আমাদের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে পড়ুয়াদের ভূমিকা কী হবে, ইদানীং এই কথাটি থেকে থেকেই উঠছে। সমাজ-রাজনীতি থেকে দূরে থেকে পড়ুয়ারা বইতে মুখ গুঁজে নিজেদের পাঠতপস্যা বজায় রাখবেন, এই তপোবনী শিক্ষাদর্শই যথার্থ ‘ভারতীয়’, এ কথা ভাবতে চাইছেন এক দল। সেই সমাজ-রাজনীতি-বিযুক্ত শিক্ষাদর্শের মুখে ছাই দিয়ে দিল্লি আর কলকাতার দুটি প্রতিষ্ঠান, জেএনইউ আর যাদবপুর থেকে থেকেই সংবাদ-শিরোনামে। আরও অনেকের মতোই গণতন্ত্রের ভালমন্দের সঙ্গে, সমাজ-রাজনীতির সঙ্গে উচ্চশিক্ষালয়গুলির অনিবার্য সম্পর্ক আছে বলে মনে করেন এই দুই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সচেতন অংশীদারেরা।
প্রথম কথা হল, প্রাচীন ভারত ছাত্র ও পুত্রদের ‘অধ্যয়ন’ করতে বলেছিল ঠিকই, কিন্তু তাদের মোটেই বাক্‌হীন, প্রশ্নহীন করে রাখেনি। নচিকেতার বাবা যজ্ঞে গরু দান করছিলেন, সেই গরুগুলো আর ঘাসও খাবে না দুধও দেবে না। এমন গরু দানের অর্থ নেই। অথচ বাবা দাতা হিসেবে নাম কিনছেন। এ অনৈতিক কাজ। নচিকেতা বাবার বিরক্তি উৎপাদন করেই প্রশ্ন তুলেছিলেন। এ কাহিনি কঠোপনিষদের। মহাভারতে আছে ধর্মব্যাধের প্রসঙ্গ। ব্রহ্মচারী শিষ্যকে গুরু পাঠিয়েছেন ব্যাধের কাছে। মাংস বিক্রি করে তার সংসার চলে। সেই লৌকিক-সামাজিক জীবনচর্যাকারী ব্যাধের কাছে গুরুর নির্দেশ অনুযায়ী শিষ্য দর্শনের মীমাংসা নিয়ে উপস্থিত। আমরা যাকে ‘হিন্দু-ভারত’ বলে ‘নির্মাণ’ করতে চাই, এ সেই হিন্দু ভারতের উপাখ্যান। সুতরাং ছাত্রেরা পারিবারিক-সামাজিক ঘটনা সম্বন্ধে নীরব থেকে, তার বাইরে গিয়ে শুধু পড়বে, পুরনো ভারত এই বিশ্বাসকে একমাত্রিক ভাবে বহন করত বলে মনে হয় না। আর বিদ্যার যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকে, তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ তো মহাভারত। দ্রোণাচার্য পাণ্ডব-কৌরবদের অস্ত্রশিক্ষা দিচ্ছেন প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য— যে বাল্যবন্ধু রাজা হয়ে দ্রোণাচার্যকে চিনতেই পারেননি, ব্রাহ্মণ দ্রোণের বালকপুত্রের জন্য সামান্য আহারের ব্যবস্থা করেননি, সেই ক্ষত্রিয় রাজার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্যই দ্রোণ অর্জুনদের অস্ত্রশিক্ষা দিয়েছেন। অস্ত্রচালনার শিক্ষা তো কার বিরুদ্ধে কখন অস্ত্র প্রয়োগ করব— এই প্রশ্নকে উপেক্ষা করে না। তাই অস্ত্রশিক্ষা রাজনৈতিক শিক্ষা।
আধুনিক ভারতে, ব্রিটিশ আমলে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজা হল। শিক্ষাব্যবস্থা ঢেলে সাজা হোক, এ দাবি ভারতীয়রা উত্থাপন করেছিলেন, উপনিবেশের সাহেবি কর্মকর্তারাও তা নিজেদের উদ্দেশ্য সাধনের জন্য মেনে নিয়েছিলেন। সেই উদ্দেশ্য সাধনের নানা অভিমুখ। সাহেবরাও শিক্ষার উদ্দেশ্য-বিধেয় নিয়ে সহমত ছিলেন না। তবে সাহেবি শিক্ষাব্যবস্থার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল ভারতীয়দের আনুগত্য আদায় করা, সাহেবরা ভারত শাসন করুক এই সম্মতি আদায় করা। মেকলে তো এক রকম ভাবে এই সম্মতি আদায় করার কথা ভেবেই ইংরেজি শিক্ষিত নেটিভ নির্মাণের কল হিসেবে শিক্ষাব্যবস্থাকে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। সিপাহি বিদ্রোহের বছর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠারও বছর। বাঙালি ভদ্রলোকেরা সমকালে কেউই প্রায় সিপাহি বিদ্রোহের সমর্থক ছিলেন না। ঈশ্বর গুপ্ত তো সিপাহিদের বেয়াদবি