Saturday, 6 February 2016

চাকচিক্য বাড়লেও হারিয়েছে অন্তরের টান

চাকচিক্য বাড়লেও হারিয়েছে অন্তরের টান

চিত্ততোষ মুখোপাধ্যায়

৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ০১:৫২:০৪

‘তান-গান-সুর এই নিয়ে ভবানীপুর।’ লোকমুখে প্রচলিত কথাটা শুনে ছোট থেকেই পাড়া নিয়ে বেশ গর্ববোধ করতাম। তবে গর্ব করার আরও একটা কারণ ছিল। খোদ রাজপথের ধারের পাড়া বলে, আমার পাড়াটা আর পাঁচটা পাড়ার চেয়ে বরাবরই আলাদা।
৭৭ নম্বর আশুতোষ মুখার্জি রোড, আমার ঠাকুরদা স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের বসতবাড়ির ঠিক বিপরীতে রাজপথের গা ঘেঁষে শুরু হওয়া কানা গলিটাই আপাতদৃষ্টিতে আমার ছোট্ট পাড়া। তবে বাড়ি সংলগ্ন এক ফালি গলি মানেই কিন্তু পাড়া নয়— ছোট থেকেই বৃহত্তর অর্থে ভবানীপুর অঞ্চলটাকেই আমার পাড়া বলে জানি। পাড়া থেকে বেরিয়ে ডান দিকে কেদার বোস লেন, ঘড়ির মোড়, বাঁ দিকে সুহাসিনী গাঙ্গুলি সরণি। রাস্তা পেরিয়ে চক্রবেড়িয়া রোড।
আগে থাকতাম রাস্তার ওপারে বিখ্যাত ওই বাড়িটায়। তবে ১৯৫৮ থেকে এ বাড়িতে আমার বসবাস শুরু। সঙ্গে বদলে গিয়েছিল অতীতের জীবনযাত্রাও। আজও বাড়ির সামনের দু’টি গাছে খেলে বেড়ায় কাঠবেড়ালি। পিছনে হরিশ পার্ক থেকে শোনা যায় কোকিলের ডাক, আর মাঝে মাঝে হাওয়ায় ভেসে আসে ছাতিম, কদম, বকুলের সুবাস।
এক কালে ভবানীপুর অঞ্চলে থাকতেন বহু বিখ্যাত গাইয়ে-বাজিয়ে। বেশ কিছু বনেদি বাড়িতেও বসত গানের আসর। আসতেন বিখ্যাত শিল্পীরা। আর ছিল সেকালের বিখ্যাত ভবানীপুর সঙ্গীত সম্মেলন।
দেখতে দেখতে রাজপথ সংলগ্ন পাড়াটা একটা বাজারি পাড়ায় বদলে গেল। রাস্তার দু’ধারে বা়ড়িগুলির নীচে এখন সারি সারি দোকান। কিন্তু পাড়া থেকে বেরিয়ে দখলমুক্ত প্রশস্ত ফুটপাথে স্বচ্ছন্দে হাঁটা যায়। তবে রাজপথের দু’ধারে গাছের সংখ্যা কমেছে। আরও কিছু গাছ লাগালে সৌন্দর্য বৃদ্ধি পাবে।
