Friday, 30 March 2018

দেখিলাম ফিরে (On Ramkinkar Baiz)

দেখিলাম ফিরে

ভাঙাচোরা বাড়ি, বিবর্ণ স্মৃতিফলক। আঁকার কাগজ কিনতেন যেখানে, সেখানে চাউমিনের দোকান। শিল্পবোধহীন বাঙালি জীবনে এই ভাবেই বেঁচে আছেন রামকিঙ্কর বেইজ। বাঁকুড়ায় দেখে এলেন গৌতম চক্রবর্তী

 
Ramkinkar Baij
মফস্সলের দোকান যেমন হয়! সরু রাস্তার এক পাশে সাইনবোর্ড: সুমন ভ্যারাইটি স্টোর্স। নুড্লস, ঝুরিভাজা থেকে কেক, পাউরুটি, সরষের তেল মায় দশকর্মার দ্রব্য... সব মজুত। সবুজ দেওয়াল, সদর দরজায় বিবর্ণ ফলক। কষ্ট করে পড়তে হয়: ‘এই বাসগৃহে নিতান্ত দীন অবস্থার মধ্যে শৈশব কাটিয়ে মাটীর পুতুল তৈরী করে’…মাটি বানানে দীর্ঘ-ই দেখে প্রথমটা খারাপ লাগছিল। তার পর নজরে পড়ল, রামকিঙ্করের মৃত্যুর চার বছর পর ১৯৮৪ সালে বাঁকুড়া লায়ন্স ক্লাবের তরফ থেকে এই ফলকটি বসানো হয়েছিল। তার পর আর সংস্কার হয়নি। টানা সাড়ে তিন দশক সরকার, ইতিহাসবিদ থেকে কলারসিক কারও টনক নড়েনি।
শরিকি বাড়ি, ভিতরে প্লাস্টারহীন ন্যাড়া ইটের দেওয়ালের গায়ে গাছের ডাল, ভিজে জামাকাপড় শুকোনোর দড়ি, ইলেকট্রিকের তার সব কিছু জট পাকিয়ে। এই বাড়িরই একটা ঘরে থাকেন শিবপ্রসাদ বেইজ। রামকিঙ্করের ভাইপো দিবাকর বেইজের ছেলে। অকৃতদার, বেকার। ছোটদের আঁকা শিখিয়ে, হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা করে দিন গুজরান করেন। তাঁকে প্রথমে প্রশ্ন করেছিলাম, ‘দাদুর কথা মনে আছে?’
শিবপ্রসাদ ঘাড় নাড়লেন, ‘হ্যাঁ। মাধ্যমিক অবধি রতনপল্লিতে যাতায়াত ছিল। দাদু পড়াশোনার জন্য মানি অর্ডারে টাকা পাঠাতেন, তিন-চার মাস অন্তর যেতে হত।’
–– ADVERTISEMENT ––
সেই মানি অর্ডার ফর্মের নীচে ভাইপো দিবাকরকে বালক শিবপ্রসাদের জন্য ভাতের ফ্যান, আলুসিদ্ধ আর ডিম খাওয়ানোর ব্যবস্থা করার নির্দেশ দিতেন রামকিঙ্কর, ‘তোর ছেলেটা বড় রোগা।’
শিবপ্রসাদকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘দাদু কত টাকা পাঠাতেন?’
‘কত আর! কখনও একশো,  কখনও দুশো। বলতেন, আমি তো রিটায়ার করেছি। টাকাপয়সা নাই।’
শিবপ্রসাদের ঘরের কুলুঙ্গিতে অনুকূল ঠাকুরের ছবি। বললেন, ‘আমরা বংশপরম্পরায় ওঁর দীক্ষিত। আমার মা-বাবাও ওঁর কাছেই দীক্ষা নিয়েছিলেন।’
‘দাদু বেঁচে ছিলেন তখন?’
‘না, না, দাদুর মৃত্যুর পরে।’
রামকিঙ্কর বেইজেরও এক ঠাকুর ছিল। বলতেন, ‘আমার ঠাকুর রবি ঠাকুর।’
এই সব জীবন্ত ঠাকুর অনেক পরে। ক্ষৌরকার চণ্ডীচরণ বেইজ আর তাঁর স্ত্রী সম্পূর্ণার বাড়িটা তখন মাটির, খড়ের চালা। পাঁচ বছর বয়সে সেখানে রামকিঙ্করের হাতেখড়ি। মেঝেয় অক্ষর লেখা শেখাচ্ছেন দাদা রামপদ। ‘শেখাচ্ছেন, কিন্তু আমার চোখ দুটো আটকে আছে দেওয়ালে টাঙানো রাধাকৃষ্ণের পটে। কানে হাত পড়তেই চোখ নামাতে হয়। তখন থেকেই ছবি আমার চোখ টেনেছে,’ এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন রামকিঙ্কর। শিল্পীর শুরু জানতে এই ভাঙাচোরা, বিবর্ণ, শরিকি বাড়িতে আসতেই হবে।
বাদনরত রামকিঙ্কর। ছবি সৌজন্য: বাসুদেব চন্দ্র
শিবপ্রসাদের বাবা দিবাকরই প্রথম পাকা ঘর তোলেন। খরচ দিয়েছিলেন রামকিঙ্কর। দুই পক্ষে তখন অনেক চিঠি চালাচালি হয়েছিল। রামকিঙ্কর এক বার লিখলেন, ‘মাটির ছাদ করে উপরে আলকাতরা দিয়ে দে।’ ভাইপো নারাজ, তাঁর পাকা ঘর চাই। রামকিঙ্করের চিঠি, ‘তোরা দালান করতে চাস! হাঃ… হাঃ… হাঃ।’ পোস্টকার্ডে লেখা দু’-একটা চিঠি এখনও রেখে দিয়েছেন শিবপ্রসাদবাবু।
শেষ অবধি এই বাড়ি তুলতে তিনশো টাকা পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু রামকিঙ্কর বেইজ ওই রকমই। স্বজনের স্বগৃহের স্বপ্ন অট্টহাস্যে উড়িয়ে দেন। শিবপ্রসাদ আরও একটা কথা জানালেন, ‘দাদুর নির্দেশে প্রথম থেকেই সেপটিক ট্যাঙ্ক।’ হাল আমলের তথাকথিত ‘স্বচ্ছ ভারত’ও অক্লেশে তাঁর কাছে নতজানু হতে পারে।
দিল্লিতে যক্ষ-যক্ষী তৈরি করছেন, শান্তিনিকেতন ভরিয়ে দিচ্ছেন ‘কলের বাঁশি’, সাঁওতাল রমণীর মূর্তিতে, কিন্তু বাঁকুড়ার সঙ্গে ভূমিপুত্রের সংযোগ কখনও ছিন্ন হয়নি। ‘শিল্পী রামকিঙ্কর আলাপচারি’ গ্রন্থের লেখক সোমেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এক সময়ে শান্তিনিকেতনের অ্যান্ড্রুজপল্লিতে ছিলেন রামকিঙ্করের প্রতিবেশী। একদিন তিনি ঢুকতেই রামকিঙ্করের হাঁক, ‘তোমাকে একটা নতুন জিনিস খাওয়াবো। এসো।’ কী খাওয়ালেন? হলদে মুড়ি। ভাজার সময় চালে হলুদ মাখানো হয়। তার মধ্যে কুসুমবীজ, কুমড়োবীজ আর ছোলাভাজার মুখরোচক মিশেল। সোমেন্দ্রনাথকে জিজ্ঞেস করছেন, ‘তুমি মুড়িভাজা দেখেছ? কুঁচা হে, কুঁচা জানো তো?’
