সে খানে গেলে, মনে হবে সাদা-কালো স্ক্রিনে কোনও পিরিয়ড ফিল্ম চলছে। ঘোড়ায় টানা গাড়ি যাচ্ছে, খেতে গরু বা ঘোড়া জুতে হাল টানা হচ্ছে, ঘরে ঘরে গরুর ঘন দুধ থেকে টাটকা মাখন তৈরি হচ্ছে। একটু বেলা গড়ালেই মহিলারা বাড়ি থেকে বেরিয়ে খেতের দিকে যাবেন। সঙ্গের ঝুড়িতে খাবার। দুপুরের খাওয়াটা সবাই মিলে খেতেই সারেন ওঁরা। আর রোববার চার্চের ঘণ্টা বাজলেই সারা গ্রাম হাজির প্রার্থনাঘরে।
এঁরা হচ্ছেন ‘আমিশ’। সতেরো শতকের শেষ দিকে, সুইজারল্যান্ডে জেকব আম্মান নামে এক জন বলতেন, যিশুর কথা অক্ষরে অক্ষরে মানো। তার জন্য যদি বাইরের জগতের নানা প্রলোভনকে এক্কেবারে ছেড়েছুড়ে থাকতে হয়, তা-ই থাকো। আম্মান-এর অনুগামীদেরই আমিশ বলে। আঠেরো শতকের প্রথম দিকটায় আমিশরা ইউরোপ ছেড়ে আমেরিকার পেনসিলভানিয়া অঞ্চলে চলে আসেন। এখনও মধ্য আমেরিকার পেনসিলভানিয়া, ওহায়ো, ইন্ডিয়ানাতেই বেশির ভাগ আমিশ গ্রামগুলো দেখা যায়। তবে, কানাডার অন্টারিয়ো’র কাছেও কিছু আমিশ আছেন। এঁদের পণ, পূর্বপুরুষরা যে ভাবে বাঁচতেন, সেই ঐতিহ্যটাকে প্রাণপণে জিইয়ে রাখবেন। গ্রামের দরজার বাইরে উনিশ, বিশ, একুশ— যে শতকই চলুক না কেন, তার ছায়াটুকুও পড়তে দেবেন না নিজেদের শান্ত জীবনে।

‘আমিশ গ্রেস’ ছবির দৃশ্য
বাইরের কেউ কিন্তু আমিশ হতেই পারেন না। এই স্বপ্ন-চৌহদ্দিতে ঢুকতে গেলে ওই গোষ্ঠীতেই জন্মাতে হবে। চোদ্দো থেকে পঁচিশের মধ্যে চার্চের সদস্য হয়ে নিলেই এই স্পেশাল-জীবন শুরু। কতগুলো নিয়ম মেনে চলতে হবে শুধু। আমিশ গোষ্ঠীর মধ্যেই বিয়ে সেরে ফেলতে হবে। গ্রামের মধ্যেই এক-কামরার স্কুল। সেখানে ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়ানো হয়। ব্যস, আর নয়। আমিশরা মনে করেন, বেশি জানলে গোল বাড়ে।
আর আমিশরা তো জীবন থেকে বেশি কিছু একটা দাবি করেন না। সবাই মিলে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ফসল ফলিয়ে খান, নিজেদের আসবাবটা নিজেরাই কাঠ কেটে বানিয়ে নেন (বাইরের দুনিয়ায় এই আমিশ ফার্নিচারের ভীষণ কদর), হাতে হাতে তৈরি করেন কাপড়ের বই, বাগান সাজানোর উপকরণ আর রোজকারের পোশাক।
ওঁরা ইলেকট্রিসিটি থেকেও শত হস্ত দূরে। বলেন, ওই তার বেয়েই যত আপদ আমাদের স্বর্গরাজ্যে হানা দেবে। টিভি, সিনেমার চিৎকার, কম্পিউটারে খুটখাট, আরও একশো ঝামেলা। তার চাইতে এই ভাল। সূর্যের সঙ্গে ভোর ভোর উঠে কাজকর্ম, চাষ-আবাদ শুরু হয়ে যায়। আলো মরে এলে অল্পবিস্তর কৃত্রিম আলো জ্বলে ঠিকই, সে-ও যতটুকু না হলেই নয় ততটুকু। সোলার প্যানেল বসিয়ে সৌরবিদ্যুতে ঝটপট দরকারগুলো সেরে ফেলা হয়। সন্ধে শেষ হতে না হতেই ডিনার করে সকলে শুয়ে পড়েন।
