(১)
মাঝবয়সি এক বাঙালি ঘুরছেন ফ্রান্সের রাস্তায়। সিন নদীর পাড়ে পুরনো দোকানে প্রাণ ভরে গন্ধ নিচ্ছেন উইপোকায় খাওয়া বইয়ের। দেখছেন ফরাসিদের। আর তাদের দেশে আসা ধরাধামের লাখো মানুষকে। সেই প্রতিটি মানুষের দিকেই হয়তো ‘অনন্তযৌবনা প্যারিস পাতলা ফরাসি সিল্কের আধাঘোমটার ভিতর দিয়ে চোখ ইসারা করে।’— ‘ইসারা’য় ধরা দেন কেউ কেউ।
ধরা হয়তো দিতে চাইলেন ওই বাঙালি ভদ্রলোকটিও। এ ইশারার বার্তা এসেছে ফরাসি তন্বীরূপে নয়, বরং এক হিটলারি জার্মানি থেকে বিতাড়িত (সম্ভবত ইহুদি বলে) এক মহিলার চোখে। যাঁকে ওই বাঙালি দেখাতে চান তাঁর দেশ, মহা-ভারত। বাঙালিটি সতীনাথ ভাদুড়ী। মহিলাটি হোটেলের পরিচারিকা। নাম অ্যানি। অ্যানি এমন এক জন, যাঁর কথা ‘একসঙ্গে বেশিক্ষণ ভাবতে’ পারা যায়। ভাবনার সূত্রেই জড়িয়ে পড়ে ‘অবিচ্ছেদ্য’ সতীনাথ-কথাও।
কিন্তু দেশ দেখানো হল কই? সতীনাথ জানলেন, অ্যানির স্বামী-পুত্র নিয়ে ভরা সংসার। তবুও... নোটবইয়ের পাতায় অন্য অ্যানি বেঁচে থাকেন। পাতা ওল্টালে ভেসে আসে অ্যানির হাতের লেখা ঘরকন্নার গন্ধ। আর সতীনাথ প্রশ্ন করেন নিজেকেই, ‘মানুষ অতৃপ্ত— কী যেন খুঁজছে সারা জীবন— কী সেই জিনিস?’
(২)
এই ‘অতৃপ্তি’ কেন, তার খোঁজ সতীনাথ শুরু করলেন সেই ছেলেবেলা থেকেই।
সতীনাথের জন্ম বাংলা তারিখ ১১ আশ্বিন, ১৩১৩, বৃহস্পতিবারে। বিজয়া দশমী, মায়ের বিদায়ের দিন সন্ধেয়। চার দিকে উৎসব শেষের বিষণ্ণতা। তার মধ্যেই কোশী নদীর পাড়ে পূর্ণিয়ার ‘সবুজকুন্তলা’ ভাট্টাবাজারে ইন্দুভূষণ ভাদুড়ী ও রাজবালাদেবীর ঘরে এলেন ষষ্ঠ সন্তান সতীনাথ। হয়তো বা অদূরে বেলাশেষের গান গাইল গাছগাছালিতে ঘরে ফেরা পাখির দল। ঘটনাচক্রে সতীনাথের ‘জাগরী’ উপন্যাসের বিলুরও জন্ম ওই দশমীর দিনেই।
মায়ের আঁচলের খুঁট ধরে ঘোরাঘুরি। বড় হচ্ছেন সতীনাথ। বাবা ইন্দুভূষণ পূর্ণিয়া আদালতের ডাকসাইটে দেওয়ানি উকিল। তাঁর থেকে কেমন যেন দূরে দূরে থাকেন সতীনাথ।
বেশ চলছিল। আচমকা পড়়াশোনার পাট চলে এল। ভর্তি হলেন ভাট্টাবাজার লাগোয়া প্রাথমিক স্কুলে। সেখানে অবশ্য উপচে পড়া স্নেহ মিলল শিক্ষক দেবেন্দ্রনাথ মণ্ডলের কাছে। পরে বৃত্তি নিয়ে ভর্তি হলেন সদর হাসপাতালের কাছে পূর্ণিয়া জেলা স্কুলে। শিক্ষক-ভাগ্য ভালই। প্রধান শিক্ষক প্যারীমোহন মুখোপাধ্যায় আর সংস্কৃত পণ্ডিত তুরন্তলাল ঝা বেশ পছন্দ করেন এই ঝকঝকে ছেলেটিকে। পণ্ডিতজি তো নামই দিয়ে ফেললেন ‘ক্লাস কী রোশনি’। ক্লাসে সতীনাথ না এলে সহপাঠীরা মজা করে বলে, ‘ক্লাস আঁধিয়ালা হো গয়া’। আসলে ‘রোশনি’ই বটে। প্রতি শ্রেণিতেই যে প্রথম হন ওই সতীনাথ!
