ফরিয়াদ’ ছায়াছবির গান শোনাতে নচিকেতা ঘোষ গিয়েছেন সুচিত্রা সেনের বাড়ি।
মন দিয়ে গান শুনলেন মহানায়িকা।
শেষে বললেন, ‘‘শুনুন, গানের মাঝে হাসিটা কিন্তু আমি নিজে হাসব। আপনার আশা ভোঁসলে নয়। আমি রেকর্ড করে দেব। আপনি নিয়ে যাবেন।’’
ঘাড় কাত করে সম্মতি জানালেন নচিকেতা।
দিন কয়েক পর।
মুম্বই। আশা ভোঁসলের বাড়ি।
হাজির নচিকেতা ঘোষ।
সব শুনে আশাজি বললেন, ‘‘ইয়ে সুচিত্রা সেন নে হাসকে দিয়া, ইসসে আচ্ছা হাসি আউর হোগাই নেহি। শুনাইয়ে সুচিত্রা সেন কা রেকর্ড। দেখুঙ্গি ক্যয়া হ্যায় উসকি হাসি মে, জো মেরা নেহি হ্যায়!’’
এ রকমটাই চাইছিলেন বাবা।
মনে করতেন, শিল্পীদের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলে, ধাক্কা দিতে পারলে সেরা কাজটা বেরিয়ে আসে।
মহাজাতি সদনের সেই অনুষ্ঠান
|
পুলককাকু (পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়), গৌরীকাকুকে (গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার) কত বার লড়িয়ে দিয়েছেন! একজনের গানের লাইন আরেক জনের কথায় মিলিয়ে দিয়েছেন। তার থেকে দুর্ধর্ষ সব হিট গান তৈরি হয়েছে।
বাবা নিজেও মুখড়া লিখে দিয়েছেন কত সময়!— ‘যদি কাগজে লেখো নাম’, ‘হাজার টাকার ঝাড়বাতিটা’, ‘মুকুটটা তো পড়েই আছে’, ‘এমন একটি ঝিনুক খুঁজে পেলাম না’...।
এই মুখড়া লেখা, লাইন জোড়ার খেলা নিয়ে এমন সব উত্তপ্ত পরিস্থিতি তৈরি হত যে, বাড়িতে গৌরীকাকু, পুলককাকু একসঙ্গে থাকলে দু’জনে দু’ঘরে বসতেন।
গান তৈরির বেলায় বাবা থাকতেন একেবারে নির্দয়। অসম্ভব মেজাজি। আর অদ্ভুত, সকলেই ওঁর এই মেজাজটাকে মেনে নিতেন। বা মানিয়ে নিতেন। এতটাই শ্রদ্ধা ছিল প্রত্যেকের।
‘ফরিয়াদ’-এর কথায় ফিরি।
সেই গান ‘নাচ আছে গান আছে’। সুচিত্রা সেন যে গানে অমন মন্তব্য করেছিলেন।
রেকর্ডিং-এর সময় গাইতে গাইতে আশাজি হাসতে হাসতে কেঁদে ফেললেন...‘আমি হাসি শুধু হাসি...আমার লাগে না ব্যথা লাগে না...’।
কলকাতায় ফিরতে রেকর্ডিং শুনলেন সুচিত্রা সেন। স্তব্ধ। মুগ্ধ। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, ‘‘এ যাত্রায় আমার হাসিটা বাদ থাক।’’
বাবার কাজের ধাঁচটাই ছিল এ রকম। সেরাটা বের করে আনার তরিকাটাই ছিল ওঁর একদম আলাদা।
‘ইন্দ্রাণী’ ছবির গান তৈরি হচ্ছে।
বাবা হেমন্তকাকুকে নিয়ে মুম্বইতে। গীতা দত্তকে সঙ্গে নিয়ে হেমন্তকাকু ডুয়েট গাইবেন ‘সূর্য ডোবার পালা’, ‘নীড় ছোট ক্ষতি নেই’।
রেকর্ডিং-এর দিন আমার মনে আছে স্টুডিয়োতে রাজকপূর ছিলেন, বাবা রেকর্ডিং করাচ্ছেন শুনে ফ্লোরে এসেছিলেন। টান টান উত্তেজনা। অ্যারেঞ্জার লক্ষ্মীকান্ত-প্যারেলাল।
হল রেকর্ডিং। পরে বাবা বলেছিলেন, সে দিন হেমন্তকাকু আর গীতা দত্তর গলা যে ভাবে বেজেছিল, আর কোনও দিন নাকি ও ভাবে বাজেনি!
