উপেক্ষিতই রয়ে গেল মানভূমের ভাষা আন্দোলন
মাতৃভাষার জন্য মানভূমের বাঙালিদের আন্দোলন নিয়ে যে কোনও আলোচনা থেকে বিরত থাকেন অনেক বাঙালি। অবহেলা না আত্মবিস্মরণ? না হলে কেন জানতে ইচ্ছে করে না, কেমন ছিল মানভূমবাসীর লড়াইয়ের দশটা বছর। প্রশ্ন তুললেন প্রবীর সরকার
হাওড়া ব্রিজ অতিক্রম করছে মানভূমবাসীদের মিছিল। ফাইল চিত্র
শুন বিহারি ভাই তোরা রাইখতে লারবি ডাং দেখাই...’ কলকাতার পথে মানভূমবাসীদের লং মার্চ হাওড়া ব্রিজ অতিক্রম করছে। বাংলা ভাষার দাবিতে।
বাংলা ভাষার রয়েছে আন্তর্জাতিক পরিচিতি। তবে এ পরিচিতি অক্ষরের নয়, শব্দের নয়, মায়ের মুখ নিঃসৃত ভাষার প্রতি সন্তানের আবেগের। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার রক্তাক্ত রাস্তা সে পরিচিতি এনে দিয়েছে। ১৯৯৯ সালে যে রক্তসরণিকে মনে রেখে এই ২১-কেই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি দিয়েছে বিশ্ব।
কিন্তু ভাষা আন্দোলন বলতেই মানুষ স্মরণ করে বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনকে। অথচ, ভাষা নিয়ে বাঙালির আবেগ এবং লড়াই কোনওটাই কিন্তু নতুন নয়। যেমন যবনের ভাষাকে ‘বাংলা’ করতে গিয়ে লড়েছিলেন ভারতচন্দ্র, মধুসূদন লড়েছেন ছন্দ ব্যবহার করতে গিয়ে, টপ্পা গান শিখতে গিয়ে লড়েছিলেন নিধুবাবু আর অস্তিত্ব রাখতে রক্ত ঝরানো আন্দোলন করেছেন অসমের বাঙালিরা। কিন্তু এর পাশাপাশি, মাতৃভাষার জন্য মানভূমের বাঙালিদের দীর্ঘ আন্দোলন নিয়ে যে কোনও রকম আলোচনা থেকে বিরত থাকেন অনেক বাঙালি। অবহেলা না আত্মবিস্মরণ? না হলে উপরোক্ত দৃশ্যপট কেন রাজ্যবাসীর মানসচক্ষে ভেসে ওঠে না! কেন জানতে ইচ্ছে করে না, কেমন ছিল মানভূমবাসীর লড়াইয়ের দশটা বছর?
লর্ড কার্জনের বঙ্গবিচ্ছেদের একটা অংশ যত আলোচিত হয়, ততটাই উপেক্ষিত দ্বিতীয় অংশটি। বঙ্গবিচ্ছেদ তো কেবল পূর্ববঙ্গ আর পশ্চিমবঙ্গের ভাগ নয়! বঙ্গবিচ্ছেদ আসলে ছিল তৎকালীন পূর্ববঙ্গ-উত্তরবঙ্গ-অসম-ত্রিপুরা নিয়ে একটি ভাগ আর বাংলার বাকি অংশের সঙ্গে বিহার-ওড়িশা মিলিয়ে আর একটি ভাগ। মানভূম বা পুরুলিয়া ছিল দ্বিতীয় অংশে। ১৯০৫-এ না হলেও বাস্তবে বঙ্গবিচ্ছেদ ঘটে গেল ১৯৪৭-এ স্বাধীনতা প্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে। বাঙালির মানভূমে তখন থেকেই শুরু হল এক রকম ‘হিন্দি-সাম্রাজ্যবাদ’।
একের পরে এক বাংলা স্কুল পরিণত হল হিন্দি স্কুলে। পোস্ট অফিস-সহ সমস্ত সরকারি দফতরে হিন্দি বাধ্যতামূলক করা হল। ফরমান আসে, আদালতের সওয়াল-জবাব, চিঠিপত্র, জমির দলিল সব হবে হিন্দিতে। ঠিক যে কৌশলে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের উপরে উর্দু চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল, হিন্দির ‘আগ্রাসন’ মানভূমে যেন ঠিক ততটাই প্রবল হয়ে উঠেছিল ১৯৪৮ থেকে। এর বিরুদ্ধেই মানভূমের ভাষা আন্দোলন।
মানভূমে বাংলার উপরে হিন্দির আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা শুরু হয় ১৯১২ থেকে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠনের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করতে গিয়ে বিষয়টি জটিল হয়ে ওঠে। যার আঁচ পড়ে জাতীয় কংগ্রেসের মানভূম শাখার কর্মী নেতাদের উপরে। ১৪ জুন, ১৯৪৮ পুঞ্চা থানার পাকবিড়রায় প্রায় দেড় হাজার কর্মী-সমর্থকের উপস্থিতিতে কংগ্রেস ভেঙে গঠিত হয় ‘লোকসেবক সংঘ’। এর বীজ বপন হয় ৩০ এপ্রিল, বান্দোয়ানের জিতান গ্রামে মানভূম জেলা কংগ্রসের পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে। সেখানে দীর্ঘ আলোচনার সারমর্ম একটাই, ‘মানভূম বাংলা ভাষাভাষী’।
