওতার মধ্যে? তারপর কোনও এক রবিবারে, বা বিশেষ কোনও উপলক্ষ্যে, সেই মুরগিটাকে কাটত আপনারই বাড়ির কেউ। দুপুরে রাতে সেদিন গরগরে মাংসের ঝোল। মনে পড়ে? নস্টালজিয়া?
গ্রামে মফসসলে আজও মুরগি পোষা হয়, এই কারণে। ভারতীয় সেনাও মুরগী পোষে। তাদের নাম, কাশ্মীরি সন্ত্রাসবাদী। আতঙ্কবাদী। অলগাওবাদী। যে সমস্ত সন্ত্রাসবাদী হিংসার পথ ছেড়ে সেনার কাছে আত্মসমর্পণ করত, বা এখনও করে – সেনা তাদের পুনর্বাসন দেয়, ঘরে ফিরিয়ে দেয়, অবশ্যই তাদের ওপর সজাগ দৃষ্টি রেখে। হিংসার পথ ছেড়ে এসে তারা ঘর বাঁধে, সাদাসিধে গৃহস্থ জীবন। শুধু আর্মির কাছে নিয়মিত হাজিরাটা দিয়ে যেতে হয়, মাঝে মাঝে ইনফর্মার বা আইডেন্টিফায়ারের কাজও করতে হয়, তাতে প্রাক্তন সহযোদ্ধাদের হাতে খুন হবার চান্স আরও বেড়ে যায়, তাই সেনাবাহিনি তাদের আইডেন্টিটি গোপন রাখে খুব সাবধানতার সঙ্গে।
কিন্তু, এত কাজ কি শস্তায় হয় নাকি? দেখাশোনা করার একটা পারিশ্রমিক নেই? প্রায়শই সেনাবাহিনির অফিসার হানা দেন হিংসার পথ ছেড়ে আসা সেই কাশ্মীরির কাছে, টাকা বা অন্য “কাইন্ড” দাবি করেন। ধার করে, ঘরের জিনিস বেচে, বন্ধু বা অন্য কারুর থেকে ধার করে, সেনা অফিসারের টাকার খাঁই মেটানোর চেষ্টা করে অসহায় সেইসব প্রাক্তন জঙ্গী। যে অপরাধ একবার সে করে ফেলেছে, তার প্রায়শ্চিত্ত করে যায় সে সারা জীবন ধরে। বদলে পায় জীবনের নিরাপত্তা। কাশ্মীর ছেড়ে যাবারও হুকুম থাকে না তার।
একটা গল্প বলি। গল্প হলেও সত্যি ঘটনা। ভেবেছিলাম একটা উপন্যাসে একটা চরিত্রকে সাজাবো এইভাবে, কিন্তু সময়ের দাবিতে গল্পটা এখানেই বলে ফেলি।
২০১২ সালে সপরিবারে যখন লাদাখ শ্রীনগর ঘুরে এসেছিলাম, তার পরে সিকিনীর অফিসের আরও দু একজন কাশ্মীর, লাদাখ ইত্যাদি বেড়াতে যান। এমনি একজন কাশ্মীর ঘুরে এসে কাহিনিটি জানিয়েছিলেন। … তাঁরাও ডিফেন্স মিনিস্ট্রির এমপ্লয়ি, তাই যাওয়া, থাকা, বেড়ানো, সমস্ত ব্যবস্থাই করেছিলেন আর্মির হাত ধরে। বেড়ানোর মধ্যে এক-দুদিন ছিল গুলমার্গে ঘোরা। যে আর্মি অফিসার তাঁদের গুলমার্গ ঘোরার দায়িত্বে ছিলেন, তিনি লোকাল একটি কাশ্মীরি ছেলেকে তাদের অ্যাসাইন করে দেন গাইড হিসেবে – এ-ই আপনাদের ঘুরিয়ে দেখাবে।
তা, সে ঘুরিয়ে দেখায়, কিন্তু কেন জানি, তার চাউনি, কথা বলার স্টাইল – খুব স্বাভাবিক লাগছিল না ঘুরতে যাওয়া সেই ভদ্রমহিলার। চোখ যেন জ্বলছে কীসের আগুনে, এই রকমভাবে আমাকে বলেছিলেন উনি। সে ছেলে তাঁদের নিয়ে গন্ডোলা রাইড করায়, ঘোড়ার পিঠে বসিয়ে ঘুরিয়ে দেখায় গুলমার্গের আনাচ কানাচ। এমনি একটা সরু পায়ে চলা রাস্তা দেখিয়ে সে জানায়, এই রাস্তা ধরে সোজা হাঁটলে, পাহাড় পেরোলেই পাকিস্তান যাওয়া যায়। পাকিস্তান থেকে জঙ্গীরা এই রাস্তা ধরেই আসে।
ভদ্রমহিলা ক্যাজুয়ালিই জিজ্ঞেস করেন, তুমি দেখেছো পাকিস্তানি জঙ্গীদের?
