আচমকাই লেখা ছেড়ে দিলেন।
টানা তিন বছর কিচ্ছু লিখলেন না। অথচ সাহিত্যিক হিসেবে তিনি তখন মধ্যগগনে।
পরে আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘‘লিখতে ইচ্ছে হয় না। লিখি না। লেখা ছেড়েই দিলাম। বাড়ি থেকে বের হওয়া বন্ধ করলাম। বসে বসে ভাবি। আর কাঁদি। একলা কাঁদি। পূজার সময় কাঁদি। রবীন্দ্রনাথের গান শুনে কাঁদি।’’
শাক্ত-পরিবারের ছেলে। বাড়ির বিশ্বাস, মা তারার দয়ায় তার জন্ম হয়েছে, তাই নাম রাখা হয়েছিল তারাশঙ্কর।

এক সাধুকে মনে ধরল
রক্তে আধ্যাত্মিকতা। মন অশান্ত, কিছুতেই যেন শান্তি পাচ্ছেন না। কীসের অতৃপ্তি বুঝতে পারছেন না।
এরই মধ্যে রবীন্দ্র পুরস্কার, সাহিত্য অকাদেমির মতো পুরস্কার পেলেন কিন্তু পুরস্কার পাবার আনন্দ কই? কিছুই যেন স্পর্শ করছে না। ছটফট করছে ভেতরটা।
কলকাতার রাস্তায় এলোমেলো ঘুরতে ঘুরতে একদিন দেখা হয়ে গেল এক সন্ন্যাসীর সঙ্গে। সারাদিন সে সন্ন্যাসী আগুন ছুঁয়ে সাধনা করেন।
মনে ধরল সেই সাধুকে। জানলেন তার বাস কাশীতে। সংসার ছেড়ে দিয়ে তাঁর শিষ্যত্ব নেবেন ঠিক করে যেদিন আবার দেখা করতে গেলেন শুনলেন সন্ন্যাসী ফিরে গেছেন।
তাঁর সন্ধানে তারাশঙ্করও রওনা দিলেন কাশী। দেখা হয়ে গেল সেই সময়ের বিশিষ্ট বাঙালি আনন্দসুন্দর ঠাকুরের সঙ্গে।
কথায় কথায় তারাশঙ্কর তাঁকে জানালেন, ‘‘একটা কিছু ধরতে চেয়ে যেন ধরতে পারছি না। তার জন্য আমার মনে অশান্তির শেষ নেই।’’
তা শুনে আনন্দসুন্দর বললেন, ‘‘আপনার সাধনার পথ হল সাহিত্য। তাকেই জীবনের সাধনা করুন, শান্তি পাবেন।’’
ফিরে এলেন কলকাতায়। নিজের মা-কে গুরু করে দীক্ষা নিলেন। নিত্যপুজো, চণ্ডী, গীতা-পাঠ চলতে থাকল। তাও যেন শান্তি মিলছে না, কী যেন জীবন ছেড়ে চলেই গেছে চিরকালের মতো।
এমনই এক সময়ে বর্ধমানে এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যাওয়ার কথা। হাওড়া-স্টেশন পৌঁছেও তিনি ট্রেনে না চেপে বসে রইলেন প্ল্যাটফর্মে।
দেখা হল বহুদিনের বন্ধু ভ্রাতৃপ্রতিম জগদীশ ভট্টাচার্যর সঙ্গে।
ধমকই দিয়ে বসলেন তিনি।— ‘‘এসব কী করছেন দাদা! আপনার এমন আচরণে গোটা বাংলার মানুষ ছি ছি করছে! আপনার নিন্দুকদের কথাই তা’হলে সত্যি হল?’’
‘‘কী সত্যি হল?’’
