বন্ধুদের নেমন্তন্ন করে খাওয়াতে ভালবাসতেন রবীন্দ্রনাথ।
তেমনই একদিন খেতে আসতে বলেছেন বিলেতে একই শিক্ষকের কাছে পড়া প্রিয়বন্ধু প্রিয়নাথ সেনকে। তারপর ভুলেও গিয়েছেন বেমালুম। স্ত্রীকে বন্ধুর কথা বলা তো দূরের কথা, নিজে খেয়েও নিয়েছেন দুপুরের খাবার।
বিশ্রাম নিচ্ছেন। এমন সময় হাজির প্রিয়নাথ সেন। রবীন্দ্রনাথ বুঝলেন কী ভুলটাই না হয়েছে!
বন্ধুকে আপ্যায়ন করে বসিয়ে পত্নীকে গিয়ে বলে এলেন নিজের ভুলো-মনের কথা।
কবি-পত্নী বন্ধু অতিথিকে বুঝতে দিলেন না কিছুই। কিছুক্ষণ পর যখন দু’জনকে ডেকে নিলেন খেতে বসবার জন্য, রবীন্দ্রনাথ দেখলেন আয়োজনের কোথাও কোনও ত্রুটি নেই। রবীন্দ্রনাথের ভুলে যাওয়া, কবিপত্নী সহজেই ঢেকে দিলেন নিজের ভালবাসা উজাড় করে দিয়ে।
রবি-জীবনে মৃণালিনীদেবী ছিলেন এমনই।
বালিকা বধূ ভবতারিণী
কলকাতার অভিজাত, একান্নবর্তী পরিবারের আদরের ছোট ছেলে। তার উপর আবার সুদর্শন এবং প্রতিভাবান। তোড়জোড় হচ্ছিল তাঁর বিয়ের। চলছিল বিয়ের উপযুক্ত কনে দেখাও।
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন, বিয়ের ব্যাপারে একরকম চাপে পড়েই শেষ পর্যন্ত নিমরাজি হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ।
ঠাকুরবাড়ির নির্বাচকমণ্ডলী অনেক খুঁজেও বিফল হয়ে শেষ পর্যন্ত ঠাকুর এস্টেটের এক কর্মচারীর মেয়ে ভবতারিণীকেই রবীন্দ্রনাথের স্ত্রী হিসেবে বেছে নিলেন।
রবীন্দ্রনাথের সেই কনে দেখার দলে ছিলেন কবির দুই বৌঠান জ্ঞানদানন্দিনী এবং কাদম্বরী, দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, ভ্রাতুষ্পুত্র সুরেন্দ্রনাথ এবং রবীন্দ্রনাথ নিজে।
যদিও রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং তাঁর কনে দেখার দলে ছিলেন কি না তা নিয়ে সংশয় আছে। নরেন্দ্রপুর গ্রামে জ্ঞানদানন্দিনীর বাপের বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে এই দল রবীন্দ্রনাথের জন্য একজন সুন্দরী পাত্রী খুঁজছিলেন। ইন্দিরাদেবী লিখেছেন পিরালী ব্রাম্মণদের আড্ডা ছিল যশোরে। সুন্দরীকূল তত দিনে নাকি উজাড় হয়ে গিয়েছিল ওখানে। অনেক খুঁজে পাওয়া গেল নাবালিকা ভবতারিণীকে।
অবিভক্ত বাংলার খুলনা জেলায় দক্ষিণডিহির ফুলতলা গ্রামে বেণীমাধব রায়চৌধুরী আর দাক্ষায়ণীর মেয়ে ভবতারিণী যখন রবীন্দ্রনাথকে বিয়ে করতে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি এলেন, তখন তাঁর বয়েস সবে নয়। আর রবীন্দ্রনাথের বাইশ। অনুমানের উপর নির্ভর করে মৃণালিনীর জন্ম ১৮৭৪ –এর ১ মার্চ ধরা হয়।
বান্ধবীর নামের ছায়ায় মৃণালিনী
গ্রামের পাঠশালায় প্রথম বর্গ পর্যন্ত পড়া শেষ করে এসেছিলেন ভবতারিণী।
ফুলতলায় গিয়ে রবীন্দ্রনাথকে বিয়ে করতে হয়নি। কিন্তু বিয়ে করতে কোন মেয়ে আবার তার শ্বশুর বাড়ি আসে?
