মন কি বাতঃ এক দেশদ্রোহীর জবানবন্দী (প্রথম পর্ব)
Posted on by অচল সিকি
(১)
লেখা শুরু করার আগে ডিসক্লেইমার দিয়ে রাখা ভালো, যা দিনকাল চলছে। কে কখন কোথা থেকে সিডিশন চার্জ ফার্জ লাগিয়ে দেবে, জানা তো নেই, দিল্লি ঘেঁষে বাস করি, বহুকালের চেনাশনা বন্ধুরাও আজকে কেমন কিছু ইস্যুতে পোলস অ্যাপার্ট হয়ে যাচ্ছে, ঘরের দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে আছি – আর পিছু হঠবারও জায়গা নেই। পাকিস্তানে যাবার হুমকি বেশ কয়েকবার পেয়ে গেছি, দেশদ্রোহী তো বাই ডিফল্ট হয়েই গেছি কানহাইয়াকে সমর্থন জানিয়ে – তাই ডিসক্লেমার দিয়ে রাখা ভালো।
ডিসক্লেমারঃ
- আমি ভারতীয় নাগরিক, আজন্ম। তবে আমৃত্যু থাকব কিনা, সেটা এখনই বলতে পারছি না।
- দেশপ্রেম বলতে আপনারা যা বোঝেন, আমার মধ্যে তা নেই, কিস্যু নেই। আর্মিতে যোগদান করারও ইচ্ছে নেই, ভারতীয় আর্মিকে মহান ভাবি-টাবি না, দেশকে আমার মা-ও ভাবি না, আমার একটাই মা, দ্যাশের বাড়িতে আছেন।
- দেশপ্রেমী নয় মানেই যাঁরা দেশদ্রোহী ভেবে ফ্যালেন, তাঁদেরও সবিনয় নিবেদন, না, ভারত নামক দেশের বিরুদ্ধে যাবার কোনও রকমের বাসনা আমার নেই। ভারতের বরবাদীও চাই না। হ্যাভিং সেইড দ্যাট, এগুলোও জানিয়ে রাখি, আমি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে নেই, বাংলাদেশের নিপাত চাই না, সিরিয়া, ইরাক বা আফগানিস্তান, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি বা আমেরিকা – কারুরই বরবাদী চাই না।
- ভারতের সংবিধানে, ওয়েল, ভরসা আছে, তবে “বিশ্বাস” নেই। এমনিতেই আমি নাস্তিক মানুষ, বিশ্বাস ফিশ্বাস শুনলে কেমন ঠাকুর দেবতা মনে হয়, আর সেগুলোতে আমার প্রভূত ঝাঁট জ্বলে। সংবিধানকে ভগবান মনে করি না। সংবিধানে ভরসা আছে, যদিও পুরোটা পড়া নেই, তবে এটুকু জানি সংবিধানে আমার সুরক্ষার জন্য একটা লাইনও লেখা নেই। সব ধর্মের প্রতি সমান নজর দেবার কথা আছে, জাত-ধর্মের বেসিসে বিভেদ না করার কথা বলা আছে, কিন্তু ধর্মহীন জাতহীন নাস্তিকদের জন্য ওই বইতে কিছুই লেখা নেই। লেখা নেই সমকামীদের ব্যক্তিগত যৌন অধিকারের কথা, লেখা নেই আরও অনেক কিছুই, তবু ভরসা আছে, বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র, সুষ্ঠুভাবে আজও চলছে – যে ফর্মেই হোক না কেন, সংবিধানে ভর করেই চলছে। সংবিধানটা কমপ্লিট নয়, আজও অ্যামেন্ডমেন্ট চলছে। একদিন কমপ্লিট হবেই, আশা রাখি।
- ইন্টিগ্রিটির কেসটা একটু ঘাঁটা আছে, যদি বলেন কাশ্মীরকে দেশের ইন্টিগ্রাল পার্ট বলে মনে করি কিনা, তা হলে একটু তোতলাবো, কারণ কাশ্মীরকে আমি সত্যিই ভারত কর্তৃক জোর করে ধরে রাখা একটা স্বাধীনতাকামী ভূখণ্ড বলে মনে করি, এখন ম্যাটার অফ ফ্যাক্ট, তার একটা বড় অংশ ভারত রাষ্ট্রের অন্তর্ভূক্ত, সেটাকে আমি সম্মান করি, কিন্তু এই যে অধিকাংশ কাশ্মিরী নিজেদের ভারতীয় মনে করেন না, তাঁরা আজাদী চান – ভারত, পাকিস্তান দু দেশের থেকেই আজাদী, তাঁদের সে ভাবনাকেও আমি সম্মান করি। আমি নিজে কাশ্মীরিদের আজাদীর জন্যে হাতে কালাশনিকভ তুলে নেব না, স্লোগান দেব না, এ ওঁদের লড়াই ওঁরাই ঠিক করবেন হিংসার পথে আজাদী হাসিল করবেন না অন্য পথে, তবে এক কথায় যদি ধরেন, বলব, কাশ্মীরিদের কাছে হিংসা ছাড়া আর কোনও রাস্তা খোলা রাখে নি আমাদের ভারতীয় রাষ্ট্র, ভারতীয় জাতীয়তাবাদ এবং সর্বোপরি, ভারতীয় সেনাবাহিনি।
- জাতীয় পতাকা, জাতীয় সঙ্গীতকে সম্মান করি, তবে সিনেমাহল-এ জাতীয় সঙ্গীত বাজলে বসে থাকি, উঠে দাঁড়াই না।
