তিনি যখন গান গাইতেন যেন ধ্যানমগ্ন হয়ে যেতেন, আর শ্রোতারাও সেই সুরের মায়াজালে আচ্ছন্ন হয়ে পড়তেন। প্রত্যক্ষদর্শীদের কথায়: সেই সুমধুর কণ্ঠস্বর এমন এক স্বর্গীয় আবহের সৃষ্টি করত যা সকলকে যেমন আকৃষ্ট করত, তেমনই মোহিত করে রাখত। তিনি কিরানা ঘরানার উজ্জ্বলতম নক্ষত্র উস্তাদ আব্দুল করিম খান।
আব্দুল করিম কেবল মাত্র ‘কিরানা’ ঘরানার প্রবাদপ্রতিম নন, হিন্দুস্তানি ধ্রুপদী সঙ্গীতের অন্যতম কিংবদন্তি যাঁর কর্নাটকী রাগসঙ্গীতের উপরও দখল ছিল। শুধু তাই নয় বেশ কিছু কর্নাটকী রাগের সফল প্রয়োগ তিনি হিন্দুস্তানি রাগসঙ্গীতের উপরে করেছিলেন। এর মধ্যে ‘সাবেরী’, ‘আনন্দভৈরব’, ‘বনধ্বনি’ উল্লেখ্য। তাঁর ঠুমরি গায়কির মধ্যেও ছিল বৈচিত্র। যদিও তার চেহারা পূরব-অঙ্গ এবং পঞ্জাব-অঙ্গের চেয়ে ছিল আলাদা। বরং গবেষকদের মতে তাতে প্রভাব ছিল মরাঠী নাট্যগীতি এবং ভাব্যগীতের। তেমনই খেয়াল গায়কির ক্ষেত্রে তিনি আলাপের উপরে জোর দিতেন, সচরাচার লয়কারি বোল, তান এড়িয়ে যেতেন। খুব সম্ভবত তিনি মনে করতেন এগুলি খেয়ালের আবহাওয়াকে নষ্ট করতে পারে। তাঁর গায়কিতে তৈরি হত এক আবেগ আপ্লুত মায়াবী পরিবেশ যা শ্রোতাদের মনকে স্পর্শ করতে পারত।
আব্দুল করিমের জন্ম ১৮৭২ সালের ১১ নভেম্বর উত্তরপ্রদেশের মুজফ্ফরনগর জেলার কিরানা গ্রামে। তিনি সঙ্গীতের শিক্ষা নিয়ে ছিলেন তাঁর বাবা কালে খান এবং কাকা অবদুল্লা খানের কাছে। পরে উস্তাদ নান্‌হে খানের কাছেও তালিম নিয়েছিলেন। ছোট থেকেই তিনি অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। কণ্ঠসঙ্গীতের পাশাপাশি তিনি সেতার, বিন, তবলা, নাকাড়া বাজানোয় পারদর্শী ছিলেন।
কুদ্‌রত্ রঙ্গবিরঙ্গী গ্রন্থে কুমারপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় লিখেছিলেন, ‘১৯৩৬ সালে খাঁ সাহেব কলকাতায় আসার অনেক আগেই রেকর্ড মারফত ওঁর গান ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়েছিল। ১৯২৪-এ দিলীপকুমার রায় ওঁকে যখন কলকাতায় আনেন, তখন কেউই ওঁকে চিনত না। ১৯৩৬-এ যখন অল বেঙ্গল কনফারেন্সে গাইতে এলেন, তখন শহর ভেঙে পড়ল।’ শোনা যায় উস্তাদ আব্দুল করিম খানের এক গানের আসরে গান শুনতে শুনতে সম্মোহিত হয়ে জ্বলন্ত হাতের সিগারেটের ছ্যাঁকা খেয়ে সংবিৎ ফিরে পেয়েছিলেন গিরিজাশঙ্কর চক্রবর্তী। কুমারপ্রসাদের মতে, ‘‘আব্দুল করিম খাঁ খাস করে শেষ বয়সে, সুর ও শ্রুতির উপর একটু বেশি জোর দিতেন।’’ সে কালেও অন্যান্য গানের রেকর্ডের মতো উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের রেকর্ড জনপ্রিয়তা পেত না। তবে কিছু ব্যতিক্রমও ছিল যেমন উস্তাদ আব্দুল করিম খানের দুটি ঠুমরি ‘যুমনা কে তীর’ ও ‘পিয়া বিন নাহি আবত’ সেকালেও সারা দেশে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল।