সবই ঠাকুরবাড়ির কেন্দ্রে সূর্যের মতো জেগে থাকা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের ইচ্ছে।
তাঁর নির্দেশেই কলকাতায় জোড়াসাঁকোর মহর্ষিভবনে এসে ব্রাহ্মমতে রবীন্দ্রনাথকে বিয়ে করলেন ভবতারিণী।
এর পর তাঁর নামটাও গেল বদলে। ‘ভবতারিণী’-কে ‘মৃণালিনী’ করে দিলেন রবীন্দ্রনাথ। কেউ কেউ বলেছেন নিজের নামের সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই নাকি রবীন্দ্রনাথ দিয়েছিলেন এই নাম।
অনেকে আবার ধরে নিয়েছেন কৈশোরে মনের গভীর দাগকাটা মরাঠি বান্ধবী আনা তড়খড়কে দেওয়া তাঁর নাম ‘নলিনী’র ছায়ায় রবীন্দ্রনাথ নববধূর নাম রেখেছিলেন মৃণালিনী।
মৃণালিনী আর রবীন্দ্রনাথের বিবাহবাসরের বর্ণনা লিখে গিয়েছেন রবীন্দ্রনাথের বড়দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথের ছেলের স্ত্রী হেমলতা ঠাকুর।
মহর্ষি তখন হিমালয়ে। খুবই ঘরোয়া আর অনাড়ম্বর ভাবে তাঁদের বিয়ে হল। ঠাকুরবাড়ির বিয়েতে একটা বেনারসি শাল গায়ে দেবার চল ছিল। রবীন্দ্রনাথ সেটিই গায়ে দিলেন। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির পশ্চিমের বারান্দা ঘুরে রবীন্দ্রনাথ বিয়ের ঘরে এলেন। ব্যাপারটা এমন যেন অনেক দূর থেকে অনেক ঘুরে বর এলেন কনেকে নিয়ে যেতে।
পিঁড়ির উপর দাঁড়ানো রবীন্দ্রনাথকে বরণ করা হল। কনেকে সাতপাক ঘুরিয়ে করা হল সম্প্রদান। এই ছোট্ট অনুষ্ঠানের ভিতর দিয়েই ১২৯০ -এর চব্বিশে অগ্রহায়ণ, ইংরেজি ৯ ডিসেম্বর, ১৮৮৩ মৃণালিনী এলেন রবীন্দ্রনাথের জীবনে। মৃণালিনী জীবিত ছিলেন ঊনত্রিশ বছর। তাঁদের ব্যস্ত, অভাবী বিবাহিত জীবন ছিল উনিশ বছরের।
ছিলেন লাবণ্যে অপরূপা
ছিলেন লাবণ্যে অপরূপা
মৃণালিনী ছিলেন গভীর ব্যক্তিত্বময়ী, সুদর্শনা। নানা বর্ণনা থেকে জানা যায় তাঁর গায়ের রং ছিল একটু চাপা। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের রূপসী ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরা দেবী তাঁর স্মৃতিকথায় কেন যে লিখেছিলেন তাঁর ‘গুণবান, রূপবান, ভাগ্যবান, ধনবান, খ্যাতিমান’ রবিকাকার স্ত্রী মৃণালিনী ‘দেখতে ভাল ছিলেন না’, তা আন্দাজ করা কঠিন।
শুধু ইন্দিরাদেবীই নন, ঊর্মিলাদেবীও তাঁর স্মৃতিচারণে লিখেছেন, ‘রবীন্দ্রনাথের স্ত্রী, সেরকম তো ভাল দেখতে নন’। তারপর ভাল করে দেখে তিনিই আবার লিখেছেন, ‘‘... এক অপরূপ লাবণ্যে সমস্ত মুখখানা যেন ঢলঢল করছে, আর একটা মাতৃত্বের আভায় যেন মুখখানা উজ্জ্বল। একবার দেখলে আবার দেখতে ইচ্ছে হয়।’’
আসলে ঊর্মিলাদেবী শুনেছিলেন ঠাকুরবাড়ির মেয়েরা সব অপ্সরার মতো, ‘‘তাঁরা দুধ দিয়ে স্নান করেন, ক্ষীর সর ছানা বেটে রূপটান মাখেন— কত গয়না, কত কাপড় যে আটপৌরে পরেন তার ঠিক নেই।’’
সে দিক থেকে একেবারে আড়ম্বরহীন থাকতেন বলেই সম্ভবত মৃণালিনীর চটক ছিল কম।
বাসরে গান জুড়লেন রবীন্দ্রনাথ
বাসরে গান জুড়লেন রবীন্দ্রনাথ
ফিরে আসা যাক মৃণালিনীদেবীর বিয়ের গল্পে। বিয়ের বাসরে বসেই রবীন্দ্রনাথ শুরু করলেন দুষ্টুমি।
ভাঁড়-কুলো খেলায় ভাঁড়ের চাল ঢেলে আবার ভাঁড় ভর্তি করে ফেলাই যেখানে নিয়ম, রবীন্দ্রনাথ সেখানে উল্টে দিলেন সব ভাঁড়। জিজ্ঞেস করলে ছোট কাকিমা ত্রিপুরা সুন্দরীদেবীকে বললেন, ‘সব যে উলট পালট হয়ে যাচ্ছে--কাজেই ভাঁড়গুলো উল্টে দিচ্ছি।’ এর পর বাসরে দরাজ গলায় মৃণালিনীর দিকে তাকিয়ে গান ধরলেন রবীন্দ্রনাথ: ‘আ মরি লাবণ্যময়ী/ কে ও স্থির সৌদামিনী,/ পূর্ণিমা-জোছনা দিয়ে/ মার্জিত বদনখানি!/ নেহারিয়া রূপ হায়,/ আঁখি না ফিরিতে চায়,/ অপ্সরা কি বিদ্যাধরী/ কে রূপসী নাহি জানি।’
লজ্জায় ওড়নায় মুখ ঢেকে মাথা হেঁট করে বসে রইলেন মৃণালিনী।
বিয়ের খুঁটিনাটি ব্যবস্থা করেছিলেন মহর্ষি স্বয়ং। ঠাকুরবাড়ির কর্মচারী সদানন্দ মজুমদারকে দিয়ে কনের আর কনের আত্মীয়স্বজনের বাড়ি পাঠিয়েছিলেন নানারকম আশীর্বাদী মিষ্টি আর খেলনা।
