‘আশ্বিনের শারদপ্রাতে বেজে উঠেছে আলোকমঞ্জীর। ধরণীর বহিরাকাশে অন্তর্হিত মেঘমালা। প্রকৃতির অন্তরাকাশে জাগরিত জ্যোতির্ময়ী জগন্মাতার আগমনবার্তা। আনন্দময়ী মহামায়ার পদধ্বনি অসীমছন্দে বেজে উঠে রূপলোক ও রসলোকে আনে নবভাবমাধুরীর সঞ্জীবন। তাই আনন্দিতা শ্যামলী মাতৃকার চিন্ময়ীকে মৃন্ময়ীতে আবাহন। আজ চিচ্ছক্তিরূপিণী বিশ্বজননীর শারদশ্রীবিমন্ডিতাপ্রতিমা মন্দিরে মন্দিরে ধ্যানবোধিতা।
সিংহস্থা শশিশেখরা মরকতপ্রেক্ষা চতুর্ভির্ভুজৈঃ।
শঙ্খং চক্রধনুঃশরাংশ্চ দধতী নেত্রৈস্ত্রিভিঃ শোভিতা।।
আমুক্তাঙ্গদহার কঙ্কণরণৎ কাঞ্চীক্কণন্নূপুরা।
দুর্গা দুর্গতিহারিণী ভবতু নো রত্নোল্লসৎকুন্ডলা।। ...’
শঙ্খং চক্রধনুঃশরাংশ্চ দধতী নেত্রৈস্ত্রিভিঃ শোভিতা।।
আমুক্তাঙ্গদহার কঙ্কণরণৎ কাঞ্চীক্কণন্নূপুরা।
দুর্গা দুর্গতিহারিণী ভবতু নো রত্নোল্লসৎকুন্ডলা।। ...’
সকালে শোনা হয়ে গেছে তো? পৃথিবীর ইতিহাসে রেডিওতে সম্প্রচারিত এমন জনপ্রিয় অনুষ্ঠান বিরল। পঁচাশি বছর ধরে চলে আসছে এই ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ অনুষ্ঠান, যা শুরু হয়েছিল ১৯৩১ সালে। সেই গল্পটা শোনো।
আকাশবাণীর (তখন অল ইন্ডিয়া রেডিও, আকাশবাণী নাম হয়নি তখনো) সেই যুগে অনুষ্ঠান প্রযোজকরা প্রতি সপ্তাহে একদিন বিকেলে বসে বসে ঠিক করতেন নতুন অনুষ্ঠান কী শুরু করা যায়। একঘেয়ে অনুষ্ঠান করলে শ্রোতাদের মন জয় করা যাবে কী করে, তাই প্রতি সপ্তাহে নতুন কিছু চাই। বিখ্যাত ঔপন্যাসিক ও চলচ্চিত্র পরিচালক প্রেমাঙ্কুর আতর্থী আকাশবাণীর পত্রিকা বেতার জগৎ প্রকাশনা চালু করেছিলেন, তাঁকে সবাই ডাকত বুড়োদা বলে। তিনিও আসতেন সেই আলোচনায়। একদিন তিনি প্রস্তাব করলেন, এই যে এত অনুষ্ঠান করা হচ্ছে, গান হচ্ছে, নাটক হচ্ছে, বাচ্চাদের-মহিলাদের জন্যে প্রোগ্রাম বানানো হচ্ছে, সবই ঠিক আছে, কিন্তু এমন কিছু সৃজনীমূলক অনুষ্ঠান তৈরী করা দরকার যা শ্রোতাদের অন্তস্থলকে নাড়িয়ে দেবে। নৃপেন মজুমদার তখন হেড প্রযোজক, তিনি হেসে বললেন, এই মুষ্টিমেয় কজন দিয়ে আমরা অনুষ্ঠান চালাচ্ছি সকাল থেকে মাঝরাত অবধি, আর আমরা কী করতে পারি?
মনে রাখতে হবে, তখন সমস্ত অনুষ্ঠানই হত লাইভ।
বুড়োদা বললেন, পারবে না কেন? মনে কর, যদি রাত দশটা থেকে সকাল চারটে অবধি রাত্রে-গাওয়া রাগগুলো দিয়ে একটা সারারাত্রব্যাপী অনুষ্ঠান করা যায়, অথবা ধরো একটা বিশেষ প্রভাতী অনুষ্ঠান যদি ভোর চারটেয় শুরু করা যায়, কিছু লোকের পছন্দ হবে নিশ্চয়, তারা বলবে, ওহ, কী দারুণ আইডিয়া।
নৃপেন মজুমদার বললেন, ঠিক আছে, ভেবে দেখি। বুড়োদা বললেন, এই তো এখানে বাণীদা আছেন, উনি যদি বেদের কিছু স্তোত্র জোগাড় করে আনেন, রাই (রাইচাঁদ বড়াল) যদি তার কিছুতে মোক্ষম সুর বসাতে পারে আর বীরেন যদি স্তোত্রপাঠ করে, কেমন হয়?
