৯ নম্বর মদন ঘোষ লেন
সিমলা পাড়ার যে বাড়িটা ছিল সঙ্গীত-সম্রাট মান্না দে’র আঁতুড়ঘর। তার অন্দরের গল্প বলছেন ভ্রাতুষ্পুত্র সুদেব দে।
বাড়ির উঠোনে ছবি: উৎপল সরকার
ছোটবেলাই থেকে দেখতাম, আমার বাবা, অন্য দুই কাকা আমাদের সিমলে পাড়ার বাড়িতেই থাকেন।
সেজকাকু কোথা না কোথা থেকে মাঝে মাঝে শুধু আসেন।
দিন কয়েক থাকেন।
আবার চলে যান।
গান করেন। হাফহাতা পাঞ্জাবি, লুঙ্গি পরে রোয়াকেও বসে থাকেন, আড্ডা দেন। আর পাঁচ জনের মতোই।
আমার তখন কতই বা বয়স, দুই-তিন। তখন কি বুঝতাম আমার এই সেজকাকুই ‘মান্না দে’!
মা’র (নীহারিকাদেবী) যখন বারো-তেরো বছর বয়স, তখন থেকেই মা এ-বাড়ির বড় বৌ। সেজকাকুর সঙ্গে মায়ের সম্পর্কটা ছিল অনেকটাই বন্ধুর মতো। একটু বড় হতে মা-ই আমায় সেজকাকুর গুরুত্বটা বুঝিয়ে দেন।
আমাদের তখন জয়েন্ট ফ্যামিলি। সব মিলিয়ে লোকজন প্রায় জনা চল্লিশেক।
মুম্বই থেকে সেজকাকু এলে বাড়িতে যেন যজ্ঞি লেগে যেত। লোকের আসাযাওয়া বেড়ে যেত।
এমনিতেই আমাদের বাড়িতে গান লেগেই থাকত। কাকা এলে দেখতাম, গানের জগতের লোকজনে যেন বাড়ি ছেয়ে যাচ্ছে।
এমনকী সকাল হলেই কত দূর দূর থেকে অচেনা সব লোকজন দরজার বাইরে এসে জড়ো হচ্ছেন।
নীচতলায় আমাদের গানের ঘর। ছোটবেলায় আমাদের সে-ঘরে ঢোকার অনুমতি ছিল না। পড়াশোনার ক্ষতি হবে যে, তাই।
এক কালে দাদু, কৃষ্ণচন্দ্র দে ওই ঘরে গানবাজনা করতেন। কাকা অবশ্য রেওয়াজ করতেন ওপরে, নিজের ঘরে।
যতক্ষণ সেই রেওয়াজ চলত, দেখতাম রাস্তায় দাঁড়িয়ে অনেকে মোহিত হয়ে শুনছেন।
সেজকাকু এ-বাড়িতে আসা মানে রান্নাও হবে এলাহি। ছুটির দিনে কম করে তেরো-চোদ্দো কিলো পাঁঠার মাংস। আমার ছোট কাকা, প্রভাস দে। বাড়িতে বড়রা যাঁকে ডাকতেন ভেলু। রান্না করতেন তিনিই। ছোট কাকাকে জোগাড় দিত আমার বড় দাদা, মুকুল দে।
সেজকাকু খেতে ভালবাসত খুউব। খেত যে খুব বেশি তা নয়, বরং অল্পই। কিন্তু ওঁর পছন্দের খাবারদাবারের কয়েকটা মার্কামারা দোকান ছিল।
দই হলে অমৃত-র। সীতাভোগটা হবে সেনমশাই-এর। ঘিয়ের মালপোয়া হলে নেপাল চন্দ্র চন্দ্র বা অন্য কোনও অবাঙালি দোকানের। আবার ফিশফ্রাই কী ফাউল কাটলেটটা চাচা-র হওয়া চাই।
ভাতের পাতে বাঙালি খাবার ছিল অসম্ভব প্রিয়। সুক্তো, আলু ভাজা, বেগুন ভাজা, ভেটকির ফ্রাই, চিংড়ির মালাইকারি, লাউ চিংড়ি, মোচা চিংড়ি, দই বড়া...।
