Friday, 29 April 2016

দুই কবির সখ্য (On the friendship of Rabindranath and Dwijendralal)

$image.name

দুই কবির সখ্য

৩০ এপ্রিল, ২০১৬, ০১:৩৮:৫৪
e e print
 
dwijendralal roy
আমাকে বা রবিবাবুকে বাঙালি কোনও দিন ভুলে যাবে না। আর ভুলে যাবে না কেন জানিস?’
‘কেন বাবা?’
‘ভুলে যাবে না এই জন্য যে আমরা রেখে যাব বাঙালির প্রাণের জিনিস- সুরে বাঁধা গান।’ দ্বিজেন্দ্রলাল বলছেন তাঁর আদরের পুত্র মন্টুকে।
বাঙালির প্রাণের গান রচনা করেছেন রবীন্দ্রনাথ ও দ্বিজেন্দ্রলাল। বাঙালির প্রাণের এই দুই কবির জন্মকালও খুব কাছাকাছি। রবীন্দ্রনাথের জন্ম ১৮৬১ সালে, দ্বিজেন্দ্রলালের ১৮৬৩ সালে। দুই কবির মধ্যে বন্ধুত্বও ছিল নিবিড়, তবু কাঁটা লুকিয়ে ছিল কোথাও। বন্ধুত্বে ভাঁটা, ভালবাসায় বিচ্ছেদ। কিন্তু কেন?
শৈশবে রবি দুষ্টুমি করছেন, তাঁকে একটু সামাল দেবার জন্য মাস্টারমশাই বোর্ডে একটা ছড়া লিখে দিলেন। ‘রবি করে জ্বালাতন আছিল সবাই। বরষা ভরসা দিল তার ভয় নাই।’ বললেন, লেখো তো তুমি এর পরে দুটি লাইন। কী আশ্চর্য, শিশু রবি তক্ষুনি লিখে ফেললেন ‘মীনগণ হীন হয়ে ছিল সরোবরে। এখন তাহারা সুখে জলক্রীড়া করে।’ ঠিক এই সময়ে ছোট দ্বিজেন্দ্রলাল তাঁর প্রথম কবিতা লিখেছেন ‘গগন-ভূষণ-তুমি জনগণ মনোহারী। কোথা যাও নিশানাথ হে নীল নভোবিহারী’—যা শুনে তাঁর পিতা দেওয়ান কার্তিকেয়চন্দ্র রায় মন্তব্য করেছিলেন— এই ছেলে যশস্বী হবে। আবার দ্বিজেন্দ্রলালের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘আর্য্যগাথা’ প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয় ১৮৮২ সালে। রবীন্দ্রনাথের প্রথম দিকের ‘সন্ধ্যাসংগীত’ প্রকাশিত হয় ১৮৮২ সালে। বিলেত থেকে ফিরে এসে দ্বিজেন্দ্রলাল প্রকাশ করলেন আর্য্যগাথা দ্বিতীয় খণ্ড ১৮৯৩ সালে। ইতিমধ্যে দশটি বছর পার হয়ে গিয়েছে। প্রকাশিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথের মানসী কাব্য, মায়ার খেলা, চিত্রাঙ্গদা নৃত্যনাট্য এবং আরও অনেক অসাধারণ রচনা। তত দিনে কবিখ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে। দ্বিজেন্দ্রলালের সাহিত্যজীবনের প্রথম লগ্ন। তখন তো কেউ তাঁর নামই জানত না। এগিয়ে এলেন রবীন্দ্রনাথ। কবি হিসেবে বরণ করে নিলেন দ্বিজেন্দ্রলালকে। তাঁর ‘আর্যগাথা’ কাব্যগ্রন্থটির দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশিত হওয়ার পর রবীন্দ্রনাথ কবিতাগুলির ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন। আর তার পরেই কৃতজ্ঞতায় দ্বিজেন্দ্রলাল তাঁর ‘বিরহ’ রবীন্দ্রনাথকে উৎসর্গ করেন। সাহিত্য সৃষ্টির মাধ্যমে দুজনের পরিচয় আর ভালবাসা।
আবগারি বিভাগ থেকে দ্বিজেন্দ্রলালের পর্যটনের জন্য একটি বজরা নির্দিষ্ট ছিল। একদিন সেই বজরাটিতে সাহিত্যিক বন্ধুদের তিনি একটি পার্টি দিলেন। সুরেশচন্দ্র সমাজপতি লিখেছেন—‘কথা ছিল এখান থেকে বরাবর খড়দা পর্যন্ত গিয়ে সেখানে একটা বাগানে আহারাদি করা যাবে এবং তারপর ধীরে সুস্থে ফেরা যাবে। বজরা রওনা হল। রবিবাবুও এ পার্টিতে ছিলেন। হঠাৎ খুব মেঘ করে এল ঝড় এবং বৃষ্টি। এ দিকে বাজে তখন প্রায় এগারোটা। শ্যামবাবু জানালেন, আমরা ব্যারাকপুরে লাটসাহেবের বাড়ির বাগানে নেমেছি। সেখানেই নেমে পড়া সাব্যস্ত হল। কিন্তু রাতের ওই দুর্যোগে একখানিও গাড়ি পাওয়া গেল না। অনন্যোপায় হয়ে সেই ঘোর অন্ধকারে পদব্রজে খড়দহ যাত্রা এবং সেই বাগানের আবিষ্কার।  রাত্রে যৎসামান্য আয়োজন। প্রত্যুষে উঠেই যে যার সব ট্রেনে করে কলকাতায় ফিরে আসা গেল। দুজন মহাকবি অম্লান বদনে এই সব অসামান্য কষ্ট সহ্য করেছিলেন এবং হাস্যামোদ, কবিত্ব ও রসিকতার অফুরন্ত প্রবাহে সেই দারুণ দুশ্চিন্তা ও ক্লেশকে আনন্দময় করে রেখেছিলেন। দুই কবির মধ্যে এ সময় খুব সম্প্রীতি ছিল এবং তাঁদের বন্ধুত্ব সম্বন্ধটাও ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল।’
যখন পূর্ণিমা মিলন ক্লাব প্রতিষ্ঠা করলেন দ্বিজেন্দ্রলাল, কে না যোগ দিয়েছিলেন সেই সাহিত্যবাসরে। তাঁর ৫ নং সুকিয়াস্ট্রিটের বাড়িতে রবীন্দ্রনাথও এসেছিলেন। ফাগ খেলা চলেছে। দ্বিজেন্দ্রলাল মুঠো মুঠো করে ফাগ মাখিয়ে কবিকে লাল রং-এ রঞ্জিত করলেন। রবিবাবু বললেন, ‘আজ দ্বিজুবাবু শুধু যে আমাদের মনোরঞ্জন করেছেন তা নয়, তিনি আজ আমাদের সর্বাঙ্গ রঞ্জন করলেন। এর পরে রবিবাবু গান ধরলেন—সে যে আমার জননী রে।’
১৩১০ সালে মোহিতচন্দ্র সেন রবীন্দ্রনাথের ‘কাব্যগ্রন্থ’ নামে ২৬টি কবিতা সম্পাদিত ও সংকলিত করে প্রকাশ করেছিলেন। তার ভূমিকাতে রবীন্দ্রনাথ তাঁর কাব্যের মধ্যে কোনও অদৃশ্য নির্দেশ অনুভব করার কথা বলেছিলেন। ভূমিকাতে ছিল ‘আমারে কর তোমার বাণী’ গানটি। ১৩১১ সালে বঙ্গবাসী পত্রিকা থেকে সংকলিত ‘বঙ্গভাষার লেখক’ নামে একটি বই প্রকাশিত হয়। রয়েছে রবীন্দ্রনাথের স্বলিখিত আত্মজীবনী। যার মধ্যে তিনি তাঁর কোনও কোনও রচনা সম্বন্ধে জীবনদেবতা—ঐশ্বরিক প্রেরণা কথাটি উল্লেখ করেছেন। লেখাটি পড়লেন দ্বিজেন্দ্রলাল এবং চিঠি লিখলেন রবীন্দ্রনাথকে।
তিরস্কার করে তিনি কবির কাছে জানতে চাইলেন, রবিবাবু কি ডিভাইন ইন্সপিরেশনের দাবি করেছেন? করে থাকলে তার ব্যাখ্যা কী? রবিবাবু উত্তরে জানালেন, তিনি যা ভাল বুঝেছেন তা লিখেছেন। এ সম্বন্ধে কারও কাছে জবাবদিহি করবার কোনও প্রয়োজন অনুভব করছেন না। দ্বিজেন্দ্রলাল উত্তরে  বললেন, রবিবাবু যদি তার  লেখাগুলি সম্পর্কে ডিভাইন ইন্সপিরেশন দাবি করতে লজ্জিত ও সংকুচিত না হন, তবে তিনি প্রমাণ করে দেবেন যে ওই রচনাগুলি দৈবশক্তি প্রণোদিত তো নয়ই বরং লালসাপূর্ণ। প্রমাণস্বরূপ তিনি বিশ্লেষণ করলেন, রবিবাবুর প্রেমের গানগুলি চোখ বুলিয়ে নিন। ‘সে আসে ধীরে’ ‘সে কেন চুরি করে’ ইত্যাদি গানগুলি সবই ইংরাজি কোর্টশিপের গান। তাঁহার ‘তুমি যেওনা এখনই’ ‘কেন যামিনী’ প্রভৃতি অভিসারিকার গান।
‘সোনার তরী’ যখন প্রকাশিত হল, তখন সেই আত্মভাব-নিমগ্ন কল্পচারণা, সংকেত ব্যঞ্জনার আলোছায়া ও অন্তরের আধ্যাত্মিক অনুভূতি অনেক কবি, সাহিত্যিক ও সাহিত্য সমালোচকের মর্মমূলে পৌঁছল। সোনার তরী কবিতাটিকে তাঁরা রবীন্দ্রনাথের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবিতা রূপে গণ্য করলেন। ‘তাঁহার সোনার লেখণী অক্ষয় হউক’ এই ভাবে কবিতাটিকে শীর্ষে স্থান দিলেন। কিন্তু দ্বিজেন্দ্রলাল কবিতাটিকে আক্রমণ করলেন। তাঁর মতে, ‘রবীন্দ্রসাহিত্য অস্পষ্ট’।  দ্বিজেন্দ্র বলছেন, ‘যদি স্পষ্ট করিয়া না লিখিতে পারেন সে আপনার অক্ষমতা। ...অস্পষ্টতা একটা দোষ, গুণ নহে’ (কাব্যের অভিব্যক্তি প্রবাসী ১৩১২ কার্তিক)।
আসলে, দ্বিজেন্দ্রর মতে রবি খালি ‘প্রেম’ নিয়ে লিখতে বসেন। নাটক নভেলও তাই। ‘কেন পৃথিবীতে মাতা নাই, ভ্রাতা নাই, বন্ধু নাই—সব নায়ক আর নায়িকা? তাও যদি কবিরা দাম্পত্য প্রেম লইয়া কাব্য লেখেন, তাহাও সহ্য হয়। ইহাদের চাই হয় বিলাতি কোর্টশিপ নয়ত টপ্পার প্রেম। নহিলে প্রেম হয় না। অবিবাহিত পুরুষ ও নারী চাই-ই। ফল দাঁড়ায় এই যে এরূপ প্রেম হয় ইংরাজি (অতএব আমাদের দেশে অস্বাভাবিক) না হয় দুর্নীতি মূলক’ (কাব্যে নীতি সাহিত্য ১৩১৬ জৈষ্ঠ সংখ্যা)।’
তখন রবীন্দ্রভক্ত ও রবীন্দ্রবিরোধী সুস্পষ্ট দুটি দল। ‘বাংলাদেশের সাহিত্যিক মহলে পত্রিকার অফিস হইতে কলেজের হস্টেল পর্যন্ত লেখাপড়া জানা ভদ্রসমাজ যেন দুই দলে বিভক্ত হইয়া গিয়াছিল। ‘দ্বিজুবাবুর দল’ ও ‘রবিঠাকুরের দল’। (রবীন্দ্রজীবনী দ্বিতীয় খণ্ড প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়)
১৩১১ সালে দুই সাহিত্যিকের মনোমালিন্য কোন জায়গায় পৌঁছেছিল, তা বোঝা যাবে রবীন্দ্রনাথের একটি চিঠি থেকে। রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, ‘আপনার নিন্দুকের দলে আমি যোগ দিতে পারব না।’
অথচ এমন নয় যে তিনি রবীন্দ্র সাহিত্যের অনুরাগী ছিলেন না। অনেকগুলি উদাহরণ দেওয়া যায় যেখানে তিনি রবীন্দ্ররচনার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। ‘যেতে নাহি দিব’ কবিতাটি পড়ে তার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন।
রবি ও দ্বিজেন্দ্র সমসাময়িক অসামান্য প্রতিভার অধিকারী। যখন রবীন্দ্রনাথের যশ মধ্যাহ্ন সূর্যের দীপ্তির মতো ছড়িয়ে পড়ল, যখন তাঁর প্রতিভার অনুরাগীর সংখ্যা সীমাহীন হয়ে উঠল, তখন কি কোনও ঈর্ষার কাঁটা বিদ্ধ করল দ্বিজেন্দ্রলালকে? মনের এই শোচনীয় অবস্থায় তিনি রবীন্দ্রনাথকে ভীষণ ভাবে এবং অন্যায় ভাবে ব্যক্তিগত আক্রমণ করে রচনা করলেন ‘আনন্দবিদায়’ প্রহসন।  ‘স্টার’ রঙ্গালয়ে তা মঞ্চস্থ করলেন। বিশিষ্ট দ্বিজেন্দ্রজীবনী লেখক দেবকুমার রায়চৌধুরী এ সম্পর্কে লিখেছেন ‘আমি বন্ধুবরের কাছে গিয়া এ ব্যাপার হইতে নিরস্ত হওয়ার জন্য তাঁকে বারবার অনুরোধ করি, হাসিতে হাসিতে দ্বিজেন্দ্রলাল বলিলেন ‘ওহে আগে অভিনয়টা দেখ, তারপরই না হয় অত গালাগাল দিও। এখনই অত চটছ কেন? অভিনয় দেখিতে দেখিতে আমার এত দুঃখ ও বিরক্তি বোধ হইতে লাগিল যে, আমি তখন বিশেষ করিয়া বারংবার অভিনয়টা বন্ধ করাইয়া দিবার জন্য দ্বিজেন্দ্রলালকে বলিয়াছিলাম, যতক্ষণ অভিনয় চলিয়াছিল এবং যখন সব শেষ হইয়া গেল তখনও। দ্বিজেন্দ্রলালের মুখের দিকে আমি যতবারই চাহিলাম দেখিলাম উহা অস্বাভাবিক বিকৃত ও বিবর্ণ হইয়া পড়িয়াছে, বোধ হইল, যেন তৎকালে তাঁহার অন্তরে দারুণ অনুশোচনার উদয় হইতেছে। দেবকুমার আরও লিখছেন দ্বিজেন্দ্রলাল তাঁকে বলেছেন, ‘সত্যি এটা আমার অত্যন্ত ভুল হয়ে গেছে। আমি আর এমন কাজ করব না। সেই থেকে, বলব কী তোমায়, আমার ভিতরটা জ্বলছে।’
তবুও অন্তরে দুই কবির যে মহামিলন ছিল একটি ঘটনায় তা প্রমাণিত। মৃত্যুর কিছুদিন আগে দ্বিজেন্দ্রলাল বললেন আমাদের দেশ, আমাদের সরকার যদি সত্যকার সমঝদার হত, তবে রবীন্দ্রনাথকে তারা নাইট উপাধি দিত। ‘আমাদের শাসনকর্তারা যদি বঙ্গ সাহিত্যের আদর জানিতেন তাহা হইলে রবীন্দ্রনাথ আজ নাইট উপাধিতে ভূষিত হইতেন।’ এই লেখাটি লেখবার পরে যদি তিনি তিনটি মাসও জীবিত থাকতেন তা হলে দেখতে পেতেন রবীন্দ্রনাথের জয় ঘোষণায় বিশ্বলোক মুখরিত হয়েছে। তিনি নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। দ্বিজেন্দ্রলালের উক্তি সার্থক হয়েছে।
আর দ্বিজেন্দ্রলালের মৃত্যুর পর রবীন্দ্রনাথের উক্তি ‘সাময়িক পত্রে যে সকল সাময়িক আবর্জনা জমা হয়, তাহা সাহিত্যের চিরসাময়িক উৎসব সভার সামগ্রী নহে। দ্বিজেন্দ্রলালের সম্বন্ধে আমার যে পরিচয় স্মরণ করিয়া রাখিবার যোগ্য তাহা এই যে আমি অন্তরের সহিত তাঁহার প্রতিভাকে শ্রদ্ধা করিয়াছি। আর যা ঘটিয়াছে তাহা মায়া মাত্র।’
সূত্র: দ্বিজেন্দ্রলাল—দেবকুমার রায়চৌধুরী, রবীন্দ্রজীবনে—প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, বঙ্গভাষার লেখক— বঙ্গবাসী পত্রিকা সম্পাদিত, দ্বিজেনরচনাবলী—ডঃ রথীন্দ্রনাথ রায় সম্পাদিত, স্মৃতিচারণ—দিলীপকুমার রায়