ছেলেটি উত্তর দেয়, হ্যাঁ দেখেছি। ওরা আমাদের গ্রামে এসেছিল, বেশ কয়েকজনকে খুন করে গেছিল আমার চোখের সামনে।
– তা তোমার আর্মির সাথে এমন জানাশোনা, জানাও নি? আবার এলে কী করবে?
নিমেষে বদলে গেছিল ছেলেটির মুখ, একমুখ আগুন নিয়ে শুধু বলেছিল, আর্মি কো নেহি চাহিয়ে, আমি একলাই ওদের মেরে ফেলতে পারি।
কী রকম যেন আন্দাজ করে ভদ্রমহিলা আর কথা বাড়ান নি। সন্ধ্যেবেলা আর্মি গেস্টহাউসে সেই অফিসার আসেন ডিউটির শেষে। ছেলেটি তার আগেই চলে গেছে তার বাড়ি। অফিসার এই মহিলাকে জিজ্ঞেস করেন, কেমন ঘুরলেন আজকে?
মহিলাটি জানান, ভালোই। খুব সুন্দর জায়গা গুলমার্গ।
– আর ছেলেটি? ঠিকঠাক ঘুরিয়েছে তো?
এইবারে আর চেপে রাখতে না পেরে তাঁর মনের অস্বস্তির কথা অফিসারটিকে জানান ভদ্রমহিলা। অফিসার মন দিয়ে শোনেন, এবং মুচকি হেসে বলেন, ভয় নেই, ওর টিকি বাঁধা রয়েছে আমাদের হাতে। ও একজন আত্মসমর্পণ করা কাশ্মীরি জঙ্গী। এখন আর্মির আন্ডারে গাইডের কাজ করে।
আফজল গুরু ছিল, এই রকমই একজন আত্মসমর্পণ করা সন্ত্রাসবাদী। “সন্ত্রাসবাদী” বললাম বটে, কিন্তু বিশ্বাস করুন, আফজল জীবনে কোনওদিন কোনও “সন্ত্রাস” করে নি। কাশ্মীরের সেই উত্তপ্ত অবস্থার মধ্যে কী ভাবে আফজলেরা জন্ম নেয়, আপনাদের বলেছি, এই আফজলও সেইভাবেই কাশ্মীরকে আজাদ করার তাগিদে সীমা পেরিয়ে চলে যায় পাকিস্তান, জিহাদি ট্রেনিং নিতে। কিন্তু এক মাসের মধ্যে তার ভুল ভাঙে, ট্রেনিং-এ যে হিংসার শিক্ষা তাকে দেওয়া হয়েছিল, তা সে মন থেকে মেনে নিতে পারে নি। পালিয়ে আসে জিহাদি ক্যাম্প থেকে। আবার ভারতের কাশ্মীরে – এবার সে ধরা পড়ে ভারতীয় সেনার হাতে এবং আত্মসমর্পণ করে তার পুরো ঘটনা আত্মোপলব্ধি জানায়। আর্মি মুচকি হেসে তাকে পুনর্বাসন দেয়, সুন্দর স্বাস্থ্যবান একটি মুরগি পাওয়া গেছে।