- জন্মেছিলাম একেবারে ন্যাংটো একটা শিশু হয়ে। ভারতেই জন্মাবো, বাঙালি হয়েই জন্মাবো, হিন্দু ব্রাহ্মণ ভরদ্বাজ গোত্র মেনেই জন্মাবো – এমন কোনও প্ল্যান ছিল না। সব আমার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে জন্মের পরে। কথা বলতে পারতাম না কিনা তখনও, তাই আমার মতামত কেউ নেয় নি। তাই এগুলোকে আমি স্রেফ ম্যাটার অফ ফ্যাক্ট হিসেবেই বয়ে চলি, এর জন্য আলাদা করে কোনও গর্ব বা ঘেন্না অনুভব করি না। হ্যাঁ, ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ভাঙার পরে আমি আমার পরিচয় থেকে হিন্দু ব্রাহ্মণ ভরদ্বাজ অ্যাট্রিবিউটগুলো সরিয়ে দিয়েছি। না, অনুষ্ঠান করে নয়, নিঃশব্দেই সরিয়েছি। ধর্ম জাত গোত্র আমি প্রাণের ভেতর থেকে ঘেন্না করি। যারা গোরুকে মা বলে মনে করেন এবং গুজরাত দাঙ্গাকে জাস্টিফাই করার নিরন্তর চেষ্টা করেন, আর যারা শুওরের মাংসকে “হারাম” বলে মনে করেন আর ইসলাম বাদে বাকি ধর্মকে “ইনফিরিয়র” বলে মনে করেন – দুই দলকেই আমি সমান অপছন্দ করি। ইনসিডেন্টালি, আমি গরু শুওর, দু রকমের মাংসই খাই।
এবার প্রসঙ্গে যাই।
(২)
শুরুতে একটা গল্প শোনাই বরং। চেনা গল্প, অনেকেই জানেন। তাও শোনাই। আমার দেশ, মেরা ভারতের মহানতার গল্প।
১৯৪৭ সালের পরে ভারতের পূর্বদিকের একটা অংশ পূর্ব পাকিস্তান নামে জন্ম নেয়। মূলভূমি, পশ্চিম পাকিস্তান থেকেই অ্যাডমিনিস্ট্রেশন সামলানো হত, এবং যেহেতু পশ্চিম পাকিস্তানের অনেক নীতি পূব পাকিস্তান মানত না, তাই পশ্চিম পাকিস্তান সেখানে অকহতব্য দমন-পীড়ন চালাতো। পূব পাকিস্তান বলল, আমরা নিজেদের পাকিস্তানের অংশ মানি না, আমরা স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে চাই। পশ্চিম পাকিস্তানের অত্যাচার আরও বেড়ে গেল পূব পাকিস্তানের ওপর। বেছে বেছে বুদ্ধিজীবিদের খুন, হিন্দু মুসলমান তোয়াক্কা না করে। মেয়েদের ধর্ষণ করছে, পুরুষদের অমানবিক পীড়ন, কিংবা স্রেফ গুলি চালিয়ে খুন। রাস্তায়, খালে বিলে, নদীতে, ধানের ক্ষেতে জমে গেল লাশের পাহাড়। পূব পাকিস্তানে লুকিয়ে চুরিয়ে গঠিত হল মুক্তিযোদ্ধা বাহিনি।
অবশ্য, তার মানে এই নয় যে পূব পাকিস্তানি মাত্রেই মুক্তিযোদ্ধা, কিন্তু অনেকেই সিমপ্যাথাইজার ছিল তাদের। তেমনি কেউ কেউ রাজাকার বা খানসেনাদের সিমপ্যাথাইজারও ছিল।
যুদ্ধ শুরু হল। দু তরফেই প্রচুর লোক মরছে, মারছে। সহজ টার্গেট হচ্ছে শিশুরা, মেয়েরা। এই সময়ে, বড়দা আমেরিকার স্ট্রং আপত্তি সত্ত্বেও একটা বিদেশী দেশ, ভারত তার নাম, সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিল মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ভারতের সেনা পাঠালেন মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করার জন্য। রক্ত আরও, আরও ঝরল, অবশেষে পশ্চিম পাকিস্তান পিছু হঠল, আত্মসমর্পণ করল, পূব পাকিস্তানের ওপর থেকে নিজেদের দাবি তুলে নিল। জন্ম নিল স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ। উনিশশো একাত্তর সাল।
… কেমন গব্বে বুক ফুলে যায় না, পড়লে? মেরা ভারত মহান, মনে হয় না?
এবার একই গল্পে, দেশের নামগুলো একটু পাল্টে দিই, কেমন? পূব পাকিস্তানের নাম দিলাম কাশ্মীর, পশ্চিম পাকিস্তানের নাম দিলাম ভারত, আর ভারতের নাম দিলাম পাকিস্তান। গল্পটা একই রইল, শেষের দিকটা বাদে, কারণ যুদ্ধ চলছে। শেষ হয় নি আজও।
সেই পূব পাকিস্তানের, থুড়ি, কাশ্মীরের, কিছু চ্যাংড়া ছেলে, পশ্চিম পাকিস্তানের – আই মিন, ভারতের মূলভূমিতে এসে বলছে “ইন্ডিয়া কি বরবাদি”। পূর্ব পাকিস্তানের লোকগুলো যেমন বলত, পশ্চিম পাকিস্তান নিপাত যাক। অবশ্য, পশ্চিম পাকিস্তানে গিয়ে বলতে সাহস পায় নি কেউই। তা, এখনকার গল্পে, ভারতের মূলভূমিতেও এর আগে এইভাবে কেউ ভারত নিপাত যাক বলে স্লোগান দেয় নি, ও স্লোগান আকছার শোনা যায় কাশ্মীরের রাস্তায় ঘাটে বাগানে শিকারায়।
তাই বলে, কাশ্মীর কি ভারতের মূলভূমি নয়, নাকি? কাশ্মীরে বলা মানেই তো ভারতে বসে বলা। এত সাহস হয় কী করে?