বাঁকুড়ার ভাষায় কুঁচা মানে রান্নার কাঠের টুকরো। বাঁকুড়ার অশন, ব্যসন সবই তাঁর হৃদয়ে। মাঝে মাঝে বাড়ি আসতেন। কখনও দু’ দিন, কখনও বা টানা দশ-বারো দিন। এসেই সোজা চলে যেতেন তাঁর বাল্যবন্ধু অতুল কুচলান, বিশ্বনাথ নন্দী, বলাই কর্মকারদের কাছে। গেরুয়া পাঞ্জাবি আর পায়জামা অনেক পরের পোশাক। তার আগে যুবক রামকিঙ্করের  চোখে কালো রোদচশমা, মাথায় তালপাতার টুপি। বন্ধুদের আড্ডা জমত, শান্তিনিকেতন-ফেরত রামকিঙ্কর মাঝে মাঝেই বলতেন, ‘এসরাজটা নিয়ে এসো।’ জমে যেত গানের আড্ডা। রবীন্দ্রনাথের গান গাইতেন রামকিঙ্কর। কখনও ‘আকুল কেশে আসে কে গো চিরবিরহিনী,’ কখনও বা রক্তকরবীর ‘আঁধার রাতে একলা পাগল।’ যুগীপাড়ার বাসুদেব চন্দ্র এখন বৃদ্ধ। যৌবনকালে এই বন্ধুদের ছবি তুলেছিলেন, তাঁর ব্যক্তিগত সং‌গ্রহ থেকে জোগাড় করা গেল একটি ছবি।
এটুকুই যা প্রাপ্তি। বাঁকুড়া শহরের পাশে গন্ধেশ্বরী নদী আজ শীর্ণ স্রোতধারা। এই নদীর ধার থেকেই মাটি এনে ছেলেবেলায় মূর্তি গড়তেন তিনি। বাসুদেববাবুর বাড়ির অদূরে চাউমিন, এগ রোলের এক বৈশিষ্ট্যহীন দোকান। একদা এটাই ছিল গোলক দত্তের গোলদারি দোকান। এখান থেকে ছবি আঁকার কাগজ ও রং কিনতেন রামকিঙ্কর।
গিয়েছিলাম দোলতলা। নাটমন্দিরের পাশে বাজার, বিক্রি হচ্ছে ঘুগনি, খাসির মাংসের চটপটি। এখানেই কংগ্রেসের প্রদর্শনী, সভাসমিতি হত। কংগ্রেস নেতা অনিলবরণ রায়ের নেতৃত্বে রামকিঙ্কর আঁকতেন মহাত্মা গাঁধী, সুভাষচন্দ্র ও নেতাদের ছবি।
তাঁর ছবি আঁকা, মূর্তি গড়া সব কিছুর সঙ্গে এই মফস্সল জড়িয়ে। গিয়েছিলাম সন্ন্যাসীতলা হয়ে পচার পাড়ে। এই পুকুরপাড়েই এক সময় থাকতেন শহরের বারাঙ্গনারা। স্কুল-বালক রামকিঙ্কর তাদের ভাদুপুজোর মূর্তি গড়ে দিতেন। উচ্ছেদ এবং উন্নয়নের এই মহাযুগে সেই পচার পাড় থেকে যৌনকর্মীদের মহল্লা তুলে দেওয়া হয়েছে। সেখানে পুকুরধারে বিত্তমধ্য তিন, চারতলা ফ্ল্যাটবাড়ি।
তারই মধ্যে হঠাৎ চোখ গেল অন্য দিকে। পুকুরধারে কে যেন বাঁশের ছোট্ট কাঠামোয় মাটি দিয়ে আধখানা মূর্তি গড়ে রেখেছে। এখনও পুজোর আগে ঠেলাগাড়ি করে গন্ধেশ্বরী নদীর পাড় থেকে মাটি নিয়ে আসা হয়। যে মাটিতে এই শহরে ঠাকুর গড়তেন রামকিঙ্কর, তন্ময় হয়ে দেখতেন তাঁর প্রথম গুরু অনন্ত সূত্রধরের হাতের কাজ। কী ভাবে মাটি ছেনে গড়ে তোলা হয় দুর্গা, কালী, কার্তিক, গণেশকে। সেই পুকুরপাড়ে আজও ছেলেপিলেরা কেউ কেউ মূর্তি গড়ে!
বাড়িঘর, পথঘাটের বদল নয়। এই প্রবহমান জীবনেরই অন্য নাম বোধ হয় রামকিঙ্কর।

এলেম নতুন দেশে
তাঁর জীবন মানেই তো বাঁক থেকে বাঁকে চঞ্চল এক নদীর প্রবাহ। রামকিঙ্করদের বাড়ি যে যুগীপাড়ায়, সেই যুগীপাড়ার মুখেই রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের এক মূর্তি। স্থাপিত: ৩১ মে, ১৯৭২। মানে, এই মূর্তি স্থাপনের সময় রামকিঙ্কর বেঁচে। ‘প্রবাসী’ পত্রিকার সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের সৌজন্যেই তাঁর প্রথম শান্তিনিকেতন যাত্রা। পিতা চণ্ডীচরণ হাজামত করতে গিয়েছেন রামানন্দবাবুর বাড়ি, কথায় কথায় সম্পাদক ‘চণ্ডী লাপতের ব্যাটা’র ছবি দেখে মুগ্ধ।
প্রস্তাব পেয়েও রামকিঙ্কর তাঁরই পাড়ার রাস্তায়, পৃষ্ঠপোষকের মূর্তি গড়লেন না কেন? শিল্পী এক বার সাফ জানিয়েছিলেন, ‘শুন হে, আমি পোর্ট্রেট বানাই না। আমার শিল্প-ভাস্কর্য চিন্তায় রামানন্দের যে মূর্তি উঠে আসত, সে মূর্তি ওরা বুঝত না হে, বলত কিচ্ছু হয় নাই। তাই রামানন্দের মূর্তি বানাতে মন চায় নাই।’
এই যে ‘সে মূর্তি ওরা বুঝত না হে’ এটা শুধু বাঁকুড়ার নয়, রাজধানী কলকাতারও লজ্জা। সত্তর দশকের ওই সময়টায় শিল্পজ্ঞানহীন, এই বেরসিক বঙ্গসমাজকে হাড়ে হাড়ে চিনে গিয়েছেন রামকিঙ্কর। স্বাধীনতার পর শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড়ে নেতাজি-মূর্তির জন্য প্লাস্টার অব প্যারিসে তৈরি একটি ছোট মূর্তি পাঠান তিনি। ঘোড়ায় চাপা নেতাজি, ঘোড়া আর তার পিঠের সওয়ার একাকার। ঘোড়া আর নেতাজি দু’জনেই যে তেজের প্রতীক! সরকারি কর্তারা সেই মূর্তি ফেরত দিয়েছিলেন।
একটা টিনের তোরঙ্গে কিছু জামাকাপড়, পেনসিল স্কেচ, ওয়াটার কালার নিয়ে রামানন্দবাবুর সঙ্গে শান্তিনিকেতন চলে গেলেন রামকিঙ্কর। সে আমলে যাতায়াত এত সহজ ছিল না। বাঁকুড়া থেকে প্রথমে বাসে দামোদরের চুণপোড়া ঘাট। সেখান থেকে নৌকোয় নদী পেরিয়ে, হেঁটে দুর্গাপুর স্টেশন। খানা জংশনে গাড়ি বদলে লুপ লাইনে বোলপুর।
১৯২৫ সাল। গ্রন্থভবনের দোতলায় তখন কলাভবনের ক্লাস। নীচে আচার্য নন্দলাল বসুর শিল্পসাধনা। খদ্দর পরে, গ্রাম্য চেহারার বালক এসে দাঁড়াল সেখানে। সহপাঠীরা নাম দিল ‘খদ্দর বন্ধু’। মাস্টারমশাই নন্দলাল বসু তার আঁকা ছবি দেখে প্রথমে বললেন, ‘সব তো শিখেই এসেছ।’ তার পর একটু ভেবে: ‘ঠিক আছে, দু’-তিন বছর থেকে যাও।’
নতুন ছাত্রের গান গাইবার ঝোঁক প্রবল। কিন্তু গলা তেমন খোলতাই নয়। সহপাঠীরা বলল, সাঁওতাল গ্রামের দিকে গিয়ে গলা সাধতে। রামকিঙ্কর মেনে নিলেন। তাঁর বেইজ পদবি নিয়ে বাকিরা ঠাট্টা করে। তাই প্রবাসীতে রঙিন ছবি পাঠান ‘রামপ্রসাদ দাস’ নামে। পরে ক্ষিতিমোহন সেন রামকিঙ্করকে বুঝিয়েছিলেন পদবির ইতিহাস। বৈদ্য থেকে বৈজ হয়ে তবে বেইজ।