বিয়ের নিমন্ত্রণপত্র বন্ধুদের নিজে হাতে লিখে পাঠিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। কত জনকে পাঠিয়েছিলেন জানা যায় না। তবে প্রিয়নাথ সেনকে লেখা নিমন্ত্রণপত্রের খোঁজ পাওয়া যায় যেখানে মজা করে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘আগামী রবিবার ২৪শে অগ্রহায়ণ তারিখে শুভদিনে শুভলগ্নে আমার পরমাত্মীয় শ্রীমান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শুভ বিবাহ হইবেক।’ এই চিঠির উপরে ছাপা ছিল মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘মেঘনাদ বধ’ কাব্যের একটি পঙ্ক্তি: ‘আশার ছলনে ভুলি কি ফল লভিনু হায়’।
ইংরেজি শেখালেন মহর্ষি
ছেলের বিয়ে দিয়েই অপরিণত পুত্রবধূকে ঘরসংসার সামলানোর কাজে ব্যস্ত করে তোলেননি মহর্ষি। মহর্ষি খুবই স্নেহ করতেন তাঁর ছোট পুত্রবধূটিকে।
বিয়ের পর রবীন্দ্রনাথের দাদা হেমেন্দ্রনাথের স্ত্রী নীপময়ীদেবী ক্ষীণতনু মৃণালিনীর শিক্ষা আর স্বাস্থ্যের উন্নতির ভার নিলেন। মৃণালিনীকে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে মহর্ষি তাঁকে ভর্তি করলেন কলকাতার লরেটো হাউসে। কিনে দিলেন স্লেট, বইপত্র। তৈরি হল মৃণালিনীর স্কুলের যাবার পোশাক।
এই সবই জানা যায় ঠাকুরবাড়ির হিসেবের খাতা থেকে।
একবছর লোরেটোতে পড়াশোনা করেন মৃণালিনী। রবীন্দ্রনাথের ইচ্ছেতে এর পর বাড়িতেই পণ্ডিত হেরম্বচন্দ্র বিদ্যারত্নের কাছে সংস্কৃত শেখার ব্যবস্থা হয় তাঁর।
১৮৮৬-র ২৫ অক্টোবর জন্ম হল বেলা অর্থাৎ মাধুরীলতার— মৃণালিনী আর রবীন্দ্রনাথের প্রথম সন্তান। একটা ছবিতে দেখা যায় বেলাকে কোলে নিয়ে সামান্য উঁচু এক আসনে বসে আছেন মৃণালিনী। পাশে মুগ্ধ বিস্ময়ে নবজাতকের দিকে তাকিয়ে স্থির রবীন্দ্রনাথ। মহর্ষিকে খুবই সমীহ করতেন মৃণালিনী।
ঊর্মিলাদেবী লিখেছেন, মহর্ষি পছন্দ করেন না এমন কোনও কাজ করতে চাইতেন না মৃণালিনী। কখনও তর্ক করে রবীন্দ্রনাথকেও বলতেন, ‘বাবামশায় থাকলে তুমি এ কাজ করতে পারতে?’ তাঁর লেখা থেকেই জানা যায় রবীন্দ্রনাথের উপর অখণ্ড প্রতাপ ছিল অভিমানিনী মৃণালিনীর। আর স্ত্রীয়ের মানভঞ্জনের জন্য বেশ বেগ পেতে হতো রবীন্দ্রনাথকে। একটু ভয়ও পেতেন মৃণালিনীকে।
পড়তেন বাংলা, ইংরেজি আর সংস্কৃত
পড়তেন বাংলা, ইংরেজি আর সংস্কৃত
ভাশুর বীরেন্দ্রনাথের ছেলে বলেন্দ্রনাথের মাধ্যমেও ইংরেজি, বাংলা আর সংস্কৃত সাহিত্যের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন মৃণালিনী। ছিলেন মার্ক টোয়েনের অনুরাগিণী। কন্যা মাধুরীলতার চিঠিতে দেখা যায় কখনও সমস্ত দিন বই পড়তে পড়তে রবীন্দ্রনাথকে চিঠি লিখে উঠতে পারছেন না মৃণালিনী।
ছোট মেয়ে মীরার স্মৃতিকথায় পাওয়া যায় মৃণালিনীর বইপড়ার এই ছবি: ‘শান্তিনিকেতনের দোতলার গাড়িবারান্দার ছাতে একটা টেবিল ল্যাম্প জ্বলছে। মার হাতে একটা ইংরেজি নভেল। তার থেকে বাংলায় অনুবাদ করে দিদিমাকে পড়ে শোনাচ্ছেন।’’
কয়েক পৃষ্ঠা মহাভারতের শান্তিপর্বের, ঈশপোনিষদ, কঠোপনিষদের অনুবাদ অভ্যাস করা মৃণালিনীর একটা খাতা দেখা যায় বিশ্বভারতীর রবীন্দ্রভবনে। সাহিত্যচর্চা, অনুবাদ চর্চার পাশাপাশি ঠাকুরবাড়ির নাটকের দলেও সক্রিয় ছিলেন মৃণালিনী।
‘রাজা ও রানী’ নাটক প্রথমবার মঞ্চস্থ হলে নারায়ণীর ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন তিনি। সাহিত্যে আগ্রহ থাকলেও চিঠি আর সামান্য কিছু অনুবাদের খসড়া ছাড়া মৃণালিনী প্রায় লিখে যাননি কিছুই।
শোনা যায়, রবীন্দ্রনাথের দিদি স্বর্ণকুমারীদেবী মৃণালিনীকে তার কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেছিলেন যে যাঁর স্বামী বাংলার এক শ্রেষ্ঠ লেখক তাঁর আর নিজের লেখার কী প্রয়োজন!