আর কালীপুজোর সময় সেজকাকু এলে ভাল মতো ভাগিদার হয়ে পড়ত বাড়ির বাজি তৈরিতেও। তুবড়ি, ফানুস, রংমশাল...। এ ছিল আমাদের বাড়ির বহু পুরনো রেওয়াজ।
দাদু বেঁচে থাকতে আরেকটা রেওয়াজ ছিল। সেটা দোলে। সে অবশ্য আমি দেখিনি। শুনেছি।
প্রত্যেক দোলে দাদু নতুন নতুন গান বাঁধতেন। কাকারা দোলের দিনে পায়ে হেঁটে রাস্তায় রাস্তায় সে-গান গাইতে বেরোতেন। অনেকটা নগরসংকীর্তনের মতো। সে দলে সেজকাকুও থাকত। দাদু চলে যাওয়ার পর থেকে সেই রেওয়াজ অবশ্য বন্ধ হয়ে যায়।
সেজকাকুর আরও কয়েকটা ব্যাপার ছিল।
সারা বছর মা-কাকিমারা তো বাড়ির হেঁশেল ঠেলে ঠেলে জেরবার হয়ে যেতেন, তাতে সেজকাকুর বোধহয় ওঁদের প্রতি এক ধরনের বাড়তি ‘ফিলিং’ কাজ করত। যখনই আসতেন, দলবেঁধে ওঁদের নিয়ে হাতিবাগানে থিয়েটার পাড়ায় নিয়ে যেতেনই যেতেন।
পুজো এলে আমরা জানতাম, আর কিছু না হোক, সেজকাকু বাড়ির সব্বার জন্য ঠিক নতুন জামাকাপড় কিনে পাঠাবেন।
আর জীবনের প্রথম পরীক্ষায় পাশ করলে একটা হাতঘড়ি দেবেন।
শেষ দিকে যখন পুজোর সময়ে জামাকাপড় নিজে কিনে দিতে পারতেন না, প্রত্যেককে মোটা টাকা পাঠাতেন, সে আমেরিকাতেই থাকুন, কী বেঙ্গালুরু।
ছোট থেকেই সেজকাকু আমুদে! মদন ঘোষ লেনের বাড়িতে ওঁর দুষ্টুমির গল্পও যে কত!
এক বার শুনেছি, সন্ধেবেলা ওঁর দেরি করে বাড়ি ফেরার কথা কাজের লোক বড়দের কাছে ফাঁস করে দিয়েছিল বলে, ঘুমন্ত অবস্থায় তার গায়ের থেকে কাপড় সরিয়ে জ্বলন্ত ধূপকাঠি ঠেসে ধরেছিল।
আচার খেতে খুব ভালবাসত। পাশের বাড়িতে যখন আচার শুকোতে দিত, তক্কে তক্কে থাকত। নির্জন দুপুরে এ-বাড়ি থেকে ও-বাড়ির ছাদের পাঁচিলের মাথায় আড়াআড়ি বাঁশ ফেলে, সেই বাঁশ বেয়ে ঝুলতে ঝুলতে অন্য বাড়ির ছাদে গিয়ে বয়াম থেকে আচার খেয়ে আবার ওই একই ভাবে ঝুলতে ঝুলতে চলে আসত।
সেজকাকুর এই ডানপিটে স্বভাব আমারও দেখা।
সালটা যদ্দুর মনে পড়ে ’৭৫ কী ’৭৬। ওঁর তখন বয়স পঞ্চান্ন-ছাপ্পান্ন।
মহালয়ার দিন। আমরা পাড়ায় বল পেটাচ্ছি। একটা ট্যাক্সি এসে থামল। দেখলাম সেজকাকু। তখন কলকাতায় ট্যাক্সিতে মিটারে যা ভাড়া উঠত, তার চেয়ে কুড়ি না দশ পার্সেন্ট বেশি দেওয়ার নিয়ম ছিল। মুম্বইবাসী কাকু অত শত জানত না।
ফলে মিটারে যা ভাড়া উঠেছিল, তাই-ই ট্যাক্সিওয়ালার হাতে দিয়ে নেমে যেতে গেছেন, হঠাৎ সে বলে উঠল, ‘‘আরে ঠিকসে ভাড়া তো দো!’’