http://www.anandabazar.com/supplementary/patrika/friendship-of-two-poets-1.373486

৯ নম্বর মদন ঘোষ লেন (On Manna Dey)

$image.name

৯ নম্বর মদন ঘোষ লেন

৩০ এপ্রিল, ২০১৬, ০১:৫৫:০৯

Manna de

বাড়ির উঠোনে ছবি: উৎপল সরকার

ছোটবেলাই থেকে দেখতাম, আমার বাবা, অন্য দুই কাকা আমাদের সিমলে পাড়ার বাড়িতেই থাকেন।
সেজকাকু কোথা না কোথা থেকে মাঝে মাঝে শুধু আসেন।
দিন কয়েক থাকেন।
আবার চলে যান।
গান করেন। হাফহাতা পাঞ্জাবি, লুঙ্গি পরে রোয়াকেও বসে থাকেন, আড্ডা দেন। আর পাঁচ জনের মতোই।
আমার তখন কতই বা বয়স, দুই-তিন। তখন কি বুঝতাম আমার এই সেজকাকুই ‘মান্না দে’!
মা’র (নীহারিকাদেবী) যখন বারো-তেরো বছর বয়স, তখন থেকেই মা এ-বাড়ির বড় বৌ। সেজকাকুর সঙ্গে মায়ের সম্পর্কটা ছিল অনেকটাই বন্ধুর মতো। একটু বড় হতে মা-ই আমায় সেজকাকুর গুরুত্বটা বুঝিয়ে দেন।
আমাদের তখন জয়েন্ট ফ্যামিলি। সব মিলিয়ে লোকজন প্রায় জনা চল্লিশেক।
মুম্বই থেকে সেজকাকু এলে বাড়িতে যেন যজ্ঞি লেগে যেত। লোকের আসাযাওয়া বেড়ে যেত।
এমনিতেই আমাদের বাড়িতে গান লেগেই থাকত। কাকা এলে দেখতাম, গানের জগতের লোকজনে যেন বাড়ি ছেয়ে যাচ্ছে।
এমনকী সকাল হলেই কত দূর দূর থেকে অচেনা সব লোকজন দরজার বাইরে এসে জড়ো হচ্ছেন।
নীচতলায় আমাদের গানের ঘর। ছোটবেলায় আমাদের সে-ঘরে ঢোকার অনুমতি ছিল না। পড়াশোনার ক্ষতি হবে যে, তাই।
এক কালে দাদু, কৃষ্ণচন্দ্র দে ওই ঘরে গানবাজনা করতেন। কাকা অবশ্য রেওয়াজ করতেন ওপরে, নিজের ঘরে।
যতক্ষণ সেই রেওয়াজ চলত, দেখতাম রাস্তায় দাঁড়িয়ে অনেকে মোহিত হয়ে শুনছেন।
সেজকাকু এ-বাড়িতে আসা মানে রান্নাও হবে এলাহি। ছুটির দিনে কম করে তেরো-চোদ্দো কিলো পাঁঠার মাংস। আমার ছোট কাকা, প্রভাস দে। বাড়িতে বড়রা যাঁকে ডাকতেন ভেলু। রান্না করতেন তিনিই। ছোট কাকাকে জোগাড় দিত আমার বড় দাদা, মুকুল দে।
সেজকাকু খেতে ভালবাসত খুউব। খেত যে খুব বেশি তা নয়, বরং অল্পই। কিন্তু ওঁর পছন্দের খাবারদাবারের কয়েকটা মার্কামারা দোকান ছিল।
দই হলে অমৃত-র। সীতাভোগটা হবে সেনমশাই-এর। ঘিয়ের মালপোয়া হলে নেপাল চন্দ্র চন্দ্র বা অন্য কোনও অবাঙালি দোকানের। আবার ফিশফ্রাই কী ফাউল কাটলেটটা চাচা-র হওয়া চাই।
ভাতের পাতে বাঙালি খাবার ছিল অসম্ভব প্রিয়।  সুক্তো, আলু ভাজা, বেগুন ভাজা, ভেটকির ফ্রাই, চিংড়ির মালাইকারি, লাউ চিংড়ি, মোচা চিংড়ি, দই বড়া...।
আর কালীপুজোর সময় সেজকাকু এলে ভাল মতো ভাগিদার হয়ে পড়ত বাড়ির বাজি তৈরিতেও। তুবড়ি, ফানুস, রংমশাল...। এ ছিল আমাদের বাড়ির বহু পুরনো রেওয়াজ।
দাদু বেঁচে থাকতে আরেকটা রেওয়াজ ছিল। সেটা দোলে। সে অবশ্য আমি দেখিনি। শুনেছি।
প্রত্যেক দোলে দাদু নতুন নতুন গান বাঁধতেন। কাকারা দোলের দিনে পায়ে হেঁটে রাস্তায় রাস্তায় সে-গান গাইতে বেরোতেন। অনেকটা নগরসংকীর্তনের মতো। সে দলে সেজকাকুও থাকত। দাদু চলে যাওয়ার পর থেকে সেই রেওয়াজ অবশ্য বন্ধ হয়ে যায়।
সেজকাকুর আরও কয়েকটা ব্যাপার ছিল।
সারা বছর মা-কাকিমারা তো বাড়ির হেঁশেল ঠেলে ঠেলে জেরবার হয়ে যেতেন, তাতে সেজকাকুর বোধহয় ওঁদের প্রতি এক ধরনের বাড়তি ‘ফিলিং’ কাজ করত। যখনই আসতেন, দলবেঁধে ওঁদের নিয়ে হাতিবাগানে থিয়েটার পাড়ায় নিয়ে যেতেনই যেতেন।
পুজো এলে আমরা জানতাম, আর কিছু না হোক, সেজকাকু বাড়ির সব্বার জন্য ঠিক নতুন জামাকাপড় কিনে পাঠাবেন।
আর জীবনের প্রথম পরীক্ষায় পাশ করলে একটা হাতঘড়ি দেবেন।
শেষ দিকে যখন পুজোর সময়ে জামাকাপড় নিজে কিনে দিতে পারতেন না, প্রত্যেককে মোটা টাকা পাঠাতেন, সে আমেরিকাতেই থাকুন, কী বেঙ্গালুরু।