আমিশ গ্রামের ত্রিসীমানায় ফোন, ক্যামেরাও ঢুকতে পায় না। ফোনের যুক্তি তো সব্বাই জানে। ক্যামেরাও মনের কোণে হীনম্মন্যতাকে ডেকে আনে। যে কারণে আমিশরা নিজেদের বাচ্চাদের জন্য যে পুতুলগুলো গড়ে দেন, সেগুলো স্রেফ কাপড়ের কাঠামো। তার চোখ-নাক, মুখ, ঠোঁট নেই। অর্থাৎ, সুন্দর-অসুন্দরের আইডিয়াটা মাথাচাড়া দেওয়ার আগেই তাকে পাড়াছাড়া করে আসেন।
হ্যাঁ, খটকা তো আছেই। কেউ বলতে পারেন, এ কেমন স্বাধীনতা? এ তো কালো কাপড়ে ঢাকা একটা খাঁচার মধ্যে বাঁচা। কেউ বলবেন,  এই অপাপবিদ্ধ ইডেন-বাগানে শয়তান যে তার সাপ ঢোকাবে না, নিশ্চয়তা কী? এই প্রসঙ্গে দু’একটা খবর শোনানোর আগে এটুকু জানাই, আমিশদের চার্চের নিয়মে মোকদ্দমা ঠোকাও মানা।
সেটা ভাল করে জেনেই অনেকে এ সব গ্রামে ঘুরঘুর করে। এক আমিশের সহায়সম্বল দুটো গরুই কিনে, টাকা না দিয়ে পালিয়ে যায় বাইরের এক বদমাশ। সেই বুড়োমানুষটা অসুস্থ, হাসপাতালে বিল চোকাতেও পারছেন না, তবু আইন-আদালতে যাবেন না। বেমালুম ক্ষমা করে দিলেন। সাগরপারে সুদীপ্ত সেনেরও অভাব নেই। মনরো নামের এক জনের মিছরি-কথায় ভুলে শ’য়ে শ’য়ে আমিশ পরিবার তার ফান্ডে টাকা রাখছিল। কয়েক মাস যেতেই বহু আমিশ জীবনের সঞ্চয় খুইয়ে পথে বসলেন। মনরো জেলে ঢুকল ঠিকই, কিন্তু এক জন আমিশও তার বিরুদ্ধে নালিশ করলেন না! বরং নিজেরা ট্রাস্ট গড়ে, চার্চের সাহায্যে, চাঁদা তুলে সর্বস্বান্ত পরিবারগুলোকে সাহায্য করায় মন দিলেন। তেল আর গ্যাস কোম্পানিরা তো রোজ আমিশদের জপাবে। জমিগুলো লিজ নিয়ে মানুষগুলোকে ঠকানোই তাদের মূল উদ্দেশ্য। আমিশরা বলেছেন, যে যা করছে করুক। তাঁরা মাপ করে দিয়েছেন। কোর্ট-কাছারিতে যে নোংরামি আর হয়রানি, তার চেয়ে  টাকা যাওয়া ভাল।
বাক্যহারা করে দিয়েছিল ২০০৬ এর ২ অক্টোবর। চার্লস নামের মার্কিন যুবক আমিশ স্কুলে ঢুকে, বেছে বেছে ছয় থেকে তেরো বছরের ছাত্রীদের কয়েদ করে, এলোপাথাড়ি গুলি চালাল। পাঁচ জনকে মারল, বাকিদের আধমরা করে ছেড়ে দিল,  তার পর নিজে মরল।
রক্তাক্ত আমিশরা তখনও ক্রুশে বেঁধা যিশুর বাণী আঁকড়ে রইলেন। নাতনি হারানো এক দাদু তাঁর পরিবার-পরিজনকে বারবার সাবধান করলেন, কেউ যেন আততায়ীর বিরুদ্ধে মনে বিষ না রাখেন। নিজেদের শোক সামলে আমিশরা সেই খুনির পরিবারকে সান্ত্বনা দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন, তার শেষযাত্রায় পা মেলালেন, খুনির বিধবা স্ত্রী ও মা-বাবার জন্য ট্রাস্টও গড়লেন।
এই নিয়ে গল্পের বই, সিনেমা অনেক হয়েছে তার পর। কেউ বলেছেন, বোকা। কেউ বলেছেন, গুষ্টির মাথায় পোকা। কিন্তু আজ, ফাঁসি নয় ফাঁসি চাইয়ের রইরইয়ের মধ্যিখানে, স্বাধীনতার সকালে টগবগে দেশপ্রেমের পেয়ালা হাতে, আপনি কী বলবেন? 

http://www.anandabazar.com/lorai/%E0%A6%B8%E0%A6%AE%E0%A7%9F-%E0%A6%A5-%E0%A6%AE-%E0%A6%A5-%E0%A6%95-1.192803