বাঁকুড়ার এই ছেলে তখন শান্তিনিকেতনে অনেক বিষয়েই পথপ্রদর্শক। কলাভবনে নন্দলাল বাবুরা অয়েল পেন্টিং শেখাতেন না। রামকিঙ্কর তো বাঁকুড়াতেই তেল রঙে হাত পাকিয়েছেন। অসহযোগ আন্দোলনের সময় নেতাদের পোর্ট্রেট করতেন তেল রঙে। কলকাতার দোকানে এসে জিজ্ঞেস করেছিলেন, কী ভাবে করতে হয়। দোকানি বলেছিল, এই তো টিউব টিপে। সেটাই রামকিঙ্করের অয়েল পেন্টিংয়ের শুরু। নন্দলাল পছন্দ করেননি, বাধাও দেননি। পরে রামকিঙ্কর প্রায়ই নিজেকে বলতেন, ‘ভুঁইফোড়’। পোশাকি, শহুরে ‘স্বশিক্ষিত’ শব্দের চেয়ে মাটির
গন্ধ-লাগা ওই ভুঁইফোড় শব্দটিই তাঁর পছন্দের ছিল।
আর আশ্রমগুরু? রামকিঙ্কর বারংবার বলেছেন, ‘পোর্ট্রেট আঁকতে গেলে মুখটাকে ভাল ভাবে স্টাডি করতে হয়। মুখের অ্যানাটমির নকল নয়, ক্যারেক্টারকে ফুটিয়ে তোলা।’
ক্যারেক্টারকে কী ভাবে ফোটালেন তিনি? দীনবন্ধু অ্যান্ড্রুজ মারা গিয়েছেন, স্মরণসভার জন্য লেখায় ব্যস্ত রবীন্দ্রনাথ। রামকিঙ্করকে শর্ত দিয়েছেন, কোনও ভাবেই বিরক্ত করা যাবে না তাঁকে। কবি তখন অসুস্থ, মাথার চুল ছোট করে ছাঁটা। ‘আমি তাঁকেই ধরার চেষ্টা করেছি হে। সিরিয়াস রবীন্দ্রনাথ। বাজারের মিষ্টি মোলায়েম কবিগুরু নয়। সারা জীবন লোকটা কী করে গেল নিজের হাতে, শিলাইদহে, এখানে শান্তিনিকেতনে…সারা জীবন এমন হাড়ভাঙা খাটুনিই বা ক’জন খেটেছে আমাদের দেশে?’ বলতেন রামকিঙ্কর। হাঙ্গেরির বালাতোন হ্রদের ধারে তাঁর সেই ‘রবীন্দ্রনাথ’ নিয়ে কম ঝড়! শিল্পবোধহীন মন্ত্রীরাও একের পর এক মন্তব্য করে গিয়েছেন তখন। শিল্পী মনে মনে হেসেছেন আর তাঁর সেই বাঁকুড়ার ছেলেবেলার কথা মনে করেছেন: আর্টিস্টের কপাল দেখো। আমাদের বাঁকুড়ায় থিয়েটারের দলের একটা ঘর ছিল। সেখানে একটা ঢোল থাকত। দেখতাম যে যখন পাচ্ছে, এক বার করে পিটিয়ে দিচ্ছে।
ঘটনা, এই মূর্তিটি তৈরির সময়েই রবীন্দ্রনাথের মুখের আসল বৈশিষ্ট্যটি ধরা দেয় তাঁর চোখে। রবীন্দ্রনাথের নাক! ‘ওঁর মুখে নাক একটা প্রধান বৈশিষ্ট্য। প্রোফাইলে সেটা আরও স্পষ্ট ধরা পড়ে। খাঁড়ার মতো।’
তাঁর আগে এই ভাবে কে আর শিখিয়েছেন, মুখের ফোটোগ্রাফ মানেই ভাস্কর্য নয়! ফোটোগ্রাফিক রিয়্যালিটির বাইরে বেরিয়ে শিল্পীকে ধরতে হবে মুখের চরিত্র! আলাউদ্দিন খাঁ শান্তিনিকেতনে এসেছেন, রবীন্দ্রনাথ নন্দলালকে বললেন, ‘আলাউদ্দিনের মাথাটা রেখে দে।’ মানে, মূর্তি গড়ে নে। রামকিঙ্কর গেলেন অতিথিশালায়, খাঁ সাহেব সে দিনই চলে যাবেন। দ্রুত কাজ করছেন, কিন্তু তৃপ্তি হচ্ছে না। তার পরই হঠাৎ মনে হল, গত রাতেই তো শুনেছিলেন খাঁ সাহেবের বাজনা। ‘সুরের ঢেউ উঠছে আকাশে দমকে দমকে, আর সুরের জালে জড়িয়ে পড়ছে মানুষ, গাছপালা, বাড়িঘর। কানে-শোনা শিল্পীর সেই ঝালা আমার ঘাড়ে চাপল, আর কুড়ি মিনিটেই কাজ শেষ।’
রবীন্দ্রনাথের শেষ অপূর্ণ আকাঙ্ক্ষা… সেটিও তো বাঁকুড়ার ছেলের কাছেই। রামকিঙ্কর তখন রবীন্দ্রনাথের মূর্তি বানাচ্ছেন, রবীন্দ্রনাথ ফিসফিস করে বললেন, ‘হ্যাঁ রে, তুই যেমন গড়িস, আমাকে এক তাল মাটি এনে দিস তো।’ রামকিঙ্কর হয়তো এনেই দিতেন, কিন্তু দরজার আড়াল থেকে বারণ করলেন রবীন্দ্রনাথের পুত্রবধূ প্রতিমা দেবী, ‘বাবামশাইয়ের শরীর খারাপ। মাটি এনো না, আবার জল ঘাঁটাঘাঁটি করলে শরীর খারাপ হবে।’ পরের দিন রামকিঙ্কর যেতেই রবীন্দ্রনাথের প্রথম প্রশ্ন, ‘কী রে, মাটি এনেছিস?’ রামকিঙ্কর জানালেন, তিনি প্লাস্টিসিন নিয়ে এসেছেন। ওতেও মূর্তি গড়া যায়। রবীন্দ্রনাথ কোনও উৎসাহ দেখালেন না, ‘দুর, ওতে হাত চটচট করে।’ পরিণত বয়সেও রামকিঙ্করের এই আক্ষেপ দূর হয়নি… সে দিন যদি কবিকে সত্যিই তিনি এক তাল মাটি এনে দিতেন! চিত্রকলার মতো মূর্তি গড়াতেও হয়তো দুনিয়াকে নতুন ভাষার সন্ধান দিতে পারতেন রবীন্দ্রনাথ। 
একদিন রবীন্দ্রনাথই তাঁকে বলেছিলেন সেই কথা, ‘বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়বি কাজে। শেষ করে আর ফিরে তাকাবি না। ছেড়ে দিবি। আবার ঝাঁপ দিবি অন্য কাজে।’
এটাই তো রবীন্দ্রনাথের জীবনমন্ত্র। কবিতায়, গানে, নাটকের এক-একটি ফর্মে চূড়ান্ত সিদ্ধিতে পৌঁছনো, তার পর সেই সিদ্ধি ঠেলে ফেলে ফের নতুনের সন্ধানে যাত্রা।
রামকিঙ্কর বেইজ তাঁর সেই মন্ত্রশিষ্য। একটার পর একটা মূর্তি গড়েছেন, পছন্দ না হলে ভেঙেছেন। আবার গড়েছেন। প্রথমে বাঁশের ফ্রেমে খড় দিয়ে মোটা করে সিমেন্ট লেপে তৈরি করলেন ‘সাঁওতাল পরিবার’। ভার কাঁধে মাঝি, ভারের এক দিকে মালপত্র, অন্য দিকে ছোট ছেলে। পাশে ঝুড়ি মাথায় মেঝেন।
কিন্তু বাঁশের ফ্রেমে সিমেন্ট টিকবে কেন? ভেঙে পড়ল সে। এ বার করানো হল লোহার আর্মেচার। তখনও শান্তিনিকেতনে বিদ্যুৎ নেই, সন্ধ্যার পর তাঁবু ফেলে মূর্তির সামনে বসে থাকেন শিল্পী। খাওয়াদাওয়ার ঠিক নেই, কখনও ভাঙেন, কখনও বাড়তি কংক্রিট চেঁছে দেন। হাতে লণ্ঠন ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন তাঁর সহকারী। নিজেই বলেছেন, ‘উপোসটুপোসও মনে থাকে না কাজের মধ্যে ঢুকে পড়লে। ওটাই কেল্লা হে। কেউ ছুঁতে পারবে না তোমাকে এই কেল্লায় একবার সেঁধিয়ে পড়তে যদি পারো। যতই চেল্লাক, কানে যাবে না কিছু। ওখানে শুধু কাজ আছে আর তুমি আছো।’ ফাঁকিবাজ বাঙালি সমাজে এটাই হতে পারত রামকিঙ্করের সেরা উত্তরাধিকার। ধান ঝাড়া থেকে কলের বাঁশি, তাঁর প্রতিটি ভাস্কর্যে তো কাজের ছন্দ। ‘সাঁওতাল, গাঁ গঞ্জের খেটে-খাওয়া মানুষ... এরাই আমাকে টেনেছে সবচেয়ে বেশি,’ বলতেন রামকিঙ্কর।
কেনই বা টানবে না? রামকিঙ্কর সেই সময়ে সোমেন্দ্রনাথকে একবার বলেছিলেন, ‘ভদ্রলোকদের অনেক সময় বুঝতে পারি না। ওখানে সুর খুব কম। অনেকে আলাপ করতে আসে। ঢং ঢাং দেখি। কেউ পণ্ডিত সাজে, কেউ কবি আর্টিস্ট, কেউ ভালমানুষ, কেউ বা দাতাকর্ণ। যাত্রাদলের সঙ সব, মনে মনে হেসে মরি!’
