সঙ্গীতের দুই ধারাকে মিলিয়েছিলেন তিনি
আব্দুল করিম খান গান গাইতেন ধ্যানমগ্ন হয়ে। শ্রোতারাও সুরের মায়াজালে আচ্ছন্ন হয়ে পড়তেন। তাঁর সুমধুর, নরম কণ্ঠস্বর শ্রোতাদের অন্তর ভেদ করে কখনও আবেগে আপ্লুত করেছে, কখনও কাঁদিয়েছে। লিখছেন বিভূতিসুন্দর ভট্টাচার্য
সে দিন তাঁর গান শোনার জন্য কলকাতার শহর যেন ভেঙে পড়েছিল। ১৯৩৬ সালের অল বেঙ্গল মিউজিক কনফারেন্সের মঞ্চে তখন শীর্ণদেহী এক শিল্পী, মাথায় পাগড়ি। তিনি গেয়ে চলেছেন পরজ বসন্ত। সেই গান শুনে শ্রোতাদের মধ্যে কারও চেখে ছিল জল, কেউ বা সুরের মূর্ছনায় পৌঁছে গিয়েছিলেন এক ভিন্ন লোকে। হঠাৎ এক সময়ে শ্রোতাদের মনে হল, মঞ্চের শিল্পী যেন হাঁ করে আছেন। তাঁর মুখ দিয়ে কোনও আওয়াজ বার হচ্ছে না। পাশে শুধু যেন এক জোড়া তানপুরা বাজছে। সযত্ন মেলানো তানপুরা আর হারমোনিয়ামের ষড়জ তাঁর কণ্ঠস্বরের সঙ্গে এমনই মিলেমিশে গিয়েছিল যে, এমনটাই মনে হচ্ছিল। সেই আসরেই গান শুনতে এসে গিরিজাশঙ্কর চক্রবর্তীর মতো সঙ্গীতশিল্পীও এতটাই সম্মোহিত হয়ে পড়েছিলেন যে, হাতের জ্বলন্ত সিগারেটের ছ্যাঁকা খেয়ে তবেই সংবিৎ ফিরে পেয়েছিলেন।
সে দিনের সেই শিল্পী কিরানা ঘরানার প্রবাদপ্রতিম উস্তাদ আব্দুল করিম খান।
সে দিনের সেই শিল্পী কিরানা ঘরানার প্রবাদপ্রতিম উস্তাদ আব্দুল করিম খান।
তিনি শুধু খেয়াল ও ঠুমরির গায়কিতে পরিবর্তনই আনেননি, তিনিই সম্ভবত প্রথম শিল্পী যিনি রাগসঙ্গীতের ভিন্ন দুই ধারার মেলবন্ধন ঘটিয়েছিলেন তাঁর গানে। ১৯২৪ সালে দিলীপকুমার রায় প্রথম তাঁকে যখন কলকাতায় নিয়ে আসেন, তখন সে ভাবে তাঁকে কেউ চিনত না। পরে ১৯৩৬ সালে তিনি যখন অল বেঙ্গল মিউজিক কনফারেন্সে গান গাইতে এলেন, তার অনেক আগেই গ্রামোফোন রেকর্ডের দৌলতে তাঁর গান ঘরে ঘরে পৌঁছে গিয়েছিল। তাই সঙ্গীতরসিকদের মধ্যে তাঁর গান শোনার উৎসাহ ছিল প্রবল।
আব্দুল করিমের জন্ম ১৮৭২ সালের ১১ নভেম্বর উত্তরপ্রদেশের মুজফ্ফরনগর জেলার কিরানা গ্রামে। তিনি সঙ্গীতের তালিম পেয়েছিলেন তাঁর বাবা কালে খান এবং কাকা আবদুল্লা খানের কাছে। এ ছাড়াও নান্হে খানের কাছেও তালিম নিয়েছিলেন। ছোট থেকেই আব্দুল করিম অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। কণ্ঠসঙ্গীতের পাশাপাশি তিনি সেতার, বীণা, সারেঙ্গি ও তবলা বাজানোয় বিশেষ পারদর্শী ছিলেন।
