আখতারি বাঈ এখনও ঝকঝকে স্মৃতি হয়ে ভাসেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের মনে।
‘‘কত বছর আগের কথা। অথচ মনে হয়, এই তো সে দিনের ঘটনা।”
মেগাফোন কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা জে এন ঘোয তখন অসুস্থ।
তাঁর প্রিয় ‘বড়িবাবা’-কে দেখতে এক সন্ধ্যায় গড়িয়াহাটের হিন্দুস্তান রোডের বাড়িতে এসেছিলেন বেগম আখতার।
‘‘সৌজন্য সাক্ষাৎকারের পরেই সবাইকে অবাক করে দিয়ে আখতারি বাঈ সে দিন গান গাইতে চাইলেন।’’
বছর দুই আগে মহাত্মা গাঁধী রোডে মেগাফোন রেকর্ড কোম্পানির অফিস ঘরে বসে সে দিনের স্মৃতিচারণ করছিলেন কর্ণধার অমলকুমার ঘোষ।
সম্পর্কে যিনি প্রয়াত জে এন ঘোষের ভাইপো এবং প্রয়াত ডি এন ঘোষের কনিষ্ঠ পুত্র।
বলছিলেন, ‘‘তখন আমার বয়স ১৮-২০।  কিন্তু আজও ভুলিনি গানবাজনার সেই আসর।’’
নিতান্তই ঘরোয়া এক আসর। কিন্তু তবলা আর তানপুরায় সঙ্গত করবেন কে?
তার ব্যবস্থাও হয়ে গেল। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ফিরে গেলেন ফেলে আসা দিনের টানে।
“আমি ছাড়া শ্যামল মিত্র আর সুরকার রবীন চট্টোপাধায়ও সে দিন হাজির সেখানে। দিদি (বেগম আখতার) আমাকে তানপুরা বাঁধতে বললেন। আমি বললাম, আমি তো তানপুরা বাঁধতে জানি না, ছাড়তে পারি।’’
শুনে তানপুরা হাতে ধরে বড় যত্ন করে বেঁধে দিয়েছিলেন বেগম আখতার। তার পরে নিজেই ধরলেন গজল। ‘‘আর আমিও মন দিলাম তানপুরায়”, দূরভাষে বলছিলেন সন্ধ্যা।
বেগম আখতারের গজলে সন্ধ্যার তানপুরার সঙ্গে সেই আসরে তবলা বাজিয়েছিলেন রাধাকান্ত নন্দী।
বেগমের অনুপম কণ্ঠে গাওয়া গজলের সুরে সুরে সে-দিন ভেসে গিয়েছিলেন উপস্থিত শ্রোতারা।
••••
দিল্লিতে সপ্রুহাউস। বেগম আখতারের গজল পরিবেশনের কথা বলছিলেন তাঁর শিষ্যা ঋতা গঙ্গোপাধ্যায়।
‘‘আম্মি’র গান শুনতে সে দিন দর্শকাসনে ভারতের রাষ্ট্রপতি জাকির হুসেন। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধী।’’
দর্শকদের কাছে ঋতাদেবীকে নিজের মেয়ে বলে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন বেগম আখতার।
গজল সম্রাজ্ঞীর সঙ্গে গজল গেয়ে সে দিন তিনিও প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রীর।
“লখনউ থেকে গান গাইতে এলে আখতারি বাঈ কোথায় বাস করতেন জানেন? আমাদের এই অফিস বাড়িরই একটি ঘরে,’’ বলছিলেন অমলবাবু।
অমলবাবু জানালেন, শুধু বেগম আখতারই নন, বড়ে গোলাম আলি, ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়-সহ সঙ্গীতের আরও অনেক দিকপাল বছরের পর বছর বাস করে গিয়েছেন সেই ঘরে।
এইচএমভি-র দমদম স্টুডিয়োয় তাঁকে খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন সাউন্ড রেকর্ডিস্ট এবং পরে ওই স্টুডিয়োর ম্যানেজার সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়।