এই সব সঙ-সাজা, খড়ের পুতুলেরা তাঁকে কম জ্বালিয়েছে! কলকাতায় এক প্রদর্শনীর উদ্বোধন করতে এসেছেন, সেই প্রদর্শনীর পুস্তিকায় এক লেখক রামকিঙ্করকে সাঁওতাল বলে পরিচয় দিয়েছেন। ‘যাঁরা লেখেন, তাঁরা কি একটু খোঁজখবর নেওয়াও দরকার মনে করেন না?’ এক নিবন্ধে লিখেছিলেন রামকিঙ্কর। ‘পোস্ট ট্রুথ’ কি আর শুধু আজকের বৈশিষ্ট্য? বাঙালি ভদ্রলোকও তো বরাবর রামকিঙ্করকে নিয়ে তৈরি করেছে তার পছন্দসই অলীক সত্য!
 এটাই হওয়ার কথা ছিল। কারণ, রামকিঙ্কর বেইজের সত্যদর্শন, কর্মদর্শন কিছুই আমরা গ্রহণ করিনি। বরং রামকিঙ্কর কতটা মদ খেতেন, কতটা বোহেমিয়ান ছিলেন— এ নিয়ে বাঙালি যত গপ্পো তৈরি করেছে, তাঁর কাজ নিয়ে সিকিভাগও নয়। শান্তিনিকেতনের প্রখর রোদে খাড়া দাঁড়িয়ে ভাস্কর্য তৈরি করতেন রামকিঙ্কর। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে নয়, বিভিন্ন কোণ থেকে কাজটা বারংবার দেখা। ‘স্কাল্পচারে খোদাইয়ের কাজে ছেনির প্রত্যেক ঘাকে মিনিংফুল হতে হয়। মুছে ফেলে আরম্ভ করবে, উটি হবে না হে। মেটিরিয়ালের সঙ্গে লড়াইয়ে দারুণ স্ট্রেন। ভুল করেছো কি কাজটাই নষ্ট,’ বলেছিলেন তিনি। বিশ্বভারতীতে তখন ব্রোঞ্জ-ঢালাইয়ের পয়সাও নেই। রামকিঙ্কর বুদ্ধি বার করলেন। কংক্রিট আর স্টোন চিপসের মেটিরিয়াল।
তাঁর শিল্পসাধনা এই রকমই। যেমন ‘কলের বাঁশি’। বাতাসের বিপরীতে ছুটছে দুই সাঁওতাল যুবতী, উড়ছে আঁচল, পায়ে পায়ে ধুলো। পিছনে একটি ছেলে ছুটতে ছুটতে হাতের বাঁশিটা দিয়ে উড়ন্ত আঁচলটা ধরার চেষ্টা করছে। রামকিঙ্কর বলতেন, ‘ওই যে উড়ন্ত শাড়ির ফোল্ডগুলি, ভার জানো? ওর মধ্যে কতটা লোহা আর কংক্রিট ভাবো দেখি। ছবিতে এই সব ঝামেলা নেই। যখন নাস্তানাবুদ, দিলাম ছেলেটাকে অ্যাড করে। ওটাই সাপোর্ট।’ নিজের জীবন দিয়ে, কাজ দিয়ে চিত্রকলা আর ভাস্কর্যের তফাত বুঝিয়ে দেওয়ার মতো সেই বাঙালি আমাদের মধ্যেই ছিলেন, আমরা তাঁকে শুধুই বেহিসেবি, বাউন্ডুলে জীবনের প্রতীক বানিয়ে উত্তরাধিকারীর তর্পণ সম্পন্ন করছি। রামকিঙ্কর, ঋত্বিক ঘটক এবং শক্তি চট্টোপাধ্যায় তাই আমাদের কাছে প্রায় একই... প্রতিভাবান, বাউন্ডুলে, বেহিসেবি এবং মাতাল!
মদ তিনি খেতেন। প্রখর রোদে কাজ করার ক্লান্তি মুছতে। ‘পরিশ্রম থেকে অব্যাহতি পাওয়ার জন্য একটুআধটু খেতাম। এভাবেই নেশা হয়ে গেল। চূড়ান্ত নেশা করে অজ্ঞান হয়তো কখনও সখনও হয়েছি, কিন্তু সেটাই রুটিন ছিল না। হলে কাজ করতাম কি করে?’ এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন রামকিঙ্কর। সেই সাক্ষাৎকারে আরও বলেছিলেন, ‘আর্ট বিক্রয়যোগ্য পণ্য নয়... কেউ আমার তুলনায় বেশি পাবলিসিটি পেয়ে যাচ্ছে দেখে চিন্তিত হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। ছবি আঁকা বা মূর্তি গড়ার পর আমার দায়িত্ব শেষ। অহেতুক কোনও পাবলিসিটির চিন্তা না করলেও চলবে।’ ইনস্ট্যান্ট খ্যাতির ইঁদুরদৌড় থেকে বহু দূরে এই মেকি সভ্যতার বিপ্রতীপে বলিষ্ঠ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকেন তিনি।
 বলিষ্ঠ, আক্ষরিক অর্থেই। নন্দলাল বসু এক বার বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়কে বলেছিলেন, ‘দেখে এসো, কলাভবনের দেওয়ালে কিঙ্কর আঁকছে। কী ডেক্সটিরিটি! দেখলে বুক কেঁপে যায়।’
এই বলিষ্ঠতা শরীরসর্বস্ব ব্যায়ামবীরের নয়, সভ্যতাকে প্রত্যাখ্যান-করা এক বাউলমনের। এক বার বিড়ি কিনবেন, দু’টাকার নোট দরকার। সেই সামান্য পয়সাও নেই। সোমেন্দ্রনাথ বিছানার শতরঞ্চি উল্টে দেখতে পেলেন, সেখানে বড় অঙ্কের চেক। তামাদি হয়ে গিয়েছে, তাঁর খেয়াল নেই। খাওয়ার সময় তাঁর পাতেই মুখ দিত বিড়াল, কুকুরেরা। রামকিঙ্কর তেড়ে যেতেন না, উল্টে সস্নেহ বলতেন, ‘খা, খা, তোদেরও তো বাঁচতে হবে।’
শিবপ্রসাদকে লেখা চিঠি। ছবি সৌজন্য: শিবপ্রসাদ বেইজ
পাহাড় কাটা
স্টেলা ক্রামরিশ তাঁকে মাঝে মাঝেই বলতেন, ‘কিঙ্কর, একটা পাহাড় ধরো।’ রবীন্দ্রনাথের আমন্ত্রণে শান্তিনিকেতনে এসেছিলেন অস্ট্রিয়ার এই শিল্পতত্ত্ববিদ।
পাহাড়ও তিনি ধরলেন। দিল্লিতে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সামনে আজও আছে ২১ ফুটের সেই যক্ষ-যক্ষীর মূর্তি। ১৯৫৪ সালে রামকিঙ্কর কুলু যাওয়ার পথে দেখলেন তাঁর পছন্দসই পাহাড়। ভাকড়ানাঙাল ড্যামের বিশেষজ্ঞদের দিয়ে ব্লাস্ট করিয়ে পাওয়া গেল পাথরের টুকরো। ন্যারোগেজ লাইনের ট্রেনে সেই পাথর আনাও ঝকমারি। বদলানো হল ওয়াগনের চেহারা। পাঠানকোটে এসে ব্রডগেজ ট্রেনে সেই পাথর আনা হল দিল্লিতে।