কিন্তু আর পাঁচটা ছেলের মতো দামাল নয় ছাত্র সতীনাথ। সঙ্গী গুটিকয় বন্ধু। খেলাধুলোয় তেমন আগ্রহ নেই। কিন্তু স্কুল চত্বরেই অমন ছাতার মতো গুগগুল, পাইন, বট, অশ্বত্থের ভিড় কেমন যেন দিকশূন্যপুরের ডাক শোনায় সতীনাথকে। সেই ডাক শুনতে শুনতেই মাঝেসাঝে উঁকি দেন অদূরের প্ল্যান্টার্স ক্লাবে। এই ক্লাবই ‘আন্টা বাংলা’, ‘জাগরী’তে ফিরে আসবে নিজস্ব রূপ-রং নিয়ে।
স্কুলজীবন এটুকুই।
আসলে দিকশূন্যপুরের ডাক শোনা হোক বা ক্লাবে উঁকি, এর মধ্য দিয়ে সতীনাথ চাইছিলেন অজানাকে দেখতে। সেই কৌতূহল থেকেই হয়তো একদিন একটু সিদ্ধি চেখে দেখা! তার পরেই কয়েক দিন ঘরবন্ধ, অসুস্থ হয়ে পড়া।
(৩)
কিন্তু সিদ্ধি-পর্ব স্কুলজীবনের ওই কৌতূহলে মোটেই দাঁড়ি টানল না। বরং আইএসসি পড়তে মাখানিয়াকুঁয়ার বাঙালি মেসে ঠাঁই নেওয়া সতীনাথের কৌতূহল বেড়েই চলে। আর তাই পটনা সায়েন্স কলেজে বিজ্ঞান প়ড়েন বটে। কিন্তু নিয়মের বাঁধা জাল অপেক্ষা রং-তুলিতেই যেন প্রাণ খুঁজে পান সতীনাথ।
পূর্ণিয়া আদালত চত্বর
এর পরে পটনা কলেজ, অর্থনীতিতে বিএ। মেসজীবনও শেষ। বাক্স-প্যাঁটরা উঠল পটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহমেডান হস্টেলে। আশ্চর্য সমাপতন। সতীনাথ যে ঘরে উঠলেন, তার ঠিক পাশের ঘরেই এক সময় ছিলেন আরও এক জন, অন্নদাশঙ্কর রায়। যাঁর ঘরের বাইরে আবার লেখা, ‘ডোন্ট কোয়ার্ল উইথ ফ্যাক্টস’। বিএ-র পরে এমএ, স্বাভাবিক নিয়মেই। আর এই সময়েই ব্যক্তি-জীবনের প্রথম ‘নির্জনতা’র সঙ্গে পরিচিত হওয়া সতীনাথের।
এক সপ্তাহের ব্যবধান। মা রাজবালাদেবী ও বড় বোন করুণাময়ী মারা গেলেন। মাতৃহারা সতীনাথ যেন খানিক আলুথালু। মন চায়, সুদূর দক্ষিণ আমেরিকা পাড়ি দিতে। কিন্তু মায়েরা এত সহজে সতীনাথের জীবন থেকে বিদায় নেননি। পূর্ণিয়ার দাক্ষায়ণী দেবী, কুসুমকুমারী দেবীরা স্নেহ দিলেন। সতীনাথও এঁদের কথাই বুনছেন ‘অচিন রাগিণী’ বা ‘জাগরী’তে। এমএ-র পরে আইন পড়া, পৈতৃক পেশায় যোগ দিতে।
ওকালতির কাজে বাবার মুখরক্ষা করলেন সতীনাথ। সাত বছরের জন্য সহকারী হিসেবে নাড়া বাঁধলেন আইনজীবী বিশ্বনাথ মুখোপাধ্যায়ের কাছে। ‘মোতির দানা’র মতো অক্ষরে ইংরেজি, বাংলা বা কৈথিতে সতীনাথের লেখা সম্ভ্রম তৈরি করল। কোর্ট চত্বরে ফিসফাস, ‘এ তো আর একটা ইন্দুবাবু তৈরি হয়ে গেছে’!
