Monday, 27 March 2017

কবিপুত্র (On Rathindranath Tagore)

$image.name

কবিপুত্র

ঠাকুর পরিবারে প্রথম বিধবা বিবাহের পাত্র তিনি। আবার কোনও এক ফেব্রুয়ারি মাসে সেই দাম্পত্য জীবন ঘিরেই আসে তাঁর এক ভয়ঙ্কর স্বীকারোক্তি! রবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর-কে নিয়ে লিখছেন নীলাঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়

১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ০০:০০:০০

Rathindranath Tagore

জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে সকলের যা-ইচ্ছে-তাই লেখার একটা খাতা ছিল। ‘পারিবারিক খাতা’।
১৮৮৮-র নভেম্বরে হিতেন্দ্রনাথ সেখানে লিখলেন, তাঁর রবিকাকার মেয়ে হবে না। হবে মান্যবান, সৌভাগ্যবান, রবীন্দ্রনাথের চেয়েও গম্ভীর একটি ছেলে। সে-মাসেরই ২৭ নভেম্বর, মৃণালিনী আর রবীন্দ্রনাথের দ্বিতীয় সন্তান হিসেবে এলেন রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর। গায়ের রং সেই তখন থেকেই চাপা। পেরিয়ে যাই বছর কয়েক।
সাত-আট বছর বয়সে একবার শিলাইদহ থেকে রথী ফিরে এলেন রোদে জলে পুড়ে। যেন আরও একটু ‘কালো’ হয়ে। পাশেই গগনেন্দ্রনাথদের বাড়িতে জ্যাঠাইমাকে প্রণাম করতে গেলেন। তিনি বললেন, ‘‘ছিঃ, রবি তাঁর ছেলেকে একেবারে চাষা বানিয়ে নিয়ে এল।’’
কথাটা সে দিন খুব মনে লেগেছিল রথীন্দ্রনাথের। এতটাই যে, তার পর থেকে ওই বাড়ি যাওয়াই ছেড়ে দিলেন তিনি। আর এমনই কাণ্ড, বাংলার পল্লিমঙ্গলের স্বপ্ন দেখে, সেই ‘চাষা’ হয়ে ওঠার পাঠ নিতেই, ছেলেকে তার পর একদিন সত্যি-সত্যি বিদেশে পাঠিয়ে দিলেন রবীন্দ্রনাথ!

আশ্রম থেকে আমেরিকায়
১৯০৬। স্বদেশি আন্দোলনের ঢেউ তখন তুঙ্গে। রথীন্দ্রনাথ আর আশ্রমে তাঁর সহপাঠী সন্তোষচন্দ্র মজুমদারকে রবীন্দ্রনাথ পাঠিয়ে দিলেন ছাত্রদের এক দলের সঙ্গে জাপানে। কিছু দিন পর দু’জনে পৌঁছলেন আমেরিকার আর্বানায়, ইলিনয়ের স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখান থেকেই হয়েছিলেন কৃষিবিজ্ঞানে স্নাতক।
১৯০৭-এ আমেরিকা থেকে রথী বাবাকে পরীক্ষার জন্য পাঠাতে লিখছেন একবার ফসল দিয়ে ঝিমিয়ে-পড়া মাটি। জানাচ্ছেন, বিদেশে তিনি যে কেবল মাটিই ‘বিশ্লেষ’ করছেন তা নয়, পরীক্ষা চলছে শস্য এবং পশুখাদ্য নিয়েও।
২১ জুন ১৯০৮। ছেলেকে রবীন্দ্রনাথ আক্ষেপ করে লিখলেন, ‘‘...আমাদের দেশের হাওয়ায় কী চাষা কী ভদ্রলোক কোনও মতে সমবেত হতে জানে না। তোরা ফিরে এসে চাষাদের মধ্যে থেকে তাদের মতিগতি যদি ফেরাতে পারিস তো দেখা যাবে।’’

ফিরেই হলেন ‘চাষা’
বাবাকে নিরাশ করলেন না রথী। রবীন্দ্রনাথের ডাকে জমিদারি দেখাশোনার কাজে ১৯০৯-এ ফিরে এলেন শিলাইদহের কুঠিবাড়িতে।
রবীন্দ্রনাথ যেন এই সময় একেবারে আঁকড়ে ধরলেন রথীকে। তাঁকে চেনালেন বাংলার পল্লিসমাজ।
ছেলের মুখে কৃষিবিদ্যা, প্রজননশাস্ত্র, অভিব্যক্তিবাদের কথা শুনতেন খুব মন দিয়ে।
রথীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘‘১৯১০ সালের সেই সময়টাতে আমরা পিতাপুত্র পরস্পরের যত কাছাকাছি এসেছিলাম তেমন আর কখনো ঘটে নি।’’
শিলাইদহে রথীন্দ্রনাথ গড়ে তুললেন প্রশস্ত খেত। মাটি পরীক্ষার গবেষণাগার। বিদেশ থেকে আমদানি করলেন ভুট্টার এবং গৃহপালিত পশুর খাওয়ার মতো ঘাসের বীজ। তৈরি করালেন দেশের উপযোগী লাঙল, ফলা, আর নানা যন্ত্রপাতি।
আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের কাছ থেকে পাতিসরের জন্য চেয়ে আনলেন একটা ট্রাক্টর। চালাতেন নিজেই।
বাংলার কৃষি আর কৃষকের হাল ফেরাতে যখন ঝাঁপিয়ে পড়েছেন রথী, তখন আবার এল রবীন্দ্রনাথের ডাক। এ বার নাকি তাঁর বিয়ে!

এলেন প্রতিমা
মৃণালিনী রথীর বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন গগনেন্দ্রনাথ-অবনীন্দ্রনাথের ভাগ্নী প্রতিমার সঙ্গে। ছেলের বিয়ে দিতে তখনই রাজি হননি রবীন্দ্রনাথ।
১৯১০-এ তত দিনে বাল্যবিধবা সেই প্রতিমাকেই ঘরে আনা ঠিক করে, রথীকে খবর পাঠালেন রবীন্দ্রনাথ।
পাঁচ বছরের ছোট প্রতিমার গুণে যে তিনি পাগল, সে-কথা  জানিয়ে ভগ্নিপতি নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়কে রথীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘‘প্রতিমা এখন আমার... সে কী চমৎকার মেয়ে তোমাকে কী করে লিখি।’’
আর একবার খোদ প্রতিমাকেই লিখেছিলেন, ‘‘আমি কখনই একজন কুশ্রী মেয়েকে সম্পূর্ণ ভালবাসতে পারতুমনা— আমার সে দুর্ব্বলতা আমি স্বীকার করছি।’’
২৭ জানুয়ারি ১৯১০। হল বিয়ে। নিজের বিয়ে নিয়ে স্মৃতিকথায় লিখেছিলেন, ‘‘আমাদের পরিবারে এই প্রথম বিধবা বিবাহ।’’
বিয়ের কয়েক মাস পর প্রতিমাকে শিলাইদহে নিয়ে এলেন রথী। এর পর হঠাৎ একদিন আবার ডাক রবীন্দ্রনাথের!
শান্তিনিকেতনে আশ্রমবিদ্যালয়ে এ বার তাঁর দরকার রথীকে!
কুঠিবাড়ির চার দিকের গোলাপ বাগিচা, একটু দূরে সুদূরবিস্তারী খেত, সেই পদ্মা নদী, সেই কত সুখদুঃখের কাহিনি মোড়া বজরা... বাবার এক ডাকে সব ছেড়ে এলেন রথীন্দ্রনাথ। তাঁর নিজের কথায়, ‘‘এই-সব যা কিছু আমার ভাল লাগত— সেই সব ছেড়ে আমায় চলে যেতে হল বীরভূমের ঊষর কঠিন লাল মাটির প্রান্তরে।’’

জাগিয়ে তোলার ভার
২ মে ১৯১০-এ লেখা এক চিঠিতে অনভিজ্ঞ, ‘ছেলেমানুষ’ প্রতিমার প্রতি রথীন্দ্রনাথের কর্তব্য তাঁকে মনে করিয়ে দিলেন রবীন্দ্রনাথ। লিখেছিলেন, ‘‘... তার চিত্তকে জাগিয়ে তোলবার ভার তোকেই নিতে হবে— তার জীবনের বিচিত্র খাদ্য তোকে জোগাতে হবে। তার মধ্যে যে শক্তি আছে তার কোনোটা যাতে মুষড়ে না যায় সে দায়িত্ব তোর।’’ কিন্তু ভিতরে-ভিতরে কোথাও মুষড়ে পড়েছিলেন যেমন রথী, তেমনই প্রতিমা। এতটাই যে, এক চিঠিতে স্ত্রীকে রথীন্দ্রনাথ জানালেন, ‘‘কতদিন বোলপুরের মাঠে একলা পড়ে যে কেঁদেছি তা কেউ জানে না। তুমিও না।’’
চাইলেও নিজেকে মেলে ধরতে না পারার অক্ষমতার কথা জানিয়ে লিখলেন, ‘‘ভগবান আমাকে বোবা করে জন্ম দিয়েছেন।’’

লজ্জা ভাঙানোর ডাক
প্রতিমাকে লেখা রথীন্দ্রনাথের তারিখবিহীন কয়েকটা চিঠিতে বোঝা যায়, দু’জনের বোঝাপড়ার এক সময় কোথাও একটা সমস্যা হচ্ছিল।
মন খুলে দু’জনে আসতে পারছেন না কাছাকাছি। রথী লিখছেন প্রতিমাকে, তাঁর শুষ্ক, শূন্য সত্তার ভিতরেও আছে, ‘‘আর একটাকেও যে খুব ভালোবাসতে চায়, যে খুব সুন্দর হতে চায়... কিন্তু তার একটি দোষ আছে সে ভারী লাজুক।’’
তার পর প্রতিমাকেই রথী দিচ্ছেন সেই লাজুক মানুষটার আড়াল থেকে তাঁর প্রকৃতিকে টেনে বের করে আনার ভার। মনে করিয়ে দিচ্ছেন, ‘‘আর তা যদি না পারো তো চিরকাল তোমাকে কষ্ট পেতে হবে— তার জন্যে নিজেকে প্রস্তুত করো।’’
আর একবার লিখলেন, ‘‘তোর মনটা সম্পূর্ণ পাবার জন্যে আমি কিরকম ব্যাকুল হয়ে থাকি তা তুই জানিস না।’’
১৯২২-এ দু’জনের সংসারে এলেন নন্দিনী, তাঁদের পালিতা কন্যা হয়ে। ‘দাদামশায়’ রবীন্দ্রনাথের রাখা আদরের নাতনি নন্দিনীর অনেক নামের মধ্যে একটা ছিল ‘পুপে’। সম্ভাব্য নাতির জন্যও একটা নাম আগলে রেখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তেইশ বসন্ত অপেক্ষার পর ‘রাসভেন্দ্র’ নামটা কবি দিয়ে দিলেন প্রিয়ভাজন সুরেন্দ্রনাথ করকে।
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে রথীঠাকুর, প্রতিমাদেবী ও পুপে
উপাচার্য হয়েই জড়ালেন বিতর্কে
ইলিনয়ে ছাত্রজীবনে রথীর সঙ্গে পরিচয় হওয়া ভাষার অধ্যাপক আর্থার সেমুর-এর স্ত্রী মেস সেমুরকে রথীন্দ্রনাথ আগেই লিখেছিলেন, রবীন্দ্রনাথ মারা যাওয়ার পর তাঁর মূল কাজ ছিল, বিশ্বভারতীর ভাঙন ঠেকিয়ে রাখা।
এক সময় তিনি চাইলেন, বাবার স্বপ্নের প্রতিষ্ঠানকে একটা স্থায়িত্ব দিয়ে যেতে। ১ নভেম্বর, ১৯৪৮। ইংরেজি এক চিঠিতে মেস সেমুরকে লিখলেন, বিশ্বভারতীর কাজ তাঁকে আর আনন্দ দেয় না, নৈতিক কর্তব্য পালনের তাগিদেই সে কাজ করে থাকেন শুধু। বহু বছর ছিলেন কর্মসচিব।
১৯৫১-য় বিশ্বভারতী কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় হলে, রথীন্দ্রনাথ হলেন তার প্রথম উপাচার্য।
তার পরই বুঝলেন, কবির আশ্রম থেকে সরকারি প্রতিষ্ঠানে বদলে যাওয়াটা আসলে এক বিপর্যয়! ক্ষমতার রাজনীতি ছিলই, তার সঙ্গেই এ বার বিশ্বভারতীতে জুড়ে গেল নিয়মের ঘেরাটোপ!
তার মধ্যেই ব্যক্তিগত আক্রমণ আর কুৎসায় নাজেহাল হয়ে গেলেন রথীন্দ্রনাথ। আর্থিক অনিয়মের মিথ্যে অভিযোগে ফাঁসানোর চেষ্টাও হল তাঁকে। বাঁচাল আদালত।