ছোট থেকেই সেজকাকু আমুদে! মদন ঘোষ লেনের বাড়িতে ওঁর দুষ্টুমির গল্পও যে কত!
এক বার শুনেছি, সন্ধেবেলা ওঁর দেরি করে বাড়ি ফেরার কথা কাজের লোক  বড়দের কাছে ফাঁস করে দিয়েছিল বলে, ঘুমন্ত অবস্থায় তার গায়ের থেকে কাপড় সরিয়ে জ্বলন্ত ধূপকাঠি ঠেসে ধরেছিল।
আচার খেতে খুব ভালবাসত। পাশের বাড়িতে যখন আচার শুকোতে দিত, তক্কে তক্কে থাকত। নির্জন দুপুরে এ-বাড়ি থেকে ও-বাড়ির ছাদের পাঁচিলের মাথায় আড়াআড়ি বাঁশ ফেলে, সেই বাঁশ বেয়ে ঝুলতে ঝুলতে অন্য বাড়ির ছাদে গিয়ে বয়াম থেকে আচার খেয়ে আবার ওই একই ভাবে ঝুলতে ঝুলতে চলে আসত।
সেজকাকুর এই ডানপিটে স্বভাব আমারও দেখা।
সালটা যদ্দুর মনে পড়ে ’৭৫ কী ’৭৬। ওঁর তখন বয়স পঞ্চান্ন-ছাপ্পান্ন।
মহালয়ার দিন। আমরা পাড়ায় বল পেটাচ্ছি। একটা ট্যাক্সি এসে থামল। দেখলাম সেজকাকু। তখন কলকাতায় ট্যাক্সিতে মিটারে যা ভাড়া উঠত, তার চেয়ে কুড়ি না দশ পার্সেন্ট বেশি দেওয়ার নিয়ম ছিল। মুম্বইবাসী কাকু অত শত জানত না।
ফলে মিটারে যা ভাড়া উঠেছিল, তাই-ই ট্যাক্সিওয়ালার হাতে দিয়ে নেমে যেতে গেছেন, হঠাৎ সে বলে উঠল, ‘‘আরে ঠিকসে ভাড়া তো দো!’’
কাকু অবাক হয়ে বলল, ‘‘ঠিক সে মতলব? গিনকে দেখো, কিতনা হ্যায়।’’
‘‘গিন লিয়া। ম্যায় ক্যায়া গলত বাতাতু হুঁ? কমতি দিয়া। চিটিংবাজ কাঁহিকা...!’’
‘‘ক্যায়া বোলা? চিটিংবাজ...!’’ বলেই ট্যাক্সিওয়ালাকে এই মারে তো সেই মারে!
এমন একজন মানুষকে এক বার এত বিচলিত হতে দেখেছিলাম, কী বলি!
কাকুর ঘরে বসে আছি।
টিভিতে কলকাতার এক বিখ্যাত ধ্রুপদ সঙ্গীত শিল্পীর সাক্ষাৎকার চলছে। ওঁর গানের আমরাও খুব ভক্ত। শুনছি।
হঠাৎ দেখি, গান গাওয়ার মাঝে ভদ্রলোক বলছেন, ‘‘জানেন, এক বার মান্নাবাবুও আমাকে বলেছিলেন, ‘আমার বয়স যদি ছোট হত, আমি আপনার কাছে গান শিখতে যেতাম।’’’
চমকে কাকুর দিকে তাকালাম। কাকু দেখলাম মুহূর্তে কেমন পাল্টে গেছেন। চোখ-কপাল কুঁচকোনো। কালো হয়ে গেছে মুখটা। কেমন যেন স্তম্ভিত!
একটু ক্ষণ বাদে বিড় বিড় করে বলে উঠলেন, ‘‘এই কথাটা ও এমন করে পাবলিকলি বলে দিল! দুর্বল মুহূর্তে যে কথাটা বলেছিলাম, সেটার এ ভাবে সুযোগ নিল? তাকেই এনক্যাশ করল!’’
কাকুর চোখ দিয়ে টস টস করে জল পড়তে লাগল। আমি সান্ত্বনা দিতে কী একটা বলতে যাচ্ছিলাম।
ধমক দিয়ে থামিয়ে দিলেন সেজকাকু, ‘‘শোনো, আমায় বোঝাতে এসো না তো! একজন মানুষের ঔদার্যের সুযোগ নেওয়াটা...ছি ছি ছি! ও তো শুধু আমায় ছোট করল না, আমার হাজার হাজার শ্রোতাকেও অপমান করল। ছিঃ!’’
কাঁদছেন আর বলে চলেছেন।
‘‘আমি কোনও দিন বলতে গেছি, আমাকে উস্তাদ বিলায়েৎ খান বলেছিলেন, ‘আপনি যদি ক্লাসিকাল গাইতেন, অনেকের ছুটি হয়ে যেত!’ কোনও দিন বলেছি, উস্তাদ বড়ে গুলাম আলি খান বলেছিলেন, ‘তিন-সাড়ে তিন মিনিট মে আপ ক্যায়সে ইতনা আচ্ছা ক্লাসিকাল গাতে হো, সমঝ নেহি আতা!’ কোনও দিন বলেছি?’’
আমি জানতাম, আমরা কয়েকজন কাছের লোক জানি, অল্প সময়ের মধ্যে কাকুর গান তুলে ফেলা, ঝট করে নোটেশন করে ফেলার বিরল ক্ষমতা দেখে চমকে গিয়েছিলেন পণ্ডিত রবিশঙ্করও। প্রায় একই কথা বলেছিলেন  তিনিও। কিন্তু কোনও দিন সে সব লোকসমক্ষে বলতেন না কাকু।
এগুলো তিনি আশীর্বাদ বলে ধরতেন। এক গুণী মানুষের উদার মানসিকতার প্রকাশ বলে মানতেন।
ভাবতেন, যাঁদেরকে এমন করে তিনিও বলে ফেলেন, তাঁরাও এ ভাবেই যেন ভাবেন। এমন করেই যেন মানেন।
সে দিন সেই বিশ্বাস চুরমার হয়ে যেতে দেখে নিজেও যেন ভেতরে-ভেতরে খান খান হয়ে গিয়েছিলেন।
গানজগতে কাকুর অপমানের গল্প অনেক শুনেছি। এখনই যেমন মনে পড়ছে, ‘চোরি চোরি’ ফিল্মের কথা।
‘ইয়ে রাত ভিগি ভিগি’ গানের রেকর্ডিং। নির্দেশক রাজকপূর ওঁর পছন্দের গায়ক মুকেশকে ছেড়ে কিছুতেই কাকুকে দিয়ে গাওয়াবেন না। জোরজার করে শঙ্কর-জয়কিষেণ রাজি করিয়েছেন ওঁকে।
প্রযোজক একজন পাঞ্জাবি ভদ্রলোক। রেকর্ডিং-এ এসে তিনি কাকুর নাম শুনে প্রায় হুঙ্কার দিয়ে বসলেন, ‘‘ক্যায়া? মান্না দে? বাঙ্গালি বাবু?’’
সপরিবার
একমাত্র পাশে ছিলেন তখন লতা মঙ্গেশকর। কানের কাছে ফিসফিস করে তিনি শুধু বলেছিলেন, ‘‘এক দম রাগ করবেন না। এমন ভাবে গাইবেন, যাতে ওঁদের ভুল ভেঙে যায়।’’
তার পরের ঘটনা তো ইতিহাস।
এতটা না হোক, প্রথম বার উত্তমকুমারের লিপে গান গাওয়ার সময়ও তো অস্বস্তির ঘটনা ঘটে।
ছবির নাম ‘শঙ্খবেলা’। দুটি গান— ‘কে প্রথম কাছে এসেছি’, আর ‘আমি আগন্তুক আমি বার্তা দিলাম’।
উত্তমকুমারও গোড়ায় রাজি ছিলেন না সেজকাকুকে দিয়ে গাওয়াতে। সুরকার সুধীন দাশগুপ্তকে অনেকে বলেছিলেন, ‘‘আরে কে এই মান্না দে মশাই? ও তো কুস্তি করে। রোম্যান্টিক গান কী গাইবে? তাও আবার উত্তমকুমারের গলায়! ছবির বারোটা বেজে যাবে।’’
গানজীবনে এমন ঘটনা কমবেশি অনেকেরই আছে। কিন্তু সে দিন, ওই টিভি-র ব্যাপারটা যেন সম্পূর্ণ অন্য ধাঁচের।
সে দিনের মতো কাকাকে অতটা বিচলিত হতে আর কবে দেখেছি, মনে পড়ে না।
রবীন্দ্রসদনে কৃষ্ণচন্দ্র দে-র ছবির সামনে।ছবি: হীরেন সিংহ
এক্কেবারে উল্টো মেরুর একটা ঘটনা বলি।
‘হারমোনিয়াম’ ছবির কাজে হাত দিয়েছেন তপন সিংহ। মিউজিক ডিরেক্টর তিনিই। কাকুর কাছে এসেছেন গান নিয়ে।
কাকু বললেন, ‘‘গানটা করুন তো একটু,’’ শুনে তপন সিংহ তো মহা অস্বস্তিতে, ‘‘আপনার সামনে আমি গানটা কী করে গাইব!’’
কাকু বললেন, ‘‘আহা করুন না, গুন গুন করে করুন। তাতেই হবে। সুরটা তো আপনার। আমি ভাবটা একটু বুঝতে চাই। একটু না শুনলে...।’’
অমন একজন শিল্পী, এতটা আন্তরিক ভাবে অনুরোধ করছেন, এর পর আর তপন সিংহ ‘না’ করেননি। জড়তা কাটিয়ে গান শুনিয়েছিলেন মান্না দে’কে। এতটাই শ্রদ্ধাবোধ ছিল পরস্পরের।
এ ভাবেই তৈরি হয়েছিল এক বিখ্যাত বাংলা গান, ‘ময়নামতীর পথের ধারে দেখা হয়েছিল’।
আরেক বারের ঘটনা যেমন।
রবীন্দ্রনাথের ১২৫ বছর। রবীন্দ্রসঙ্গীতের লং প্লেইং বেরোবে। সুচিত্রা মিত্রের তত্ত্বাবধানে। তাতে সেজকাকুও আছেন।
এ দিকে নিজের গান কিছুতেই মনমতো হচ্ছে না। সুচিত্রা মিত্রকে বললেন, ‘‘হচ্ছে না, হচ্ছে না। ‘কেন আমায় পাগল করে যাস’ ...। একটা কনফিউশন লাগছে।’’
সুচিত্রা মিত্র শুনে বলেছিলেন, ‘‘শুনুন, আপনার মতো করে গাইবেন তো! আপনি যে ভাবে রবীন্দ্রনাথের গান গাইতে পারেন, অনেক রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পীও তা পারবেন না। আপনার ‘না চাহিলে যারে পাওয়া যায়’ তো একটা দৃষ্টান্ত হয়ে আছে।’’
এতটাই শ্রদ্ধাবোধ ছিল ওঁদের মধ্যেও।
গানের ব্যাপারে সেজকাকুর খুঁতখুঁতানি যে কী প্রচণ্ড ছিল! হেমন্তকাকুর (মুখোপাধ্যায়) একটা ঘটনা বলি।
কোনও একটা ছবির রেকর্ডিং। হেমন্তকাকু মিউজিক ডিরেক্টর। মুম্বই থেকে দমদম এয়ারপোর্টে নেমে সোজা এইচএমভি-তে চলে গেলেন কাকু। রেকর্ডিং রুমে বসেই গান তুলছেন। গাইছেন। বেশ কিছুক্ষণ চলার পর সেজকাকু বললেন, ‘‘চলুন এ বার রেকর্ডিং করি।’’
হেমন্তকাকু বললেন, ‘‘গানটা আমার নেওয়া হয়ে গেছে।’’
‘‘মানে? কী বলছেন আপনি? আমার তো গলাই গরম হয়নি এখনও!’’
হেমন্তকাকু জানতেন, এই সব ব্যাপারে ওঁকে বুঝিয়ে কোনও লাভ নেই। ফলে হেসে বললেন, ‘‘ঠিক আছে, আবার করুন তবে।’’
শুধু সাউন্ড-রেকর্ডিস্টকে বলে দিলেন, ‘‘উনি যা খুশি করুন। আমি কিন্তু প্রথম টেক-টাই নেব।’’
শুধু খুঁতখুঁতানি নয়, আরেকটা অদ্ভুত স্বভাব ছিল সেজকাকুর। হঠাৎ হঠাৎ দেখতাম, রেডিয়ো খুলে চুপচাপ বসে গান শুনছেন। হয়তো অত্যন্ত মামুলি একজন লোকশিল্পী। সুরের লয়ের বালাই নেই, কিন্তু মন দিয়ে শুনে চলেছেন সেজকাকু।
হাবেভাবে যদি বুঝতে পারতেন, আমাদের অদ্ভুত লাগছে ব্যাপারটা। বলতেন, ‘‘শোনা, গমকটা খেয়াল করো। দেখো, গান যদি ভাল করে শিখতে চাও, কাউকে তুচ্ছ কোরো না। মন দিয়ে শুনবে, দেখবে, অনেকের মধ্যেই শেখার মতো কত কিছু পেয়ে যাবে।’’
কাকুর এই ব্যাপারটা এক্কেবারে আমার দাদুর থেকে পাওয়া।
দাদুর একটা ঘটনা যেমন, আমার শোনা। দাদুর তখন কীর্তন শিল্পী হিসেবে বাংলাজোড়া নাম। তেমনই এক সময়ে প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়ে কোনও এক বংশীধারী চট্টোপাধ্যায়ের গান শুনে উনি এতটাই অভিভূত হয়ে পড়েন যে, তাঁকে সঙ্গে সঙ্গে ডেকে পাঠান। বলেন, ‘‘আহা কী অপূর্ব আপনার গলা! আপনি আমায় গান শেখাবেন?’’
বংশীধারী বিলক্ষণ চিনে ছিলেন কৃষ্ণচন্দ্র দে’কে। তাঁর মুখে অমন কথা শুনে তিনি তো আকাশ থেকে পড়েন আর কী! তবু দাদুর জোরাজুরিতে তাঁকে গান শেখাতেই হয়েছিল।
ঠিক এই স্বভাবটা কাকুও পেয়েছিল। গানের ক্ষেত্রে এমন গল্প সেজকাকুর যে কত আছে!
একটা ঘটনা বলি।
সে বার কলকাতার বাইরে জলসা। রাতের অনুষ্ঠান শেষে সবাই ঠিক করলেন, এই মাঝরাতে ফিরলে সমস্যা হতে পারে। আলো ফুটলে তবে বেরনো হবে।
এ দিকে তখনও ভোর হতে প্রায় ঘণ্টা দুই দেরি। এখন সময়টা কী করে কাটবে? ঠিক হল, একটু গানবাজনা হোক।
কে গাইবেন?
কেন, ভ্যাকাদা আছে যে সঙ্গে!
ভ্যাকাদা, মানে রবীন গঙ্গোপাধ্যায়, কাকার ইউনিটেরই একজন। এক সময় দেবব্রত বিশ্বাসের কাছে গান শিখতেন। সে চর্চা তো কবে ছেড়েছেন! ফলে গলায় মরচে ধরেছে। তবু সকলের জোরাজুরিতে তিনিই গান ধরলেন। রবীন্দ্রসঙ্গীত।
কিছুক্ষণ বাদে সবাই দেখলেন, সেজকাকু বিভোর হয়ে পড়েছেন গানে। আর হাপুস নয়নে কেঁদে চলেছেন।
গানের শরীরে উনি যে কী পেতেন, কে জানে! গান ওঁকে এতটাই ভাসিয়ে দিত বারে বারে।
সুরকার-গীতিকারের ক্ষেত্রেও এমনটা হয়েছে। নাম শোনেননি। গানটা দেখেছেন শুধু। ভাল লেগেছে। গেয়েছেন।
দু’জনের কথা বলতে পারি।
জহর মজুমদার আর মুক্তি রায়চৌধুরী। প্রথম জনের লেখা ‘সবাই তো সুখী হতে চায়’। দ্বিতীয় জনের লেখা ‘খুব জানতে ইচ্ছে করে’।
দুটোই আজও কাকার হিট গানের লিস্টে প়ড়ে। কিন্তু যখন রেকর্ড করছেন গান দুটি, কে চিনত ওঁদের!
নতুন গায়ক-গায়িকাদের ক্ষেত্রেও এমনটা বার বার হয়েছে। এ নিয়ে আরতি মুখোপাধ্যায়, হৈমন্তী শুক্লা কী কবিতা কৃষ্ণমূর্তিদের কথা অনেকেই জানেন। বলেনও।
আমি বলব পিন্টু ভট্টাচার্যর কথা।
পুলককাকু একবার পিন্টু ভট্টাচার্যকে আনলেন। বললেন, ‘‘এ বার যদি পুজোয় আপনি সুর করে না দেন, ওর হয়তো গানই করা হবে না।’’
সেজকাকুর খুব যে ইচ্ছে ছিল, তা নয়। তার চেয়েও বড় কথা, সময়ও যে ছিল তা’ও নয়, কিন্তু কাকা কী যে দেখেছিলেন তরুণ গায়কের কাতর দুই চোখে!
যত্ন করে সুর করে দিয়েছিলেন দুটি গানের—‘বুকেতে আগুন জ্বেলে’ আর ‘তোমার ওই সুন্দর মুখ’।
আমার কেন জানি মনে  হয়, গানকে এ ভাবে নিতেন বলেই সেজকাকু হয়তো এতটা দরদি, এতটা মরমি হতে পেরেছেন। শ্রোতাকে এতটাই স্পর্শ করতে পারতেন এই কারণেই।
নাগপুরে এক বিপত্নীকের কথা জানি। ভদ্রলোকের স্ত্রীর মৃত্যুকালে একমাত্র অবলম্বন ছিল আমার কাকার গান।
ওঁর মৃত্যুর পর ভদ্রলোক সারা রাত জেগে বসে তাঁর মৃত স্ত্রীর উদ্দেশ্যে একটা একটা করে গান শুনিয়ে যেতেন, কাকার। সেটাই ছিল তাঁর সেই মুহূর্তের একমাত্র সান্ত্বনা! 

