খুশি হলে এমন করে হাতটা জাপটে ধরতেন! তখন মনের সবটুকু উষ্ণতায় মাখামাখি থাকত ওঁর দুই হাতের তালু।
মজাও কি কম করতেন!
সে মজা চলত স্টেজেও।
একবারের ঘটনা বলি।
ভালবাসতেন জমিয়ে খেতে। একা নয়, সবার সঙ্গে। তাই স্টেজে ওঠার আগে সবাই মিলে ভাল করে মাংস-রুটি খাওয়াটা ছিল দস্তুর।
একবার নাটক চলছে। স্টেজে রাধারমণ তফাদার আর অজিতবাবু। হঠাৎই সংলাপ শেষ করে পিছন দিকে রাধারমণকে দেখেই, অজিতবাবু মুখ বেঁকিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে উঠলেন, ‘‘ভাগ্যিস থিয়েটার করতে এলে। তাই না প্রায়ই মাংসটাংস খেতে পাচ্ছ!’’ ভাবুন একবার!
অজিতবাবুকে প্রথম দেখি মুক্তাঙ্গন-এ। তখন তিনি রীতিমত ‘অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়’! নান্দীকার ‘নাট্যকারের সন্ধানে ছ’টি চরিত্র’ করছে। আমি সবে থিয়েটারের অ-আ-ক-খ-র নেশায় পড়েছি। তবে প্রেসিডেন্সিতে পড়া, ফিল্ম ক্লাব করা, বাড়িতে উঠতে বসতে রাজনীতির গল্প শোনা যুবক। পাড়ায় নাটক করি। আমার বন্ধু অশোক মুখোপাধ্যায়, চিন্ময় রায় তখন নান্দীকার-এর সদস্য। ওরাই বলল নাটকটার কথা।
গেলাম দেখতে।
ফিরলাম ‘বোল্ড আউট’ হয়ে। 
এর ঠিক দু’বছর বাদের কথা। তখন দমদমে থাকি। সাতগাছিয়া-র ত্রিপল ফ্যাকটরি-তে নাটক প্রতিযোগিতা। ‘জাজ’ হয়ে এলেন অজিতবাবু। প্রতিযোগিতায় আমরা নাটক করলাম অজিত গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘নব স্বয়ংবর’। ফার্স্ট হলাম।
তার কিছু দিন পরেই ‘নান্দীকার’ থেকে আমার ডাক এল। পরে শুনেছিলাম নেপথ্যের কারণ। চিনু, মানে চিন্ময় রায় কিছু পারিবারিক কারণে নিয়মিত ‘শো’ করতে পারছিল না। এদিকে সেই ‘সাতগাছিয়া’র প্রতিযোগিতা থেকেই অজিতবাবুর আমাকে মনে ছিল। উনিই আমায় ডাকতে বলেছিলেন। তো, গেলাম।
সেই-ই আমার প্রথম গ্রুপ থিয়েটারে সিরিয়াস নাট্যর্চচার শুরু। চিনুর মতো হালকা রসে জমানো অভিনয় করতে পারলাম না বটে, তবে কাজ চালিয়ে দিলাম। আর ধীরে ধীরে অজিতবাবুর নজরে পড়ে গেলাম।  এক সময় দলের সেক্রেটারি হতে বললেন। রাজি হইনি।....খামোকা কেনই বা! তাতে বোধহয় রাগ হল ওঁর। কিন্তু দেখলাম, দলের নতুনদের নিয়ে অদ্ভুত একটা প্রজেক্ট নিলেন। একাঙ্ক করবে দলের নতুনরা।
আন্তন চেকভের নাটক ‘প্রোপোজাল’ করলাম। অজিতবাবুরই অবলম্বন। নাম ‘প্রস্তাব’।
