রবীন্দ্রসঙ্গীত না থাকলে কী যে হত আমার!
মান্নাদা প্রায়ই বলতেন কথাটা। প্রথম যে দিন বলেছিলেন প্রচণ্ড অবাক হয়েছিলাম শুনে। কিন্তু নেপথ্যের গল্পটা ভুলতে পারিনি।
সুচিত্রা মিত্রের সঙ্গে এইচএমভি-তে কাজ ছিল। সকালে গিয়েই সুচিত্রাদিকে বললাম, ‘‘আজ একটু আগে শেষ করব দিদি।’’
পরিচিত ঢঙে সুচিত্রাদি বললেন, ‘‘কেন, খেপ আছে বুঝি?’’
বললাম, ‘‘না, না মান্নাদা এসেছেন কলকাতায়।’’
—মান্না এখানে নাকি? ও বেশ এখনও চালিয়ে যাচ্ছে, না! অসম্ভব মনের জোর। কুস্তি-টুস্তি করত তো। তার জন্যই পারছে। যত দিন পারে তত দিনই ভাল। কত কাল কথা হয় না ওর সঙ্গে!
ফোনে ধরিয়ে দিয়েছিলাম মান্নাদাকে। দু’জনে টানা এমন করে কথা বলছিলেন মনে হচ্ছিল, দু’জন শিশু আলাপ করছে!
মান্নাদার বাড়িতে গিয়ে দেখলাম, সুচিত্রদির সঙ্গে কথা বলার রেশটা তখনও আছে। এর পরই কথায় কথায় রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে ওঁর অমন একটা মন্তব্য।
অবাক হয়ে বললাম, ‘‘মানে?’’
হাসতে হাসতে বললেন, ‘‘আরে আমি তো ৯ নম্বর মদন ঘোষ লেনের প্রোডাক্ট। ঘষে মেজে আজকের আমি হয়েছি। রবীন্দ্রসঙ্গীত না থাকলে কি হত?’’
এ বারেও আদ্যোপ্রান্ত কিছু বুঝলাম না। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছি।
মান্নাদা বলে চললেন, ‘‘বম্বেতে তখন ‘ইন্ডিয়ান কালচার লিগ’ নামের একটা সংস্থা ছিল। ভারতের প্রায় সব ভাষার লোকেদের নিয়ে তৈরি সংগঠন। ওরা নানারকম কালচারাল অনুষ্ঠান করত। একবার ঠিক করল, রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রোগ্রাম করবে। তো, আমায় দায়িত্ব দিল, নানা রকম ভাষাভাষী লোকদের রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখাবার। নিলাম দায়িত্ব। দিন কতক পরে বলল, মালয়ালি এক গায়িকার সঙ্গে ডুয়েট গাইতে হবে। আমি তো শুনে থ! মালয়ালি? রবীন্দ্রসঙ্গীত? ওরা কিছুতেই ছাড়বে না। বাধ্য হলাম রাজি হতে। রিহার্সালে গিয়ে দেখি, একটি সুন্দরী মেয়ে মাথা নিচু করে বসে আছে। নাম জিজ্ঞেস করতে বলল, সুলোচনা কুমারন।’’
পরে যিনি সুলোচনা দে হয়ে মান্নাদার জীবনে এসেছিলেন।
সেই ওঁদের প্রথম দেখা।
মান্নাদা বলেছিলেন, ‘‘প্রথম দিনই আলাপ করে মনে হয়েছিল, ও যেন অনেক কালের চেনা। নতুন কেউ নয়।’’
অনুষ্ঠানে ডুয়েট গেয়েছিলেন ‘আমি তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ সুরের বাঁধনে’।
এর পর আর শুধু সুরে নয়, জীবনেও বাঁধা পড়লেন তাঁরা। ১৯৫৩-র ১৮ ডিসেম্বর। যার সূত্রটা যে রবীন্দ্রসঙ্গীত, বারবার তা মজা করে বলতেন।
যাঁদের ভালবাসতেন মান্নাদা, তাঁদের সঙ্গে কথাবার্তায় বেশ খোলামেলা থাকতেন।
এমনকী সেটা বিবাহ-পূর্ব জীবনে প্রেম নিয়েও। এবং আশ্চর্য সেখানেও জুড়ে ছিল রবীন্দ্র-প্রসঙ্গ!