কিন্ত বাবার সঙ্গে দূরত্ব বোধহয় কমল না। আর তাই বার-লাইব্রেরিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটালেও সকলে অবাক চেয়ে দেখে, ইন্দুবাবু আদালতে আসেন জুড়িগাড়ি চড়ে। আর তাঁরই ছেলে সাইকেলে, মানুষের সঙ্গে আলাপ করতে করতে।
এই সাত বছরে সতীনাথের রুটিন সকালে আইনের বই পড়া, দাদামশাই কেদারনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতে আড্ডা, দুপুরের খাওয়া শেষে খানিক বিশ্রাম। তার পরে বিকেলে হাঁটাহাটি, রাত ৯টা পর্যন্ত স্টেশন ক্লাবে টেনিস খেলা আর রাতে নিজের লেখালেখি।
লেখালেখি। এই সূত্রেই আর বোধহয় ভাল লাগে না ‘উকিলের কারবার’। কারণ তা যে মন নিয়ে নয়। ‘নবশক্তি’তে স্যাটায়ারধর্মী লেখায় হাত পাকালেন সতীনাথ। ‘পূর্ণিয়া দর্পণ’-এ লিখলেন কিছু চুটকি। খানিক বাদে ‘বিচিত্রা’য় প্রথম গল্প প্রকাশ পেল, ‘জামাইবাবু’।
কিন্তু শুধু মাত্র লেখালেখিতে বাঁধা পড়ার সময় তখনও আসেনি। অন্য কিছুর খোঁজ শুরু করে দিয়েছেন তত দিনে সতীনাথ।
(৪)
সেই অন্য কিছুর খোঁজেই শুরু হয়ে গিয়েছে ‘অন্য’ জীবনের প্রস্তুতি পর্ব। তাই দিনভর আদালতের কাজ সেরে রাতে লণ্ঠন হাতে সতীনাথ ঘুরে বেড়ান বই সংগ্রহের জন্য। আর সকলের সঙ্গে মিশে তৈরি করলেন পূর্ণিয়া পাবলিক লাইব্রেরি। পরে যার নাম ইন্দুভূষণ লাইব্রেরি। পূর্ণিয়ায় মহিলা সমিতি সংগঠন ও মন্দির তৈরি, পশুবলির বিরুদ্ধে জনমত সংগঠন— সব ভূমিকাতেই দেখা যেতে লাগল সতীনাথকে।
সবই হচ্ছে। কিন্তু ওই একলাপনার অভ্যেস যেন গা ছাড়া হয় না! আর তাই রাতে কাজ সেরে ব্যঙ্গ করেন নিজেকেই, ‘বাড়ি এসে নিজেরই হাসি আসে এসব তুচ্ছ ব্যাপারে মাথা ঘামানোর জন্য’।
আসলে সময়টাই ‘মাথা ঘামানোর’। মহাত্মা গাঁধী যে তত দিনে প্রান্তিক মানুষের ‘গানহী বাওয়া’ হয়ে উঠেছেন। ডাক দিয়েছেন অধীনতা থেকে মুক্তির।
গতানুগতিক জীবন আর পোষাল না। তেত্রিশ বছর বয়সে বাড়ি ছাড়লেন সতীনাথ। যোগ দিলেন পূর্ণিয়া থেকে প্রায় ২৫ মাইল দূরে কংগ্রেস নেতা বিদ্যানাথ চৌধুরীর টিকাপট্টি আশ্রমে। গায়ে উঠল খাদির ধুতি, চাদর, পাঞ্জাবি। শীতে গলাবন্ধ কোট, পায়ে চপ্পল। স্বাধীনতার খোঁজে সতীনাথ ছুটলেন গ্রাম থেকে গ্রামে। ‘অখ্যাত, অজ্ঞাত, অবজ্ঞাত গ্রামের লোক’দের গানহী বাওয়ার কথা বোঝাতে এবং ওই ‘বন্ধু’দের বুঝতে।
বাবা ইন্দুভূষণ সবই হয়তো দেখছিলেন, দূরে দাঁড়িয়েই। কিন্তু আর পারলেন না। প্রিয় সতু যাতে বাড়ি ফেরে, তার জন্য ছেলে ভূতনাথকে কলকাতায় টেলিগ্রাম করলেন বাবা।
সতুর দুই বন্ধু দ্বারিক সুর ও কমলদেও নারায়ণ সিংহের সঙ্গে দাদা ভূতনাথ গেলেন ভাইকে ফেরত আনতে। কিন্তু ভূতনাথের নিজেরই কথায়, ‘সে আমাকে ফিরিয়ে দিল’। ভূতনাথ দেখলেন, ভাইয়ের ফেরার পথ আপাতত বন্ধ। বিস্মিত হলেও স্বাগত জানালেন দাদামশাই। বুঝলেন, ‘সাধারণে যা করে তাতে মন সায় দেয় না’ যে ও ছেলের! মন সায় দেয় না আদর্শকে ফেলে আসতে। আর তাই আশ্রমিক পর্বে বাড়ি এলে সঙ্গী হয় দাঁতোয়ান। টুথপেস্ট-ব্রাশ... ও সব বিলিতি অভ্যেস যে! পাতে পড়ে দই, কাঁচকলা সিদ্ধ, আলু সিদ্ধ। আর বিলাসিতা এক চামচ মাখন!