মাত্র এগারো বছর বয়সে মেরঠে কিরানা পরিবারের উস্তাদদের সামনে মুলতানি ও পূরবী গেয়ে হইচই ফেলে দিয়েছিলেন। সেই সময়ে তাঁর গান শুনেছিলেন মহীশূর দরবারের সারেঙ্গিবাদক হায়দর বখ্শ। বছর পাঁচেক পরে আব্দুল করিম তাঁর কাছেই মহীশূরে গিয়েছিলেন রাজদরবারে দশেরা উৎসবে গান শোনানোর উদ্দেশে। এখানে তোড়ি গেয়ে তিনি সকলের নজর কেড়েছিলেন। মহীশূর দরবারেই তিনি কর্ণাটকী সঙ্গীতের প্রখ্যাত শিল্পীদের সান্নিধ্যে এসে কর্ণাটকী সঙ্গীতের নানা বিষয়ে সমৃদ্ধ হয়েছিলেন। তাঁর সরগমেও কর্ণাটকী সঙ্গীতের প্রভাব ছিল।
সেখান থেকে ফেরার পথে আব্দুল করিম জয়পুর গিয়েছিলেন। সতেরো বছর বয়সে ইচ্ছের বিরুদ্ধে তাঁর বিয়ে হয় আব্দুল রহিম খানের মেয়ে এবং আব্দুল বহিদ খানের জ্যাঠতুতো বোন গফুরনের সঙ্গে। তবে সে বিয়ে সুখের হয়নি। কেননা আব্দুল করিম আর কখনও কিরানায় ফিরে আসেননি। এমনকী পরবর্তী সময়ে তিনি দিল্লি বা তার কাছাকাছি কোনও অনুষ্ঠানও নিতেন না। কেননা আব্দুল করিমের মনে হত, তাঁর আত্মীয়স্বজন জোর করেই তাঁকে কিরানায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবেন।
প্রথম জীবনে তিনি তাঁর দাদা লতিফ পরে আব্দুল হকের সঙ্গে গান গাইতেন। ১৮৯৪ সালে আব্দুল করিম ও তাঁর দাদা আব্দুল হক বরোদায় আসেন। এখানে তাঁরা আল্লারাখি নামে এক গায়িকার বাড়িতে আশ্রয় নেন। আব্দুল করিম ও আব্দুল হক সারা দিন ঘুড়ি উড়িয়ে রাতে রেওয়াজ করতেন। বরোদার তৎকালীন রাজা সিয়াজিরাও মাঝে মধ্যেই গভীর রাতে প্রজাদের সুখ-দুঃখের কথা জানতে ছদ্মবেশে নগর পরিদর্শনে বেরোতেন। এমনই এক রাতে সিয়াজিরাও দুই ভাইকে রেওয়াজ করতে শোনেন। মাসখানেক পরে আবারও একই ভাবে দুই ভাইয়ের গান শুনে তাঁর ভাল লাগে। এবং পরদিন তাঁদের প্রাসাদে নিয়ে আসেন। তাঁদের গান শুনে মহারাজ ও মহারানির এতটাই ভাল লেগেছিল যে, পাঁচশো টাকা ও দামি শাল উপহার দিয়ে আব্দুল করিমকে সভাগায়ক নিযুক্ত করেছিলেন। এ ছাড়াও দু’জনের ভদ্র ব্যবহার ও অতিথিদের মনোরঞ্জনের ক্ষমতা দেখে প্রাসাদের মহিলামহলে গান শেখানোর চাকরিও পাকা হয়ে গিয়েছিল।
১৮৯৬ সালে রানি ভিক্টোরিয়ার সিংহাসন প্রাপ্তির হীরক জয়ন্তী উপলক্ষে বরোদায় এক বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। তাতে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ভাইসরয় লর্ড এলগিন। সেই অনুষ্ঠানে আব্দুল করিম ও আব্দুল হক সঙ্গীত পরিবেশন করেন। আসর জমে উঠেছিল, এমন সময়ে লর্ড এলগিন হঠাৎই রাগের নাম জিজ্ঞেস করায় কেউই সঠিক উত্তর দিতে পারেননি। গান শেষ হওয়ার পরে আব্দুল করিম বিনীত ভাবে জানিয়েছিলেন সেই রাগটিকে ‘রসিকরঞ্জনী’ বলে। গানে মুগ্ধ লর্ড এলগিন সে দিন দুই ভাইকে সোনার আংটি উপহার দিয়েছিলেন।