‘ইন্দ্রাণী’র কাজ করতে করতে হঠাৎই মাঝপথে বাবা ছবির পরিচালক নীরেন লাহিড়িকে বলে বসলেন, ‘‘এই ছবিতে আমি একটা হিন্দি গান রাখব। আর সেটা গাওয়াব মহম্মদ রফিকে দিয়ে।’’
শুনে পরিচালক-প্রযোজক সবারই তো মাথায় হত। বাংলা ছবিতে মহম্মদ রফি গাইবেন! রাজি হবেন? আর হলেও বা, কত টাকা চাইবেন, সে টাকা জোগাড় হবে কোত্থেকে? ভেবে কূলকিনারা পাচ্ছিলেন না ওঁরা।
যে যাই ভাবুক, সকলে কিন্তু একটা ব্যাপারে নিশ্চিত, নচিকেতা ঘোষ গানের জন্য যা ঠিক করবেন, আদায় করেই ছাড়বেন।
ভরসা সেই হেমন্তকাকু। উনিই রফির বাড়ি নিয়ে গেলেন বাবাকে। ‘সবি কুছ লুটাকার হুয়ে হাম তুমহারে’— গান শুনে মহম্মদ রফি তো প্রায় পাগল হয়ে গেলেন, ‘‘ক্যয়া ধুন বানায়া আপনে! ইতনা মিঠা...!’’
তক্ষুনি রেকর্ডিং-এ রাজি উনি।
এ দিকে প্রযোজকের কথামতো বাবা তখন ওঁকে বললেন, ‘‘ওঁরা কিন্তু আপনাকে পাঁচশো টাকার বেশি দিতে পারবেন না।’’
‘‘পাঁচশো টাকায় রেকর্ডিং!’’ চমকে উঠলেন রফি।
রফির আঁতকে ওঠা দেখে বাবা উঠে পড়লেন। এর পর কী যে মনে হয়েছিল রফিসাবের! দরজার দিকে চলে যাচ্ছেন বাবা, অমন সময় পিছু ডাকলেন তিনি। বললেন, ‘‘ছাড়ুন, ছাড়ুন। ও সব কথা ছাড়ুন। আপনার জন্য এ গানটা আমি বিনা পয়সায় গেয়ে দেব।’’
এই হলেন নচিকেতা ঘোষ। মনে মনে হয়তো জানতেন, তাঁর গান এক বার শুনলে কেউ ফিরিয়ে দিতে পারবেন না!
অথচ অমন নিয়মনিষ্ঠ, একরোখা বাবা, এক এক সময় গানের ব্যাপারে এতটা উদাসী হয়ে যেতেন, কী বলব!
হেমন্তকাকু ছিলেন বলতে গেলে আমাদের পরিবারেরই একজন। কত বার হয়েছে, বাবা কাজে যাবেন মুম্বই। স্কুল ছুটি বলে আমিও জুড়ে গেলাম সঙ্গে। বাবা কাজ সেরে ফিরে গেলেন। আমি রইলাম হেমন্তকাকুর কাছে। ফেরার সময় বাবা খালি বলে যেতেন, ‘‘সাত দিন রেখে ওকে পাঠিয়ে দেবেন।’’
এতটাই কাছের ছিল সম্পর্কটা।
লতা মঙ্গেশকরের পাশে |
সেই হেমন্তকাকুই হয়তো হঠাৎ বলেছেন, ‘‘নচিবাবু, আপনার একটা গান দিন না!’’
দিয়ে দিলেন বাবা।
‘হাম ভি ইনসান’ ছবিতে আজও যদি কেউ গীতা দত্ত আর সুমন কল্যাণপুরের ডুয়েট ‘ফুলওয়া’ শোনেন, দেখবেন মনে হবে প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘মেঘলা ভাঙা রোদ উঠেছে’ গানটাই যেন হুবহু হিন্দিতে বাজছে। লোকে ভাবেন বুঝি গানটা চুরি হয়ে গিয়েছিল।
ঘটনা তা কিন্তু নয়।
তখন এ ভাবে বাবা ওঁর বহু গান দিয়ে দিয়েছেন। যেমন ধরুন, ‘অসমাপ্ত’ ছবিতে গাওয়া হেমন্তকাকুর গান ‘কান্দ ক্যানে মন রে’। এটা মরাঠি ভাষায় যখন হয়, তখন হেমন্তকাকু-লতাজি ডুয়েট গাইলেন। বলা হল সুর লতাজির। আসলে কিন্তু সুরটা বাবার। বাবা এ সব নিয়ে কোনও দিন মাথাই ঘামাননি।
