স্টেডিয়াম তৈরির সময় ছবি: ডিপি সিংহ
‘‘খেতে দিতে পারছি না আর ভাবব কিনা ওয়ার্ল্ড টিটি চ্যাম্পিয়নশিপ করার কথা!’’ বললেন খাদ্য ও ক্রীড়ামন্ত্রী প্রফুল্লকান্তি ঘোষ।
পূর্তমন্ত্রী ভোলানাথ সেন বললেন, ‘‘আকাশ থেকে পড়লাম ভাই! কই, এখানে বিশ্ব টেবল টেনিসের কথা তো শুনিনি?’’
মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় শুধু দু’টো বাক্য উচ্চারণ করলেন— ‘‘আই অ্যাকসেপ্ট ইট। গো অ্যাহেড।’’
আর ইন্টারন্যাশনাল টেবল টেনিস ফেডারেশন বা আইটিটিএফ প্রেসিডেন্ট রয় ইভান্সের সঙ্গে রাইটার্স বিল্ডিংয়ে প্রথম আলাপে মুখ্যমন্ত্রীর প্রথম সংলাপ ছিল, ‘‘ইউ চুজ দ্য ব্রাইড, উই উইল ড্রেস হার আপ!’’
কুড়ি পেরোলেই নাকি বুড়ি!
তা হলে চল্লিশ মানে তো ডাবল বুড়ি। সেই থুত্থুড়ি বুড়ি কিন্তু চুপিসাড়ে এক রঙিন ইতিহাসকে বুকে করেই চল্লিশ পেরিয়ে গেল।
নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়াম।
যাকে গড়ে তোলার নেপথ্য কাহিনি অনেকটা রোমহর্ষক যুদ্ধ জয়ের মতো মনে হয়।
১৯৭৫। গোটা দেশে তখন একটাও ইন্ডোর স্টেডিয়াম নেই। এ দিকে ৩৩তম আন্তর্জাতিক টেবিল টেনিস-এর আসর প্রায় হাতের গোড়ায়। অংশ নেবে ৬৩টি দেশ। তার সঙ্গে ৬০০ প্রতিনিধি।
হাজার বাধাবিপত্তি পেরিয়ে মাত্র কয়েক মাসের চেষ্টায় নতুন তৈরি ইন্ডোর স্টেডিয়ামেই ’৭৫-এর ৬ ফেব্রুয়ারিতে বসেছিল আন্তর্জাতিক খেলার আসর।
ফিরে যাই ১৯৭৩-এ।
যুগোস্লাভিয়ার সেরাজেভো। সেখানেই বিশ্ব টিটি চ্যাম্পিয়নশিপ চলার সময় আইটিটিএফের কংগ্রেসে সিদ্ধান্ত হয়, দু’বছর পরের ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপ ভারতে হবে।
কিন্তু কোথায়?
কোন শহর পাবে তার দায়িত্ব?