কাল হল সাহসী বন্ধুত্ব
সব গুঞ্জনকে ছাপিয়ে গেল আশ্রমের অধ্যাপক নির্মলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় আর তাঁর স্ত্রী মীরার সঙ্গে রথীন্দ্রনাথের প্রথাভাঙা অন্তরঙ্গতা।
ও দিকে নির্মলচন্দ্র আর মীরাকে শান্তিনিকেতন থেকে সরিয়ে দেওয়ার মৌখিক পরামর্শ দিয়ে, উপাচার্য রথীন্দ্রনাথের কাছে খবর পাঠালেন আচার্য জওহরলাল নেহরু।
এতেই যেন ধৈর্যের বাঁধ ভাঙল অপমানিত রথীন্দ্রনাথের। পদত্যাগ করলেন তাঁর কাছেই।
কারণ হিসেবে লিখলেন, তাঁর শরীর খারাপ। ঠিক করলেন, বিশ্বভারতীর কলুষিত পরিবেশ ছেড়ে দূরে কোথাও চলে যাবেন।
সেই স্বেচ্ছা-নির্বাসনে তাঁকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য নির্মলচন্দ্রের কাছে তার পর তিনি করে বসলেন এক ‘অসম্ভব দাবী’। নির্মলের কাছে এক রকম সোজাসাপটা চেয়েই বসলেন বয়সে একত্রিশ বছরের ছোট মীরাকে। এই চাওয়ার কথা প্রথম স্বীকার করে চিঠি লিখেছিলেন নির্মলচন্দ্রকে। তারিখ ছিল ২২ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫৩।
১৯১৮-য় নির্মলচন্দ্র ছিলেন আশ্রমের ছাত্র, এর পর রবীন্দ্রনাথের ডাকে ১৯৩৮-এ সেখানেই ফিরে আসেন ইংরেজির শিক্ষক হিসেবে।
কোলের ছেলে জয়ব্রতকে নিয়ে মীরাকে রথীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেহরাদুনে গিয়ে বসবাসের সম্মতিও দিয়ে দিলেন তাঁর উদার-হৃদয় স্বামী। নিজে রইলেন মেয়েকে নিয়ে। যাওয়ার আগে প্রতিমাকে রথীন্দ্রনাথ লিখে গেলেন, ‘‘আমি লুকিয়ে চুরিয়ে যাচ্ছি না, এখানে সবাইকে জানিয়েই যাচ্ছি মীরা আমার সঙ্গে যাচ্ছে।’’
রথীন্দ্রনাথের নিজের কথায়, বিশ্বভারতী থেকে তাঁর ‘মুক্তি’ পাওয়ার দিন ২২ অগস্ট ১৯৫৩। আর আশ্রম ছেড়েছিলেন তার দু’-একদিন পর।

জগৎ যখন ‘মীরু’
১৯৫৩ থেকে ১৯৬১। দেহরাদুনে প্রথমে তিনটে ভাড়াবাড়ি। তার পর ’৮৯-এ রাজপুর রোডে তাঁর নিজের তৈরি বাড়ি ‘মিতালি’তেই মীরাকে নিয়ে জীবন কাটিয়ে দিলেন রথীন্দ্রনাথ।
দেহরাদুনে স্বামীর বাড়ির সামনে দিয়ে মুসুরি যাওয়ার পথে প্রতিমা একবার শুধু দেখতে পেয়েছিলেন, বারান্দা থেকে ঝুলে থাকা নতুন শাড়ি। রথীন্দ্রনাথের বোন, দাদার সঙ্গিনী মীরা প্রসঙ্গে একবার মেয়েকে লিখেছিলেন, ‘‘...ওনার সমস্ত ব্যক্তিত্ব ঐ মেয়ে গ্রাস করে নেবে।’’
এক সাময়িক বিচ্ছেদের সময় দেহরাদুনে বসে, তাঁর বেলাশেষের আলো মীরা চট্টোপাধ্যায়কে তারিখবিহীন এক চিঠিতে রথীন্দ্রনাথ লিখলেন, ‘‘আমার কেবল মীরু আছে— সে-ই আমার সমস্ত জগৎ ব্রহ্মাণ্ড। তাকে ছাড়া আমি কিছুই নই— আমার কোনও অস্তিত্ব নেই। তাকে আমার সবকিছু দিয়েছি— নিজেকেও সপেঁ দিয়েছি।’’
অন্য এক চিঠিতে মীরার সঙ্গে দেখা হওয়ার অপেক্ষায় আকুল রথীন্দ্রনাথ তাঁকে লিখছেন, ‘‘সময় যত কাছে আসছে মন আরও অস্থির হয়ে উঠছে। কী করে শান্ত করি বল তো?... তোমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হবার পর থেকে এতদিনের ছাড়াছাড়ি এই প্রথম। বাপরে আর যেন এরকম না ঘটে।’’
চিঠি লিখতেন মীরাও, তাঁর ‘রথীদা’-কে। যদিও এযাবৎ খোঁজ নেই রথীন্দ্রনাথকে লেখা মীরা চট্টোপাধ্যায়ের কোনও চিঠির। দেহরাদুনে রথীন্দ্রনাথের সঙ্গে মীরা ও তাঁর শিশুপুত্র ছাড়াও থাকতেন মীরার মা। ছুটিছাটায় মেয়েকে নিয়ে নির্মলচন্দ্র এসে ঘুরে যেতেন কখনও।

চাইলেন ভুলতে অভিমান
বিশ্বভারতী ছেড়ে তাঁর দূরে চলে যাওয়ার ইচ্ছের কথা জেনেই প্রতিমা রথীকে লিখেছিলেন, শুধু ‘‘ভাল আছ এই খবর পেলেই খুশী হব।’’ ভাল থাকার খবর দিয়ে দেহরাদুন থেকে প্রতিমাকে নিয়মিত মমতায় মাখা সব চিঠি লিখেছেন রথীন্দ্রনাথ।
ও দিকে অদৃষ্টের হাতে সব ছেড়ে দিয়েও রথীর জন্য উতলা হয়েছেন প্রতিমা।
১৯৬০। বাংলা নববর্ষের আগে প্রতিমাকে রথী লিখলেন, ‘‘আমরা দু’জনেই এখন জীবনের সীমান্তে এসে পড়েছি। এখন আর কারও প্রতি রাগ বা অভিমান পুষে রাখা (শোভনীয়) হয় না। সেইজন্য জেনো আমার মনে কোনও রাগ নেই— আমি সব ঝেড়ে ফেলেছি। আমাদের মধ্যে প্রীতি সম্বন্ধ অক্ষুণ্ণ থাকে এই নতুন বছরে তাই কামনা করি।’’

ছুঁয়ে গেলেন আশ্রমের মাটি
রতনপল্লিতে ‘ছায়ানীড়’-এ মেয়ে নন্দিনীর নিজের বাড়ি শুরু হওয়ার আগে সেখানেই রথীন্দ্রনাথ চাইলেন, নিজের মাথা-গোঁজা আর কাঠের-কাজের জন্য দু’-একটা ঘর।
বললেন, উত্তরায়ণ আর ভাল লাগে না তাঁর। বাবার শততম জন্মবর্ষে একবার এসে ছুঁয়ে গেলেন আশ্রমের মাটি।
৪ মার্চ। মেয়ের বাড়ি থেকে ফিরে যাওয়ার দিন গাড়িতে তুলে
দিতে গিয়ে, তাঁর স্বামী গিরিধারী লালার সঙ্গে নন্দিনী সেই প্রথম দেখলেন, বহু দুর্যোগে এযাবৎ অবিচল বাবার চোখে জল।
৩ মে ১৯৬১। দেহরাদুনের ‘মিতালি’তে, রবীন্দ্রনাথের শতবাৰ্ষিক জন্মদিনের দিনকয়েক আগে, চলে গেলেন প্রতিভাবান পুত্র রথীন্দ্রনাথ। নির্বিবাদী, সিংহরাশি, ‘সেবক রথী’র বিষণ্ণ জন্মপত্রীতে তখন শুধু জেগে:  ‘অমিত নবমী পূর্ব্বফল্গুনী’।

অশেষ প্রতিভার রথীঠাকুর
এঁকেছিলেন মিশ্রমাধ্যমে বহু উল্লেখযোগ্য ল্যান্ডস্কেপ আর ফুলের ছবি
চামড়ার উপর কারুকাজ, দারুশিল্পেও ছিল অনায়াস দক্ষতা
আসবাব, স্থাপত্য, উদ্যান নির্মাণেও ছিলেন অনন্য
তৈরি করতেন গোলাপ, জুঁই, মগরা সহ রকমারি ফুলের আতর আর সুগন্ধি পাউডার। তাঁর আতরের বাজারি নাম ছিল ‘Arty Perfume’
রান্নার, জ্যাম, জেলি, আচার আর দই পাতার হাত ছিল চমৎকার
চাষ করতেন মৌমাছির, নেশা ছিল শিকারেরও
গান গাইতেন, বাজাতেন এস্রাজ
চিঠি আর দিনলিপি ছাড়াও লিখেছেন কবিতা, গল্প প্রবন্ধ। ইংরেজিতে প্রকাশিত তাঁর বই “On the Edges of Time”। বাবার নির্দেশে অনুবাদ করেছিলেন অশ্বঘোষের ‘বুদ্ধচরিত’। তাঁর লেখা অন্য দুটি বই: ‘প্রাণতত্ত্ব’, এবং ‘অভিব্যক্তি’
রবীন্দ্রনাথ বিষয়ক সংবাদ কর্তিকার সংগ্রহে ইচ্ছুক হয়ে সদস্য হন লন্ডনের International Newspaper Clipping Service -এর। ছিলেন রবীন্দ্র-সৃষ্টির সংগ্রাহক

কেমন আছে ‘মিতালি’
দেহরাদুনে রথীন্দ্রনাথের বাড়ি ছুঁয়ে এলেন বিশ্বভারতীর ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য স্বপনকুমার দত্ত

দেহরাদুনে গিয়েছিলাম কর্মসূত্রে। এখানেই বিশ্বভারতীর প্রথম উপাচার্য, রথীন্দ্রনাথের বাড়ি ‘মিতালি’র কথা নানা স্মৃতিচারণে পড়েছিলাম, যেখানে কেটেছিল তাঁর শেষ জীবন। ভাবলাম খুঁজে দেখি। বেরিয়ে পড়লাম ৮৯এ রাজপুর রোডের দিকে।
খুঁজে পেলাম দোতলা একটা বাড়ি, অবশ্য রথীবাবুর বাড়ি কি না, প্রতিবেশীরাও নিশ্চিত নন। প্রকাণ্ড প্রাচীর। দুর্ভেদ্য লোহার গেট। বাড়ির ভিতর প্রাচীন গাছ। দুটো বিলাসবহুল গাড়ি...
কিন্তু না আছে নেমপ্লেট, না সে বাড়ির নম্বর! শান্তিনিকেতনের উদয়নের আদলে গড়া রথীন্দ্রনাথের ‘মিতালি’র দোতলায় ছিল অতিথিদের জন্য সাজানো ঘর। জানালায় মোড়া রথীন্দ্রনাথের ঘর থেকে দেখা যেত পাহাড়ি উপত্যকা। বাগানে ফুলগাছের বাহার, স্ট্রবেরির ছোট খেত। বাগানের চৌবাচ্চায় ফুটত নীল শালুক, ভোরবেলা ভেসে আসত বনমোরগের ডাক। রথীন্দ্রনাথ মেতে থাকতেন শিল্প বা উদ্যান চর্চায়। কখনও বাজাতেন এস্রাজ।
হাত-বদল হওয়া বাড়িটা ভেঙেচুরে বদলানো হয়েছে। ফিরে আসব, এমন সময় চোখ আটকে গেল বুজিয়ে দেওয়া জানালার উপরে সিমেন্টের নকশায়! রথীন্দ্রনাথের সিগনেচার স্টাইল, যা ছড়িয়ে আছে শান্তিনিকেতনের উদয়ন আর গুহাঘরে। দেখলাম, সিমেন্টে খোদাই করা ফুলও। ‘‘এটাই মিতালি,’’ বললাম সঙ্গী উৎসাহীদের। তার পর বিষণ্ণ মনে ফিরে এলাম স্মৃতিভারাতুর বাড়িটির সামনে থেকে।