‘‘তাঁরা বলে আপনি শেষ। আর কখনও লিখতে পারবেন না।’’
এমন কথায় যেন যেন কেঁপে উঠলেন তারাশঙ্কর। এবার সাহিত্যিকের অহংকারে ধাক্কা লাগল বহুকাল পর।
পুজোর আর মাত্র আড়াই-মাস বাকি। ভেবেছিলেন কিছুই লিখবেন না, আর সেই বছরই ওই অল্পসময়ে চারটে পুজো সংখ্যায় লিখলেন গল্প। দেশ পত্রিকায় ‘রাধা’, আনন্দবাজার-এ ‘বিচারক’ শনিবারের চিঠি-তে একটি একাঙ্কিকা আর তরুণের স্বপ্ন-য় ‘পঞ্চপুত্তলী’।
প্রকাশ পাওয়া মাত্র আবার হই- হই পড়ে গেল পাঠক মহলে। ফিরে এসেছেন, তারাশঙ্কর আবার ফিরে এসেছেন! আর গণদেবতা-র লেখক ফিরে পেলেন তার হারিয়ে যাওয়া শান্তি।
সজনীকান্ত ও বনফুলের মাঝে তারাশঙ্কর

পাখির মৃত্যু ও প্রথম কবিতা
গোটা জীবনটা যেন অমসৃণতায় ভরা। বারবার অশান্তির বাঁকে এসে দাঁড়িয়েছেন। আঘাত পেয়েছেন অসংখ্য।
জীবনের সাহিত্যচর্চা শুরুর সঙ্গেও তো জুড়ে আছে আঘাত পাওয়ারই কাহিনি।
তখন বয়স সাত, কী আট।
তিন বন্ধু মিলে বাড়ির উঠোনে খেলছে, হঠাৎই গাছ থেকে খসে পড়ল একটি পাখির ছানা। দৌড়ে গেল ওরা। ছানাটিকে নিজের মুঠোয় তুলে নিল কিশোর তারাশঙ্কর। বাঁচানোর চেষ্টা চলল নানা উপায়ে। তবু পাখি বাঁচল না। মা পাখিটা এসে ওদের মাথার ওপর ঘুরতে লাগল।
তাই দেখে তিন কিশোরের কী কষ্ট! ভেতরে ভেতরে জমে ওঠা দুঃখকে উগরে দিতে তারাশঙ্কর চকখড়ি নিয়ে বাড়ির দরজায় লিখে ফেলল—
পাখির ছানা মরে গিয়েছে
মা ডেকে ফিরে গিয়েছে
মাটির তলায় দিলাম সমাধি
আমরাও সবাই মিলিয়া কাঁদি।
জীবনের প্রথম কবিতা। যন্ত্রণা পেয়ে লেখা। কিন্তু এর পর যেন লেখা নেশায় পেয়ে গেল।
ওই বয়সেই এক বার পুজোর সময় দুই বন্ধু মিলে কবিতা লিখে লিফলেটে ছাপিয়ে পাড়ায় বিলি করলেন।

খাতাটা আগুনে গুঁজে দিলেন
আরেকটু পরের দিকের কথা।
তখনও লেখক হিসেবে তেমন পরিচিতি মেলেনি। মাঝেমাঝে কবিতাই লেখেন। সে কবিতা ছাপাও হয়। সম্পাদকরা কবিতা লিখতে উৎসাহও দেন, কিন্তু কবিতা লিখে যেন তাঁর মন ভরে না।
নাটক লেখার শখ হল। লিখেও ফেললেন। আত্মীয়-বন্ধু নির্মলশিববাবু তখন নাট্যকার হিসেবে নাম করেছেন। তারাশঙ্করের নাটক পড়ে উচ্ছ্বসিত। বললেন, ‘‘তোমার এই নাটক মঞ্চস্থ হলে চারদিকে হই হই পড়ে যাবে। নিশ্চিন্ত থাকো।’’
স্বপ্ন দেখলেন তারাশঙ্কর। শহরের পোস্টারে নাট্যকার হিসেবে তাঁর নাম। কিন্তু সে নাটক কলকাতার এক নামকরা গ্রুপের ম্যানেজারকে জমা দিতে গিয়ে প্রবল অপমানিত হতে হল নির্মলবাবুকে।
অধ্যক্ষ নাটকটি তো পড়লেনই না। উলটে বললেন, ‘‘শুনুন মশাই, নিজে নাটক লিখে নাম করেছেন ঠিক আছে, কিন্তু নিজের আত্মীয়স্বজনকে এনে ঢোকাবেন না।’’
‘‘আপনি একবার পড়ে তো দেখুন। ভাল লেখা।’’
‘‘সে যেমনই হোক। আমরা এখানে কোনও শরিক বরদাস্ত করব না। আজকে সুচ ঢোকাব কাল ফাল হয়ে বেরোলে আমাদের পস্তাতে হবে। আপনি ও নাটক নিয়ে যান।’’
মাথা নিচু করে ফিরে এলেন নির্মলবাবু। সব শুনে এত অপমানিত বোধ করলেন তারাশঙ্কর যে বাড়ি ফিরে পুরো খাতাটাই উনুনে গুঁজে দিলেন। ছারখার হয়ে গেল নাট্যকার হওয়ার স্বপ্ন।

লজ্জা করে না আপনার?