কিন্তু একবার “আতঙ্কবাদী” তকমা লেগে গেলে তো নিশ্চিন্ত জীবন আর কাটানো যায় না। নানা কারণে অছিলায় আর্মি অফিসার আসত, অন্যান্য মুরগিদের সাথে তাকে উত্যক্ত করার জন্য। খুশি করতে না পারলে যে আরও বড় লাঞ্ছনা থাকে, কপালে। খুশি করতে না পারার অপরাধে, চোখে চোখে রাখার সাত বছর পরেও আফজলকে নিজেদের হেফাজতে নেয় এসটিএফ। ছ মাস লেগেছিল এক লক্ষ টাকা জোগাড় করতে, আফজলের পরিবারের। মুক্তির জন্য ওই দামটাই ধার্য করেছিল ভারতের স্পেশাল টাস্ক ফোর্স। ছ মাস বাদে আফজল মুক্তি পায়। নজরদারী চলতেই থাকে তার ওপর।
দু দিন আগেই রৌহিনের লেখা আমার ব্লগে তুলেছি, এখানে পড়ে নিতে পারবেন তার পরে কী কী ভাবে আফজলকে জড়িয়ে ফেলা হয় সংসদ ভবন আক্রমণের একজন চক্রী হিসেবে। নতুন করে আর সেগুলো লেখার দরকার নেই। কেস চলে, আফজল সমেত তিনজনের ফাঁসির আদেশ হয় প্রথমে। আফজল, শওকত, গিলানী। শওকতের সাজা পরে কমে পাঁচ বছরের সশ্রম জেল হয়। গিলানী বেকসুর মুক্তি পান।
তিনজনকার বিরুদ্ধেই একই চার্জ ছিল। দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। কিন্তু কোনওটাই প্রমাণ করা যায় নি। তা হলে কী হবে? শওকত আর গিলানীকে না হয় রেহাই দেওয়া গেল, তাই বলে আফজলকেও রেহাই দিতে হবে? মুরগিটাকে দশ এগারো বছর ধরে পোষা হয়েছে, এখনও যদি দেশপ্রেমের মশলা দিয়ে মাংসের ঝোল না বানানো যায়, তবে আর মুরগি পোষা কী জন্য? বাকি দুজনের না হয় “টেররিস্ট” ব্যাকগ্রাউন্ড নেই, কিন্তু আফজলের তো আছে, অন্তত আর্মির খাতায়? না হয় সে কোনও টেরর করে নি এর আগে, কিন্তু পাকিস্তানে গেছিল তো? এক মাস জিহাদি ট্রেনিং নিয়েছিল তো? একেও যদি ছেড়ে দিতে হয় – আরোপ একটাও কোর্টে সাব্যস্ত করা যায় নি বলে, তা হলে দেশের হইবে কী? দেশভর্তি জাতীয়তাবাদী নাগরিক কী ভাববেন? জনমানসে এর কী প্রতিক্রিয়া পড়বে? পার্লামেন্ট অ্যাটাক হয়েছিল ২০০১ সালে, দেশে তখন বিজেপি-এনডিএ সরকারের জমানা। আর বিচার চলতে চলতে এখন ইউপিএ সরকারের রাজত্ব। বিজেপি যদিও কান্দাহার কাণ্ডের সামনে মাথা ঝুঁকিয়ে এক জঙ্গীকে জেল থেকে মুক্ত করে পৌঁছে দিয়ে এসেছিল আফগানিস্তানে, তাই বলে এখন ইউপিএ আফজলকে ছেড়ে দিলে কি বিজেপি ক্ষমা করবে? ক্ষমা করবে, আসমুদ্রহিমাচল দেশবাসীর জাতীয়তাবোধ?
