আমার পাড়া মানে কৈলাস বোস স্ট্রিট। যেখানে সুখে-দুঃখে, আবেগে, স্মৃতিতে কাটিয়েছি জীবনের ৬৩টা বছর। আপাতদৃষ্টিতে আর পাঁচটা পাড়ার মতোই, তবু অনেকটাই আলাদা। পাড়ার পরতে পরতে মিশে থাকা আকর্ষণটাই ধরে রেখেছে সকলকে। ক্লান্ত দিনের শেষে পাড়া-পাড়া যে গন্ধটা আনে স্বস্তির আমেজ।
আমহার্স্ট স্ট্রিট থেকে শুরু হয়ে কৈলাস বোস স্ট্রিট সোজা এসে মিশেছে বিধান সরণিতে। তার মধ্যেই পড়ে বৈষ্ণব সম্মিলনী লেন, দক্ষিণে যদুনাথ সেন লেন, প্রাণনাথ সেন লেন, ঝামাপুকুর লেন, বলাই সিংহ লেন, মদন মিত্র লেন আর বাড়ির সামনে সুকিয়া রো। এক কালে এ সব চত্বরেই বাস ছিল কয়েক জন বিখ্যাত মানুষের— আমহার্স্ট স্ট্রিটে রাজা রামমোহন রায়ের বাড়ি, কর্নওয়ালিস স্ট্রিটে স্যার কৈলাস বোসের বাড়ি, সুকিয়া রো-তে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের। কাছাকাছিই থাকতেন জাদুকর পিসি সরকার (সিনিয়র)ও।
ভোরে ঘুম ভাঙত পাখির ডাক, টানা রিকশার ঠং ঠং শব্দ আর রেডিওর সুরে। চাবিওয়ালার ঝনঝনানি, খঞ্জনি বাজিয়ে গান গেয়ে যাওয়া সেই বৈষ্ণব ভিক্ষুক, শিলকাটাইয়ের সজাগ ডাক বেলা বাড়ার ইঙ্গিত দিত। এখন ঘুম ভাঙে যানবাহনের শব্দ আর কোলাহলে। ভোর থেকেই রাস্তায় অসংখ্য মানুষ আর গাড়ি। ভোরের সেই আমেজটাই বদলে গিয়েছে।
কাছেই লোহা পট্টি। লোহা কেনা-বেচার ব্যবসা এখানে মূলত অবাঙালি সম্প্রদায়ের। রাস্তায় সার দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে তাদের পণ্যবাহী লরি এবং যত্রতত্র গাড়ির পার্কিং। ফলে গাড়ি নিয়ে পাড়ায় ঢুকতে-বেরোতে সমস্যা হয়। এর জন্য থানা-পুলিশও করতে হয়েছে। আরও একটা বড় সমস্যা তৈরি হয়েছে এ পাড়ায়। অন্ধকারে ফুটপাথে দাঁড়িয়ে থাকা লরির আড়ালে ছোট ছোট পাউচে চলে চোলাইয়ের বেচাকেনা। বার বার পুলিশ ও প্রশাসনকে জানিয়েও লাভ হয়নি। সেই সঙ্গেই অপরিষ্কার থাকে ভোরের ফুটপাথ। তাই প্রাতর্ভ্রমণের জায়গাটাই বদলাতে হলো। এখন দেশবন্ধু পার্কে গিয়ে প্রাতর্ভ্রমণ সারি।