কিন্তু শুধু কংগ্রেস স্কুলের মাস্টার হিসেবে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেবেন সতীনাথ, এমনটা হওয়ার নয়।
(৫)
সেটা হওয়ার নয় বলেই আশ্রমের চৌহদ্দি ডিঙিয়ে সতীনাথ দাঁড়ালেন খেটে খাওয়া ভারতবর্ষের সন্তান-সন্ততিদের দু’চোখের সামনে। কাজ করলেন তাৎমা, ধাঙ়ড় সম্প্রদায়ের মধ্যে। তাঁদের গলায় দিলেন মহা-ভারতের স্লোগান— ‘সরকার জুলুমকার। আংরেজ জুলুমকার।’ পিকেটিং করলেন ভাট্টাবাজারের বিলিতি মদের দোকানের সামনে। পুলিশ এল, মারমুখী পেয়াদা দেখে অনেকেই চম্পট দিলেন। কিন্তু ঠায় দাঁড়িয়ে রইলেন সতীনাথ।
কংগ্রেসকর্মী, নেতা থেকে জেলা সেক্রেটারি, বাগ্মী, তিন বার জেল খাটা (মতান্তরে চার বার), জেল ভাঙার চেষ্টা— অস্থির সময়ে নেতৃত্ব দেওয়ার যাবতীয় ‘গুণ’ সতীনাথের রাজনৈতিক ঝুলি কানায় কানায় পূর্ণ করে তুলল। সেই পূর্ণতার জন্যই ‘জল কাদা ভেঙে বিনা টর্চের আলোয় ১৫-২০ মাইল’ হাঁটা আদালত চত্বরের ছোটবাবু সতীনাথ হয়ে উঠলেন ‘ভাদুড়ীজি’।
’৪২-এর অগস্ট আন্দোলন। ফের সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়ার সময়। ইংরেজ সরকার ঘিরে ফেলল টিকাপট্টি আশ্রম। শুরু হল গণ অভ্যুত্থান। হরতাল, মিছিল, কিষাণগঞ্জ আদালতে রানির দেশের পতাকা টেনে নামানো, রেললাইন উড়িয়ে দেওয়া— সব হল। ‘জাগরী’র বিলু বা সতীনাথও শরিক হলেন ‘জনশক্তির প্রকৃত স্বরূপ’-এর সঙ্গে। আর তাই ‘জাগরী’ উৎসর্গীকৃত ‘যে সকল অখ্যাতনামা রাজনৈতিক কর্ম্মীর কর্ম্মনিষ্ঠা ও স্বার্থত্যাগের বিবরণ, জাতীয় ইতিহাসে কোনোদিনই লিখিত হইবে না, তাঁহাদের স্মৃতির উদ্দেশে—’
কিন্তু শুধু ‘অখ্যাতনামা’ নন, খ্যাতিমান অনেকের সঙ্গেই পূর্ণিয়া ও ভাগলপুর জেল বা রাজনৈতিক জীবন একসঙ্গে কাটল সতীনাথের। সেই তালিকায় ভিড় জমান জয়প্রকাশ নারায়ণ, বিহারের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী শ্রীকৃষ্ণ সিংহ-সহ একঝাঁক প্রথম সারির দেশনেতা। জেলের মধ্যেই দিনভর আলাপ চলতে থাকে দেশ-সমাজ-আন্দোলনের রূপরেখা নিয়ে।
সতীনাথের অবশ্য ও সব রূপরেখায় তেমন মন নেই। আর তাই জেলজীবনের কোনও পর্বে তাঁকে দেখা যায় লৌহকপাটের ফাঁক দিয়ে আসা সূর্যরেখায় তুলসীদাসের ‘রামায়ণ’ পড়তে। রপ্ত করতে উর্দু-ফারসি ভাষা। কখনও বা জেলের ‘টি’ সেলে স্বেচ্ছানির্বাসন নিয়ে দেখা যায়, খসখস করে ‘বেশ মোটা মোটা গাঢ় সবুজ রংয়ের দু’খানা খাতা’য় কী যেন লিখে চলেন সতীনাথ। ওই লেখাটিই ‘জাগরী’!
