Saturday, 15 August 2015

এ বার বাঘের খেলা

এ বার বাঘের খেলা

১৫ অগস্ট, ২০১৫, 
উ নিশ শতকের আশির দশক। উদ্যোগপতি প্রিয়নাথ বসু (‘হিন্দু মেলা’খ্যাত মনমোহন বসু-র ছেলে) সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টায় একটি সার্কাস দল তৈরি করলেন। নাম দিলেন ‘গ্রেট বেঙ্গল সার্কাস’। অল্প সময়ের মধ্যে বিখ্যাত সার্কাস-দল ‘গ্রেট ইন্ডিয়ান সার্কাস’কেও গ্রেট বেঙ্গল-এর ছাতার তলায় নিয়ে এলেন। তার পর নামডাক হতে আর দেরি হল না। ১৮৮৮-র ডিসেম্বরে রংপুরে তাজহাট রাজবাড়িতে খেলা দেখানোর ডাক পেল গ্রেট বেঙ্গল। খেলা দেখে রাজা গোবিন্দলালের মন ভরে গেল, তিনি খেলা বাবদ টাকা তো দিলেনই, পঁচিশ জোড়া শালও উপহার দিলেন। এ বার গ্রেট বেঙ্গল পা রাখল বাংলার বাইরে। ফৈজাবাদ, রাওয়ালপিণ্ডি, লাহৌর, করাচি হয়ে পৌঁছল তখনকার বোম্বাই প্রদেশে। ১৮৯৬ সালে, গ্রেট বেঙ্গলের লক্ষ্মীলাভ ঘটল। এত দিন সার্কাসটি জিমনাস্টিক্‌স, ঘোড়া, কুকুর, বাঁদরের খেলা দেখাত, কিন্তু বাঘের খেলা ছিল না। খেলা দেখে মুগ্ধ হয়ে রেওয়া-র রাজা এক জোড়া সুন্দরবনের বাঘ উপহার দিলেন। তাদের  নাম দেওয়া হল লক্ষ্মী ও নারায়ণ। এই লক্ষ্মীনারায়ণের কৃপায়, গ্রেট বেঙ্গল উঠল সাফল্যের শীর্ষে।