বরোদায় থাকাকালীন বরোদার রাজমাতার ভাই, সর্দার মারুতিমানের মেয়ে তারাবাঈ মানের সঙ্গে আব্দুল করিমের পরিচয় হয়। সিয়াজিরাও ঠিক করেছিলেন, তাঁর সঙ্গীত বিদ্যালয়ের জন্য একটি পাঠক্রম তৈরি করবেন। এ ছাড়াও ফ্রেডরিল সাহেবের অর্কেস্ট্রার দল দেশীয় রাগ-রাগিণী বাজাবে, তার জন্য নোটেশনের প্রয়োজন ছিল। আব্দুল করিম খান অল্প উর্দু পড়তে লিখতে জানতেন। তাই তাঁর একার পক্ষে তা করা সম্ভব ছিল না। শেষ পর্যন্ত ঠিক হয়েছিল যে, আব্দুল করিমের গানের নোটেশন করবেন তারাবাঈ।
এ ভাবেই তাঁদের মধ্যে যে ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়, তা ভালবাসায় পরিণত হয়। তবে মারুতিরাও মানে মেয়েকে সন্দেহ করে তাঁর উপরে অত্যাচার শুরু করলে তারাবাঈয়ের কথায় আব্দুল করিম রাতারাতি তাঁকে নিয়ে বরোদা ছেড়েছিলেন ১৮৯৮ সালে।
সেই বছরেই তাঁরা মুম্বই এসেছিলেন। সেখানে আব্দুল করিম প্লেগে আক্রান্ত হন। পরে সুস্থ হয়ে উঠলে তিনি তারাবাঈকে বিয়ে করেন। শুরু হয় জীবনের এক নতুন অধ্যায়। তাঁদের মোট পাঁচটি সন্তান হয়। তাঁরা হলেন হীরাবাঈ বরদেকর, কমলাবাঈ বরদেকর, সরস্বতী মানে, পুত্র সুরেশবাবু মানে এবং কৃষ্ণারাও মানে। তারাবাঈ ছিলেন সুগৃহিণী এবং এক সার্থক মা। তিনি ভাল নাচ জানতেন এবং খানসাহেবের সঙ্গে সঙ্গতও করতেন। দুঃসময়ে নাচ শিখিয়ে তিনি সংসারও চালিয়েছিলেন।
১৯১৩ নাগাদ আব্দুল করিম পুণেতে আর্য সঙ্গীত বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। জাতিধর্ম নির্বিশেষে সঙ্গীতের সকল শিক্ষার্থীর জন্য তা উন্মুক্ত ছিল। সঙ্গীত নিয়ে তাঁর কোনও সংকীর্ণতা ছিল না। গুরুকুল প্রথায় তিনি গান শেখাতেন। তাই তাঁদের যাবতীয় ব্যয়ভার বহন করতেন নিজেই। ১৯১৭ নাগাদ তিনি মুম্বইয়ে এর একটি শাখা প্রতিষ্ঠা করেন।
বিখ্যাত এই গায়ক ছিলেন উদার মনের মানুষ। তাঁর স্বভাবটি ছিল ফকিরের মতো। কখনও কারও নিন্দা করতেন না, শুনতেনও না। তাঁর জীবনযাপন ছিল অত্যন্ত সাধারণ। তবু তা ছিল নানা ঘাত-প্রতিঘাতে ভরা। তারাবাঈয়ের সঙ্গে তাঁর সুখের সংসার দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। সম্পর্কের তিক্ততার কারণে তারাবাঈ তাঁকে