ঋণ: পিতৃস্মৃতি (রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর), চিঠিপত্র: দ্বিতীয় খণ্ড (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর), রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর: জন্মশতবর্ষপূর্তি-শ্রদ্ধার্ঘ্য (অনাথনাথ দাস সম্পাদিত), আপনি তুমি রইলে দূরে: সঙ্গ নিঃসঙ্গতা ও রথীন্দ্রনাথ (নীলাঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়), রবীন্দ্রনাথের আত্মীয়স্বজন (সমীর সেনগুপ্ত), On the Edges of Time (Rathindranath Tagore), A Home in Urbana: Correspondences between the Tagores and Seymours (Supriya Roy Ed.) The Diaries of Rathindranath Tagore (Supriya Roy Ed.), Rathindranath Tagore: The Unsung Hero (Tapati Mukhopadhyay and Amrit Sen Ed.), বিশ্বভারতী রবীন্দ্রভবনের অভিলেখাগার, জয়ব্রত চট্টোপাধ্যায় ও সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায়ের ব্যক্তিগত সংগ্রহ

http://www.anandabazar.com/supplementary/patrika/some-unknown-facts-about-tagore-s-son-rathindranath-tagore-1.566092

গোহ পালোয়ান (On Gobor Goho)

$image.name

গোহ পালোয়ান

পুরো নাম গোবর গোহ। সাহেব মহলে পরিচয় ‘দ্য জেন্টল জায়ান্ট’। প্রবাদপ্রতিম এই মল্লবীরকে নিয়ে অবাক করা গল্পের অন্ত নেই। ১৩ মার্চ তিনি ১২৫। লিখছেন শঙ্করলাল ভট্টাচার্য

২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ০০:০০:০৬
Gobar Guha
শোনা যেত, দেহের শক্তি বাড়ানোর জন্য তাঁর খাবারে মেশানো হত সোনা-রুপো!
শরীরচর্চা করতেন গলায় ১৬০ পাউন্ডের পাথর ঝুলিয়ে!
দশাসই পালোয়ান। অথচ অতি বিনয়ী, সুবক্তা। ভালবাসতেন সেতার বাজাতে!

পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকে আর ষাটের দশকের বেশ ক’বছর দেদার পেশাদার দঙ্গল বসত রনজি স্টেডিয়ামে।
যে কুস্তিকে ডাকা হত আমেরিকান ফ্রি-স্টাইল বা শুধুই ফ্রি-স্টাইল। আর বালক, কিশোর, নব্য যুবার ঠোঁটে ঠোঁটে ঘুরত রুস্তম-এ-হিন্দ, দারা সিংহ, কিং কং, ওয়াদি আইয়ুব, সৈয়দ সৈফ শাহ গোছের সব পালোয়ানের নাম।
অথচ হাজার চেষ্টাতেও আমরা টলাতে পারিনি আমাদের জ্যাঠা-খুড়োর প্রজন্মকে। হরিনামের মতো তাঁদের জিভে লেগে ছিল একটাই নাম— গোবর গোহ।
তখন শোনা যেত, পেশাদার কুস্তির চ্যাম্পিয়ন লু-থেজ-এর সঙ্গে নাকি দু’বার ড্র করেছিলেন দারা সিংহ। তবে এই পর্যন্তই। কোথায় কী বৃত্তান্ত কিছুই জানতাম না। আমাদের সব আমোদ-আস্ফালন ছিল দারা-কিং কং মোকাবিলা নিয়ে।
কিন্তু আমাদের কাকা-জ্যাঠারা কাগজপত্তর বের করে দেখিয়ে দিতেন, গোবর গোহ ১৯২১-এর ২৩ অগস্ট সান ফ্রানসিসকোর কলিসিয়াম স্টেডিয়ামে জার্মান কুস্তিগির আড সান্টালকে চিৎ করে বিশ্ব পেশাদার লাইট হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন। তার আগে, ১৯১৩-য় রবীন্দ্রনাথের নোবেল প্রাইজ ঘোষণার সামান্য আগে, ৩ সেপ্টেম্বর এডিনবরায় বিশালদেহী জিমি এসনকে ৩৯ মিনিটে চিৎ করে ব্রিটিশ এম্পায়ার হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন হন। খেতাব সহ পেয়েছিলেন দেড় হাজার পাউন্ড ছাড়াও টিকিট বিক্রির সত্তর শতাংশ টাকা।
কাকা-জ্যাঠাদের মুখে যখন এই সব চাঞ্চল্যকর তথ্যের চর্চা চলত, তখনও কিন্তু উত্তর কলকাতার ১৯ নং গোয়াবাগান স্ট্রিটে একটা চৌচালা টালির চালার নীচে গোবরবাবু তাঁর প্রসিদ্ধ কুস্তির আখড়ায় নিজের কাঠের চেয়ারে স্বমহিমায় আসীন। বলা উচিত, স্বরাজ্যে স্বরাট।
কত গল্প তাঁকে নিয়ে বয়স্ক বাঙালির মুখে তখন। তাঁর ভাল নাম যতীন্দ্রচরণ গোহ আর ক’জন উচ্চারণ করে! গোবর গোহ তো গোবর গোহই। শক্তির প্রসঙ্গ উঠলে যেমন চলে আসে স্যান্ডোর নাম, বড় ও ছোট গামা, গোলাম পালোয়ান, করিম বখশের কথা, তেমনই বাঙালির গৌরব এক ও অদ্বিতীয় গোবরবাবুর লীলাকীর্তন। বড় বাঙালির নাম করতে হলে তাঁরা কর গুনে বলতে থাকেন সত্যেন বোস, মেঘনাদ সাহা, উদয়শঙ্কর, যামিনী রায়, আলাউদ্দিন খান, ভীষ্মদেব, গোবর গোহ...
গোবরবাবুর আখড়ার থেকে দু’গলি পেরিয়ে ৪নং ঈশ্বর মিল লেন। সেখানে নিবাস বিজ্ঞানাচার্য সত্যেন্দ্রনাথের,  যিনি মাঝেমধ্যেই আখড়ায় চলে আসেন, চা নিয়ে আড্ডায় বসতে। তা নিয়েও গপ্পো কিছু কম না। আসলে ফ্যাকড়া, এলেই গোবরবাবু ছেলে রতনকে দেখিয়ে বলেন, ‘‘ওর মগজে একটু অঙ্ক কষে দিন তো।’’ তখন সত্যেন বোসে আচ্ছন্ন রতন পালায় কোথায়!
গোবর গোহ মানেই কিন্তু গল্প, গল্প আর গল্প। সে-সবে যাওায়ার আগে মার্ক্সবাদী নেতা হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের একটা ছোট্ট স্মৃতি তুলে দিই। হীরেনবাবু লিখছেন: ‘‘১৯২৭-২৮ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ ইউনিয়নের সম্পাদক রূপে আমি তাঁকে নিমন্ত্রণ করে কলেজে আনি। তিনি এলেন— ‘ব্যূঢ়োরস্ক বৃষস্কন্ধ শালপ্রাংশু মহাভুজ’— বিরাট তাঁর মূর্তি ও ব্যক্তিত্ব, পরনে বাঙালির ধুতি পাঞ্জাবি শাল (এটা এমন সময় যখন কলেজের অধ্যাপকরাও প্রায় সকলে ‘সাহেবি’ পোশাক পরতেন!) বাঙালি জীবনে গর্বের একটা বিস্মৃত অধ্যায়...।’’
তবে গোবর গোহ বলতে যে-চেহারাটা সব বাঙালির চোখে ভাসে, সেটা ১৯২১-এ স্যান্ডো গেঞ্জি আর শর্টস পরে আমেরিকায় তোলা কুস্তির পোজের ছবি। ছ’ফুট দুই ইঞ্চি উচ্চতার ঊনত্রিশ বছর বয়সি দৈত্যাকার গোবরবাবুর ওজন তখন ২৩০ পাউন্ড। গলা ২০ ইঞ্চি, হাতের গোছা ১৫ ইঞ্চি, কব্‌জি পৌনে ৯ ইঞ্চি, বুক ৫০ ইঞ্চি, বুক (ফোলালে) ৫২ ইঞ্চি, ঊরু ৩৩ ইঞ্চি, পায়ের ডিম সাড়ে ১৮ ইঞ্চি। এই দশাসই চেহারার মধ্যেও যা চোখ ও মন কাড়ে তা মুখমণ্ডলের প্রশান্তি, চোখের চাহনির সৌন্দর্য। অবাক লাগে, এহেন মানুষটিকে নিয়েই সে-সময় আমেরিকায় মস্ত স্টোরি বেরোল ক্যানসাস সিটি পোস্ট পত্রিকায় এই হেডিং-সহ: “Invasion of ‘Hindu Menace’ breeds fear among matmen.” হিন্দু আক্রমণে কুস্তিগিররা থরহরি কম্প।
সদ্য খেতাব হারানো মার্কিন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন এড ‘স্ট্র্যাংগলার’ লুইসের সঙ্গে গোবরের লড়াইয়ের আগে দেশ জুড়ে একটা তুমুল উত্তেজনা। তত দিনে অপরাজিত গোবরকে নিয়ে একটা আতঙ্কই প্রায় ছড়িয়ে গেছে দঙ্গল মহলে। সমানে লেখালেখি হচ্ছে বহিরাগত হিন্দু কুস্তিগিরের গুপ্ত প্যাঁচপয়জার নিয়ে। তাঁর আহারে সোনা ও রুপোর চূর্ণ মেশানো নিয়ে। সব কিছুর মধ্যেই একটা গেল-গেল ভাব! এতটাই যে, শেষ অবধি এক যুবতী মার্কিন কুস্তি বিশেষজ্ঞ লোরি প্র্যাটকে গোবরের পক্ষ নিয়ে কলম ধরতে হল গোবর-লুইস লড়াইয়ের আগে।
তাঁর বক্তব্য: ‘গোবর কোনও ভাঁওতা নয়। শুধু সোনার গুঁড়োর খেল নয়। ওঁর আসল শক্তি শ্বাস নিয়ন্ত্রণে।’ লোরি প্র্যাটের সেই রচনা থেকে একটু উদ্ধৃতি না দিয়ে পারছি না। লিখছেন:
‘‘গোবর গোহকে নিয়ে পত্রপত্রিকায় যা চলছে, তা এক কথায় ভয়ঙ্কর। আর তার একটাই কারণ— মানুষটা বড়ই বিনয়ী। কাগজে কাগজে তাঁর জমকালো পোশাক নিয়ে ছবি বেরোচ্ছে, তাঁর জেতার অভ্যাস নিয়ে লেখা হচ্ছে, তাঁর রোজকার খাওয়ার মধ্যে সোনা রুপোর গুঁড়োর কথা থাকছে, আর থাকছে তাঁর গলায় মস্ত পাথরের ভার চাপিয়ে ব্যায়ামের কেত্তন। অথচ গোবর মানুষটা বাস্তবত এক লজ্জাবতী লতার মতো। আমি এই গোবরকে নিয়েই লিখতে চাই।’’
সে-লড়াইয়ে বলা বাহুল্য, গোবর পা ধরে লুইসকে এক ঘণ্টার মধ্যে আছড়ে ফেললেন রিংয়ে। তার পর দুটো কাঁধ চেপে ধরলেন জমিতে। গোটা লড়াই ধরে গোবরই আগ্রাসী ছিলেন, এবং যে-সাবলীল কেতায় তিনি লুইসকে পা ধরে লটকালেন তা বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন সিবিস্কোর প্রয়োগ করা টো-হোল্ড প্যাঁচের চেয়েও চটকদার ছিল। ওই টো-হোল্ডেই কয়েক মাস আগে লুইসকে কাত করে বিশ্ব খেতাব জিতে নিয়েছিলেন সিবিস্কো।
এই শক্তিশালী সিবিস্কোকেও হারতে হয়েছিল গোবরের কাছে। এ ছাড়া ছোট গামার সঙ্গেও ওঁর লড়াইয়ের বৃত্তান্তে যেতে হবে। তার আগে অবশ্য ওঁর বংশ পরিচয় ও নানা বিষয়ে ওঁর অদ্ভুত প্রতিভার কথা একটু শোনালে মন্দ হয় না।
গোবর গোহোর বংশ লতিকায় যাঁর প্রথম উল্লেখ পাচ্ছি আমরা,  তিনি ব্রজরাম গুহ (ইংরেজরা মিঃ গোহো ডেকে তাঁর পদবি গোহো করে দেন)। বুদ্ধিমান ও উচ্চাভিলাষী ব্রজরাম যশোহর জেলার ইটিন্ডাঘাটে তাঁর পিত্রালয় ছেড়ে কলকাতায় এসে সাহেবদের মুৎসুদ্দির কাজ ধরেন। এবং অনতিকালে প্রভূত অর্থোপার্জন করে উত্তর কলকাতার দর্জিপাড়ায় প্রচুর সম্পত্তি কিনে স্থায়ী বাসিন্দা হন।
ব্রজরাম গোহো (১৭৬৩-১৮০০) বেশি দিন বাঁচেননি, কিন্তু তাঁর বংশধরেরা জমিদারি ও সম্পদ সুরক্ষিত রেখেছিলেন। বিশেষত পুত্র শিবচরণও (১৭৯৩-১৮৭৪) মুৎসুদ্দির কাজে পর্যাপ্ত অর্থ করেছিলেন। এই শিবচরণের নাতি অম্বিকাচরণের (১৮৪২-১৯০১) হাত ধরেই ডন-কুস্তির নেশা ঢোকে গোহো পরিবারে। নাতির নতুন নেশায় শিবচরণের প্রত্যক্ষ প্রশ্রয় ও বিপুল অর্থব্যয় ডন-কুস্তিকে কালে কালে সম্ভ্রান্ত গোহো বাড়ির এক কালচারে পরিণত করে।
মথুরা থেকে বীর হনুমানের এক পাথরের মূর্তি আনিয়ে ৬৫ মসজিদ বাড়ি স্ট্রিটে আখড়া বসালেন শিবচরণ, আর ওই মথুরারই বড় পালোয়ান কালী চৌবেকে আখড়ার গুরু করলেন।
গোহোদের এই আখড়ার চালচলন কলকাতার অবাঙালি আখড়ার থেকে বেশ স্বতন্ত্র ছিল। চল্লিশটা গরু ও তিরিশটা ছাগলের এক খাটালও তৈরি হয়েছিল শিক্ষার্থীদের দুধ জোগাতে। ডন-কুস্তির নেশাটা ক্রমে উত্তর কলকাতার ভদ্র ও অভিজাত পরিবারে চারিয়ে যায়।
অম্বিকাচরণ চমৎকার তালিম নিয়ে, রেওয়াজ করে আঠারো-বিশ বছর বয়সের মধ্যেই প্রথম শ্রেণির পালোয়ান হিসেবে সমাদর পান। বড় পালোয়ান হয়েও কুস্তিকে পেশা করেননি বলে উত্তর ও পশ্চিম ভারতের পালোয়ান মহলে ওঁর বেশ সম্মান ছিল। এক সময়কার মল্লসম্রাট বুটা তাঁর নওজোয়ান শিষ্য করিম বখশ্‌কে নিয়ে অম্বিকাচরণের আখড়ায় এসেছিলেন।