কাকু অবাক হয়ে বলল, ‘‘ঠিক সে মতলব? গিনকে দেখো, কিতনা হ্যায়।’’
‘‘গিন লিয়া। ম্যায় ক্যায়া গলত বাতাতু হুঁ? কমতি দিয়া। চিটিংবাজ কাঁহিকা...!’’
‘‘ক্যায়া বোলা? চিটিংবাজ...!’’ বলেই ট্যাক্সিওয়ালাকে এই মারে তো সেই মারে!
এমন একজন মানুষকে এক বার এত বিচলিত হতে দেখেছিলাম, কী বলি!
কাকুর ঘরে বসে আছি।
টিভিতে কলকাতার এক বিখ্যাত ধ্রুপদ সঙ্গীত শিল্পীর সাক্ষাৎকার চলছে। ওঁর গানের আমরাও খুব ভক্ত। শুনছি।
হঠাৎ দেখি, গান গাওয়ার মাঝে ভদ্রলোক বলছেন, ‘‘জানেন, এক বার মান্নাবাবুও আমাকে বলেছিলেন, ‘আমার বয়স যদি ছোট হত, আমি আপনার কাছে গান শিখতে যেতাম।’’’
চমকে কাকুর দিকে তাকালাম। কাকু দেখলাম মুহূর্তে কেমন পাল্টে গেছেন। চোখ-কপাল কুঁচকোনো। কালো হয়ে গেছে মুখটা। কেমন যেন স্তম্ভিত!
একটু ক্ষণ বাদে বিড় বিড় করে বলে উঠলেন, ‘‘এই কথাটা ও এমন করে পাবলিকলি বলে দিল! দুর্বল মুহূর্তে যে কথাটা বলেছিলাম, সেটার এ ভাবে সুযোগ নিল? তাকেই এনক্যাশ করল!’’
কাকুর চোখ দিয়ে টস টস করে জল পড়তে লাগল। আমি সান্ত্বনা দিতে কী একটা বলতে যাচ্ছিলাম।
ধমক দিয়ে থামিয়ে দিলেন সেজকাকু, ‘‘শোনো, আমায় বোঝাতে এসো না তো! একজন মানুষের ঔদার্যের সুযোগ নেওয়াটা...ছি ছি ছি! ও তো শুধু আমায় ছোট করল না, আমার হাজার হাজার শ্রোতাকেও অপমান করল। ছিঃ!’’
কাঁদছেন আর বলে চলেছেন।
‘‘আমি কোনও দিন বলতে গেছি, আমাকে উস্তাদ বিলায়েৎ খান বলেছিলেন, ‘আপনি যদি ক্লাসিকাল গাইতেন, অনেকের ছুটি হয়ে যেত!’ কোনও দিন বলেছি, উস্তাদ বড়ে গুলাম আলি খান বলেছিলেন, ‘তিন-সাড়ে তিন মিনিট মে আপ ক্যায়সে ইতনা আচ্ছা ক্লাসিকাল গাতে হো, সমঝ নেহি আতা!’ কোনও দিন বলেছি?’’
আমি জানতাম, আমরা কয়েকজন কাছের লোক জানি, অল্প সময়ের মধ্যে কাকুর গান তুলে ফেলা, ঝট করে নোটেশন করে ফেলার বিরল ক্ষমতা দেখে চমকে গিয়েছিলেন পণ্ডিত রবিশঙ্করও। প্রায় একই কথা বলেছিলেন তিনিও। কিন্তু কোনও দিন সে সব লোকসমক্ষে বলতেন না কাকু।
এগুলো তিনি আশীর্বাদ বলে ধরতেন। এক গুণী মানুষের উদার মানসিকতার প্রকাশ বলে মানতেন।
ভাবতেন, যাঁদেরকে এমন করে তিনিও বলে ফেলেন, তাঁরাও এ ভাবেই যেন ভাবেন। এমন করেই যেন মানেন।
সে দিন সেই বিশ্বাস চুরমার হয়ে যেতে দেখে নিজেও যেন ভেতরে-ভেতরে খান খান হয়ে গিয়েছিলেন।
গানজগতে কাকুর অপমানের গল্প অনেক শুনেছি। এখনই যেমন মনে পড়ছে, ‘চোরি চোরি’ ফিল্মের কথা।
‘ইয়ে রাত ভিগি ভিগি’ গানের রেকর্ডিং। নির্দেশক রাজকপূর ওঁর পছন্দের গায়ক মুকেশকে ছেড়ে কিছুতেই কাকুকে দিয়ে গাওয়াবেন না। জোরজার করে শঙ্কর-জয়কিষেণ রাজি করিয়েছেন ওঁকে।
প্রযোজক একজন পাঞ্জাবি ভদ্রলোক। রেকর্ডিং-এ এসে তিনি কাকুর নাম শুনে প্রায় হুঙ্কার দিয়ে বসলেন, ‘‘ক্যায়া? মান্না দে? বাঙ্গালি বাবু?’’