অনেকটা এ রকমই ভাবতাম আমিও, জানেন। তখনও জানতাম না কাশ্মীরের ইতিহাস। ওপর ওপর শুধু জানতাম কাশ্মীরের আমজনতা না ভারত, না পাকিস্তান, কারুর সাথেই যেতে চায় নি, ওরা আলাদা একটা দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে চেয়েছিল। কিন্তু এমন সুন্দরী রূপসী একটা রাজ্য, তাকে কি অরক্ষিত অবস্থায় ফেলে রাখা যায়? না দাবি ছেড়ে দেওয়া যায়? নীল জল, সাদা পাহাড়, সবুজ গালিচায় মোড়া এই ভূস্বর্গ তো যে কারুর কাছেই লোভনীয়। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে তাই আক্রমণ চলেছে কাশ্মীর উপত্যকার ওপর। কখনও পঞ্জাব, কখনও ইংরেজ, কখনও আফগান উপজাতি।
ভারত দেশ স্বাধীন হবার পর জনমত উপেক্ষা করে রাজা হরি সিং কাশ্মীরকে ভারতের সাথে যুক্ত করতে ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। লোকে বলে, হরি সিং-কে রাজি করানো হয়েছিল, কিছু বিশেষ উপায়ে, যেটাকে “স্ব-ইচ্ছা” কোনওমতেই বলা যায় না। আসলে পাকিস্তান তখন তাল ঠুকছিল কাশ্মীরকে তাদের অংশ বানাবার জন্য। ছোট্ট দেশ কাশ্মীরের ক্ষমতা ছিল না পাকিস্তানকে প্রতিহত করার। রাজা হরি সিং ভারতের সাহায্য চান – ঠিক যেভাবে পূর্ব পাকিস্তানের মুক্তিযোদ্ধারা ভারতের সাহায্য চেয়েছিল। কিন্তু, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যে কাজ ভারত করে নি, সেই কাজ ভারত করল কাশ্মীরের জন্য। বলল, সাহায্য করতে পারি, যদি তোমরা ভারতের অংশ হও।
সুন্দরী কাশ্মীর, পাকিস্তান তোমাকে হরণ করে নিজের হারেমে রাখবে, সে আমি আটকাতে পারি, যদি তুমি স্বেচ্ছায় আমার হারেমে আসতে রাজি হও।
“স্বেচ্ছায়” রাজি হওয়া ছাড়া হরি সিং-এর কাছে আর কোনও অপশন ছিল না। তিনি রাজি হন।
দুই জায়গার জন্য দু রকমের নীতি নিয়েছিল নবগঠিত ভারত। একদিকে হায়দ্রাবাদ, অন্যদিকে কাশ্মীর। দুদিকের গল্প পুরো দু রকম ছিল। হায়দ্রাবাদের লোকজন ভারতে যুক্ত হতে ইচ্ছুক ছিল, ইচ্ছুক ছিলেন না শুধু হায়দ্রাবাদের নিজাম। সেখানে তাই জনমতকে প্রাধান্য দিয়ে হায়দ্রাবাদকে ভারতের অংশ বানিয়ে নেওয়া হয়।
যাই হোক, কথা হচ্ছিল কাশ্মীর নিয়ে। কাশ্মীরকে ভারত এইভাবে নিয়ে নেওয়ায় পাকিস্তান রেগে যায়, তারাও ভূখণ্ড দখল করতে এগিয়ে আসে, কিছু অংশ দখল করেও নেয় যা আজও পিওকে, বা পাকিস্তান অক্যুপায়েড কাশ্মীর নামে রয়েছে পাকিস্তানের হাতে। এবং সেই জমি নিয়ে বিবাদ চলেছে দশকের পর দশক ধরে, সেই বিবাদিত জমির মধ্যে রয়েছে আমাদের সিয়াচেন হিমবাহও, যা পাকিস্তান দাবি করে তাদের, ভারত দাবি করে তাদের। আপাতত দীর্ঘকাল এই অঞ্চলের কব্জা নিয়ে রেখেছে ভারত, বিশ্বের উচ্চতম ব্যাটলগ্রাউন্ড, সবচেয়ে ডেঞ্জারাসও বটে, কারণ যুদ্ধ চলুক বা না চলুক, এই সিয়াচেনের বেস ক্যাম্প ভারতীয় সেনাবাহিনিকে স্টেডি “শহীদের” সাপ্লাই দেয়। এত কঠিন সেখানে বেঁচে থাকা, প্রতি বছরই কিছু না কিছু সৈনিক সেখানে মারা যান প্রকৃতির হাতে, এ বছরের গোড়াতে সেই রকমেরই এক বিশাল অ্যাভালাঞ্চে দশ ভারতীয় সৈনিক শহীদ হলেন, হনমন্তাপ্পা যাঁদের একজন, বরফের নিচে ছ দিন জীবিত ছিলেন, শেষে দিল্লির সেনা হাসপাতালে এসে জীবনের যুদ্ধে হার মানলেন।
প্রসঙ্গান্তরে চলে যাচ্ছি আবার। কাশ্মীর ভ্যালিতে চলে আসি। তো, কাশ্মীর ভ্যালির লোকজন যেহেতু ভারতের অংশ হয়ে খুশি হয় নি, মাঝে মাঝেই তারা মিছিল বের করত বাদামি বাগে, লাল চকে। হাম কেয়া চাহতে হ্যায়? আজাদী। শান্তিপূর্ণ মিছিল।