লতাজিও তো এক রকম আমাদের পরিবারেরই হয়ে গিয়েছিলেন। বাড়িতেও এসেছেন। এক বার মনে পড়ে, হেমন্তকাকুর সঙ্গে রিহার্স করছেন। হঠাৎ কী মনে করে ব্যাগ থেকে সদ্য কেনা ক্যামেরাটা বার করলেন। ভারতে তখন প্রথম অটো-শাটার ক্যামেরা এসেছে। ওটা ছিল তাই-ই। তা দিয়ে শিশুর মতো ছবি তুলে ফেললেন বেশ কয়েকটা।
লতাজি অসম্ভব ভালবাসতেন বাবাকে। এত যে গুণী মানুষের ভালবাসা, শ্রদ্ধা পেয়েছেন বাবা, গান তৈরির ক্ষেত্রে কিন্তু কাউকে রেওয়াত করতেন না। এ সব ব্যাপারে বাবার মতো এত ঠোঁটকাটা মানুষ আমি খুব কমই দেখেছি।
মান্নাকাকু তো এক বার আমায় বলেই ফেলেছিলেন, ‘‘শোনো খোকা (আমার ডাকনাম), আর যাই হোক, বাবার মতো মুখটা যেন তোমার না হয়, দেখো।’’
বাবার মেজাজের সাক্ষী থেকেছেন খোদ উত্তমকুমারও।
‘নিশিপদ্ম’ ছবির কথা মনে পড়ছে। ‘না না না আজ রাতে আর যাত্রা শুনতে যাব না’-র পিকচারাইজেশন। উত্তমকাকুর ওপর রেগেমেগে সেটই ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন বাবা।
ঘটনাটা বলি।তার আগে বলে রাখি, গানে বা ছবিতে ওই যে নটবর চরিত্রটা, ওটা কিন্তু বাবারই তৈরি। ঢুলুকাকুর (পরিচালক অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়) সঙ্গেও বাবার তো খুব দহরম-মহরম ছিল। তো, বাবারই আবদারে ছবিতে নটবরের চরিত্রটা আনেন ঢুলুকাকু।
পিকচারাইজেশন হবে। সে দিন আবার উত্তমকাকুর মুড ভাল নেই। ফ্লোরে এসে গম্ভীর গলায় বললেন, ‘‘ঢুলুদা, নচির গান, ওকে ডাকুন। ও না থাকলে হবে না।’’
খবর পেয়ে বাবা কিছুক্ষণের মধ্যেই হাজির। ইন্ডাস্ট্রিতে বাবা আর উত্তমকাকু প্রায় সমসাময়িক। ওঁদের দু’জনের মধ্যে সম্পর্ক ছিল তুইতোকারির। ফ্লোরে পৌঁছে বাবা আগে চলে গেলেন উত্তমকাকুর কাছে। —‘‘অ্যাই, আজ কী পাঠিয়েছে রে সুপ্রিয়া? দে খাই।’’
প্রচণ্ড খেতে ভালবাসতেন বাবা। সন্ধ্যাপিসি (মুখোপাধ্যায়) উৎপলাপিসিকে (সেন) প্রায়ই ফোন করে বলতেন, ‘‘শোন, চা আর টোস্ট বানা তো, আসছি আমি।’’ বাড়িতে হয়তো গান তোলার জন্যই এসেছেন, আগে চলে যেতেন ঠাকুমার হেঁশেলে। শুরু করে দিতেন, ‘শুক্তুনিতে কী ছ্যাঁকা দিচ্ছ গো?’ ‘বড়ির ঝালে কীসের ফোড়ন?’
তো, সে দিন সুপ্রিয়াকাকিমার হাতের রান্না খেয়েই কাজ শুরু। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক বাজছে। সেতারে খ্যামটার সুর। সেই মোক্ষম সময়টাতেই তালটা কেটে গেল!
উত্তমকাকু বললেন, ‘‘আমি এখানে শুয়ে শুয়ে লিপ দেব।’’
শুনে বাবা প্রচণ্ড খেপে গেলেন। মুখের ওপর বলে দিলেন, ‘‘ব্যাকগ্রাউন্ডে সুর বাজছে। সামনে নটবর। আর তুই শুয়ে লিপ দিবি? তা হলে আর আমায় ডাকলি কেন? আমি চল্লুম।’’
কথাটুকু বলেই ছিটকে বেরিয়ে গেলেন বাবা। উত্তমকাকু ততক্ষণে বুঝে গেছেন, একটা ভুল হয়ে গেল!