কুস্তিতে তাঁর অবদানের জন্য পালোয়ান মহলে তত দিনে তাঁকে ডাকা শুরু হয়েছে ‘রাজাবাবু’।
এই ‘রাজাবাবু’-র চতুর্থ পুত্র ক্ষেত্রচরণ (ক্ষেতুবাবু ডাকনামেই প্রসিদ্ধ) গোহো ঘরানার কুস্তিকে ক্রমপ্রসারিত করেন।
ডাকসাইটে পালোয়ান গোলামের শিষ্য কাদরা-কে কুড়ি মিনিটের লড়াইয়ে চিৎ করেছিলেন।
যদিও কুস্তিতে ক্ষেতুবাবুর সেরা স্বাক্ষর থেকে গেল ভাইপো বিশ্ববিশ্রুত গোবর ছাড়াও বিপ্লবী মহানায়ক যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, ভীম ভবানীর মতো পালোয়ান
তৈরি করায়।
ক্ষেতুবাবু গোবরকে তৈরি করতে গিয়ে দেখেন যে, পনেরো বছর বয়সেই দু’ঘণ্টার কুস্তিতে ওঁর কোনও দমই খরচ হয় না।
কাজে কাজেই রেওয়াজের জন্য অমৃতসর থেকে রহমান ওস্তাদকে আনা হল। তাতেও পাঁচ-ছ’ঘণ্টার কোস্তাকুস্তির সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। তখন বিখ্যাত মল্ল কল্লুর শাগরেদ গুর্তা সিংহকে আনানো হল। আর পুরো ব্যাপারটার তদারকির জন্য নিয়োগ করা হল লাহোরের ওস্তাদ বগলা খলিফাকে।
সতেরো-আঠারো বছরেই গোবরের ব্যায়াম-কুস্তির চেহারাটা অদ্ভুত দাঁড়িয়ে গেল। রোজ ছ’ঘণ্টা ডন-কুস্তি করেও ক্লান্তির নামগন্ধ নেই। দু’আড়াই হাজার বৈঠকেও কিছু হয় না। তাই গলায় একটা ১৬০ পাউন্ড ওজনের পাথরের হাঁসুলি পরতে হয়। তখন তাঁর দু’জোড়া মুগুরের এক জোড়ার প্রতিটির ওজন ২৫ সের। অন্য জোড়ার প্রত্যেকটার ওজন এক মণ দশ সের করে।
এই শক্তিচর্চার দীর্ঘপ্রসারী সুফল কী দাঁড়াতে পারে তা নিয়ে আমার কাকার মুখে শোনা একটা গল্প এখানে শোনাতে পারি। গোবরবাবুর তখন পঁয়ষট্টি-ছেষট্টি বছর বয়স। গোয়াবাগানের আখড়ায় নিত্যদিন চেয়ারে বসে ছেলেদের ডন-কুস্তির ওপর চোখ রাখেন। তো এক দিন এক সুঠামদেহী ছোকরা এসে প্রণাম করে বলল, ‘‘স্যার, একটু কুস্তি শিখতে পারি?’’ গোবরবাবু মুখের মোটা লম্বা চুরুটটা (শেষ বয়সে এটাই ওঁর আরাম আর বিলাসিতা ছিল) বাঁ হাতে নামিয়ে নিয়ে বললেন, ‘‘আলবৎ শিখবি! তার আগে আমার ডান পাশে একটু দাঁড়া।’’
ছেলেটি ওঁর ডান পাশে ঘেঁষে দাঁড়াতে গোবরবাবু বসে বসেই নিজের ডান হাতটা ওর বাঁ কাঁধে রেখে আস্তে আস্তে চাপ দিতে লাগলেন। সেই চাপে ছেলেটি দেখতে দেখতেই বসে পড়ল।
গোবরবাবু হেসে বললেন, ‘‘বডি ঠিক আছে, তবে জোর বাড়াতে হবে। সময় করে ঠিকঠাক আয়, ডনবৈঠক কর। তার পর কুস্তি ধরে নিবি।’’
গোবর গোহর কিংবদন্তি গড়ে দিয়েছিল যে-সব লড়াই, তার প্রায় সবই সে কালের সেরা মার্কিন ও ইউরোপীয় কুস্তিগিরদের সঙ্গে লড়ে। জীবনের দশ-দশটা বছর তিনি বিদেশে লড়ে কাটিয়েছিলেন, যার শুরু ১৯১০-এ, বয়স যখন নিতান্ত আঠারো।
বড় বংশের ছেলে হয়েও গোবর কুস্তিকে পেশা করতে পিছ-পা হননি। তবে ভারতীয় মল্লমহলের প্রথানুযায়ী গুরু-শিষ্যে, শিষ্যে-শিষ্যে কি একই ঘরানার একজনের সঙ্গে আরেক জনের লড়া বারণ। তাতে অনেক বড় পালোয়ানের সঙ্গে ওঁর মোকাবিলায় বাধা পড়ছিল। তখন রাস্তা বার করার জন্য ভগ্নিপতি শরৎকুমার মিত্রকে নিয়ে গোবর লাহোর রওনা হলেন রহিম ওস্তাদ ও গামা পালোয়ানের তিন নম্বর মোলাকাত দেখার জন্য। সেটা ১৯৯০-এর ফেব্রুয়ারিতে। আগের দুটির মতো সেটিও ড্র হল।
কুস্তি দেখে শরৎবাবু ফিরে এলেন, কিন্তু গোবরবাবু এলেন না। তিনি আহমদ, গামা, ইমাম এবং গামু জলন্ধরিয়াকে নিয়ে একটা দল গড়ে ওখান থেকে লন্ডন পাড়ি দিলেন। এবং লন্ডন পৌঁছেই সাহেব ম্যানেজার নিয়োগ করলেন। এবং সরকারি ভাবে ঘোষণা করলেন যে, এই দল যে-কোনও চ্যালেঞ্জ নিতে প্রস্তুত।
এই প্রথম সফরে দারুণ ছাপ ফেলে দিয়েছিল ভারতীয় দল। দাঁড়ানো মাত্র লটকে পড়েছিল সাহেব পালোয়ানরা। কপাল মন্দ সে বার গোবরবাবুর। শ্বেতাঙ্গরা যখন কালোদের ভয়ে কাঁপছে, এবং নতুন নতুন লড়াইয়ের চুক্তি সই হচ্ছে তখনই টেলিগ্রাম গেল কলকাতা থেকে,‘‘ফিরে এসো, মা অসুস্থ।’’
গোবরের অনুপস্থিতিতে অবশ্য গামা, ইমাম আর আহমদ বখশ দুর্ধর্ষ লড়েছিলেন সে বার ইংল্যান্ডে। সুন্দর, ফর্সা চেহারার জন্য গামা বেশ জনপ্রিয়ও হয়ে উঠেছিলেন। আমেরিকা থেকে বেনজামিন রোলার ইংল্যান্ড চলে আসেন এবং কয়েক মিনিটের মধ্যে দু’-দু’বার চিৎ হন গামার প্যাঁচে। তখন শ্বেতাঙ্গদের মান বাঁচাতে লড়াই ডাকা হয় গামার সঙ্গে পোল্যান্ডের স্তানিস্‌লস্ সিবিস্কোর। প্রথম বার পরাস্ত হয়ে দ্বিতীয় বার গা ঢাকা দিলেন সিবিস্কো। তাই দ্বিতীয় বার যখন গোবরবাবু লন্ডন এলেন ১৯৬২-তে  তত দিনে ওখানে একটা রহস্যের বাতাবরণ সৃষ্টি হয়ে গেছে ভারতীয় মল্লদের ঘিরে। গোবরের দ্বিতীয় আবির্ভাবে সেই রহস্য বহু গুণ ঘনীভূত হল।
ইউরোপ ও মার্কিন মল্লমহল দেখল প্রবল শক্তি ও জটিল প্যাঁচের পাশাপাশি এই বিনয়ী, ভদ্র মানুষটি দারুণ বক্তৃতা করেন নিখুঁত উচ্চারণে বিশুদ্ধ ইংরেজিতে। প্রিয় লেখকদের মধ্যে উল্লেখ করেন  রবীন্দ্রনাথ, বার্নার্ড শ’, অস্কার ওয়াইল্ডের নাম। ‘নিউ ইয়র্কের মডার্ন আর্টস অ্যান্ড লেটার্স-এ তো দীর্ঘ বক্তৃতাই দিলেন রবীন্দ্রনাথের জীবন ও বাণী নিয়ে। সেই ভাষণের বিষয়-গুরুত্ব ছাড়াও ওঁর ভাষাও প্রশংসা পায় পত্রপত্রিকায়। একটা নতুন নামও জোটে ভারতীয় পালোয়ানের— ‘দ্য জেন্টল জায়ান্ট’।
এই দৈত্যের পাল্লায় পড়ে এক সময় পাশ্চাত্যের সব বড় পালোয়ানকেই নাস্তানাবুদ হতে হয়েছে। এড ‘স্ট্র্যাংগলার’ লুইসের কথা আগেই বলেছি। সেই লুইসকে হারিয়ে যিনি বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন, সেই জো স্ট্রেখারকেও হারালেন গোবর। অবশ্য তত দিনে স্ট্রেখারও আর চ্যাম্পিয়ন নেই, তিনি খেতাব হারিয়েছেন স্তানিস্‌লাস্ সিবিস্কোর কাছে। এই সিবিস্কোর সঙ্গে দুই মোলাকাতে একবার হেরে একবার জিতেছিলেন গোবরবাবু।
বস্তুত কাকেই বা হারাননি গোবর? স্কটল্যান্ডের জিমি ক্যাম্বেল, গ্রিসের বিল দেমেত্রালস, জার্মানির কার্ল সাফ্‌ট, বোহেমিয়ার জো শুল্‌জ, বেলজিয়ামের জ্যানসন, সুইডেনের লুনডিন, বুলগেরিয়ার গ্রানোভিচ, তুরস্কের মেহমুত...।
১৯২১-এর ১৮ অক্টোবরে শিকাগোর এক পত্রিকায় হেডলাইন দেখছি সেই প্রবাদপ্রতিম স্যান্ডো (১৮৬৭-১৯২৫) গোবরের লড়াই দেখে মন্তব্য করছেন ‘‘গোবর ইজ অ্যানাদার মেহমুত।’’ মসৃণ প্যাঁচ ও প্রবল ঝটকার জন্য মেহমুতের বেজায় নাম তখন বিশ্ব কুস্তিতে।
তবে যে-ছোট গামা ও গোবরের কুস্তি নিয়ে দীর্ঘকাল চর্চা শুনে আসছি আমরা, তার ফলাফল নিয়েও বিশেষ কৌতূহল থাকার কথা নয়। তিন ভাই গোলাম, কল্লু ও রহমানের মধ্যে মধ্যম জন কল্লুর পুত্র ছোট গামা (জন্ম ১৮৯৯) মারপিট ও জঙ্গিপনাতেও অভ্যস্ত ছিলেন। গোবরবাবুর ঘনিষ্ঠ ও তাঁর জীবনীকার সমর বসু মনে করেন না, ছোট গামা গোবরের যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন।
মুর্শিদাবাদের নবাব স্যার ওয়াশিক আলি মির্জা খাঁ সাহেবই ছোট গামার সঙ্গে গোবরের কুস্তির প্রস্তাব দেন, অথচ সে-কুস্তিতে না রাখা হল রেফারি, না টাইমকিপার। বস্তুত নিয়মের বালাই রইল না। গোবরবাবু হাত মেলানোর জন্য হাত বাড়াতেই ছোট গামা ওঁকে ধাক্কা মেরে মেরে দড়ির
ওপর নিয়ে ফেললেন এবং নিজেও দড়ির ওপর গিয়ে পড়লেন। তার পর ‘জিত গয়া!’ হুঙ্কার দিয়ে রিং থেকে নেমে গেলেন। বাঁশি বাজিয়ে তাঁকে ফিরিয়ে আনা হলে অন্য দিকে
মুখ করে দাঁড়ানো গোবরকে ধাক্কা মেরে ছোট গামার দিক থেকে চিৎকার ‘জিত গ্যয়া!’
কুস্তির এই প্রহসন দিয়ে গোবরবাবুর গুরুত্ব মাপা যায় না। সত্যিই তো, এত বড় মল্ল বাংলায় তো আর হল না। শেষ বয়সে এটাই বড় আফসোস রয়ে গেল তাঁর। জুডো, ক্যারাটের শখ হল, বাঙালি ছেলে-ছোকরাদের (কুংফু-র নাম তখনও ছড়ায়নি অতটা) মধ্যে, কিন্তু ডন-কুস্তির হাল ধরল না কেউ। ডন-কুস্তি করেও যে সেতার বাজানো যায় এ তো তিনি নিজের জীবন দিয়ে দেখিয়েছিলেন।
সে কথাটিই তাঁর শ্রাদ্ধবাসরে ‘গোবরস্মরণে’ স্মৃতিগ্রন্থ প্রকাশ করে মনে করিয়ে দিয়েছিলেন বন্ধু বিজ্ঞানী ও এস্রাজ বাজিয়ে সত্যেন্দ্রনাথ বসু।