সকাল-সন্ধ্যা পরিষ্কার হওয়া রাস্তাঘাট, নিয়মিত জঞ্জাল অপসারণ, পর্যাপ্ত জল এবং আলোকস্তম্ভের জোরালো আলো উন্নত নাগরিক পরিষেবার ইঙ্গিত দেয়। এলাকার কাউন্সিলর রতন মালাকার ভালই কাজ করছেন। জল জমার সমস্যা খুব একটা না থাকলেও ভাদ্রমাসে ষাঁড়াষাঁড়ি বানের সময় রাজপথে জল উপচে ওঠে।
এ অঞ্চলে খেলাধুলোর চল এখনও আছে। কাছেই হরিশ পার্ক, রাস্তার ও পারে কিছুটা দূরে নর্দান পার্ক। ছুটির দিনে ছোটদের মাঠে খেলতে দেখা গেলেও তাদের খেলাধুলোর সময় বা আগ্রহ কমেছে। যুব সম্প্রদয়ের মধ্যে ক্রিকেট খেলায় কিছুটা আগ্রহটা থাকলেও কমেছে ফুটবলের আকর্ষণ। এখনও শীতের রাতে হরিশ মুখার্জি রোডে জোরালো আলোয় চলে পুরোদস্তুর ক্যারম আর ব্যাডমিন্টন খেলা।
আমাদের পুরনো বাড়িটি এখন আশুতোষ মেমোরিয়াল ইনস্টিটিউট। সেখানে রয়েছে বেশ কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। কালের স্রোতে ঝিমিয়ে পড়েছে এলাকার নামকরা বাংলা মাধ্যম স্কুলগুলি। এখন অভিভাবকদের পছন্দ শহরের নামী ইংরেজি মাধ্যম স্কুল। আর স্কুলের পরে কোচিং-এর চক্রব্যূহে আবদ্ধ ছোটদের বিকেল-সন্ধ্যে।
কাছেই যদুবাবুর বাজার। অবাঙালিদের সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে কমেছে মাছের জোগান। এ অঞ্চলে কমেছে পাঁঠার মাংসের দোকানও। এটা ভোজনরসিক বাঙালির পক্ষে বেশ কষ্টদায়ক বৈকি! আশুতোষ মুখার্জি রোড নো পার্কিং হওয়ায় বাজার থেকে অনেকটা দূরে গাড়ি রাখতে হয়। তবে বাজারের সীমানা ছাড়িয়ে সুহাসিনী গাঙ্গুলি সরণির মুখ থেকে যদুবাবুর বাজার পর্যন্ত ফুটপাথেই বসে মাছ ও সব্জির বাজার। এর জন্য ফুটপাথটা মাছের জল, কাদায় পিছল হয়ে থাকে। হাঁটাচলায়ও সমস্যা হয়।
এখন বাঙালিয়ানা বোঝা যায় পুজো-পার্বণে। সময়ের সঙ্গে চাঁদার উপদ্রব কমলেও বেশির ভাগ নাম করা পুজো এখন হয়ে উঠেছে কর্পোরেট পুজো। পাড়ার পুজোর সেই গন্ধটাই হারিয়ে গিয়েছে। আগে পাড়ায় পাড়ায় নাটকের প্রচলন ছিল। সেই ঐতিহ্য অক্ষুণ্ণ ছিল উত্তমকুমার, তরুণকুমারের যুগ পর্যন্ত। তেমনই পুজোর পরে হত বিজয়া সম্মিলনী আর নববর্ষে গানের জলসা। সেটা বিক্ষিপ্ত ভাবে এখনও হলেও আগের আকর্ষণ বা জৌলুসটা আর নেই।