মাঝেসাঝে এই মানুষটিই সহ-আবাসিকদের পাউরুটি টোস্ট, ডিমের পুডিং বা ‘মোতঞ্জন’ (এক ধরনের পোলাও) রান্না করে চমকে দেন। আর ভলিবল খেলেন। ভলিবলে এক দলের ক্যাপ্টেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী কৃষ্ণবল্লভ সহায় (কেবি), অন্য দলের রণেন রায়চৌধুরী। সতীনাথ কেবি-র দলে। সতীনাথ খারাপ খেললেন। কেবি বললেন, ‘এ সাহব! কল সে আপ হমারে তরফ সে মত খেলিয়েগা। সমঝে?’ এর পরের দিনেই বদলে গেল খেলা। নেতার আর্জি, ‘হমারে সাইড সে খেলিয়ে কৃপা কর’।
ভাগলপুর সেন্ট্রাল জেলেই একটি ঘটনা সতীনাথের চরিত্রকে আরও সামনে আনে। সাক্ষী তাঁরই় ‘শিষ্য’, হিন্দি সাহিত্যিক ফণীশ্বরনাথ রেণু। ঘটনাটি—
‘লাহোর কংগ্রেস’-এর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ২৬ জানুয়ারি ‘পূর্ণ-স্বরাজ’ দিবস পালন করতেই হবে। এক সপ্তাহ আগে থেকে শুরু হল ব্রিটিশ জেল কর্তৃপক্ষের তানাশাহি। জাতীয় পতাকা, পোস্টারের জন্য রাখা লাল রং, সবুজ কাগজের খোঁজে ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে শুরু হল ব্যাপক তল্লাশি।
২৫ জানুয়ারি। জেল কর্তৃপক্ষ জানিয়ে দিলেন, ‘হল্লা’ হলেই চলবে লাঠি। সেই সঙ্গে ২৬ জানুয়ারি ওয়ার্ডের কপাট দিনভর বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। এ বার রাজবন্দিরা দু’ভাগ। এক দল বললেন, এই পরিস্থিতিতে কী ভাবে ‘পূর্ণ স্বরাজ’ দিবস পালন সম্ভব! অন্য দল অনড়। সতীনাথের সমর্থন দ্বিতীয় দলেই।
২৬ জানুয়ারি। সকাল থেকেই নিজের লেখায় মগ্ন সতীনাথ। ওয়ার্ডের দরজা বন্ধ। বাইরে রক্ষীদের জুতোর মচমচ। সতীনাথের ওয়ার্ডের কয়েক জন আচমকা স্লোগান দিলেন। শুরু হল ‘বন্দেমাতরম’ গাওয়া। গাঁধীবাদীরা বসে পড়লেন চরকা কাটতে। ‘হল্লা’র খবর পৌঁছল জেলকর্তাদের কাছে। ব্রিটিশ অফিসার চিৎকার করে ‘বেয়াদপি বন্ধের অর্ডার’ দিলেন। উঠে দাঁড়ালেন সতীনাথ।
শিষ্য ফণীশ্বরনাথ থমকে গেলেন। ক’দিন আগের লাঠিচার্জের ফলে ভাদুড়ীজির ঘাড়ের কাছে কালশিটেটা যে এখনও মেলায়নি। ফের যদি... সতীনাথ তত ক্ষণে দ্বিতীয় দলের এক্কেবারে গোড়ায় এসে আওয়াজ তুললেন ‘বন্দেমাতরম!’