অপমান যেন কিছুতেই তাঁর পিছু ছাড়ে না। তা যে শুধু সাহিত্যের জীবনে, তা নয়, যখন রাজনীতিতে এলেন, সেখানেও।
সে কেমন, শুনুন।
পৈতৃক জমিদারি থেকে পাওয়া ক্ষতিপূরণের সমস্ত টাকা একবার দেশের স্বার্থে বিনোবাজির ভূদান আন্দোলনে দেওয়ার জন্য ভাবলেন।
তাতে বলা নেই কওয়া নেই, হঠাৎ কংগ্রেস নেতা অতুল্য ঘোষ বলে বসলেন, ‘‘আপনি তো মশাই নাম কেনার জন্য বিনোবাজিকে টাকা দেন।’’ তারাশঙ্কর তো শুনে থ।
আর ছোটখাট রাজনৈতিক নেতারা তো উঠতে বসতে কথা শোনাতেন। বলতেন, ‘‘আরে, উনি তো ধান্দাবাজির জন্য রাজনীতি করেন।’’
অথচ জমিদারের ছেলে হয়েও দেশের কাজের জন্য জেল খেটেছেন। অর্থ, আয়েসি জীবন সব ছেড়েছুড়ে দিন রাত এক করে স্বাধীনতা সংগ্রামে সামিল হয়েছেন। তাতেও ‘জমিদার তনয়’-এর ‘দুর্নাম’ তার যায়নি।
একবার তো অপমানের চূড়ান্ত। তারাশঙ্করের এক খুব কাছের বন্ধু এবং সেই বন্ধুর এক আত্মীয় নির্বাচনে পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী।
তারাশঙ্কর তাঁর বন্ধুর পাশে দাঁড়ালেন। তাঁর হয়ে প্রচার চালাতে লাগলেন। লড়াই তুঙ্গে উঠল।
হঠাৎই দুই আত্মীয়ের মিটমাট হয়ে গেল। মর্নিং কোর্টে সেই আত্মীয় মনোনয়ন তুলে নিলেন। বেলা হয়ে গেছে। বন্ধু একপ্রকার জোর করেই দুপুরবেলা খাওয়ার জন্য নিয়ে গেলেন প্রতিদ্বন্দ্বী সেই আত্মীয়েরই বাড়িতে।
খেতে বসেছেন। সবে ভাতের গ্রাস মুখে তুলতে যাবেন, ঠিক তখনই সেই আত্মীয়র বড় ছেলে বলে উঠলেন, ‘‘তারাবাবু, আপনি আমাদেরই বিরোধিতা করে এখন আমাদের বাড়িতেই পাত পেড়ে খাচ্ছেন! লজ্জা করে না আপনার?’’
হাতের গ্রাস নামিয়ে রাখলেন তারাশঙ্কর। বললেন, ‘‘আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। লজ্জাহীনতার যে কাজ আমি করতে যাচ্ছিলাম সঠিক সময়ে আমাকে বাঁচিয়েছেন। এখনও মুখে তুলিনি, এই নামিয়ে রাখলাম,’’ বলেই উঠে দাঁড়ালেন। অভুক্ত বেরিয়ে এলেন সেই বাড়ি ছেড়ে। কেউ বাধাও দিল না।
জন্মদিনে
আশাপূর্ণাকে একটা নতুন শাড়ি পরিয়ে দিয়ো
এ তো গেল অতিথি হিসেবে অন্যের বাড়ি গিয়ে তাঁর হেনস্তা হওয়া। অন্য দিকে তাঁর বাড়িতে কেউ যখন অতিথি হয়ে যেতেন,  যত্নের ত্রুটি হত না কোনও।
সে কাহিনি পাওয়া যায় আশাপূর্ণা দেবীর লেখায়।
আশাপূর্ণা লিখেছেন, ‘‘আমি এসেছি ওর বাড়িতে, যেন শ্বশুরবাড়ি থেকে ছোটবোন এসেছি। তেমনি আগ্রহ, তেমনি আনন্দ। নিজের সৌভাগ্যে অভিভূত হচ্ছিলাম।’’
তারাশঙ্কর নিজেই দেখভাল করছেন আশাপূর্ণা কোন ঘরে থাকবে, কোথায় শোবে, কী খাবে, কোথায় কোনও অসুবিধা হচ্ছে কিনা।
আশাপূর্ণা বর্ণনা করছেন, ‘‘মশারির ভেতর শুতে পারি না শুনে অস্বস্তির অন্ত নেই। বারবার বোঝানোর চেষ্টা করছেন ওটা অসম্ভব। লাভপুরের মশাকে তুমি চেনো না আশাপূর্ণা, মশারি না টাঙালে সকালে উঠে আর তুমি নিজেকে এখানে খুঁজে পাবে না। দেখবে জঙ্গলে টেনে নিয়ে গেছে। স্নেহের প্রশ্রয়ে আমিও বলে ফেললাম, লাভপুরের মশারাও আমাকে চেনে না দাদা। ওদের যে কী অনায়াসে উপেক্ষা করতে পারি আমি। তা জানে না ওরা।’’
শেষ পর্যন্ত রফা হল, আকণ্ঠ চাদরে ঢেকে মাথার সামনে টেবিলফ্যান ঘুরিয়ে শোওয়া। পাখাটা মশা ওড়াতে আর চাদরটা ঠাণ্ডা থেকে বাঁচতে। পাখা বসানোর পরেও তারাশঙ্করের শান্তি নেই।
নিজে হাতে একটা কম্বল নিয়ে এসে বললেন, ‘‘দেখো আশাপূর্ণা, রাতে যদি বৃষ্টি হয় তাহলে ওই পাতলা চাদরে কিছু হবে না,আবার ফ্যানও মশার জন্য বন্ধ করা যাবে না। তখন এটা গায়ে দিয়ো।’’
তারপর লক্ষ করলেন ফ্যানের টুলটা নড়ছে, অতয়েব কিছুটা ঘটঘট শব্দ হচ্ছে। কোথা থেকে এক টুকরো কাগজ নিয়ে পাট করে দিয়ে দিলেন টুলের পায়ার তলায়। দেখলেন ঘরে খাবার জল আছে কি না।
শুধু তাই নয়, পরদিন ফিরে আসার সময় তারাশঙ্কর স্ত্রীকে বললেন, ‘‘ও গো শুনছ, আশাপূর্ণাকে একটা নতুন শাড়ি পরিয়ে দাও।’’
তাই শুনে আশাপূর্ণা অবাক।
তারাশঙ্কর বুঝতে পেরে বললেন বাংলাদেশের নিয়ম হল, ‘‘মেয়েরা বাপ-ভাইয়ের বাড়ি থেকে যখন শ্বশুরবাড়ি যায় তখন নতুন শাড়ি পরে যায়।’’

কিলো দরে বেচে দেব আপনার বই
বরাবরই তিনি স্বভাবকোমল।
অথচ এই নরম মনের ওপরেই একের পর এক আঘাত এসেছে প্রায় সারাটা জীবন জুড়ে।
এক বারের আঘাত তো চরম। সে বার ছয় বছরের মেয়ে বুলু মৃত্যুযন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। হাতে একটা পয়সা নেই। সেই অবস্থায় আত্মীয়ের কাছে পাঁচটা টাকা ধার চাইতে গেলেন। মুখের ওপর ‘না’ করে দিলেন সেই স্বজন। চোখের জল চেপে মাথা নিচু করে ফিরে এসেছিলেন তারাশঙ্কর।
আরেক বারের ঘটনা বলি।
জেলে থাকার সময়েই উপন্যাসের প্লট ভেবে রেখেছিলেন। ছাড়া পাওয়ার পর লিখে ফেললেন, ‘চৈতালি ঘূর্ণি’।
কিন্তু ছাপবে কে?