থিতু হননি এক ঠিকানায়
থিতু হননি এক ঠিকানায়
বিয়ের পর একটি মাত্র ঠিকানায় থিতু হতে পারেননি মৃণালিনী। কলকাতা, শিলাইদহ, সোলাপুর আর শান্তিনিকেতনে বারবার বাসা বদল করেছেন।
বিয়ের পাঁচ বছর পর রবীন্দ্রনাথ আর শিশুকন্যা বেলার সঙ্গে গাজিপুরেও কিছু দিন ছিলেন মৃণালিনী।
পশ্চিমভারতের গাজীপুরে গোলাপবাগানের টানে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। বলা যায় সেটাই ছিল তাঁদের মধুচন্দ্রিমা!
বৈশাখ থেকে আষাঢ়ের মধ্যে সেখানেই রবীন্দ্রনাথ লিখলেন আঠাশটি কবিতা। এই আঠাশটা কবিতা ছাপা হয়েছিল তাঁর ‘মানসী’ কাব্যগ্রন্থে।
মৃণালিনীর সঙ্গে গাজীপুরে এসেই রবীন্দ্রনাথ হারিয়ে ফেলেছিলেন তাঁর প্রিয় বৌঠান কাদম্বরীর উপহার দেওয়া সোনার এক আংটি।
বিয়ের প্রায় পাঁচ বছরের মাথায় জমিদারি দেখাশোনার কাজে রবীন্দ্রনাথকে শিলাইদহে পাঠিয়ে দিলেন মহর্ষি। সে বারও সঙ্গে মৃণালিনী। আর দুই শিশু সন্তান মাধুরীলতা আর রথীন্দ্রনাথ।
মাঝে মাঝে সপরিবার থাকতেন ‘পদ্মা’ বোটে, নদীতে ভেসে ভেসে। এক দিকে নাগাড়ে স্থানবদল। অন্য দিকে কোলে আসতে লাগল সন্তানরা।
১৮৮৮-তে রথীর পর ১৮৯১-এ জন্ম হল মেজো মেয়ে রেণুকার। ১৮৯৪-এ ছোট মেয়ে মীরা। আর ১৮৯৬-এ ছোট ছেলে শমীন্দ্রনাথের।
১৮৯১-এ রবীন্দ্রনাথ, বেলা, রথী আর রেণুকাকে সঙ্গে নিয়ে প্রথম শান্তিনিকেতনে এসে এলাকার আদি বাড়ি শান্তিনিকেতন গৃহের দোতলায় কবিপত্নী ছিলেন কিছু দিন।
এর পর বিভিন্ন পর্যায়ে ১৯০২ সাল অবধি সব মিলিয়ে প্রায় সাত বার মৃণালিনী নানা কারণে শান্তিনিকেতনে এসেছিলেন বলে অনুমান করা যায়।
খাতার সেই শেষ মলাট
চিঠিতেই স্পষ্ট সম্পর্কের গভীরতা
মৃণালিনীকে চিঠি লিখতে উৎসাহ দিতেন রবীন্দ্রনাথ। আর অধীর হয়ে অপেক্ষা করতেন তাঁর চিঠি পাবার জন্য।
মৃণালিনী ছিলেন অভিমানী। সম্ভবত লিখতেন অনেক কম। মৃণালিনীকে লেখা রবীন্দ্রনাথের চিঠি পাওয়া গেছে ছত্রিশটি।
রবীন্দ্রনাথকে লেখা মৃণালিনীর দুটোর বেশি চিঠির খোঁজ পাওয়া যায় না।
শিলাইদহ, কালিগ্রাম, কুষ্টিয়া, শান্তিনিকেতন, মজফ্ফরপুর, এলাহাবাদ, কলকাতা, সাহাজাদপুর থেকে প্রতিদিনের নানা খুঁটিনাটি জানিয়ে, পরিবারের নানা কথা জানতে চেয়ে মৃণালিনীকে সুন্দর সুন্দর সব চিঠি লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ।
দ্বিতীয়বার বিলেত যাবার পথে ২৯ অগস্ট ১৮৯০-এ এক চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ মৃণালিনীকে লিখেছিলেন একটা স্বপ্নের কথা।
সেখানে দেখা যাচ্ছে, কবির ‘আত্মা’ যেন শরীর ছেড়ে বেরিয়ে জোড়াসাঁকোয় পৌঁছে যাচ্ছে, তাঁর স্ত্রী আর ছেলে-মেয়ের কাছে।
লিখেছিলেন—
‘একটা বড় খাটে একধারে তুমি আর বেলি শুয়ে রয়েছ আর তোমার পাশে খোকা শুয়ে।
আমি তোমাকে একটু আধটু আদর করলুম আর বল্লুম ছোট বৌ মনে রেখো আজ রবিবার রাত্তিরে শরীর ছেড়ে বেরিয়ে তোমার সঙ্গে দেখা করে গেলুম। বিলেত থেকে ফিরে গিয়ে জিজ্ঞাসা করব তুমি আমাকে দেখতে পেয়েছিলে কিনা।’
আইফেল টাওয়ারের ছবি ছাপা পোস্টকার্ডে ১৮৯০ সালের ৯ সেপ্টেম্বর ছেলেদের ‘হামি’ পাঠিয়ে মৃণালিনীকে লিখেছেন, ‘ভাই ছোট বৌ— আমরা ইফেল টাউয়ার বলে খুব একটা উঁচু লৌহস্তম্ভের উপর উঠে তোমাকে একটা চিঠি পাঠালুম। আজ ভোরে প্যারিস এসেছি। লন্ডনে গিয়ে চিঠি লিখব।’
এই চিঠির তিন দিন আগে ৬ সেপ্টেম্বর ম্যাসালিয়া জাহাজে দূর থেকে ইউরোপের ডাঙা দেখতে দেখতে ছোট গিন্নি-কে লিখছেন, ‘সমুদ্রের ঠিক ধারেই নীল পাহাড়ের কোলের মধ্যে সাদা শহরটি বেশ দেখাচ্চে। তোমার দেখতে ইচ্ছে করচে না ছুটকি? তোমাকেও একদিন এই পথ দিয়ে আসতে হবে তা জান? তা মনে করে তোমার খুসি হয় না?’
