কষ্ট সয়েও পটচিত্র কথার ঐতিহ্যআগলে রাখছেন লাল্টু-সালেমারা
হেমাভ সেনগুন্ত ■ সিউড়ি‘
রুপোর খাটে পা গৌরীর , সোনার খাটে গা ,শাঁখা পড়েছে দেখগো , কাতি র্ক-গণেশের মা ’লাঠির আগায় ঘুরছে পটচিত্র৷ যত উঠছে , ততই সালেমা চিত্রকরের গলার জাদুতে বিস্তার হচ্ছে কাহিনির৷ দেবাদিদেব মহাদেব শাঁখা পরার সাধ পূরণ করেননি বলে রাগ করে বাপের বাড়ি চলেছেন দেবী গৌরী৷ তাঁর স্বামীগৃহ ত্যাগে অমঙ্গলের ছায়া কৈলাসে৷ সুর করে শোনাচ্ছেন সালেমা , ‘মাথার উপর কালো বরণের প্যাঁচা , বিনা মেঘে হবে বষ র্ণ , রক্ত পড়বে ন্যাচা ন্যাচা৷ ’ স্থান -কাল ভেদে অনেক সময় গাইতে গাইতে গানের শব্দ বদলে ফেলেন সালেমা৷ পটচিত্র কথার অন্যতম স্রষ্টা তিনি ও তাঁর স্বামী লাল্টু চিত্রকর৷ এমন অনেকে আছেন সিউড়ি শহর থেকে কিছুটা দূরের গ্রাম ইটাগড়িয়ায়!
বংশপরম্পরায় পটচিত্রের সঙ্গে কথকতার ডালি নিয়ে গ্রামের পথেঘাটে ঘুরে বেড়ানোই তাঁদের নেশা -পেশা৷ পুজো এলে পুরাণ ও লোকশ্রীত কাহিনি অবলম্বনে আঁকা ছবি আর নিজেদের সুরে গান বেঁধে পয়সা রোজগার করেন এঁরা৷ তাঁদের হাত ও গলার জাদুতে বেঁচে থাকে পুরাণের নানা কাহিনি৷ লাল্টু ও সালেমা এর আগেও পুজোয় নানা পটচিত্রের জন্ম দিয়েছেন৷ কোনও বার তাঁদের তুলিতে মূত র্ হয়েছে গণেশের বিশ্বভ্রমণ , কখনও বা আঁকা হয়েছে হর -পাব র্তীর বিয়ের আখ্যান৷ চিত্রকর দম্পতির এ বছরের ‘থিম ’ শাঁখা পরতে না দেওয়ায় ভোলানাথকে ছেড়ে উমার বাপের বাড়ি যাত্রা!
শেষে শাঁখারি সেজে স্ত্রীর কাছে গিয়ে মানভঞ্জন করলেন শিব৷ সেই ছবি ভাষা পাচ্ছে লাল্টুর সুরে৷ রুপোর খাটে পা রেখে , সোনার খাটে গা এলিয়ে স্বামীর হাতে শাঁখা পরছেন দুগা র্!
বাংলার লোকসংস্কৃতির অন্যতম অংশ এই পটচিত্র কথা৷ সালেমা -লাল্টুর মতো ইটাগড়িয়া গ্রামের আরও কয়েক জন শিল্পটাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন৷ একসময় গ্রামের ২৫ জন শিল্পী রোজ সকালে পটচিত্র নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন৷ লাঠিতে পেঁচানো ছবির পর ছবি৷ পরপর বেরিয়ে আসছে নানা গল্পের চিত্ররূপ৷ সঙ্গে চিত্রকরের স্বরচিত গান -কবিতায় সেই চিত্রের ব্যাখ্যান৷ বাজনা বলতে শুধু ঢোল৷ চিত্রকর নিজেই বাজিয়ে গান করেন৷ আগে দিনের শেষে নগদ টাকা তো ঘরে আসতোই , সঙ্গে ভক্তিরসে আপ্লুত মানুষের দান চাল -আনাজ পেতেন চিত্রকররা৷ লাল্টু আক্ষেপ করেন , ‘পটের কদর আগের মতো নেই৷ অনেকে ফিরেও তাকায় না৷ আয় না পোষানোয় আমাদের অনেকে পেশাই ছেড়ে দিয়েছেন৷ আমরা মাত্র পাঁচ জন নেশায় বলুন , অন্য কিছু করার উপায় নেই বলেই বলুন , পটচিত্র কথা ছেড়ে যেতে পারছি না৷ ’দামী রংয়ের বালাই নেই৷ নারকোলের মালায় দেশি নানা উপকরণে রং গোলেন সালেমা৷ তিনি বলেন , ‘বাপ -ঠাকুরদার কাছে এই রং তৈরির কৌশল শিখেছি৷ সিম গাছের পাতা কিংবা হিঞ্চে শাকের রস নিংড়ে সবুজ রং তৈরির মজাই আলাদা৷ পাকা জাম বা পুঁই গাছের ফলে মেলে বেগুনি রং৷ স্রেফ ভুষো কালিতে জোগার করলেই কালো রং বানানো শুধু কয়েক মিনিটের ব্যাপার৷ ’ গৌরীর আখ্যান গলায় নিয়ে বাংলায় এখনও টিঁকে আছেন সালেম -লাল্টুদের মতো হাতেগোনা কয়েক জন চিত্রকর৷ পটচিত্র হাতে লাল্টু চিত্রকর ---নিজস্ব চিত্রবাংলার লোকসংস্কৃতির অন্যতম অঙ্গ পটচিত্র কথা৷ সালেমা -লাল্টুর মতো হাতেগোনা কয়েক জন চিত্রকর বাঁচিয়ে রেখেছেন শিল্পটিকে!
Ei Samay 19-10-2015
|
No comments:
Post a Comment