(৩)
ধুনো দেওয়া শুরু করল পাকিস্তান। নে শালা, আমরা যখন খেতে পারছি না, এমন হুড়কো দেব, ভারতও শান্তিতে কাশ্মীরকে চাখতে পারবে না। জঙ্গী সাপ্লাই শুরু হল। শুরু হল ধর্মের মোড়কে জঙ্গী বানানোর কাজ। আজাদীর লড়াইয়ের ট্রেনিং নেবার স্বপ্ন চোখে নিয়ে অনেকেই কাঁটাতার পেরিয়ে রাতের অন্ধকারে চলে গেল পাকিস্তান অক্যুপায়েড কাশ্মীরে। সেখানে জিহাদি ট্রেনিং নিল, সাথে মাথায় ভরে নিল একগুচ্ছ নোংরা ইসলামিক জিহাদি চিন্তাভাবনা। তার মধ্যে একটা হচ্ছে – ভারত হিন্দুদের দেশ। ওরা তোমাদের জোর করে দখল করে রেখেছে, তাই হিন্দুস্তান আর হিন্দু – দুইই তোমাদের শত্রু।
ধুনো দেওয়া শুরু করল পাকিস্তান। নে শালা, আমরা যখন খেতে পারছি না, এমন হুড়কো দেব, ভারতও শান্তিতে কাশ্মীরকে চাখতে পারবে না। জঙ্গী সাপ্লাই শুরু হল। শুরু হল ধর্মের মোড়কে জঙ্গী বানানোর কাজ। আজাদীর লড়াইয়ের ট্রেনিং নেবার স্বপ্ন চোখে নিয়ে অনেকেই কাঁটাতার পেরিয়ে রাতের অন্ধকারে চলে গেল পাকিস্তান অক্যুপায়েড কাশ্মীরে। সেখানে জিহাদি ট্রেনিং নিল, সাথে মাথায় ভরে নিল একগুচ্ছ নোংরা ইসলামিক জিহাদি চিন্তাভাবনা। তার মধ্যে একটা হচ্ছে – ভারত হিন্দুদের দেশ। ওরা তোমাদের জোর করে দখল করে রেখেছে, তাই হিন্দুস্তান আর হিন্দু – দুইই তোমাদের শত্রু।
না, সব মুসলমান কিন্তু এই স্বপ্ন দ্যাখে নি। বেশির ভাগ অংশই শান্তিতে কাশ্মীর ভ্যালিতে থাকত। পড়াশুনা করত, চাকরি করত, ব্যবসা করত। কিছু মুসলিম যুবক এই জিহাদের স্বপ্নে মশগুল হল। ট্রেনিং নিয়ে আবার ফিরে এল ভারতের কাশ্মীরে। আর ভারতের বিরুদ্ধে জিহাদ লড়তে গেলে সহজ টার্গেট কে? কে আবার! আর্মি। মিলিটারি। ভারতীয় সেনা। চোরাগোপ্তা আক্রমণ চলতে লাগল।
পরিস্থিতি ক্রমশ খারাপের দিকে চলতে লাগল। বাড়তে লাগল অবিশ্বাস। কে সন্ত্রাসবাদী, আর কে নয়, তা বাছবিচার করার মত ধৈর্য বা মেধা ভারত সরকার বা ভারতীয় সেনা, কারুর কাছেই ছিল না। অবশ্য, সদিচ্ছা ছিল না বললেও হয়। প্রায়ই চলতে লাগল মহল্লায় মহল্লায় গিয়ে দশ থেকে পঞ্চাশ বছর বয়েসী মুসলমান নামধারী লোকেদের বের করে সারা দিন ধরে আইডেন্টিফিকেশন প্যারেড। একটা জালে ঢাকা ভ্যানের সামনে নিয়ে যাওয়া হত সবাইকে এক এক করে, ভ্যানে বসে থাকত একজন “ইনফর্মার” যে পোটেনশিয়াল সন্ত্রাসবাদীকে চিনত। যে মুসলমানটিকে দেখে সে গাড়ির ভেতর থেকে হর্ন বাজাবে, তাকে ভারতীয় সেনা তুলে নিয়ে যাবে তাদের নিজস্ব আপ্যায়নখানায়। তার পরে আপ্যায়ন। যতক্ষণ না কথা বেরোচ্ছে। সত্যি হোক, মিথ্যে হোক, তাকে বলতেই হবে সে জিহাদি ট্রেনিং নিতে গেছিল। সে নয় তো তার দাদা, তার ভাই, তার চাচা। নইলে মার। রুলের গুঁতো। শরীরের অঙ্গে, রন্ধ্রে ঢুকত সেনার মার।
সত্যিকারের সন্ত্রাসবাদী কি ধরা পড়ত না এ সব করে? হ্যাঁ পড়ত। তারা আর ফিরত না সেই আপ্যায়নখানা থেকে। দুদিন পরে তার গুলিবিদ্ধ দেহ পাওয়া যেত কাশ্মীরের রাস্তায় কিংবা শহরের বাইরে, বরফের ধারে। মহল্লার লোকেরা ভয়ে ভয়ে তুলে আনত সেই বিপথগামী তরুণের শবদেহ, কবর দিত চিনার গাছের তলায়, আর সেই কবরের সামনে দাঁড়িয়ে আরও একদল তরুণ দাঁতে দাঁত চেপে শপথ নিত, এর বদলা নেবই।
আর যারা সত্যি সন্ত্রাসবাদী নয়? স্রেফ “স্বীকারোক্তি”র কারণে যাদের সেনার অত্যাচার সইতে হত?
