শরীর আমার আর জুতে নেই! এই বয়সে যেমন হয়। তবু ডিজিটাল আনন্দবাজারের জন্য কয়েকটা কথা লিখছি দিল্লি যাওয়ার পথে। কত বছর পরে যে দিল্লি যাচ্ছি আবার, মনে পড়ছে না! কনকনে ঠান্ডায় এই শরীর নিয়ে আবার দিল্লি কেন? উত্তর একটাই। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু!
নেতাজির স্মৃতিতে, নেতাজির নামে কিছু করতে পারলে এখনও মনটা ভাল হয়ে যায়। দিল্লিতে ফরওয়ার্ড ব্লকের কেন্দ্রীয় কমিটির পাকাপাকি ঠিকানা এখন নেই। সেই সমস্যার সুরাহা করার জন্যই তহবিল ঝেড়ে-পুঁছে, লোকের কাছে হাত পেতে ‘নেতাজি ভবন’ তৈরির সিদ্ধান্ত! করোলবাগের ঝান্ডেবালনে সেই নতুন বাড়ির শিলান্যাস হবে ২৩ জানুয়ারি। দলের সকলের আবেগ এর সঙ্গে জড়িয়ে। তাই দিল্লিতে উপস্থিত থাকার ডাকটা ফেলতে পারলাম না!

নেতাজি নথি সামনে আনার পর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়
যখন দিল্লিতে আমাদের এই কাজ চলবে, সেই সময়েই নরেন্দ্র মোদীর সরকার আবার নেতাজি সংক্রান্ত ফাইল প্রকাশ করতে চলেছে। পশ্চিমবঙ্গে এসে বৃহস্পতিবারও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ একই ঘোষণা করে গিয়েছেন শুনেছি। এর আগে কলকাতায় নেতাজি সংক্রান্ত ৬৪টা ফাইল প্রকাশ করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তা নিয়েও একপ্রস্ত হইচই। অনেকে সাধু-সাধু বলছেন! কেউ কেউ আবার এগিয়ে গিয়ে বলছেন, ফরওয়ার্ড ব্লকের কাছ থেকে নেতাজিকে কেড়েই নিলেন মমতা!
আমরা বলছি, নেতাজি কেড়ে নেওয়ার জিনিস নয়! নেতাজি একটা লড়াইয়ের নাম, নেতাজি একটা আদর্শের পথ। দেশ স্বাধীন হওয়ার ৬৯ বছর পরেও সে আদর্শ সমান প্রাসঙ্গিক বলে আমরা মনে করি। নেতাজির ফাইল প্রকাশের জন্য আমি অবশ্য আগেই মুখ্যমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়েছি। কেন্দ্রীয় সরকারও একই কারণে ধন্যবাদার্হ হতে পারে। কিন্তু ধন্যবাদ জানানোর পরেও কয়েকটা কথা বলার থাকে।
রাজ্য সরকারের প্রকাশ করা ফাইলের ব্যাপারে খোঁজ নিয়েছি। আমাদের দলের নেতা নরেন চট্টোপাধ্যায় ওই নথির প্রতিলিপি নিয়ে শান্তিনিকেতনের পৌষ মেলা এবং বৈদ্যবাটী উৎসবে প্রদর্শনীও করেছেন। কিন্তু এ সব ফাইলে কাজের কথা কী আছে? বড়বাজারের কোন নেতার উপরে থানা থেকে নজরদারি চলত, কোন বিপ্লবী উত্তর কলকাতায় বিশেষ কারও বাড়িতে দেখা করতে আসবেন বলে খবর পেয়ে সেখানে গোয়েন্দাদের ওত পাতা— এ সব তথ্যও আছে পাতার পর পাতা! নেতাজির অন্তর্ধান রহস্যের কোনও কিনারা তো এতে হচ্ছে না! যে মানুষটার হারিয়ে যাওয়া আজও এ দেশের গভীরতম রহস্যের অন্যতম, সেখানে আলোকপাত করার কোনও চেষ্টা তো দেখছি না! কয়েক দিন আগে মুখ্যমন্ত্রী ফের বলে দিয়েছেন, তাইহোকু বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজির মৃত্যু হয়েছে বলে তিনি বিশ্বাস করেন না! এতে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের কিছু নেই! ওই বিমান দুর্ঘটনা আদৌ ঘটেনি বলে আগেই তো ঐতিহাসিকেরা প্রমাণ করে দিয়েছেন। মনোজ মুখোপাধ্যায় কমিশনও সেই কথা স্পষ্ট করে রিপোর্টে জানিয়েছিল। কিন্তু এ দেশের সরকার সে রিপোর্ট গ্রহণই করেনি। শুধু ফাইল প্রকাশ, শুধু কমিটি গড়ে আর কিছু হওয়ার নয়। নেতাজির প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা জানাতে চাইলে তাঁর অন্তর্ধান রহস্য ভেদ করার জন্য কার্যকরী পদক্ষেপ করা হোক।

জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর দাদা এবং কলকাতার মেয়রের সঙ্গে সুভাষ (বিছানায়)
কয়েক দিন আগেই বামফ্রন্টের বৈঠকে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলাম অতীন দাশগুপ্তকে। অনেক তথ্য-সাবুদ তিনি বামফ্রন্টের বৈঠকেও দেখিয়েছেন। আর একটা কথা আছে। নেতাজি সংক্রান্ত যে ৬৪টা ফাইল রাজ্যে প্রকাশ করা হল, সে সবের ঠাঁই হয়েছে মানিকতলার পুলিশ মিউজিয়ামে! কেন? নেতাজি কি পুলিশের সম্পত্তি? রাজ্য লেখ্যাগার আছে এই ধরনের নথি সংরক্ষণের জন্য। সেখানে নথি পাঠানো হল না কেন?
খুব বেদনার সঙ্গে আরও একটা প্রশ্ন আছে আমার। বামফ্রন্ট সরকার বিদায় নেওয়ার আগে ২৩ জানুয়ারি নেতাজির জন্মদিনটা ‘দেশপ্রেম দিবস’ হিসাবে পালনের সিদ্ধান্ত নিয়ে গিয়েছিল। সরকারের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব পাল্টাতেই পারে। কিন্তু সরকারি স্তরে দেশের এমন গৌরবময় সন্তানকে নিয়ে এই রকম একটা সিদ্ধান্তকে অগ্রাহ্য করার কি কোনও কারণ ছিল? গত কয়েক বছরে পরের পর চিঠি লিখেছি মুখ্যমন্ত্রী মমতাকে। লাভ হয়নি! এমনকী, মমতা যে আমার জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানাতে এসে বলেছিলেন, ভুল হলে ধরিয়ে দেবেন, আপনাকে অধিকার দিয়ে গেলাম, সেই অধিকারও চিঠি লিখে স্মরণ করিয়েছি। দেশপ্রেম দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নিলে আমরাই তো মুখ্যমন্ত্রী ও তাঁর সরকারকে অভিনন্দন জানাতাম! কিন্তু এই সিদ্ধান্ত নিতে কোনও আগ্রহ দেখলাম না এখনও।
আর আছেন মোদী। চমকে তিনি আরও ওস্তাদ! এ দেশের অর্থনীতির কথা ভেবে যোজনা কমিশন গড়া ছিল নেতাজির ভাবনা। মোদীর সরকার দিল্লির তখতে এসে সেই কমিশন তুলে দিল! দেশের অর্থনীতিকেও নেতাজি যে পথে রাখতে চেয়েছিলেন, তার সম্পূর্ণ বিপরীত অভিমুখে নিয়ে চলেছে মোদী জমানা। তাতে আম আদমির দুর্দশা বাড়ছে। আমরা প্রতিবাদ করছি। কিন্তু মোদীরা কানে তুলছেন না। একটা লোকের ভাবনা, আদর্শ, নীতিকে অসম্মান করে শুধু তাঁর নামে ফাইল প্রকাশ করে কী হবে? নিজেদের রাজনৈতিক অভীপ্সা পূরণ করে কংগ্রেসকে কোণঠাসা করা ছাড়া?
নেতাজি এ সব রাজনীতির অনেক ঊর্ধ্বে। তাঁকে নিয়ে এমন দড়ি টানাটানি দেখে জীবনের এই উপান্তে এসে বড় লজ্জা করে আজকাল!
(লেখক ফরওয়ার্ড ব্লকের রাজ্য সম্পাদক)


http://www.anandabazar.com/netaji/a-special-story-on-netaji-by-ashok-ghosh-dgtl-1.291393