ত্যাগ করেন। মিরজে তাঁর এক ছাত্রী বন্নুবাঈ লটকর তাঁর দেখাশোনা করতেন। পরবর্তী কালে সামাজিক স্বীকৃতি দিতেই আব্দুল করিম তাঁকে বিয়ে করেন। এই বন্নুবাঈ পরবর্তী কালে সরস্বতীবাঈ মিরজকর নামে পরিচিত হয়েছিলেন। নিজের সন্তানদের ছাড়াও তিনি গান শিখিয়েছিলেন সাওয়াই গন্ধর্ব, শঙ্কর রাও সারনায়েক, বালকৃষ্ণ বুয়া কপিলেশ্বরী এবং রোশনারা বেগম প্রমুখকে।
জীবনের প্রথম দিকটা বরোদা এবং পুণেতে কাটালেও ১৯২০ সাল থেকে জীবনের শেষের দিনগুলি আব্দুল করিম মিরজে কাটিয়ে ছিলেন। জীবনে যে ক’জন শিল্পীর গান শুনে আব্দুল করিম খান প্রভাবিত হয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে গ্বালিয়র ঘরানার হদ্দু খানের ছেলে রহমৎ খান ছিলেন অন্যতম। সে সময় রহমৎ খান কুরুন্দ্বাড়ে গান গেয়ে সাংলির দিকে যাচ্ছিলেন। কুরুন্দ্বাড়েতেই আব্দুল করিম শুনেছিলেন রহমৎ খানের গান। সে দিন রহমৎ খান ভূপালি আর মালকোষ গেয়েছিলেন, যা আব্দুল করিম সারা জীবন ভুলতে পারেননি। আব্দুল করিমের গায়কির উপরে রহমৎ খানের প্রভাব কতটা পড়েছিল, তা রহমৎ খানের মালকোষ রাগে গাওয়া ‘যমুনা কি তীর’ গানটি শুনলে বোঝা যায়।
আব্দুল করিম সম্পর্কে অমিয়নাথ সান্যাল লিখেছিলেন, ‘‘আব্দুল করিম খানের কণ্ঠ এসরাজের মতো তারসপ্তকে পৌঁছে কৃত্রিম ও সুতীক্ষ্ণ রূপ ধারণ করত।’’ তাঁর জীবনের প্রথম দিকে গাওয়া গানগুলি শুনলে বোঝা যায়, তাতে তানের ব্যবহার বেশি। পরবর্তী কালে রেকর্ড করা গানগুলির সঙ্গে এগুলির অনেকটাই পার্থক্য রয়েছে।
তাঁর গাওয়া বেশ কিছু রাগে হিন্দুস্থানি ও কর্ণাটকী সঙ্গীতের অভূতপূর্ব এক মিলন ঘটেছিল। তার মধ্যে ‘সাবেরী’, ‘আনন্দভৈরবী’, ‘খরহরপ্রিয়া’ বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। পরবর্তী কালে তিনি মহীশূর রাজ দরবারের গায়ক হিসেবেও নিযুক্ত ছিলেন এবং ‘সঙ্গীতরত্ন’ সম্মানে ভূষিত হয়েছিলেন।
খেয়াল, ঠুমরি, হোলি বা ভজন... তিনি যা-ই গাইতেন না কেন, তা ছিল গভীর আবেগে আপ্লুত। তাতে কোনও নাটকীয়তা ছিল না। তাঁর গানে প্রভাব ছিল মরাঠি নাট্যগীতি এবং ভাবগীতেরও। খেয়াল গাওয়ার সময়ে তিনি বিস্তারের উপরেই বেশি জোর দিতেন। এড়িয়ে যেতেন লয়কারি বোল-তান। তেমনই তার গায়কির মধ্যে খুঁজে পাওয়া যেত সারেঙ্গির গমক এবং বীণার মীড়। তাঁর পছন্দের রাগের মধ্যে ছিল ললিত, জৌনপুরি, মাড়বা, মালকোষ ইত্যাদি। তাঁর গাওয়া ঠুমরি পূরব-অঙ্গ এবং পঞ্জাব-অঙ্গ ঠুমরির চেয়ে ছিল আলাদা। রাগ ঝিনঝোটিতে ‘পিয়া বিন নাহি আবত’ এবং ভৈরবীতে ‘যুমনা কে তীর’ এই দু’টি গান খুবই জনপ্রিয়তা লাভ করে।