চোখ বুজলে তিনিও যেন দেখতে পান গজল সম্রাজ্ঞীকে।
‘‘পরনে শাড়ি। ডান নাকে নীলরঙা হিরের নাকছাবি। আঙুলের ফাঁকে ধরা লম্বা  সিগারেট। বোধহয় ফাইভ ফিফটি ফাইভ-এর প্যাকেট কিনতেন। ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যে শেষ। পান চিবোতেনও খুব।’’
তবে কথাবার্তায় অসম্ভব সংযমী। তেমনই ব্যক্তিত্ব আর ব্যবহার।
মেগাফোন থেকে তাঁকে এইচএমভি-তে নিয়ে আসেন বিমান ঘোষ।
বেগম আখতারের কাছে গান শিখেছিলেন কলকাতার ধ্রুপদী গায়িকা প্রভাতী মুখোপাধ্যায়।
তাঁর স্মৃতিতেও চিরকালের মতোই আঁকা হয়ে আছে কিংবদন্তি গজল সম্রাজ্ঞীর এক উজ্জ্বল ছবি।
সাদা পোশাক। হাতে, কানে, নাকে হিরে-মানিকের জড়োয়া। আঙুলে লম্বা সিগারেট।
‘মা’-এর স্মৃতিচারণে এখনও চোখে জল এসে যায় প্রভাতীদেবীর।
‘‘খুব ছোট্টবেলায় রেডিয়োতে তাঁর গান শুনলে মনে হতো, রেডিয়ো থেকে উনি বেরিয়ে এলেই জড়িয়ে ধরব। স্বপ্নের সেই গায়িকার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল বালিগঞ্জ মিউজিক কনফারেন্সে। সে ’৬২ সালের কথা।’’
প্রভাতীদেবী তখন ‘অল ইন্ডিয়া আকাশবাণী’ গানের প্রতিযোগিতায় ক্লাসিকাল-সেমি-ক্লাসিকাল মিলিয়ে তিনটি ক্যাটেগরিতে সাতটি পুরস্কার পেয়েছিলেন। 
বেগম আখতারের সঙ্গে কথা হয়ে যাওয়ার পরেই গান শিখতে  মা-বাবার হাত ধরে প্রভাতী সোজা পৌঁছে যান লখনউয়ে তাঁর লালবাগের বাড়িতে।
‘‘তাঁকে ‘মা’ বলেই ডাকতাম। পুরনো একটা হারমোনিয়াম দিলেন আমাকে, শিখলাম মনপ্রাণ ঢেলে। পেলাম তাঁর সান্নিধ্য। সকাল ৮-৯টায় ঘুম থেকে উঠেই রেওয়াজ শুরু করে দিতেন। মেয়ের মতো করে আমাদের শেখাতেন।”
কণ্ঠস্বরে কর্কশ ভাবটা যাতে এক্কেবারে চলে যায়, তার জন্য বারবার বলতেন, ‘গলে মে মিঠে আওয়াজ লাও’। ...তাঁকে যেমন নকল করা যায় না, তাঁর পর্যায়ে নিজের গায়কিকে নিয়ে যাওয়াও  কারও পক্ষে সম্ভব নয়।’’
তবে আশ্চর্য, বহু বছর পরে এই প্রভাতীদেবীরই গান শুনে বেগম আখতারের বোনের স্বামী মুক্তার আহমেদ নাকি মন্তব্য করেছিলেন, ‘‘আরে, এ তো পুরো বেগমের মতো গায়।’’
বেগম আখতারের জীবনের অসাধারণ সব ঘটনার সাক্ষী ঋতাদেবী। 
কলকাতায় আয়োজিত সঙ্গীত সম্মেলন। শ্রোতারা সারা রাত জেগে থাকতেন বরকত আলি, উস্তাদ ফৈয়াজ খান, উস্তাদ মুস্তাক খান, পণ্ডিত তারাপদ চক্রবর্তী, পণ্ডিত ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়ের গান শোনার জন্য।
‘‘শুনেছি, ভোর রাতে উস্তাদ বড়ে গোলাম আলির সারেঙ্গির সঙ্গে বেগম আখতারের মধ্যসপ্তকের ভৈরবী সারা রাত্রির গায়নকে নাকি ম্লান করে দিত। উস্তাদ ফৈয়াজ খান নাকি আল্লাকে ধন্যবাদ দিতেন, আখতারি বাঈয়ের আগে গান গাওয়ার সুযোগ পাওয়ার জন্য। বলতেন, ‘নহি তো খুদা কসম, ইসকে বাদ বৈঠ্না মুস্কিল থা।’’