গ্রামোফোন ও টাইপরাইটার কোম্পানি যখন এ দেশে রেকর্ডের ব্যবসা শুরু করেন ১৯০৪-০৫ নাগাদ, আব্দুল করিম খানের বেশ কিছু গান রেকর্ড করা হয়। পরে এগুলি এক পিঠে বাজা রেকর্ড হিসেবে বাজারে প্রকাশ পায়। এর মধ্যে ৭, ১০ ও ১২ ইঞ্চি ব্যাসের রেকর্ড ছিল। আদি যুগের সেই সব দুর্লভ রেকর্ড আজও কালেক্টর্স আইটেম। বিশেষ উল্লেখযোগ্য এই রেকর্ডগুলিতে যুবক আব্দুল করিমের যে গলার নমুনা পাওয়া যায় তা পরবর্তী কালের রেকর্ডের চেয়ে আলাদা। এগুলিতে তাঁর যৌবনের গায়কির ‘তানবাজি’ আর ‘তৈয়ারি’ ধরা পড়ে। পরবর্তী কালে অবশ্য গ্রামোফোন কোম্পানির ‘ওডিওন’ লেবেলে তাঁর বেশ কিছু গান প্রকাশিত হয়েছিল।
শোনা যায় তাঁর জীবনে ছিল আধ্যাত্মিকতার প্রভাব। হিন্দু–মুসলমানের ভেদাভেদের ছায়া তাঁর জীবনে কখনও পড়েনি। দত্তাত্রেয় মন্দিরে বসে যেমন ধর্মসঙ্গীত গাইতেন, তেমনই দরগায় বসে আপন মনে তানপুরা মেলে গান করতেন। তাঁর সঙ্গে সিরডির সাঁইবাবা ও নাগপুরের তাজউদ্দিন বাবার যোগাযোগ ছিল।
তাঁর ব্যক্তিগত জীবন ছিল নানা ঘাত প্রতিঘাতে ভরা। তাঁর প্রথম স্ত্রী গফুরন ছিলেন আব্দুল রহিম খানের মেয়ে এবং আব্দুল বহীদ খানের বোন। তবে আব্দুল বহীদ খানের সঙ্গে তাঁর তিক্ততার কারণে তিনি গফুরনকে ত্যাগ করেন। তার দ্বিতীয় স্ত্রী তারাবাই মানে প্রসিদ্ধ গাইকোয়াড় পরিবরের রাজমাতার ভাই সর্দার মারুতিমানের মেয়ে। আব্দুল করিমের কাছে গান শিখতে গিয়েই প্রণয়ে আবদ্ধ হয়েছিলেন। তাঁদের মোট পাঁচটি সন্তান হয়।  হীরাবাই বরদেকর, কমলাবাই বরদেকর, সরস্বতী মানে, পুত্র সুরেশবাবু মানে এবং কৃষ্ণারাও মানে।
তবে নিজের সন্তানদের ছাড়াও তিনি সঙ্গীতের শিক্ষাদান করেছিলেন সাওয়াই গন্ধর্ব, শঙ্কর রাও সার্ণিক এবং বালকৃষ্ণ বুয়া কপিলেশ্বরীকে। তবে পরবর্তী কালে তাঁর ছাত্রী সরস্বতী বাই মিরজকরের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের জন্য তাঁর স্ত্রী তারা বাইয়ের সঙ্গে সম্পর্কে তিক্ততা দেখা দেয়। পরে এক সময় তারাবাই তাঁকে ত্যাগ করেন। জীবনের বেশির ভাগ সময় আব্দুল করিম খান বরোদা, পুণে আর মিরাজে কাটিয়েছিলেন। মহীশূর রাজ দরবারের গায়ক হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। সেখানেই তিনি ‘সঙ্গীতরত্ন’ সম্মানে ভূষিত হয়েছিলেন।
তবে শুধু অতীতের এক শিল্পী হিসেবে নয়, আজকের দিনেও তিনি অমলিন। তাই গ্রামোফোন রেকর্ডের যুগের শেষে লং প্লেয়িং, ক্যাসেট  সিডির যুগ পেরিয়েও তিনি স্মৃতির অতলে বিলীন হয়নি। তাই আজও মেলে তাঁর গানের সিডি, এমপি থ্রি।
১৯৩৭-এ দক্ষিণ ভারতে একটি অনুষ্ঠান শেষে ফেরার সময় স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছিলেন। তাঁর মৃত্যুতে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘Whatever he sang was music’, তেমনই ফৈয়াজ খান বলেছিলেন, ‘‘হিন্দুস্তান সে সুর মর গয়া।’’

http://www.anandabazar.com/calcutta/a-special-write-up-about-abdul-karim-khan-dgtl-1.338322