সপরিবার
একমাত্র পাশে ছিলেন তখন লতা মঙ্গেশকর। কানের কাছে ফিসফিস করে তিনি শুধু বলেছিলেন, ‘‘এক দম রাগ করবেন না। এমন ভাবে গাইবেন, যাতে ওঁদের ভুল ভেঙে যায়।’’
তার পরের ঘটনা তো ইতিহাস।
এতটা না হোক, প্রথম বার উত্তমকুমারের লিপে গান গাওয়ার সময়ও তো অস্বস্তির ঘটনা ঘটে।
ছবির নাম ‘শঙ্খবেলা’। দুটি গান— ‘কে প্রথম কাছে এসেছি’, আর ‘আমি আগন্তুক আমি বার্তা দিলাম’।
উত্তমকুমারও গোড়ায় রাজি ছিলেন না সেজকাকুকে দিয়ে গাওয়াতে। সুরকার সুধীন দাশগুপ্তকে অনেকে বলেছিলেন, ‘‘আরে কে এই মান্না দে মশাই? ও তো কুস্তি করে। রোম্যান্টিক গান কী গাইবে? তাও আবার উত্তমকুমারের গলায়! ছবির বারোটা বেজে যাবে।’’
গানজীবনে এমন ঘটনা কমবেশি অনেকেরই আছে। কিন্তু সে দিন, ওই টিভি-র ব্যাপারটা যেন সম্পূর্ণ অন্য ধাঁচের।
সে দিনের মতো কাকাকে অতটা বিচলিত হতে আর কবে দেখেছি, মনে পড়ে না।
রবীন্দ্রসদনে কৃষ্ণচন্দ্র দে-র ছবির সামনে।ছবি: হীরেন সিংহ
এক্কেবারে উল্টো মেরুর একটা ঘটনা বলি।
‘হারমোনিয়াম’ ছবির কাজে হাত দিয়েছেন তপন সিংহ। মিউজিক ডিরেক্টর তিনিই। কাকুর কাছে এসেছেন গান নিয়ে।
কাকু বললেন, ‘‘গানটা করুন তো একটু,’’ শুনে তপন সিংহ তো মহা অস্বস্তিতে, ‘‘আপনার সামনে আমি গানটা কী করে গাইব!’’
কাকু বললেন, ‘‘আহা করুন না, গুন গুন করে করুন। তাতেই হবে। সুরটা তো আপনার। আমি ভাবটা একটু বুঝতে চাই। একটু না শুনলে...।’’
অমন একজন শিল্পী, এতটা আন্তরিক ভাবে অনুরোধ করছেন, এর পর আর তপন সিংহ ‘না’ করেননি। জড়তা কাটিয়ে গান শুনিয়েছিলেন মান্না দে’কে। এতটাই শ্রদ্ধাবোধ ছিল পরস্পরের।
এ ভাবেই তৈরি হয়েছিল এক বিখ্যাত বাংলা গান, ‘ময়নামতীর পথের ধারে দেখা হয়েছিল’।
আরেক বারের ঘটনা যেমন।
রবীন্দ্রনাথের ১২৫ বছর। রবীন্দ্রসঙ্গীতের লং প্লেইং বেরোবে। সুচিত্রা মিত্রের তত্ত্বাবধানে। তাতে সেজকাকুও আছেন।
এ দিকে নিজের গান কিছুতেই মনমতো হচ্ছে না। সুচিত্রা মিত্রকে বললেন, ‘‘হচ্ছে না, হচ্ছে না। ‘কেন আমায় পাগল করে যাস’ ...। একটা কনফিউশন লাগছে।’’
সুচিত্রা মিত্র শুনে বলেছিলেন, ‘‘শুনুন, আপনার মতো করে গাইবেন তো! আপনি যে ভাবে রবীন্দ্রনাথের গান গাইতে পারেন, অনেক রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পীও তা পারবেন না। আপনার ‘না চাহিলে যারে পাওয়া যায়’ তো একটা দৃষ্টান্ত হয়ে আছে।’’