মান্নাদা বলেছিলেন, ‘‘কথার থেকে আমাদের গানই বেশি হত। আমরা দু’জনেই ছিলাম রবীন্দ্রানুরাগী। ও একের পর এক রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইত। আমার কাছে গান শুনতে চাইলে আমি বেশির ভাগ সময় রবীন্দ্রসঙ্গীতই গাইতাম। কখনও কখনও কাকার গান বা শচীনকর্তার। কিন্তু মুশকিল হত কী, ও আমার কাছে প্রায়ই ‘কেটেছে একেলা বিরহের বেলা’ গানটা শুনতে চাইত, আমিও গাইতাম। আর যখনই ‘সব পথ এসে মিলে গেল শেষে তোমার দুখানি নয়নে’ লাইনটা আসত, ব্যস... কোথায় চলে যেত তখন আমার গান! সুর হারিয়ে যেত। ওর দুটো চোখেই যেন থমকে যেত আমার সব সুর।’’
ম্লান হেসে বলতেন, ‘‘ওহ্ দোজ্ ওয়্যার দ্য ডেজ্, রিয়্যালি!... সুলু তো আমার জীবনের অনেক গানেই কোনও না কোনও ভাবে এসেছে। আর রবীন্দ্রনাথের গান সুলুকে না ভেবে গাইব কী করে! যেমন ধরো, ‘ওগো স্বপ্নস্বরূপিণী...।’’ মান্নাদার গলা আবেগে ধরে এল।
সুচিত্রা মিত্রর সঙ্গে মান্নাদার নিবিড় সম্পর্কর কথা বললাম। আরেক জনের কথা মনে পড়ছে। শান্তিদেব ঘোষ। তিনিও মূলত রবীন্দ্র-গানেরই শিল্পী।
মিউজিক ভিডিয়ো-র শ্যুটিং-এ
তবে ঘটনাটি রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে নয়। ছবির গান। ‘ওগো তোমার শেষ বিচারের আশায়’। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিখ্যাত উপন্যাসের চিত্ররূপ ‘ডাক হরকরা’ সিনেমায়। গানটিও তারাশঙ্করের লেখা।
সিনেমায় এই গানটি ছিল শান্তিদেবের লিপে। উনি বাউল সেজে গাইতে গাইতে যাচ্ছেন।
ছবির নেপথ্যে ওঁরই গাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সুরকার সুধীন দাশগুপ্ত সুর করে বললেন, ‘‘না না এ গান মান্নাদাই গাইবে।’’
এ দিকে আবার শান্তিদেবের খুব ইচ্ছে, উনিই গানটি গাইবেন। শেষে সুধীনবাবু দু’জনকেই নিয়েই বসলেন। মান্নাদাকে বললেন, ‘‘আপনি এক বার গানটা ধরুন।’’
গাইলেন মান্নাদা। আর গানটি শেষ হওয়ার পর শান্তিদেব নিজের থেকেই বলে উঠলেন, ‘‘না না, এ গান মান্নাবাবুরই গাওয়া উচিত। উনি চমৎকার গাইলেন।’’
আজও ঘটনাটা মনে পড়লে ভাবি, কী সব দিন ছিল!

রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে মান্নাদার যে কী অসম্ভব কাতরতা কাজ করত!