সুদূর প্রবাসে সাহাজাদপুরে একমাস পূর্ণ করে রবীন্দ্রনাথ চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছেন মৃণালিনীর ছবি। ২০ জুন ১৮৯১-এর চিঠিতে ‘ছুটি’ অর্থাৎ মৃণালিনীকে তাঁর ‘রবি’ লিখছেন, ‘আমার খুব সন্দেহ হচ্চে তুমি সেই কেদারাটার উপর পা ছড়িয়ে বসে একটু একটু করে পা দোলাতে দোলাতে দিবি (দিব্যি) আরামে নভেল পড়চ। তোমার যে মাথা ধরত এখন কি রকম আছে?’
মৃণালিনীর চিঠির কতটা আন্তরিক প্রত্যাশী ছিলেন রবীন্দ্রনাথ তা বোঝা যায় বেশ কয়েকটা চিঠিতে।
একবার অনেক অভিমান করে রবীন্দ্রনাথ মৃণালিনীকে লিখলেন, উত্তর না পেলে আর তিনি চিঠি লিখবেন না তাঁকে।
লিখলেন, ‘এখন আমার ক্রমশঃ বিশ্বাস হয়ে আসচে তোমার কাছে আমার চিঠির কোন মূল্য নেই এবং তুমি আমাকে দু ছত্র চিঠি লিখতে কিছুমাত্র কেয়ার কর না।’
আর একটা চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘যেমনি গাল দিয়েছি অমনি চিঠির উত্তর এসে উপস্থিত।’
ছিল এলোঝেলো, হল পরিবন্ধ
ছিল এলোঝেলো, হল পরিবন্ধ
রবীন্দ্রনাথ যেমন ছিলেন ভোজন রসিক, মৃণালিনী তেমনই ছিলেন রান্নায় পটু।
মৃণালিনীকে নিয়ে সামান্য যে কয়েকটা স্মৃতিকথা লেখা হয়েছে, তার মধ্যে বড় জায়গা জুড়ে রয়েছে মৃণালিনীর রান্নার গল্প।
রবীন্দ্রনাথের প্রিয়পাত্র দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে আসতেন প্রায়ই।
সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতেই মৃণালিনীকে বলতেন, ‘কাকিমা, বড় ক্ষিদে পেয়েছে।’
হাসিমুখে পাত্র-ভরা খাবার চিত্তরঞ্জনের সামনে সাজিয়ে দিতেন মৃণালিনী।
স্ত্রীকে নিত্য নতুন রান্নার ফরমায়েশ করতেন রবীন্দ্রনাথ। শিলাইদহে মাঝেমাঝেই যেতেন কবির বন্ধু জগদীশচন্দ্র বসু আর নাটোরের মহারাজা জগদীন্দ্রনাথ রায়।
তাঁরা কখনও আবার থাকতেন পদ্মা বোটে। কথামতো একবার পদ্মাবোটে নাটোরের মহারাজার জন্য মৃণালিনীকে দিয়ে প্রতিদিন একটা না একটা নতুন রান্না করাতেন রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথের উদ্ভাবন করা সেইসব রান্নার উপকরণ আর পদ্ধতি মৃণালিনী লিখে রাখতেন একটি খাতায়। মাধুরীলতার মৃত্যুর পর হারিয়ে যায় সেই খাতা!