নিয়ে পদ্যও লিখেছিলেন। সিপাহি বিদ্রোহের বছরেই ঢাকা নিউজ-এ ‘এডুকেশন ফর দ্য নেটিভস’ নামের লেখা প্রকাশিত হয়েছিল। তাতে বলা হয়েছিল নেটিভদের মগজে যদি ঢুকিয়ে দেওয়া যায় শিক্ষাদীক্ষায় সাহেবরা উন্নত, তা হলেই তারা অনুগত ও পদানত হয়ে উপনিবেশ বজায় রাখবে। তখন বিদ্রোহ দমন করতে বন্দুক কামান লাগবে না। পড়াশোনার কলেই নেটিভদের জয় করে নেওয়া যাবে। তারা যত সাহেবি শিক্ষা-সভ্যতা সম্বন্ধে জানবে, তত বেশি সাহেবদের মানবে। এই পলিটিক্যাল মতলব শিক্ষার পাঠক্রমে ও ঔপনিবেশিক চাকরি ব্যবস্থায় এমন ভাবে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছিল যে উনিশ শতকের শিক্ষিত ভদ্রলোকেরা মোটের ওপর শান্তপ্রাণ। কংগ্রেসি রাজনীতির প্রথম পর্বে যে বৃহত্তর রাজনৈতিক স্বাধীনতা দাবি করা হয়নি, তারও কারণ এই কেন্দ্রীয় পলিটিক্যাল মতলবের আত্তীকৃত শিক্ষাব্যবস্থা।
উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের মাঝামাঝি ও শেষের দিক থেকে ভারতীয় চিন্তাবিদরা বুঝতে পারলেন, এই ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থার মডেলটিকে প্রশ্ন করতে হবে। তা করতে না পারলে সাহেবি মতলবের দাসানুদাস হয়েই কাটিয়ে দিতে হবে। আধুনিক শিক্ষার অঙ্গনে ভারতীয়রা রাজনৈতিক ভাবে সরব হয়ে উঠছেন সেই সময় থেকেই। সেই সরবতা পুরনো ভারতের ভাবধারার পরিপন্থী নয়, কারণ এ ভাবে না হোক, প্রচলিত সমাজ-রাজনীতি ইত্যাদির সঙ্গে আর এক ভাবে গুরু-শিষ্যের যোগাযোগ ঘটে গিয়েছিল। 
সাহেবি ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থাকে প্রশ্ন করার দুটি মডেল ছিল। একটি মডেল আশুতোষ মুখোপাধ্যায় অনুসরণ করতেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে আশুতোষের নানা পর্বে দীর্ঘদিনের যোগ। সাহেবি শিক্ষাব্যবস্থার বাইরে তিনি চলে যাননি, সেই ব্যবস্থার রকমসকম বুঝে নিয়ে অন্তর্ঘাত ঘটাতে চেয়েছিলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাপর্ব থেকে শুরু করে তাঁর সময় পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা অধিবেশনের মিনিটস ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যালোচনার বিধি খুবই মন দিয়ে পড়েছিলেন আশুতোষ। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনার নীতি-রাজনীতি ভাল করে বুঝেছিলেন বলেই তার মধ্যে ক্রমে ভারতীয়দের দাবিগুলি ঢুকিয়ে দিতে পেরেছিলেন। মনে রাখতে হবে আশুতোষের উদ্যোগে ও তাঁর উপাচার্য থাকার সময়েই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে নব্যভারতীয় আর্যভাষা-সাহিত্যের এমএ-র পাঠদানের অধিকার স্বীকৃত হয়। তার আগে বাংলা-ওড়িয়া-হিন্দি-অসমিয়া ইত্যাদি ভাষা-সাহিত্যে এমএ পড়ার অধিকার ছিল না। উপাচার্য আশুতোষের ছাত্রজীবন কিন্তু নিতান্ত বইমুখো ছিল না। ১৮৭৭-এ প্রেসিডেন্সি কলেজ ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৮২’তে এই কলেজ ইউনিয়ন নতুন করে সরগরম হয়ে ওঠে। সে সময় আশুতোষ এর সক্রিয় সদস্য। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ‘বেঙ্গলি’ পত্রিকায় হাইকোর্টের বিরুদ্ধে ‘সম্পাদকীয়’ লেখার জন্য জেলবন্দি হন। ইংরেজদ্রোহী, মানে তৎকালীন দেশদ্রোহী সুরেন্দ্রনাথের মুক্তি বিষয়ে ছাত্ররা সরব, আশুতোষও তাঁদের দলে। কাজেই উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকেই ক্রমে ইংরেজদের ব্যবস্থাপনার মধ্যে থেকেই ছাত্রদের সরবতার সূত্রপাত, এবং সেই ব্যবস্থাপনাকে ভারতীয়দের পক্ষে যতটা সম্ভব অনুকূল, নমনীয় করে তোলায় আশুতোষের প্রকল্প।