লিখে অতি সামান্য আয়। তাতে একবেলা চলে তো আরেকবেলা চলে না। তার মধ্যেই নিজের খরচে বই করে ছাপালেন।
সে-বই বিক্রি হল না। একদিন নিজেই পাঠক সেজে বইয়ের দোকানে নিজের বই কিনতে গেলেন। কথায় কথায় দোকানি যখন জানতে পারলেন বইটির লেখক তিনিই, সঙ্গে সঙ্গে বললেন, ‘‘মশাই আপনার বইয়ের এক কপিও বিক্রি নেই। এখুনি ঝাঁকা মুটে ডেকে দিচ্ছি, সব বই ফেরৎ নিয়ে যান।’’ সঙ্গে আরও গোটা কয় কটুবাক্য।
অপমানে লজ্জায় যেন মাটিতে মিশে গিয়েছিলেন রসকলির স্রষ্টা।
আরেকদিন সেই ‘চৈতালি ঘূর্ণি’রই এক দপ্তরি এসে হাজির। এসেই তারাশঙ্করকে সকলের সামনে সরাসরি আক্রমণ, ‘‘ও মশাই আপনার বই বাঁধার টাকা পাই, এখুনি শোধ করুন, নয় তো গোডাউনে যত বই পড়ে রয়েছে সব ফুটপাতে হকারদের কিলো দরে বেচে দেব।’’
লজ্জায় পা কাঁপতে লাগল তারাশঙ্করের। কিন্তু এ বারের ঘটনার শেষটি অনেকটাই অন্য রকম।
কোথা থেকে তখনই সামনে এসে উদয় হলেন এক ব্যক্তি। সেই সময়ের সাহিত্য জগৎ যাঁর সমালোচনার ভয়ে কাঁপে। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথকেও যিনি ছেড়ে কথা বলেন না। দোকানিকে গম্ভীর গলায় তিনি বললেন, ‘‘এখুনি সব বই আমার দপ্তরে পাঠিয়ে দিন। আর বিল করে দিন। এখুনি সব মিটিয়ে দিচ্ছি।’’
তারাশঙ্কর হতবাক।
দ্বিতীয় বার কথা বললেন সেই ভদ্রলোক। এবার তারাশঙ্করের দিকে চেয়ে, ‘‘আপনার বই আমি ছাপব।’’
ভদ্রলোকটি আর কেউ নন, স্বয়ং ‘শনিবারের চিঠি’র সম্পাদক সজনীকান্ত দাস। এর পর এই দু’জনের আজীবনের বন্ধুত্ব তো আজ এক ইতিহাস।
এআইসিসি অধিবেশনে নেহরু, ডা. বিধানচন্দ্র রায়, 
সজনীকান্ত দাশের সঙ্গে তারাশঙ্কর 

বিভূতিভূষণের হাতমুখ ধুইয়ে দিলেন তিনি
শত্রুতা যেমন পেয়েছেন, ভালবাসার বন্ধুও পেয়েছেন তিনি। তেমনই এক বন্ধু ছিলেন আরেক বন্দ্যোপাধ্যায়।
বিভূতিভূষণ।
সে কেমন বন্ধুত্ব?