রাজনৈতিক বাধ্য-বাধকতায় এই ভাবনা কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি অগ্রাহ্য করতে কংগ্রেস থেকে পদত্যাগ করেন অন্নদাপ্রসাদ চক্রবর্তী, বীররাঘব আচারিয়া, বিভূতিভূষণ দাশগুপ্ত, ভজহরি মাহাতো, অতুলচন্দ্র ঘোষ, জগবন্ধু ভট্টাচার্য, সত্যকিঙ্কর মাহাতোর মতো বহু গুরুত্বপূর্ণ গাধীঁবাদী নেতা। মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধীর সত্যাগ্রহই ছিল তাঁদের অস্ত্র, কিন্তু ১৯৪৬-এর বিহার নিরাপত্তা আইনের ‘নামে’ অত্যাচার শুরু হল ভাষা আন্দোলনকারীদের উপরে।
সত্যাগ্রহকে দমন করার জন্য হয়েছে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, বিচিত্র দমনপীড়ণ। গ্রেফতার হয়েছেন সাত নেতা। পুরুলিয়া জুবিলি ময়দান, রাসমেলা ময়দানের সভাতেও লাঠি চালায় পুলিশ। সাঁতুড়ির জনসভায় পুলিশের লাঠির আঘাতে মাথা ফাটে চিত্তভূষণ দাশগুপ্তের। মিথ্যা মামলায় কারারুদ্ধ করা হয় বহু নেতাকে।
এই আন্দোলনে স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন জানান সর্ব স্তরের বাঙালি। এর পরে মানভূমে বাংলা ভাষার আন্দোলন দৃষ্টি আকর্ষণ করে কলকাতা ও দিল্লির, তবু নিপীড়ণ-অত্যাচার চলছিলই। ফলে, শুরু হল ‘টুসু সত্যাগ্রহ’। মানভূমের লোকগান ‘টুসু’, সাধারণের স্বতোৎসারিত আবেগ মিশে থাকে। তাতেও ফুটে উঠতে লাগল বাংলা ভাষার প্রতি আবেগ।
লোকসেবক সংঘের একটি ছোট্ট পুস্তিকা ‘টুসু গানে মানভূম’ ঝড় তুলেছিল এই সময়। টুসু গান আবহমানকালের যূথবদ্ধ সঙ্গীত। অথচ, দল বেঁধে গান গাইতে গেলেই তা অপরাধ বলে গণ্য করা শুরু হল। যুবক-বৃদ্ধ, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে টুসু গান গেয়ে গ্রেফতার হলেন অসংখ্য মানুষ। কারারুদ্ধ গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের স্থানান্তরিত করা হল হাজারিবাগের মতো দূরের কারাগারে। এরই মধ্যে শুরু হয় সীমা কমিশনের কাজ।
সেই সময়ে পশ্চিমবঙ্গ ও বিহারের তৎকালীন দুই মুখ্যমন্ত্রীর (বিধানচন্দ্র রায় ও শ্রীকৃষ্ণ সিংহ) তরফে বঙ্গ-বিহার যুক্ত প্রদেশ গঠন করার প্রস্তাব আসে। এ বার কেবল মানভূম নয়, প্রতিবাদ করেন কলকাতার বাঙালি বিদ্বজ্জনেরাও। ইতিমধ্যে ১৪৪ ধারা জারি করে ‘টুসু সত্যাগ্রহ’ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। সাবেক মানভূমের নানা স্থানে চলেছে বিহার পুলিশের ‘অত্যাচার।’ ঝালদা ও জয়পুরে দোকান লুঠ হচ্ছে, জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে বাড়িঘর।
পরের ঘটনা ঐতিহাসিক ‘লং মার্চের’ সঙ্গে তুলনীয়। বাংলা-বিহার সংযুক্তিকরণের প্রতিবাদে (নিহিতার্থে মানভূমে বাংলা ভাষার হৃত অধিকার ফিরিয়ে আনার দাবিতে) ১০ জন মহিলা-সহ ১০০৫ জনের সত্যাগ্রহী দল পাকবিড়রা থেকে পদযাত্রা শুরু করে কলকাতার উদ্দেশে। ২০ এপ্রিল থেকে ৬ মে, টানা ২১ দিন প্রায় ৩০০ কিলোমিটার পথ হেঁটেছিলেন সত্যাগ্রহীরা। কণ্ঠে ছিল ‘বন্দে মাতরম’ ধ্বনি আর ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’, ‘বাংলা ভাষা প্রাণের ভাষা রে’ ইত্যাদি গান। কলকাতায় পৌঁছলে
৭ মে ডালহৌসি স্কোয়ার থেকে ১৪৪ ধারায় গ্রেফতার করা হয় ৯৫৬ জনকে। বাকিরা অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। ৯ মে কলকাতায় পৌঁছতেই তাঁদের গ্রেফতার করে পশ্চিমবঙ্গের পুলিশ।
পরের ঘটনাক্রম দ্রুততর। বাধ্য হয়ে রদ করা হয় বাংলা-বিহার সংযুক্তির প্রস্তাব। বঙ্গ-বিহার ভূমি হস্তান্তর আইন পাশ হয়। সীমা কমিশনের রিপোর্ট লোকসভা হয়ে ‘সিলেক্ট কমিটি’ ও আরও নানা স্তর পেরিয়ে ১ নভেম্বর, ১৯৫৬ জন্ম নেয় আজকের পুরুলিয়া জেলা।
নিস্তারিণী কলেজে বাংলার শিক্ষক
How to Play Baccarat Online - Online Casinos UK
ReplyDelete› how-to-play-baccarat › how-to-play-baccarat Learn how to play Baccarat online. Learn how to play Baccarat online plus how to win at 바카라 안전 사이트 baccarat online and many other online casinos including poker,