ছবি : শুভাশিস ভট্টাচার্য
আগে ধনী দরিদ্র নির্বিশেষে পাড়া-পড়শির মধ্যে সদ্ভাব ও যোগাযোগ ছিল। তবে অবাঙালিদের সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে এ অঞ্চলে একটা অর্থনৈতিক বিভাজন এখন স্পষ্ট। পরিবর্তনটা শুরু হয় ষাটের দশকে। একে একে ভাঙতে থাকা একান্নবর্তী পরিবার, জমির দাম বৃদ্ধি, বেশি ভাড়ার জন্য অবাঙালিদের ভাড়া দেওয়া। সেই ফাঁকে আর্থিক সঙ্গতি সম্পন্ন অবাঙালিরাই একে একে বাঙালি বাড়িগুলির মালিক হয়ে উঠলেন। একটু করে আমাদের বর্ধিষ্ণু বনেদি ভবানীপুর অঞ্চলটা বদলে গেল। এখন ভবানীপুর-আশুতোষ মুখার্জি রোড অঞ্চলে বাঙালিরা সংখ্যালঘু বললে বোধ হয় খুব একটা ভুল হবে না। এ অঞ্চলে গুজরাতি ও মারোয়াড়ি সম্প্রদায়ের মানুষের সংখ্যা বেশি। তাঁরাও নিজেদের মতো থাকতে পছন্দ করেন। এ কারণেই তৈরি হচ্ছে আত্মকেন্দ্রিক শূন্যতা।
তবু আমাদের ছোট পাড়াটায় রোজ দেখাসাক্ষাৎ না হলেও পড়শিদের মধ্যে যোগাযোগ, সদ্ভাব আছে। সকলে সকলকে চেনেন, সমস্যায় পাশে দাঁড়ান। অন্য পাড়ার পুরনো বাসিন্দাদের সঙ্গে যোগাযোগ থাকলেও নতুনদের মধ্যে কোনও যোগাযোগ নেই বললেই চলে।
শোনা যায়, সাবেক গোবিন্দপুরে ইংরেজদের পুরনো কেল্লাটি তৈরির সময়ে বেশ কিছু মানুষ সেখান থেকে এসে আজকের ভবানীপুর অঞ্চলে বসবাস শুরু করেছিলেন। অতীতে পাড়াটা ছিল বর্ণময়। ছেলেবেলায় ভোরে ঘুম ভাঙত হোসপাইপ দিয়ে রাস্তা ধোয়ার শব্দে। ভোর সাড়ে চারটের ফার্স্ট ট্রামে কীর্তন করতে করতে কিছু মানুষ প্রতি দিন যেতেন বাবুঘাট। আজ যেখানে চক্রবেড়িয়া হকার্স কর্নার সেখানেই ছিল ঘোড়ার গাড়ির স্ট্যান্ড। থাকত এক এক ধরনের ঘোড়ার গাড়ি। কলেজে ভর্তি হওয়ার পরেই মিলেছিল বাড়ি থেকে একা বেরোনোর স্বাধীনতা। তখন থেকেই একটু একটু করে পরিচিত হয়েছিলাম এলাকাটার সঙ্গে।
আশপাশের পাড়ায় তখন থাকতেন বেশ কিছু বিখ্যাত মানুষ। পিপল কোঠি রোডে শম্ভুনাথ পণ্ডিত, হরিশ মুখার্জি রোডে সর্বপল্লি রাধাকৃষ্ণন, বকুলবাগানে রাজশেখর বসু আর খালসা স্কুলের যে বাড়িটি সেটাই ছিল স্যার রমেশ মিত্রের বাড়ি। থাকতেন প্রেমেন্দ্র মিত্র, সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায় আর সেকালের বেশ কিছু বিচারপতি
ও আইনজীবীও।
রাজপথে আড্ডার পরিবেশ ছিল না ঠিকই তবে পাড়ার রকে রকে নানা মেজাজের আড্ডা দেখা যেত। সেখানে যুক্তি তক্কো আর গপ্পে কে কাকে হারায়? সেই জমজমাট আড্ডাগুলো আজ নেই। নবনির্মিত বহুতলগুলিতে আড্ডার পরিবেশ তেমন চোখে পড়ে না। তবে পাড়ার মোড়ে, চায়ের দোকানে ছুটির দিনে কিছু মানুষকে আড্ডা দিতে দেখি।
এ পাড়ার অতীত আর বর্তমান যেন দুই জগৎ। সময়ের সঙ্গে বাইরের চাকচিক্য জৌলুস বাড়লেও হারিয়েছে অন্তরের সেই টান।
লেখক প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি

http://www.anandabazar.com/calcutta/increase-of-glamour-have-diminished-the-heartfelt-attraction-1.302239


No comments:

Post a Comment