প্রস্তুতির শেষ মুর্হূতে ডাকলাম দেখতে। টুকটাক কিছু সাজেশন দিলেন। তাতেই দেখলাম আগাগোড়া  নাটকটাই পাল্টে গেল। এমনই একটা সময়ে রুদ্র (রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত) আর আমি যৌথ ভাবে আর্নল্ড ওয়েস্কারের ‘রুটস’-এর শেষাঙ্কটা করলাম। অজিতবাবু তাতে এতই প্রভাবিত হলেন, লিখে ফেললেন নতুন নাটক ‘যখন একা’।  এর মাঝে ‘মঞ্জরী আমের মঞ্জরী’ হয়ে গেল। চেকভের ‘চেরি অর্চার্ড’। ওঁরই অবলম্বন। প্রথম যখন থিয়েটারটার কথা ভাবছেন, মনে আছে, গল্প বললেন একদিন। অমন গল্প-বলিয়ে আমি কস্মিনকালেও দেখিনি।
ঠিক হল, শুধু চেকভের থিয়েটার করব না, তাঁকে ভাল করে জানতেও হবে। এমনকী দর্শককেও জানাব।
তখন পবিত্র (সরকার) এসে গেছে দলে। অজিতবাবু ওকেই ভার দিলেন, ‘কেন চেকভ, কী চেকভ’ ইত্যাদি নিয়ে লেখা তৈরি করতে। পুস্তিকা হবে। ছাপানোর ভার আমার। তত দিনে ‘গুরু’ মেনে ফেলেছি লোকটাকে। যদিও মাত্র চার বছরের বড়।  বারবার বলতেন, থিয়েটার করবে মনের আনন্দে, পয়সার কথা ভেবে নয়। থিয়েটার হল গরিবের বি‌নোদন।
আর অজিতবাবুর মন? এত দরাজ, এত পরার্থপর মানুষ খুব কম দেখেছি। ঘরেও যেমন, বাইরেও তেমন। শুধু ওঁর অর্থ সাহায্যর কাহিনিগুলোই যদি সাজাই, উপন্যাস হয়ে যাবে।
সব ব্যাপারেই মানুষটা যেন একটু অন্যরকম। এমনকী অভিনয় শেখানোর ধরনেও।
‘হাটেবাজারে’ ছবিতে অশোককুমারের সঙ্গে
একবারের কথা মনে পড়ে। ‘মঞ্জরী আমের মঞ্জরী’র রিহার্সাল হচ্ছে। আমি ‘তাপস’ করতাম। তাপসের কথা বলার ঢং একটু বক্তৃতা গোছের। তা, আমি সংলাপ আওড়াতে গিয়ে কথা আর বক্তৃতার দরকারি মিশেলটা কিছুতেই বাগে আনতে পারছিল‌াম না। মহলার মাঝেই রুদ্র ঢুকল ঘরে। অজিতবাবু আমায় থামালেন। তখন নান্দীকার-এ একটা বড় প্ল্যানিং চলছে। দল ‘কাশী বিশ্বনাথ মঞ্চ’টা নেবে কি নেবে না। আগের দিনই মিটিং হয়েছে। রুদ্র সেখানে ছিল না। অজিতবাবু বললেন, ‘‘থামুন তো বিভাস, রুদ্রকে কালকের ব্যাপারটা একটু ব্রিফ করে দিন!’ থামলাম। গড়গড় করে বলতে লাগলাম। এবারও আমায় থামালেন অজিতবাবু। বললেন, ‘‘এই, এইটাই হবে তাপসের বলার ঢং। এবার ক্লিয়ার তো?’’
তখন অজিতবাবু  থাকেন শ্যামবাজার ট্রামডিপোর উলটো দিকে, একটা গলিতে। স্ত্রী লীলা বন্দ্যোপাধ্যায়ও ওঁর সঙ্গে। আমাদের লীলা বৌদি। দু’জনেই পার্টি করেন। নান্দীকার-এ রুদ্র তখন তত নিয়মিত নয়। কেয়াও (চক্রবর্তী) না। আমরা শুধু দিনে দিনে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে পড়েছি থিয়েটারে। তখনই ছন্দপতন!