http://www.anandabazar.com/supplementary/patrika/some-unknown-facts-about-the-gentle-giant-gobar-goho-1.569694

স্টেজে খুব দুষ্টুমিও করতেন (On Ajitesh Bandopadhyay)

$image.name

স্টেজে খুব দুষ্টুমিও করতেন

অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়। ছিলেন দুর্ধর্ষ গল্প-বলিয়েও। কিছু ঘটনা ওঁর জীবনে না ঘটলেই ভাল হত! স্মৃতিতে ফিরলেন বিভাস চক্রবর্তী

৪ মার্চ , ২০১৭, ০০:০০:০০
Ajitesh Bandopadhyay

‘থানা থেকে আসছি’ নাটকে

খুশি হলে এমন করে হাতটা জাপটে ধরতেন! তখন মনের সবটুকু উষ্ণতায় মাখামাখি থাকত ওঁর দুই হাতের তালু।
মজাও কি কম করতেন!
সে মজা চলত স্টেজেও।
একবারের ঘটনা বলি।
ভালবাসতেন জমিয়ে খেতে। একা নয়, সবার সঙ্গে। তাই স্টেজে ওঠার আগে সবাই মিলে ভাল করে মাংস-রুটি খাওয়াটা ছিল দস্তুর।
একবার নাটক চলছে। স্টেজে রাধারমণ তফাদার আর অজিতবাবু। হঠাৎই সংলাপ শেষ করে পিছন দিকে রাধারমণকে দেখেই, অজিতবাবু মুখ বেঁকিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে উঠলেন, ‘‘ভাগ্যিস থিয়েটার করতে এলে। তাই না প্রায়ই মাংসটাংস খেতে পাচ্ছ!’’ ভাবুন একবার!
অজিতবাবুকে প্রথম দেখি মুক্তাঙ্গন-এ। তখন তিনি রীতিমত ‘অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়’! নান্দীকার ‘নাট্যকারের সন্ধানে ছ’টি চরিত্র’ করছে। আমি সবে থিয়েটারের অ-আ-ক-খ-র নেশায় পড়েছি। তবে প্রেসিডেন্সিতে পড়া, ফিল্ম ক্লাব করা, বাড়িতে উঠতে বসতে রাজনীতির গল্প শোনা যুবক। পাড়ায় নাটক করি। আমার বন্ধু অশোক মুখোপাধ্যায়, চিন্ময় রায় তখন নান্দীকার-এর সদস্য। ওরাই বলল নাটকটার কথা।
গেলাম দেখতে।
ফিরলাম ‘বোল্ড আউট’ হয়ে। 
এর ঠিক দু’বছর বাদের কথা। তখন দমদমে থাকি। সাতগাছিয়া-র ত্রিপল ফ্যাকটরি-তে নাটক প্রতিযোগিতা। ‘জাজ’ হয়ে এলেন অজিতবাবু। প্রতিযোগিতায় আমরা নাটক করলাম অজিত গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘নব স্বয়ংবর’। ফার্স্ট হলাম।
তার কিছু দিন পরেই ‘নান্দীকার’ থেকে আমার ডাক এল। পরে শুনেছিলাম নেপথ্যের কারণ। চিনু, মানে চিন্ময় রায় কিছু পারিবারিক কারণে নিয়মিত ‘শো’ করতে পারছিল না। এদিকে সেই ‘সাতগাছিয়া’র প্রতিযোগিতা থেকেই অজিতবাবুর আমাকে মনে ছিল। উনিই আমায় ডাকতে বলেছিলেন। তো, গেলাম।
সেই-ই আমার প্রথম গ্রুপ থিয়েটারে সিরিয়াস নাট্যর্চচার শুরু। চিনুর মতো হালকা রসে জমানো অভিনয় করতে পারলাম না বটে, তবে কাজ চালিয়ে দিলাম। আর ধীরে ধীরে অজিতবাবুর নজরে পড়ে গেলাম।  এক সময় দলের সেক্রেটারি হতে বললেন। রাজি হইনি।....খামোকা কেনই বা! তাতে বোধহয় রাগ হল ওঁর। কিন্তু দেখলাম, দলের নতুনদের নিয়ে অদ্ভুত একটা প্রজেক্ট নিলেন। একাঙ্ক করবে দলের নতুনরা।
আন্তন চেকভের নাটক ‘প্রোপোজাল’ করলাম। অজিতবাবুরই অবলম্বন। নাম ‘প্রস্তাব’।
প্রস্তুতির শেষ মুর্হূতে ডাকলাম দেখতে। টুকটাক কিছু সাজেশন দিলেন। তাতেই দেখলাম আগাগোড়া  নাটকটাই পাল্টে গেল। এমনই একটা সময়ে রুদ্র (রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত) আর আমি যৌথ ভাবে আর্নল্ড ওয়েস্কারের ‘রুটস’-এর শেষাঙ্কটা করলাম। অজিতবাবু তাতে এতই প্রভাবিত হলেন, লিখে ফেললেন নতুন নাটক ‘যখন একা’।  এর মাঝে ‘মঞ্জরী আমের মঞ্জরী’ হয়ে গেল। চেকভের ‘চেরি অর্চার্ড’। ওঁরই অবলম্বন। প্রথম যখন থিয়েটারটার কথা ভাবছেন, মনে আছে, গল্প বললেন একদিন। অমন গল্প-বলিয়ে আমি কস্মিনকালেও দেখিনি।
ঠিক হল, শুধু চেকভের থিয়েটার করব না, তাঁকে ভাল করে জানতেও হবে। এমনকী দর্শককেও জানাব।
তখন পবিত্র (সরকার) এসে গেছে দলে। অজিতবাবু ওকেই ভার দিলেন, ‘কেন চেকভ, কী চেকভ’ ইত্যাদি নিয়ে লেখা তৈরি করতে। পুস্তিকা হবে। ছাপানোর ভার আমার। তত দিনে ‘গুরু’ মেনে ফেলেছি লোকটাকে। যদিও মাত্র চার বছরের বড়।  বারবার বলতেন, থিয়েটার করবে মনের আনন্দে, পয়সার কথা ভেবে নয়। থিয়েটার হল গরিবের বি‌নোদন।
আর অজিতবাবুর মন? এত দরাজ, এত পরার্থপর মানুষ খুব কম দেখেছি। ঘরেও যেমন, বাইরেও তেমন। শুধু ওঁর অর্থ সাহায্যর কাহিনিগুলোই যদি সাজাই, উপন্যাস হয়ে যাবে।
সব ব্যাপারেই মানুষটা যেন একটু অন্যরকম। এমনকী অভিনয় শেখানোর ধরনেও।
‘হাটেবাজারে’ ছবিতে অশোককুমারের সঙ্গে
একবারের কথা মনে পড়ে। ‘মঞ্জরী আমের মঞ্জরী’র রিহার্সাল হচ্ছে। আমি ‘তাপস’ করতাম। তাপসের কথা বলার ঢং একটু বক্তৃতা গোছের। তা, আমি সংলাপ আওড়াতে গিয়ে কথা আর বক্তৃতার দরকারি মিশেলটা কিছুতেই বাগে আনতে পারছিল‌াম না। মহলার মাঝেই রুদ্র ঢুকল ঘরে। অজিতবাবু আমায় থামালেন। তখন নান্দীকার-এ একটা বড় প্ল্যানিং চলছে। দল ‘কাশী বিশ্বনাথ মঞ্চ’টা নেবে কি নেবে না। আগের দিনই মিটিং হয়েছে। রুদ্র সেখানে ছিল না। অজিতবাবু বললেন, ‘‘থামুন তো বিভাস, রুদ্রকে কালকের ব্যাপারটা একটু ব্রিফ করে দিন!’ থামলাম। গড়গড় করে বলতে লাগলাম। এবারও আমায় থামালেন অজিতবাবু। বললেন, ‘‘এই, এইটাই হবে তাপসের বলার ঢং। এবার ক্লিয়ার তো?’’
তখন অজিতবাবু  থাকেন শ্যামবাজার ট্রামডিপোর উলটো দিকে, একটা গলিতে। স্ত্রী লীলা বন্দ্যোপাধ্যায়ও ওঁর সঙ্গে। আমাদের লীলা বৌদি। দু’জনেই পার্টি করেন। নান্দীকার-এ রুদ্র তখন তত নিয়মিত নয়। কেয়াও (চক্রবর্তী) না। আমরা শুধু দিনে দিনে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে পড়েছি থিয়েটারে। তখনই ছন্দপতন!
অজিতবাবুর সঙ্গে এমন একটা সৌহার্দ্যের সম্পর্ক, তা সত্ত্বেও ওঁর প্রতি অনেক অভিযোগ মনে পুষে ১৯৬৬ সালে দল ছাড়লাম।
বছর কয়েক পরে একজন আমায় জিজ্ঞেস করেছিল, ‘‘কেন ছেড়েছিলেন বলুন তো? কী অভিযোগে?’’ বলেছিলাম, ‘‘সেদিন যে অভিযোগ ছিল অজিতবাবুর প্রতি, আজকে হয়তো আমার দলের কেউ আমার প্রতি সেই একই অভিযোগ করে!’’
চোদ্দো জন একসঙ্গে ছেড়েছি‌লাম ‘নান্দীকার’। প্রচণ্ড অভিমান করেছিলেন। আমি বেরিয়ে গিয়ে ‘থিয়েটার ওর্য়াকশপ’ করলাম। কিছুতেই আসতেন না আমাদের নাটক দেখতে। আমিই দেখা করতাম। রঙ্গনা-য় যখন ‘নান্দীকার’ শো করতে শুরু করল, ম‌নে পড়ে গ্রিনরুমে বসে কত আড্ডা দিয়েছি! কেয়াকে দেখতাম, স্টেজে ওঠার আগে এসে অজিতবাবুকে প্রণাম করে যেতে। গৃহদেবতার কাছে যেম‌ন গেরস্ত করে, ঠিক তেমনই।
অজিতবাবু আবৃত্তি করতেন। কবিতা লিখতেন। যাত্রায় গেলেন। সিনেমায় গেলেন। তার মধ্যেই অজিতদা-লীলাবোদি সম্পর্কে ভাঙন এল। নাটকেরই এক সহকর্মীর স্ত্রী রত্না বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে থাকতে শুরু করলেন বেলেঘাটায়। ঘটনাটা যে আমায় খুব ভাবাল, এমন নয়। কিন্তু অজিতবাবুকে যে ভাবে ‘নান্দীকার’ ছাড়তে হল, মানতে পারিনি কোনওদিন।
‘থিয়েটার ওয়ার্কশপ’-এর দুটো নাটকের শো করলাম। ‘শোয়াইক গেল যুদ্ধে’, ‘চাক ভাঙা মধু’।
সেই প্রথম বার নাটক দেখতে এলেন আমাদের। গ্রিনরুমে এসে কাছে ডাকলেন। চোখটা বুজে জড়িয়ে ধরলেন বুকে। অ‌‌নেকক্ষণ!
আমি দূরদর্শন-এ ঢুকলাম। ১৯৭৫ সালের ৯ অগস্ট টেলিকাস্ট শুরু হল। তখন ‘গুরুদক্ষিণা’ দেওয়ার সুযোগ এল। প্রথম থিয়েটার দেখানো শুরু হতেই ‘নানা রঙের দিন’ করালাম ওঁকে ডেকে।
১৯৮৩ সাল। অক্টোবর মাস। দুর্গাপুজোর অষ্টমী না নবমী। সাতসকাল। আমি তখন সবে গল্ফ গ্রিনের ডেরায় উঠে এসেছি। কাকভোরে দরজায় বেল। খুলেই দেখলাম বিধ্বস্ত চেহারায় দাঁড়িয়ে রমা। রমাপ্রসাদ বণিক। ওর বাড়ি আমার থেকে অল্প দূরে।
ভাঙা ভাঙা অস্পষ্ট ঘড়ঘড়ে গলায় রমা বলল, ‘‘বিভাসদা, অজিতদা কাল রাতে...।’’
‘‘মানে? কী বলছিস তুই!’’ স্বজনহারা যন্ত্রনায় ডুকরে উঠলাম।
ছুটলাম বেলেঘাটায়। শুয়ে আছেন অজিতবাবু।  হাতটা জাপটে ধরলাম। কী ঠান্ডা! উষ্ণতা নিভে যাওয়া হিমশীতল তালুটা আমায় হু হু কান্নায় ভাসিয়ে দিল। 