জীবনের অমূল্য ন’টি বছর ঋতাদেবী বেগম আখতারের কাছে গান্ডাবন্দি হয়ে শুধু গানই শেখেননি, তাঁর লউনউয়ের বাড়িতে বাস করেছেন মেয়ের মতো স্নেহযত্নে।
••••
‘‘রেকর্ড ডিস্কের জমানায় বেগম আখতার এলেন, দেখলেন আর জয় করলেন, এমনটা কিন্তু মোটেই হয়নি’’, অমলবাবুর এমন তথ্যে যে-কেউ চমকে উঠবে।
বলছিলেন, ‘‘প্রথম দিকে একের পর এক রেকর্ড ফ্লপ। মোট ১১-১২টি ৭৮এমআরপি রেকর্ড ডিস্ক (দু’পিঠে একটি করে গান) তেমন চলেনি বাজারে। শুরুর শুরুতে ‘মেরে জাঁহানে’, ‘চলো আয়ে চলো’, ‘ওয়াফা নহি না সহি’র মতো সব গান গেয়ে আখতারি বাঈ জয় করতে পারেননি শ্রোতাদের  মন।’’
কিন্তু তাঁর গায়কির উপরে অগাধ আস্থা ছিল অমলবাবুর জ্যাঠ্যামশাই জে এন ঘোষের।
“বেশি দিন অপেক্ষা করতে হয়নি আখতারি বাঈকে।  ‘দিওয়ানা বনানা হো তো দিওয়ানা বনা দে’ আর ‘ঝুটি জাগ কি ঝুটি প্রীত’ গজলের রেকর্ড ডিস্ক বাজারে আসার পরে খ্যাতির তুঙ্গে পৌঁছে গেলেন তিনি। এর পর তাঁর ফ্লপ রেকর্ডও কেনার জন্য হুড়োহুড়ি পড়ে গেল শ্রোতাদের মধ্যে। সঙ্গীত জগতে বেগম আখতারের স্বপ্নের উড়ানের সেই শুরু।’’
••••
ফেলে আসা দিনের নানা জলছবি একের পর এক তুলে আনছিলেন অমলবাবু।
যাঁর জন্ম, বেড়ে ওঠা এবং সঙ্গীতশিক্ষা ফৈজাবাদ এবং লখনউয়ে, সেই আখতারি বাঈকে ভারতীয় সঙ্গীতজগতে প্রতিষ্ঠিত করার সিংহভাগ কৃতিত্বের অনেকটাই দাবিদার  লখনউ এবং এই কলকাতার বাঙালিরা।
‘‘ঘরে ঘরে বেগম আখতারের গজলকে সমাদরের সঙ্গে পৌঁছে দিয়ে তাঁকে খ্যাতির চূড়ায় পৌঁছে দিতে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের মধ্যে অবশ্যই আছেন আমার জ্যাঠামশাই যতীন্দ্রনাথ ঘোষ আর আমার বাবা দিগেন্দ্রনাথ ঘোষ। মেগাফোন রেকর্ড কোম্পানির দুই কর্ণধার।’’
শৈশবে পিতা-মাতার বিচ্ছেদ হয়ে যাওয়ার পরে পিতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত ছিলেন আখতারি। কিন্তু বেগম আখতারের সঙ্গীত এবং দৈনন্দিন জীবনে মেগাফোন কোম্পানির দুই কর্ণধারের ভূমিকা ছিল পিতার মতোই।
“জ্যাঠামশাই জে এন ঘোষকে তিনি ডাকতেন ‘বড়ি বাবা’ আর ‘ছোটি বাবা’ বলতেন আমার বাবাকে। দাদার সঙ্গেও তাঁর দারুণ বোঝাপড়া ছিল”, জ্যাঠা-বাবার পরে মেগাফোনের হাল ধরেছিলেন অমলবাবুর দাদা প্রয়াত কমলকুমার ঘোষ। বাঙালির এই সাধের সংস্থাকে তিনিও এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন।
‘দিবানা বনা দে’র সাফল্যের পরে ভারতের যে-কোনও প্রান্তে মার্গসঙ্গীতের যে-কোনও মেহফিলের শিল্পীতালিকায় তখন থেকেই অনেকের আগে থাকত বেগম আখতারের নাম।
আজ থেকে ৭৬ বছর আগে শুরু হয়েছিল আখতারি বাঈয়ের উল্কা-সম উত্থান। 
ভারতের গানবাজনার ইতিহাসে কেন তিনি আজও অনন্যা, অতুলনীয়া এবং স্মরণীয়া?