আসুন, আলাপ করিয়ে দিই হুসেনের সাথে।
দক্ষিণ কাশ্মীরের প্রত্যন্ত গ্রামের এক ভীতু মানুষ, হুসেন । শান্ত চোখ, সঙ্কুচিত ভঙ্গিতে বসে থাকে ডাক্তারখানায়। হুসেনের ধারণা সে ইমপোটেন্ট হয়ে গেছে। তার ডাক্তার ভাইয়ের ভাষায়, ‘হুসেনের আর দাঁড়ায় না’। হুসেন বিয়ে করতে চায় না, কারোর সাথে মিশতে চায় না। নিজের ছোট্ট দোকান-ঘরের মধ্যে জড়োসড়ো হয়ে কাটিয়ে দেয় সারাদিন। হুসেন এক একলা ভাঙ্গাচোরা মানুষ।
১৯৯০ সালে যখন কাশ্মীরে সশস্ত্র অভ্যুত্থানের ডাক ওঠে হুসেন তখন কলেজে পড়ে। তেরোজন বন্ধুর সাথে হুসেন রওনা দিয়েছিল এল ও সি পেরিয়ে পাক-অধিকৃত কাশ্মীরের দিকে ‘ট্রেনিং’ নিতে। কুপওয়ারা থেকে একটু দূরে বিএসএফ তাদের ট্রাক থামায় এবং অ্যারেস্ট করে কাছের আধা-সামরিক ক্যাম্পে নিয়ে যায়। পরের দিন সকালবেলা ইন্টেরোগেশন রুমে নিয়ে আসা হয় তাদের। জোর করে উলঙ্গ করিয়ে দুই হাতে তামার তার বেঁধে ইলেকট্রিক শক দেওয়া হতে থাকে। হুসেনের গলা ফাটিয়ে ঠিকরে আসতে চায় বমি, কিন্তু করতে পারে না কারণ মুখে গোঁজা ছিল তুলোর বল। রক্ত লালা এবং বমিতে সেই বল ভিজে গেলে ফেলে দিয়ে নতুন বল ঢোকানো হচ্ছিল। এরপর হুসেনের পুরুষাঙ্গের ভেতর তার ঢুকিয়ে দেওয়া হয় জোর করে। শক পেতে পেতে মনে হয় ছিঁড়ে যাবে পুরুষাঙ্গ। হুসেন পরে বুঝেছিল, এগুলো শুধুই কথা বার করার জন্য নয়। কারণ সকলেই একটা না একটা সময় মুখ খোলে, অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে মুখ খুলতে বাধ্য হয়। ইন্ডিয়ান আর্মিও জানে সেটা। তারা দীর্ঘ সময় ধরে জিজ্ঞাসাবাদের নামে এই টর্চার চালায় নিছক স্যাডিস্ট আনন্দ পাবার জন্যেই।
অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে হুসেন অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল একসময়। তাকে জাগিয়ে তুলে আবার শক দেওয়া হয়। হুসেন প্যান্ট ভিজিয়ে ফেলে, কিন্তু হিসির বদলে রক্ত বেরিয়ে আসে। ফুলে ওঠে অন্ডকোষ। বিপদ বুঝে আর্মি হাসপাতালে ট্রান্সফার করে। সেখান থেকে বেরিয়ে আসার পর আবার অত্যাচার। দুই বছর বাদে হুসেন যখন ছাড়া পায় তখন তার পুরুষাংগ আর শক্ত হয়না। বাড়ি ফিরে আসার পর গুটিয়ে যায় সে। বাড়ির লোক বিয়ে করার জন্য বার বার চাপ দিতে থাকে, একসময় সে জানায় যে সে বিয়ে করতে পারবে না, কারণ তার “দাঁড়ায় না”। কোনও ডাক্তারের কাছে যেতে চায় না লজ্জায়। গোটা সময় কাটায় গ্রামের মসজিদে। হুসেন ধর্মপ্রাণ এক মুসলিম হয়ে যেতে শুরু করে, যাকে অনায়াসে ভারতীয় মিডিয়া দাগিয়ে দিতে পারে ধর্মান্ধ মৌলবাদী নামে।
শুধু পুরুষ? শুধু কাশ্মীরি তরুণরাই ভারতীয় আর্মির আক্রমণের শিকার হত? মেয়েরা? রশিদ আর মুবিনার কথা শুনুন।