অতএব, নাথিং লেস দ্যান ফাঁসি। সুপ্রিম কোর্টের ফাইনাল জাজমেন্টে লেখা হয়, নিখুঁত নিশ্ছিদ্র প্রমাণের থেকেও জোর দেওয়া হয় “জাতির বিবেকের” ওপর। সংসদের ওপর আক্রমণ, দেশের গণতন্ত্রের সৌধের ওপর আক্রমণ। “Afzal is characterised as a “menace to the society”, whose “life should become extinct” to satisfy “the collective conscience of the society.”।
বিস্তারিত লিখব না, সমস্তই রৌহিনের লেখাটায় দেওয়া আছে, একবার পড়ে ফেলতে পারেন। যে সমস্ত তথ্যপ্রমাণের ওপর ভিত্তি করে এই কেস দাঁড় করানো হয়েছিল, সেই সমস্ত তথ্যপ্রমাণই ধসে যায় একে একে। গিলানী নির্দোষ প্রতিপন্ন হন, কিন্তু একই লজিকে আফজলকে কম দোষী সাব্যস্ত করা যায় না। তাই, কনসেনসাস বিল্ডিং। মতাদর্শ নির্মাণের রাস্তা নেয় সরকার। আজ তক টিভিতে চলে আসে আফজলের বিস্ফোরক স্বীকারোক্তি। কেউ জানে না, জানতে চায়ও না, কী অবস্থায় আফজলকে দিয়ে এই ইন্টারভিউটা শুট করানো হয়েছিল। কারুর মনে প্রশ্ন আসে না, মৃত্যুদণ্ড পাওয়া একজন আসামী কী করে টিভি স্টুডিওতে বসে শান্ত মুখে ইন্টারভিউ দিতে পারে, ভারতে কেন, পুরো পৃথিবীতে এমন ঘটনা আগে ঘটেছে কিনা।
জানার দরকার হয় না। দেশপ্রেম, দেশভক্তির কাছে যুক্তি, প্রমাণ – এরা সবসময়েই নতজানু। আফজলের তাই ফাঁসি হয়ে যায়। তাই নিয়ে প্রতিবাদ দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। আফজলের জন্য ওয়েবসাইট চলছে, আফজলের হয়ে দীর্ঘদিন ধরে লেখালিখি করে আসছেন এন ডি পাঞ্চোলি – লিখেছেন বিশিষ্ট রাজনীতি-ইতিহাসবিদ নির্মলাংশু মুখার্জি, লিখেছেন নামকরা কলামনিস্ট শুদ্ধব্রত সেনগুপ্ত, আফজলের বিরুদ্ধে হওয়া অন্যায়ের বিরুদ্ধে কলম ধরেছেন আরও অনেকে। দেশপ্রেমিকরা সে সব পড়বেন না – দেশের নেতারা সে সব নস্যাৎ করে দেবেন, বেঁচে থাকবে শুধু একটা দুটো স্বর। আফজলকে সাপোর্ট করে কী সাহসে? বলে কিনা, আফজল হম শর্মিন্দা হ্যায়, তেরে কাতিল জিন্দা হ্যায়? এ কি সরাসরি দেশদ্রোহিতা নয়? সুপ্রিম কোর্টকেও প্রশ্ন করে ফেয়ার জাজমেন্ট নিয়ে? দেশের আইনে আস্থা রাখে না?