সাততাড়াতাড়ি লোক পাঠিয়ে ডেকে আনা হল বাবাকে। বাবাকে ফিরতে দেখেই উত্তমকাকু আর দেরি করলেন না। নটবরকে দেখিয়ে খ্যামটা নাচতে শুরু করে দিলেন।
ভালবাসা তো ছিলই, উত্তমকাকুর সঙ্গে বাবার এ রকম রাগারাগি, খুনসুটি প্রায়ই চলত। তার মধ্যেই বাবা এক বার উত্তমকাকু আর সুপ্রিয়াকাকিমাকে দিয়ে গান গাওয়ালেন। উত্তমকাকুর গাওয়া এক মাত্র রেকর্ডেড গান। —‘এই মনজোছনায় অঙ্গ ভিজিয়ে এসো না গল্প করি’।
আমাদের বাড়িতেই বাবা গানটা শিখিয়েছিলেন ওঁদের। উত্তমকাকু গাইছেন। সঙ্গে সুপ্রিয়াকাকিমা একটা-একটা করে লাইন... কী যে সব মুহূর্ত! উদ্দেশ্য ছিল, মহাজাতি সদনে মেয়র গোবিন্দ দে’র একটা ফান্ড রিলিজ অনুষ্ঠানে ওঁদের দু’জনকে দিয়ে গানটা গাওয়ানোর।
•
আমার বাবাকে লোকে বলত গম্ভীর। কিন্তু সেটা ছিল আপাতভাবে। প্রথম আলাপে সকলেই ভয় পেত ওঁকে। কিন্তু সেই খোলসটার ভিতরে অদ্ভুত একটা নরম মন ছিল বাবার।
বাবাকে সবচেয়ে ভাল চেনা বা ছোঁওয়া যেত বাবার গানে। আজ মনে হয়, সে দিনের সেই খ্যামটা গানের মধ্যেও বোধ হয় বাবা বলে দিয়েছিলেন ওঁর জীবনের মূল সুরটা— ‘আমার মনটা যদি সিরাজ সাজে, ভাগ্য মিরজাফর’।
বাংলায় দারুণ সব হিট গানের পর হঠাই বাবার জেদ চাপল মুম্বই যাবেন।
কিন্তু মুম্বইয়ের গিয়ে বাবা ওখানকার পরিবেশ-পরিস্থিতি-মানসিকতার সঙ্গে কিছুতেই মানিয়ে নিতে পারলেন না। ফিরে আসেন।
এমন না-মানিয়ে নেওয়া গল্প হয়তো অনেক। একটা বলি।
মুম্বইতে ‘স্বয়ংসিদ্ধা’ ছবির গান। মান্নাকাকু গাইবেন। সঙ্গে আশাজি। তারিখ-টারিখ সব ঠিক। অ্যারেঞ্জার ছিলেন সুমিত মিত্র। তিনি আবার লক্ষ্মীকান্ত-প্যারেলালের সহকারী। ওই দিন কিছুতেই ওঁরা সুমিতকে ছাড়লেন না। এমনকী স্টুডিয়োটার ‘ডেট’টাও প্রায় আটকে দেবার চেষ্টা করতে লাগলেন। ওঁরা বাবাকে বললেন, ‘‘আপনি অন্য একটা ডেট নিন। ও দিন না হয় সুমিতকেও ছেড়ে দেব।’’
এ কথায় ভয়ঙ্কর রেগে গেলেন বাবা। বলে দিলেন, ‘‘শুনুন, গান হবে না তো হবে না। স্টুডিয়োতে তেমন হলে ফুটবল খেলব। কিন্তু এই ডেটটা আপনি পাবেন না।’’
শেষে আশাজি সব শুনে বললেন, ‘‘ঘোষদাদা, ইয়ে সব বদমাসি হ্যায়। আপ কিজিয়ে আপনা কাম। ম্যায় আপকা সাথ হুঁ।’’
নতুন তিনটে গান লেখাই ছিল। মিউজিশিয়ান ডেকে নোটেশন করলেন বাবা। গান রেকর্ড হয়ে গেল। সেই সুমিত মিত্রকে ছাড়াই।
মান্নাকাকু তো ঘরের লোক। ওঁকে অনেক দেখেছি। চিনেছি। কিন্তু সে দিন দেখেছিলাম আশা ভোঁসলেকে— অত অল্প সময়, অত ভাল কাজ করে পেশাদারিত্ব কাকে বলে উনি দেখিয়ে দিয়েছিলেন।
তবে এমন অবস্থা বারবার সামলে বাবার পক্ষে কাজ করা ওখানে সম্ভব ছিল না। ফিরেও এসেছিলেন তাই।
আমার স্পষ্টবক্তা মেজাজি বাবার আরেকটা ঘটনা মনে পড়ছে।
গানটা ছিল ‘এক গোছা রজনীগন্ধা হাতে নিয়ে বললাম...’। এইচএমভি স্টুডিয়ো। দমদম। হেমন্তকাকু বারবার রেকর্ড করে চলেছেন। বাবার কিছুতেই পছন্দ হচ্ছে না।
হঠাৎ সবার সামনে বাবা গম্ভীর মুখে কাকুকে বলে দিলেন, ‘‘একটু দরদ দিয়ে গাইলে গানটা হিট হবে।’’
উত্তরে হেমন্তকাকু কিন্তু একটা কথাও বললেন না। এমনকী এই ঘটনার পর দু’জনের সম্পর্কও এতটুকু টাল খায়নি। যেমন বন্ধু ছিলেন, তেমনই থেকে গিয়েছিলেন ওঁরা। গানের সময় কে বন্ধু, কে কার আপন— মনেই রাখতেন না বাবা। অন্যরাও এ কথা বুঝতেন। আর বাবাও জানতেন, কাকে কী বললে কাজ হবে। গানটাও হিট হবে।
তবে বাবার কি কোনও পক্ষপাতিত্ব ছিল?
যেমন ধরুন, সত্তর দশকের শেষাশেষি বাবার বিরুদ্ধে একটা অভিযোগ উঠত প্রায়ই। বাবা সব গানই মান্না দে-কে দিয়ে গাওয়াচ্ছেন। কিশোরকুমারকে দিয়ে নয় কেন?