গান দিয়ে সেজকাকু কেমন যেন সম্মোহন করতে পারতেন শ্রোতাকে।
এ নিয়ে একটা অদ্ভুত অভিজ্ঞতার কথা বলি।
প্রায়ই কাকুর অনেক অনুষ্ঠানে যেতাম ওঁর গান শুনতে।
সে বার বঙ্গ সংস্কৃতি সম্মেলন মার্কাস স্কোয়্যার থেকে সরে গিয়ে ময়দানে হচ্ছে।
আমি গিয়েছি। দেখি এত্ত ভিড় যে, ঘের দেওয়া বাঁশের খুটি থেকেও লোক ঝুলছে।
কাকা গাইছেন। তবলায় রাধাকান্ত নন্দী। অ্যাকোর্ডিয়ানে ওয়াই এস মুলকি। খোকন মুখোপাধ্যায় স্প্যানিশে। টোপাদা, মানে অমর দত্ত পার্কাশানে। সবে পাঁচ-সাতটা গান হয়েছে, হঠাৎ দেখা গেল দূরে আগুন।
আতঙ্কিত দর্শকদের মধ্যে অল্পস্বল্প ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়ে গেল। হাজার হাজার লোকের ভিড়। এ বার যদি ছোটাছুটি হয়, তো কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। এর-ওর পায়ের চাপে পড়েই মারা যেতে পারে অনেকে।
এই বার দেখলাম কাকুকে!
কী একটা গান গাইছিলেন। মহূর্তে সে-গান থামিয়ে দিয়ে গাইতে লাগলেন, ‘‘আ-গু-ন..... লেগেছে লেগেছে লেগেছে লেগেছে আগুন....।’’
মাঝে একটু থেমে কেবল ছোট্ট ঘোষণা, ‘‘আতঙ্কিত হবেন না। আগুন কন্ট্রোলে চলে আসবে। আপনারা দৌড়াদৌড়ি না করে গান শুনে যান শুধু।’’
গান শুরু হল। একটু পরে আগুনও নিয়ন্ত্রণে এসে গেল। শ্রোতারা ততক্ষণে সম্মোহিত হয়ে পড়েছেন গানের আগুনে।
সে দিন কাকুর উপস্থিত বুদ্ধি, সাহস আর আত্মবিশ্বাস দেখে পুরো অভিভূত হয়ে গিয়েছিলাম।