রবীন্দ্রনাথের প্রকল্পটি অন্য রকম। তিনি প্রচলিত ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থার অংশ হতে চাননি। আশুতোষের মতো বিপ্লবী ছাত্র তিনি নন, স্কুলপালানো কবি তিনি। তিনি বিকল্প এক শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের রূপকার। ছাত্রজীবনে আন্দোলনের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক না থাকলেও পরে যখন রবীন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথ, তখন তিনি প্রশাসনের হুকুম ও ছাত্রদের দাবি— দুইয়ের টানাপড়েনে অধিকাংশ সময়েই ছাত্রদের পক্ষে। প্রশাসন যখন ছাত্র সুভাষচন্দ্রের বিরুদ্ধে, তখন রবীন্দ্রনাথ নানা ভাবে চেষ্টা করছেন সুভাষের ওপর যাতে শাস্তির খড়্গ নেমে না আসে। দিল্লি বা যাদবপুরের বিদ্রোহী সরব পড়ুয়াদের পাশে যখন শিক্ষকেরা এসে দাঁড়ান তখন এই রাবীন্দ্রিক ঐতিহ্যের কথা মনে পড়ে যায়। আশুতোষও সুভাষকে খুবই সাহায্য করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর বিকল্প শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দুটি নীতি পড়ুয়াদের জন্য আজীবন অনুসরণ করেছেন। ছাত্রদের সরব চিন্তাশীল প্রশ্নপরায়ণ করে তুলতে হবে, আর শিক্ষক-প্রশাসন তাঁদের বাইরে থেকে শাসন করবেন না, পড়ুয়ারা নিজেরাই নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করবেন মতামত ও পরামর্শ বিনিময়ের মাধ্যমে। এতে গণতন্ত্রের প্রাথমিক অনুশীলন সম্ভব। মনে রাখতে হবে, রবীন্দ্রনাথ এই গণতন্ত্রকে রাষ্ট্রীয় গণতন্ত্র বলে ভাবতে নারাজ। নেশন তাঁর মতে কিছু লোকের অর্থনৈতিক স্বার্থ পরিপূরণকারী নির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমাবিশিষ্ট দানবীয় সংগঠন। তিনি নেশনের বিপরীতে ব্যক্তিমানুষের সঙ্গে ব্যক্তিমানুষের সহযোগে নির্মিত মতবিনিময়ের মাধ্যমে পোক্ত কল্যাণকামী স্বতঃস্ফূর্ত এক সংগঠনে বিশ্বাসী। সে সংগঠনের নাম সমাজ। তিনি মনে করেন পড়ুয়ারা এই সমাজের জন্য শিক্ষিত হবে, এই সমাজকে সম্প্রসারণে সহায়তা করবে। শিক্ষার পাঠক্রমকে সমাজের সব বৃত্তির সঙ্গে যুক্ত করতে হবে, বৃত্তির বাইরে স্বাধীন দার্শনিক চিন্তার আধুনিক বিজ্ঞান-প্রযুক্তির অধিকারও থাকবে। কাজেই আজকে যাঁরা পড়ুয়াদের সরবতার বিরুদ্ধে ‘আদর্শের দোহাই’ দিচ্ছেন তাঁদের সেই যুক্তি টিকবে না, পুরনো ভারত, রবীন্দ্রনাথ, আশুতোষ সবাই এর বিরোধী।
শুধু একটা কথা। সরবতা, নিজের মতো করে চিন্তা করার সরবতা আর সরবতা এবং বিপ্লবের ফ্যাশন যে এক নয়, সেটা রবীন্দ্রনাথ বার বার স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন। স্বদেশির নামে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বয়কটকে তিনি সমর্থন করতে পারেননি। স্বদেশির নামে না বুঝে নিরপরাধ মেমসাহেবকে যে ছাত্র ঢিল মারে, তাকে রবীন্দ্রনাথ নায়ক বলতে নারাজ। ‘বিপ্লবের ফ্যাশন’ এবং ‘সরবতার মাদকতা’, আর ‘চিন্তাশীল পরিপ্রশ্ন’ যা অধ্যয়ন, অনুভব ও সমাজসচেতনতার ফল— এই দুই যে আলাদা, এ কথা বার বার মনে করিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। এই দুইকে গুলিয়ে ফেললে রক্ষণশীল, কায়েমি স্বার্থের সমর্থক জ্যাঠামশাই জেঠিমাদের হাতই কিন্তু শক্ত করা হবে।

বিশ্বভারতীতে বাংলার শিক্ষক


http://www.anandabazar.com/editorial/student-will-ask-questions-that-is-tradition-1.340218