১৯৫২ সালে ভারত সরকার জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহাকে প্রধান করে ভারতীয় রাষ্ট্রীয় পঞ্জিকা সংস্কার কমিটি গঠন করে। অধ্যাপক সাহা এ দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং সেপ্টেম্বর ১৯৫৪ সালে পঞ্জিকা সংস্কার সংক্রান্ত বিস্তারিত প্রতিবেদন পেশ করেন। ড. সাহা কমিটি জ্যোতির্বিজ্ঞানের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিচার-বিবেচনা করে ভারতীয় রাষ্ট্রীয় পঞ্জিকা শকাব্দের বিজ্ঞানসম্মত সংস্কার সাধন করেন, সেই রিপোর্টে তিনি বাংলা পঞ্জিকারও অনুরূপ সংস্কার প্রস্তাব পেশ করেন।
পূর্ব বাংলায়ও পঞ্জিকা সংস্কারের লক্ষ্যে ঢাকার বাংলা একাডেমি ১৯৬৩ সালে মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্-এর নেতৃত্বে একটি পঞ্জিকা সংস্কার কমিটি গঠন করে। এই কমিটি মূলত মেঘনাদ সাহার সংস্কার প্রস্তাবের মর্মানুযায়ীই বাংলাদেশে বাংলা পঞ্জিকা সংস্কারের প্রস্তাব করে।
পঞ্জিকার জ্যোতির্বিজ্ঞানসম্মত বিন্যাস না হলে সময়ের বিপুল হেরফের হয়ে যেতে পারে। একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। সম্রাট আকবরের সময়ে বাংলায় নববর্ষ ছিল ১১ এপ্রিল। কিন্তু ভারতবর্ষীয় পঞ্জিকার বিজ্ঞানসম্মত বিন্যাস না হওয়ায় বিগত চারশো বছরে তিন বা চার দিনের হেরফের হয়ে গেছে। এখন বাংলাদেশে আমরা নববর্ষ উদযাপন করি রোমান ক্যালেন্ডারের ১৪ এপ্রিল তারিখে। পশ্চিমবঙ্গে করা হয় ১৪ বা ১৫ তারিখে। পশ্চিমবঙ্গে সাহা কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়িত হয়নি। তার ফলে আমরা যেমন ১৪ এপ্রিলকে পহেলা বৈশাখ হিসেবে নির্দিষ্ট করে দিতে পেরেছি, পশ্চিমবাংলা তা পারেনি। ফলে সেখানে একশো বছরে ২৫টির পরিবর্তে ২৬টি লিপ-ইয়ার বা অধিবর্ষ হয়। আর, চারশো বছরে ১০০টির পরিবর্তে ১০৩টি অধিবর্ষ। শুধু তা-ই নয়, এই নিয়মে চললে চার হাজার বছর পরে পশ্চিমবাংলায় পহেলা বৈশাখ হবে জুন মাসে। বিজ্ঞানের পরিবর্তে সংস্কারভিত্তিক পঞ্জিকার ওপর নির্ভরশীলতার কারণেই পশ্চিমবাংলার দিন-তারিখ নির্ধারণে এমন কাণ্ড ঘটবে। এখনই নববর্ষ, রবীন্দ্র-নজরুলজয়ন্তী বাংলাদেশে যখন পালন করা হয়, পশ্চিমবাংলা করে তার এক দিন পরে।
১৯৬৩ সালে মুহম্মদ শহীদুল্লাহর পঞ্জিকা সংস্কার প্রস্তাবে যে সংস্কার করা হয়, তা ছিল এই রকম: বৈশাখ থেকে ভাদ্র পর্যন্ত প্রতি মাস ৩১ দিন এবং আশ্বিন থেকে চৈত্র প্রতি মাস ৩০ দিনে গণ্য করা হবে। যে বছর অধিবর্ষ হবে, সেই বছরে চৈত্র মাস হবে ৩১ দিনে। এর পরে আশির দশকে বাংলা একাডেমি কর্তৃক একটি টাস্কফোর্সের মাধ্যমে বাংলা পঞ্জিকার অধিকতর উন্নতি সাধনের লক্ষ্যে যে প্রস্তাব করা হয়, তাতে বলা হয়, মাসের দিন নির্ধারণে পূর্বোক্ত পদ্ধতি বলবৎ থাকবে, তবে রোমান বা গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জির অধিবর্ষে যে বাংলা বছরে ফাল্গুন মাস পড়ত, সেই বাংলা বছরকে অধিবর্ষ গণ্য করা হবে। অধিবর্ষে চৈত্র মাসের পরিবর্তে ফাল্গুন মাসে ৩১ দিন হবে। আন্তর্জাতিক রীতি অনুযায়ী রাত ১২টায় তারিখ পরিবর্তন হবে। বাংলা একাডেমি প্রস্তাবিত বাংলা সনের এই বৈজ্ঞানিক সংস্কার বাংলাদেশ সরকার গ্রহণ করেছে এবং এখন তা সারা দেশে সরকারি ভাবে চালু রয়েছে।