একবারের কথা বলি।
বাড়িতে বসে গানের কথাই হচ্ছিল। হঠাৎ বললেন, ‘‘আচ্ছা, মানুষটা এত সহজ করে এত এত সব কঠিন অনুভূতি কী ভাবে লিখলেন বলো তো? দেখো, এই যে গানটা, ‘তুমি যারে জানো সে যে কেহ নয়, কেহ নয়, পাও নাই পাও নাই পরিচয়, তুমি মোর পাও নাই পাও নাই পরিচয়’। এই যে ‘পরিচয়’ উনি বোঝাতে চেয়েছেন, এই সূক্ষ্ম পরিচিতির ক্রাইসিসে ভোগেনি এমন মানুষ কি আছেন? কিন্তু এই বিশেষ উপলব্ধি এত সহজে কেউ প্রকাশ করতে পেরেছেন? এ শুধুমাত্র ওঁর পক্ষেই সম্ভব। তার উপরে ওই সুর। আপাত সহজ সরল সুরের মধ্যে যে এত মাদকতা থাকতে পারে, তা রবিঠাকুরের গান না শুনলে বোঝাই যাবে না।’’
মাদকতা শব্দটা লিখতে গিয়েই আরও একটা ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল।
হিন্দি গান দিয়ে প্রফেশনাল জীবন শুরু হলেও বাংলা গানের প্রতি যে স্বাভাবিক ভাবেই একটা দুর্বলতা ছিল মান্নাদার, সেটা বলে দিতে লাগে না।
সময়টা মুম্বইয়ে মান্নাদা যাওয়ার গোড়ার পর্ব। মুম্বই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি তখন বাঙালিতে-বাঙালিতে ছেয়ে আছে। কিন্তু অবাঙালিদের কেউ কেউ মান্নাদার এই যে বাংলা গান বা রবীন্দ্রসঙ্গীত-প্রীতি, তাকে তির্যক চোখে দেখতেন।
মান্নাদা বলেছিলেন, ‘‘আমি ওদের কথায় কিছু বলতাম না, কিন্তু বাংলা গানের বা রবীন্দ্রসঙ্গীতের রস ওঁদের কী করে বোঝাব, মনে মনে শুধু সেই সুযোগটা খুঁজতাম।’’
তেমনই সুযোগ এসে গেল এক দিন। হিন্দি ছায়াছবির সর্বকালীন সেরাদের এক জুটি তাঁদের ছবির গান শেখাতে সে দিন মান্নাদার বাড়িতে এসেছেন।
কিছুক্ষণ গানবাজনা চলার পর মান্নাদা ওঁদের বাংলা গান শোনাতে শুরু করেন। ধীরে ধীরে রবীন্দ্রনাথের গানও।
এর পরের ঘটনা মান্নাদার কথাতেই বলি, ‘‘একটা করে গান শেষ হচ্ছে, আর ওঁরা দেখি, কেয়াবাত কেয়াবাত বলছে। এক সময় বলল, ‘কিসনে বানায়া দাদা ইয়ে ধুন?’ বললাম, ‘আরে শুনো তো প্যাহলে!’ একের পর এক রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে গাইতে যখন অনেকটা সময় চলে গেছে, আমি বললাম, ‘চলো, এ বার তোমাদের গান শোনাও।’ ওরা ততক্ষণে সুরের নেশায় প্রায় বুঁদ। বলল, ‘দাদা, যে গান আপনি শোনালেন, তার পর আর কোনও গান হয় না। এত সহজ সরল কমপোজিশন কে বানিয়েছেন দাদা?’ বললাম। বলল, ‘রবীন্দ্রনাথের নামটাই শুনেছিলাম,  তাঁর এ রকম সব কম্পোজিশন সত্যি জানতাম না। আজ বুঝছি, আপনি কেন এত বাংলা গানের কথা বলেন!’’
সে দিনের সেই স্বনামধন্য জুটি আর কেউ নন— শঙ্কর-জয়কিষেণ।
রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে মান্নাদার এই যে প্রীতি, এটা যখন প্রথম-প্রথম জানতে পেরেছিলাম, খুব অবাক হয়েছিলাম। কেবলই ভাবতাম, মানুষটার বেড়ে ওঠাটা তো কৃষ্ণচন্দ্র দে-র ধ্রুপদী ঘরানায়। তা হলে রবীন্দ্রগান তাঁকে কী করে পেল?
বলেই ফেলেছিলাম এক দিন।
উত্তর দিয়েছিলেন, ‘‘রবীন্দ্রনাথের গান পঙ্কজবাবুর গলায় শুনলে খুব ভাল লাগত। যখন স্কটিশে পড়তাম তখন ওঁর মতো করে গাইতে চেষ্টা করতাম।’’ বলেই গান শুরু করলেন, ‘‘আমার ভুবন তো আজ হল কাঙাল, কিছু তো নাই বাকি, ওগো নিঠুর, দেখতে পেলে তা কি!’’ গানটা শেষ হল, আর সঙ্গে সঙ্গে বললেন, ‘‘আহা কী কথা বলো তো!’’