উত্তমকুমার, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় থেকে অনুপকুমার, সবার ঠোঁটেই তখন মান্না দে’র গান তুলে দিচ্ছেন বাবা।
এ কথায় ফিরব, তার আগে একটা ঘটনা বলে নিই।
রাগ করতেন। মুখের ওপর কড়া কড়া কথা বলে দিতেন। কিন্তু বহু গুণিজনকে দেখেছি, সব কিছুর ওপরে বাবাকে ওঁরা মনে রেখেছেন, বাবার বিশেষ কিছু গুণের জন্য।
সঞ্জীবকুমারের কথাই যেমন।
স্বয়ংসিদ্ধা-র রিমেক। কথা ছিল ছবিতে অভিনয় করবেন সঞ্জীবকুমার। মুম্বইতে গেলাম আমরা। ছবির চিত্রনাট্যকার রানাসাহেব আর আমি ওঁর সঙ্গে দেখা করলাম শ্যুটিং-এর মাঝেই। লীনা চন্দ্রভরকারের সঙ্গে শ্যুট করছেন। শ্যুটের ফাঁকেই কথা হল।
আমি নচিকেতা ঘোষের ছেলে শুনে উনি যে ভাবে ‘রি-অ্যাক্ট’ করেছিলেন, কোনও দিন ভুলব না। বলেছিলেন, ‘‘আমি দুটো কারণে নচিকেতা ঘোষকে কোনও দিন ভুলতে পারব না। ফিল্মালয়-তে ওঁর সঙ্গে আমি রুম শেয়ার করেছি। কী যে সব মিঠে সুর তৈরি করতেন! আর একটা ব্যাপারও খুব মনে পড়ে, প্রচুর বাঙালি খাবার খাওয়াতেন।’’
শেষ পর্যন্ত ‘ডেট’ পাওয়া গেল না বলে ‘স্বয়ংসিদ্ধা’য় সঞ্জীবকুমারকে দিয়ে অভিনয় করানো যায়নি। কিন্তু বাবাকে নিয়ে ওঁর উচ্ছ্বাসভরা কথাগুলো আমার কানে আজও বাজে।
ফিরছি কিশোরকুমার প্রসঙ্গে।
সঞ্জীবকুমার তো হল না। রানাসাহেব নতুন আব্দার করে বসলেন। রঞ্জিত মল্লিকের মুখে ‘কিচিমিচি কিচিমিচি’ গানটা কিশোরকুমারকে দিয়ে গাওয়াতে হবে।
বাবা ফোন করতেই কিশোরকুমারের গলা, ‘‘আরে, নচিদা, তুমি তো আমায় ভুলেই গেছ! ঠিক আছে, আমি ইকবালকে পাঠাচ্ছি।’’
ইকবালকে পাঠাচ্ছি মানে? ইকবাল কে? তিনি তো কিশোরদার ড্রাইভার!
বাবা তো ভয়ানক চটে গেলেন। গানের কথা বলতে ড্রাইভার পাঠানো— এর মানে কী?
কিশোরকুমারের রেকর্ডিং-এ
|
ইকবাল আসতে ওঁর কথাতে সব পরিষ্কার হল। টাকার যে অঙ্ক ইকবাল জানালেন তাতে বাবা রাজি হলেন না।
এই ঘটনার পর বাবা মান্নাকাকুকে দিয়ে গানটা গাওয়ালেন। ‘কিচিমিচি’ সুপারহিট হল। এ রকম কিছু ঘটনার সময়ই বুঝতাম বাবার কাছে গানটাই ছিল আসল। আর্টিস্ট নয়। তবে কিশোরকুমারের সঙ্গে যে এ রকম হল, তাতে কি বাবার সঙ্গে ওঁর সম্পর্ক চলে গিয়েছিল? একেবারেই না।
‘শেষ থেকে শুরু’ ছবির গান ‘বলো হরি হরি বোল’, বাবা কিশোরদাকে দিয়েই গাওয়ালেন।
সেও এক গল্প বটে!
কিশোরদার বাড়ি গিয়ে প্রথমেই ওঁকে এক তাড়া নতুন নোট দিলেন বাবা। নতুন নোট কিশোরকুমারের ভীষণ পছন্দের। এক গুচ্ছ অমন নোট পেয়ে উনি তো বেজায় খুশি। প্রাণভরে গন্ধ নিলেন নোটের। তার পর বললেন, ‘‘মা, নচিদা এসেছে, লুচি পাঠাও। জমিয়ে খাওয়া হবে।’’
বাবা শুনে আঁতকে উঠলেন। বললেন, ‘‘আরে আরে আমার হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল, আর তুমি আমায় লুচি খাওয়াচ্ছ?’’
কে শোনে কার কথা!
কিছুক্ষণ বাদেই বাড়ির এক কাজের লোক মাথায় কুলট নিয়ে ঢুকল ঘরে। কুলট উপচে পড়ছে লুচি!
