তামাশা বা কবিতার ঝাঁজ
ক্ষমতার চূড়ান্ত ঔদ্ধত্যের মোকাবিলা করতে গিয়ে বহু সিনেমাই অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে স্যাটায়ার বা কবিতা। স্বৈরাচারী ল্যাজে-গোবরে হয়, স্বপ্নের মুখোমুখি হয়ে ডিক্টেটরের যুক্তি গুলিয়ে যায়। শান্তনু চক্রবর্তী
১৫ অগস্ট, ২০১৫
সে এক কেলেংকারিয়াস কাণ্ড! এক ঝাঁক মার্কিনি বোমারু বিমান বোঁ বোঁ করে উড়ে চলেছে সাবেক সোভিয়েত রাশিয়ার দিকে। উদ্দেশ্য বিলকুল সাফসুতরো! ‘কমি’ ব্যাটাদের বড্ড তেল বেড়েছে। ওদের দু-একটা এলাকা তাক করে দু-চার পিস নিউক্লিয়ার বোমা টপকে দিয়ে চলে আসতে হবে। মার্কিন রাষ্ট্রপতির ওয়ার-রুম থেকে ফোন করা হল রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রীকে।
সে এক দুর্ধর্ষ ফোনালাপ! রাশিয়ান দূতমশাই মার্কিনবাবুকে হুঁশিয়ারি দিয়েই রেখেছিলেন, এত রাত্তিরে ক্রেমলিনের প্রাসাদে আমাদের ‘লাল’ জার-বাহাদুর গলা অবধি ভদকা গিলে বেশ একটু টানুস-টুনুস আছেন। আমেরিকার ‘ইনি’ ফোনটা হাতে নিয়েই সেটা মালুম পেলেন। কয়েক বার থতমত আর হোঁচট খেয়ে, একটু কিন্তু-কিন্তু করে শেষে বলেই ফেললেন, ভাই দিমিত্রি, তোমার মিউজিক সিস্টেমের আওয়াজটা একটু না কমালে তো আমার কোনও কথাই শুনতে পাবে না! ঠান্ডা যুদ্ধের সেই কনকনে ওয়েদারে, কূটনৈতিক রসালাপে খানিকটা আপন-আপন ভাব, একটু উষ্ণতার ছোঁয়া আনতেই রুশ প্রধানমন্ত্রীর পয়লা নাম ধরে এত ডাকাডাকি।
‘দ্য গ্রেট ডিক্টেটর’ ছবির দৃশ্য
পরিচালক স্ট্যানলি কুব্রিক-এর ১৯৬৪ সালের ছবি ‘ডক্টর স্ট্রেঞ্জলাভ অর: হাউ আই লার্নড টু স্টপ ওরিং অ্যান্ড লাভ দ্য বম্ব’-এ, দুই সাংঘাতিক শক্তিশালী দেশের দুই রাষ্ট্রপ্রধান, কে কম ‘হ্যালো’ বলেছেন, বা কে বেশি ‘সরি’ হলেন, তাই নিয়ে রীতিমত ঠোঁট ফুলিয়ে ফোনে মান-অভিমান করছেন! সোভিয়েত নেতার মান ভাঙাতে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বাবা-বাছা তোয়াজ করছেন, আবার দিমিত্রির খোঁচা-মারা বাঁকা কথায় প্রেসিডেন্ট সাহেবের গলা আবেগে ধরা-ধরা, সেন্টিমেন্টে স্যাঁতসেতে। আর এই মানভঞ্জন-পালার ফাঁকেই রাশিয়ার আকাশে চক্কর কাটছে আমেরিকান বোমারু! ও দিকে রাশিয়ার তরফেও পালটা ‘ডুম্স ডে মেশিন’ রেডি হয়েই আছে। আমেরিকা-সুদ্ধ গোটা পশ্চিমি দুনিয়াকে শ্মশান বানাতে যার লাগবে মাত্র কয়েকটা সেকেন্ড।
যে পাগলাটে বেস-কম্যান্ডার রাশিয়ায় বোমা ঝাড়ার সিগনাল পাঠিয়েছে, পৃথিবী-কুখ্যাত সিরিয়াল কিলারের নামেই তার নাম জ্যাক ডি রিপার! আর তার এয়ারবেস-এর দেওয়াল, দরজা, সাইনবোর্ডে জ্বলজ্বল করছে ঘোষণা: ‘পিস ইজ আওয়ার প্রফেশন’! সেই ‘পেশা’র ইজ্জত রাখতেই প্লেনের পকেটে ‘শান্তির বাণী’ নিয়ে রাশিয়ার মগজে ঢেলে আসার উড়ানের দায়িত্ব যার, কুব্রিক তার মাথায় পাইলটের হেলমেটের বদলে একটা কাউবয়-টুপি পরিয়ে দেন। আমেরিকার ‘বীর’ কিনা!