এত ঝঞ্ঝাট, কাজ আর এগোয় না। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক সতর্কবার্তা পাঠাল, ডেটলাইন পেরিয়ে যাচ্ছে। রামকিঙ্কর গেলেন রেগে, ‘দুর, আমাকে ডেটলাইন দেখাচ্ছেন? যান, আমাকে জেলে পাঠিয়ে দিন। ভালই হবে, আমি সেখানে নিশ্চিন্তে অনেক মূর্তি গড়তে পারব।’ ডেটলাইন পেশাদার কর্মীর আয়ুরেখা, শিল্পীর নয়। ডেটলাইনওয়ালারা কি বুঝবে, কত দিন ঘুম ভেঙে মধ্যরাতে তিনি তাকিয়ে থেকেছেন অসমাপ্ত ভাস্কর্যের দিকে, পরদিন সেটাকে ভেঙে ফেলে আবার শুরু করেছেন প্রথম থেকে! ডেটলাইনওয়ালারা কি বুঝবে, তাঁর মাস্টারমশাই নন্দলাল বসু কী ভাবে তাঁকে আদিগন্ত খোয়াইয়ে নিয়ে গিয়ে প্রথমে চুপচাপ বসে থাকতে বলতেন! আগে ধ্যানস্থ হয়ে পরিপার্শ্ব, প্রকৃতিকে নিজের ভাবনায় নিতে হবে, তার পরই তৈরি হবে শিল্পসম্ভাবনা।
১৯৬৭-তে শেষ হল কাজ। রামকিঙ্কর চিঠিতে রাধারানিকে জানালেন, ‘যক্ষীটা তোমার আদলে। তোমার জন্য অনেকগুলি টাকা পেয়েছি। আমাদের বাড়ি ছেড়ে কখনও যাবে না।’ রাধারানি স্বামী পরিত্যক্তা এক গ্রাম্য মহিলা, কাজ করতেন রথীন্দ্রনাথের স্ত্রী প্রতিমা দেবীর কাছে। রামকিঙ্কর বললেন, ‘খাওয়াদাওয়ার অসুবিধা হয়, আমাকে লোকটি দিতে পারো?’
সেই শুরু। রাধারানিকে মডেল করে ছবি আঁকেন কিঙ্কর। কখনও দিনে, কখনও বা রাতে। শান্তিনিকেতন আপত্তি তুলেছিল। রামকিঙ্কর স্পষ্টবাক, ‘আমি সেবাদাসী রেখেছি। তোমাদের আপত্তি কেন?’
সেবাদাসী? রাধারানি পরে বলেছিলেন, ‘ওই জড়ামড়িতেই থেকে গেলাম।’ দেশিকোত্তম পেয়েছেন রামকিঙ্কর। ছাত্ররা গিয়ে বললেন, তাঁকে সংবর্ধনা দেবেন। উপাচার্যও থাকবেন সেই অনুষ্ঠানে। রামকিঙ্কর বললেন, মঞ্চে উপাচার্য এবং তাঁর পাশে সম-মর্যাদায় রাধারানিকে আসন দিলে তবেই তিনি যাবেন।
  রাধারানিই একমাত্র নন। কখনও ছাত্রী জয়া আপ্পাস্বামী, কখনও বা মণিপুরী ছাত্রী বিনোদিনীকে নিয়ে তৈরি করেছেন ভাস্কর্য। ‘প্রেম এসেছে জীবনে। সেক্সুয়াল রিলেশনও হয়েছে। কিন্তু একটা জিনিস, কখনও লেপ্টে থাকিনি,’  বলেছিলেন শিল্পী।  
রামকিঙ্কর ও রাধারানি
একটি চিঠি
সাগরদা... বুঝি লেখাটা কিছু overdue হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমি একেবারে নিরুপায়।
১৯৮৪ সালের জানুয়ারি মাসে সমরেশ বসু এই চিঠি লিখছেন ‘দেশ’ পত্রিকার সম্পাদক সাগরময় ঘোষকে। তার চার বছর আগে ১৯৮০ সালের অগস্ট মাসে এসএসকেএম হাসপাতালে মারা গিয়েছেন রামকিঙ্কর।
উপন্যাসের মালমশলা জোগাড়ের কাজ শুরু হয়েছিল তাঁর জীবদ্দশাতেই। সমরেশ তখন বারংবার শান্তিনিকেতন, বাঁকুড়া করেছেন। রামকিঙ্করও এগিয়ে এসেছেন উদার ভাবে। ১৯৭৯ সালের ২৫ এপ্রিল শিল্পীর শেষ বাঁকুড়াযাত্রা। সঙ্গে লেখক। টেপ রেকর্ডারে ধরে রেখেছেন শিল্পীর পরিবার ও তাঁর বন্ধুদের কথা। গাড়িতে উঠতে উঠতে রামকিঙ্কর এক বন্ধুকে বললেন, ‘এই বোধহয় শেষ আসা।’
কে জানত, সে কথা ফলে যাবে এই ভাবে! প্রস্টেটের গোলমাল, মলমূত্র ত্যাগের বোধ অবধি চলে গিয়েছিল। ডাক্তার ঠিক করেছিলেন, শান্ট বসিয়ে মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা ফিরিয়ে আনতে হবে।
রামকিঙ্করের বাড়ির সদর দরজা: এখন। ছবি সৌজন্য: অভিজিৎ সিংহ
শান্তিনিকেতন থেকে তাঁকে কলকাতায় এনে অস্ত্রোপচার সফল হয়নি। হাসপাতালে ভাইপো দিবাকরকে দেখে তখন তিনি বলছেন, ‘ও দিবাকর, এসেছিস? ওই দিকে রাধারানির বাড়ি, ওখানে খেয়েদেয়ে তাড়াতাড়ি চলে আয়।’ দিগভ্রান্ত তিনি, কলকাতায় খুঁজছেন রাধারানির বাড়ি।
 বহু বছর আগে, শেষ দিকে এ ভাবেই দিগভ্রান্ত থাকতেন রামকিঙ্করের মা সম্পূর্ণা। রাত্তিরে বিছানা থেকে উঠে বেরিয়ে যেতেন, ‘ওই... ওই দিকে যাব।’ রামকিঙ্কর তখন শান্তিনিকেতনে, মা-বাবা কারও মৃত্যুর সময়েই কাছে ছিলেন না তিনি। কিন্তু দিগভ্রান্ত বিকার হাসপাতালের শেষ শয্যায় তাঁর পিছু ছাড়ল না।
সমরেশের উপন্যাসও শেষ হয়নি। তিনি অবশ্যই রামকিঙ্করের জীবনী লিখছিলেন না। তৈরি করছিলেন জীবনভিত্তিক উপন্যাস। ভ্যান গঘকে নিয়ে ‘লাস্ট ফর লাইফ’ বা মিকেলেঞ্জেলোকে নিয়ে ‘অ্যাগনি অ্যান্ড এক্সট্যাসি’ যেমন!  ‘কথ্য ভাষা এখন আমার সম্পূর্ণ আয়ত্তে, সত্তর বছর আগের বাঁকুড়া শহর স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি,’ আর এক চিঠিতে লিখছেন সমরেশ।
‘দেখি নাই ফিরে’ নামের সে উপন্যাস শেষ হয়নি, মাঝপথে মারা গিয়েছেন সমরেশ। রামকিঙ্কর এই কেচ্ছাভুক, মেকি সভ্যতার কাছে বরাবর অধরা ছিলেন, তাঁর সাহিত্যিক উপস্থাপনাও রয়ে গেল অসমাপ্ত। বাঙালির ট্র্যাজেডি এখানেই!