শান্তিনিকেতন গৃহে মৃণালিনীর রান্না করার বর্ণনা দিয়ে কন্যা মীরাদেবী লিখেছেন, ‘... সরু এক-ফালি বারান্দায় একটা তোলা উনুনে মোড়ায় বসে মা রান্না করছেন, তাঁর পিঠটা শুধু দেখা যাচ্ছে।’
নানা রকম মিষ্টি রবীন্দ্রনাথের জন্য তৈরি করতেন মৃণালিনী। তাঁর হাতের দইয়ের মালপো, পাকা আমের মিষ্টি, চিঁড়ের পুলি ছিল বিখ্যাত।
একবার মৃণালিনীকে দিয়ে রবীন্দ্রনাথ মানকচুর জিলিপিও বানিয়েছিলেন। কবির ফরমায়েশ শুনে প্রথমে হেসে খুব আপত্তি করেছিলেন কবি-পত্নী। তারপর সত্যি সত্যি তৈরি করে ফেললে দেখা গেল তাঁর হাতের গুণে উতরে গিয়েছে সে-জিলিপিও।
মৃণালিনী রান্না করছেন আর পাশে একটা মোড়ায় বসে রবীন্দ্রনাথ নতুন রান্নার ফরমায়েশ করছেন, কখনও মাল-মশলা দিয়ে শিখিয়ে দিচ্ছেন নতুন প্রণালীতে কোনও রান্না—স্মৃতিকথনে পাওয়া যায় এমন ছবিও। রথীন্দ্রনাথের লেখা থেকে জানা যায়, শান্তিনিকেতন গৃহে দোতলার বারান্দার এক কোণে তিনি এক উনুন পেতে নিয়েছিলেন। আশ্রমে ছুটির দিনে নিজের হাতে রেঁধে খাওয়াতেন ছেলেমেয়েদের।
মৃণালিনীর হাতের রান্নার যেমন ভক্ত ছিলেন কবি, তেমন তাঁর তৈরি খাবারের নামও বদলে দিয়েছেন, এমনও হয়েছে। একদিন রবীন্দ্রনাথকে একটা মিষ্টি তৈরি করে খাওয়ালেন মৃণালিনী। ওই মিষ্টির নাম বাঙাল ভাষায় ‘এলোঝেলো’ শুনে নাক সিঁটকোলেন রবীন্দ্রনাথ। তারপর তার নাম রাখলেন ‘পরিবন্ধ’।
সাজতে লজ্জা পেতেন কবির সামনে
একেবারেই সাধারণ সাজগোজে থাকতেন মৃণালিনী। খুব বেশি সাজগোজ পছন্দ করতেন না রবীন্দ্রনাথ নিজেও।
সম্ভবত তাই তাঁর সামনে গয়নাগাটি পরতেও লজ্জা পেতেন মৃণালিনী। হেমলতা ঠাকুর লিখেছেন, একদিন তাঁদের ধরাধরিতে দুই কানে দুই দুল ঝোলানো বীরবৌলি পরেছিলেন মৃণালিনী। হঠাৎ রবীন্দ্রনাথ এসে পড়ায় দুই হাত চাপা দিয়ে আড়াল করে ফেললেন দুল। সমবয়েসি বাড়ির বৌদের সাজতে বলেও মৃণালিনী নিজে থাকতেন অতি সাধারণভাবে।
তবে তাঁর হয়ত ইচ্ছে হতো রবীন্দ্রনাথকে একটু সাজিয়ে দেবার। স্বামীর জন্য তাঁর জন্মদিনে একবার সাধ করে গড়িয়ে আনলেন সোনার বোতাম।
রবীন্দ্রনাথ দেখে বললেন, ‘ছি ছি ছি, পুরুষে কখনো সোনা পরে-- লজ্জার কথা!’
শুনে, মৃণালিনী সেই বোতাম ভেঙে ওপাল বসানো বোতাম গড়িয়ে দিলেন। আর প্রায় দায়ে পড়ে সেই বোতাম কিছু দিন ব্যবহার করলেন রবীন্দ্রনাথ।
আর একবার, বিয়ের তিন মাস পর, কলকাতা জাদুঘরের প্রথম প্রদর্শনী দেখতে অন্যদের সঙ্গে যাবেন মৃণালিনী। পরেছেন বাসন্তী রঙের জমিতে লাল ফিতের উপর জরির কাজ করা পাড় বসানো একটা শাড়ি। হাতে একটা পাত্রে মিষ্টি খেতে খেতে হাজির হলেন রবীন্দ্রনাথ। সুন্দর সাজে মৃণালিনীকে দেখে তারপর চড়া সুরে গেয়ে উঠলেন, ‘হৃদয়কাননে ফুল ফোটাও,/ আধো নয়নে সখি, চাও চাও!’
হারিয়ে গেলেন বালি-সমুদ্রে
১৮৯৮ সালের ৩ অগস্ট পাঁচ ছেলেমেয়েকে নিয়ে পাকাপাকি ভাবে জোড়াসাঁকো থেকে শিলাইদহে বসবাসের জন্য গেলেন মৃণালিনী। গৃহবিদ্যালয় খুলে ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা শেখানোয় সেখানে যেমন মন দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ, তাদের স্বনির্ভর করে তুলতে ঘরের কাজ শিখিয়েছিলেন মৃণালিনী।
রবিবার বাড়ির কাজের লোকদের ছুটি দিতেন তিনি। কাজেই বাড়ির কাজে সেদিন হাত লাগাতে হতো সকলকে। রবীন্দ্রনাথ যেমন দুর্বল ছিলেন তাঁর দরিদ্র প্রজাদের প্রতি, গরিব মানুষ সাহায্যপ্রার্থী হলে তাঁকে ফেরাতে পারতেন না মৃণালিনীও।