এটা গ্রেট বেঙ্গল সার্কাস-এর ছবি নয়। কিন্তু এই বাঘে-মানুষে মোকাবিলার রোমাঞ্চ গ্রেট বেঙ্গল কবেই আমদানি করেছিল!
গ্রেট বেঙ্গল সার্কাসের দাপটে, তাবড় ব্রিটিশ কোম্পানির সার্কাস পাততাড়ি গুটিয়ে জাহাজে উঠতে লাগল। বাণিজ্যদক্ষতা ও বীরত্ব, প্রায় অ-বাঙালিসুলভ এই দুটি গুণ কাজে লাগিয়ে প্রিয়নাথ বসু এক আশ্চর্য লড়াই শুরু করলেন। ব্রিটিশদের হাত থেকে সার্কাসের বাজার ছিনিয়ে নিলেন, এই আত্মবিশ্বাস ছড়িয়ে দিলেন: যদি পরাধীন ভারতে থেকেও বাঙালিরা একটা ক্ষেত্রে ইংরেজদের হারিয়ে দিতে পারে, অন্য বহু ক্ষেত্রেও তা সম্ভব। মোহনবাগানের সেই ঐতিহাসিক ফুটবল ম্যাচ জেতার মতোই, ব্যায়ামের আখড়া থেকে এক বাঙালির এমন সফল সার্কাস তৈরি করে ফেলা আর সর্বত্র তার সাংঘাতিক খ্যাতি— গোটা বাঙালি জাতের কাছেই তুমুল প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছিল। 
উনিশ শতকের বাঙালি মেয়ে বলতে বোঝাত ঘোমটা-আঁটা নতমুখী অন্তরালচারিণী। সেই সময়ে দাঁড়িয়ে গ্রেট বেঙ্গল সার্কাসে বাঘের খেলা দেখিয়েছেন সুশীলাসুন্দরী। ‘ইংলিশম্যান’ পত্রিকায় তখন ভারতীয়দের বিরুদ্ধেই লেখা ছাপা হত বেশি, কিন্তু সেই কাগজের সম্পাদক নিজেই লিখছেন— ‘হিন্দু স্ত্রীলোকদিগের দুর্নাম যে তাঁহারা বড় ভীরু, কিন্তু এই সুশীলাসুন্দরী একগাছি ছড়ি পর্যন্ত না লইয়া, নির্ভয়ে ব্যাঘ্র-বিবরে প্রবেশপূর্ব্বক দুইটি বাঘের সহিত খেলায় এরূপ অমিত সাহসের পরিচয় দেন, যে তাহা দেখিলে সত্যই চমকিত হইতে হয়।’ সুশীলার আর একটি জনপ্রিয় খেলা ছিল ‘জীবন্ত সমাধি’। রিং-এর এক দিকে গর্ত খুঁড়ে, সুশীলাকে সমাধি দেওয়ার মতো করে পুঁতে রাখা হত। তার পর কিছু সময় চলত ঘোড়ার খেলা। দর্শকের ভিড়ে তখন চাপা উদ্বেগ, টান টান উত্তেজনা। সবাই যখন অঘটনের ভয়ে প্রহর গুনছে, ঠিক সেই সময় আবার গর্ত খোঁড়া হলে সহজ স্বাভাবিক ভাবে বেরিয়ে আসতেন সুশীলাসুন্দরী।
তাঁর এই জীবন্ত সমাধি খেলার সময় এক বার ভয়ংকর দুর্ঘটনা ঘটে। পশ্চিমের কোনও এক শহরে খেলা চলছে। সুশীলাসুন্দরীকে ‘পুঁতে দেওয়া’ হয়েছে। হঠাৎ ‘আঁধি’ উঠে সব লন্ডভন্ড হয়ে গেল। ঝড়ের প্রথম ধাক্কাতেই তাঁবুর একটা অংশ ছিঁড়ে বেরিয়ে গেল। চার দিকে হুলস্থুল, গেল-গেল রব। সার্কাসের লোকেরা কেউ তাঁবু সামলাচ্ছে, কেউ বা দর্শকদের নিরাপদে বের করে দিতে ব্যস্ত। তত ক্ষণে মুষলধারে বৃষ্টি নেমেছে। ক্রমে সমস্ত খেলোয়াড় একে একে তাঁবু থেকে নিজেদের ঘাঁটিতে ফিরে এসেছে। হঠাৎ এক জন খেলোয়াড়ের খেয়াল হল, সুশীলা নেই। তক্ষুনি হ্যারিকেন নিয়ে কয়েক জন ছুট লাগাল। চারিদিকে যেন ধ্বংসস্তূপ। তার মধ্যে একটি রিং-এর খুঁটিতে হেলান দিয়ে আধশোওয়া হয়ে থরথর কাঁপছেন সুশীলা। গর্তের ভেতরে যখন তাঁর প্রায় শ্বাস রোধ হয়-হয়, তখন দেহের সমস্ত শক্তি দিয়ে মাটি ঠেলে উপরে উঠে আসেন। তাঁর বীরত্বের এই সত্যিকারের গল্প সে সময়ে বাঙালির ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়েছিল।