প্রয়াত গজল সম্রাজ্ঞীর জন্মশতবর্ষের স্মরণে এগিয়ে এসেছিল তথ্য ও বেতার মন্ত্রকও। দূরদর্শনের আঞ্চলিক চ্যানেলে শুরু হয়েছিল গজল প্রতিযোগিতা ‘জসন্-এ-বেগম আখতার’।
এই প্রতিযোগিতায় সুযোগ দেওয়া হয়েছিল ১৮-৪০ বছর বয়সি গজল গায়কদের। ভাবনাটি ছিল ঋতা গঙ্গোপাধ্যায়ের।
সেরার সেরাদের নিয়ে তার পরে ডিডি উর্দু চ্যানেলে শুরু হয়েছিল ফাইনাল রাউন্ড।
ভারতের আর কোনও গায়কের জন্মশতবর্ষে সরকারি চ্যানেলে এমন অভিনব অনুষ্ঠান আগে কখনও হয়েছে কি?
••••
দমদমে স্টুডিয়োর দিনগুলো বলছিলেন সুশান্তবাবু— ‘‘রিহার্সাল বিশেষ করতেন না রেকর্ডিংয়ের আগে। গজলকে অন্য মাত্রায় তুলে নিয়ে যেতেন স্রেফ সারেঙ্গি, তবলা আর তানপুরার সঙ্গত নিয়ে। কেন তাঁর গজল সরাসরি পৌঁছে যেত শ্রোতাদের হৃদয়ে জানেন? তিনি গান করতেন এক্কেবারে সহজসরল ঢংয়ে। সুরের বিস্তারে গানকে অনর্থক জটিল না-করার অনবদ্য দক্ষতা ছিল তাঁর। আসলে নন-ফিল্মি গানে যতটা স্বাধীনতা নেওয়া যেতে পারে, তার সবটার সদ্ব্যবহার করতেন অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে।”  
পরাধীন ভারতে উচ্চবর্ণের শিক্ষিত, মার্গসঙ্গীতের সমঝদার সমাজে সঙ্গীতশৈলী হিসেবে কোঠিবাড়ির গজলের বিশেষ কোনও স্থান ছিল না।
কিন্তু পরবর্তী কালে ত্রিশের  দশক থেকে ভারতীয় ধ্রুপদী সঙ্গীতের রসাস্বাদনে আগ্রহী রসিক, শিক্ষিত শ্রোতাদের জলসায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঠায় বসিয়ে রাখতেন সৈয়দ আসগর হুসেন ও মুস্তারি বেগমের মেয়ে আখতারি বাঈ।
আর এই সঙ্গীত সাধনার কঠিন রাস্তায় হেঁটেই তিনি পাল্টে ফেলেন নিজের ভাগ্য।
নিজস্ব গায়কি তৈরি করে গজলের উড়ানে চেপে তিনি বাঈ থেকে হয়ে গেলেন বেগম।
 “তাঁর উপদেশ ছিল, ‘বঁয়া অপনা’, অর্থাৎ আমাকে নকল না-করে নিজস্ব গায়কিতে গাও। নকল করে কেউ কোনও দিন সাফল্য পায় না”, গুরুর সেই উপদেশ আজীবন পালন করে এসেছেন ঋতা দেবী।