সশস্ত্র ও নিরস্ত্র আন্দোলনে দেশ স্বাধীন হল ’৪৭-এ। একদিন দেখা গেল, ডক্টর রাজেন্দ্রপ্রসাদ এবং সস্ত্রীক আচার্য কৃপালনী সতীনাথের বাড়িতে এসে আতিথ্য গ্রহণ করলেন। খবর রটল, কংগ্রেস কোনও গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী করছে সতীনাথকে। কিন্তু সতীনাথ অন্য রকম।
(৬)
সতীনাথ অন্য রকম বলেই দেখা গেল, ১৯৪৮-এ দুম করে পূর্ণিয়া কংগ্রেসের সেক্রেটারির পদ ত্যাগ করলেন। স্পষ্ট বললেন, ‘কংগ্রেসের কাজ ছিল স্বাধীনতা লাভ করা, সে কাজ হাসিল হয়ে গেছে, রাজকাজ ছাড়া কোনো কাজ নেই আর।’ সেই ‘কাজ’ থেকে স্বাভাবিক ভাবেই দূরত্ব বজায় রাখলেন নির্জনতায় অভ্যস্ত সতীনাথ।
কিন্তু রাজনীতির মধ্য দিয়ে যাঁর মহা-ভারতকে চেনা, তাঁর পক্ষে বেশি দিন দূরে থাকাটাও সম্ভব হল না। আর তত দিনে মাথার মধ্যে গিজগিজ করছে কার্ল মার্ক্স থেকে মানবেন্দ্রনাথ রায়ের লেখা। বারবার ডাক আসে সোশ্যালিস্ট পার্টিতে যোগ দেওয়ার। তাতে বিশেষ লাভ হওয়ার নয়। শেষমেশ আর কারও ডাকে নয়, বরং নিজেই একদিন পার্টি অফিসে গিয়ে সোশ্যালিস্ট দলে নাম লেখালেন সতীনাথ। তাঁর সদস্যপদে প্রস্তাবক হিসেবে সই থাকল রেণুর। এ বার কলের মজুরদের জীবন নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি শুরু হল। হয়তো এই ঘাঁটাঘাঁটিই রূপ পেল ‘চিত্রগুপ্তের ফাইল’-এ। কিন্তু সোশ্যালিস্ট পার্টিতেও বেশি দিন মন টিকল না। কারণ তত দিনে সে দলে ভিড় দুর্নীতিগ্রস্ত ‘জমিদারনন্দনদের’।
এক নির্জন রাজনীতিকের দলীয় রাজনীতির খোঁজ এখানেই শেষ হল। আসলে ‘সহজ লোকের মতো কে চলিতে পারে’, রূঢ় বাস্তবের এই সংশয়ই নির্জন করে সতীনাথকে। কারণ তত দিনে রাজনৈতিক নেতাদের দলাদলি, ১৯৩৪-এ বিহার ভূমিকম্পের সময়ে এক শ্রেণির নেতার আখের গোছানোর চেষ্টা দলীয় রাজনীতি সম্পর্কে হয়তো প্রশ্ন তৈরি করেছে সতীনাথের মনে। তাই পরাজিত ‘ঢোঁড়াই’ যখন ‘সলন্ডর’ করে মহকুমাশাসকের অফিসে, তখন মনে হয়, এ আসলে অভিমানী সতীনাথেরই রাজনীতিকে বিদায় সম্ভাষণ।
আর তাই ‘লোকনায়ক’, ‘জনজাগৃতি’র মতো কথাগুলি শুনলে হাই ওঠে সতীনাথের!