এখানে একটা ব্যাপার বলি, কৃষ্ণচন্দ্র দে’র রবীন্দ্রগানের প্রীতিও কিন্তু মান্নাদা’র ওপর প্রভাব ফেলেছিল। পরে জীবনীতেও লিখেছেন সে কথা।
মান্নাদা বলতেন, ‘‘কাকা কিন্তু রবীন্দ্রসঙ্গীত খুব ভালবাসতেন। অসম্ভব দরাজ গলায় গাইতেনও। আজ যে আমার ‘না চাহিলে যারে পাওয়া যায়’ নিয়ে লোকে এত বলে, সেটাও কিন্তু আমার কাকারই দান। কাকার কাছে ও ভাবে কীর্তন না শিখলে আমি কখনও অমন করে গানটা গাইতে পারতাম না। তবে আমার পক্ষে কি কাকার মতো কীর্তন গান গাওয়া সম্ভব? নেভার। সেই সময়ে যাঁরা গীতিকার শৈলেন রায়, হেমেন্দ্র গুপ্ত, হেমেন্দ্রকুমার রায়, মোহিনী চৌধুরী... এঁদের প্রত্যেককে কাকা বলতেন, ‘আহা, রবীন্দ্রনাথের এই যে গানের ভাষা, শব্দপ্রয়োগ কী দুর্ধর্ষ বলোতো?’ শৈলেনদাকে তো কাকাই নর্থ বেঙ্গল থেকে আমাদের বাড়িতে এনে বিএ পাস করিয়েছিলেন। ওঁকে কাকা এক দিন বললেন, ‘শৈলেন যুক্তাক্ষর দিয়ে একটা গান লেখো তো।’ শৈলেনদা গাঁইগুঁই করছেন দেখে কাকা বলেছিলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ যদি পারেন, তুমি পারবে না কেন? চেষ্টা তো করো!’ শৈলেনদা কাকার এই কথার পরে লিখে ফেলেছিলেন, ‘যদি বন্ধুর রথ এল দ্বারে, প্রেমের পাত্র কেন উচ্ছ্বল হল রে, চক্ষের নির্ঝর ধারে।’ কাকা রবীন্দ্রসঙ্গীতের একটি রেকর্ডও করেন। যার এক দিকে ছিল— ‘আঁধার রাতে একলা পাগল যায় কেঁদে’, এবং অন্য পিঠে ছিল ‘আমার যাবার বেলায় পিছু ডাকে’। তখন রবীন্দ্রনাথ বেঁচে। শুনেছি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও ওই দুটি গানের খুবই প্রশংসা করেছিলেন। এমনকী তাঁর নিজের কাছে কাকার ওই দুটি গান ছিল।’’

কেবলই বলতেন, রবীন্দ্রসঙ্গীতের একটা টিপিক্যালিটি আছে, সেটা না বুঝলে খুব মুশকিল। খুব পছন্দ করতেন কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গান। বিশেষ করে উনি যে ভাবে মীড় লাগাতেন গানে। এক দিন ওঁরই অনুরোধে ‘দূরে কোথায় দূরে’ শোনানোর পর দেখি, দু’চোখ ভরা জল মান্নাদার চোখে।
পঙ্কজ মল্লিক, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় তো ভালবাসতেনই। তার সঙ্গে পাগলভক্ত ছিলেন দেবব্রত বিশ্বাসের।
বলতেন, ‘‘বেশির ভাগ বাঙালির মিন মিন করে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়া এক দম আমার পছন্দ নয়। ওই কথা, ওই সুর তাকে অমন ভাবে দাঁত চিপে চিপে কেন গাইবে বলো তো? পঙ্কজবাবু শোনো। দেবব্রত বিশ্বাস শোনো। আহা কী উদাত্ত গলায় গেয়েছেন বলো তো ওঁরা! এক দিন রাতে প্রোগ্রাম করে ফিরে শুতে যাওয়ার আগে রেডিয়ো খুলেছি। অ্যানাউন্সমেন্ট হল, রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইবেন দেবব্রত বিশ্বাস। তিনটে গান গেয়েছিলেন। শেষ গানটা ছিল, ‘পেয়েছি ছুটি, বিদায় দেহ ভাই’। শুনে আমি সারা রাত ঘুমোতে পারিনি। শুধু কেঁদেছিলাম।’’
অনেক পরে এই ‘পেয়েছি ছুটি...’ গানটা মান্নাদা নিজেই রেকর্ড করেন। তখন আবার আমি ছিলাম মিউজিক অ্যারেঞ্জার। গাইতে বসে এতটাই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলেন, প্রথম দিন রেকর্ডই করা গেল না।
পর দিন বললেন, ‘‘শোনো, অন্য সব গান হয়ে যাওয়ার পর ওই গানটা ধরব।’’ গাইতে গাইতে কত বার যে দেবব্রত বিশ্বাসের কথা বলেছিলেন! ওঁর গাওয়াটা এতটাই নাড়া দিয়েছিল ওঁকে।
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে ছবি: সমর দাস
এক বার জানতে চেয়েছিলাম, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের রবীন্দ্রসঙ্গীত  কেমন লাগে?