আমি এক বার তেড়ে বকুনি খেয়েছিলাম সেজকাকুর কাছে। সেও গানের জন্যই।
সে এক কাণ্ড!
তিন মাস কথাই বন্ধ করে দিয়েছিলেন। কী দমবন্ধ করা সময় গেছে তখন আমার!
ঘটনাটা বলার আগে ছোট্ট একটা মুখড়া লাগে।
ইস্কুলে যখন ভর্তি হলাম, তখন দেখতাম, সবাই আমায় খুব পাত্তা দেয়। একটাই কারণ, আমি মান্না দে’র ভাইপো।
আমাদের বাড়ি তো পুরো গানের। দাদু, কাকা তো আছেনই, আমার বাবা, প্রণব দে’ও ছিলেন নিউ থিয়েটার্স স্টুডিয়ো টু-র মিউজিক ডিরেক্টর। বাবা অনেক সিনেমাতেও সুর দিয়েছেন।
বাড়িতে সর্বক্ষণ গান আর গান। সেই শোনা গানগুলোই ইস্কুলে গাইতাম। যখন ক্লাস টেনে উঠি, স্কুলেরই একটা অনুষ্ঠানে আমাকে গান গাওয়ানোর জন্য আমাদের এক শিক্ষক মশাই বাড়িতে এলেন। আমার ছোট কাকা প্রভাস দে’র সঙ্গে দেখা। বললেন সব। সুবিধে করতে পারলেন না। মাস্টারমশাই আসার কারণ শুনে বাবাও পরে বলেছিলেন, ‘‘ওর দ্বারা গানবাজনা হবে না।’’
সেজকাকু শুধু বলেছিলেন, ‘‘এখন নয়, মাধ্যমিকে ফার্স্ট ডিভিশন পেলে তবে গান শিখো।’’
তো, সেই মাধ্যমিকের পরই আমার গান শেখার শুরু। প্রথমে বাবার কাছে। পরে আমাদের ঘরানা মতে একজন তারযন্ত্রীর কাছে।
কাকুরই পরামর্শে আমি যখন সারেঙ্গিবাদক পণ্ডিত মহেশপ্রসাদ মিশ্রর কাছে শিখতে শুরু করি টিউশন ফি-টা পর্যন্ত কাকুই দিতেন। প্রথম দিনই কেবল কাকু বলে দিয়েছিলেন, ‘‘শিখছ, শেখো, কিন্তু ডোন্ট এক্সপেক্ট এনি কমার্শিয়াল হেল্প ফ্রম মি, নেভার।’’
তো, এক বার কাকারই জনপ্রিয় কিছু হিন্দি গান অনুবাদ করলেন পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়। লাগা চুনরি মে দাগ, জিন্দেগি ক্যায়সি হ্যায় পহেলি, কাসমে ওয়াদে...। এইচএমভি থেকে আমায় ডাকা হল গাইতে।
সেজকাকুর কোনও অনুমতি নিলাম না। ভয়ে ভয়ে গাইতে চলে গেলাম। এ দিকে পুলককাকু রেকর্ডিং শুনে কাকুকে বলে বসলেন, ‘‘ও বেশ ভাল গেয়েছে কিন্তু!’’
ব্যস, আমায় শুধু মারতে বাকি রেখেছিলেন সেজকাকু।—‘‘কী ভেবেছ কী? গান গেয়ে দিলেই হল! জানো, ওই গানগুলো কতটা সিচ্যুয়েশনের সঙ্গে মিল রেখে, কত কষ্ট করে তৈরি? আর পুলকবাবু ‘লাগা চুনরি’-কে ‘রাঙা আঁচলের দাগ’ বলে অনুবাদ করে দিল, আর তুমি গেয়ে দিলে?’’
আমি ভয়ে থর থর করে কাঁপছি। কাকু সেই যে কথা বন্ধ করে দিলেন, তিন মাস কথা বলেননি।
তিন মাস বাদে আমি যখন প্রায় পায়ে ধরে ক্ষমা চাইলাম, তখন ওঁর রাগ পড়ল।
সে দিন বুঝেছিলাম, আরও বেশি করে বুঝেছিলাম, গান সেজকাকুর কাছে কতটা ঈশ্বরতুল্য!
এখানে একটা কথা বলি, কাকু কোনও দিনই নিজের গানের রিমেক পছন্দ করতেন না।
হৈমন্তীদির (শুক্ল) একটা ঘটনা বলে লেখা শেষ করব।
সেজকাকু আর হৈমন্তীদি কলকাতার বাইরে কোনও একটা অনুষ্ঠানে যাচ্ছেন।
কাকুর গাড়িটা সামনে।
হৈমন্তীদির গাড়ি পিছনে।
হঠাৎ হৈমন্তীদি দেখেন, কাকুর গাড়ি পাক খেতে খেতে রাস্তার ধারে একটা পুকুরে পড়ে গেল!
হইহই করে উঠলেন সবাই। লোকজন। চিৎকার-চেঁচামেচি।
ওঁদের সঙ্গে ছিলেন একজন।
দেখতে না দেখতে তিনি মুহূর্তের মধ্যে ঝাঁপ দিলেন জলে।
জল বিশেষ নেই। কাদাই বেশি। তাতে কাকুর গাড়িটা গেছে আটকে।
কোনও ক্রমে তার থেকে ওঁকে পাঁজাকোলা করে উদ্ধার করা হল। পাড়ের উপরে তুলে দেখা দেখা গেল, চোট-আঘাত তেমন লাগেনি।
ধীরে ধীরে হৈমন্তীদির গাড়িতে বসিয়ে দেওয়া হল ওঁকে। পাশে বসে হৈমন্তীদি। তিনি তখনও ভয়ে জড়সড় হয়ে থর থর করে কাঁপছেন।
একটু হাঁফ ছেড়ে কাকু প্রথম কথা বললেন, ‘‘তোমার গাড়িতে গান আছে? একটু চালিয়ে দাও তো!’’
গান চালিয়ে দেওয়া হল।
আরেকটু বাদে বললেন, ‘‘মাঝে থানায় একটা খবর দিয়ে সোজা ফাংশানে চলে যাব। নইলে ওঁরা যে অসুবিধেয় পড়ে যাবেন।’’
এই ছিলেন আমার কাকু।
আপনাদের মান্না দে।
গানের কাছে যাঁর জীবনটা ছিল বাঁধা। সুরই ছিল যাঁর জিয়নকাঠি।


http://www.anandabazar.com/supplementary/patrika/9-madan-ghosh-lane-1.373496

তুমি একটু কেবল বসতে দিয়ো কাছে...(On Manna Dey)


$image.name

তুমি একটু কেবল বসতে দিয়ো কাছে...