http://www.anandabazar.com/supplementary/patrika/sculpture-and-painter-ramkinkar-baij-a-key-figure-of-contextual-modernism-1.775681?ref=archive-new-stry

রাতে দোকান খুলিয়ে কিনলেন শেক্সপিয়র (On Bikash Roy)

রাতে দোকান খুলিয়ে কিনলেন শেক্সপিয়র

জীবনে মদ ছোঁননি। নেশা বলতে বই পড়া। শখ বিদেশি গাড়ির। সাদামাঠা গৃহস্থজীবন কাটানো ‘ভিলেন’ বিকাশ রায়কে নিয়ে লিখেছেন দেবাশিস ভট্টাচার্য 

 
Bikash Roy
তাঁর মায়ের কাছে বাবা বললেন, ‘‘তোমার এই ছোট ছেলেটির লেখাপড়া কিচ্ছু হবে না। রেসিটেশন শিখছে, নকল-টকল করতে পারে। যাত্রা, থিয়েটারে নোটো সেজেই ওর দিন যাবে।’’
কী অমোঘ ছিল সেই পর্যবেক্ষণ! বিকাশ রায় নিজেই পরে বলেছেন, ‘‘বাবার ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে ফলেছে। নোটো হয়েই দিন গেল!’’
যে সময়ের কথা, বিকাশ তখন বালক। জন্ম ১৯১৬য়, নদিয়ার রানিনগরে। বিত্তবান জমিদার বংশের ছেলে। তবে পূর্বপুরুষের বাবুয়ানি এবং উড়নচণ্ডিপনায় ভাঁড়ার প্রায় সবটাই তত দিনে উজাড় হয়ে গিয়েছিল। টিকেছিল শুধু জমিদারিসূত্রে পাওয়া ‘রায়’ পদবিটুকু।

বাবা যুগলকিশোর কলকাতায় এসে সরকারি চাকরি নিলেন। যে কোনও আদর্শ পিতার মতোই তিনি চাইতেন, ছোট ছেলে ‘বিকু’ ভাল লেখাপড়া শিখে আইসিএস হোক।
 বিকাশ ভর্তি হলেন ভবানীপুরের মিত্র ইনস্টিটিউশনে। কিন্তু তাঁর বেশি আগ্রহ আবৃত্তি (সেই শিক্ষা অবশ্য বাবার কাছেই শুরু), অভিনয়ে। তাই হাত-পা নেড়ে ‘পঞ্চনদীর তীরে’ আবৃত্তি করে প্রশংসা কুড়োলেও বাবা যেই ইংরেজি ট্রান্সলেশন ধরলেন, বিকুর হাল খারাপ! 
 ম্যাট্রিকে বাংলায় লেটার ও স্বর্ণপদক নিয়ে পাশ করলেন বিকাশ। পড়তে গেলেন প্রেসিডেন্সি কলেজে। সেখানেও নাটকের ভূত তাঁর ঘাড়ে। তখন ঘটল আর এক কাণ্ড! কলেজের থিয়েটারের দলে ঢুকে শরৎচন্দ্রের ‘বৈকুণ্ঠের উইল’-এ পেলেন বিনোদের ভূমিকা। চরিত্রের দাবি অনুযায়ী মদ, সিগারেট সবই দরকার। কলেজের নাটকে মদ খাওয়া দেখানোর প্রশ্নই নেই। তবে সিগারেট রেখেই মহলা হল। কিন্তু গোল বাধল শেষবেলায়। চূড়ান্ত মহলা দেখতে এসে অধ্যক্ষ রেগে আগুন। প্রেসিডেন্সির ছেলেদের নাটকে সিগারেট খাওয়া! অতএব সেটি অভিনয় থেকে ছেঁটে দেওয়া হল। যদিও সিগারেটের নেশা তত দিনে রপ্ত হয়ে গিয়েছে বিকাশের।
আর মদ? একের পর এক চলচ্চিত্রের খল চরিত্রে মদ্যপান যাঁর কাছে জলপানের চেয়েও স্বাভাবিক লেগেছে, ব্যক্তিজীবনে সেই বিকাশ রায় নেশা করবেন, এতে আশ্চর্য কী!
সত্যিই আশ্চর্য। কারণ কোনও দিন মদের গ্লাসে চুমুকটুকুও দেননি তিনি! ঘনিষ্ঠদের আড্ডায় এ সব নিয়ে মজাও করেছেন। বিকাশ রায়ের বিভিন্ন লেখার সংকলনগ্রন্থ প্রকাশের সূত্রে বইপাড়ার প্রকাশক বামাচরণ মুখোপাধ্যায় তাঁর খুব কাছের মানুষ হয়ে উঠেছিলেন। একবার বিকাশবাবুর কাছে তিনি জানতে চান, নিজে মদ না খেলে মদ্যপের নিখুঁত অনুভূতি বোঝা যায়? বিকাশবাবু হেসে জবাব দিয়েছিলেন, ‘‘অভিনয় তো মনে। মদ কী করবে!’’
অভিনয়ের এই সাবলীলতাই বিকাশ রায়ের সবচেয়ে বড় সম্পদ। চলচ্চিত্র জগতের মানুষজন তো বটেই, একেবারে সাধারণ দর্শকও তাঁর অভিনয় প্রতিভায় মজে থেকেছেন চিরকাল। তিনি আর নেই। কিন্তু সেই স্বীকৃতি আজ পর্যন্ত একই রকম রয়ে গিয়েছে।
পুরোদস্তুর নায়ক তিনি ছিলেন না। নায়কোচিত দর্শনধারীও নন। কিন্তু চরিত্রাভিনেতা হিসেবে নিজেকে তিনি বারবার যে উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন, তা ভোলার নয়। যখন খলচরিত্র করতেন, মনে হত এত ঘৃণ্য লোক আর হয় না। ’৪২ ছবিতে অত্যাচারী অফিসার মেজর ত্রিবেদীর চরিত্রে তাঁর অভিনয় তো বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে কিংবদন্তি হয়ে আছে। আবার যখন ‘আরোগ্য নিকেতন’-এর জীবনমশাই হয়ে পর্দায় এসেছেন, ‘উত্তর ফাল্গুনী’-র মনীশ হয়েছেন, তখন সেই অভিনয় দেখে সম্ভ্রমে মুগ্ধ হয়েছেন দর্শকেরা। ‘ছেলে কার’ বা ‘ছদ্মবেশী’র মতো কিছু ছবি তাঁকে চিনিয়েছে কমেডি অভিনয়ে দক্ষতার মাপকাঠিতে।
বিকাশ রায়ের পাকাপাকি ভাবে অভিনয়ে আসার আগের পথটি কিন্তু খুব মসৃণ ছিল না। চড়াই-উতরাই ছিল বিস্তর। সংসার প্রতিপালনের জন্য কঠিন লড়াই করতে হয়েছে তাঁকে। বিলেত ফেরত চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট দাদার অকালমৃত্যু, বাবার চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পরে পরিবারে নিদারুণ অর্থকষ্ট, তারই মধ্যে তাঁর বিয়ে। অন্নসংস্থানের জন্য হাড়ভাঙা খাটুনি ছিল তাঁর। সকালে টিউশন দিয়ে শুরু হত দিন। তার পরে বাসভাড়া বাঁচাতে ভবানীপুর থেকে হেঁটে হাইকোর্ট পাড়া। ভাগ্যান্বেষণে এ দুয়ার, সে দুয়ার।
প্রেসিডেন্সি থেকে অনার্স নিয়ে বিএ পাশ করেছেন, আইন পাশ করেছেন। ওকালতি করতে গিয়েও সুবিধে হয়নি। বহু ঘাটে ঘুরতে ঘুরতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বাজারে অল্প দিন মোটা বেতনে সিভিল ডিফেন্সে পাবলিসিটির চাকরিও করলেন। কাজ করলেন একটি এরোড্রম তৈরির অফিসেও। কিন্তু কোনওটিই তাঁর জীবনে স্থায়ী হল না। অনেক কম টাকায় যোগ দিলেন রেডিয়োর চাকরিতে। মাইক্রোফোনের আকর্ষণ তাঁকে টেনেছিল। নানা বাঁক ঘুরে সেখান থেকেই তিনি এক সময় পৌঁছলেন সিনেমার জগতে। দেশ তখনও স্বাধীন হয়নি। সিনেমায় নামার আগে স্ত্রীর ‘অনুমতি’ নিয়েছিলেন বিকাশ। কারণ এমন একটি কাজে পদে পদে নানা হাতছানি থাকে, নিন্দা রটতেও দেরি হয় না। স্ত্রী কিন্তু মুক্তমনে সায় দিয়েছিলেন। তিনি জানতেন, তাঁর স্বামী কত ‘খাঁটি’।