সঙ্গীত জীবনের শুরু থেকেই তিনি গতানুগতিকতার পথ না মাড়িয়ে সঙ্গীতশিক্ষার কঠিন থেকে কঠিনতর শৃঙ্গে পা রাখার লক্ষ্যে ডুব দিয়েছিলেন সাধনার অতল গভীরে। ভারতীয় মার্গ সঙ্গীতের উচ্চ পর্যায়ে সেরার সেরাদের মধ্যে তিনি আবিষ্কার করতে চেয়েছিলেন নিজেকে।
••••
সঙ্গীতের প্রাথমিক শিক্ষা পেয়েছিলেন পাতিয়ালার উস্তাদ আতা মহম্মদ খানের কাছে।
কিরানা ঘরানার উস্তাদ আব্দুল ওয়াহিদ খানের তালিমে তাঁর গায়কির ভিত শক্ত জমির উপরে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন আখতারি বাঈ।
আব্দুল করিম খানের ভক্ত আখতারি বাঈ ধ্রুপদী সঙ্গীতের রেশ এবং আমেজ মিশিয়ে তৈরি করেছিলেন তাঁর নিজস্ব গায়কি, যার সাহায্যে তিনি গজলকে সরাসরি পৌঁছে দিতে পেরেছিলেন তাঁর শ্রোতাদের হৃদয়ে।
তাঁর নিজস্ব সাবলীল গায়কি এবং কণ্ঠসম্পদে সময় এবং বয়স কখনও থাবা বসাতে পারেনি।
শোনা যায় নিজের কণ্ঠস্বরকে আল্লার দান বলে মনে করতেন বেগম।
 “ওই ন’বছরে কত কী যে শিখেছি তাঁর কাছে,” সারা ভারতে বিভিন্ন মেহফিলে ‘আম্মি’র পাশাপাশি ঋতাদেবী নিজেও গজল পরিবেশন করে গিয়েছেন শ্রোতাদের।
দিল্লিতে গাইতে এসেই ঋতাদেবীর সঙ্গে দেখা বেগম আখতারের। প্রথম দর্শনেই ভাললাগা।
ঋতাদেবীর আগের গুরু সিদ্ধেশ্বরী দেবীও ছিলেন ধ্রুপদী সঙ্গীতের বড় শিল্পী। কিন্তু তাঁর কাছ থেকে ঋতাকে প্রায় ছিনিয়ে নিয়েছিলেন বেগম আখতার।
তাঁকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিলেন সিদ্ধেশ্বরী দেবী।— “আরে তুমি ওকে কী শেখাবে, আমি দেড় ঘণ্টার বোল শিখিয়েছি ওকে। জবাবে আম্মি বলেছিলেন, তিন মিনিটেই দর্শকদের হৃদয় জয় করে নিতে হবে। দেড় ঘণ্টার বোল এখন অচল।”
সৈয়দ ঘরের মহিলা ছিলেন আখতারি বাঈ। শোনা যায়, নার্গিসের মা জদ্দনবাঈয়ের গায়কি নাকি তাঁকে অনুপ্রাণিত করত।
তাঁর সাফল্যের পিছনে উস্তাদ বড়ে গোলাম আলি খানের ভাই উস্তাদ বরকত আলি খানের অবদানও নাকি কম ছিল না।
কোন প্রতিভায় তিনি কালজয়ী গজল গায়িকার সম্মান ছিনিয়ে নিয়েছিলেন? কোন গুণে তিনি ‘গজল কুইন’?