তিনি আরও একটি বিশেষ গুণের অধিকারী ছিলেন। তা হল তিনি অত্যন্ত পারদর্শিতার সঙ্গে পুরনো বাদ্যযন্ত্র মেরামত করতে পারতেন। যেখানেই যেতেন, সঙ্গে রাখতেন ছোট্ট একটি বাক্স। তাতেই থাকত সব যন্ত্রপাতি।
আব্দুল করিম খানের আধ্যাত্মিক জীবন ছিল ঘটনাবহুল। হিন্দু–মুসলমানের ভেদাভেদের ছায়া তাঁর জীবনে কখনও পড়েনি। দত্তাত্রেয় মন্দিরে বসে যেমন ধর্মসঙ্গীত গাইতেন, তেমনই দরগায় বসে আপন মনে তানপুরা মেলে গান করতেন। শিরডির সাঁইবাবা ও নাগপুরের তাজউদ্দিন বাবার প্রভাব পড়েছিল তাঁর গানের উপরেও। এক সময়ে তিনি নাগপুরে রাজা লক্ষ্মণরাও ভোঁসলের বাড়িতে অতিথি হয়ে ছিলেন। সেই সময়ে সেখানেই থাকতেন তাজউদ্দিন বাবা। আব্দুল করিম সে কথা শোনার পর থেকেই তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু দেখা আর কিছুতেই হয় না। এক দিন ভোরে হঠাৎ তিনি দেখলেন তাজউদ্দিন বাবা প্রাতর্ভ্রমণে বেরিয়েছেন। সেই সুযোগে তিনিও পিছু নিলেন। এ ভাবেই তিন-চার মাইল হাঁটার পরে জঙ্গলের মধ্যে এসে তাজউদ্দিন বাবা পিছন ফিরে প্রবল আক্রোশে আব্দুল করিমকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, সারা দুনিয়াকে যে পাগল করে, এ বার কি সে তাঁকেও পাগল করতে চায়? এর পরে আব্দুল করিম মাটিতে বসে পড়ে যোগিয়া রাগে কবীরের একটি ভজন শুরু করেছিলেন। গান শেষ হতেই তাজউদ্দিন বাবা হাসিমুখে আব্দুল করিমকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, সে কী চায়? এর উত্তরে আব্দুল করিম আশীর্বাদ ছাড়া কিছুই চাননি। এর পরে প্রায় এক মাস আব্দুল করিম নাগপুরে ছিলেন এবং তাজউদ্দিন বাবা মাঝেমধ্যেই তাঁকে ডেকে পাঠিয়ে গান শুনতেন। তার মধ্যে একটি গান তিনি বার বার শুনতে চাইতেন, ‘হরিকে ভেদ না পায়ো রামা’।
তেমনই বালকৃষ্ণ বুয়া কপিলেশ্বরীর বইতে একটি ঘটনার উল্লেখ রয়েছে। তারাবাঈ সন্তান-সহ তাঁকে ছেড়ে চলে যাওয়ার পরে আব্দুল করিম অত্যন্ত মর্মাহত হয়েছিলেন। এক দিন কষ্টের হাত থেকে মুক্তি পেতে তিনি হাত থেকে একটি হিরের আংটি খুলে সেটিকে গিলে ফেলেছিলেন। পরদিন সকালে উঠে দেখলেন তিনি সম্পূর্ণ সুস্থই রয়েছেন। হঠাৎ তাঁর মনে পড়ল, আগের দিন রাতে স্বপ্নে তিনি বজীরবাবাকে দেখেছেন। কিছু ক্ষণ পরে অন্য এক ব্যক্তি