‘উত্তর ফাল্গুনী’ ছবিতে সুচিত্রা সেনের সঙ্গে
বিকাশবাবুর একমাত্র পুত্র বিজ্ঞান গবেষক সুমিত রায় ৫৪ বছর আমেরিকা প্রবাসী। পিতৃস্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে ওই ঘটনা শুনিয়েছেন তিনিই। বলেছেন, ‘‘আমার ঠাকুরদা তখনও জীবিত। তিনিও মাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘শুনেছি সিনেমা লাইনটা অতি খারাপ। লোকে নাকি কুসংসর্গে পড়ে, সংসার উচ্ছন্নে যায়। বিকু এই লাইনে গেলে সামলাতে পারবে তো?’ মা সম্মতি দিয়েছিলেন এবং বাবা আজীবন পরিবারের সেই মর্যাদা রক্ষা করেছেন।’’
১৯৪৭-এ মুক্তি পায় বিকাশ রায় অভিনীত প্রথম ছবি ‘অভিযাত্রী’।  ছবির কাহিনি, চিত্রনাট্য, শিল্পী নির্বাচন ইত্যাদির দায়িত্ব পেয়েছিলেন তাঁর রেডিয়ো-জীবনের বন্ধু জ্যোতির্ময় রায়। তিনিই নিয়ে যান বিকাশবাবুকে। আশ্বাস ছিল, নায়ক হবেন। পেলেন চার নম্বর চরিত্র। পাঁচ হাজার টাকাও। মন না মানলেও অবস্থা তা মেনে নিতে বাধ্য করল। এবং বাংলা চলচ্চিত্র জগৎ পেয়ে গেল অভিনেতা বিকাশ রায়কে।
প্রথম ছবির পরিচালক হেমেন গুপ্তের কাছেই বিকাশবাবুর দ্বিতীয় ছবি ‘ভুলি নাই’। সেই সঙ্গে পরিচালকের সহকারী হয়ে বুঝতে শুরু করলেন চলচ্চিত্র নির্মাণের অন্ধিসন্ধি। যেটা পরবর্তী কালে  বিকাশকে নানা ভাবে সাহায্য করেছে। পরিচালনা, চিত্রনাট্য তৈরি, প্রযোজনা— সব ক্ষেত্রে তাঁর বিচরণে দীর্ঘ সময় জুড়ে সমৃদ্ধ হয়েছে বাংলা ছবি।
১৯৫১ সাল। একের পর এক ছবি করতে করতে অভিনেতা বিকাশ রায় তখন বেশ পরিচিতি পেয়ে গিয়েছেন। সেই সময় হেমেনবাবু তৈরি করেন ’৪২। ছবিটিতে নৃশংস অত্যাচারী মেজর ত্রিবেদীর ভূমিকায় অবিস্মরণীয় অভিনয় করেন বিকাশ রায়। দেশ তখন স্বাধীন হওয়ার আবেগে উত্তাল। পর্দায় স্বাধীনতা সংগ্রামীদের উপর মেজরের অত্যাচার দেখতে দেখতে মানুষ এতটাই খেপে উঠেছিল যে, রাস্তাঘাটে বিকাশ রায়কে দেখলে তাড়া করার ঘটনাও ঘটত। ছবির প্রিমিয়ারে তাঁকে দেখতে পেয়ে জুতো তুলে ছুটে এসেছিলেন অনেকে।
‘‘একজন অভিনেতার জীবনে এর চেয়ে বড় পুরস্কার আর কী হতে পারে!’’ স্মৃতিচারণে সশ্রদ্ধ হলেন অভিনেতা বিশ্বজিৎ চট্টোপাধ্যায়। ’৪২-এর বছর দশেক পরে ‘মায়ামৃগ’ ছবি। সেখানে বিকাশ রায়ের সঙ্গে প্রথম কাজ করার সুযোগ পান বিশ্বজিৎ। একেবারে নায়কের ভূমিকা। উত্তমকুমার ছিলেন একটি বিশেষ চরিত্রে।
বিশ্বজিৎ বলেন, ‘‘বিকাশদাকে সামনে থেকে দেখার সুযোগ এর আগে হয়নি। কিন্তু তাঁর ’৪২ দেখে শিহরিত হয়েছিলাম। অভিনয় এমনও হয়!’’ প্রথম দিন পরিচয় করিয়ে দিলেন ছবির পরিচালক চিত্ত বসু। বিকাশবাবু নবাগত নায়ককে বললেন, ‘‘নতুন এসেছ। হিরোর রোল! তুমি তো অভিমন্যু বধ হয়ে যাবে হে!’’ মানে? প্রথমটা বুঝতে পারেননি বিশ্বজিৎ। নিজেই হেঁয়ালি ব্যাখ্যা করে দিয়েছিলেন বিকাশ রায়। হেসে বলেছিলেন, ‘‘তোমাকে কাদের পাশে অভিনয় করতে হবে, জানো? ছবি বিশ্বাস, উত্তম, আমি, সন্ধ্যারাণী... সবাই ঘিরে থাকব কিন্তু। তুমি চক্রব্যূহে একা অভিমন্যু। কেউ বেরোনোর জায়গা দেবে না! বেরোতে পারবে তো?’’
’৪২ ছবিতে
‘‘শুনেই কেমন একটা ধাক্কা লেগেছিল,’’ অকপট স্বীকারোক্তি বিশ্বজিতের। তাঁর মনে হয়েছিল, ‘‘আমাকে দমিয়ে দেওয়ার জন্য বলছেন নাকি?’’ তার পরেই তিনি বুঝতে পারলেন, বিষয়টা একেবারে উল্টো। আসলে বিকাশবাবু যা বলেছেন, সেটা অগ্রজের উপদেশ। বিশ্বজিতের কথায়, ‘‘সে দিন বিকাশদার বলা কথাগুলো কিন্তু আমাকে সচেতন করে দিয়েছিল। আমি বুঝে নিলাম, পর্দায় টিকে থাকতে হলে নিজের ক্ষমতা উজাড় করে অভিনয়ক্ষমতা দিয়ে নিজেকে চেনাতে হবে। এখন থেকে এটাই হবে আমার ধ্যানজ্ঞান।’’ পরে বিশ্বজিতের পরিচালনায়, প্রযোজনায় একাধিক ছবিও করেছেন বিকাশবাবু।
ছোট-বড় যে চরিত্রই হোক, নিজেকে সেই অনুযায়ী তৈরি করার কাজে বিকাশ রায় কোনও ঘাটতি রাখতেন না। যখন তিনি রীতিমতো নামডাকওয়ালা, তখনও সেই অভ্যেস তিনি ছাড়েননি। শট দেওয়ার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত চরিত্রায়ন নিয়ে নিজের মতো কিছু না কিছু ভেবেই চলতেন।
অভিনেত্রী লিলি চক্রবর্তী শুনিয়েছেন তেমনই এক টুকরো অভিজ্ঞতা। টেকনিশিয়ান্স স্টুডিয়োয় কোনও ছবির শুটিং করছেন তিনি। পাশের ফ্লোরে অন্য কোনও ছবিতে বিকাশ রায়। এক ফাঁকে বাইরে বেরিয়ে লিলিদেবী দেখেন, পুলিশ অফিসারের পোশাক পরা বিকাশবাবু বাইরের চত্বরে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছেন। ‘‘কী হয়েছে, বিকাশদা? পায়ে লাগল?’’ তাঁর প্রশ্নে বিকাশ রায় জানিয়েছিলেন, এই পুলিশ অফিসারের চরিত্রে একটু পা টেনে হাঁটলে ভাল হবে মনে হয়েছে বলে তিনি শটের আগে সেটা অভ্যেস করছেন। ফ্লোরে অন্য কেউ কিন্তু তা জানেননি, বোঝেননি। তাঁরা শুধু শটটাই দেখেছেন।
‘আমি সিরাজের বেগম’ ছবিতে মিরজাফর হয়েছিলেন বিকাশবাবু। সিরাজের ভূমিকায় বিশ্বজিৎ। শট দেওয়ার সময় বিশ্বজিতের মনে হত, বিকাশ রায়ের মিরজাফর যেন একটু ভালমানুষ গোছের। চুপচাপ বসে মালা জপছেন, আর ঘাড় হেলিয়ে তাকাচ্ছেন। ক্রূরতার প্রকাশ কি কম হচ্ছে? তখন সংশয় ছিল বিশ্বজিতের। এখন বলেন, ‘‘পরে ছবি দেখে মালুম হল, মিরজাফর চরিত্রকে কী অসীম দক্ষতায় জীবন্ত করে তুলেছিলেন বিকাশদা। ওই ঠান্ডা দৃষ্টিতে কী অসম্ভব কুটিলতা, ভাবা যায় না!’’