ভয় করে। কানহাইয়া জেএনইউ-র ছাত্র, তার জন্য হাজার হাজার লোক পথে নামতে পারে, আমার জন্য কেউ নামবে না পথে, আমি জানি। তবু বলতে চাই, এই একটি কেসে নয়, সুপ্রিম কোর্ট একাধিক কেসে আমার ভরসা হারিয়েছে – মজবুত তথ্যপ্রমাণের থেকে “সমাজের ভাবাবেগ”কে প্রাধান্য দিয়েছে জাজমেন্ট দেবার সময়ে। যদিও, আমিও যে সমাজের একজন, আমার ভাবাবেগ কী – সেটা জানার চেষ্টা করে নি কোর্ট। অ্যাজিউম করে নিয়েছে মেজরিটি এই চায়, অতএব এই শাস্তি হোক। আবার ভরসা জুগিয়েছেও অনেক ক্ষেত্রে। এই যেমন কদিন আগে, কানহাইয়াকে পাটিয়ালা হাউস কোর্ট চত্বরে পেটানোর খবর পাওয়া মাত্র সুপ্রিম কোর্ট বরিষ্ঠ উকিলদের দল পাঠিয়ে দিয়েছিল সেখানে, পরিস্থিতি সামলানোর জন্য। এখানেই তো ভরসা পাই, এই তো গণতন্ত্রের ভরসা।
সুপ্রিম কোর্ট তো ভগবান নয়।, কিছু মানুষই তো চালান। মানুষের কি ভুল হয় না? হয়। সে ভুল যদি আমার চোখে পড়ে, আমি বলব না? সেটা বলা মানে সুপ্রিম কোর্টকে অপমান করা? দেশদ্রোহিতা? সমীকরণ এত সোজা? আফজলের ফাঁসির বিরুদ্ধে ওঠা প্রতিবাদকে দাগিয়ে দেওয়া হয় “দেশদ্রোহীকে সমর্থন”, “আফজলকে সমর্থন”? জঘন্যভাবে এডিট করা কিছু ভিডিও ফুটেজের ভিত্তিতে পুলিশ ক্যাম্পাসে ঢুকে তুলে নিয়ে যায় কানহাইয়া কুমারকে? আনন্দবাজার তার স্বভাবসিদ্ধ উইচহান্ট প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ভিলেন বানিয়ে দেয় জুবি সাহা আর তার দলকে? মিডিয়া ট্রায়াল ঢুকে পড়ে আমাদের ঘরের মধ্যে?
(৫)
যে কদিন এই লেখার কথা ভেবেছি, যে কদিন এই লেখা লিখেছি, ততদিনে জল গড়িয়েছে অনেকটা। লেখার খাতা খুলেছিলাম কানহাইয়াকে নিয়ে কিছু লিখব বলে, কিন্তু ওর জন্যই কিছু লেখা হল না। না হোক। কানহাইয়াকে নিয়ে অনেকেই লিখছে। আজ, উনিশে ফেব্রুয়ারি অনেকেই জেনে গেছে, কীভাবে ফেক ভিডিও ফুটেজের জন্য কানহাইয়াকে গ্রেফতার হতে হয়েছে, মার খেতে হয়েছে আদালত চত্বরে আইনজীবিদের হাতে। আর টিভি মিডিয়া, প্রিন্ট মিডিয়া, সোশাল মিডিয়াতে তো তার ট্রায়াল চলছেই অনবরত, ফাঁসির নিচে কোনও কথাই ভাবতে রাজি নন দেশভক্ত জনগণ।
এত কিছু পড়ে ফেলার পর, এখন কি মনে হচ্ছে না, হে দেশপ্রেমিক, যে আপনাদের প্রতিক্রিয়াটা খুব হাঁটুকাঁপা প্রতিক্রিয়া হয়ে গেছিল? নী-জার্ক রিয়্যাকশন? দেশপ্রেমের একটাই সংজ্ঞা হয়? সোলি সোরাবজি পর্যন্ত বলেছেন, কানহাইয়া “বলেছে” বলে যে কথা চালানো হচ্ছে, তা যদি কানহাইয়া বলেও থাকে, তাতে সিডিশন হয় না। বড়জোর একবার বকে দেওয়া যেতে পারে, সেটা ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষই করে দিতে পারত। পুলিশের দরকার একেবারেই ছিল না। আপনারা, দেশপ্রেমিকরা, সোলি সোরাবজির থেকেও কি বেশি বোঝেন, আইন?
তাই বলি, স্যার, ম্যাডাম, ভাবুন। ভাবা প্র্যাকটিস করুন। যাহা চোখের সামনে দেখা যায়, তাহাই পরম সত্য নয়। সত্যেরও রকমারি রঙ হয়, পূর্বাপর হয়। আর রাষ্ট্রশক্তির আগ্রাসনকে চিনতে শিখুন, তার প্রতিবাদ করতে শিখুন। এর আগেও আরেকটা লেখাতে আমি একটা কবিতা লিখে দিয়েছিলাম, আজ আবার সেটা পুনরুক্ত করি –
First they came for the Socialists, and I did not speak out—
Because I was not a Socialist.