এর আগে ১৯৫২-য় প্রথম বিশ্ব টেবল টেনিস চ্যাম্পিয়নশিপ হয়েছিল মুম্বইয়ে। ব্রেবোর্ন স্টেডিয়াম জুড়ে বিশাল সামিয়ানার নীচে।
সে বারই প্রথম বার ভারতে বসে অমন আসর। সে আসরের বরাত পাওয়ারও গল্প আছে একটা।
বিশ্ব টেবল টেনিস শুরু হওয়ারও দু’বছর আগে ১৯৫০-এ এশিয়ান টিটি ফেডারেশনের জন্ম এ দেশেই।
অসাধারণ সেই নজিরকে সম্মান দিতে টেবল টেনিসের প্রথম বিশ্ব প্রতিযোগিতার দায়িত্ব দেওয়া হয় ভারতকে।
তার পর তেইশ বছর কেটে গেছে।
দ্বিতীয় বার বিশ্ব টিটি-র দায়িত্বে সেই ভারত। সে সময় ভারতীয় টেবল টেনিসের প্রাণপুরুষ ছিলেন জাতীয় টিটি সংস্থার প্রেসিডেন্ট রঙ্গরামানুজম। শুরুতে তিনি যে তিন শহরের নাম ভেবেছিলেন তার মধ্যে কলকাতা ছিল না।
তাঁর তালিকায় তখন মুম্বই, দিল্লি, বেঙ্গালুরু। মুম্বই প্রথমেই সরে যায়। কিছু দিনের মধ্যে বিশ্বকাপ হকি ওই শহরে হবে এই অজুহাতে। হাত তুলে নেয় দিল্লিও।
ঠিক এ রকম একটা ‘ওয়ান হর্স রেস’ অবস্থায় আমরা, মানে, বেঙ্গল টেবল টেনিস অ্যাসোসিয়েশন নড়েচড়ে বসি। কেমন হয় যদি কলকাতায় ওয়ার্ল্ড টিটি করা যায়? সন্দেহ নেই, রীতিমতো কঠিন কাজ।
কিন্তু সেই কঠিন কাজকে অনায়াস করার জন্য যে-মানুষটির নাম আগে স্বীকার করতে হয়, তিনি প্রবীর মিত্র। তিনি তখন সর্বভারতীয় ভাইস প্রেসিডেন্ট।
পরের দিকে তাঁর কার্যকলাপে বিটিটিএ-র যত ক্ষতিই হোক, সে বার প্রবীর মিত্রই কিন্তু বেঙ্গালুরুর দিকে ঢলে থাকা রঙ্গরামানুজমকে প্রথম কলকাতার কথা ভাবতে বাধ্য করেছিলেন।
সে সময় প্রবীর মিত্রের অনুজদের দলে ছিলাম আমি ছাড়াও সরোজ ঘোষ রায়, রথীন মিত্র, বারীন ঘোষ, এখনও ময়দানে অতি পরিচিত টেবল টেনিস কর্তা রবি চট্টোপাধ্যায়ের মতো কয়েক জন।
স্পষ্ট মনে আছে, কথাটা আমরা প্রথম পেড়েছিলাম বেঙ্গল ক্লাবে এক অনুষ্ঠানের ফাঁকে। ক্রীড়া ও খাদ্যমন্ত্রী প্রফুল্লকান্তি ঘোষের কাছে। তার পরেই ওঁর সেই বিখ্যাত উক্তি। লেখার শুরুতেই যার উল্লেখ করেছি। এর পর পূর্তমন্ত্রী। তিনিও তো শুনে আকাশ থেকে পড়লেন! তাঁর কথাও বলেছি।
কিন্তু এই তাচ্ছিল্যগুলোই যেন জেদ বাড়িয়ে দিচ্ছিল। শহরের চারটে বড় কনস্ট্রাকশন কোম্পানির সঙ্গে একদম প্রাথমিক স্তরে কথাবার্তা শুরু করে দিলাম। কলকাতায় কী ভাবে, কোথায় এত ব্যাপক একটা ক্রীড়াযজ্ঞ বসানোর মতো বন্দোবস্ত করা যায়!
খুব মামুলি গোছের হলেও তখনই একটা প্রোজেক্ট রিপোর্টও তৈরি রাখা হল। যদি হুট করে মুখ্যমন্ত্রী বা টিটিএফআই, এমনকী বিশ্ব টিটি সংস্থার প্রেসিডেন্ট আমাদের প্ল্যান-প্রোগ্রাম জানতে চান।
১৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৪।
রাইটার্সে রথীন-বারীন আর আমি সে দিনই সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের কাছে এ নিয়ে প্রথম বার গিয়েছিলাম।
মুখ্যমন্ত্রী ঠিক ৩০ সেকেন্ড সময় নিয়েছিলেন। তার পরেই বলেছিলেন, ‘‘আই অ্যাকসেপ্ট ইট। গো অ্যাহেড।’’
৩৩তম বিশ্ব টেবিল টেনিস চ্যাম্পিয়নশিপ
কিন্তু এর পর?