৩০ এপ্রিল, ২০১৬, ০২:১৬:৪২
Manna de

ছবি: রথজিৎ ধটক

রবীন্দ্রসঙ্গীত না থাকলে কী যে হত আমার!
মান্নাদা প্রায়ই বলতেন কথাটা। প্রথম যে দিন বলেছিলেন প্রচণ্ড অবাক হয়েছিলাম শুনে। কিন্তু নেপথ্যের গল্পটা ভুলতে পারিনি।
সুচিত্রা মিত্রের সঙ্গে এইচএমভি-তে কাজ ছিল। সকালে গিয়েই সুচিত্রাদিকে বললাম, ‘‘আজ একটু আগে শেষ করব দিদি।’’
পরিচিত ঢঙে সুচিত্রাদি বললেন, ‘‘কেন, খেপ আছে বুঝি?’’
বললাম, ‘‘না, না মান্নাদা এসেছেন কলকাতায়।’’
—মান্না এখানে নাকি? ও বেশ এখনও চালিয়ে যাচ্ছে, না! অসম্ভব মনের জোর। কুস্তি-টুস্তি করত তো। তার জন্যই পারছে। যত দিন পারে তত দিনই ভাল। কত কাল কথা হয় না ওর সঙ্গে!
ফোনে ধরিয়ে দিয়েছিলাম মান্নাদাকে। দু’জনে টানা এমন করে কথা বলছিলেন মনে হচ্ছিল, দু’জন শিশু আলাপ করছে!
মান্নাদার বাড়িতে গিয়ে দেখলাম, সুচিত্রদির সঙ্গে কথা বলার রেশটা তখনও আছে। এর পরই কথায় কথায় রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে ওঁর অমন একটা মন্তব্য।
অবাক হয়ে বললাম, ‘‘মানে?’’
হাসতে হাসতে বললেন, ‘‘আরে আমি তো ৯ নম্বর মদন ঘোষ লেনের প্রোডাক্ট। ঘষে মেজে আজকের আমি হয়েছি। রবীন্দ্রসঙ্গীত না থাকলে কি হত?’’
এ বারেও আদ্যোপ্রান্ত কিছু বুঝলাম না। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছি।
মান্নাদা বলে চললেন, ‘‘বম্বেতে তখন ‘ইন্ডিয়ান কালচার লিগ’ নামের একটা সংস্থা ছিল। ভারতের প্রায় সব ভাষার লোকেদের নিয়ে তৈরি সংগঠন। ওরা নানারকম কালচারাল অনুষ্ঠান করত। একবার ঠিক করল, রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রোগ্রাম করবে। তো, আমায় দায়িত্ব দিল, নানা রকম ভাষাভাষী লোকদের রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখাবার। নিলাম দায়িত্ব। দিন কতক পরে বলল, মালয়ালি এক গায়িকার সঙ্গে ডুয়েট গাইতে হবে। আমি তো শুনে থ! মালয়ালি? রবীন্দ্রসঙ্গীত? ওরা কিছুতেই ছাড়বে না। বাধ্য হলাম রাজি হতে। রিহার্সালে গিয়ে দেখি, একটি সুন্দরী মেয়ে মাথা নিচু করে বসে আছে। নাম জিজ্ঞেস করতে বলল, সুলোচনা কুমারন।’’
পরে যিনি সুলোচনা দে হয়ে মান্নাদার জীবনে এসেছিলেন।
সেই ওঁদের প্রথম দেখা।
মান্নাদা বলেছিলেন, ‘‘প্রথম দিনই আলাপ করে মনে হয়েছিল, ও যেন অনেক কালের চেনা। নতুন কেউ নয়।’’
অনুষ্ঠানে ডুয়েট গেয়েছিলেন ‘আমি তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ সুরের বাঁধনে’।
এর পর আর শুধু সুরে নয়, জীবনেও বাঁধা পড়লেন তাঁরা। ১৯৫৩-র ১৮ ডিসেম্বর। যার সূত্রটা যে রবীন্দ্রসঙ্গীত, বারবার তা মজা করে বলতেন।
যাঁদের ভালবাসতেন মান্নাদা, তাঁদের সঙ্গে কথাবার্তায় বেশ খোলামেলা থাকতেন।
এমনকী সেটা বিবাহ-পূর্ব জীবনে প্রেম নিয়েও। এবং আশ্চর্য সেখানেও জুড়ে ছিল রবীন্দ্র-প্রসঙ্গ!
মান্নাদা বলেছিলেন, ‘‘কথার থেকে আমাদের গানই বেশি হত। আমরা দু’জনেই ছিলাম রবীন্দ্রানুরাগী। ও একের পর এক রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইত। আমার কাছে গান শুনতে চাইলে আমি বেশির ভাগ সময় রবীন্দ্রসঙ্গীতই গাইতাম। কখনও কখনও কাকার গান বা শচীনকর্তার। কিন্তু মুশকিল হত কী, ও আমার কাছে প্রায়ই ‘কেটেছে একেলা বিরহের বেলা’ গানটা শুনতে চাইত, আমিও গাইতাম। আর যখনই ‘সব পথ এসে মিলে গেল শেষে তোমার দুখানি নয়নে’ লাইনটা আসত, ব্যস... কোথায় চলে যেত তখন আমার গান! সুর হারিয়ে যেত। ওর দুটো চোখেই যেন থমকে যেত আমার সব সুর।’’
ম্লান হেসে বলতেন, ‘‘ওহ্ দোজ্ ওয়্যার দ্য ডেজ্, রিয়্যালি!... সুলু তো আমার জীবনের অনেক গানেই কোনও না কোনও ভাবে এসেছে। আর রবীন্দ্রনাথের গান সুলুকে না ভেবে গাইব কী করে! যেমন ধরো, ‘ওগো স্বপ্নস্বরূপিণী...।’’ মান্নাদার গলা আবেগে ধরে এল।
সুচিত্রা মিত্রর সঙ্গে মান্নাদার নিবিড় সম্পর্কর কথা বললাম। আরেক জনের কথা মনে পড়ছে। শান্তিদেব ঘোষ। তিনিও মূলত রবীন্দ্র-গানেরই শিল্পী।
মিউজিক ভিডিয়ো-র শ্যুটিং-এ
তবে ঘটনাটি রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে নয়। ছবির গান। ‘ওগো তোমার শেষ বিচারের আশায়’। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিখ্যাত উপন্যাসের চিত্ররূপ ‘ডাক হরকরা’ সিনেমায়। গানটিও তারাশঙ্করের লেখা।
সিনেমায় এই গানটি ছিল শান্তিদেবের লিপে। উনি বাউল সেজে গাইতে গাইতে যাচ্ছেন।
ছবির নেপথ্যে ওঁরই গাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সুরকার সুধীন দাশগুপ্ত সুর করে বললেন, ‘‘না না এ গান মান্নাদাই গাইবে।’’
এ দিকে আবার শান্তিদেবের খুব ইচ্ছে, উনিই গানটি গাইবেন। শেষে সুধীনবাবু দু’জনকেই নিয়েই বসলেন। মান্নাদাকে বললেন, ‘‘আপনি এক বার গানটা ধরুন।’’
গাইলেন মান্নাদা। আর গানটি শেষ হওয়ার পর শান্তিদেব নিজের থেকেই বলে উঠলেন, ‘‘না না, এ গান মান্নাবাবুরই গাওয়া উচিত। উনি চমৎকার গাইলেন।’’
আজও ঘটনাটা মনে পড়লে ভাবি, কী সব দিন ছিল!

রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে মান্নাদার যে কী অসম্ভব কাতরতা কাজ করত!
একবারের কথা বলি।
বাড়িতে বসে গানের কথাই হচ্ছিল। হঠাৎ বললেন, ‘‘আচ্ছা, মানুষটা এত সহজ করে এত এত সব কঠিন অনুভূতি কী ভাবে লিখলেন বলো তো? দেখো, এই যে গানটা, ‘তুমি যারে জানো সে যে কেহ নয়, কেহ নয়, পাও নাই পাও নাই পরিচয়, তুমি মোর পাও নাই পাও নাই পরিচয়’। এই যে ‘পরিচয়’ উনি বোঝাতে চেয়েছেন, এই সূক্ষ্ম পরিচিতির ক্রাইসিসে ভোগেনি এমন মানুষ কি আছেন? কিন্তু এই বিশেষ উপলব্ধি এত সহজে কেউ প্রকাশ করতে পেরেছেন? এ শুধুমাত্র ওঁর পক্ষেই সম্ভব। তার উপরে ওই সুর। আপাত সহজ সরল সুরের মধ্যে যে এত মাদকতা থাকতে পারে, তা রবিঠাকুরের গান না শুনলে বোঝাই যাবে না।’’
মাদকতা শব্দটা লিখতে গিয়েই আরও একটা ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল।
হিন্দি গান দিয়ে প্রফেশনাল জীবন শুরু হলেও বাংলা গানের প্রতি যে স্বাভাবিক ভাবেই একটা দুর্বলতা ছিল মান্নাদার, সেটা বলে দিতে লাগে না।
সময়টা মুম্বইয়ে মান্নাদা যাওয়ার গোড়ার পর্ব। মুম্বই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি তখন বাঙালিতে-বাঙালিতে ছেয়ে আছে। কিন্তু অবাঙালিদের কেউ কেউ মান্নাদার এই যে বাংলা গান বা রবীন্দ্রসঙ্গীত-প্রীতি, তাকে তির্যক চোখে দেখতেন।
মান্নাদা বলেছিলেন, ‘‘আমি ওদের কথায় কিছু বলতাম না, কিন্তু বাংলা গানের বা রবীন্দ্রসঙ্গীতের রস ওঁদের কী করে বোঝাব, মনে মনে শুধু সেই সুযোগটা খুঁজতাম।’’
তেমনই সুযোগ এসে গেল এক দিন। হিন্দি ছায়াছবির সর্বকালীন সেরাদের এক জুটি তাঁদের ছবির গান শেখাতে সে দিন মান্নাদার বাড়িতে এসেছেন।
কিছুক্ষণ গানবাজনা চলার পর মান্নাদা ওঁদের বাংলা গান শোনাতে শুরু করেন। ধীরে ধীরে রবীন্দ্রনাথের গানও।
এর পরের ঘটনা মান্নাদার কথাতেই বলি, ‘‘একটা করে গান শেষ হচ্ছে, আর ওঁরা দেখি, কেয়াবাত কেয়াবাত বলছে। এক সময় বলল, ‘কিসনে বানায়া দাদা ইয়ে ধুন?’ বললাম, ‘আরে শুনো তো প্যাহলে!’ একের পর এক রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে গাইতে যখন অনেকটা সময় চলে গেছে, আমি বললাম, ‘চলো, এ বার তোমাদের গান শোনাও।’ ওরা ততক্ষণে সুরের নেশায় প্রায় বুঁদ। বলল, ‘দাদা, যে গান আপনি শোনালেন, তার পর আর কোনও গান হয় না। এত সহজ সরল কমপোজিশন কে বানিয়েছেন দাদা?’ বললাম। বলল, ‘রবীন্দ্রনাথের নামটাই শুনেছিলাম,  তাঁর এ রকম সব কম্পোজিশন সত্যি জানতাম না। আজ বুঝছি, আপনি কেন এত বাংলা গানের কথা বলেন!’’
সে দিনের সেই স্বনামধন্য জুটি আর কেউ নন— শঙ্কর-জয়কিষেণ।
রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে মান্নাদার এই যে প্রীতি, এটা যখন প্রথম-প্রথম জানতে পেরেছিলাম, খুব অবাক হয়েছিলাম। কেবলই ভাবতাম, মানুষটার বেড়ে ওঠাটা তো কৃষ্ণচন্দ্র দে-র ধ্রুপদী ঘরানায়। তা হলে রবীন্দ্রগান তাঁকে কী করে পেল?
বলেই ফেলেছিলাম এক দিন।
উত্তর দিয়েছিলেন, ‘‘রবীন্দ্রনাথের গান পঙ্কজবাবুর গলায় শুনলে খুব ভাল লাগত। যখন স্কটিশে পড়তাম তখন ওঁর মতো করে গাইতে চেষ্টা করতাম।’’ বলেই গান শুরু করলেন, ‘‘আমার ভুবন তো আজ হল কাঙাল, কিছু তো নাই বাকি, ওগো নিঠুর, দেখতে পেলে তা কি!’’ গানটা শেষ হল, আর সঙ্গে সঙ্গে বললেন, ‘‘আহা কী কথা বলো তো!’’
এখানে একটা ব্যাপার বলি, কৃষ্ণচন্দ্র দে’র রবীন্দ্রগানের প্রীতিও কিন্তু মান্নাদা’র ওপর প্রভাব ফেলেছিল। পরে জীবনীতেও লিখেছেন সে কথা।
মান্নাদা বলতেন, ‘‘কাকা কিন্তু রবীন্দ্রসঙ্গীত খুব ভালবাসতেন। অসম্ভব দরাজ গলায় গাইতেনও। আজ যে আমার ‘না চাহিলে যারে পাওয়া যায়’ নিয়ে লোকে এত বলে, সেটাও কিন্তু আমার কাকারই দান। কাকার কাছে ও ভাবে কীর্তন না শিখলে আমি কখনও অমন করে গানটা গাইতে পারতাম না। তবে আমার পক্ষে কি কাকার মতো কীর্তন গান গাওয়া সম্ভব? নেভার। সেই সময়ে যাঁরা গীতিকার শৈলেন রায়, হেমেন্দ্র গুপ্ত, হেমেন্দ্রকুমার রায়, মোহিনী চৌধুরী... এঁদের প্রত্যেককে কাকা বলতেন, ‘আহা, রবীন্দ্রনাথের এই যে গানের ভাষা, শব্দপ্রয়োগ কী দুর্ধর্ষ বলোতো?’ শৈলেনদাকে তো কাকাই নর্থ বেঙ্গল থেকে আমাদের বাড়িতে এনে বিএ পাস করিয়েছিলেন। ওঁকে কাকা এক দিন বললেন, ‘শৈলেন যুক্তাক্ষর দিয়ে একটা গান লেখো তো।’ শৈলেনদা গাঁইগুঁই করছেন দেখে কাকা বলেছিলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ যদি পারেন, তুমি পারবে না কেন? চেষ্টা তো করো!’ শৈলেনদা কাকার এই কথার পরে লিখে ফেলেছিলেন, ‘যদি বন্ধুর রথ এল দ্বারে, প্রেমের পাত্র কেন উচ্ছ্বল হল রে, চক্ষের নির্ঝর ধারে।’ কাকা রবীন্দ্রসঙ্গীতের একটি রেকর্ডও করেন। যার এক দিকে ছিল— ‘আঁধার রাতে একলা পাগল যায় কেঁদে’, এবং অন্য পিঠে ছিল ‘আমার যাবার বেলায় পিছু ডাকে’। তখন রবীন্দ্রনাথ বেঁচে। শুনেছি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও ওই দুটি গানের খুবই প্রশংসা করেছিলেন। এমনকী তাঁর নিজের কাছে কাকার ওই দুটি গান ছিল।’’