এতটাই শ্রদ্ধাবোধ ছিল ওঁদের মধ্যেও।
গানের ব্যাপারে সেজকাকুর খুঁতখুঁতানি যে কী প্রচণ্ড ছিল! হেমন্তকাকুর (মুখোপাধ্যায়) একটা ঘটনা বলি।
কোনও একটা ছবির রেকর্ডিং। হেমন্তকাকু মিউজিক ডিরেক্টর। মুম্বই থেকে দমদম এয়ারপোর্টে নেমে সোজা এইচএমভি-তে চলে গেলেন কাকু। রেকর্ডিং রুমে বসেই গান তুলছেন। গাইছেন। বেশ কিছুক্ষণ চলার পর সেজকাকু বললেন, ‘‘চলুন এ বার রেকর্ডিং করি।’’
হেমন্তকাকু বললেন, ‘‘গানটা আমার নেওয়া হয়ে গেছে।’’
‘‘মানে? কী বলছেন আপনি? আমার তো গলাই গরম হয়নি এখনও!’’
হেমন্তকাকু জানতেন, এই সব ব্যাপারে ওঁকে বুঝিয়ে কোনও লাভ নেই। ফলে হেসে বললেন, ‘‘ঠিক আছে, আবার করুন তবে।’’
শুধু সাউন্ড-রেকর্ডিস্টকে বলে দিলেন, ‘‘উনি যা খুশি করুন। আমি কিন্তু প্রথম টেক-টাই নেব।’’
শুধু খুঁতখুঁতানি নয়, আরেকটা অদ্ভুত স্বভাব ছিল সেজকাকুর। হঠাৎ হঠাৎ দেখতাম, রেডিয়ো খুলে চুপচাপ বসে গান শুনছেন। হয়তো অত্যন্ত মামুলি একজন লোকশিল্পী। সুরের লয়ের বালাই নেই, কিন্তু মন দিয়ে শুনে চলেছেন সেজকাকু।
হাবেভাবে যদি বুঝতে পারতেন, আমাদের অদ্ভুত লাগছে ব্যাপারটা। বলতেন, ‘‘শোনা, গমকটা খেয়াল করো। দেখো, গান যদি ভাল করে শিখতে চাও, কাউকে তুচ্ছ কোরো না। মন দিয়ে শুনবে, দেখবে, অনেকের মধ্যেই শেখার মতো কত কিছু পেয়ে যাবে।’’
কাকুর এই ব্যাপারটা এক্কেবারে আমার দাদুর থেকে পাওয়া।
দাদুর একটা ঘটনা যেমন, আমার শোনা। দাদুর তখন কীর্তন শিল্পী হিসেবে বাংলাজোড়া নাম। তেমনই এক সময়ে প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়ে কোনও এক বংশীধারী চট্টোপাধ্যায়ের গান শুনে উনি এতটাই অভিভূত হয়ে পড়েন যে, তাঁকে সঙ্গে সঙ্গে ডেকে পাঠান। বলেন, ‘‘আহা কী অপূর্ব আপনার গলা! আপনি আমায় গান শেখাবেন?’’
বংশীধারী বিলক্ষণ চিনে ছিলেন কৃষ্ণচন্দ্র দে’কে। তাঁর মুখে অমন কথা শুনে তিনি তো আকাশ থেকে পড়েন আর কী! তবু দাদুর জোরাজুরিতে তাঁকে গান শেখাতেই হয়েছিল।
ঠিক এই স্বভাবটা কাকুও পেয়েছিল। গানের ক্ষেত্রে এমন গল্প সেজকাকুর যে কত আছে!