বাণীকুমার লেগে পড়লেন কাজে। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ নৃপেন মজুমদারকে বললেন, সামনেই পুজো আসছে, পুজোতে আমি এমনিতেই চন্ডীপাঠ করি, যদি ওটাতেই একটা ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর দেওয়া যায়, আর আরও কিছু গানের সঙ্গে পরিবেশন করা যায়, বেশ কিছু লোকের ভাল লাগা উচিত।
সেই প্রস্তাব পাশ কয়ে গেল। এক সপ্তাহের মধ্যে বাণীকুমার কিছু গান লিখে ফেললেন। পন্ডিত হরিশচন্দ্র বালি, রাইচাঁদ বড়াল আর পঙ্কজকুমার মল্লিক তাতে সুর চড়ালেন। পন্ডিতজী সুর দিলেন অখিল বিমানে আর বিমানে বিমানে আলোকের গানে গান দুটোতে। মহম্মদ সাগির খান সুর দিলেন শান্তি দিলে ভরি-তে। নিখিল আজি সকাল-এ সুর দিলেন রাইচাঁদ বড়াল। মাগো তব বিনে, জাগো দুর্গা জাগো দশপ্রহরণধারিণি, তব অচিন্ত্য, শুভ্র শঙ্খরবে, বাজলো তোমার আলোর বেণু আর অন্যান্য গানে সুর দিলেন পঙ্কজকুমার।
সেই সময়কার স্বনামধন্য শিল্পীদের ডাকা হল গানগুলো গাইতে, তাদের রিহার্সাল দেওয়ালেন পঙ্কজকুমার মল্লিক। বিখ্যাত যন্ত্রশিল্পীরা এলেন সেই অনুষ্ঠানে বাজানোর জন্যে। মুনশি বাজালেন সারেঙ্গী, তার ভাই আলি বাজালেন চেলো। হারমোনিয়ামে ছিলেন খুশি মহম্মদ, বেহালায় অবনী মুখার্জী আর তারকনাথ দে, ম্যান্ডোলিনে সুরেন পাল, গিটারে সুজিত নাথ, এস্রাজে দক্ষিণামোহন ঠাকুর। শান্তি ঘোষ বাজালেন ডাবল বাস। রাইচাঁদ বড়াল নিজে বাজালেন পিয়ানো ও অর্গান। পরে বংশীবাদক গৌর গোস্বামী, হিমাংশু বিশ্বাস, শৈলেন দাস, অনিল দাস ও আরো অনেক যন্ত্রশিল্পীদের সমন্বয় ঘটল সেই অনুষ্ঠানে।
গায়কদের তালিকায় তাবড় শিল্পীরা। পঙ্কজকুমার মল্লিক নিজে তো বটেই, সঙ্গে বিমলভূষণ, কৃষ্ণা ঘোষ, আভাবতী, মানিক মাল, প্রফুল্ল বালা, বীণাপাণি, প্রভাবতী এবং আরো প্রতিষ্ঠিত শিল্পীবৃন্দ। পরে যোগদান করলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, জগন্ময় মিত্র, শৈল দেবী, রাধারাণী, শ্যামল মিত্র, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, আরতি মুখোপাধ্যায়, সুপ্রীতি ঘোষ, শিপ্রা বসু, দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়, তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়, উৎপলা সেন, ইলা ঘোষ, সাবিত্রী ঘোষ, ইলা বসু, সুমিত্রা সেন ও আরো বরেণ্য শিল্পীরা।
প্রথমবার যে কী করে পুরো অনুষ্ঠানটা পরিবেশিত হল, সে এক মজার কাহিনী। ঠিক হয়েছিল বীরেন্দ্রকৃষ্ণ যেই সংস্কৃত শ্লোক পাঠ শুরু করবেন, অমনি বাদ্যযন্ত্রীরা তার সঙ্গে স্বরের উচ্চনীচ অনুসরণ করে উপযুক্ত বাজনা বাজাবেন। তিনি যখন ভাষ্যপাঠ করবেন, তারা সঙ্গত করবেন ব্যাকগ্রাউন্ডে এক একটা শাস্ত্রীয় রাগের গৎ বাজিয়ে। রাইচাঁদ বড়াল সুন্দর করে বুঝিয়ে দিলেন যন্ত্রসঙ্গীতশিল্পীদের। তারা ঘাড় নাড়ল, বুঝেছে।