ঠিক এক মাস পর আবার একটা ১৪ তারিখে আন্তর্জাতিক টেবল টেনিস ফেডারেশনের প্রধান রয় ইভান্স দেখা করলেন মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে। কলকাতায় ৩৩তম বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপ হওয়া নিয়ে নিজস্ব মতামত জানাতে।
তার আগে ও দিনই দিনভর ইভান্সকে নিয়ে আমরা চষে ফেললাম ময়দানে সেই সময় চলা বঙ্গ সংস্কৃতি সম্মেলনের বিশাল প্যান্ডেল থেকে শুরু করে সল্ট লেকে এখন যেটা ইন্দিরা ভবন (মানে জ্যোতি বসু মারা যাওয়া অবধি যে বাড়িতে থাকতেন) সেই পুরো তল্লাট। চল্লিশ-বিয়াল্লিশ বছর আগে লবণ হ্রদের ওই অঞ্চল ছিল ধু-ধু খোলা প্রান্তর।
সব শেষে আমরা সাহেবকে দেখালাম ই়ডেন গার্ডেন্সের লাগোয়া প্রয়াত পঙ্কজ গুপ্তর নামে টিনের শেড দিয়ে ঢাকা একটা মোটামুটি বড় জায়গা। যার মেঝে সিমেন্টে বাঁধানো। এই চত্বরটায় তখন মাঝেমধ্যে লোক দেখানো নকল কুস্তির বিশ্বযুদ্ধ হত। দারা সিংহ বনাম কিং কং, দারা বনাম জায়ান্ট— এমন সব কিম্ভুত নামধাম দিয়ে!
সব শেষে আমরা সাহেবকে দেখালাম ই়ডেন গার্ডেন্সের লাগোয়া প্রয়াত পঙ্কজ গুপ্তর নামে টিনের শেড দিয়ে ঢাকা একটা মোটামুটি বড় জায়গা। যার মেঝে সিমেন্টে বাঁধানো। এই চত্বরটায় তখন মাঝেমধ্যে লোক দেখানো নকল কুস্তির বিশ্বযুদ্ধ হত। দারা সিংহ বনাম কিং কং, দারা বনাম জায়ান্ট— এমন সব কিম্ভুত নামধাম দিয়ে!
ইভান্স সব ঘুরেটুরে বিকেলের দিকে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের সঙ্গে দেখা করলেন।
ইউনিভার্সিটির ক্রিকেট-ব্লু মুখ্যমন্ত্রী তাঁকে প্রথম দর্শনেই বোল্ড করে দিলেন তাঁর সেই বিখ্যাত সংলাপে— ‘‘ইউ চুজ দ্য ব্রাইড, উই উইল ড্রেস হার আপ!’’
পরের দিনই দিল্লি ফিরে রঙ্গরামানুজমের প্রবল বিরোধিতা আর অনিচ্ছা সত্ত্বেও বেঙ্গালুরুর দাবি নাকচ করে কলকাতাকে বিশ্ব টিটি আয়োজনের দায়িত্ব দিলেন বিশ্ব টেবল টেনিসের সর্বেসর্বা রয় ইভান্স।
কিন্তু এর পরেই তো আসল খেলা। কনে সাজানোর পালা!
গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলে টানা তিন-চার দিনের জন্য বিটিটিএ-কে ঘর ভাড়া নিতে হল গোটা পরিকল্পনার ছক কষতে। তত দিনে খবর চাউড় হয়ে গিয়েছে। তামাম মিডিয়া হত্যে দিয়ে লেগে গেল আমাদের গায়ে-গায়ে।
তার মধ্যে বিদেশি মিডিয়া মানে এপি, রয়টার্সের যে-যে সাংবাদিক ৩৩তম বিশ্ব টিটি-র প্রস্তুতি দেখতে শহর কলকাতায় এসেছিলেন, তাঁদের যেন একটাই লক্ষ্য— কী ভাবে সংগঠকদের নিন্দেমন্দ করা যায়!