একটা ঘটনা বলি।
সে বার কলকাতার বাইরে জলসা। রাতের অনুষ্ঠান শেষে সবাই ঠিক করলেন, এই মাঝরাতে ফিরলে সমস্যা হতে পারে। আলো ফুটলে তবে বেরনো হবে।
এ দিকে তখনও ভোর হতে প্রায় ঘণ্টা দুই দেরি। এখন সময়টা কী করে কাটবে? ঠিক হল, একটু গানবাজনা হোক।
কে গাইবেন?
কেন, ভ্যাকাদা আছে যে সঙ্গে!
ভ্যাকাদা, মানে রবীন গঙ্গোপাধ্যায়, কাকার ইউনিটেরই একজন। এক সময় দেবব্রত বিশ্বাসের কাছে গান শিখতেন। সে চর্চা তো কবে ছেড়েছেন! ফলে গলায় মরচে ধরেছে। তবু সকলের জোরাজুরিতে তিনিই গান ধরলেন। রবীন্দ্রসঙ্গীত।
কিছুক্ষণ বাদে সবাই দেখলেন, সেজকাকু বিভোর হয়ে পড়েছেন গানে। আর হাপুস নয়নে কেঁদে চলেছেন।
গানের শরীরে উনি যে কী পেতেন, কে জানে! গান ওঁকে এতটাই ভাসিয়ে দিত বারে বারে।
সুরকার-গীতিকারের ক্ষেত্রেও এমনটা হয়েছে। নাম শোনেননি। গানটা দেখেছেন শুধু। ভাল লেগেছে। গেয়েছেন।
দু’জনের কথা বলতে পারি।
জহর মজুমদার আর মুক্তি রায়চৌধুরী। প্রথম জনের লেখা ‘সবাই তো সুখী হতে চায়’। দ্বিতীয় জনের লেখা ‘খুব জানতে ইচ্ছে করে’।
দুটোই আজও কাকার হিট গানের লিস্টে প়ড়ে। কিন্তু যখন রেকর্ড করছেন গান দুটি, কে চিনত ওঁদের!
নতুন গায়ক-গায়িকাদের ক্ষেত্রেও এমনটা বার বার হয়েছে। এ নিয়ে আরতি মুখোপাধ্যায়, হৈমন্তী শুক্লা কী কবিতা কৃষ্ণমূর্তিদের কথা অনেকেই জানেন। বলেনও।
আমি বলব পিন্টু ভট্টাচার্যর কথা।
পুলককাকু একবার পিন্টু ভট্টাচার্যকে আনলেন। বললেন, ‘‘এ বার যদি পুজোয় আপনি সুর করে না দেন, ওর হয়তো গানই করা হবে না।’’
সেজকাকুর খুব যে ইচ্ছে ছিল, তা নয়। তার চেয়েও বড় কথা, সময়ও যে ছিল তা’ও নয়, কিন্তু কাকা কী যে দেখেছিলেন তরুণ গায়কের কাতর দুই চোখে!
যত্ন করে সুর করে দিয়েছিলেন দুটি গানের—‘বুকেতে আগুন জ্বেলে’ আর ‘তোমার ওই সুন্দর মুখ’।
আমার কেন জানি মনে হয়, গানকে এ ভাবে নিতেন বলেই সেজকাকু হয়তো এতটা দরদি, এতটা মরমি হতে পেরেছেন। শ্রোতাকে এতটাই স্পর্শ করতে পারতেন এই কারণেই।
নাগপুরে এক বিপত্নীকের কথা জানি। ভদ্রলোকের স্ত্রীর মৃত্যুকালে একমাত্র অবলম্বন ছিল আমার কাকার গান।
ওঁর মৃত্যুর পর ভদ্রলোক সারা রাত জেগে বসে তাঁর মৃত স্ত্রীর উদ্দেশ্যে একটা একটা করে গান শুনিয়ে যেতেন, কাকার। সেটাই ছিল তাঁর সেই মুহূর্তের একমাত্র সান্ত্বনা!