কূপওয়াড়া থেকে বিয়ে করে নতুন স্বামী রশিদের সঙ্গে বরযাত্রী-ভরা বাসে করে ফিরছিল মুবিনা। পথে বিএসএফ বাস দাঁড় করায়। মুবিনাদের বাস আসার আগে জঙ্গীদের একটা জিপ গিয়েছিল সেই রাস্তা দিয়ে এবং সেখান থেকে বিএসএফ-এর উদ্দেশ্যে কয়েকটা গুলি ছোঁড়া হয়েছিল শূন্যে। কেউ হতাহত হয়নি। কিন্তু সেই জিপকে ধরা যায়নি। এই অক্ষমতার জ্বালা কীভাবে মেটাবে বিএসএফ? তাই পরের বাসটিকে থামানো হয়, যাতে ছিল বরযাত্রী সমেত নবদম্পতিরা। তাদের ভয়ার্ত চোখের সামনে বন্দুক উঁচিয়ে নববধূ মুবিনাকে বাস থেকে নামিয়ে নিয়ে যায় বিএসএফ। সারারাত ধরে চলে তার ওপর গণধর্ষণ। জঙ্গীদের জিপ মিস করার পরে তাদের অপমানিত দেশপ্রেম এ ছাড়া তো শান্তি পেত না।
মুবিনা আজও বেঁচে আছে। রশিদও আছে। আপনারা জানেন, কাশ্মীরিদের বিয়ে একটা দারুণ মনমাতানো অনুষ্ঠান? ভারতের অন্যান্য প্রদেশের বিয়ের অনুষ্ঠানের মত অনেকটা, তবে একটু আলাদা। মেহেন্দী, মেয়েদের গান, নাচ, আর তুমুল খাওয়াদাওয়া না হলে বিয়ে সম্পূর্ণই হয় না কাশ্মীরিদের।
মুবিনার ঘটনার পরে কাশ্মীরে আর কখনও সন্ধ্যের পরে কারুর বিয়ের অনুষ্ঠান হয় নি। এখন দিনের বেলাই সমস্ত অনুষ্ঠান সেরে দিনের আলো থাকতে থাকতে ফিরে আসা হয়।
শুনুন গুলজারের কথা। ক্লাস টু্য়েলভের ছাত্র গুলজার নিছক মজা করার জন্য স্কুলের এক জুনিয়ারকে একটু র্যাগ করেছিল। সে জানত না যে, সেই ছেলেটি এক ইন্ডিয়ান আর্মি অফিসিয়ালের পুত্র। আর্মি গুলজারের বাড়িতে এসে তাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল এবং হাত পা বেঁধে কাছের এক গোডাউনে ঢুকিয়ে মাইন ফাটিয়ে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল তার শরীর। অফিসিয়াল ডকুমেন্টে লেখা হয়েছিল, গুলজার এক বিপজ্জনক জঙ্গী যার মাইন ভুল করে হাতে ফেটে গেছিল।
আর শুনতে চান? পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্র একটা ভূখণ্ডের ওপর নিজের অধিকার বজায় রাখতে গিয়ে কী কী করতে পারে? আমাকে দিয়ে আর না-ই লেখালেন। পড়ে ফেলুন একটা বই। একটা নয়, বরং বলব, পর পর দুটো বই পড়তে। এই ঘটনাগুলো সেখান থেকেই তোলা। পড়ুন, বাশারাত পীর-এর লেখা The Curfewed Night, আর তার পরে পড়ুন রাহুল পণ্ডিতার লেখা Our Moon Has Blood Clots। কাশ্মীরকে জানতে হলে, সেখানকার মানুষের সেন্টিমেন্ট বুঝতে হলে এই বইদুটো পড়া ছাড়া গতি নেই। আরও কয়েকটা বই আর দুটো সিনেমা রেকমেন্ড করতে পারতাম, কিন্তু, আপাতত দুটোই থাক, পড়ে উৎসাহ পেলে আপনি নিজেই খুঁজে নিতে পারবেন বাকিগুলো।
একটা ভূখণ্ডের জনজাতির ওপর নিয়মিত চলা সেনাবাহিনির এই রকমের অসহ্য অত্যাচার, কতদিন সইতে পারে, মানুষ? নিরপরাধ মানুষ, স্বাধীনতাকামী মানুষ রোজ মরছে, ধর্ষিত হচ্ছে একটা দেশের সেনাবাহিনির হাতে, আপনি এর পরেও আশা করবেন তারা সাম্যের গান গাইবে? তারা ভারতের ইন্টিগ্রিটির প্রতি সম্মান জানাবে? কাশ্মীর ভুলে যান, আপনার গ্রামে, আপনার শহরে, ভারতের যে কোনও অঞ্চলে কোনও বিশেষ জনজাতির ওপর দশকের পর দশক ধরে এই জিনিস চলতে থাকলে আপনি কতদিন মেনে নেবেন?