এর মধ্যে দু’বার ‘ডেডলাইন’ মিস হল আমাদের। ১৯৭৪-এর ৩০ নভেম্বর দিনস্থির করেও শেষ করা গেল না স্টেডিয়ামের কাজ। তার পর ৩১ ডিসেম্বরের তারিখও ফেল।
শেষমেশ নতুন বছরের ২৩ জানুয়ারি, নেতাজির জন্মদিনেই উদ্বোধন করা গেল দেশের প্রথম ইন্ডোর স্টেডিয়ামের।
একই সময় উদ্বোধন হয়েছিল নেতাজি ইন্ডোর সংলগ্ন ক্ষুদিরাম অনুশীলন কেন্দ্রেরও। আসলে টেবল টেনিসের বিশ্ব টুর্নামেন্ট করতে হলে মূল স্টেডিয়ামের লাগোয়া প্লেয়ারদের ‘প্র্যাকটিস হল’ থাকা বাধ্যতামূলক। জানিয়েছিলেন আইটিটিএফের সেই সময়ের টেকনিক্যাল চেয়ারম্যান নেজ ভাসিল। ক্ষুদিরাম অনুশীলন কেন্দ্র তৈরি সে-কারণেই।
নেতাজি ইন্ডোরের ভূমিপুজোর তারিখটা স্পষ্ট মনে আছে। অক্ষয়তৃতীয়ার দিন। ২৫ এপ্রিল। ১৯৭৪। ভূমিপুজো করেছিলেন বিটিটিএ-রই এক ভাইস প্রেসিডেন্ট আর নারায়ণন। দক্ষিণী ব্রাহ্মণ। তিনিই পুরোহিত!
আমরা বিটিটিএ থেকে সেই যে চারটে কনস্ট্রাকশন সংস্থার সঙ্গে প্রাথমিক কথাবার্তা বলেছিলাম, তার মধ্যে ঘোষ-বোস অ্যাসোসিয়েটস এবং বোস ব্রাদার্স-এর প্ল্যান মঞ্জুর হয়। বাজেট ছিল ৯০ লাখ টাকা। কেন্দ্রীয় সরকার একটা টাকাও ঠেকায়নি। রাজ্যের বরাদ্দ মাত্র ১ লাখ।
তো এমন অবস্থাতেও ’৭৪-এর জুন মাসের শেষ নাগাদ স্টেডিয়াম তৈরির কাজে হাত পড়ে গেল।
জেসি বা জীবেশচন্দ্র তালুকদারকে আমি বলব নেতাজি ইন্ডোর সৃষ্টির ম্যান অব দ্য ম্যাচ। রাজ্য সরকারের তরফে তাঁর ওপরই স্টেডিয়াম তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হয়। ভদ্রলোক প্রাক্তন সেনা অফিসার। ছয় ফুটের উপর লম্বা। আইএএস। রেভেনিউ বোর্ডের মেম্বারও হয়েছিলেন। প্রতিদিন রাত দেড়টা-দু’টো পর্যন্ত কাজের তদারকি করে পরের দিন সকালে মুখ্যমন্ত্রীকে রিপোর্ট দিয়ে আবার পৌঁছে যেতেন নির্মীয়মাণ নেতাজি ইন্ডোরে।
রোজ এক রুটিন। উত্তম সিংহ দুগ্গল নামের এক ঠিকাদারের সংস্থাকে কাঁচ মাল দেওয়ার জন্য বেছেছিলেন জেসি। অথচ দুগ্গলের সংস্থা সেই সময় ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের ব্ল্যাক লিস্ট-এ। তা সত্ত্বেও কী ভাবে যে ‘ম্যানেজ’ করেছিলেন জেসি, তিনিই জানেন। কাঁচা মাল পেতেনও অনেক কম টাকায়।
স্টেডিয়ামের কাজের শেষের দিকে সেই দুগ্গলের সঙ্গেই একদিন জেসির কী ঝামেলা!