ছবি : শুভাশিস ভট্টাচার্য
এ পাড়ায় নাগরিক পরিষেবার উন্নতি হয়েছে ঠিকই। কাউন্সিলর সাধনা বসু সহযোগিতার চেষ্টা করেন। সমস্যায় তাঁকে পাশে পাওয়া যায়। এখানে জল জমার সমস্যাও এখন অনেক কম। তবে সচেতনতা না থাকায় চারপাশ পরিচ্ছন্ন রাখা যাচ্ছে না সে ভাবে। রাস্তা সাফাই হওয়ার পরপরই আছড়ে পড়ে প্লাস্টিকবন্দী জঞ্জাল। কখনও গভীর রাতে বাড়ি ফেরার সময় দেখি রাস্তায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আবর্জনা।
এ পাড়ার পুজোও কম আকর্ষণীয় নয়। আমাদের ও চ্যাটার্জি বাড়ির প্রাচীন পুজো ছাড়াও কয়েকটি সর্বজনীন পুজোও হয় এখানে। তাতে বাঙালি-অবাঙালি প্রতিবেশীর সপ্রতিভ অংশগ্রহণ দেখে ভাল লাগে। এখানের কয়েকটি ক্লাবের উদ্যোগে রক্তদান শিবির, আঁকা প্রতিযোগিতা ও কম্বল বিতরণ হয়। কাছাকাছি রয়েছে শ্রীমানি বাজার, কলেজ স্ট্রিট বাজার ও মানিকতলা বাজার। মাছ-পাগল বাঙালির কাছে শেষটাই সম্ভবত সেরা ঠিকানা।
আমার ছোটবেলার পাড়াটা অবশ্য অন্য রকম ছিল। বেশির ভাগ বাড়ি ছিল দোতলা। দরজার দু’পাশে রক। সেখানে সকাল-সন্ধ্যা-রাতে জমজমাট আড্ডা। তখন অফিস থেকে ফিরে যত রাতই হোক পাড়ার মানুষ চায়ের দোকানে, কিংবা কোনও একটা রকে আড্ডা দিতে যেতেন। এখনকার ছেলেরা দেখি রকে বসে আড্ডা দিতে লজ্জা পায়। তাদের পছন্দ অভিজাত শপিং মল কিংবা ফুড কোর্ট। চায়ের দোকানে বা বাড়ির সামনে এখন বিক্ষিপ্ত ভাবে আড্ডা দেন শুধু কিছু বয়স্ক মানুষ। পাড়ার আড্ডায় ভাঙন শুরু অবশ্য সেই নকশাল আমল থেকেই। দখল হওয়ার আশঙ্কায় কেউ কেউ রক ভেঙে দিয়েছিলেন, কেউ বা সেগুলো ঢালু করে তার উপরে কাচ বসিয়ে দেন। সত্তর দশকের সে সময়টায় দিন ছিল উত্তপ্ত। এখন পাড়াটা অনেক শান্তিপূর্ণ।
এ পাড়াতেও এখন শুরু হয়েছে ফ্ল্যাট কালচার। কিছু পুরনো বাড়ি ভেঙে বহুতল হয়েছে। সন্ধ্যার পরে সবাই বসে যায় টিভির সামনে। আগেকার মতো বাড়ি বাড়ি যোগাযোগটা সে ভাবে আর নেই। তবু রাস্তাঘাটে দেখা হলে পুরনো বাসিন্দাদের মধ্যে আলাপচারিতা হয় আজও। তবে এ অঞ্চলে বেশির ভাগ চিকিৎসক এখন রোগীর বাড়িতে আসতে চান না। মনে পড়ে যায় চিকিৎসক ভোলানাথ পাইন, সুকান্তি হাজরা, অম্বিকা দত্ত, নিমাইচাঁদ বড়ালের কথা। যাঁরা রাত-বিরেতেও রোগীর বাড়ি যেতেন।
ছুটির দিন এ পাড়ার রাস্তায় ফুটবল, ক্রিকেট খেলা হতো। তখন এত গাড়ির যাতায়াত ছিল না। পার্কের ফুটবল টুর্নামেন্ট ঘিরে পাড়াপড়শির উৎসাহও কিছু কম ছিল না। এখন মাঝেসাঝে পাড়ার অবাঙালি ছেলেরা রাস্তায় খেললেও বাঙালিদের মধ্যে খেলাধুলোর ইচ্ছেটা
যেন অনেকটাই কম। ছোটরা আর স্কুল থেকে ফিরে মাঠে খেলতে যায় না, ছাদে ঘুড়িও ওড়ায় না। সেই জায়গা করে নিয়েছে ডেস্কটপ, ইন্টারনেট, স্মার্ট ফোন আর ফেসবুক। সান্ধ্য-বিনোদনের হাজারো হাতছানিতে কমেছে বইপড়ার অভ্যাসটাও।
আগে পাড়ার কিছু মানুষ বিপদে-আপদে পাশে এসে দাঁড়াতেন। যেমন পাড়ার ছোটুদা। ভাল নাম সৌমেন ভোঁস। আশির দশকে পাড়ার ঘন ঘন চুরি হওয়ায় তাঁরই উদ্যোগে রাত-পাহারার ব্যবস্থা হয়েছিল। প্রতিটি বাড়ির সদস্যদের এক-এক রাতে পাহারায় সামিল হতে হতো। এতে যোগ দিয়েছিলেন অবাঙালিরাও। পাড়ার কোণে একটা চালা তৈরি করে রাতে বসার জায়গা হয়েছিল। ছোটুদার বাড়ি থেকে রাতে দু’বার চা আসত। পাহারা দেওয়ার পাশাপাশি চলত রাত জেগে দেদার আড্ডা।
হারিয়ে গিয়েছে এ পাড়ার তুবড়ি প্রতিযোগিতা, বিশ্বকর্মা পুজোয় ঘুড়ি, আরও কত কী! পাড়াটা কী ভাবে যে তবু এত টানে! যার মায়াবী বলে সুখে-দুঃখে পাড়া-পড়শি এখনও ভালই আছি।

লেখক ব্যবসায়ী

http://www.anandabazar.com/calcutta/increase-of-glamour-have-diminished-the-heartfelt-attraction-1.302239