কাশ্মীরিরা তাও মানিয়ে নিচ্ছিল। সহ্যের বাঁধ ভাঙল ১৯৯০ সালে। আজাদী চেয়ে হেঁটে যাওয়া একটা শান্তিপূর্ণ মিছিল যখন ঝিলম নদীর ওপর একটা ব্রিজ পেরোচ্ছিল, তখন বিনা প্ররোচনায় দুদিক থেকে রাস্তা আটকে সেই মিছিলের ওপর ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি ছোঁড়ে ভারতীয় সেনা। কয়েকশো কাশ্মীরি, নিরস্ত্র কাশ্মীরি মারা যান। স্বাধীনতা চাইবার অপরাধে।
সন্ধ্যের অন্ধকারে আর্মির ট্রাক এসে তুলে নিচ্ছিল মৃতদেহগুলো। হাসপাতালের মর্গে নিয়ে যাওয়া হবে। মৃতদের স্তুপে আর বন্দুক উদ্যত করে রাখার দরকার হয় না। আধা অন্ধকার সেই মর্গের সামনে যখন ট্রাক এসে থামে, তখন মৃতদেহের স্তুপ থেকে সুড়ুৎ করে গড়িয়ে নামে এক ছায়ামূর্তি, একটা দশ বারো বছরের বাচ্চা ছেলে, শবের নিচে চাপা পড়ে ছিল সে সারাদিন। “আমি বেঁচে আছি, আমি বেঁচে আছি” বলে চেঁচাতে চেঁচাতে রক্তমাখা সেই বালক দৌড়ে নিমেষে হারিয়ে যায় হাসপাতাল মর্গের বাইরের অন্ধকারে। সেনাবাহিনির বন্দুক তার নাগাল পায় নি।
আগুনে ঘি পড়ে এর পরে। অশান্ত হয়ে ওঠে সমগ্র কাশ্মীর উপত্যকা। আগে ছুটকোছাটকা যেত, এর পর থেকে দলে দলে মুসলিম তরুণ যুবক কাঁটাতার পেরিয়ে যোগ দেওয়া শুরু করল পাকিস্তানের দিকের জিহাদি ক্যাম্পে, উদ্দেশ্য, কাশ্মীরকে আজাদ করা। না, ভুল বুঝবেন না, পাকিস্তানে যুক্ত হওয়ার স্বপ্ন কখনওই দেখে নি কাশ্মীর। তারা শুধু আজাদী চেয়েছে। পাকিস্তান তাদের ট্রেনিং দিয়েছে, অস্ত্র রসদ জুগিয়ে গেছে স্রেফ কাশ্মীরকে ফিরে পাবার আশায়, ভারতের শান্তি বিঘ্নিত করার প্রচেষ্টায়, আর কাশ্মীরিরা পাকিস্তানের থেকে এই সাহায্য নিয়ে চলেছে, শুধু, শুধুমাত্র কাশ্মীরকে স্বাধীন করার চেষ্টায়।
ভারতীয় সেনার এই বর্বর অত্যাচারের ফলে, জম্মু কাশ্মীর লিবাআরেশন ফ্রন্টের নেতা ইয়াসিন মালিকের মনে জেগে ওঠে ভেদবুদ্ধি। যেহেতু বেশির ভাগ অত্যাচারই হত মুসলিমদের ওপর, সে হেতু কাশ্মীর ভ্যালিতে বসবাস করা এক বিপুল সংখ্যক হিন্দু, যাঁদের “পণ্ডিত” বলা হয়, তাঁদের ভারতীয়দের সাথে সমার্থক করে ফেলার রাজনীতি শুরু হল কাশ্মীরে। কাশ্মীর, শুধু মুসলমানদের। জিহাদি মুসলমানদের। হিন্দুস্তান হিন্দুদের, অতএব হিন্দু পণ্ডিতদের খেদাও।
পুরো নব্বইয়ের দশক ধরে শুরু হয় উলটো অত্যাচার। এবার পণ্ডিতদের ওপর। শুরু হয় মাস এক্সোডাস। পন্ডিত সম্প্রদায়, যারা এতদিন পাশাপাশি বাস করে এসেছে কাশ্মীরি মুসলমানদের সাথে, একে অপরের সুখদূঃখের শরিক হয়েছে, এর পরবে ওর নেমন্তন্ন এসেছে, ওর পার্বণে এ প্রসাদ খেয়ে গেছে, তারা রাতারাতি উৎখাত হতে শুরু করে কাশ্মীর ভ্যালি থেকে, নিজেদের সারাজীবনের সঞ্চয়, জমি, বাড়ি, বাগান ফেলে। কেউ কেউ সাহস করে থেকে যেতে চেয়েছিলেন, প্রতিবেশিদের ওপর ভরসা করে। কাশ্মীরি সন্ত্রাসবাদীর দল রাতে হানা দিত তাদের বাড়ি। মেয়েদের ভাগ্যে জুটত – যে কোনও যুদ্ধক্ষেত্রে তাদের ভাগ্যে যা জোটে, তাইই, ছেলেদের মেরে ফেলা হত। শিশু, কিশোর, তরুণ, বুড়ো – কেউ বাদ পড়ত না তাদের হিংসার আওতা থেকে। কারণ, ওরা পণ্ডিত।
এক সত্তরোর্ধ্ব, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপকের কাহিনি পাবেন রাহুলের বইতে। শুধু সংস্কৃত নয়, আরবি এবং অন্যান্য ইসলামিক লিটারেচারে ছিল তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্য। তিনি ছিলেন একজন হিন্দু পণ্ডিত। নিজের টাউন শুধু নয়, আশপাশের গাঁয়ের হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে তাঁকে শ্রদ্ধা করত। ভালোবাসত। তিনি তাদের শ্রদ্ধা, ভালোবাসায় ভরসা রেখেছিলেন। কিন্তু বিচ্ছিন্নতাবাদীদের তা সহ্য হয় নি। এক রাতে তারা আসে। বৃদ্ধকে বলা হয় ঘরের সমস্ত মূল্যবান জিনিস একটা সুটকেসে ভরে নিতে। এর পরে তাঁর কপালে বন্দুক ঠেকিয়ে সেই ভারী সুটকেস তাঁকে দিয়ে বইয়ে বাড়ির বাইরে নিয়ে যায় জঙ্গীরা। বৃদ্ধের বড় ছেলে স্বেচ্ছায় বাবার সাথে যেতে চান, জঙ্গীরা তাকেও নিয়ে যায়।