একবারের ঘটনা। রাতের ট্রেনে দুই বন্ধু তারাশঙ্কর আর বিভূতিভূষণ যাচ্ছেন দূরের এক সাহিত্যসভায়। রাতের খাবার এত বেশি খেয়ে ফেললেন বিভূতি যে, হাতমুখ না ধুয়েই সটান বার্থে শুয়ে পড়লেন। নড়াচড়ার ক্ষমতাও নেই।
তারাশঙ্কর দুজনের এঁটো গুছিয়ে হাতমুখ ধুচ্ছেন, বিভূতিভূষণের কাতর আবদার, ‘‘ভাই আমার মুখ হাতটা একটু ধুয়ে দিবি? এত খেয়ে ফেলেছি যে আর নড়তে পারছি না।’’
তারাশঙ্কর মুচকি হেসে খুব যত্ন নিয়ে বন্ধুর এঁটো হাতমুখ ধুইয়ে, ধুতির খোট দিয়ে মুছিয়ে দিলেন। নির্বিকার বিভূতি ঘুমিয়ে পরলেন পাশ ফিরে।
অন্যবারের কথা। তারাশঙ্কর মটরগাড়ি কিনেছেন। তখন তিনি সাহিত্যিক হিসেবে তো বটেই আর্থিকভাবেও প্রতিষ্ঠিত।
আর বিভূতিভূষণ রাস্তাঘাটে যাকে পান, তাকেই তুমুল আহ্লাদ করে বলতে থাকেন, ‘‘আরে শুনেছ তারাশঙ্কর গাড়ি কিনেছে।’’
শুধু দেখা হলে নয়, পয়সা খরচ করে লোকের বাড়ি-বাড়ি গিয়েও সে-খবর দিতে থাকলেন অন্যদের। তাতে এক বন্ধু একবার একটু বিরক্ত হয়ে বলেই ফেললেন, ‘‘তারাশঙ্কর গাড়ি কিনেছে তো আপনার কী?’’
এ কথায় বিভূতিভূষণের উত্তরটা একবার শুনুন। বলেছিলেন, ‘‘আরে একটা মানুষ শুধু লিখে একটা আস্ত মটরগাড়ি কিনে ফেলেছে, এতে আনন্দ পাব না!’’ তারপরেই নিচু স্বরে মিষ্টি হেসে বললেন, ‘‘আর জানো আমাকে একদিন ওর গাড়িতে চাপাবেও বলেছে!’’

বড়বৌ বলল, তুমি এতটা পাষাণ
ভাল কিছু বন্ধু ছিল বলেই হয়তো শেষ পর্যন্ত লেখাটা ছাড়তে হয়নি। আর সঙ্গে ছিল অদম্য জেদ।
এক বার প্রাণের বন্ধু যামিনী রায় বললেন, ‘‘ভায়া শবসাধনা করতে গেলে যেমন শ্মশান প্রয়োজন, ঠিক তেমনই সাহিত্য সাধনা করতে দরকার কলকাতা। লাভপুরে থেকে সাহিত্য হবে না। কলকাতা চলে আসুন।’’
বন্ধুর কথাতেই সপরিবার কলকাতায় চলে এলেন তারাশঙ্কর। উঠলেন যামিনী রায়েরই বাড়ির গায়ে লাগানো একটি বাসায়।
আর্থিক অবস্থা তখন শোচনীয়। স্ত্রী উমাশশী শয্যাশায়ী। শুধু লেখার টাকায় সংসার চালাতে হিমশিম দশা।
বয়স ছুঁয়েছে চৌষট্টিতে। কিন্তু সংসার চালানোর জন্য ওই বয়সেও শনিবারের চিঠি-তে চাকরি নিতে হল। তাই নিয়েও সেকালের কিছু সাহিত্যিক সারাক্ষণ ব্যঙ্গবিদ্রুপ করে যেতেন।
যাতায়াতের খরচটুকুও বাঁচানোর জন্য রোজ হেঁটে বাড়ি-অফিস, অফিস-বাড়ি করতেন।
সারাদিন অফিস সামলে বাড়ি ফিরে রাতে মাটিতে আসন পেতে কোলের ওপর একটা সুটকেস নিয়ে তার ওপর কাগজ রেখে চলত লেখালেখি।
ঘরে পাখা লাগানোরও সামর্থ্য নেই। তখন ‘কবি’ উপন্যাসটি লিখছেন। নিতাই কবিয়ালের গানের কলি ‘কালো যদি মন্দ তবে কেশ পাকিলে কান্দ কেনে’র সঙ্গে মিল রেখে  ওরই দোসর চরণ রচনায় ব্যস্ত।
পাশে বিছানায় শুয়ে উমাশশী। দুর্বিসহ ব্যাধিতে তখন কাতর দশা তাঁর। তারাশঙ্করের তাতেও হুঁশ নেই। লিখে যেতেন মন দিয়ে।
এত নির্বিকার স্বামীকে দেখে এক দিন আর সহ্য করতে পারলেন না উমাশশী। চিৎকার করে উঠলেন, ‘‘তুমি এমন মায়াদয়াহীন! এমন পাষাণ! আমি এই ভাবে একদিকে পড়ে আছি, কাতরাচ্ছি আর তুমি সুটকেস কোলে নিয়ে লিখেই যাচ্ছ!’’
এ বার যেন হুঁশ ফিরল তারাশঙ্করের। লেখা ফেলে সাততাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়েন ডাক্তার ডাকতে।

ডাক্তার ডাকারও পয়সা নেই
ছয় বছরের মেয়ে বুলু মারা গিয়েছিল চিকিৎসার সুযোগ না দিয়েই। আর কলকাতায় যে দিন এলেন সেইরাত্রেই বড় মেয়ে গঙ্গার এল ধুম জ্বর। হাতে তখন মাত্র পাঁচ টাকা।
স্ত্রী ভয়ে দুশ্চিন্তায় বললেন, ‘‘এখুনি ডাক্তার ডাকো।’’
তখনও গড়িমসি করছেন তারাশঙ্কর। হাতে যে পয়সা নেই! ডাক্তার আনবেন কি!