(৭)
হাই ওঠারই কথা। কারণ রাজনীতি যে জন্য, সেই মহা-ভারতের পথ তত দিনে চেনা হয়ে গিয়েছে সতীনাথের। শুধু রাজনীতি নয়, তাঁর ‘অতৃপ্তি’ অধ্যাত্মবাদ নিয়েও। কিন্তু এই মানুষটিকেই আবার পাড়ি দিতে দেখা যাবে বৃন্দাবনে। তা অধ্যাত্মবাদের জন্য নয়, ‘দিগ্ভ্রান্ত’ লিখতে। আসলে অধ্যাত্মবাদের কাছে সমর্পণ তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি। তাই বউদি রেণুকাদেবীকে স্পষ্ট ভাবে বললেন, ‘কিছু মানতে পারলে হয়তো ভাল হত, তবু পারছি না যে মানতে।’
আর তাই এ বার পাড়ি দেওয়া প্যারিস, লন্ডন, জার্মানি... সে সব দেশের সাহিত্য, সংস্কৃতি, মানুষদের কাছ থেকে দেখা, তা-ও হল। দেখলেন ভ্যাটিকানের উৎসবে ‘সাদা, কালো, হলদে সব জাত’ এক হয়ে যাওয়ার আখ্যান। কিন্তু দেখা হল না, যা চেয়েছিলেন দেখতে। সেই সোভিয়েত রাশিয়া! পর্যটন জটিলতায় সে দেশে যাওয়া আটকে গেল। তবে পাঠক এই ভ্রমণপর্বের কানায় কানায় পূর্ণ বিবরণ পেলেন ‘সত্যি ভ্রমণকাহিনী’তে। এই লেখা প্রকাশের আগে ‘দেশ’ পত্রিকা বিজ্ঞাপন দিল, ‘ইহা ভ্রমণকাহিনী না উপন্যাস রসিক পাঠকেরাই বিচার করিবেন।’
কিন্তু লেখালেখির জগতেও সহজে প্রতিষ্ঠা হয়নি। সতীনাথের প্রথম উপন্যাস ‘জাগরী’র পাণ্ডুলিপি সজনীকান্ত দাস ফেলে রাখলেন পাঁচ-ছ’মাস। শেষমেশ সমবায় পাবলিশার্স তা প্রকাশ করে। প্রকাশ হতেই তাকে স্বাগত জানাল ‘দেশ’ ও ‘পরিচয়’ পত্রিকা। স্বাগত জানালেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘বইখানি পড়ে চমকে গেলাম। একেবারে নূতন কথা, নূতন সুর, নূতন সব মানুষের ভিড়, একেবারে সম্পূর্ণ নূতন মনোভাব।’
বিহার সাহিত্য ভবন থেকে এর হিন্দি অনুবাদ বেরোল। ভূমিকা লিখলেন সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়। পরে এর ইংরেজি অনুবাদ করবেন লীলা রায়। ইউনেস্কোর প্রযোজনায় যা এশিয়া পাবলিশিং হাউস থেকে ছাপা হবে ‘ভিজিল’ নামে। গল্প, ‘দেশ’ পত্রিকায় ‘ঢোঁড়াই চরিত মানস’ প্রকাশ... সতীনাথ লিখে চললেন। বাস্তবের ঢোঁড়়াই কিন্তু আসলে দুর্নীতিপরায়ণ। অথচ তাঁকেই ‘সারা দেশের সাধারণ লোকের’ প্রতিনিধি করে তুললেন সতীনাথ।
এ সব সাহিত্যসৃষ্টি আনল স্বীকৃতিও। কিন্তু সতীনাথ সে স্বীকৃতিতে থিতু হওয়ার লোক নন। ‘লেখকের লেখক’টি তখন প্যারিসে। দাদা ভূতনাথ টেলিগ্রামে খবর দিলেন, ‘রবীন্দ্র পুরস্কার’ প্রাপ্তি ঘটেছে। সতীনাথ খবরটা জানালেন প্রিয় অ্যানিকে। পুরস্কারের চেেয়ও বোধহয় বড় পুরস্কার এ বার মিলল। অ্যানি ‘ওলালা’ বলে উচ্ছল হয়ে ওঠেন। এই-ই ভাল লাগে সতীনাথের। কিন্তু অ্যানি অন্য রূপে নয়, বরং ধরা দিয়েছেন মাতৃরূপে। পুত্রহারা অ্যানির শোকজর্জর, কালো জালে ঢাকা মুখটিই বেশি মনে পড়ে...
বিভুঁইয়েও তাই অতৃপ্তি পিছু ছাড়েনি সতীনাথের।
(৮)
সেই অতৃপ্তি বুকে করেই সতীনাথ ফিরলেন প্রিয় পূর্ণিয়ায়। সঙ্গী পরিচারক বাবাজি আর ‘খাঁকি খাঁকি রং, পোড়া কালোমুখ, খাড়া কান, গুটনো লেজ’ওয়ালা কুকুর। নাম তার ‘পাহারা’। মাঝেসাঝে যান কলকাতায় নবকৃষ্ণ স্ট্রিটে দাদার বাড়িতে। মগ্ন থাকেন দেশ-বিদেশের বইয়ে। আর পূর্ণিয়ার সতীনাথকে দেখা যায় বাড়ির বাগানে খালি পায়ে ঘুরে বেড়াতে। ‘অচিন রাগিণী’র ‘বৃষ্টির পর মাটির গন্ধ বদলে’ যাওয়ার গল্প হয়তো তাই সতীনাথের নিজেরই পাওয়া। আসলে এই ‘অতৃপ্ত’ জীবনে খানিকটা হলেও বোধহয় তৃপ্তি এনেছিল প্রকৃতি।
তাই লেখা-রাজনীতি ছাড়া আর যে বিষয়ে বিশেষ যত্ন দেখা গেল সতীনাথের, তা হল ওই বাগান করায়। কেমন ধারার তা?