ঐতিহাসিক ইন্ডোর স্টেডিয়ামের বিজয় মঞ্চে
সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের ব্যক্তিগত সচিব ধ্রুব দাস, পিডব্লিউডি, কর্পোরেশনটেশনের বিভিন্ন চিফ ইঞ্জিনিয়ারদের সামনে ডেকে পাঠিয়ে দুগ্গলকে বিয়ার খেতে খেতে জেসি বললেন, ‘‘এই কাজটা আমার এই তারিখের মধ্যে চাই। আপনি না মানলে আমি প্রথমে আপনাকে অনুরোধ করতে পারি। তার পরেও না মানলে পরামর্শ দেব। তার পরে উপদেশ। তার পরে নির্দেশ। সব শেষে আদেশ। এ বার আপনার পছন্দ।’’ সুড়সুড় করে কাজ হয়েছিল। এই ছিলেন জেসি।
২৮ হাজার স্কোয়ার ফিট জুড়ে ছড়িয়ে থাকা আমাদের দেশের প্রথম ইন্ডোর স্টেডিয়ামটাকে আঠারোটা বড়-বড় পোর্টাল ধরে রেখেছে।
অত বড়-বড় পোর্টাল ঠিক ভাবে ফিট করতে ভীষণ প্রয়োজনীয় ফর্ক লিফ্ট তখন ছিল না জেসির হাতে।
তা সত্ত্বেও কাজটা নিখুঁত শেষ হয়েছিল। নেতাজি ইন্ডোরের মোট আসন ১২৩০০। ২২টা ব্লক। ১৮টা ভমিটরি— মানে স্টেডিয়ামে ঢোকার মুখের সামনের খোলা জায়গাটা।
গোটা ফ্লোর কাঠের পাঠাতন বসিয়ে বানানো। এখনকার মেটাল লাইট চল্লিশ বছর আগে তৈরিই হয়নি। হ্যালোজেন ছিল ভরসা।
শুরুতে নেতাজি ইন্ডোরের ছাদে ১৭২টা হ্যালোজেন বসানো হয়েছিল। দিনের আলোর মতো ঠিকরে বেরনো সেই আলোর নীচে যে দিন মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় আর বিশ্ব টেবল টেনিস সংস্থার প্রেসিডেন্ট রয় ইভান্সের হাত দিয়ে টিটি ম্যাচের মাধ্যমে নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হল, সেই মুহূর্তটা ভাবলে আজও গায়ে কাঁটা দেয়। তবে এখনও মনে খোঁচা মারে, সেমিফাইনালের দিন স্টেডিয়ামের ছাদের ফুটো দিয়ে মেঝেতে জল পড়ার দুঃস্বপ্ন! ম্যাচ চলছে। তার মধ্যেই টপ টপ করে জল পড়ছে ছাদ চুইঁয়ে। লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে গিয়েছিল সবার।
আসলে এ ধরনের উৎপাত থেকে বাঁচতে এক ধরনের বিশেষ ‘সলিউশন’ দিতে লাগে, তাড়াহুড়োয় সেটা দেওয়া যায়নি সেই সময়। ফলে উপরে বসানো এয়ার কুলারের জল চুঁইয়ে গড়িয়ে পড়ে স্টেডিয়ামের মেঝেয়।
দেখেছিলাম ভিআইপি বক্সে বসা সাংগঠনিক কমিটির চেয়ারম্যান সঙ্গে সঙ্গে মাথা নিচু করে ফেললেন! তাঁর নাম? সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়। মুখ্যমন্ত্রীর নামে আবার সেই সময় রটনা হয়েছিল, নির্মীয়মাণ কোলাঘাট পাওয়ার প্ল্যান্টের টাকায় নাকি নেতাজি ইন্ডোর তৈরি হয়েছে! তার ওপর ওই ঘটনা!
কোলাঘাটের ঘটনাটি নিছকই গুজব। সেখানে এক মেগাওয়াট বিদ্যুৎ তৈরির খরচ ছিল ১ কোটি টাকা। স্টেডিয়ামের খরচের সঙ্গে তার তুলনা!
