ছো ট গল্প ‘সমুদ্র’-এ, জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী একটা ভারী দামি কথা বলেন, ‘পৃথিবীর যে মানুষ প্রথম ঈশ্বরের কথা বলতে গিয়েছিল সে বাজে চরিত্রের লোক ছিল, ছোটলোক ছিল, আকাশের গ্রহনক্ষত্রের রহস্য যে বোঝাতে চেয়েছিল সে উন্মাদ ছিল, অপরাধী ছিল।’ সত্যি, অন্য রকম মানুষকে নিয়ে, তার নিজের মতো থাকাটাকে নিয়ে আমাদের সমাজের বাড়াবাড়ি রকমের গায়ের জ্বালা। সকলে অবশ্য সমাজের এই গা-জ্বালার থাপ্পড় ও টিপ্পনীকে মেনে নেওয়ার বান্দা নয়, কেউ একা, আবার কখনও কয়েক জন মিলে এই ‘অন্য’ হওয়ার অধিকার ছিনিয়ে নিতে লড়াই চলে। লড়াই মানে মারামারি নয়, শুধু সব কিছুকে উপেক্ষা করে, নিজের মতো হয়ে চলা। নিজের মতো থেকে যাওয়া। তাদের কথায়, গানে, পোশাকে, বাসস্থানে, ধর্মাচরণে আর জীবনযাপনে ঠিকরে পড়ে শেকলভাঙা জীবনদর্শন। স্বাধীনতার সত্যিকারের মানেটা দেখিয়ে আর বুঝিয়ে দিতে শুরু করে তারা।
একটা সময়, হিপিরা সমাজে অনেকটা আশ্চর্য অন্যরকমত্ব এনেছিলেন। আমরা সাধারণত হিপি বলতে বুঝি, লম্বা চুলের কিছু লোক, যারা দিনরাত নেশাভাঙ করে আর মহা ফাঁকিবাজ বলে জীবনের মূল স্রোতে ঢোকে না, দায়িত্ব নেয় না। মনে রাখতে হবে, যে বিটনিক শিল্পীরা কমিউন করে থাকতেন আর সমাজের প্রায় সব ক’টা শ্রদ্ধেয় প্রতিষ্ঠান ও প্রথাকে হেসে উড়িয়ে দিতেন, তাঁদের মধ্যে থেকেই অ্যালেন গিন্‌সবার্গ বা জ্যাক কেরুয়াক বেরিয়ে পৃথিবীর শিল্পের বাঁক বদলে দিয়েছিলেন। হিপিদের জীবন ও দর্শনে ‘বিট’দের প্রভাব প্রবল।

ছবি: গেটি ইমেজেস।
প্রথম বিশ্বের লোকজন হয়েও হিপিরা লোভের গোটা ফাঁদটাকেই এড়িয়ে যেতে চেয়েছিলেন। দশটা-পাঁচটার কেরানি-সংস্কৃতি আর সারা ক্ষণ লোলুপ জিভ বের করে ‘টিভি কিনতে হবে ফ্ল্যাট কিনতে হবে’-র দৌড়ে শামিল হওয়ার বাধ্যতা; পাইকারি হারে, দোকানের তৈরি একই ডিজাইনের পুতুলের মতো, সব্বার স্বপ্ন একদম একই ব্লুপ্রিন্ট চলার হাস্যকর ছক— একে আক্রমণ করতেই হিপিরা এর পুরোপুরি বাইরে একটা জীবন বেঁচে ও খেয়েমেখে বলতে চেয়েছিলেন, ভাই, তুমি তোমার বাবা ঠাকুদ্দা ও তার বাবা না হয়ে, বরং তুমি হও।
স্বামী-স্ত্রী-সন্তানের ইউনিটটাকে ভেঙে, সমাজের একক যে পরিবার— তার ধারণাটাকেই ভেঙে, কমিউন করে, সবাই মিলে একসঙ্গে থাকা হত। তা শুধু সম্মিলিত যৌনতার আশ্চর্য স্বাদের জন্য নয়, যদিও সেটা একটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ। কিন্তু এর মধ্যে ব্যক্তিগত সম্পত্তির ধারণাটাকেই প্রত্যাখ্যান করা হচ্ছে, আর তাই পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার গোড়ার ব্যাপারটারই বিরোধিতা করা হচ্ছে, তা নজর এড়িয়ে গেলে চলবে না। 
যে রাষ্ট্র একের পর এক যুদ্ধাস্ত্র বানায়, পারমাণবিক বোমা ফেলে বড়াই করে, সেই রাষ্ট্রকে শ্রদ্ধা করব না, যে মধ্যবিত্ত মূল্যবোধগুলো পৃথিবীকে দখল করে রেখেছে সেই ক্ষুদ্র মানসিকতার আড়তকে প্রণাম জানাব না, আর একটা বিকল্প জীবনযাপনের তরিকা খুঁজে চলব, এই ছিল হিপিদের মূল ভাবনা। হ্যাঁ, নেশা করতে তাঁরা বলতেন বইকী। চিৎকার করে সবাইকে ড্রাগ নিতে বলতেন। এটা কিন্তু ঠিক ইয়ং বেঙ্গলের মতো গো-হাড় ছুড়ে মজা পাওয়ার মতো নয়। ড্রাগ নাও, এলএসডি নাও, এই অনুরোধের মধ্যে মধ্যবিত্ত ভিতু মানসিকতার প্রতি ব্যঙ্গ নেই, আছে এই বিশ্বাস: যুক্তির মধ্যে, র‌্যাশনালিটির মধ্যে বন্দি থাকাও এক বিরাট পরাধীনতা। কখনও কখনও মনের পরিধিটাকে অনেক বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য, নিজের মধ্যে কতগুলো দেশবিদেশ আছে তার আভাস পাওয়ার জন্য, জীবনের আনন্দ-অভিজ্ঞতার সম্ভাবনা অনেকটা বাড়িয়ে নেওয়ার জন্য, মাদকের সাহায্যে ঘেরাটোপ পেরিয়ে যেতে হয়।
কবি জে স্টিভেন্‌স তো ‘এলএসডি’ সম্পর্কে এ কথাও বলেছেন, ‘এটা ছিল হিপিদের দীক্ষার মূল উপকরণ, একটা ‘হৃদয়ের সাবান’, যা বছর বছর ধরে হওয়া সামাজিক মগজধোলাইকে ধুয়ে দেবে, নতুন করে লিখবে নতুন মন্ত্র, তার চেতনাকে প্রসারিত করবে, এই ড্রাগের সাহায্যেই আমরা উঠে যাব বিবর্তনের মই বেয়ে, পরের ধাপে’! আমাদের মনে পড়ে যায় বিটলসের বিশ্বজয়ী গান, ‘লুসি ইন দ্য স্কাই উইথ ডায়মন্ডস’, যার প্রথম শব্দগুলোর আদ্যক্ষর মিলে ‘এলএসডি’-ই হয়! 