রাত বাড়তে জ্বরও বাড়ল। খবর কানে গেল যামিনী রায়ের। সঙ্গে সঙ্গে ছুটে এলেন তিনি। এসেই বুঝতে পারলেন পুরো অবস্থাটা ঠিক কী। নিজের ছেলেকে ডেকে বললেন, ‘‘যাও এখুনি ডাক্তার নিয়ে এসো।’’
এলেন ডাক্তার। ওষুধ দিয়ে জ্বর কমালেন তিনি। প্রাণে বাঁচল মেয়ে। ডাক্তার-ওষুধের সব দাম মেটালেন বন্ধু-সুহৃদ যামিনী রায়।
বন্ধুত্বের এই সম্পর্কটা ঠিক কেমন ছিল, বোঝাতে একটা ব্যাপার উল্লেখ করা যেতে পারে।
একটা সময়ের পরে তারাশঙ্কর যখন অনেক অনেক রোজগার করেছেন,  অনায়াসে পারতেন বন্ধুর পুরনো ঋণ শোধ দিয়ে দিতে।
কিন্তু জীবনে কোনও দিন সেই ধারের টাকাটুকু তাঁর যামিনীদাকে শোধ দেওয়ার সাহস পাননি তিনি। কথা তুললে বন্ধু যে তুলোধনা করতে বাদ রাখবেন না, তা বিলক্ষণ জানতেন তিনি। এ নিয়ে এক বার বড় ছেলেকে তারাশঙ্কর বলেছিলেন, ‘‘কিছু ঋণ শোধ করা যায় না। করতে নেই।’’

ভুল স্বীকার করলেন নেতাজি
কংগ্রেসের সঙ্গে তখন তাঁর তিক্ততা তুঙ্গে। নরেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় নামের এক কংগ্রেস নেতা তাঁকে মিথ্যে এক কাণ্ডে ফাঁসালেন।
পরিস্থিতি শেষে এমন দাঁড়াল যে, সত্যি কথা বলতে গেলে তাঁকে সুভাষচন্দ্রের বিরুদ্ধে সাক্ষী দিতে হবে। একেবারে সরাসরি সুভাষচন্দ্র বসুর সঙ্গে সংঘাত উপস্থিত।
একমাত্র মিথ্যে কথা বললেই সেই সংঘাত এড়ানো যায়। কিন্তু মিথ্যে তো তিনি বলবেন না। তাই সত্যিটা জানাতে একদিন দুই বন্ধুর সঙ্গে নিজেই সরাসরি উপস্থিত হলেন নেতাজির বাড়িতে। খবর গেল নেতাজির কাছে। শোনামাত্র অন্য মিটিং ছেড়ে চলে এলেন তিনি।
‘‘আপনি তারাশঙ্করবাবু? আপনার সঙ্গে আমার কথা বলা খুব প্রয়োজন।’’
জবাবে তারাশঙ্কর কথা বলবেন কি, হাঁ করে তাকিয়ে রয়েছেন নেতাজির  দিকে।
ঠিক ওইসময় সামনে ছিলেন অন্য এক কংগ্রেস-কর্মী।
মুখ ফসকে তিনি বলে ফেললেন, ‘‘ওই হল! এবার সাহিত্যিক নিয়ে জল-খাওয়ানো মজলিশ।’’
কথাটা কানে যাওয়া মাত্র এমন বাঘের মতো গর্জে উঠলেন সুভাষচন্দ্র যে, সেই ভদ্রলোক কোথায় পালাবেন বুঝে পেলেন না।
সুভাষচন্দ্র নিজের কাছে ডেকে নিয়ে গেলেন তারাশঙ্করকে। সরাসরি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘‘আপনি সাক্ষী দেবেন?’’
‘‘আজ্ঞে দেব,’’ শিরদাঁড়া সোজা করে বললেন রাইকমল-এর লেখক।
‘‘কেন দেবেন?’’