ছবিটার মস্ত নামেই মালুম, পরিচালকের টার্গেটটা কী। রাশিয়া-আমেরিকা মিলে সারা ক্ষণ এই যুদ্ধ-যুদ্ধ ভাব জিইয়ে রাখা, রোজ রোজ বেশি বেশি মানুষ খুন করার নিত্যনতুন অস্ত্রের সফল পরীক্ষা, আর পৃথিবীসুদ্ধ মানুষের সেটাকে মুখ বুজে গা-সওয়া করে ফেলা— ঠান্ডা যুদ্ধের এই পুরো ব্যাপারটাকেই কুব্রিক তুমুল তুখড় ঠাট্টায় এতোল-বেতোল করে দিয়েছেন।
অনেক সময়েই, কোনও প্রতিবাদেই যাকে খুব একটা ঘায়েল করা যাচ্ছে না, তুমুল হাসিঠাট্টা তাকে অনেকটা পেড়ে ফেলে। তামাশা অনেক সময় ক্ষমতাবানের চোখে চোখ রেখে বলতে পারে, তুমি একটি ধুর্-ফুটো রংবাজ— পাঁচপেঁচি পাবলিকের সঙ্গে তোমার কিস্যু ফারাক নেই! ঠান্ডা যুদ্ধের ভরা বাজারে কুব্রিক যে ভাবে ওয়াশিংটন আর মস্কোকে নিয়ে মশকরা করলেন, আড়াই দশক আগে সে ভাবেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ঘাড়ের ওপর নিয়ে নাত্সি জার্মানি আর তার সর্বশক্তিমান ‘ফুয়েরার’ হিটলারকে স্রেফ সার্কাসের ক্লাউন বানিয়ে ছেড়েছিলেন চার্লস চ্যাপলিন। ’৬৪-তে কুব্রিক যখন ‘ডক্টর স্ট্রেঞ্জলাভ’ বানাচ্ছেন, তখন তাঁর মাথায় হয়তো দুই বছর আগের কিউবা সংকট, মিসাইল-ঘাঁটি বসানো নিয়ে রুশ-আমেরিকা ইগোর দড়ি-টানাটানির ব্যাপারটা ছিল। কিন্তু ‘দ্য গ্রেট ডিক্টেটর’-এ চার্লি ‘হয়তো’, ‘হতেও পারে’ গোছের আড়াল-আবডাল রাখেননি। সরাসরি হিটলার ও ফ্যাসিবাদই এখানে তাঁর চাঁদমারি। বিশ্বযুদ্ধ শুরুর দু-তিন সপ্তাহের মধ্যে এ ছবির শুটিং শুরু হচ্ছে, আর যখন ১৯৪০-এর অক্টোবরে ছবি মুক্তি পাচ্ছে, তত দিনে অর্ধেক ইউরোপ নাত্সি বুটের তলায়।
এই জায়গায় দাঁড়িয়ে চ্যাপলিন হিটলার আর মুসোলিনির আদলে একটা হিংকেল আর একটা নাপালোনিকে নিয়ে আসছেন। এবং দর্শকের সামনে প্রমাণ করে দিচ্ছেন, চেয়ারের লিভার ঘুরিয়ে দুজন দুজনকে ছাড়িয়ে যতই ওপরে ওঠার চেষ্টা করুক না কেন, ডিক্টেটররা আসলে নেহাতই খাটো মাপের লোক। ভিতু, মেগালোম্যানিয়াক। পৃথিবীসুদ্ধ লোককে ভয় খাওয়ানো মহান ডিক্টেটরবাবু বেলুনের গ্লোব নিয়ে লোফালুফি খেলতে খেলতে যখন ফটাস করে ফাটিয়ে ফেলে, তখন ছোট বাচ্চাদের মতোই ফ্যাঁচফ্যাঁচ ফোঁতফোঁত করে কান্না জোড়ে। চ্যাপলিন তো এটাই চাইতেন! ক্ষমতাকে যতটা পারো, হাস্যকর, ল্যাজে-গোবরে, ভাঁড় বানাও! ওর ফোলানো-ফাঁপানো পাবলিক ইমেজের হাওয়া বের করে দাও! চ্যাপলিনের ভাষায়: ‘দ্য বিগার দ্যাট ফেলো গেট্স, দ্য হার্ডার মাই লাফটার উইল হিট হিম।’