উত্তর দিয়েছিলেন, ‘‘হেমন্তবাবুর রবীন্দ্রনাথের গান বললেই মনে পড়ে, ওঁর গাওয়া ‘হে নিরুপমা’ আর ‘চলে যায় মরি হায়’। অপূর্ব! আর ভাল লাগে ওঁর গাওয়া রবীন্দ্র গীতিনাট্যের গানগুলো। বা, ওই যে, ‘চরণ ধরিতে’... কী গেয়েছিলেন। আমি পঙ্কজ মল্লিকের গলায় এ গান শুনেছি। তার পরও বলছি, হেমন্তবাবুও অসম্ভব ছুঁয়ে গেছেন আমায়। কিন্তু সাফল্যের তো কিছু নেগেটিভ দিক থাকে। অতিরিক্ত গাইতে হয়েছে বলে, বেশ কিছু গান ‘ম্যাটার অফ ফ্যাক্ট’-এর মতো গাইতে হয়েছে ওঁকে। নিজে শিল্পী বলে জানি, এ সব ক্ষেত্রে মনের সূক্ষতা কাজ করে না। তবে ওই রকম গায়ক বাংলায় আর আসবে কিনা কে জানে! কী ভয়েস!’’
এক বার বললেন, ‘‘আরেক জন আছেন না, সাদা শার্ট-সাদা প্যান্ট পরেন... চোখে চশমা!’’
বললাম, ‘‘সাগর সেন?’’
‘‘হ্যাঁ। প্রচণ্ড স্মার্ট ভয়েস। আমার খুব ভাল লাগে।’’
আরেক দিনের ঘটনা মনে পড়ছে।
মদন ঘোষ লেনের বাড়িতে গেছি। কথা বলছি মান্নাদা আর সুলুআন্টির সঙ্গে। সে দিনও রবীন্দ্রসঙ্গীতের কথা উঠলে বলছিলেন, ‘‘আমি কত রবীন্দ্রসঙ্গীত জানি জানো?’’
তা হলে এত কম রেকর্ড করলেন কেন?
‘‘আরে, রেকর্ড ছাড়ো। সে তো কোম্পানির ব্যাপার। আমি কোনও দিনও বলিনি, আমার গান রেকর্ড করো। আমার বয়ে গেছে। রবীন্দ্রনাথের গান আমি নিজের জন্য, তৃপ্তির জন্য গাই,’’ পাশে বসা সুলুআন্টিকে দেখিয়ে বললেন, ‘‘আমরা দু’জনে গাই।’’ বলেই শুরু করলেন, ‘স্বপনে দোঁহে ছিনু কী মোহে, জাগার বেলা হল।’’
মান্নাদা ইশারায় সুলুআন্টিও গলা মেলালেন। গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল। কী অনায়াস ভঙ্গিতে দু’জনে সুরের উজানে ভাসছিলেন!
সে এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা!
এতটাই রবীন্দ্র-প্রীতি ছিল ওঁদের।
তবে শুনেছি, সুলুআন্টি প্রথম-প্রথম তেমন একটা রবীন্দ্রনাথের গান গাইতে চাইতেন না। ভয় পেতেন। বলতেন, ‘‘সব কথার তো মানেটাই ঠিক বুঝতে পারি না। আমি কি পারব?’’