১৯৩১ সালের মহাদুর্গাষষ্ঠীর ভোর চারটে। শুরু হল আকাশবাণীর প্রভাতী অনুষ্ঠান। লাইভ। সংস্কৃত শ্লোক পাঠ করে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ শুরু করলেন বাংলায় ভাষ্যপাঠ। তার শুরুটা এই রকম – আজ শুভ শারদোৎসব, জলে-স্থলে-প্রকৃতিতে তার আগমনবার্তা, ইত্যাদি। যন্ত্রশিল্পীদের অনেকেই অবাঙালী মুসলমান, তারা বাংলা আর সংস্কৃতর পার্থক্য বুঝতে না পেরে বাজিয়ে যেতে লাগল শ্লোক পাঠ করার সময় যেমন বাজাচ্ছিল তেমনই। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ পাঠের মধ্যেই বুঝলেন, প্ল্যানমাফিক না হলেও এ তো বেশ জমছে। তিনিও ভাষ্যপাঠ করে যেতে লাগলেন স্বর উঁচুনীচু করে, গানে যেমন করা হয়। ভাষ্যের সঙ্গে সঙ্গত দারুণ খাপ খেয়ে গেল। যেমন ভেবে রাখা হয়েছিল, কার্যক্ষেত্রে তেমন হচ্ছে না দেখে রাইচাঁদ, নৃপেন মজুমদার আর পঙ্কজকুমার প্রথমদিকে রেগে গেলেন, কিন্তু তাঁরাও বেশ বুঝতে পারলেন জিনিসটা মোটেই বেখাপ্পা লাগছে না, বরং সুন্দর জমছে। তাঁদের ইঙ্গিতে এরপর বাঙালী যন্ত্রশিল্পীরাও সেই তালে তাল দিতে পুরো জিনিসটা সর্বাঙ্গসুন্দর রূপ পেতে লাগল। দুঘন্টার সেই অনুষ্ঠান শুনে ভোর রাতে জেগে ওঠা আকাশবাণীর শ্রোতারা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল। অনুষ্ঠান শেষ হতেই শুরু হল অভিনন্দনপ্রাপ্তির রাশি রাশি চিঠি আর ফোন।
প্রথম দু’বছর এই অনুষ্ঠান হল মহাষষ্ঠীর দিন ভোর চারটে থেকে ছটা অবধি, লাইভ। পরে এটাকে কমিয়ে দেড়ঘন্টার অনুষ্ঠান করা হল। শ্রোতাদের সনির্বন্ধ অনুরোধে পরিবেশনের সময় এগিয়ে এনে মহালয়ার দিন ঠিক করা হল। সম্প্রচারের দিন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ সারারাত থেকে যেতেন আকাশবাণী ভবনে। অন্যান্যদের গাড়ি পাঠিয়ে রাত দুটোর সময় বাড়ি থেকে তুলে আনা হত।
১৯৫৮ সালে প্রথম রেকর্ডিং করে বাজানো প্রোগ্রাম সম্প্রচার হয়। তারপর থেকে এ যাবৎ সেটাই বাজানো হয়ে আসছে। প্রথমদিকে হয় জয়ন্ত চৌধুরী বা কাজী সব্যসাচী এই অনুষ্ঠানের ঘোষণার দায়িত্বে থাকতেন। পরে বহু বছর সেই দায়িত্বে ছিলেন দিলীপ ঘোষ।
শুধু পশ্চিমবঙ্গে নয়, সারা পৃথিবীর বাঙালীদের কাছে এই অনুষ্ঠান অসম্ভব জনপ্রিয়। ঢাকা সফরে গিয়ে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ অবাক হয়েছিলেন সেখানকার মুসলমান মানুষের কাছেও এর জনপ্রিয়তা দেখে।
আকাশবাণী এই অনুষ্ঠানে বৈচিত্র্য আনতে ১৯৭৬ সালে বাঙালীর হার্টথ্রব উত্তমকুমারকে দিয়ে আর একটি অনুষ্ঠানের সম্প্রচার করেছিল, যার ফল হয়েছিল মারাত্মক। সেই অনুষ্ঠান জনপ্রিয় তো হয়ই নি, শ্রোতাদের সমবেত প্রতিবাদে আকাশবাণীকে ফিরিয়ে নিয়ে আসতে হয় বীরেন্দ্রকৃষ্ণ-বাণীকুমার-পঙ্কজকুমার প্রমুখের যুগপৎ প্রচেষ্টার এক অবিনশ্বর সৃষ্টি - মহিষাসুরমর্দিনী-কে।
(বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের জীবনী অবলম্বনে)