•
বাবার খুব প্রিয় গায়িকা ছিলেন সন্ধ্যাপিসি (মুখোপাধ্যায়) আর আরতিপিসি (মুখোপাধ্যায়)। তবে এক জন আর্টিস্টকে বাবা খুব ভাল বাসতেন। তিনি রবীন মজুমদার। রবীন মজুমদার কোনও এক নেশায় জীবনটা প্রায় শেষই করে ফেলেছিলেন। বেঁচে ফিরেছিলেন বাবারই জন্য।
বাবা ওঁকে আমাদের বাড়ি নিয়ে আসেন। আমার বাবা নিজে আরজিকর থেকে এমবিবিএস পাস করেছিলেন। ডাক্তারি করেননি গানকে ভালবেসে। ঠাকুরদা চেয়েছিলেন তাঁর ছেলে ডাক্তারি পড়ুক। তাই পড়েছিলেন। ওই পর্যন্তই। ঠাকুর্দা সনৎকুমার ঘোষ নিজে ছিলেন ডা. বিধানচন্দ্র রায়ের চিকিৎসক।
এই দু’জনের চিকিৎসাতেই রবীন মজুমদার ‘দ্বিতীয় জীবন’ পেয়েছিলেন। টানা সাত-সাতটা বছর আমাদের বাড়ি ছিলেন উনি। ওঁর সেবায় এক ফোঁটা যাতে ঘাটতি না হয়, সে দিকে পুঙ্খানুপুঙ্খ নজর ছিল বাবার।
রবিজ্যেঠু সুস্থ হওয়ার পর বাবা গৌরীকাকাকে এক দিন বললেন, ‘‘রবিদার জন্য ফাটাফাটি একটা গান বানা তো।’’
কথা হচ্ছিল শ্যামবাজারের বিখ্যাত কষা মাংসের দোকান ‘গোলবাড়ি’-র সামনে দাঁড়িয়ে। হার্ট অ্যাটাক, শারীরিক অসুস্থতার তোয়াক্কা না করে বাবা তখন বাড়ির বাইরে যথেচ্ছ মুখরোচক খাবার খেয়ে বেড়াতেন। বিধান সরণির চাচা হোটেলের পাশ দিয়ে যাচ্ছেন, যত কাজই থাক থামবেনই থামবেন। ওখানকার ফাউল কাটলেটটা না খেলে চলে! সিমলা পাড়ায় নকুড়ের দোকানের সন্দেশটা চাই-ই চাই।
সে দিন গৌরীকাকা কাটলেটটা সবে শেষ করেছেন, নিয়মের সিগারেটটাও শেষ। হঠাৎই লিখলেন, ‘‘আমার গানের স্বরলিপি লেখা রবে।’’ তার পর ধীরে ধীরে পুরো গানটা হল। সুরও বসল তাতে।
এ বার রবিজ্যেঠুর গল্পটা শুনুন।
গান শুনে রবিজ্যেঠু বললেন, ‘‘এই গান শুনে একজনের কথাই মনে হচ্ছে। হেমন্তবাবু। উনি এ গান গাইতে পারবেন।’’
ভাবুন শুধু। এই মানুষগুলো এমনই ছিলেন। ‘আগামী পৃথিবী’ আজও সে-গান কান পেতে শোনে।
•
বাংলা সিনেমায় গান তৈরির ক্ষেত্রে পরিচালকরা শুধু ‘সিচ্যুয়েশন’টা সংক্ষেপ করে বলে দিতেন বাবাকে। বাদ বাকি দায়িত্বটা ছিল বাবারই।
এ নিয়েও অদ্ভুত-অদ্ভুত সব গল্প আছে বাবার। ৈমনে পড়ছে ‘মৌচাক’-এর কথা। ‘পাগলাগারদ কোথায় আছে’ গানটা প্রথমে চিত্রনাট্যে ছিল না। বাবা পরে এটা ঢোকান। এ রকম বেশ কয়েক বার হয়েছে।আবার উল্টো ছবিও আছে। কোনও পরিচালক যদি ছবিতে গান ঢোকানোর জন্য বেশি চাপাচাপি করতেন, বাবা রসিকতা করে প্রায়ই বলতেন, ‘‘এখানে গান দেবেন? দিন। তবে দর্শকরা কিন্তু এই সময় টয়লেটে যাবে।’’
ছবির সিক্যুয়েন্স বুঝে গান ফেলাতে বাবার সত্যি জুড়ি পাওয়া ভার!