কেবলই বলতেন, রবীন্দ্রসঙ্গীতের একটা টিপিক্যালিটি আছে, সেটা না বুঝলে খুব মুশকিল। খুব পছন্দ করতেন কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গান। বিশেষ করে উনি যে ভাবে মীড় লাগাতেন গানে। এক দিন ওঁরই অনুরোধে ‘দূরে কোথায় দূরে’ শোনানোর পর দেখি, দু’চোখ ভরা জল মান্নাদার চোখে।
পঙ্কজ মল্লিক, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় তো ভালবাসতেনই। তার সঙ্গে পাগলভক্ত ছিলেন দেবব্রত বিশ্বাসের।
বলতেন, ‘‘বেশির ভাগ বাঙালির মিন মিন করে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়া এক দম আমার পছন্দ নয়। ওই কথা, ওই সুর তাকে অমন ভাবে দাঁত চিপে চিপে কেন গাইবে বলো তো? পঙ্কজবাবু শোনো। দেবব্রত বিশ্বাস শোনো। আহা কী উদাত্ত গলায় গেয়েছেন বলো তো ওঁরা! এক দিন রাতে প্রোগ্রাম করে ফিরে শুতে যাওয়ার আগে রেডিয়ো খুলেছি। অ্যানাউন্সমেন্ট হল, রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইবেন দেবব্রত বিশ্বাস। তিনটে গান গেয়েছিলেন। শেষ গানটা ছিল, ‘পেয়েছি ছুটি, বিদায় দেহ ভাই’। শুনে আমি সারা রাত ঘুমোতে পারিনি। শুধু কেঁদেছিলাম।’’
অনেক পরে এই ‘পেয়েছি ছুটি...’ গানটা মান্নাদা নিজেই রেকর্ড করেন। তখন আবার আমি ছিলাম মিউজিক অ্যারেঞ্জার। গাইতে বসে এতটাই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলেন, প্রথম দিন রেকর্ডই করা গেল না।
পর দিন বললেন, ‘‘শোনো, অন্য সব গান হয়ে যাওয়ার পর ওই গানটা ধরব।’’ গাইতে গাইতে কত বার যে দেবব্রত বিশ্বাসের কথা বলেছিলেন! ওঁর গাওয়াটা এতটাই নাড়া দিয়েছিল ওঁকে।
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে ছবি: সমর দাস
এক বার জানতে চেয়েছিলাম, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের রবীন্দ্রসঙ্গীত  কেমন লাগে?
উত্তর দিয়েছিলেন, ‘‘হেমন্তবাবুর রবীন্দ্রনাথের গান বললেই মনে পড়ে, ওঁর গাওয়া ‘হে নিরুপমা’ আর ‘চলে যায় মরি হায়’। অপূর্ব! আর ভাল লাগে ওঁর গাওয়া রবীন্দ্র গীতিনাট্যের গানগুলো। বা, ওই যে, ‘চরণ ধরিতে’... কী গেয়েছিলেন। আমি পঙ্কজ মল্লিকের গলায় এ গান শুনেছি। তার পরও বলছি, হেমন্তবাবুও অসম্ভব ছুঁয়ে গেছেন আমায়। কিন্তু সাফল্যের তো কিছু নেগেটিভ দিক থাকে। অতিরিক্ত গাইতে হয়েছে বলে, বেশ কিছু গান ‘ম্যাটার অফ ফ্যাক্ট’-এর মতো গাইতে হয়েছে ওঁকে। নিজে শিল্পী বলে জানি, এ সব ক্ষেত্রে মনের সূক্ষতা কাজ করে না। তবে ওই রকম গায়ক বাংলায় আর আসবে কিনা কে জানে! কী ভয়েস!’’
এক বার বললেন, ‘‘আরেক জন আছেন না, সাদা শার্ট-সাদা প্যান্ট পরেন... চোখে চশমা!’’
বললাম, ‘‘সাগর সেন?’’
‘‘হ্যাঁ। প্রচণ্ড স্মার্ট ভয়েস। আমার খুব ভাল লাগে।’’
আরেক দিনের ঘটনা মনে পড়ছে।
মদন ঘোষ লেনের বাড়িতে গেছি। কথা বলছি মান্নাদা আর সুলুআন্টির সঙ্গে। সে দিনও রবীন্দ্রসঙ্গীতের কথা উঠলে বলছিলেন, ‘‘আমি কত রবীন্দ্রসঙ্গীত জানি জানো?’’
তা হলে এত কম রেকর্ড করলেন কেন?
‘‘আরে, রেকর্ড ছাড়ো। সে তো কোম্পানির ব্যাপার। আমি কোনও দিনও বলিনি, আমার গান রেকর্ড করো। আমার বয়ে গেছে। রবীন্দ্রনাথের গান আমি নিজের জন্য, তৃপ্তির জন্য গাই,’’ পাশে বসা সুলুআন্টিকে দেখিয়ে বললেন, ‘‘আমরা দু’জনে গাই।’’ বলেই শুরু করলেন, ‘স্বপনে দোঁহে ছিনু কী মোহে, জাগার বেলা হল।’’
মান্নাদা ইশারায় সুলুআন্টিও গলা মেলালেন। গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল। কী অনায়াস ভঙ্গিতে দু’জনে সুরের উজানে ভাসছিলেন!
সে এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা!
এতটাই রবীন্দ্র-প্রীতি ছিল ওঁদের।
তবে শুনেছি, সুলুআন্টি প্রথম-প্রথম তেমন একটা রবীন্দ্রনাথের গান গাইতে চাইতেন না। ভয় পেতেন। বলতেন, ‘‘সব কথার তো মানেটাই ঠিক বুঝতে পারি না। আমি কি পারব?’’
সাহসটা জুগিয়েছিলেন মান্নাদাই। বলতেন, ‘‘আমি তো আছি, বুঝিয়ে দেব।’’
বারবার অমন করে বলাতে সুলুআন্টির ভয়টা চলে গিয়েছিল। নিজের থেকেই তখন রবীন্দ্রনাথের গান করতেন। বলতে হত না। ভাল বেসেই গাইতেন।
মান্নাদা খুব চাইতেন, মেয়েরাও যেন রবীন্দ্রনাথের গান শেখে। গায়। চর্চা করে। সেখানে একটা খেদ থেকে গিয়েছিল ওঁর।
এক দিনের কথা বলি।
আড্ডার মাঝে মেয়েদের কথা উঠতে বললেন, ‘‘ওরা বম্বেতে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াশুনো করলেও ছোট থেকেই ওদের রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়ানোর চেষ্টা করতাম। প্রথমে শিখিয়েছিলাম, ‘হিমের রাতে ওই গগনের দীপগুলিরে’। আমার বড় মেয়ে যেমন এখনও কোনও কথা না বুঝতে পারলে আমেরিকা থেকে ফোন করে বলে, ড্যাডি এর মানে কী? ওর মানে কী? কিন্তু দুঃখ হয় ছোট মেয়েকে বললে, সে বলে ও সব বাংলা গান-টান নয়। আমি ইংরেজি গান করব। ওর গানটা হতে পারে ভেবে বলতাম, একটু লতার গানও গাও, যার গান তুমি অত ভালবাসো। একটু আমার গান গাও। আশার গান গাও। রফির গান করো। কথাটা শুনলে তো! ঘরে বসে ও এখন সব ইংরেজি গান করে। আমি দরজা বন্ধ করে শুয়ে থাকি। কী করব? মানুষের সব ইচ্ছে তো পূরণ হবার নয়।’’