এভাবেই রবীন্দ্রনাথের অনুপস্থিতিতেই শিলাইদহে এক দরিদ্র পঞ্জাবি মূলা সিংহকে মাসিক পনেরো টাকা মাইনেতে বাড়ির দারোয়ানের চাকরি দিয়েছিলেন মৃণালিনী। ঠাকুর এস্টেটের স্বল্পবেতনভোগী আমলা আর কর্মীদের জন্য সরকারি তহবিল থেকে খুলে দিয়েছিলেন একটি মেস। কুঠিবাড়িতেই নিজে করেছিলেন শাক সবজির বাগান।
বলেন্দ্রনাথকে খুবই স্নেহ করতেন মৃণালিনী। শিলাইদহে একবার বলেন্দ্রনাথ আর এক সহচরীকে নিয়ে প্রকৃতি আর পাখির চানে পদ্মার বালি-সমুদ্রের গভীরে হারিয়ে যান মৃণালিনী।
বহু চেষ্টার পর একদল মৎস্যজীবীর কল্যাণে তাঁরা ফেরার পথ খুঁজে পান। পদ্মার বোটে কখনও সন্ধে হলেই সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর সুর বাঁধতেন এস্রাজে। পালা করে গান গাইতেন রবীন্দ্রনাথ, চিত্তরঞ্জন দাশের বোনঅমলা। শিলাইদহে মৃণালিনীর দুই প্রিয়পাত্র বলেন্দ্রনাথ ও নীতিন্দ্রনাথের অকাল মৃত্যুতে গভীর শোক পেয়েছিলেন কবি-পত্নী। বলেন্দ্রনাথের মৃত্যুর পরই আর শিলাইদহে থাকতে চাননি মৃণালিনী। চলে আসেন প্রথমে কলকাতায়। তারপরে শান্তিনিকেতনের নির্জনতায়।
দুই মেয়ের বিয়ে দেখে গিয়েছিলেন
দুই মেয়ের বিয়ে দেখে গিয়েছিলেন
বিয়ের পরই মৃণালিনীকে দেখতে হয়েছিল কাদম্বরী দেবীর অস্বাভাবিক মৃত্যু। সম্ভবত নীরবেই তিনি সামলেছিলেন স্বামীর প্রিয়বৌঠানের অপমৃত্যুর গভীর সেই শোক।
রবীন্দ্রনাথের মতো নিজের সন্তানদের মৃত্যু অবশ্য দেখে যেতে হয়নি মৃণালিনীকে।
বড় মেয়ে বেলা আর মধ্যম কন্যা রেণুকার বিয়ে দেখে যেতে পেরেছিলেন।
কবি বিহারীলাল চক্রবর্তী পণ নিয়ে ছেলে শরৎচন্দ্রের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিলেন পনেরো বছরের কন্যা মাধুরীলতার।
পণ নিয়ে পাত্রপক্ষের রীতিমতো দর কষাকষিতে বিরক্ত হয়েছিলেন মৃণালিনী। বিয়ের আগে ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষা নেওয়ার পর দশ হাজার পাঁচ টাকা যৌতুক দিয়ে বরকে আশীর্বাদ করেছিলেন মহর্ষি।
বেলার বিয়ে হয়েছিল ১৯০১-এর ১৫ জুন। আর সেবছরই ৯ অগস্ট তিনদিনের ব্যবস্থাপনায় বিলেতযাত্রী সত্যেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের সঙ্গে রেণুকার বিয়ে দিলেন রবীন্দ্রনাথ। অতি কোমল স্বভাবের রেণুকার বয়েস তখন সাড়ে এগারো বছর। স্বামীর হঠাৎ খেয়ালে ঠিক করে আসা মেয়ের বিয়ের খবর জেনে অবাক হলেও বিয়েতে অমত করেননি মৃণালিনী। নিজের জীবদ্দশায় তাঁকে দেখে যেতে হয়নি এই দুই বিয়ের করুণ পরিণতি।
রবিপ্রিয়া |
আশ্রমের জন্য বেচলেন গায়ের গয়না
মূলত নিজের ছেলেমেয়েদের শিক্ষা দিতেই পূর্ববঙ্গ ছেড়ে শান্তিনিকেতনে খোলামেলা প্রকৃতির মধ্যে শাসন আর প্রথার সীমানাবিহীন এক বিদ্যালয় খুললেন রবীন্দ্রনাথ।
১৯০২ সালে তারই সূচনা হল ব্রহ্মচর্যাশ্রম হিসেবে।
জুটে গেল পরিবারের বাইরে থেকে আসা জনাকয়েক ছাত্রও।
কলকাতার শহর আর বিশাল ইমারত ছেড়ে মৃণালিনী গিয়ে উঠলেন রুক্ষ বীরভূমে শান্তিনিকেতনের অতিথিনিবাসে।
আশ্রম বিদ্যালয় গড়ে তুলতে হাত মেলালেন স্বামীর সঙ্গেই। রবীন্দ্রনাথের বিদ্যালয় নিয়ে নিজের বাড়ির লোকেদের থেকে অনেক বিদ্রুপ আর বিরুদ্ধতা সহ্য করতে হয়েছিল মৃণালিনীকে। তবু বিদ্যালয়ের কাজে যখনই অর্থের অভাব দেখা দিয়েছে, নিজের গায়ের গয়না বিক্রি করে রবীন্দ্রনাথকে টাকা এনে দিয়েছেন মৃণালিনী। রথীন্দ্রনাথ লিখেছেন, এইভাবে ‘শেষপর্যন্ত হাতে সামান্য কয়েকগাছা চুড়ি ও গলায় একটি চেন ছাড়া তাঁর কোনো গয়না অবশিষ্ট ছিল না। মা পেয়েছিলেন প্রচুর, বিবাহের যৌতুক ছাড়াও শাশুড়ির পুরানো আমলের ভারী গয়না ছিল অনেক। শান্তিনিকেতনের বিদ্যালয়ের খরচ জোগাতে সব অন্তর্ধান হল।’
