বাবাকে ডিভোর্স দেব
কিংবা মা’কে। খুব বিরল হলেও, এই দাবি উঠেছে। শিশু জিতেওছে মামলা। বাবা-মা যখন তাঁদের কর্তব্যে ডাহা ফেল, তখন কি তাঁদের হাত থেকে মুক্তির চেষ্টা করার অধিকার সন্তানের নেই? পৌলমী দাস চট্টোপাধ্যায়
১৫ অগস্ট, ২০১৫,
প্যা ট্রিক হল্যান্ড যখন এই দাবি জানিয়েছিল, তার বয়স মোটে চোদ্দো। স্পষ্ট ভাষায় সে বলে দেয়, বাবার সঙ্গে কোনও সম্পর্কই আর রাখতে চায় না। মায়ের ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহটা এখনও তার চোখের সামনে ভাসে। নরম তুলতুলে শিশু-মনটা তো সেই দিন থেকেই জমে বরফ। সপ্তাহে এক বার কাউন্সেলিং হয় তার। ওই ঘটনাটার সময় কতই বা বয়স হবে প্যাট্রিক হল্যান্ডের? বছর আটেক। তার বাপ-মায়ের মধ্যে বনিবনা ছিল না। ফলে ম্যাসাচুসেট্স-এ কুইন্সি-র বাড়িটাতে মায়ের সঙ্গেই থাকত সে। হঠাৎ এক দিন সকালে ঘুম ভেঙে প্যাট্রিক দেখল পাশের ঘরে ঘুমন্ত মায়ের শরীরটা কে যেন ফুঁড়ে দিয়েছে বুলেট দিয়ে, থেঁতো করেছে প্রচণ্ড আক্রোশে। খুনি অবশ্য ধরা পড়ল। খুনি, ছেলেটার বাবা ড্যানিয়েল হল্যান্ড। যাবজ্জীবন কারাদন্ডের সাজা হল তার। কিন্তু একরত্তি ছেলেটা থাকবে কার কাছে? আইনি টানাপড়েনে নামল এক দিকে প্যাট্রিকের দাদু-ঠাকুমা, অন্য দিকে তার মায়ের এক বন্ধু ও তার পরিবার। শেষে মিটমাট একটা হল। আপাতত প্যাট্রিক থাকবে সেই বন্ধু-পরিবারের কাছেই। এ ব্যবস্থায় প্যাট্রিকও খানিক স্বস্তি পেল।
কিন্তু ড্যানিয়েল হল্যান্ড তো এমন সহজ সমাধানে তুষ্ট থাকার বান্দা নয়। জেলে বসেই চলল তার অবাধ খবরদারি। প্যাট্রিক অপ্রাপ্তবয়স্ক। সুতরাং আইনমাফিক বাবাই তার অভিভাবক। সেই মতোই খোঁজখবর চলতে লাগল, স্কুলে প্যাট্রিকের রিপোর্ট কেমন, সপ্তাহে এক বার তার যে কাউন্সেলিং হওয়ার কথা ছিল, সেগুলো কেমন চলছে। এর সঙ্গেই ড্যানিয়েল হাত বাড়াল স্ত্রীর সম্পত্তির দিকেও। একমাত্র ছেলের লালনপালন করতে হবে তো!
কিন্তু ড্যানিয়েলের অতি যত্নে বানানো ছকটা বানচাল হয়ে গেল। যার জন্য তার এমন ভয়ানক মাথাব্যথা, সেই চোদ্দো বছরের ছেলেই বসল বেঁকে। বাবার বুলেট মা’কে কেড়েছে তার কাছ থেকে। অথচ সেই খুনি বাবাকেই নাকি খাতায়-কলমে ‘অভিভাবক’ মানতে হবে! জানাতে হবে, সে অংক পরীক্ষায় কত নম্বর পেল, স্পোর্টসে আদৌ ভাল করতে পারছে কি না! কেন? কচিবেলাটাকে দু’হাতে আগলে একটু একটু করে বড় করে তোলার দায়িত্ব তো বাবা-মায়েরই হাতে। কিন্তু তারাই যখন সে পরীক্ষায় ডাহা গোল্লা খেয়ে বসে, তখনও কি তাদের বাবা-মা হয়ে থাকার অধিকার আছে? প্যাট্রিকের ডিভোর্স চাওয়ার মধ্যে এই প্রশ্নটাই ছুটে গিয়েছিল বিচারকদের কাছে।