Then they came for the Trade Unionists, and I did not speak out—
Because I was not a Trade Unionist.
Then they came for the Jews, and I did not speak out—
Because I was not a Jew.
Then they came for me—and there was no one left to speak for me.
[প্রথমে ওরা এসেছিল সোস্যালিস্টদের খুঁজে বের করতে, আমি কিছু বলি নি –
কারণ, আমি তো সোস্যালিস্ট নই।
তারপরে ওরা এল ট্রেড ইউনিয়নিস্টদের খুঁজতে, আমি কিছু বলি নি –
কারণ, আমি তো ট্রেড ইউনিয়নিস্ট নই।
তার পরে ওরা এল ইহুদীদের খুঁজে বের করতে, আমি কিচ্ছুটি বলি নি –
কারণ, আমি তো ইহুদী নই।
আজ ওরা এসেছে আমাকে ধরতে, আজ আমার হয়ে কথা বলবার জন্য আর কেউ নেই। ]
মনে রাখবেন, দাদারা, দিদিরা, যদি এই আগ্রাসন সময়মত চিনতে না পারেন, তা হলে যেদিন আপনার সময় আসবে, কেউ থাকবে না আপনার পাশে। সারা দেশ, সারা জাতি আপনার ফাঁসি চাইবে। তবে আমি যদি বেঁচে থাকি, আমি লিখব আপনার জন্য, আমি আবার হাঁটব রাজধানীর রাস্তায়, যেমন কাল হেঁটেছিলাম।
(৬)
শেষ করব, আরেকটা ছোট গল্প দিয়ে।
দুটো দেশ, ক আর খ। ক-এর অধিকারে আছে খ। খ-দেশের লোকজন অনেকেই এই অধিগ্রহণে অখুশি। তারা ক-এর সমালোচনা করে, প্রকাশ্যে। যদিও তেমন কোনও দমন-পীড়ন চলে না, কালচারাল কনফ্লিক্টও নেই, জোর করে ক-এর খ-বিরোধী নীতি খ-এর ওপর চাপিয়ে দেওয়ার গল্প নেই, তবু – স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে, কে বাঁচিতে চায়।
অখুশি খ-বাসীদের দাবি প্রবল হয়ে উঠল। আমরা ক-এর থেকে আলাদা হতে চাই। আশ্চর্য, কেউ তাদের দেশবিরোধী আইনে জেলে পুরল না। যারা ক-পন্থী, তাঁরা মুচকি হাসলেন ঠিকই, কিন্তু খ-পন্থীদের মুখে রুমাল বেঁধে দিলেন না। কেউ বললেন না, ফাঁসি চাই। কেউ বললেন না, যে দেশের মাটিতে খাও, সেই দেশের বিরুদ্ধে আওয়াজ ওঠাও? এক্ষুনি গ-দেশে চলে যাও। ক-বিরোধীদের ক বা খ, কোথাওই জায়গা নেই।
শেষে ঠিক হল ভোট হবে। দেখা যাক, কে জেতে। খ আলাদা দেশ হবে, নাকি ক-এর অংশ হয়েই থাকবে?
ভোট হল। খ-পন্থীরা হেরে গেল। খ তাই আলাদা দেশ হল না, ক-এর সাথেই রয়ে গেল। খ-পন্থী এবং ক-পন্থীরা পরস্পরের সাথে হ্যান্ডশেক করলেন, এবং দাবি থেকে সরে আসলেন। একটিও মারপিট হল না, দাঙ্গা হল না।
রূপকথা নয়। ক দেশটির নাম ইংলন্ড, খ দেশটির নাম স্কটল্যান্ড।
গ দেশের নাম জানি না, ওটা কাল্পনিক।

http://achalsiki.com/2016/02/17/%E0%A6%86%E0%A6%AB%E0%A6%9C%E0%A6%B2-%E0%A6%97%E0%A7%81%E0%A6%B0%E0%A7%81-%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%9A%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%A3%E0%A7%80-%E0%A6%A8/

No comments:

Post a Comment