যার নামও আব্দুল করিম (তিনি সেতার তৈরি করতেন) তিনিও এসে জানালেন, রাতে তিনিও বজীরবাবাকে স্বপ্নে দেখেছেন। এর পরে দু’জনেই ঠিক করেছিলেন কোলহাপুরে বাবার কাছে যাবেন। বাবার ঘরে প্রবেশ করা মাত্রই তিনি সরোষে গালি দিয়ে আব্দুল করিমকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, খোদার দেওয়া জীবন শেষ করার সাহস তাঁর হল কী করে? এর পরে বাবা আরও বলেছিলেন যে, আব্দুল করিমকে আরও কিছু বছর জীবিত থাকতে হবে। আর তাঁর জীবনের শেষ হবে ঠিক সে ভাবেই, যেমন তিনি চেয়েছেন। কোনও কষ্ট না পেয়ে, কাউকে কোনও কষ্ট না দিয়ে।
আব্দুল করিম খানের গলা নষ্ট করে দেওয়ার জন্য তাঁকে দু’বার বিষ খাওয়ানো হয়েছিল। তবু দৈব কৃপায় তাঁর কণ্ঠ কখনও নষ্ট হয়নি। প্রথম বার ১৮৯৬ সালে বরোদায় এক অনুষ্ঠানের পরে। দ্বিতীয় বার ১৯০৮ সালের শেষের দিকে বাগলকোট শহরে তাঁর কোনও শত্রু খাবারে বিষ দিয়েছিল। এর ফলে প্রায় ছ’মাস তাঁর গান বন্ধ ছিল। তার পরে গ্রামের কাছে পাহাড়ের উপরে এক সাধুর সমাধি দর্শন করতে গিয়েছিলেন আব্দুল করিম। সেখানেই এক মেষপালকের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়। সেই মেষপালক ওই ঘটনার কথা শুনে তাঁকে কিছু গাছের শিকড় খেতে দেন। যা খাওয়ার পরে আব্দুল করিম কয়েক বার বমি করেন এবং পুনরায় নিজের কণ্ঠ ফিরে পান।
আব্দুল করিমের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে তাঁর পোষা কুকুর টিপু মিঞার কাহিনি। শিষ্যদের সঙ্গে রেওয়াজ করার সময়ে তাকে বেঁধে রাখলে সে বিকট চিৎকার করতে থাকত। তবে বাঁধন খুলে দিলেই সামনে এসে উবু হয়ে বসে উ-উ করে তাঁর ছাত্রদের গলার আওয়াজ নকল করত। অমনটা দেখে আব্দুল করিম ঠিক করেন, কুকুরটিকেও গান শেখাবেন। এতে তাঁর আত্মীয়, বন্ধু সকলেই বেশ বিরক্ত হয়েছিল। তবু আব্দুল করিম সে সব কিছু তোয়াক্কাই করেননি।
তিনি যখন রেওয়াজ করতেন, পোষা কুকুরটিও অদ্ভুত ভাবে সুর মেলাত। এ ভাবেই বেশ কিছু দিন রেওয়াজ চলার পরে আব্দুল করিম বিজ্ঞাপন দিয়েই তাঁর ও টিপু মিঞার এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন। মখমলের জামা আর গলায় মুক্তোর মালা পরে মঞ্চে এসে আব্দুল করিমের সঙ্গে সুর মেলানোয় রাতারাতি টিপু মিঞার নাম ছড়িয়ে পড়েছিল। এর পরে টিপু মি়ঞাকে নিয়ে তিনি আরও দু’টি অনুষ্ঠান করেন। একটি মুম্বইয়ে, অন্যটি পুণেতে। মুম্বইয়ের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন অ্যানি বেসান্ত, সরোজিনী নাইডু প্রমুখ।