গান দিয়ে সেজকাকু কেমন যেন সম্মোহন করতে পারতেন শ্রোতাকে।
এ নিয়ে একটা অদ্ভুত অভিজ্ঞতার কথা বলি।
প্রায়ই কাকুর অনেক অনুষ্ঠানে যেতাম ওঁর গান শুনতে।
সে বার বঙ্গ সংস্কৃতি সম্মেলন মার্কাস স্কোয়্যার থেকে সরে গিয়ে ময়দানে হচ্ছে।
আমি গিয়েছি। দেখি এত্ত ভিড় যে, ঘের দেওয়া বাঁশের খুটি থেকেও লোক ঝুলছে।
কাকা গাইছেন। তবলায় রাধাকান্ত নন্দী। অ্যাকোর্ডিয়ানে ওয়াই এস মুলকি। খোকন মুখোপাধ্যায় স্প্যানিশে। টোপাদা, মানে অমর দত্ত পার্কাশানে। সবে পাঁচ-সাতটা গান হয়েছে, হঠাৎ দেখা গেল দূরে আগুন।
আতঙ্কিত দর্শকদের মধ্যে অল্পস্বল্প ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়ে গেল। হাজার হাজার লোকের ভিড়। এ বার যদি ছোটাছুটি হয়, তো কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। এর-ওর পায়ের চাপে পড়েই মারা যেতে পারে অনেকে।
এই বার দেখলাম কাকুকে!
কী একটা গান গাইছিলেন। মহূর্তে সে-গান থামিয়ে দিয়ে গাইতে লাগলেন, ‘‘আ-গু-ন..... লেগেছে লেগেছে লেগেছে লেগেছে আগুন....।’’
মাঝে একটু থেমে কেবল ছোট্ট ঘোষণা, ‘‘আতঙ্কিত হবেন না। আগুন কন্ট্রোলে চলে আসবে। আপনারা দৌড়াদৌড়ি না করে গান শুনে যান শুধু।’’
গান শুরু হল। একটু পরে আগুনও নিয়ন্ত্রণে এসে গেল। শ্রোতারা ততক্ষণে সম্মোহিত হয়ে পড়েছেন গানের আগুনে।
সে দিন কাকুর উপস্থিত বুদ্ধি, সাহস আর আত্মবিশ্বাস দেখে পুরো অভিভূত হয়ে গিয়েছিলাম।
আমি এক বার তেড়ে বকুনি খেয়েছিলাম সেজকাকুর কাছে। সেও গানের জন্যই।
সে এক কাণ্ড!
তিন মাস কথাই বন্ধ করে দিয়েছিলেন। কী দমবন্ধ করা সময় গেছে তখন আমার!
ঘটনাটা বলার আগে ছোট্ট একটা মুখড়া লাগে।
ইস্কুলে যখন ভর্তি হলাম, তখন দেখতাম, সবাই আমায় খুব পাত্তা দেয়। একটাই কারণ, আমি মান্না দে’র ভাইপো।
আমাদের বাড়ি তো পুরো গানের। দাদু, কাকা তো আছেনই, আমার বাবা, প্রণব দে’ও ছিলেন নিউ থিয়েটার্স স্টুডিয়ো টু-র মিউজিক ডিরেক্টর। বাবা অনেক সিনেমাতেও সুর দিয়েছেন।
বাড়িতে সর্বক্ষণ গান আর গান। সেই শোনা গানগুলোই ইস্কুলে গাইতাম। যখন ক্লাস টেনে উঠি, স্কুলেরই একটা অনুষ্ঠানে আমাকে গান গাওয়ানোর জন্য আমাদের এক শিক্ষক মশাই বাড়িতে এলেন। আমার ছোট কাকা প্রভাস দে’র সঙ্গে দেখা। বললেন সব। সুবিধে করতে পারলেন না। মাস্টারমশাই আসার কারণ শুনে বাবাও পরে বলেছিলেন, ‘‘ওর দ্বারা গানবাজনা হবে না।’’
সেজকাকু শুধু বলেছিলেন, ‘‘এখন নয়, মাধ্যমিকে ফার্স্ট ডিভিশন পেলে তবে গান শিখো।’’
তো, সেই মাধ্যমিকের পরই আমার গান শেখার শুরু। প্রথমে বাবার কাছে। পরে আমাদের ঘরানা মতে একজন তারযন্ত্রীর কাছে।
কাকুরই পরামর্শে আমি যখন সারেঙ্গিবাদক পণ্ডিত মহেশপ্রসাদ মিশ্রর কাছে শিখতে শুরু করি টিউশন ফি-টা পর্যন্ত কাকুই দিতেন। প্রথম দিনই কেবল কাকু বলে দিয়েছিলেন, ‘‘শিখছ, শেখো, কিন্তু ডোন্ট এক্সপেক্ট এনি কমার্শিয়াল হেল্প ফ্রম মি, নেভার।’’
তো, এক বার কাকারই জনপ্রিয় কিছু হিন্দি গান অনুবাদ করলেন পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়। লাগা চুনরি মে দাগ, জিন্দেগি ক্যায়সি হ্যায় পহেলি, কাসমে ওয়াদে...। এইচএমভি থেকে আমায় ডাকা হল গাইতে।
সেজকাকুর কোনও অনুমতি নিলাম না। ভয়ে ভয়ে গাইতে চলে গেলাম। এ দিকে পুলককাকু রেকর্ডিং শুনে কাকুকে বলে বসলেন, ‘‘ও বেশ ভাল গেয়েছে কিন্তু!’’