হিন্দিতে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়া নিয়ে মান্নাদার গল্পটা বেশ ইন্টারেস্টিং লাগে।
সময়টা রবীন্দ্র-জন্মশতবার্ষিকীর। শতবার্ষিকী কমিটি মান্নাদাকে ডেকে পাঠাল। অনুরোধ হিন্দিতে রবীন্দ্রনাথের গান গাইবার।
তখনও সে ভাবে রবীন্দ্রনাথের গান হিন্দিতে অনুবাদ করা হয়নি। মান্নাদার প্রথমে একটু আপত্তিই ছিল।
ওঁর যুক্তি ছিল, রবীন্দ্রনাথের প্রত্যেকটি গানে একটা ভিতরের ভাব থাকে। শুধু ভাষাটা অনুবাদ করে দিলে সেই ভাবটা চলে যেতে পারে।
পঙ্কজ মল্লিক তখন বেঁচে। উনি আর কয়েকজন মিলে ভরসা দিলেন, ভয়ের কিছু নেই। ওঁরা একজনকে যোগাযোগ করেছেন, তিনি ঠিকঠাক অনুবাদ করে দিতে পারবেন।
ভদ্রলোককে মান্নাদার কাছে নিয়ে এলেন পঙ্কজ মল্লিক।
মান্নাদা তাঁকে বললেন, ‘‘আমি একটা গানের কয়েকটা লাইন বলছি—‘আমার চোখে যে চাওয়া খানি, ধোওয়া সে আঁখিলোরে, তোমারে আমি দেখিতে পাই, তুমি না পাও মোরে।’ এটার হিন্দি অনুবাদ করে দিন তো।’’
গানের ভাষা শুনে ভদ্রলোকের মুখটা পাংশু হয়ে গেল। শেষে হাল ছে়ড়ে দিয়ে বললেন, ‘‘দাদা, ইয়ে ক্যায়সা গানা হ্যায়? মুঝে তো লাগতা হ্যায় কি হিন্দিমে অ্যায়সা গানা ম্যায় কভি সোচভি নেহি সাকতা। আপ কোই দুসরা গানা বাতাইয়ে।’’
তবে তাই হোক।
মান্নাদা দ্বিতীয় গান বললেন,  ‘আমার এ পথ, তোমার পথের থেকে অনেক দূরে গেছে বেঁকে।’’
ভদ্রলোক এ বার খুব উৎসাহের সঙ্গে বললেন, ‘‘হাঁ জি, ইয়ে...হো জায়গা।’’
তার পর অনেক ঘেমেনেয়ে, দাঁত দিয়ে নখ খেয়ে, প্রচুর সময় নিয়ে বললেন, ‘‘হয়ে গেছে।’’
মান্নাদা বলেছিলেন, ‘‘সেই অনুবাদ দেখে আমার গান গাওয়ার ইচ্ছেটাই প্রায় চলে গেল। ওঁর লেখা কাগজটা হাতে নিয়ে দেখি লিখেছেন— ‘মেরি ইয়ে রাহ্ তেরি রাহ্ সে গ্যয়া মুড়কে বহুৎ দূর।’’’
যদিও পরে এই মান্নাদাই আবার হিন্দিতে রবীন্দ্রনাথের গান করেন।

মান্নাদার রবীন্দ্রগানে এমন একটা নাটকীয়তা কাজ করত, সামনাসামনি বসে সেটা উপলব্ধি করাটা ছিল এক অপার্থিব অভিজ্ঞতা।
একবারের ঘটনা বলি।
ওঁর কলকাতার বাড়ি। সন্ধে নেমেছে। গরমকাল। হাওয়াবাতাস পুরো থমকে আছে। লোডশেডিং হয়ে গেল। এমার্জেন্সির টিমটিমে আলোয় বসে আছি। সামনে মান্নাদা। হঠাৎই চড় চড় করে বাজ পড়ল। চমকে উঠলাম আমরা। বললেন, ‘‘কালবোশেখি শুরু হল বোধহয়। একটু বসে যাও। এখন বেরিয়ো না।’’
শুরু হল ঝমঝমে বৃষ্টি। সঙ্গে বিদ্যুৎ চমকানি। মান্নাদা গান করছিলেন গুন গুন করে। নানারকম গান। বললাম, ‘‘আপনার সেই গানটা কিন্তু এখনকার জন্য আইডিয়াল...।’’
মুহূর্তে বুঝে গেলেন, কোন গানের কথা বলছি। আর খোলা উদাত্ত গলায় গেয়ে উঠলেন, ‘‘বিদ্যুৎ চমকিয়া যায়... ক্ষণে ক্ষণে...শর্বরী শিহরিয়া উঠে, হায়....শ্রাবণের গগনের গায়...।’’
ওপাশে বৈশাখের খ্যাপা বৃষ্টিধোওয়া আকাশ। মাঝে মাঝে সাদা হয়ে যাচ্ছে আলোর ঝলকানিতে। ঝমঝমে শব্দ চিরে মিঠে হাওয়ায় তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে চারপাশ। আর ঘরে মান্নাদা’র ওই দামাল-রোম্যান্টিক গলা...বর্ষার যেন অকালবোধন দেখেছিলাম সে দিন।

২০০৯ সালের শেষ দিকের কথা।
মান্নাদা তখন আমেরিকায়।
ওখান থেকেই সুলুআন্টির অসুস্থতার খবর দিলেন। দিনে দিনে শরীর ভাঙছে। বোঝা যাচ্ছে, আর বোধ হয় বেশি সময় নেই। মান্নাদার মনের অবস্থাটা বুঝতে অসুবিধে হয়নি।
দেশে ফিরলেন ওঁরা। কথা হত ফোনে। বারবার মনে হত, নিজেকে মানসিক ভাবে শক্ত প্রমাণ করার খুব চেষ্টা করছেন, কিন্তু ভেতরে-ভেতরে কেমন যেন ভাঙন ধরেছে ওঁর। সুলুআন্টির অসুখের কষ্ট, তাঁর অতিনিকট ভবিতব্যকে মেনে নিতে পারছিলেন না কিছুতেই।
তার মধ্যেই এক দিন দেখা হতে বললেন, ‘‘আমি সুলুর জন্য দশটা রবীন্দ্রনাথের গান করব। দিন দশেক বাদে তোমায় ফোন করছি।’’
দশ দিন বাদে আমিই ফোন করলাম। বললেন, ‘‘হ্যাঁ করব। কিন্তু নো প্যানপ্যানানি। ওই যে তুমি একটা ছবির গান শুনিয়েছিলে না, সেরকম অ্যাপ্রোচ থাকবে।’’
এর আগের ঘটনাটা না বললে, মান্নাদার এই কথাটা বোঝা যাবে না।
সালটা এখন আর মনে নেই। সন্ধেবেলায় গেছি ওঁর সঙ্গে দেখা করতে। কলকাতার বাড়িতে।
কথায় কথায় বললেন, ‘‘আচ্ছা, ইদানীং তরুণবাবুর (মজুমদার) কী একটা ছবি না কি খুব ভাল হয়েছে? ওঁর ছবিতে তো রবীন্দ্রসঙ্গীত থাকেই। এই ছবিতেও নাকি সব রবীন্দ্রসঙ্গীত ব্যবহার করা হয়েছে। গান নাকি খুব চলছে?’’
বললাম, ‘‘হ্যাঁ, ছবিটার নাম ‘আলো’।’’
মান্নাদা বেঙ্গালুরু চলে যাওয়ার আগে ‘আলো’-র একটা সিডি দিয়ে বলেছিলাম, ‘‘সময় পেলে শুনে বলবেন কেমন লাগল?’’
দু’দিনের মধ্যে ফোন।
বললেন, ‘‘আমি তো সিডিটা শুনে ফেলেছি। রবীন্দ্রনাথের গান মানেই তো ঝিমানো ব্যাপার করে ফেলা হয়। তাতে গান গাওয়ার ইচ্ছেটা অনেক সময় মাটি হয়ে যায়। অথচ এখানে ঠিক তার উল্টো। এই অ্যাপ্রোচটাই ঠিক। এরকম না হলে নতুন প্রজন্ম ওঁর গান শুনবে না। ভাল কাজ হয়েছে। এই অ্যাপ্রোচেই রেকর্ড করব।’’
খুব ইচ্ছে ছিল রেকর্ডটা করার। কেবলই বলতেন, ‘‘আমার শুধু একটাই চাওয়া। গানগুলো শুনে সুলু যেন এই অবস্থাতেও একটু আনন্দ পায়। শান্তি পায়। স্বস্তি পায়। আমি আর কিছু চাই না।’’
নানা কারণে সে-রেকর্ড আর হয়ে উঠল না। সুলুআন্টির ম়ত্যুর পরেও তাঁকে নিয়ে আরেকটা অ্যালবামও যেমন তিনি করে যেতে পারেননি, ঠিক তেমনই। এই আফসোসগুলো আমার কিছুতেই যাবার নয়।
২০১৩-র ফেব্রুয়ারি। শেষবারের জন্য গিয়েছিলাম বেঙ্গালুরুর ঠিকানায়। শরীর ভেঙে গেছে। আর মন যেন শতছিন্ন। একটু কথা এগোলেই বারবার পুরনো কথায় ফিরে যাচ্ছিলেন। কেবলই ছল ছল করে উঠছিল চোখ।
তার মাঝেও অবধারিতভাবে উঠে এল রবীন্দ্রনাথের গানের প্রসঙ্গ। এক বার বললাম, ‘‘কোনও বিশেষ গানের কথা মনে পড়ে? ইচ্ছে করে গাইতে?’’
অপলক চেয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। চশমার আড়ালে ঘোলাটে চোখে তখন কত কত ছায়া!
ঠোঁটটা অল্প ফাঁক করে মান্নাদা অস্ফুটে বলে উঠলেন, ‘‘ওঁর প্রেমের গান আজও আমায় টানে...‘তুমি একটু কেবল বসতে দিয়ো কাছে... আমায় শুধু ক্ষণেক তরে... আজি হতে আমার যা-কিছু কাজ আছে, আমি সাঙ্গ করব পরে...।’’
গলাটা বুজে এল মান্নাদার।
ওঁর ওই ধরা-ধারা ক্লান্ত-শীর্ণ-শীতল স্বরটা আজও বাতাস হয়ে আমার চারপাশে চলে বেড়ায়।


http://www.anandabazar.com/supplementary/patrika/special-write-up-on-manna-de-on-his-birth-day-1.373509