http://www.anandabazar.com/supplementary/patrika/some-unknown-facts-about-actor-ajitesh-bandopadhyay-1.573620


কাঁটালপাড়ার বঙ্কিম

$image.name

কাঁটালপাড়ার বঙ্কিম

অকালে হারান প্রাণপ্রিয়া স্ত্রীকে। খুন হন কন্যা। নিজে বাবার প্রতি অভিমানে ঘর ছাড়েন। এ কোন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়? তাঁর কপালকুণ্ডলা উপন্যাসের ১৫০ বছরে লিখছেন অনিরুদ্ধ সরকার

২৬ নভেম্বর, ২০১৬, ০০:০০:৪০
Bankim Chandra

চিত্রণ: বিমল দাস

প্রয়াণের বারো বছর না পেরোলে যেন জীবনচরিত লেখা না হয়!
এমনই এক নির্দেশ জারি করে গিয়েছিলেন তিনি।
কিন্তু কেন?
খুব সম্ভবত তাঁর ধারণা ছিল কোনও ব্যক্তি মারা যাওয়ার কিছু দিনের মধ্যেই জীবনী লিখলে সব কথা খোলাখুলি বলা যায় না।
এই বিশ্বাসের কথা তিনি বলেছিলেন বন্ধু দীনবন্ধু মিত্রের জীবনী লিখতে বসে।
বন্ধুর জীবনের রূপরেখাটুকুও দাঁড় করতে অপেক্ষা করেছিলেন তিন-চার বছর।
তিনি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।
যাদবচন্দ্র ,রাজলক্ষ্মীদেবী ও সঞ্জীবচন্দ্র
••••••
অদ্ভুত এক ছেলেবেলা তাঁর। প্রখর স্মৃতিশক্তি। শোনা যায়, বার্ষিক পরীক্ষার আগে পাঠ্যপুস্তকের খোঁজ পড়ত। এক দিনে এক একটা গোটা বই পড়ে ফেলতে পারতেন!
কাঁটালপাড়ার বাড়ির কাছেই ছিল ওঁর বাবা যাদবচন্দ্রের পাঠশালা। বঙ্কিম অবশ্য পাঠশালায় যেতেন না, গুরুমশাই আসতেন বাড়িতে।
পাঁচ বছর বয়েসে বঙ্কিমের হাতেখড়ি হয় গুরুমশাই রামপ্রাণ সরকারের কাছে।
গুরুমশাই বুঝেছিলেন, মেধাবী ছাত্র বঙ্কিম যে দ্রুততার সঙ্গে পাঠ নিচ্ছে, তাতে তার কাজ আর বেশি দিন থাকবে ন।
এ’ও শোনা যায়, শিশু বঙ্কিম নাকি একদিনেই আস্ত বর্ণপরিচয় শেষ করে ফেলেছিল!
পড়াশুনোয় ভাল তো বটেই, সঙ্গে আত্মসম্মানবোধও প্রখর।
আসা যাক তেমনই একটি ঘটন়ায়।
যাদবচন্দ্র যখন মেদিনীপুরের ডেপুটি কালেক্টর, বঙ্কিম বছর চার-পাঁচ টানা বাবার কাছে যেতেন, আসতেন।
ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে যাদবচন্দ্রের বেশ ঘনিষ্ঠতা। মাঝেমধ্যে সাহেবের বাংলোয় যেতেন তিনি। সঙ্গে যেতেন বঙ্কিমও। সেখানে সমবয়েসিদের সঙ্গে মেলামেশা করতেন বঙ্কিম।
এক দিন ম্যাজিস্ট্রেটের অন্দর থেকে চা-পানের ডাক এল। তাতে গেলেন কেবল সাহেবের ছেলেমেয়েরা। বঙ্কিম বাদ। ঘটনাটি খুব মানে লেগেছিল তাঁর। অপমানে তার পর থেকে আর যাননি সে-বাংলোয়।
মেদিনীপুর থেকে এ বার কাঁটালপাড়ায়।
সে আরেক কাণ্ড!
মাথার ওপর তেমন শক্ত কোনও অভিভাবক নেই। বাবা থাকেন দূরে। মা অতিরিক্ত স্নেহকাতর।
ফলে যা হবার, তাই-ই হল।
বাইরের কোনও খেলাতেই তেমন মন নেই। নেশা ধরল তাস-এ। সঙ্গী জুটিয়ে নেন নিজেই।
ফুরসত পেলেই তাস।
না জানেন সাঁতার, না ঘোড়ায় চড়া। তার মধ্যেই এক উদ্ভট ঘটনা বাধিয়ে বসলেন।
লোক ডেকে কী এক খেয়ালে দাদার সাধের ঘোড়াটাকে দিলেন বেচে!
কী বিচিত্র কৈশোরকাল!
দাদাদের সঙ্গে বসে একসঙ্গে ধূমপান করতেন ছোট বয়স থেকেই। দাদারাও তেমন, কেউই আপত্তি করতেন না।
বৈঠকখানা ঘরে আড্ডা বসত নিয়ম করে। ওখান থেকেই তামাকু সেবনের শুরু।
আড্ডাতে যে সবাই সাধু গোছের সঙ্গী, মোটেই তা নয়। বরং বখাটে ছেলেপুলে জুটিয়ে নিয়ে আড্ডা দেওয়া ছিল মেজদাদা সঞ্জীবচন্দ্রের দস্তুর।
অদ্ভুত, ওই অতটুকু বয়সেও দাদার এই ব্যাপারটি কিন্তু তেমন ভাল মনে নেননি বঙ্কিম!
বঙ্কিম দেখতেন, ধীরে ধীরে উচ্ছন্নে যেতে বসেছে তাঁর দাদাটি। বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে সঞ্জীব পরীক্ষার দিনেও কলেজমুখো না হয়ে দাবা খেলে খেলে দিন কাটিয়েছেন, এমনও হয়েছে।
এ নিয়ে বঙ্কিমের প্রচণ্ড ক্ষোভ ছিল। রাগের চোটে দাদার এই আড্ডাধারীদের তিনি ডাকতেন ‘বানর সম্প্রদায়’।
••••••
দাদাদের সঙ্গে আড্ডায় বসতেন বটে, কিন্তু এই ভিড়ের বাইরে ছোট থেকেই বঙ্কিমের একটি নিজের জগৎও ছিল।
পড়াশুনোতে ধারালো ছিলেন কলেজেও। ভাল ফল করতেন। বৃত্তিও পেতেন। বৃত্তির টাকায় একটা ছোট বাগান বানিয়েছিলেন।
চাটুজ্জে পরিবারের অনেক পুকুর। তার এক-একটির নাম এক এক রকম— অর্জুনা, ভীমা, ঠাকুরপুকুর, সরের পুকুর।
এগুলোর মধ্যে পদ্মপাতায় ঢাকা পদ্মফুলের শোভায় মোড়া অর্জুনার কদরই ছিল বেশি।
অর্জুনার চার পাশে আমবাগান। দাদা শ্যামাচরণ খুব যত্ন করে গড়ে তুলেছিলেন জায়গাটিকে।
এই অর্জুনার ধারেই একটি ছোট বাগান তৈরি করলেন বঙ্কিম। কলেজের মালিকে ডেকে নানা রকম ফুলের চারা লাগালেন।
অবসর পেলে মাঝে মাঝেই পুকুর ধারের এই ঘাসজমিতে পায়চারি করতেন বঙ্কিম। নয়তো অর্জুনা-বাগানে একাকী বসে থাকতেন। নির্জনতা ছিল এতই প্রিয়!
এক এক সময় নিজেকে নিয়েই থাকতে ভালবাসতেন।
••••••
১৮৫৭-র জানুয়ারিতে প্রতিষ্ঠিত হল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়।
তার এক বছর পরেই বিএ পরীক্ষা।
সিলেবাস বেশ কঠিন। পরীক্ষা দিলেন তেরো জন। ডিগ্রি পেলেন মাত্র দু’জন। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় আর যদুনাথ বসু।
তবে ষষ্ঠ পত্রে এঁদেরও পাশ নম্বরে ঘাটতি ছিল। ৭ নম্বর ‘গ্রেস’ দেওয়া হল দু’জনকে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য জে ডবলিউ কোলভিল কৃতী ছাত্র দু’জনকে সমাবর্তনে উপস্থিত করলেন বিশেষ পোশাকে। ১৮৫৮-র ১১ ডিসেম্বর শনিবার টাউন হলে সমারোহ করে অনুষ্ঠান হল।
প্রথম গ্র্যাজুয়েট ডিগ্রি পেলেন দুই বাঙালি। কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত ‘সংবাদ প্রভাকর’ পত্রিকায় ঘটনাটি ফলাও করে লিখলেন। তাঁর গর্বের শেষ নেই। আসলে এই কৃতীদের একজন যে অল্প বয়েসে তাঁর পত্রিকায় কবিতা লিখতেন! যাঁর নাম বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।
শুধু ইস্কুল-কলেজের ভাল ছাত্র বলে নয়, পাঠ্যবইয়ের বাইরেও বঙ্কিম বরাবরই ভাল পড়ুয়া।
ঊনবিংশ শতাব্দীর কলেজ-বইয়ের তালিকায় চোখ রাখলেই বোঝা যায়, সংস্কৃত ও ইংরেজি ভাষায় রাশি রাশি বই তখন ছাত্রদের পড়তে হতো। চসার, স্পেন্সার, শেক্সপিয়র, স্কট, শেলি, বায়রন, মিলটন, টেনিসনের পাশাপাশি কালিদাস, ভারবি, বাণভট্ট...!
বঙ্কিমকেও এ সব পড়তে হয়েছে। কিন্তু পাঠ্যপুস্তকের চেয়ে বাইরের বই পড়াতেই যেন তাঁর ঝোঁক ছিল বেশি।
নৈহাটির ভাটপাড়ার জয়রাম ন্যায়ভূষণের কাছে বসে বঙ্কিম রঘুবংশ, কুমারসম্ভব, মেঘদূত, শকুন্তলা পড়েছিলেন।
দাদা সঞ্জীবচন্দ্রর ব্যক্তিগত সংগ্রহেও প্রচুর ইংরেজি ও সংস্কৃত সাহিত্যের বই ছিল।  সে গুলি আসত সে কালের প্রসিদ্ধ ‘থ্যাকার স্পিঙ্ক অ্যান্ড কোম্পানি’ থেকে। সে সবের মধ্যেও ছিল বঙ্কিমের নিরন্তর বিচরণ। 
শরৎকুমারী ,নীলাব্জকুমারী ও উৎপলকুমারী
••••••
কাঁটালপাড়ার দক্ষিণে হাঁটাপথে চার কিলোমিটার গেলেই নারায়ণপুর। সমৃদ্ধ গ্রাম। গ্রামের এক গৃহস্থ-কর্তা নবকুমার চক্রবর্তী। তাঁর পাঁচ বছরের কন্যা মোহিনী। মোহিনী রূপসী। তাঁকে পছন্দ করে ভাই বঙ্কিমের সঙ্গে বিয়ে দিলেন বড়দা শ্যামাচরণ।
বিয়েতে বাপের বাড়ি থেকে মোহিনী পেলেন অনেক গহনা। বঙ্কিমের পিতা যাদবচন্দ্রও পুত্রবধূকে অলঙ্কারে ভরিয়ে দিলেন।
দিন যেতে না যেতেই বালিকা বধূ মোহিনী হয়ে উঠলেন শ্বশুরবাড়ির সকলেরই স্নেহের পাত্রী।
বঙ্কিম তখন কলেজ-পড়ুয়াও নন। বয়স সবে দশ পেরিয়েছেন।
পরীক্ষায় ভাল ফল করে বৃত্তির টাকা ছিল বঙ্কিমের একমাত্র উপার্জন। সেই বৃত্তির টাকায় যেমন বাগান করেছিলেন, তেমন স্ত্রী মোহিনীকে দিতেন নানান উপহার। তার মধ্যে অলঙ্কারও ছিল। দুটি কানের দুল আর সোনার একটি চুলের কাঁটা কিনে দিয়েছিলেন তিনি।
মোহিনীর সঙ্গে সম্পর্ক গোড়ার থেকেই নিবিড়। কিন্তু তা শুধু যে উপহার দেওয়া-নেওয়ার মতো সোহাগে-আহ্লাদে মোড়া ছিল, তা নয়। নতুন কিছু লেখা হলে এই মোহিনীই হতেন বঙ্কিমের প্রথম শ্রোতা। সারাক্ষণ মোহিনীকে যেন চোখে হারাতেন বঙ্কিম।
মোহিনী মাঝে মধ্যে নারায়ণপুরে বাপের বাড়ি গিয়ে থাকতেন। বঙ্কিমের তখন কিছুতেই বাড়িতে মন বসত না।
লুকিয়ে রাতের অন্ধকারে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পায়ে হেঁটে সোজা চলে যেতেন নারায়ণপুর। শুধু মোহিনীর সঙ্গে একটু কথা বলার জন্য। তাঁকে চোখের দেখা দেখতে পাবেন বলে। মাঝে মাঝে রাতও কাটাতেন শ্বশুরালয়ে। ভোরে ফিরে আসতেন কোনও এক সময়।
এই ঘটনাক্রমের বর্ণনা এক জায়গায় পাওয়া যায়—‘‘... (বঙ্কিম) বাড়িতে উপস্থিত হইয়া পড়িতে বসিতেন। সঞ্জীবচন্দ্র বঙ্কিমকে পড়িতে দেখিয়া (রাত্রে) শুইতে যাইতেন। আর ভোরে আসিয়াও পাঠ নিমগ্ন দেখিতেন। আশ্চর্য হইয়া তিনি প্রায়ই জিজ্ঞাসা করিতেন—বঙ্কিম কি সারারাত জেগে পড়েছে?’’
মোহিনী-বঙ্কিমের এমন ঘন মধুর সম্পর্কের কী করুণ পরিণতি!
বঙ্কিম চাকরি নিয়ে তখন যশোরে। সেই প্রথম দীর্ঘদিন স্ত্রীকে ছেড়ে থাকার যন্ত্রণা তাঁকে অসম্ভব পীড়ায় রেখেছিল।
একলা প্রবাস-জীবন বছর খানেক এ ভাবে চলছিল। শেষে আর থাকতে না পেরে ঠিক করলেন, যাই-ই হোক, এ বার মোহিনীকে তিনি নিয়ে আসবেন।
চিঠি লিখলেন প্রাণপ্রিয়াকে।
চিঠি পেয়ে মোহিনী উৎফুল্ল। বাড়ির সবাইকে স্বামীর দেখিয়ে বেড়াতে লাগলেন। নিজের সংসার পাতার আনন্দে তিনি তখন বিভোর। গুরুজনরাও মত দিলেন যশোরে যাওয়ার। স্নেহের মোহিনীর বিরহ তাঁদেরও যে কাতর করে!
ধীরে ধীরে দিন গড়িয়ে আসে। মোহিনী আনন্দে উত্তেজনায় হাওয়ার গায়ে ভাসেন।
বাধ সাধলেন বিধাতা। সামান্য জ্বর। অসুখের খবর পেয়ে বঙ্কিম রওনা দিলেন যশোর থেকে।
বাড়ি পৌঁছবার আগেই সব শেষ!
বাবা আর দাদার কাছে খবর পেলেন মোহিনী আর নেই! মাত্র ষোলো বছর বয়সে এ পৃথিবীর যাবতীয় মায়াবন্ধন কাটিয়ে তিনি তখন দূর নক্ষত্রের কোলে ঠাঁই নিয়েছেন! 
শোকস্তব্ধ বঙ্কিম বাড়ি গেলেন না আর, মাঝপথ থেকেই ফিরে গেলেন। এর পর দীর্ঘদিন তিনি কাঁটালপাড়ার বাড়িতেই যাননি।
শুধু দাদা সঞ্জীবচন্দ্রকে তিনি অনুরোধ করেছিলেন, মোহিনীকে উপহার দেওয়া সেই দুটি কানের দুল আর চুলের সোনার কাঁটাটি যেন তাঁর কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