ব্যস, আমায় শুধু মারতে বাকি রেখেছিলেন সেজকাকু।—‘‘কী ভেবেছ কী? গান গেয়ে দিলেই হল! জানো, ওই গানগুলো কতটা সিচ্যুয়েশনের সঙ্গে মিল রেখে, কত কষ্ট করে তৈরি? আর পুলকবাবু ‘লাগা চুনরি’-কে ‘রাঙা আঁচলের দাগ’ বলে অনুবাদ করে দিল, আর তুমি গেয়ে দিলে?’’
আমি ভয়ে থর থর করে কাঁপছি। কাকু সেই যে কথা বন্ধ করে দিলেন, তিন মাস কথা বলেননি।
তিন মাস বাদে আমি যখন প্রায় পায়ে ধরে ক্ষমা চাইলাম, তখন ওঁর রাগ পড়ল।
সে দিন বুঝেছিলাম, আরও বেশি করে বুঝেছিলাম, গান সেজকাকুর কাছে কতটা ঈশ্বরতুল্য!
এখানে একটা কথা বলি, কাকু কোনও দিনই নিজের গানের রিমেক পছন্দ করতেন না।
হৈমন্তীদির (শুক্ল) একটা ঘটনা বলে লেখা শেষ করব।
সেজকাকু আর হৈমন্তীদি কলকাতার বাইরে কোনও একটা অনুষ্ঠানে যাচ্ছেন।
কাকুর গাড়িটা সামনে।
হৈমন্তীদির গাড়ি পিছনে।
হঠাৎ হৈমন্তীদি দেখেন, কাকুর গাড়ি পাক খেতে খেতে রাস্তার ধারে একটা পুকুরে পড়ে গেল!
হইহই করে উঠলেন সবাই। লোকজন। চিৎকার-চেঁচামেচি।
ওঁদের সঙ্গে ছিলেন একজন।
দেখতে না দেখতে তিনি মুহূর্তের মধ্যে ঝাঁপ দিলেন জলে।
জল বিশেষ নেই। কাদাই বেশি। তাতে কাকুর গাড়িটা গেছে আটকে।
কোনও ক্রমে তার থেকে ওঁকে পাঁজাকোলা করে উদ্ধার করা হল। পাড়ের উপরে তুলে দেখা দেখা গেল, চোট-আঘাত তেমন লাগেনি।
ধীরে ধীরে হৈমন্তীদির গাড়িতে বসিয়ে দেওয়া হল ওঁকে। পাশে বসে হৈমন্তীদি। তিনি তখনও ভয়ে জড়সড় হয়ে থর থর করে কাঁপছেন।
একটু হাঁফ ছেড়ে কাকু প্রথম কথা বললেন, ‘‘তোমার গাড়িতে গান আছে? একটু চালিয়ে দাও তো!’’
গান চালিয়ে দেওয়া হল।
আরেকটু বাদে বললেন, ‘‘মাঝে থানায় একটা খবর দিয়ে সোজা ফাংশানে চলে যাব। নইলে ওঁরা যে অসুবিধেয় পড়ে যাবেন।’’
এই ছিলেন আমার কাকু।
আপনাদের মান্না দে।
গানের কাছে যাঁর জীবনটা ছিল বাঁধা। সুরই ছিল যাঁর জিয়নকাঠি।
http://www.anandabazar.com/supplementary/patrika/9-madan-ghosh-lane-1.373496
No comments:
Post a Comment