এই মার্কিন মুলুকেরই আর এক শিশু গ্রেগরি কিংসলে আবার মুক্তি চেয়েছিল তার মায়ের কাছ থেকে। আদর নয়, গ্রেগরির গোটা ছেলেবেলাটা কেটেছে এক দিকে মা আর অন্য দিকে বাবার কাছে একটু নিশ্চিন্ত আশ্রয়ের খোঁজে দৌড়োদৌড়ি করে। বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ-শেষে সে তখন তার বাবার কাছে। বাবা অ্যালকোহলিক। মায়ের সঙ্গে গ্রেগরির যোগাযোগ রাখায় বিন্দুমাত্র আগ্রহী নয়। কিন্তু গ্রেগরি তার মায়ের কাছেই গেল। ওখানে তার দুটো ভাইও রয়েছে যে। কিন্তু আশ্রয় সেখানেও জুটল না। ড্রাগ-আসক্ত মা গ্রেগরিকে পাঠাল ‘বয়েজ শেল্টার’-এ। এখানেই জর্জ রাস-এর সঙ্গে দেখা হয় গ্রেগরির। তাঁর হাত ধরেই সে নিজের ছেঁড়াফাটা ছেলেবেলাটাকে কিছুটা জোড়া দেওয়ার চেষ্টা করে। জর্জ এবং তাঁর স্ত্রী গ্রেগরিকে দত্তক নেন এবং গ্রেগরি মায়ের সঙ্গে ডিভোর্সের আবেদন করে। জুভেনাইল কোর্টে বিচারপতি জানান, গ্রেগরির মা শুধু নিজের সন্তানকে চরম অবহেলাই করেনি, নিজের কাছ থেকে তাকে আলাদাও করে দিয়েছে। সুতরাং এখানেই তার অভিভাবকত্বের ইতি টানা বাঞ্ছনীয়। মামলা জিতে যায় গ্রেগরি। সে-ই প্রথম মার্কিনি খুদে, যে মাত্র বারো বছর বয়সে মায়ের সঙ্গে আইনি বিচ্ছেদ পেয়েছিল। মামলা জিতে সে উপহার পায় একটা টি-শার্ট। তাতে লেখা শন রাস, তার নতুন নাম। আর লেখা ‘৯’। রাস-পরিবারের নবম সন্তান যে সে।
এমন সব কাণ্ডকারখানার কথা জেনেশুনে আমাদের একটা বিরাট ধাক্কা লাগা স্বাভাবিক। ‘ডিভোর্স’ শব্দটাকে তার চেনা গণ্ডির বাইরে টেনে এনে এখানে এমন এক জন বা দু’জনের দিকে তাক করা হচ্ছে, যার বা যাদের সঙ্গে শিশুটির আজন্ম সম্পর্ক, রক্তের সম্পর্ক। বিশেষ করে মা’র সঙ্গে কোনও সন্তান স্বেচ্ছায় বিচ্ছেদ চাইতে পারে, মেনে নিতে কষ্ট হয় খুব। আমরা তো বিশ্বাস করি, কুপুত্র যদি বা হয়, কুমাতা কখনও নয়। তাই পয়সা, বাংলো, গাড়ি, চাকর, ব্যাংক-ব্যালেন্স মিলিয়েও ‘মা’-র সমান ওজন মেলে না। আমাদের ধর্মগুরুরা উপদেশও দেন, মা-বাবাই ভগবান। মুশকিল হল, বহু মা-বাবা তা বোধ হয় জানে না। তাই শয়তানের মতো আচরণ করে। ছেলেকে টেবিল টেনিস প্লেয়ার বানাতে গিয়ে, তার গাফিলতি সহ্য না করতে পেরে তাকে পেটে আঘাত করে খুন করে ফেলে। বহু বাবা বাড়িতে এসে বাচ্চার সামনে মা’কে বেধড়ক পেটায়। অনেক সময় বাবা তার মেয়েকে দিনের পর দিন যৌন নির্যাতন করে। কখনও কিশোরী মেয়ে বেজাতে প্রেম করলে, সন্তানকে ‘অনার কিলিং’-এ নিকেশ করার পরিকল্পনাকে মা হইহই করে সাপোর্ট করে। এই সব ক্ষেত্রে, যে-ই সন্তানের জীবনকে নষ্ট করুক, মা বা বাবা, তার বিরুদ্ধে লড়াই চালানো যাবে না কেন? পাশ্চাত্যে এই লড়াইকে নিয়ে সিনেমাও হয়েছে।
আমাদেরও, ‘উড়ান’এর মতো ছবি হয়, যেখানে নৃশংস বাবার অত্যাচার থেকে ছোট্ট দুই ছেলেকে পালিয়ে বাঁচতে হয়। তারা কিন্তু আইনি লড়াইয়ের কথা ভাবতে পারেনি। এখানেই স্বাধীনতার প্রশ্নে অনেকটা এগিয়ে থাকে পশ্চিম। ভরা আদালতে, হাজার হাজার উৎসুক চোখের সামনে দাঁড়িয়ে মদ্যপ, খুনি, অত্যাচারী বাবা-মায়ের অভিভাবকত্বকে সপাটে অস্বীকার করার কলজে দেখাতে পারে তাদের কিছু কিছু ছেলেমেয়ে। তারা খোঁজ দেয় স্বাধীনতার এক অনাস্বাদিত দিকের, যেখানে দরকার পড়লে ত্যাগ করা যায় নিজের জন্মদাতা বাবা-মা’কেও। রক্তের সম্পর্কহীন মানুষদেরও বসানো যায় সবচেয়ে ভরসার জায়গা দুটোয়। স্বেচ্ছায়।
http://www.anandabazar.com/lorai/poulami-das-chatterjee-writes-on-responsibility-of-parents-1.192800
No comments:
Post a Comment