অজিতবাবুর সঙ্গে এমন একটা সৌহার্দ্যের সম্পর্ক, তা সত্ত্বেও ওঁর প্রতি অনেক অভিযোগ মনে পুষে ১৯৬৬ সালে দল ছাড়লাম।
বছর কয়েক পরে একজন আমায় জিজ্ঞেস করেছিল, ‘‘কেন ছেড়েছিলেন বলুন তো? কী অভিযোগে?’’ বলেছিলাম, ‘‘সেদিন যে অভিযোগ ছিল অজিতবাবুর প্রতি, আজকে হয়তো আমার দলের কেউ আমার প্রতি সেই একই অভিযোগ করে!’’
চোদ্দো জন একসঙ্গে ছেড়েছি‌লাম ‘নান্দীকার’। প্রচণ্ড অভিমান করেছিলেন। আমি বেরিয়ে গিয়ে ‘থিয়েটার ওর্য়াকশপ’ করলাম। কিছুতেই আসতেন না আমাদের নাটক দেখতে। আমিই দেখা করতাম। রঙ্গনা-য় যখন ‘নান্দীকার’ শো করতে শুরু করল, ম‌নে পড়ে গ্রিনরুমে বসে কত আড্ডা দিয়েছি! কেয়াকে দেখতাম, স্টেজে ওঠার আগে এসে অজিতবাবুকে প্রণাম করে যেতে। গৃহদেবতার কাছে যেম‌ন গেরস্ত করে, ঠিক তেমনই।
অজিতবাবু আবৃত্তি করতেন। কবিতা লিখতেন। যাত্রায় গেলেন। সিনেমায় গেলেন। তার মধ্যেই অজিতদা-লীলাবোদি সম্পর্কে ভাঙন এল। নাটকেরই এক সহকর্মীর স্ত্রী রত্না বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে থাকতে শুরু করলেন বেলেঘাটায়। ঘটনাটা যে আমায় খুব ভাবাল, এমন নয়। কিন্তু অজিতবাবুকে যে ভাবে ‘নান্দীকার’ ছাড়তে হল, মানতে পারিনি কোনওদিন।
‘থিয়েটার ওয়ার্কশপ’-এর দুটো নাটকের শো করলাম। ‘শোয়াইক গেল যুদ্ধে’, ‘চাক ভাঙা মধু’।
সেই প্রথম বার নাটক দেখতে এলেন আমাদের। গ্রিনরুমে এসে কাছে ডাকলেন। চোখটা বুজে জড়িয়ে ধরলেন বুকে। অ‌‌নেকক্ষণ!
আমি দূরদর্শন-এ ঢুকলাম। ১৯৭৫ সালের ৯ অগস্ট টেলিকাস্ট শুরু হল। তখন ‘গুরুদক্ষিণা’ দেওয়ার সুযোগ এল। প্রথম থিয়েটার দেখানো শুরু হতেই ‘নানা রঙের দিন’ করালাম ওঁকে ডেকে।
১৯৮৩ সাল। অক্টোবর মাস। দুর্গাপুজোর অষ্টমী না নবমী। সাতসকাল। আমি তখন সবে গল্ফ গ্রিনের ডেরায় উঠে এসেছি। কাকভোরে দরজায় বেল। খুলেই দেখলাম বিধ্বস্ত চেহারায় দাঁড়িয়ে রমা। রমাপ্রসাদ বণিক। ওর বাড়ি আমার থেকে অল্প দূরে।
ভাঙা ভাঙা অস্পষ্ট ঘড়ঘড়ে গলায় রমা বলল, ‘‘বিভাসদা, অজিতদা কাল রাতে...।’’
‘‘মানে? কী বলছিস তুই!’’ স্বজনহারা যন্ত্রনায় ডুকরে উঠলাম।
ছুটলাম বেলেঘাটায়। শুয়ে আছেন অজিতবাবু।  হাতটা জাপটে ধরলাম। কী ঠান্ডা! উষ্ণতা নিভে যাওয়া হিমশীতল তালুটা আমায় হু হু কান্নায় ভাসিয়ে দিল। 


http://www.anandabazar.com/supplementary/patrika/some-unknown-facts-about-actor-ajitesh-bandopadhyay-1.573620