‘‘কারণ মিথ্যে বলতে আমি পারব না। আমরা যারা কংগ্রেসের কর্মী, তারা দেশের সেবা করব বলে এসেছি। সুভাষ বোস বা অন্য কোনও ব্যক্তির সেবা করব বলে নয়। তাই সত্যি কথাটা বলার জন্যই সাক্ষী দেব।’’
যে দুই বন্ধু তারাশঙ্করের সঙ্গে গিয়েছিলেন তারা দু’জনে দুইপাশ থেকে প্রাণপণে ইশারায় থামতে বলছেন। কিন্তু তারাশঙ্করও ছেড়ে কথা বলার লোক নয়।
গোটা ঘর নিশ্চুপ।
সকলে অপেক্ষা করছেন এই বুঝি আবার গর্জন করে উঠবেন নেতাজি। কিন্তু তা তো হল না। ঘটনার  বর্ণনা দিতে গিয়ে তারাশঙ্কর পরে লিখছেন, ‘‘তাঁর মুখখানা কঠিন হয়ে উঠল মুহূর্তের জন্য, টকটকে রঙ লাল হয়ে উঠল। কিন্তু পর-মুহূর্তেই তিনি হাসলেন। প্রসন্ন হাসি। বললেন, নিশ্চয়, মানুষকে দেবতা হিসাবে সেবা করলে পুরো সাধনাই ব্যর্থ হয়ে যাবে। কিন্তু আমি সত্যি কী ঘটেছে তা জানতে চাই,’’ বলে আড়ালে নিয়ে গেলেন তারাশঙ্করকে। সব শুনলেন, তারপর বললেন ‘‘আমি অকপটে আপনার কথা বিশ্বাস করলাম। আপনি সত্যি কথাই বলছেন। আমি দুঃখিত, লজ্জিত। ওই নরেনবাবুর জন্যই এইসব হয়েছে। আপনি বিশ্বাস করুন এ আমি চাইনি, এ আমি চাইনি।’’
এর পর আর তারাশঙ্কর কথা বলবেন কী! বিভোর হয়ে দেখলেন, নেতাজির মতো এক জন মানুষ কী নির্দ্বিধায় নিজের ভুল স্বীকার করছেন! ‘চৈতালি ঘূর্ণি’ বইটি তারাশঙ্কর উৎসর্গ করেছিলেন সুভাষচন্দ্র বসুকে।
আরেক বার তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছিল বহু বছর পর।
সে বার নেতাজি কী এক দরকারে শান্তিনিকেতন এসেছেন কবিগুরুর সঙ্গে দেখা করতে।
খবর পেয়ে তারাশঙ্করও গেলেন বোলপুর স্টেশনে তাঁকে দেখবেন বলে। দূরে দাঁড়িয়ে দেখছেন নেতাজিকে।
আচমকাই সুভাষচন্দ্রের চোখ পড়ল দূরে ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা তারাশঙ্করের দিকে। তাকিয়ে রইলেন। তারপর একটু এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘‘আপনি তো তারাশঙ্করবাবু।’’
আবার বিস্মিত তারাশঙ্কর। কত বছর আগে মাত্র মিনিট কুড়ির জন্য দেখা হয়েছিল। আজও তাঁর চেহারা, এমনকী নামটাও মনে রেখেছেন তিনি!  

ফিরিয়ে দিলেন সাগরপারের ডাক
তখন মাসে নিয়মিত রোজগার চল্লিশ টাকারও কম। বড় সংসার চালাতে নাভিশ্বাস উঠেছে।
এর মধ্যেই কবি সমর সেনের ঠাকুরদা ডাক্তার দীনেশ সেনের মাধ্যমে এমন এক প্রস্তাব এল যেন আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার মতো।
বোম্বাইবাসী হিমাংশু রায় ডাক পাঠিয়েছেন। তাঁর একজন বাঙালি গল্পকার প্রয়োজন। শুরুতে মাস মাইনে ৩৫০টাকা। প্রতিবছর একশো টাকা করে বাড়বে।
অভাবের সংসারে এতগুলো টাকা! রাজি হয়ে যাওয়ারই কথা।
কিন্তু তিনি যে তারাশঙ্কর।
লিখছেন, ‘‘কী ভেবেছিলাম, কোন তর্ক, কোন হিসেব সেদিন মনের মধ্যে উঠেছিল— মনে নেই, তবে এইটুকু ভুলিনি এবং কোনও দিন ভুলব না যে— আমার মন সায় দেয়নি, মনে আমি কোনও  উৎসাহ অনুভব করিনি। বরং বেদনাই অনুভব করেছিলাম। মনে হয়েছিল এই যাওয়া আমার সাহিত্য সাধনার সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়ে যাওয়া হবে।’’
প্রথমে শুধু জানিয়েছিলেন, ‘‘আমার মায়ের অনুমতি পেলে যাব।’’
সারা রাত মাঠে বসে ভাবলেন, কী করা উচিত। ভোর রাতে শুনলেন মনের ভেতর থেকে কেউ যেতে বারণ করছে।
সজনীকান্তকে পরদিন সব বললেন। শুনে সজনীকান্ত প্রথমেই বলে উঠলেন, ‘‘চলে যাও। এখানে থেকে কী করবে?’’
‘‘কিন্তু আমি যে যাব না ঠিক করেছি।’’
শুনে কিছুক্ষণ স্থির হয়ে তাকিয়ে থাকলেন শনিবারের চিঠি-র সম্পাদক।
তারপর জ্বলজ্বলে চোখে হাসিমুখে বন্ধুকে বললেন, ‘‘তোমার জয় হোক।’’
মাকেও চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন। ক’দিন পর মায়ের উত্তর এল।—
‘‘তুমি এমন প্রলোভন জয় করিয়াছ জানিয়া আমি পরম তৃপ্তি পাইয়াছি। সুখী হইয়াছি। আমি তোমাকে আশীর্বাদ করিতেছি।’’
সেই চিঠি নিয়ে গেলেন দীনেশবাবুর কাছে।
‘‘আপনি যাবেন না?’’