সাহসটা জুগিয়েছিলেন মান্নাদাই। বলতেন, ‘‘আমি তো আছি, বুঝিয়ে দেব।’’
বারবার অমন করে বলাতে সুলুআন্টির ভয়টা চলে গিয়েছিল। নিজের থেকেই তখন রবীন্দ্রনাথের গান করতেন। বলতে হত না। ভাল বেসেই গাইতেন।
মান্নাদা খুব চাইতেন, মেয়েরাও যেন রবীন্দ্রনাথের গান শেখে। গায়। চর্চা করে। সেখানে একটা খেদ থেকে গিয়েছিল ওঁর।
এক দিনের কথা বলি।
আড্ডার মাঝে মেয়েদের কথা উঠতে বললেন, ‘‘ওরা বম্বেতে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াশুনো করলেও ছোট থেকেই ওদের রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়ানোর চেষ্টা করতাম। প্রথমে শিখিয়েছিলাম, ‘হিমের রাতে ওই গগনের দীপগুলিরে’। আমার বড় মেয়ে যেমন এখনও কোনও কথা না বুঝতে পারলে আমেরিকা থেকে ফোন করে বলে, ড্যাডি এর মানে কী? ওর মানে কী? কিন্তু দুঃখ হয় ছোট মেয়েকে বললে, সে বলে ও সব বাংলা গান-টান নয়। আমি ইংরেজি গান করব। ওর গানটা হতে পারে ভেবে বলতাম, একটু লতার গানও গাও, যার গান তুমি অত ভালবাসো। একটু আমার গান গাও। আশার গান গাও। রফির গান করো। কথাটা শুনলে তো! ঘরে বসে ও এখন সব ইংরেজি গান করে। আমি দরজা বন্ধ করে শুয়ে থাকি। কী করব? মানুষের সব ইচ্ছে তো পূরণ হবার নয়।’’

হিন্দিতে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়া নিয়ে মান্নাদার গল্পটা বেশ ইন্টারেস্টিং লাগে।
সময়টা রবীন্দ্র-জন্মশতবার্ষিকীর। শতবার্ষিকী কমিটি মান্নাদাকে ডেকে পাঠাল। অনুরোধ হিন্দিতে রবীন্দ্রনাথের গান গাইবার।
তখনও সে ভাবে রবীন্দ্রনাথের গান হিন্দিতে অনুবাদ করা হয়নি। মান্নাদার প্রথমে একটু আপত্তিই ছিল।
ওঁর যুক্তি ছিল, রবীন্দ্রনাথের প্রত্যেকটি গানে একটা ভিতরের ভাব থাকে। শুধু ভাষাটা অনুবাদ করে দিলে সেই ভাবটা চলে যেতে পারে।
পঙ্কজ মল্লিক তখন বেঁচে। উনি আর কয়েকজন মিলে ভরসা দিলেন, ভয়ের কিছু নেই। ওঁরা একজনকে যোগাযোগ করেছেন, তিনি ঠিকঠাক অনুবাদ করে দিতে পারবেন।
ভদ্রলোককে মান্নাদার কাছে নিয়ে এলেন পঙ্কজ মল্লিক।
মান্নাদা তাঁকে বললেন, ‘‘আমি একটা গানের কয়েকটা লাইন বলছি—‘আমার চোখে যে চাওয়া খানি, ধোওয়া সে আঁখিলোরে, তোমারে আমি দেখিতে পাই, তুমি না পাও মোরে।’ এটার হিন্দি অনুবাদ করে দিন তো।’’
গানের ভাষা শুনে ভদ্রলোকের মুখটা পাংশু হয়ে গেল। শেষে হাল ছে়ড়ে দিয়ে বললেন, ‘‘দাদা, ইয়ে ক্যায়সা গানা হ্যায়? মুঝে তো লাগতা হ্যায় কি হিন্দিমে অ্যায়সা গানা ম্যায় কভি সোচভি নেহি সাকতা। আপ কোই দুসরা গানা বাতাইয়ে।’’
তবে তাই হোক।
মান্নাদা দ্বিতীয় গান বললেন,  ‘আমার এ পথ, তোমার পথের থেকে অনেক দূরে গেছে বেঁকে।’’
ভদ্রলোক এ বার খুব উৎসাহের সঙ্গে বললেন, ‘‘হাঁ জি, ইয়ে...হো জায়গা।’’
তার পর অনেক ঘেমেনেয়ে, দাঁত দিয়ে নখ খেয়ে, প্রচুর সময় নিয়ে বললেন, ‘‘হয়ে গেছে।’’