রবীন্দ্রনাথের ইচ্ছেয় অন্য ছাত্রদের সঙ্গে রথীন্দ্রনাথও তখন থাকতেন আশ্রমের ছাত্রাবাসে।
রবীন্দ্রনাথের ইচ্ছেয় অন্য ছাত্রদের সঙ্গে রথীন্দ্রনাথও তখন থাকতেন আশ্রমের ছাত্রাবাসে।
ছেলেকে নিজে রেঁধে খাওয়াতে পারেন না বলে মন খারাপ হত মৃণালিনীর।
আশ্রমে সাপ্তাহিক ছুটির দিন বুধবার। সেইদিন রথী আর অন্য সমস্ত ছাত্রকে বাড়িতে ডেকে নিজে রেঁধে খাওয়াতেন মৃণালিনী। তারা নাকি ‘লুঠ’ করে নিয়ে যেত ভাঁড়ার ঘরে আলমারির যাবতীয় খাবার।
শেষ যেন এক চিঠির গল্প
২৯ অগস্ট। ১৮৯০। প্রবাস যাত্রায় জাহাজ থেকে মৃণালিনীকে একটা চিঠিতে মা হারা দু-তিনজন ছোট মেয়ে আর তার অসহায় বাবার গল্প শুনিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। লিখেছিলেন, ‘আমাদের জাহাজে দুটো তিনটে ছোট ছোট মেয়ে আছে-- তাদের মা মরে গেছে, বাপের সঙ্গে বিলেত যাচ্চে। বেচারাদের দেখে আমার বড় মায়া করে। তাদের বাপটা সর্বদা তাদের কাছে কাছে নিয়ে বেড়াচ্চে...।’
চলতি পথের এই বিষাদগাথা যে একদিন তাঁর নিজের জীবনেরই গল্প হয়ে উঠবে সম্ভবত স্বপ্নেও তা কল্পনা করেননি রবীন্দ্রনাথ। ১৯০২-এর মাঝামাঝি এতই অসুস্থ হয়ে উঠলেন মৃণালিনী, যে ১২ সেপ্টেম্বর তাঁকে নিয়ে যেতে হল কলকাতায়।
প্রায় দুই মাস তাঁর নিরলস সেবা করলেন রবীন্দ্রনাথ। অসুখ ধরা না পড়ায় হোমিওপ্যাথির চিকিৎসা হল। শেষ রক্ষা হল না তাতেও। লালবাড়ির এক কোনায় মৃণালিনীর ঘরে তাঁকে রাতদিন পাখার বাতাস করতেন রবীন্দ্রনাথ।
রেলপথে কলকাতায় নিয়ে আসা হয়, শান্তিনিকেতন থেকে তার সঙ্গে সেদিন রথীন্দ্রনাথ ছাড়াও সম্ভবত ছিলেন দ্বিপেন্দ্রনাথ ঠাকুর। রথীন্দ্রনাথ লিখে রেখেছেন মৃণালিনীর শান্তিনিকেতন থেকে সেই শেষ যাত্রার বর্ণনা। মা শুয়ে আছেন,তাঁর পাশে বসে রথীন্দ্রনাথ দেখছেন তালগাছের শ্রেণি, বুনো খেজুরের ঝোঁপ, বাঁশঝাড়ে ঘেরা গ্রামের পর গ্রাম, মোষের পিঠে বসা শিশু। একসময় চোখে পড়ল মাঠের মাঝে অর্ধেক বোজা এক পুকুর। তার ভিতর ফুটে আছে অসংখ্য সাদা পদ্ম। রথীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘দেখে এতো ভালো লাগল, মাকে ডেকে দেখালুম. তারপর কত বছর গেছে, প্রতিবারই বোলপুর-কলকাতা যাতায়াতের সময় সেই পদ্মপুকুর দেখার চেষ্টা করি— কেবল দেখতে পাই--পুকুরে জল নেই, মাটি ভরে মাঠের সঙ্গে পুকুর সমান হয়ে গেছে, পদ্ম সেখানে আর ফোটে না।
১৯০২-এর ২৩ নভেম্বর সব চেষ্টা ব্যর্থ করে রাত্রে চলে গেলেন কবিপত্নী মৃণালিনী।
১৯০২-এর ২৩ নভেম্বর সব চেষ্টা ব্যর্থ করে রাত্রে চলে গেলেন কবিপত্নী মৃণালিনী।
সারাটা রাত ছাদে একা পায়চারি করে কাটালেন রবীন্দ্রনাথ। বলে গেলেন কাউকে তাঁর কাছে না যেতে। নিভে গেল জোড়াসাঁকোর লালবাড়িতে মৃণালিনীর ঘরের সব আলো। রইলেন এক আকুল কবি আর মা-হারা তাঁর পাঁচটি ছেলেমেয়ে। ভিড়ে, আদরের আড়ালে আর রইল নিজের অনুবাদের খাতার শেষ মলাটে দেবনাগরী অক্ষরে মৃণালিনীর নিজের হাতে লিখে রাখা, অনিঃশেষ ভালবাসা আর বেদনায় ভেজা এক কবির সংসারের সাতটি তারার নাম।
ঋণ:মৃণালিনী দেবী (রবীন্দ্রভবন কর্তৃক সংকলিত), মৃণালিনী দেবী: রবীন্দ্র কাব্যে ও জীবনে
(প্রজ্ঞাপারমিতা বড়ুয়া), চিঠিপত্র : প্রথম খণ্ড (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর), রবীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথ (পূর্ণানন্দ চট্টোপাধ্যায়), মর্মের গেহিনী কবিপত্নী মৃণালিনী (সবুজকলি সেন)
http://www.anandabazar.com/supplementary/patrika/mrinalini-1.499542
No comments:
Post a Comment