তবে ওই জল পড়ার ঘটনাটি বাদ দিলে কিন্তু ’৭৫-এ ওয়ার্ল্ড টিটি-র বাকি পর্ব কিন্তু অসম্ভব জ্বলজ্বলে। টানা ওই দশ দিন স্টেডিয়ামের পিছন দিকে গড়ে উঠেছিল বাংলার শিল্প-সংস্কৃতির নানা স্টল। লক্ষ্য, বিদেশিদের কাছে দেশের সংস্কৃতি জানান দেওয়া। অসংখ্য ফুড স্টল। বিরতি দিনগুলোয় খেলোয়াড়দের নিয়ে গঙ্গায় প্রমোদতরণীতে ভ্রমণ, গানবাজনা, খানাপিনা।
‘টিটি ডিপ্লোমেসি’ একটা দারুণ জনপ্রিয় শব্দ। নেতাজি ইন্ডোরের গোড়ার ইতিহাসেও তার ছাপ রয়ে গেছে। ’৬২-তে চিনা আগ্রাসনের পরে নেতাজি ইন্ডোরের বিশ্ব টিটি চ্যাম্পিয়নশিপই ভারত-চিন দু’দেশের মধ্যে ফের কূটনৈতিক সম্পর্ক ফিরে আসার প্রথম ধাপ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে আসছে। মনে পড়ে, লিয়াং কো লিয়াং, লি চেন শি, সু সাও ফা-র মতো সেই সময়ের বিশ্বসেরা চিনা খেলোয়াড়দের কলকাতায় তাঁদের টিম হোটেলে রবীন্দ্রসঙ্গীত পর্যন্ত গাইতে শুনেছি।
এ নিয়ে আরও একটি ঘটনার উল্লেখ করতে পারি।
বিভিন্ন রাজনৈতিক কারণে দক্ষিণ আফ্রিকা আর ইজরায়েল দলকে ভারত সরকার সে বার কলকাতায় খেলার অনুমতি দেয়নি।
এ শহরে বসেই আন্তর্জাতিক টিটি সংস্থা যে কারণে ভারতীয় টিটি ফেডারেশনের বিরুদ্ধে নিন্দাসূচক প্রস্তাব গ্রহণের সিদ্ধান্ত প্রায় নিয়েই ফেলেছিল। তখন চিন আর রাশিয়া প্রবল আপত্তি তুলে ভারতের পাশে দাঁড়ায়। তাই পিছু হটেন ইভান্স।
এমন সব ঐতিহাসিক ঘটনা পরম্পরার মধ্যে দিয়ে যে স্টেডিয়ামের জন্ম, পরের অধ্যায়ে কোথায় যেন হারিয়ে গেল তার সেই রং!
বিশ্ব টিটি বাদে গত চল্লিশ বছরে একটা এশিয়ান টিটি চ্যাম্পিয়নশিপ, একটা গ্রাঁপ্রি টিটি, গোটা কয়েক জাতীয় টিটি টুর্নামেন্ট। ব্যস।
অন্য খেলার ইভেন্ট বলতেও তথৈবচ। বিজয় অমৃতরাজ, লেন্ডল-অরান্টেস নিয়ে মশালা টেনিস, একটা এশিয়ান বাস্কেটবল, একটা এশিয়ান ব্যাডমিন্টন, একটা কমনওয়েলথ ভলিবল আর ওই ওয়ার্ল্ড পাওয়ারলিফ্টিং। তার বাইরে খেলার বৃত্ত থেকে ক্রমেই যেন দূরে হঠছে ইন্ডোর স্টেডিয়াম। সত্যিই কি তবে চালশেয় পেল বাংলার এই গর্বকে।
মেনে নিতে যে কষ্ট হয়!
http://www.anandabazar.com/supplementary/patrika/a-winning-story-1.445261
No comments:
Post a Comment