যে রাজনীতি কোটি কোটি মানুষকে দুনিয়া থেকে স্রেফ মুছে ফেলতে চায়, তাকে নিয়ে শুধু ইয়ার্কি মারা যায় কি না, সে ব্যাপারে তর্ক চলতেই পারে। তবে ‘আল্ফাভিল’ ছবিটায় গোদার যখন একটা স্বৈরাচারী ব্যবস্থার মহড়া নেন, তখন ওপর-ওপর কোথাও কোনও ফাজলামির ব্যাপার থাকে না। বরং সায়েন্স ফিকশন, স্পাই থ্রিলার ইত্যাদি হলিউডের নানা রকম ফর্মুলা মশলা ঘেঁটেঘুঁটে শেষ অবধি গোদার যে পদটা বানান, সেটা একদম তাঁর নিজের ঘরানার কুটকুটে কালো কমেডি। আল্ফাভিল আসলে ভিন-গ্যালাক্সির একটা তারা। ‘আলফা-সিক্সটি’ নামে একটা সুপারকম্পিউটার সেখানকার সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করে। আর এই কম্পিউটারটা যিনি বানিয়েছেন সেই প্রফেসর ফন ব্রাউনই বকলমে এখানকার শাসক। ফন ব্রাউনের আপন দেশে প্রেম, কান্না, হাসি, এ সব বেফালতু আবেগ সব মানা। স্ত্রীর মৃতদেহের সামনে চোখের জল ফেললে গুলি করে মেরে ঝকঝকে সুইমিং পুলের টলটলে অ্যান্টিসেপ্টিক জলে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। এখানে সব কিছু যুক্তির নিয়মে চলে। ডিকশনারি থেকে প্রতি দিন পুরনো অকাজের শব্দ বাতিল করে কম্পিউটারের মর্জিমাফিক নতুন নতুন শব্দ যোগ হয়। ‘গ্র্যান্ড ওমেগা মাইনাস’ নামে যন্তরমন্তর ঘরে লোকেদের মগজধোলাই করে অন্য গ্রহে বন্ধ, হরতাল, বিপ্লব ইত্যাদি ঝামেলা পাকাতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
অনেকটা সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন বা পূর্ব ইউরোপের ‘লাল সাম্রাজ্য’র মতো মনে হচ্ছে তো? আসলে একনায়কতন্ত্র পার্টিরই হোক বা কম্পিউটারের, তার মোডাস অপারেন্ডি প্রায় একই রকম! মানুষের মগজ দখল করাটাই পয়লা লক্ষ্য। তাই এদের মোকাবিলাটাও মগজ দিয়েই করতে হয়। এখানে প্রফেসর ব্রাউন আর তার কম্পিউটার-রাজ খতম করতে যে সিক্রেট এজেন্টটি আল্ফাভিল-এ পা রাখে, একেবারে বন্ড-মার্কা এই লোকটি ঠাঁই-ঠাঁই-ঠাঁই-ঠাঁই-ঠাঁই করে পিস্তল চালাতে, চান্স পেলেই মেয়েমানুষ চেখে নিতে ওস্তাদ, কিন্তু আলফা-সিক্সটি’র সঙ্গে এনকাউন্টারে তার হাতিয়ার কবিতা! হ্যাঁ, কবিতা। কারণ, যুক্তি আর কার্য-কারণ বিশ্লেষণ দিয়ে সাজানো সুপারকম্পিউটারের