পরের দিন দুজনেরই গুলিবিদ্ধ ছিন্নভিন্ন লাশ পাওয়া যায়। বৃদ্ধ অধ্যাপকের কপালে, জঙ্গীরা ঠুকে ঠুকে গেঁথে দিয়েছিল একটা পেরেক। করোটির মধ্যে।
আমরা, যারা ভারতের নিশ্চিত নিরাপদ নাগরিক জীবন কাটাই, তারা বুঝতেও পারব না, ঠিক কী অবস্থার মধ্যে দিয়ে গেছে, যাচ্ছে, কাশ্মীর। একদিকে এই বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নৃশংস কার্যকলাপ, অন্যদিকে তাকে থামাতে না পেরে নিরীহ কাশ্মীরিদের ওপরে ভারতীয় সেনা আর বিএসএফের অমানুষিক অত্যাচার, আর দুই যুযুধান পক্ষের মাঝে পড়ে হাজারে হাজারে অসহায় সম্বলহীন কাশ্মীরি পণ্ডিতদের কাশ্মীর ছেড়ে আশ্রয় নেওয়া জম্মুতে, দিল্লিতে, পাঞ্জাবে, চণ্ডীগড়ে।
যে ভারত তার অখণ্ডতায় এত গর্ব রাখে, যে মিডিয়া হাজারটা সামাজিক সমস্যা নিয়ে এত উদ্বেগ দেখায়, দীর্ঘ এক দশক ধরে চলে আসা এই এক্সোডাসের প্রতি এতটুকুও সহানুভূতি দেখায় নি। অবশ্য, নব্বইয়ের দশকে এত মিডিয়া ছিল না, আমরা মূলত দূরদর্শন দেখতাম। পণ্ডিতদের এক্সোডাস থামাবার জন্য কোনও চেষ্টা হয় নি, কাশ্মীরের সমস্যা সমাধান করার জন্য আলোচনার থেকে সবসময়েই সেনাবাহিনির বন্দুকের ওপর বেশি ভরসা রেখেছে ভারত সরকার।
আচ্ছে দিনের স্বপ্ন দেখিয়ে দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন নরেন্দ্র মোদী। তাঁর দলের অন্যতম অ্যাজেন্ডা ছিল কাশ্মীরি পণ্ডিতদের কাশ্মীর ভ্যালিতে পুনর্বাসন দেওয়া। কিন্তু সে কাজ আজও শুরু করা যায় নি।
(৪)
কিন্তু ধান ভানতে বসে, এত বড় শিবের গীত কেন গেয়ে বসলাম আমি? কাশ্মীরের ইতিহাস তো আমার লেখার কথা ছিল না!
লিখতে হল এই কারণে, কারণ, কাশ্মীরের এই বৃহত্তর প্রেক্ষাপটটা না জানলে বোঝা সম্ভব নয়, কোন আইডিওলজি, কোন আদর্শ থেকে আফজল গুরুরা আসে, জন্ম নেয়, ঢুকে পড়ে আমাদের নিরাপদ রাষ্ট্রের ঘেরাটোপের ভেতর। এই সোশাল নেটওয়ার্কেই, আমার পরিচিত বন্ধু, প্রিয় লোকজন, তাঁরাও দেশপ্রেম আর দেশদ্রোহের দ্বন্দ্বে উত্তাল গত এক সপ্তাহ ধরে। সমস্ত ঘটনাপ্রবাহে সম্যক মন না দিয়ে, পূর্বাপর ইতিহাস না জেনে, না পড়ে, কিছু মনগড়া ধারণা আর কিছু মিডিয়ার খাওয়ানো খবরের ভিত্তিতে তাঁরা তৈরি করছেন তাঁদের নিজস্ব মতবাদ। মতাদর্শ বলাই ভালো। খুব কনভিনিয়েন্টলি ঘেঁটে দেওয়া হচ্ছে প্রতিবাদ, প্রতিবাদের কনটেক্সট, এবং চলছে বাজারে সহজলভ্য কিছু স্টিকার নিয়ে এর ওর গায়ে সেঁটে দেওয়ার প্রক্রিয়া। তুই দেশদ্রোহী। তুমি দেশপ্রেমিক নও। আপনি আফজল গুরুকে সাপোর্ট করছেন। আপনি ভারতের অখণ্ডতায় বিশ্বাস করছেন না। কানহাইয়া কুমারকে তো পিটিয়ে মেরে ফেলা উচিত, পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেওয়া উচিত, শালা বলে কিনা পাকিস্তান জিন্দাবাদ! বলে কিনা ইন্ডিয়া কি বরবাদী! শালা আমাদের ট্যাক্সের টাকায় পড়বে আর দেশের নামে গদ্দারি করবে?
মারো সালে কো।
পিটো সালে কো।
ফাঁসি পে লটকা দো চুতিয়া কো।
ভারতমাতা কী জয়!
বন্দে মাতরম্।
পিটো সালে কো।
ফাঁসি পে লটকা দো চুতিয়া কো।
ভারতমাতা কী জয়!
বন্দে মাতরম্।
(পরের পর্বে শেষ করব)
http://achalsiki.com/2016/02/18/%E0%A6%AE%E0%A6%A8-%E0%A6%95%E0%A6%BF-%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%A4%E0%A6%83-%E0%A6%8F%E0%A6%95-%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A6%B6%E0%A6%A6%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A7%8B%E0%A6%B9%E0%A7%80%E0%A6%B0-%E0%A6%9C/
No comments:
Post a Comment