মান্নাদা বলেছিলেন, ‘‘সেই অনুবাদ দেখে আমার গান গাওয়ার ইচ্ছেটাই প্রায় চলে গেল। ওঁর লেখা কাগজটা হাতে নিয়ে দেখি লিখেছেন— ‘মেরি ইয়ে রাহ্ তেরি রাহ্ সে গ্যয়া মুড়কে বহুৎ দূর।’’’
যদিও পরে এই মান্নাদাই আবার হিন্দিতে রবীন্দ্রনাথের গান করেন।

মান্নাদার রবীন্দ্রগানে এমন একটা নাটকীয়তা কাজ করত, সামনাসামনি বসে সেটা উপলব্ধি করাটা ছিল এক অপার্থিব অভিজ্ঞতা।
একবারের ঘটনা বলি।
ওঁর কলকাতার বাড়ি। সন্ধে নেমেছে। গরমকাল। হাওয়াবাতাস পুরো থমকে আছে। লোডশেডিং হয়ে গেল। এমার্জেন্সির টিমটিমে আলোয় বসে আছি। সামনে মান্নাদা। হঠাৎই চড় চড় করে বাজ পড়ল। চমকে উঠলাম আমরা। বললেন, ‘‘কালবোশেখি শুরু হল বোধহয়। একটু বসে যাও। এখন বেরিয়ো না।’’
শুরু হল ঝমঝমে বৃষ্টি। সঙ্গে বিদ্যুৎ চমকানি। মান্নাদা গান করছিলেন গুন গুন করে। নানারকম গান। বললাম, ‘‘আপনার সেই গানটা কিন্তু এখনকার জন্য আইডিয়াল...।’’
মুহূর্তে বুঝে গেলেন, কোন গানের কথা বলছি। আর খোলা উদাত্ত গলায় গেয়ে উঠলেন, ‘‘বিদ্যুৎ চমকিয়া যায়... ক্ষণে ক্ষণে...শর্বরী শিহরিয়া উঠে, হায়....শ্রাবণের গগনের গায়...।’’
ওপাশে বৈশাখের খ্যাপা বৃষ্টিধোওয়া আকাশ। মাঝে মাঝে সাদা হয়ে যাচ্ছে আলোর ঝলকানিতে। ঝমঝমে শব্দ চিরে মিঠে হাওয়ায় তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে চারপাশ। আর ঘরে মান্নাদা’র ওই দামাল-রোম্যান্টিক গলা...বর্ষার যেন অকালবোধন দেখেছিলাম সে দিন।

২০০৯ সালের শেষ দিকের কথা।
মান্নাদা তখন আমেরিকায়।
ওখান থেকেই সুলুআন্টির অসুস্থতার খবর দিলেন। দিনে দিনে শরীর ভাঙছে। বোঝা যাচ্ছে, আর বোধ হয় বেশি সময় নেই। মান্নাদার মনের অবস্থাটা বুঝতে অসুবিধে হয়নি।
দেশে ফিরলেন ওঁরা। কথা হত ফোনে। বারবার মনে হত, নিজেকে মানসিক ভাবে শক্ত প্রমাণ করার খুব চেষ্টা করছেন, কিন্তু ভেতরে-ভেতরে কেমন যেন ভাঙন ধরেছে ওঁর। সুলুআন্টির অসুখের কষ্ট, তাঁর অতিনিকট ভবিতব্যকে মেনে নিতে পারছিলেন না কিছুতেই।
তার মধ্যেই এক দিন দেখা হতে বললেন, ‘‘আমি সুলুর জন্য দশটা রবীন্দ্রনাথের গান করব। দিন দশেক বাদে তোমায় ফোন করছি।’’
দশ দিন বাদে আমিই ফোন করলাম। বললেন, ‘‘হ্যাঁ করব। কিন্তু নো প্যানপ্যানানি। ওই যে তুমি একটা ছবির গান শুনিয়েছিলে না, সেরকম অ্যাপ্রোচ থাকবে।’’
এর আগের ঘটনাটা না বললে, মান্নাদার এই কথাটা বোঝা যাবে না।
সালটা এখন আর মনে নেই। সন্ধেবেলায় গেছি ওঁর সঙ্গে দেখা করতে। কলকাতার বাড়িতে।
কথায় কথায় বললেন, ‘‘আচ্ছা, ইদানীং তরুণবাবুর (মজুমদার) কী একটা ছবি না কি খুব ভাল হয়েছে? ওঁর ছবিতে তো রবীন্দ্রসঙ্গীত থাকেই। এই ছবিতেও নাকি সব রবীন্দ্রসঙ্গীত ব্যবহার করা হয়েছে। গান নাকি খুব চলছে?’’