প্রোগ্রাম-ভুবনে সেটা একেবারেই ‘ফোরেন মাল’! আবেগ-ফাবেগ, অনুভূতি-টনুভূতি, কী সব আজেবাজে অচেনা জিনিসে ঠাসা! সেই শত্রুকে বুঝে ওঠাই অসম্ভব আলফা-সিক্সটির পক্ষে, তাই মোকাবিলা করারও প্রশ্ন ওঠে না। ফলে তার সুপার-সিস্টেম পুরো ঘেঁটে-গুলিয়ে একশা হয়ে যায়। কম্পিউটারজি দেহ রাখেন। সেই বীর এজেন্টও প্রফেসর ব্রাউনের নাতাশাকে উদ্ধার করে ‘আউটল্যান্ড’-এর মুক্ত বিশ্ব, থুড়ি গ্যালাক্সির দিকে গাড়ি হাঁকিয়ে চলে যায়। আর ‘প্রেম’ শব্দের মানেই না বোঝা নাতাশাও যেতে-যেতে পথে ‘আই লাভ ইউ’ বলতে শিখে যায়।
‘আলফাভিল’-এর সঙ্গে চট করে এক নজরে আমাদের চেনা যে ছবিটার খানিকটা মিল পাওয়া যায়, ‘হীরক রাজার দেশে’। ওমেগা মাইনাস-এর মতো এখানেও ‘মস্তিষ্ক প্রক্ষালক যন্ত্র’, মগজধোলাইয়ের দৌরাত্ম্য। তবে ওই যন্ত্র আর তার মগজধোলাইয়ের মন্ত্রের কোনও পক্ষপাত নেই। যন্ত্রের স্রষ্টা ‘বৈজ্ঞানিক’ও আপাদমস্তক পেশাদার, তার কোনও দল নেই। তাই গুপি-বাঘা তাকে হাত করে ওই যন্ত্রে রাজার মন্ত্র পুরে দিতে পারে! এবং ফ্যাসিস্ট রাজা ও তার গোটা পুতুল-ক্যাবিনেটের মগজধোলাইয়ের পর সব্বাই মূর্তির মাঠে জড়ো হয়। আর জনগণের সঙ্গে হাত মিলিয়েই রাজা ‘দড়ি ধরে মারো টান’ বলে নিজেই নিজের মূর্তি ভেঙে খানখান করে। ‘দ্য গ্রেট ডিক্টেটর’-এর শেষে হিংকেল-এর জায়গায় তার ডুপ্লিকেট ইহুদি নাপিত শাসকের মঞ্চে উঠছে। কিন্তু আগের ডিক্টেটরের ওই লাফঝাঁপ, হুংকার, নাটকের বদলে সে নরম গলায় ধীরে ধীরে সাধারণ লোকের আশা, স্বপ্ন, আকাঙ্ক্ষার কথা বলে। মাত্র তিনটে শটে ক্যামেরার দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে প্রায় ছ’মিনিটের সে বক্তৃতা কবিতার মতোই শোনায়। আর ‘আল্ফাভিল’-এ সিক্রেট এজেন্ট তো কবিতার ধাঁধাতেই স্বৈরাচারের বারোটা বাজায়। কিন্তু একনায়ক শাসকের নিজেরই মগজধোলাই হয়ে যাচ্ছে, এই আইডিয়ার জুড়ি নেই! নিজের মূর্তি টেনে নামানোর জন্য ফ্যাসিস্ট নায়কের হাতে দড়ি ধরিয়ে দেওয়াটা স্যাটায়ার হিসেবে মাস্টারস্ট্রোক, যেটা শুধু এক জন মাস্টারই দিতে পারেন। ফলে অ্যাডভান্টেজ সত্যজিত্ রায়!
http://www.anandabazar.com/lorai/%E0%A6%A4-%E0%A6%AE-%E0%A6%B6-%E0%A6%AC-%E0%A6%95%E0%A6%AC-%E0%A6%A4-%E0%A6%B0-%E0%A6%9D-%E0%A6%9C-1.192809
No comments:
Post a Comment