অভিন্ন-হৃদয় হেমন্ত-নচিকেতা
|
‘ধন্যি মেয়ে’র কাজ হচ্ছে। গানের মধ্যে দিয়ে একটা মেয়েকে ডানপিটে বোঝাতে হবে। পুলককাকু লিখলেন, ‘‘যা যা বেহায়া পাখি যানা, অন্য কোথা যানা...।’’ পাখির সঙ্গে কথা বলছে সেই মেয়ে। খুঁজে পেতে বাবা স্টুডিয়োতে মন্টু বন্দ্যোপাধ্যায়কে (হরবোলা) আনিয়েছিলেন রেকর্ডিং-এ।
ভাস্কর বসুর ‘ঠাকুমার ঝুলি’র কাজ করছেন বাবা। ছোটদের গান, রূপকথার গান নিয়ে প্রবল উৎসাহ ছিল বাবার। ‘ঠাকুমার ঝুলি’র এক জায়গায় বলা হচ্ছে, ‘কুড়মুড় খাই কুসুমের মুন্ডি/কুড় কুড় কুড় করে খাই অজিতের পিন্ডি।’
কিন্তু এই মুন্ডু-পিন্ডি খাওয়ার আওয়াজটা হবে কী করে? মহা মুশকিল। অনেক পরীক্ষানিরীক্ষা চলল। কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। এ দিকে স্টুডিয়োর সময়সীমা ফুরিয়ে আসছে। ভাড়ার অঙ্কও বাড়ার মুখে।
হঠাৎ রাধুকাকু (রাধাকান্ত নন্দী) বললেন, ‘‘ও নচিবাবু, পয়সা দিন তো।’’
কিছু না বলেই বাবা দশ টাকার একটা নোট দিলেন রাধুকাকার হাতে। তা দিয়ে এক ঠোঙা লেড়ো বিস্কুট কিনিয়ে আনা হল। এ বার সেই লেড়ো প্রত্যেকের হাতে দিয়ে বলা হল, প্রত্যেককে এক সঙ্গে মাইক-এর সামনে বিস্কুটে কামড় দিতে হবে। খচরমচর সেই লেড়োর খাওয়ার আওয়াজেই তৈরি হল রাক্ষসখোক্কসের মুন্ডি-পিন্ডি খাওয়ার শব্দ!
নেপথ্যের এই ঘটনাটি শুনে ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য বলেছিলেন, ‘‘ঠাকুমার ঝুলির ঠাকুমাকে চিনতাম এত দিন। এ বার ঠাকুরদাকে চিনলাম।’’
রাধুকাকু ছিলেন আমাদের একজন ‘মুশকিল আসান’। ‘বন্ধু’ ছবির কাজ করার সময় রাধুকাকার ওপর দিয়ে যা গেছে! পরিচালক চিত্ত বসু বাবাকে একটা ব্যাপারে হঠাৎ খুব জোর করতে লাগলেন। ‘‘মালতী ভ্রমরে’ গানটিতে উস্তাদ কেরামাতুল্লা খান যেন তবলা বাজান!
বাবা যে খুব একটা রাজি হচ্ছিলেন, এমন নয়। কারণ ওঁর ভয় ছিল, উস্তাদজি তো ঠিক ছবিতে বাজিয়ে অভ্যস্ত নন। ফলে অসুবিধে হতে পারে। শেষে পছন্দ না হলে অত বড় মাপের একজন তবলিয়ার বাজনা বাদ দেওয়াটাও তো অস্বস্তিকর!
কিন্তু-কিন্তু করেও শেষপর্যন্ত পরিচালক এত জোরাজুরি করলেন যে, স্বভাববিরুদ্ধ কাজটা করতেই হল বাবাকে।
রেকর্ডিং হল। বাবার আশঙ্কাই ঠিক। গানের সঙ্গে কিছুতেই উস্তাদজির বাজনা যাচ্ছে না। এখন উপায়?
অনেক ভেবে বাবা রাধুকাকাকেই ডাক পাঠালেন। এ দিকে সব ব্যাপার শুনে রাধুকাকা তো স্টুডিয়োর পথই মাড়াতে চান না। প্রচণ্ড অস্বস্তি ওঁরও।
অনেক বুঝিয়েসুঝিয়ে রাজি করানো হল রাধুকাকাকে। স্টুডিয়োয় এলেন। গানটা ঠিক দু’বার শুনলেন। তার পর ওঁর হাতে যে বোল উঠল, প্রাণ ভ’রে গেল সবার।
তখন উস্তাদ কেরামাতুল্লাকে দেখতে হয়! কী মানুষ ছিলেন! রাধুকাকাকে বুকে টেনে নিলেন তিনি! এত খুশি হয়েছিলেন ওঁর বাজনা শুনে।
এ সব মানুষজন যে কোথায় হারিয়ে গেল!
তখন অনেক শিল্পীর মধ্যেই এই ধরনের ব্যাপার-স্যাপার দেখেছি। পারস্পরিক অসম্ভব শ্রদ্ধাবোধ। একে অন্যের জন্য চিন্তা করা। শুধুই নিজেরটা না-ভাবা। এমনকী সম্পর্কের মধ্যেও যে কত রকমের ভাললাগা-আবেশ জুড়ে থাকত!
গীতা দত্ত যেমন। কলকাতায় এলেই আসতেন আমাদের বাড়ি। মায়ের সঙ্গে গল্প করতে করতে বলতেন, ‘‘খুব জোর আপনি নচিদাকে পেয়ে গিয়েছেন। নইলে ওঁর সঙ্গে তো আমারই বিয়ে হত।’’
আবার বাবার কথা বলি। সঙ্গীতকার অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে শোনা। ‘মধুমতী’ রিলিজ করবে যে দিন, বাবা দেখি কেবলই পায়চারি করছেন, আর অদ্ভুত রকমের টেনশন চোখেমুখে। ঘন ঘন সিগারেট খাচ্ছেন।
কী হয়েছে? জানতে চাইলে শোনা গেল, ‘‘মধুমতী যদি হিট না হয়, তা হলে তো সলিলকে (চৌধুরী) ফিরে আসতে হবে এ বার। মনে মনে কত যে চাইছি, সলিল যেন সফল হয়!’’