ঋতাদেবী ব্যাখা করলেন।
“আম্মি বলতেন, জন্মেই কেউ সঙ্গীতজ্ঞ হয় না। নিজেকে গড়ে নিতে হয় তালিম আর ‘রিওয়াজ’-এর কঠিন সাধনায় ডুবে থেকে। আর সবার আগে প্রয়োজন নিজেকে ভাল মানুষ হিসেবে তৈরি করা। ভালমানুষ না-হলে, বড় শিল্পীও হওয়া যায় না।” আরবিতে গজল শব্দের মানে প্রেমিকের সঙ্গে কথোপকথন। কবিতা না-বুঝতে পারলে সম্ভব নয় গায়কিতে গজলের বড় শিল্পী হওয়া। বারবার তিনি নাকি এই কথাই বলতেন।
••••
গান গাইতে গাইতেই হঠাৎই  তিনি যোগ দিলেন কলকাতার বাণিজ্যিক থিয়েটারে।
তাঁকে নিয়ে শোরগোল পড়ে গেল দর্শকদের মধ্যে। গানে-অভিনয়ে-ব্যক্তিত্বে সীতার ভূমিকায় তিনি অনবদ্য। প্রচারের সার্চলাইটে তাঁর সুনাম  পৌঁছে গেল আরব সাগরের তীরের সেই স্বপ্নশহরেও।
আখতারি চলে এলেন বলিউডে। ‘টকি’তে অভিনয় করলেন। ‘নল-দময়ন্তী’ ‘রোটি’-র মতো কয়েকটি ছবিতে অভিনয় করার পরেই তিনি ফের ঘরমুখী।
কাঁকুলির নবাব বিপত্নীক ব্যারিস্টার ইশতিয়াখ অহমেদ আব্বাসি গান শুনতে আসতেন আখতারি বাঈ ফৈজাবাদীর লখনউয়ের লালবাগের বাড়িতে।
শেষমেশ তাঁকেই বিয়ে করে আখতারি বাঈ হলেন বেগম আখতার।
কিন্তু গান গাইতে পারবেন না, এই শর্তে আব্বাসিসাব তাঁকে বিয়ে করেছিলেন। বিয়ের পরে একের পর এক সন্তান জন্ম দিয়েছিলেন গজল কুইন। কিন্তু কোনও সন্তানই তাঁর বাঁচেনি।
সন্তান-হারানোর দুঃখ, গান গাইতে না-পাওয়ার বেদনা, গৃহবন্দি জীবন তাঁকে অসুস্থ করে তোলে।
ফের তাঁকে গানবাজনা করার অনুমতি দেন নবাবসাব। তৈরি হল গান শেখানোর স্কুল।
খবর পেয়ে বেগম আখতারের সঙ্গে দেখা করতে এলেন  লখনউ রেডিয়ো স্টেশন ডিরেক্টর সুনীল বসু এবং সঙ্গীত বিভাগের প্রধান এল কে মলহোত্র।
তাঁদের অনুরোধ ঠেলতে না-পেরে বেগমকে রেকর্ড করানোর অনুমতি দেন আব্বাসিসাব।
এইচএমভি-র কর্তৃপক্ষ হাজির হলেন লখনউয়ে। রেকর্ডিং হয়ে গেল। এক পিঠে ‘কোয়েলিয়া মত করো পুকার’ আর অন্য পিঠে ‘সঁইয়া ছোড় দে নৌকরিয়া’।
দু’টি দাদরা-সহ এই রেকর্ড প্রকাশ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাজারে ফের আলোড়ন। ঘরে ঘরে বাজতে শুরু করল ‘কোয়েলিয়া মত করো পুকার’।
তত দিনে বেগম আখতারের ব্যক্তিগত জীবনেও এসে গিয়েছে বিরাট পরিবর্তন।
শোক-দুঃখ-বিষাদ-নিরাশা-হতাশার অভিজ্ঞতার আগুনে ক্রমাগত পুড়তে পুড়তে তাঁর সঙ্গীতজীবন পরিণত হয়ে গিয়েছে এক্কেবারে তপ্তকাঞ্চনে। সঙ্গীতশিক্ষার আরও কঠিন থেকে কঠিন পথের সন্ধান করে তিনি নিজের গায়কিকে নিয়ে গিয়েছিলেন সবার ধরাছোঁয়ার ঊর্ধ্বে।