বললাম, ‘‘হ্যাঁ, ছবিটার নাম ‘আলো’।’’
মান্নাদা বেঙ্গালুরু চলে যাওয়ার আগে ‘আলো’-র একটা সিডি দিয়ে বলেছিলাম, ‘‘সময় পেলে শুনে বলবেন কেমন লাগল?’’
দু’দিনের মধ্যে ফোন।
বললেন, ‘‘আমি তো সিডিটা শুনে ফেলেছি। রবীন্দ্রনাথের গান মানেই তো ঝিমানো ব্যাপার করে ফেলা হয়। তাতে গান গাওয়ার ইচ্ছেটা অনেক সময় মাটি হয়ে যায়। অথচ এখানে ঠিক তার উল্টো। এই অ্যাপ্রোচটাই ঠিক। এরকম না হলে নতুন প্রজন্ম ওঁর গান শুনবে না। ভাল কাজ হয়েছে। এই অ্যাপ্রোচেই রেকর্ড করব।’’
খুব ইচ্ছে ছিল রেকর্ডটা করার। কেবলই বলতেন, ‘‘আমার শুধু একটাই চাওয়া। গানগুলো শুনে সুলু যেন এই অবস্থাতেও একটু আনন্দ পায়। শান্তি পায়। স্বস্তি পায়। আমি আর কিছু চাই না।’’
নানা কারণে সে-রেকর্ড আর হয়ে উঠল না। সুলুআন্টির ম়ত্যুর পরেও তাঁকে নিয়ে আরেকটা অ্যালবামও যেমন তিনি করে যেতে পারেননি, ঠিক তেমনই। এই আফসোসগুলো আমার কিছুতেই যাবার নয়।
২০১৩-র ফেব্রুয়ারি। শেষবারের জন্য গিয়েছিলাম বেঙ্গালুরুর ঠিকানায়। শরীর ভেঙে গেছে। আর মন যেন শতছিন্ন। একটু কথা এগোলেই বারবার পুরনো কথায় ফিরে যাচ্ছিলেন। কেবলই ছল ছল করে উঠছিল চোখ।
তার মাঝেও অবধারিতভাবে উঠে এল রবীন্দ্রনাথের গানের প্রসঙ্গ। এক বার বললাম, ‘‘কোনও বিশেষ গানের কথা মনে পড়ে? ইচ্ছে করে গাইতে?’’
অপলক চেয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। চশমার আড়ালে ঘোলাটে চোখে তখন কত কত ছায়া!
ঠোঁটটা অল্প ফাঁক করে মান্নাদা অস্ফুটে বলে উঠলেন, ‘‘ওঁর প্রেমের গান আজও আমায় টানে...‘তুমি একটু কেবল বসতে দিয়ো কাছে... আমায় শুধু ক্ষণেক তরে... আজি হতে আমার যা-কিছু কাজ আছে, আমি সাঙ্গ করব পরে...।’’
গলাটা বুজে এল মান্নাদার।
ওঁর ওই ধরা-ধারা ক্লান্ত-শীর্ণ-শীতল স্বরটা আজও বাতাস হয়ে আমার চারপাশে চলে বেড়ায়।


http://www.anandabazar.com/supplementary/patrika/special-write-up-on-manna-de-on-his-birth-day-1.373509