মোহিনীর মতোই আরেকটি মৃত্যু বঙ্কিমকে বিধ্বস্ত করে দিয়েছিল।
সে অবশ্য বেশ কিছু কাল পর। তাঁর দ্বিতীয় পক্ষের বিয়েরও অনেক পরে। কিন্তু শোক এখানেও পাহাড়সম।
সে বারে ছিলেন হৃদ্‌নন্দিনী স্ত্রী, আর এ বারে সন্তান!
পলা। আদরের ছোট মেয়ে। ভাল নাম উৎপলকুমারী। তাঁর স্বামী মতীন্দ্র। মতীন্দ্রর চরিত্রের দোষ। থিয়েটার পাড়ায় নটীদের বাড়িতে রাতদিন পড়ে থাকা তার নেশা। ফুর্তির জন্য পলার কাছে একদিন সে তাঁর মায়ের দেওয়া গয়নাও চেয়ে বসে।
পলা দিতে রাজি হননি।
রাখালচন্দ্র
আর তার পরই ক্ষিপ্ত মতীন্দ্র স্ত্রীকে মেরে ফেলার ষড়যন্ত্র করে।
শোনা যায়, ওষুধের সঙ্গে বিষ মিশিয়ে তাঁকে মেরে ফেলে স্বামী। এর পর পলার মৃত শরীর ঝুলিয়ে দেয় কড়ি-বর্গার গায়ে।
এই কুকর্মে তাঁকে সাহায্য করে পাড়ার বিনোদডাক্তার। এর পর থানা পুলিশ। ময়না তদন্ত।
হত্যা, না আত্মহত্যা?
ডাক্তারি রিপোর্টে প্রমাণ মেলে ঘটনাটি খুন!
শুরু হল মামলা।
আদালতের বিচারে মতীন্দ্রর প্রাণদণ্ডের রায় বেরনো যখন শুধু সময়ের অপেক্ষা, আশ্চর্যজনক ভাবে সওয়ালে নীরব থাকলেন দুঁদে আইনজ্ঞ বঙ্কিমচন্দ্র!
প্রাণে বাঁচলেন মতীন্দ্র।
কিন্তু কেন মতীন্দ্রকে প্রাণে বাঁচিয়ে দিলেন বঙ্কিম?
এ ঘটনা কি বঙ্কিমের কোমল মনের কিংবা ক্ষমা-প্রবণতার পরিচয় দেয়?
কে জানে!
শোনা যায়, বৃদ্ধ ঠাকুর্দার বাঁচার একমাত্র অবলম্বন ছিল মতীন্দ্র। তাঁর অনুরোধেই নাকি বঙ্কিম মেয়ের হত্যাকারীকে ক্ষমা করে দেন।
••••••
চুঁচুড়ার ষাঁড়েশ্বরতলায় প্রতিবছর বৈশাখ মাসে খুব জাঁকজমক করে মেলা বসত। মেলায় প্রচুর লোক সমাগম হত।
তখন বঙ্কিম চুঁচুড়ার ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। মেলা চলাকালীন এক দিন তিনি গঙ্গার তীরে বেড়াতে বেড়াতে দেখলেন একটি ছোট নৌকায় অনেক যাত্রী নিয়ে মাঝি গঙ্গা পার হচ্ছে।
বঙ্কিম মাঝিকে বারণ করলেন। এ ভাবে ঠাস বোঝাই করা যাত্রী নিয়ে পারাপার ঠিক নয়। না মানলে পুলিশের ভয় দেখালেন।
তাতেও মাঝি শুনল না।
যাত্রীসুদ্ধ নৌকা মাঝগঙ্গায় ডুবে গেল। মাঝি রক্ষা পেয়ে গেল। বিচারে তাকে তিন মাসের জেল-বন্দির সাজা দিলেন বঙ্কিম।
এ দিকে জেলখানাতেই মাঝি মারা গেল। তার মৃত্যুর কথা কানে গেল বঙ্কিমের। তার পর, কী অদ্ভুত! নিজে উদ্যোগী হয়ে মাঝির বিধবা স্ত্রীর জন্য আজীবন মাসিক বৃত্তির ব্যবস্থা করলেন বঙ্কিমচন্দ্র।
••••••
এমনিতে স্বভাবে সংযমী, স্পর্শকাতর, নম্র হলেও শরীরে রাগ যে কম ছিল, তা নয়। রেগে গেলে নাকি চুল ছিঁড়তেন বঙ্কিম।
অপছন্দের কিছু ঘটলে সহজে ছাড়তেন না। সে অন্যের কাছে যতই তুচ্ছ ঘটনা মনে হোক।
বঙ্কিমের প্রিয় হারমোনিয়ামে হাত দেওয়ার জন্য একবার ভাইপো জ্যোতিশ্চন্দ্র বেধড়ক বকুনি খেয়েছিলেন কাকার কাছে। হারমোনিয়াম বাজানোয় সিদ্ধহস্ত বঙ্কিম সইতে পারেননি তাঁর প্রিয় যন্ত্রটির প্রতি এই অনধিকার চর্চা।
এই জ্যোতিশ্চন্দ্রকে ঘিরে সঞ্জীবচন্দ্রর একটি ঘটনা যেমন। সঞ্জীবচন্দ্রর একমাত্র ছেলে জ্যোতিশ্চন্দ্রকে বঙ্কিম নিজের ছেলের মতো মানুষ দেখতেন।
জ্যোতিশ্চন্দ্র পড়াশুনোয় একেবারেই ভাল ছিলেন না। প্রবেশিকা পরীক্ষায় টেনেটুনে পাশ করেন। বাড়িতে বসে বড়দের সঙ্গে তাস খেলে, আড্ডা দিয়েই দিন কাটাতেন। তাঁর মতিগতি অনেকটাই তাঁর বাবার ধাঁচে।
জ্যোতিশ্চন্দ্রের বিয়ের ঠিক হয় রাজা নন্দকুমারের বংশধরের পরিবারে। পাত্রের বয়স তখন মাত্র চোদ্দো। পাত্রী মোতিরানী অপূর্ব সুন্দরী।
রাজ পরিবারে বিয়ে। তাই ধুমধাম তো করতেই হবে। এমনিতেই তখন সঞ্জীবচন্দ্রের ঋণজর্জর অবস্থা।
তা সত্ত্বেও ছেলের বিয়ে দিতে আরও ঋণ নিলেন সঞ্জীবচন্দ্র। এলাহী আয়োজন। ধুমধাম ঘটার যেন সীমা নেই। কাঁটালপা়ড়া থেকে হাতির পিঠে চাপিয়ে বরকে নিয়ে যাওয়া হল সালকিয়ার শ্বশুরবাড়ি।
পুরো ব্যাপারটিতে বেজায় চটেছিলেন বঙ্কিম। বিয়ের জন্য আবার টাকা ধার চাইতে গেলে প্রচণ্ড রেগে যান তিনি।
কড়া ভাষায় দাদাকে বলেন, ‘‘যে ঋণ পরিশোধ করিতে পারিবেন না মনে জানিয়াছেন, তাহা গ্রহণ করা পরকে ফাঁকি দিয়া টাকা লওয়া হয়।’’
আরেকটি ঘটনা যেমন।
বঙ্কিমের বড়দাদা শ্যামচরণ চট্টোপাধ্যায়ের ছোট ছেলে শচীশচন্দ্রের বিয়ে।
বিয়ে হচ্ছে সাহিত্যিক দামোদর মুখোপাধ্যায়ের মেয়ের সঙ্গে। পাত্রী  সুরেশ্বরী। ভাইপো পাইকপাড়ার জমিদারদের কাছ থেকে পোশাক ধার করে একেবারে রাজপুত্র সেজে এসেছেন।
রাজবেশে বর নামছেন।
বিবাহে উপস্থিত বিদ্যাসাগর।
বিদ্যাসাগর বরের হাত ধরতে গেলেন। তাতে রাজপোশাক নষ্ট হয়ে যেতে পারে মনে করে শচীশচন্দ্র বাঁ হাত দিয়ে বিদ্যাসাগরকে সরিয়ে দিলেন। থতমত খেয়ে বিদ্যাসাগর চকিতে পিছু হটলেন।
পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র। ভাইপোর এমন আচরণ দেখে তিনি অগ্নিশর্মা! — ‘‘তুমি জানো ইনি কে? ইনি বিদ্যাসাগর! এক্ষুনি ক্ষমা চাও।’’
মাথা নিচু করে ক্ষমা চাইতে বাধ্য হলেন শচীশচন্দ্র।
তবে একটা কথা কী, রাগান্বিত বঙ্কিমের যত গল্প, সবই প্রায় তাঁর পরিবারের লোকজনকে ঘিরে। বাইরের মানুষের কাছে তিনি প্রায় বিপরীত।
তবে নিজের বিশ্বাস জলাঞ্জলি দিয়ে তিনি সচরাচর পিছু হটেননি। ছিলেন অকুতোভয়ও। সে ঘরেও যেমন, তেমন বাইরেও।
আর আপস? তা বোধহয় বঙ্কিমের ধাতে ছিল না।
এমন লৌহমনা বঙ্কিমের পরিচয় দিতে তাঁর চাকরি জীবনে তাকানো যেতে পারে।
বঙ্কিম তখন খুলনার ম্যাজিস্ট্রেট। এক নীলকর সাহেব হাতির শুঁড়ে মশাল বেঁধে একটা আস্ত গ্রাম জ্বালিয়ে দিলেন। তখনও বেঙ্গল পুলিশের সৃষ্টি হয়নি। ম্যাজিস্ট্রেটের অধীনে পুলিশ কাজ করত।
দারোগারা কোনও ভাবে সাহেবকে ধরতে পারল না। তার কারণ, সাহেবের কাছে সব সময় গুলি ভরা পিস্তল থাকে। কিন্তু বঙ্কিম পিস্তলের তোয়াক্কা না করে জীবনের ঝুঁকি নিয়েই সাহেবকে ঠিক গ্রেফতার করলেন।
আরেকবারের ঘটনা বলা যাক।
তখন যশোরে। পঞ্চম শ্রেণির ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর। পঞ্চম শ্রেণি থেকে প্রথম শ্রেণি অবধি উঠতে লেগেছিল তাঁর দীর্ঘ ছাব্বিশ বছর।
মাঝে কিছু দিনের জন্য পেলেন অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারির পদ। তবে দ্রুতই এই পদটি বিলুপ্ত করে দেওয়া হয়। বঙ্কিম ফিরে যান ডেপুটির পদে।
কারণ? উপন্যাস ‘আনন্দমঠ’!
বঙ্গদর্শন-এ উপন্যাসটি বেরনোর সময় প্রকাশ বন্ধর হুকুম জারি হয়।
বঙ্কিম মানেননি।
আবার এই অবজ্ঞার কারণে তাঁর মতো দক্ষ অফিসারকে পদচ্যুত করা, সে’ও তো কঠিন কাজ!
উপায়? পদটিই লুপ্ত করে দেওয়া হল।
বঙ্কিম অবশ্য নিস্তার পাননি তাতেও। ক্রমাগত তাঁকে বদলির চক্করে ফেলে হয়রান করা চলল। বছরে দু’তিন বার করে বদলি। কখনও আলিপুর বা বারাসাত, তো কখনও জাজপুর বা ভদ্রকে। কর্তৃপক্ষের এমন আচরণে বিরক্ত হয়ে শেষে স্বেচ্ছা-অবসর নিয়ে নেন বঙ্কিমচন্দ্র। সভাসমিতিতেও বিশেষ যেতেন না। ভীষণ রাশভারী মানুষ ছিলেন। বলতেন, ‘‘যে সময় বৃথা সভাসমিতিতে কাটাব, সে সময়টা বসে লিখলে কাজ দেবে।’’
••••••
পূর্ণচন্দ্র
বঙ্কিমচন্দ্র দ্বিতীয় বিবাহ করেন হালিশহরের সীতারাম বন্দ্যোপাধ্যায়ের কন্যা রাজলক্ষ্মীকে। প্রথম স্ত্রী মোহিনী মারা যাওয়ার তখন আট মাস কেটে গেছে।
রাজলক্ষ্মীও গুণবতী। সুন্দরী।
বিয়ের চার বছর পরে তাঁদের প্রথম সন্তান শরৎকুমারীর জন্ম।
এখানে একটি ঘটনার উল্লেখ না করলেই নয়। মোহিনীদেবীর সেই যে দুল, কাঁটা— ও দু’টি বঙ্কিম বহুকাল রাজলক্ষ্মীকে দিতে পারেননি।
অন্য অনেক অলঙ্কার দিলেও মোহিনীকে দেওয়া গহনা কিছুতেই না। নববধূ রাজলক্ষ্মীকে বলেছিলেন, ‘‘এগুলি এখন আমার কাছেই রইল। যে দিন তোমায় ভালবাসিব, সে দিন দিব।’’
শরৎকুমারীর জন্মের তিন মাস পর সেই অলঙ্কার রাজলক্ষ্মীর হাতে তুলে দিতে পেরেছিলেন বঙ্কিম। সে তুলে দেওয়ার মধ্যে সে এক অপূর্ব প্রেমাতুর ভঙ্গি! নৌকায় পাড়ি দিতে দিতে নিজে হাতে স্ত্রীর কানে দুল আর চুলে কাঁটা লাগিয়ে দিলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।
বঙ্কিম বড় চাকরি করতেন, কিন্তু ধনী ছিলেন না। কারণ একান্নবর্তী পরিবার। ভাইদের সংসারও বঙ্কিমকে সামলাতে হতো। মেজদাদা সঞ্জীবের সংসারের পুরো দায়িত্বই ছিল বঙ্কিমের ওপর। সঙ্গে পরিজনদের চিকিৎসা, অন্নবস্ত্র, সব কিছুর কথাই ভাবতে হতো তাঁকে।
স্ত্রী রাজলক্ষ্মী দিনে দিনে যে কেবল চট্টোপাধ্যায় পরিবারের ‘কল্যাণস্বরূপা’ হয়ে উঠেছিলেন, তা নয়, বঙ্কিমের সাহিত্যিক বন্ধুদের কাছেও ছিল তাঁর অসীম গুরুত্ব। তাঁদের আপ্যায়নও তাঁকেই করতে হত।
স্বভাবগম্ভীর রাজলক্ষ্মী ভাল রান্না জানতেন। অতিথি এলে রাজলক্ষ্মীর হাতের রান্না না খাইয়ে বঙ্কিম পারতপক্ষে কাউকে ছাড়তেন না।
বঙ্কিম ধীরে ধীরে রাজলক্ষ্মীর কাছে খরচপত্রের দায়দায়িত্বও তুলে দেন। এমনকী নিজে চিঠিপত্র লেখারও যখন সময় পেতেন না, লিখে দিতেন রাজলক্ষ্মীদেবী। বঙ্কিম কেবল সই করে দিতেন।
রাজলক্ষ্মীর প্রতি এত নির্ভরতা ছিল যে, বলতেন, ‘‘তিনি না থাকিলে আমি কী হইতাম, বলিতে পারি না।’’
রাজলক্ষ্মীর প্রতি এত টান, অথচ শেষ দিন পর্যন্ত মোহিনী যেন বঙ্কিমের অবচেতনে ডানা মেলে ভেসে বেড়াতেন তাঁরই গহীন অতলে। মৃত্যুশয্যায় যখন অর্ধচেতন অবস্থা, যন্ত্রণায় কাতর, তখন রাজলক্ষ্মী নয়, বারবার বলেছিলেন একটিই নাম— মোহিনী, মোহিনী!—‘‘আমি এ বার তার কাছে যাব।’’
••••••
এমনিতে স্বভাবে বঙ্কিম সংযমী। কিন্তু খাবার বেলায় মাংস খেতেন অপরিমিত। অল্পবিস্তর মদ্যপানও করতেন। চেষ্টা করেও যে মদ খাওয়া ছাড়তে পারেননি, তার জন্য অবশ্য তাঁর গ্লানিও ছিল।
চিকিৎসকরা বলেছিল, ডায়াবেটিক মানুষ মদ্যপান করলে শারীরিক সমস্যা বাড়ে। বঙ্কিমেরও বেড়েছিল। কিন্তু তাতেও সুরা ছাড়তে পারেননি। বঙ্কিমের বাড়িতে নিয়মিত পোর্ট ওয়াইন আসত। নিজে পরিমিত খেতেন, কিন্তু অন্যে অপরিমিত খেয়ে বেসামাল হয়ে পড়লে সামালও দিতেন তিনি।


http://www.anandabazar.com/supplementary/patrika/bankim-chandra-and-his-memories-1.520805