‘‘না। আমার মন চাইছে না। মনে হচ্ছে সব হারিয়ে যাবে।’’
দু’হাত বাড়িয়ে তারাশঙ্করকে জড়িয়ে ধরলেন বৃদ্ধ।
‘‘আপনার হবে বাবা...। আপনারই হবে।’’

হাতে ছ্যাঁকা দিতেন সিগারেটের
তাঁর এমনই জেদের অন্য আরেক প্রমাণ পেয়েছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।
বড় মাপের একটি পুরস্কার পেয়েছেন তারাশঙ্কর। তরুণ সুনীল গিয়েছেন সাক্ষাৎকার নিতে।
কথায় কথায় তারাশঙ্কর বলে উঠলেন, ‘‘আমার জেদ চিরকালই বড্ড বেশি। এই দেখো না জেদের বশে পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন বছর ধরে সিগারেট খাওয়ার অভ্যেস একদিনে ছেড়ে দিলুম।’’
তাই শুনে সুনীল অবাক। সিগারেটের নেশা ছাড়া যে কী কঠিন, নেশারু মাত্রই জানেন। কৌতূহলী সুনীল জিজ্ঞাসাই করে ফেললেন, ‘‘এত কঠিন কাজ একদিনে করলেন কী করে?’’
কোনও কথা না বলে বাঁ-হাতখানা উঁচু করে দেখালেন। সুনীল শিউরে উঠে লক্ষ করলেন বাঁ হাতের কবজি থেকে শুরু করে তালু পর্যন্ত অনেকগুলো গোল গোল পোড়া-ছ্যাঁকা দাগ।
জিজ্ঞাসা করলেন ‘‘ও কী? এটা কী?’’
‘‘কিছু না। সিগারেট ছাড়ার পর ও জিনিস আবার খেতে লোভ হলেই সিগারেট ধরিয়ে নিজের হাতে ছ্যাঁকা দিয়েছি। তাই এখন আর লোভ হয় না।’’
শুধু কি জেদ? ধৈর্যও ছিল চমকে দেওয়ার মতো।
ভারতবর্ষ পত্রিকায় গণদেবতা ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ হওয়ার পর বই হওয়ার কাজ চলছে।
প্রায় হাজার পৃষ্ঠার লেখা। সবে আশি পৃষ্ঠা ছাপা হয়েছে। প্রকাশককে একদিন ডেকে বললেন, ‘‘ছাপানো থামাও। লেখাতে খামতি আছে। আবার নতুন করে লিখতে হবে।’’
বাকি পুরো ন’শো পৃষ্ঠা আবার নতুন করে লিখলেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়।

বড়বৌকে ছেড়ে যেতে পারব না
মৃত্যুকে যেন টের পাচ্ছিলেন শেষ দিকে। শরীর ভাল যাচ্ছিল না।
স্ত্রী উমাশশীকে ডাকতেন বড়বৌ নামে। প্রাণের চেয়েও প্রিয় তিনি। কে আগে পৃথিবী ছেড়ে যাবেন তাই নিয়ে দোলাচল কাজ করত প্রায়ই। কেবলই ভাবতেন, যে পড়ে থাকবে সে যে চূড়ান্ত একা হয়ে পড়বে।
শেষ দিকের লেখা ডায়রিতে বারবার মৃত্যু-চিন্তা এসেছে। ১৯৬৮ সালের ৮ এপ্রিল ডায়রিতে লিখেছেন—‘‘আজ সনতের (বড় ছেলে) ঘরে আয়নায় নিজের খালি গায়ের ছবি দেখলাম। শরীরে-মৃত্যুর হাতের স্পর্শ লেগেছে- তা বোঝা যাচ্ছে।—আসুক সমাপ্তি আসুক। খুব ক্লান্ত আমি। মৃত্যুতে কোনও আক্ষেপ তো নেই আমার।...কিন্তু আমার বড়বৌ! আমার বৌকে ছেড়ে যেতে পারব? বড়বৌ নইলে যে আমার পৃথিবী অন্ধকার। সে যে আমার জীবনকে জুড়ে রয়েছে— মাটির উপরে বয়ে যাওয়া নদীর মত।’’
তবু যেতেই হল। ‘জীবন এত ছোট কেনে, এ ভুবন’-এ! আগে একাই চলে গেলেন তারাশঙ্কর। বড়বৌয়ের  তাঁর কাছে আসতে তখনও তেরো বছর বাকি!
চিত্রণ: অনুপ রায়

ঋণ: আমার সাহিত্য জীবন, ১ম খণ্ড (তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়),
তারাশঙ্কর: ব্যক্তিত্ব ও সাহিত্য (সম্পদনা: প্রদ্যুম্ন ভট্টাচার্য),
বিশেষ তারাশঙ্কর সংখ্যা (বৈশাখী), তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় জন্মশতবর্ষপূর্তি সংখ্যা (কথাসাহিত্য), তারাশঙ্কর সংখ্যা (আজকের কাদম্বরী), অমলশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় 

http://www.anandabazar.com/supplementary/patrika/remembering-tarasankar-bandyopadhyay-1.386099