কেউ কেউ মনে করেন, বাংলাদেশ সরকার এবং বাংলা একাডেমি পঞ্জিকা সংস্কার কমিটির প্রস্তাব বাস্তবায়ন করে সুবিবেচনার পরিচয় দেয়নি। এর ফলে বাংলা তারিখ নিয়ে যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে, তার দায় বাংলাদেশের। এ বক্তব্য যে ঠিক নয়, আমরা তা ভারতের পঞ্জিকা বিশেষজ্ঞ ও ইন্ডিয়ান জার্নাল অব হিস্ট্রি অব সায়েন্স ৩৯/৪ (২০০৪) ৫১৯-৫৩৪ সংখ্যার বিস্তৃত তথ্যমূলক প্রবন্ধ থেকে প্রমাণ করব।
সাহা কমিটির প্রস্তাব যথাযথ ভাবে কার্যকর না হওয়ায় ১৯৮৬ সালে ভারত সরকার অধ্যাপক এস পি পান্ডের সভাপতিত্বে আর একটি পঞ্জিকা সংস্কার কমিটি গঠন করে। এ কমিটি ১৯৮৮ সালের মার্চ মাসে রিপোর্ট পেশ করে। পান্ডে কমিটি পঞ্জিকা সংস্কারে ভারতবর্ষের ঐতিহ্যগত, ধর্মসম্পৃক্ত নানা বিষয় বিবেচনা করে তাদের প্রস্তাব উত্থাপন করে। এবং এ কাজে পঞ্জিকাকার বা জ্যোতিষীদেরও প্রতিনিধিত্ব রাখা হয়। কমিটি দীর্ঘ যুক্তিতর্ক এবং সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিচার-বিশ্লেষণের পর মেঘনাদ সাহার পঞ্জিকা সংস্কারের সায়ন পদ্ধতি থেকে ঐতিহ্যগত নিরায়ণ পদ্ধতিতে ফিরে আসেন এবং আরও দু-একটি ক্ষেত্রে কিছু পরিবর্তন সাধন করেন। ভারত সরকার পান্ডে কমিটির উপর্যুক্ত  প্রস্তাব বিচার-বিশ্লেষণ করে ২০০২ সালের অক্টোবর মাসে তা গ্রহণ করে।
বর্তমান লেখায় পান্ডে কমিটির বিস্তারিত ও অনুপুঙ্খ বিবরণ দেওয়ার সুযোগ নেই। তবে মূল বিষয়গুলি উল্লেখ করেই বোঝাতে পারব ভারতীয় বিশেষজ্ঞরা বাংলা সন সংস্কারের যে নীতি নির্ধারণ করে দিয়েছেন, তা-ই বাংলাদেশের পঞ্জিকা বিশেষজ্ঞ এবং পণ্ডিতেরা গ্রহণ করেছেন। পান্ডে কমিটিতে শুধু পঞ্জিকা বিশেষজ্ঞ এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা ছিলেন না, বি ভি রমন নামে এক জ্যোতিষী এবং দৈবজ্ঞ পঞ্জিকাকারও ছিলেন। তাঁদের সুবিবেচিত এবং সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত হল: ‘The year shall start with the month of Vaishakh when the sun enters nirayana mesarasi, which will be 14th April of the Gregorian calendar.’’
অর্থাৎ, ভারতীয় পঞ্জিকা বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত পঞ্জিকা সংস্কার কমিটি সুস্পষ্ট ভাবে ১৪ এপ্রিলকে প্রতি বছর বাংলার নববর্ষ হিসেবে ঘোষণা করেছেন এবং ভারত সরকার ২০০২ সালে তা গ্রহণ করেছে। এ ছাড়া, ফাল্গুন মাসের ৩১ তারিখ যে অধিবর্ষ হবে, তা-ও তাঁরা নির্ধারণ করে দিয়েছেন এবং এটাও নির্ধারণ করেছেন যে, রাত ১২টায় নতুন দিনের সূচনা হবে। বাংলাদেশের পঞ্জিকা সংস্কারেও এ সিদ্ধান্তগুলোই গ্রহণ করা হয়েছে এবং বাংলাদেশ সরকার ভারত সরকারের মতোই তা গ্রহণ করেছে এবং তার বাস্তবায়নও করা হয়েছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের প্রধান পঞ্জিকাগুলিতে এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়নি, সেগুলি পুরনো এবং অবৈজ্ঞানিক মতেই চলছে। এটাই দুর্ভাগ্যজনক বাস্তব।

বাংলাদেশে বাংলা একাডেমী–র মহাপরিচালক

http://www.anandabazar.com/editorial/if-it-goes-like-this-bengali-s-new-year-will-be-starting-in-the-month-of-june-1.359145