আর এক বীর ছিলেন বাদলচাঁদ। তিনি বাঘের খাঁচায় ঢুকে তুড়ি দিয়ে ইশারা করতেন, বাঘ লাফিয়ে পড়ত তাঁর ঘাড়ে। হয়তো ঝাঁকুনি দিয়ে ঠেলে ছুড়ে দিলেন একটিকে, তক্ষুনি ঝাঁপিয়ে এল আর একটি। এই ভাবে কুস্তি চলত বেশ খানিক ক্ষণ। তার পর কানমলা দেওয়া, লাথি মারা, লেজ ধরে টানা, এমন নানা ভালবাসার অত্যাচার চলত বাঘে-মানুষে। খেলার একেবারে শেষে বাদলচাঁদ বাঘের মুখ হাঁ করে ধরে নিজের মাথা ঢুকিয়ে দিতেন। তখন মাঝে মাঝেই দর্শক-আসন থেকে ভেসে আসত আর্ত চিৎকার। অনেকে ভয়ে তাঁবু ছেড়ে বেরিয়ে যেত। অথচ এই রোমহর্ষক মুহূর্তের সাক্ষী হওয়ার জন্যই টিকিট কাটার লম্বা লাইন পড়ত।
এই সার্কাসকে নিয়ে গোটা ভারতবর্ষে কেমন উচ্ছ্বাস তৈরি হয়েছিল, প্রিয়নাথের কিছু বর্ণনা থেকেই স্পষ্ট। এক বার লাহৌরে গ্রেট বেঙ্গলের শেষ রজনীকে ঘিরে মানুষের উন্মাদনা চরমে পৌঁছয়। শেষ রাতের বিজ্ঞাপন পাওয়া মাত্র, শুরু হয়ে যায় টিকিট বুকিং। বেগতিক বুঝে বিকেল থেকেই কর্মকর্তারা তাঁবুর জায়গা বাড়ান, বাড়তি চেয়ারের ব্যবস্থাও করেন প্রচুর, তবু শেষ রক্ষা হয়নি। প্রিয়নাথের বর্ণনায়: ‘৯টা বাজিয়া গিয়াছে অথচ এখনও খেলা আরম্ভ হইতেছে না, ইহার কারণ কিছুই বুঝিতে পারিলাম না। দেখি, লোকের কোলে লোক। চেয়ারের পৃষ্ঠের কাষ্ঠের উপর একজন বসিবার স্থানে একাধিক জন। গ্যালারীতে চতুর্গুণ লোক জোর করিয়া যাওয়ায় দুই এক স্থান মড়্ মড়্ শব্দে ভাঙিয়া গেল। আমি তো ঘোর বিপদে পড়িলাম— ভিতরে যাইবার এমন তিলার্দ্ধ স্থান নাই যে আহত ব্যক্তিগণের শুশ্রূষার ব্যবস্থা করিয়া ভগ্ন গ্যালারির সংস্কার করি। আমাকে সশরীরে উপস্থিত দেখিতে পাইয়া, একটা মার-মার কাট-কাট রব উঠিল— আনন্দ, ভয়, অস্বস্তি মিলিয়া তখন মনের মধ্যে একটা অদ্ভুত অনুভূতি জাগিয়া উঠিল।’
এক সময় এই বাঙালি সার্কাস দেশের সীমানা ছাড়িয়ে পৌঁছে গেল মালয়, সুমাত্রা, জাভা এমনকী ব্রহ্মদেশ (এখন মায়ানমার) পর্যন্ত। বছরের অন্য সময় দেশে-বিদেশের নানা প্রান্তে কাটালেও, প্রত্যেক বছর শীতের সময় তারা ফিরে আসত কলকাতার মাঠে। তাঁবু পড়ত ময়দানে। বঙ্গভঙ্গের পর বাঙালির মধ্যে দেশাত্মবোধ যখন প্রবল হয়ে উঠেছে, গ্রেট বেঙ্গল সার্কাস যেন নতুন করে সমাদর পেল। পথেঘাটে, ঘরে ঘরে ‘বোসের সার্কাস’ দেখার কথা মুখে মুখে ফিরছে। খেলা দেখাতে দেখাতে মাঝে মাঝে প্রিয়নাথ গুরুগম্ভীর গলায় স্বদেশি আন্দোলনের সপক্ষে কিছু কথাও বলতেন। অমনি গ্যালারি থেকে হইহই করে দর্শক চেঁচিয়ে উঠত, ‘বন্দে মাতরম’! খেলার পটুতা, সাহস আর চ্যালেঞ্জের মধ্যে, স্বাধীনতা সংগ্রামকে নিপুণ ভাবে বুনে দেওয়া হত।


http://www.anandabazar.com/lorai/%E0%A6%8F-%E0%A6%AC-%E0%A6%B0-%E0%A6%AC-%E0%A6%98-%E0%A6%B0-%E0%A6%96-%E0%A6%B2-1.192798

উ নিশ শতকের আ

No comments:

Post a Comment