১৯০৪-০৫ নাগাদ লন্ডন থেকে এ দেশে আগত গ্রামোফোন কোম্পানির প্রতিনিধিরা তাঁর বেশ কিছু গান রেকর্ড করে, যা এক পিঠে বাজা রেকর্ডে প্রকাশিত হয়েছিল। এগুলির মধ্যে ছিল মুলতানি, বসন্ত, মল্লার, ভীমপলশ্রী, ললিত, হিন্দোল ইত্যাদি। পরে ১৯৩৫ সালে রুবি রেকর্ড কোম্পানি এবং ১৯৩৬ সালে ওডিয়ন কোম্পানি তাঁর বেশ কিছু গান রেকর্ড করে। তাঁর সমকালীন বহু শিল্পীই স্মৃতির অতলে হারিয়ে গেলেও আব্দুল করিম খানের গানের জনপ্রিয়তা কখনও কমেনি। গ্রামোফোন রেকর্ডের যুগ শেষ হওয়ার পরেও চাহিদা থাকায় তাঁর গান লং প্লেয়িং রেকর্ডে, ক্যাসেটে, সিডিতে প্রকাশিত হয়েছে।
১৯৩৭ সালে আব্দুল করিম খান চেন্নাইয়ের একটি সঙ্গীত সম্মেলনে গান গাইতে গিয়েছিলেন। এরই মধ্যে তিনি দিলীপকুমার রায়ের কথায় পুদুচেরিতে গিয়ে শ্রীঅরবিন্দকে গান শোনানোর কথায় রাজিও হয়েছিলেন। সে জন্য চেন্নাই থেকে ট্রেনেও উঠেছিলেন। কিন্তু ২৭ অক্টোবর রাতে ট্রেনের মধ্যেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। শুরু হয় শ্বাসকষ্ট। ক্রমেই তিনি দুর্বল বোধ করতে থাকেন। এই সময়ে তাঁর এক বন্ধুকে তিনি বলেন পরের স্টেশনে নেমে পড়তে। তাঁর কথা মতোই সিঙ্গপেরুমল কোইল নামে একটি ছোট স্টেশনে তাঁরা সকলেই নেমে পড়েছিলেন। প্ল্যাটফর্মেই তাঁর জন্য বিছানা পেতে দেওয়া হয়। আব্দুল করিম কাবার দিকে মুখ করে নমাজ পড়লেন। এর পরে সেই নিঝুম রাতে তানপুরাটি নিয়ে দরবারি কানাড়া ধরেছিলেন। গান শেষে তিনি ঘুমিয়ে পড়েন। এ ভাবেই জীবনের শেষ নিদ্রায় প্রবেশ করেছিলেন আব্দুল করিম।
তাঁর মৃত্যুসংবাদ যখন বরোদায় পৌঁছেছিল, ফৈয়াজ খান চেঁচিয়ে উঠে বলেছিলেন, ‘‘হায় আল্লা! আজসে সুর মর গিয়া হিন্দুস্থান মে!’’
ঋণ: কুদ্রত্ রঙ্গিবিরঙ্গী: কুমারপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, আনন্দ
কিরানা ঘরানার সুরসম্রাট: বসন্তগোবিন্দ পোদ্দার: দেশ বিনোদন ১৩৮৭
সঙ্গীতরত্ন উস্তাদ আব্দুল করিম খান: আ বায়ো-ডিস্কোগ্রাফি, মাইকেল কিনিয়ার
সাম হিন্দুস্থানি মিউজিশিয়ানস-দে লেট দ্য ওয়ে: অশোক দা রানাডে
দ্য মেকার্স অব মডার্ন মেলোডি: আব্দুল করিম খান: মোহন ডি নাদকর্ণী
https://www.anandabazar.com/supplementary/patrika/article-on-ustad-abdul-karim-khan-1.845863?ref=patrika-new-stry
No comments:
Post a Comment