এক রাত্তিরে বাড়িতে এসেছেন গোপাল হালদার। দু’জনে গল্প চলে। এমন সময়ে হঠাৎ আসর থামালেন সতীনাথ। টর্চ হাতে পা টিপে টিপে বেরোলেন। কেন? সতীনাথ বলেন, ‘একটা ফুল ফুটতে আরম্ভ করেছিল, কতটা ফুটেছে’ তা দেখতেই আড্ডা ছে়ড়ে বেরোনো।
পরের দিন সকাল ৮টা-৯টা। বারান্দায় দু’জনে চা খাচ্ছেন। আলাপে ফের বাধা। ‘শুনছো’? কান পেতেও কিচ্ছুটি বোধহয় শোনা হল না গোপালবাবুর। বাড়ির অদূরের গাছে এসেছে এক বিশেষ পাখি। ওই পাখিই অমন ডাক পাড়ে। এ বার আরও চমকের পালা। সতীনাথ হিসেব দিলেন, গত বছরের তুলনায় ‘এ বার নয় দিন আগে এল’ পাখিটি! এই অন্য সতীনাথ ‘বাগানীয়া’, ‘গোলাপীয়া’, গোপালবাবুরই ভাষায়। তবে শুধু মগ্ন-নির্জনেই সতীনাথের প্রকৃতি-প্রেম শেষ নয়। আর তাই বনফুল হোন বা বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়, দেখা হলেই একটি উপহার বাঁধা— অর্কিড। বিলিতি এক লতার নাম রবীন্দ্রনাথ রেখেছিলেন, ‘নীলমণিলতা’। সতীনাথ ওই লতার নাম বদলে রাখলেন, ‘নীলমণি রবীন্দ্রাণী।’
এই বাগান, বাড়িই ‘অতৃপ্ত’ জাগতিক জীবনের শেষ ঠিকানা হল। ৩০ মার্চ, ১৯৬৫। সকালে লোকজনের সঙ্গে কথা বলছেন সতীনাথ। বাগানের রাস্তার ধারে পায়চারি করছেন ‘ভিজিল’ হাতে নিয়ে। পরিচারক বাবাজি বাজারে গিয়েছেন বাবুর জন্য পাবদা আনতে। আর সঙ্গে নতুন ধুতি।
বাবাজি ফিরলেন। দেখলেন, লাইব্রেরি ঘরের বারান্দায় টেবিলে আধখাওয়া জলখাবার। পাতকুয়োর পাশে পড়ে সতীনাথের দেহ। হৃদযন্ত্রে বাসা বাঁধা টিউমারটা বোধহয় ফেটে গিয়েছে। মুখ থেকে অল্প অল্প রক্ত ঝরছে। অদূরেই মুখ গুঁজে পাহারা!
কোশী নদীর তীরে কাপ্তানপুল শ্মশানঘাটে কাকাকে দাহ করলেন গৌতম ভাদুড়ী। গৌতমবাবু যেন ‘প্রথমবার পিতৃহারা’ হলেন। এই কাকার হাত ধরেই এক সময়ে যে গৌতমের গাছ চেনা হয়েছিল।
আসলে গাছ হোক বা দেশের মানুষ, লেখক ও মানুষ সতীনাথ তা-ই বিজনে আমাদের চেনাতে চেয়েছেন। তা আমরা চিনতে পেরেছি কি না, সে ‘খোঁজ’ উনি নিতে যাননি।
ঋণ: আনন্দবাজার আর্কাইভ; ‘দেশ’; ‘সতীনাথ গ্রন্থাবলী’ (সম্পাদনা: শঙ্খ ঘোষ, নির্মাল্য আচার্য); ‘সতীনাথ ভাদুড়ী’: সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায়; ‘সতীনাথ ভাদুড়ী’: স্বস্তি মণ্ডল; ‘সতীনাথ ও ফণীশ্বরনাথ ব্যক্তি ও শিল্পী’: নন্দকুমার বেরা; ‘দিবারাত্রির কাব্য’; ‘কোরক’। ছবি ঋণ: দিবারাত্রির কাব্য।
https://www.anandabazar.com/supplementary/patrika/a-write-up-of-satinath-bhaduri-1.842249?ref=patrika-new-stry