হিপিদের ভারতীয়রা ভাল চোখে দেখেনি, কিন্তু তাদের অস্বীকারও করা যায়নি। সত্যজিতের ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’তে হিপিদের দেখা যায় নাচতে, তপন সিংহের ‘এখনই’-তে চিন্ময় রায় হিপির ভূমিকায় অভিনয় করেন।আর হিন্দি ছবি ‘হরে রাম হরে কৃষ্ণ’-তে জিনাত আমনের হিপির ভূমিকায় ঘোর-লাগা নাচ তো আইকনিক। 
অনেকেই ড্রাগ বা ছন্নছাড়া যাপনকে একটা দর্শনে এনে ফেলার প্রয়াসটাকে নিতান্ত আমোদবিলাসীর কুযুক্তি ভাবতেই পারেন, কিন্তু এই লাগামছাড়া ‘অল্টারনেটিভ লাইফ’ বাঁচার সাংঘাতিক প্রভাব পড়েছিল সাহিত্য, সংগীত, সিনেমা, নাটক— শিল্পের সব শাখায়। হিপিদের যুদ্ধবিরোধিতা, যুদ্ধবাজদের দেখলে ফুল ধরিয়ে দেওয়া, পোশাকে গাড়িতে মারকাটারি রঙের ব্যবহার, কমিউনে যৌনতা নিয়ে নিরীক্ষা, সতীত্বের ধারণাকে উপেক্ষা করে সবাই মিলে আনন্দ-ভোগের আয়োজন নাড়া দিয়েছিল পৃথিবীকে। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক থেকে ‘বিটলস্‌’ তখন হিপিদের পক্ষে। ১৯৬৭-তে সান ফ্রানসিসকোর হিপি ফেস্টিভালে লাখো মানুষ এসে জড়ো হন। ’৬৯-এর অগস্টে বিখ্যাত উডস্টক ফেস্টিভালে হাজির হন চার-পাঁচ লাখ হিপি। সত্তরের দশকে হিপি-কালচার মার্কিন মুলুক পেরিয়ে পৌঁছে যায় ব্রিটেন, নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, চিলি-সহ দুনিয়ার নানা প্রান্তে। কেউ কেউ হিপিদের তো উইলিয়াম ব্লেক, অস্কার ওয়াইল্ড, ওয়াল্ট হুইটম্যানের  যোগ্য উত্তরসূরি বলে দাবি করেছেন।
১৯৬৪ সালে আমেরিকায় লেখক কেন কেসি’কে ঘিরে একটা বাউন্ডুলে দল গড়ে উঠেছিল, যাঁরা নিজেদের বলতেন ‘মেরি প্র্যাংকস্টারস’।  ‘ফারদার’ নামের একটা ছোট্ট, রঙিন স্কুলবাসে চড়ে এঁরা ঘুুরেছিলেন গোটা আমেরিকা। আর এক বাস-যাত্রায় মন জয় করে নিয়েছিলেন দেশের সব হিপিদের। সেই নিয়ে গান বেঁধেছিল আমেরিকার রক ব্যান্ড ‘গ্রেটফুল ডেড’—‘দ্যাটস ইট ফর দি আদার ওয়ান’: Escapin' through the lily fields/ I came across an empty space/ It trembled and exploded/ Left a bus stop in its place/ The bus came by and I got on/ That's when it all began/ There was cowboy Neal/ At the wheel/ Of a bus to never-ever land...
হিপিরা নিরামিষ অর্গানিক ফুড খেতেন, প্রচুর দর্শন পড়তেন, প্রাচ্যের অধ্যাত্মবাদ তাঁদের খুব টানত। চেনা লাগছে না? আজ যখন বিদেশিরা ‘যোগ’ নিয়ে হইহই করেন, বা সব দেশেই অর্গ্যানিক খাবার খাওয়াকে স্বাস্থ্য ও নীতির পক্ষে আদর্শ হিসেবে ঘোষণা করা হয়, হয়তো কোথাও হিপি কালচারই জিতে যায়! 


http://www.anandabazar.com/lorai/anunay-chattopadhyay-writes-on-hipi-1.192813