••••
একবার লখনউ রেডিয়ো স্টেশনে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের ধ্রুপদী সঙ্গীতের ‘লাইভ’ অনুষ্ঠান।
সন্ধ্যা বলছিলেন সে দিনের গল্প, “রেকর্ডিং রুমে গিয়ে দেখি দিদি বেগম আখতার বসে আছেন। আমি তো বেশ ঘাবড়ে গেলাম। দিদি থাকলে আমি গাইব কী করে! আমার জড়সড় ভাব দেখে তিনি আমাকে অভয় দিলেন। বললেন ‘চৈন সে গা লেনা। ডরনা কেয়া হ্যায়’।  গান শেষে তাঁর প্রশংসাও পেলাম।”
এর পর বিমান  ঘোষের সঙ্গে বেগম আখতারের লালবাগের বাড়ি গিয়ে সন্ধ্যা অবাক। সার দিয়ে বসে এক দল ছেলেমেয়ে পড়াশোনা করছে। বেগমের এত ছেলেমেয়ে?
তাঁর মনের কথা বুঝে বিমান ঘোষ বলেন, ‘‘আরে না না। উনি সন্তানহীনা। এরা সব পোষ্য। এদের সব খরচা উনি দেন।’’
মা ডাকের জন্য আকুল হয়ে থাকতেন সন্তানহীনা চিরদুঃখী বেগম।
‘আপনাকে কী বলে ডাকব?’, সন্ধ্যার মনে আছে, এই প্রশ্নে বেগম  জানিয়েছিলেন, আমাকে ‘মা’ বলেই ডাকবে।
মানুষ বেগম আখতারকে নিয়ে ঋতাদেবীর অভিজ্ঞতাও প্রায় একই রকম। গরিব মানুষদের পাশে সর্বদাই দাঁড়িয়েছেন আম্মি। বই-খাতা, ওষুধ থেকে সাইকেল, স্কুটার পর্যন্ত সব কিনে দিতেন।
শিয়া পরিবারের মেয়ে বেগম আখতার মহরম পালন করতেন। আর বহু বছর ধরে প্রয়াত ‘আম্মি’র সম্মানে মহরমের সপ্তম বা নবম দিনে দিল্লিতে গজলের মেহফিল বসান ঋতাদেবী।
জলসায় তিনি কতটা অনবদ্য ছিলেন, ভাবা যায় না। শ্রোতাদের সম্বোধন করে গাইতেন। গানে অহেতুক কালোয়াতি করতেন  না।  উদাস ভাব আনতেন গজলে। আর তার সঙ্গে ঋতা বলছিলেন, ‘‘আমাদেরও কেবলই হুঁশিয়ারি দিতেন, উপরে নীচে, এ দিক ও দিক, তান মারবে না।”
বেগমের মৃত্যুর পরে দিল্লিতে পণ্ডিত রবিশঙ্করের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছেন ঋতাদেবী।
তখনকার একটি অভিজ্ঞতা বলছিলেন তিনি, ‘‘আম্মি-র প্রসঙ্গ উঠতে রবুদা বললেন, ‘আমরা বসে থাকতাম কখন আখতারি সুর ভুল করবে। কিন্তু ও ছিল বসরার মোতির মতো।  কখনও আমরা ওর ভুল ধরতে পারিনি। ওর সঙ্গে কারও তুলনা হয় না।”
বেগমের চলে যাওয়ার চার দশক পরেও পণ্ডিতজির এ কথাগুলিই যেন আজও মিঠে সুরের তান হয়ে ঘুরপাক খায় রসিকজনের কানে!

http://www.anandabazar.com/supplementary/patrika/she-dwellers-in-our-heart-even-after-her-death-1.503549