প্রতিমাপিসির একটা গল্প।
সকাল সাড়ে সাতটা। একটা রিকশা নিয়ে প্রতিমাপিসি হাজির আমাদের বাড়ি। হাতে কাপড়ের বটুয়া। বাবার তখন ঘুমই ভাঙেনি। প্রতিমাপিসি বসে রইলেন। বাবার সঙ্গে দেখা করে তবে যাবেন। বাবা উঠে এসে দেখা করতেই প্রতিমাপিসি বললেন, ‘‘স্বপ্ন দেখলাম, আপনাকে কতগুলো পাথর দিচ্ছি। তাই ছুটে চলে এলাম। এই নিন,’’ বলে হাতের সেই বটুয়াটা বাবাকে দিলেন। ভেতরে ভর্তি চুনী, পান্না, হিরে...!
এক ধমক দিলেন বাবা, ‘‘তুই পাগল হলি নাকি? রাখ এ সব। নে বোস তো, জীবন নদীর ওপারে-টা গা তো!’’
এর পর যে দৃশ্য দেখলাম, তা এতটাই মুগ্ধ করা, মনে হল যেন, পাহাড়ের গায়ে ভোরের সূর্য উঠছে!
মাটিতে হাঁটু মুড়ে বসে প্রতিমাপিসি একের পর এক গেয়ে চললেন ‘জীবন নদীর ও পারে’, ‘আমার হাত ধরে তুমি নিয়ে চলো সখা’... সকালের সোনা ঝরা আলো যেন বাবার ভেতর থেকে চুঁইয়ে পড়ছিল প্রতিমাপিসির চোখে। জ্বলজ্বলে সে চোখে মুক্তোদানার মতো টলটল করছিল জল। এখনও যখন সে-ছবি ভেসে ওঠে ভেতরটা কেমন ভিজে যায় ঠিক সে দিনের মতোই!
এক কাপ চা খেলেন। একটু গল্প করলেন। চলে গেলেন।
প্রতিমাপিসির আরেকটা গল্প বলি। অনেক দিন আগের।
শুধু শ্রদ্ধা নয়, কী যে ভয় পেতেন পিসি বাবাকে! রেকর্ডিং হচ্ছে প্রতিমাপিসির। সারা দিন ধরে একটাই গান গেয়ে চলেছেন তিনি। আর বাবার কিছুতেই পছন্দ হচ্ছে না। শেষে এমন অধৈর্য হয়ে পড়লেন, প্রতিমাপিসির গালে মারলেন সপাটে এক চড়। পিসি তো হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। বাবার তাতেও ভ্রুক্ষেপ নেই। বলে দিলেন, ‘‘ওই কাঁদতে কাঁদতেই রেকর্ড করবি, চল।’’
রেকর্ডিং হল। গানটা ছিল ‘আঙুল ফুলেরে খুন করে গেছে’।
অনেকেই বাবাকে বাইরে থেকে দেখে ভেবে বসতেন লোকটা বুঝি একেবারে মায়াদয়াহীন। পাষাণ।
বাড়িতে কত বার দেখেছি, সকালে স্নান সেরে বেরিয়েছেন, খেতে বসবেন এ বার। খাবার দিতে দেরি হলে মায়ের মুখের ওপর খাবার ছুড়ে দিয়েছেন।
সাদা ধুতি পরতেন। সঙ্গে গিলে করা পাঞ্জাবি। ধুতির সঙ্গে পাঞ্জাবির রংটা না মিললে কিছুতেই পরতেন না।
গায়ে পাউডার দিতেন, তাও যে কী রাজকীয় ঢঙে! কৌটো থেকে হুশ হুশ করে ঢালতেন গায়ে। মাটিতে যতটা পড়ত, তা দিয়ে আরেকজনের হয়ে যেতে পারে।
সুগন্ধি মাখলে দামি হওয়া চাই। নয়তো নয়।
হাবেভাবে একেবারে ‘সন্ন্যাসীরাজা’র সূর্যকিশোর নাগচৌধুরী! অথচ এই বাবা-ই যখন দ্বিজেনকাকার পাশে বসে ‘আমার রাত পোহালো’ শুনতে শুনতে কাঁদতেন, কিছুতেই যেন মেলাতে পারতাম না। আর আমারও চোখের জল বাঁধ মানত না।
কী ছিল মানুষটার ভিতরে, যা শুধু গানেই বলতে পেরেছেন তিনি!
তারই বা কতটুকু বুঝেছি?
আজীবন যেন একটা ঝিনুক খুঁজে বেড়িয়েছেন আমার বাবা, যাতে মুক্তো আছে। একটা মানুষ, যার মন আছে... তা’ও কি পেয়েছিলেন কোনও দিন?
জানা হয়নি!
No comments:
Post a Comment