প্রমথেশ বড়ুয়া ছিলেন তাঁর প্রিয় শিল্পী। অভিনয়ে আসার আগেই বড়ুয়া সাহেবের স্টাইল তাঁকে টানত। ফিল্মে পরিমিতি বোধের অনুভূতি তিনি বুঝতে শিখেছিলেন প্রমথেশ বড়ুয়ার ছবি দেখে। বিকাশ রায়ের কাটা কাটা সংলাপ বলার ভঙ্গিতেও অনেকে তাই বড়ুয়া-স্টাইল খুঁজে পান।
আবৃত্তির প্রতি অনুরাগ তো শৈশব থেকেই ছিল। তাই প্রতিটি শব্দ উচ্চারণে যত্ন এবং স্বর প্রক্ষেপণ তাঁর অভিনয় প্রতিভায় যোগ করেছিল বাড়তি মাত্রা। কিন্তু তার বাইরেও আবৃত্তি তাঁকে প্রেরণা দিত। কাজ থেকে ফিরে সময় পেলেই ছেলে সুমিতের সঙ্গে বসে কত কী যে পড়তেন— ‘শেষের কবিতা’, ‘ম্যাকবেথ’, ‘সঞ্চয়িতা’র পাতা উল্টে কোনও কবিতা। বাবা-ছেলের পাঠে ঘর গমগম করে উঠত।
ইডেনের খেলায় উত্তমকুমারের সঙ্গে
ছেলেকে ডাকতেন ‘বেণুবাবু’ বলে। তবে ছেলে-মেয়ের মুখে সাদামাঠা ‘বাবা’ শুনতে চাইতেন না। তাঁকে সন্তানেরা বলতেন ‘বাবু’। ধমনীতে জমিদারের রক্ত বলেই হয়তো ‘কর্তা’ ডাকটিও অপছন্দের ছিল না।
ছেলেকে নিয়ে এক সান্ধ্য পাঠের আড্ডায় একদিন ঘটল মজার কাণ্ড। সে দিন শেক্সপিয়র-এর লেখা পড়া হবে। বিকাশ রায়ের বাড়ি ছিল বইয়ের গুদাম। পুস্তক অনুরাগী এই অভিনেতার নিজস্ব সংগ্রহে ছিল কয়েক হাজার বই। তাঁর যোধপুর পার্কের ভাড়াবাড়িতে কাজের বাইরে সর্বদা বই নিয়ে মগ্ন থাকতেই স্বচ্ছন্দ বোধ করতেন শিল্পী। তাঁর ছেলের কথায়, ‘‘বাবুকে বইয়ের পোকা বলা হত। বাড়ি জুড়ে শুধুই বই, বই, আর বই। কত রকম বিষয়। বিশেষ কোনও বাছবিচার নেই। বই পেলেই তিনি কিনতেন।’’ ছেলেকেও বইয়ের নেশা ধরিয়ে দিয়েছিলেন পুরোদস্তুর।
কিন্তু সে দিন শেক্সপিয়র পড়তে গিয়ে দেখা গেল, রচনাসমগ্রটি বেপাত্তা! তন্ন তন্ন করে খুঁজে বোঝা গেল, কোনও বহিরাগত অতিথি হয়তো ‘নিজের’ ভেবে সেটি কোনও দিন হস্তগত করেছেন। ‘‘সে হোক। তা-বলে শিক্ষিতের বাড়িতে শেক্সপিয়র থাকবে না! রবীন্দ্রনাথ এবং শেক্সপিয়র যে বাড়িতে নেই, সে বাড়ি বাসের যোগ্যই নয়।’’ মেজাজ হারালেন বিকাশবাবু।
অতএব সিদ্ধান্ত হল, তখুনি শেক্সপিয়রকে বাড়িতে এনে পুনর্স্থাপন করতে হবে। ছেলেকে বললেন, ‘‘বেণুবাবু, গাড়ি বের করো।’’ পুত্র সুমিতবাবুর মনে আছে, তিনি গাড়ি চালিয়ে বাবাকে নিয়ে এলেন চৌরঙ্গির ফারপো হোটেলের কাছে। ফুটপাতের এক পরিচিত বই বিক্রেতা তখন ঝাঁপ ফেলে শোওয়ার আয়োজন করছেন। বই পাওয়া গেল তাঁর ভাণ্ডারে। স্বস্তি পেলেন বিকাশ রায়!
আরও একবার একই ভাবে রবীন্দ্রনাথের ‘ছিন্নপত্র’ খুঁজে পাননি। পরদিন বিশ্বভারতীর গ্রন্থন বিভাগে কিনতে গিয়ে শুনলেন, ছাপা নেই। আপাতত বাজেট-বরাদ্দও নেই। সুমিতবাবু বলেন, ‘‘বাবু ওঁদের বললেন, আমি যদি গোপনে ছাপার টাকা দিই, তা হলে নেবেন? কাউকে বলতে হবে না। শুধু ছাপলেই হবে।’’ শুনে বিশ্বভারতীর কর্তারা হতবাক!
প্রসঙ্গ শুরু হয়েছিল আবৃত্তির কথা দিয়ে। সেখানেই ফেরা যাক। এখন যে শ্রুতিনাটকের চল, বিকাশবাবু তার অন্যতম সূচনাকার। তাঁর পরিচালনায় ‘শেষের কবিতা’ ছিল প্রথম মঞ্চস্থ শ্রুতিনাটক।
সপরিবার বিকাশ
লিলি চক্রবর্তী বলেন, ‘‘একদিন স্টুডিয়োয় কাজ করছি। একটু বাইরে বেরোতেই দেখি বিকাশদা। সৌমিত্রদা (চট্টোপাধ্যায়) তখন পাশের ফ্লোরে ঢুকছেন। আমাকে দেখিয়ে বিকাশদাকে বললেন, ‘তুমি লিলিকে ওটা বলেছ?’ বিকাশদা বললেন, ‘এখনই বলব।’ তার পরে ‘শেষের কবিতা’য় আমাকে লাবণ্যর চরিত্র দিলেন। সৌমিত্রদা অমিত। যত্ন করে, ধরে ধরে শিখিয়েছেন বিকাশদা। উত্তর কলকাতায় আমার রাজবল্লভ পাড়ার বাড়িতেও গিয়েছেন বোঝাতে। দারুণ হিট হয়েছিল।’’
চিত্র পরিচালক হিসেবে বিকাশ রায়ের অন্যতম উল্লেখযোগ্য কাজ ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’। আনুমানিক শ’আড়াই ছবিতে কাজ করেছেন তিনি। পরিচালনা করেছেন আটটি ছবি। এর মধ্যে পাঁচটি আবার নিজেরই প্রযোজনা। ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’ তার একটি।
ছবির নায়ক থিরুমলের চরিত্রে উত্তমকুমার। নায়িকা সাবিত্রী ছিলেন কুন্তীর ভূমিকায়। দিঘার কাছে সমুদ্র সৈকতের বালিয়াড়িতে মরুভূমি বানানো হয়েছিল। ছবিতে ব্যবহারের জন্য দু’টি উট এনে রেখেছিলেন। এক চরম নাটকীয় মুহূর্তে মানসিক বিকারগ্রস্ত থিরুমল আচমকা কুন্তীর গলা টিপে ধরবে। সেই দৃশ্য গ্রহণের কয়েক দিন আগে থেকে উত্তমকুমার চুপচাপ। বিশেষ কথা বলছেন না কারও সঙ্গে। কেমন যেন আত্মভোলা ভাব। শুটিং শুরু হল। উত্তমকুমারের দৃষ্টি বেশ অস্বাভাবিক লাগছে। গলা টিপলেন যখন, তখন যেন তিনি আর নিজের মধ্যে নেই। সাবিত্রীর দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। শট শেষ করেই ছুটে এলেন পরিচালক বিকাশ রায়। সাবিত্রীর তখন হুঁশ নেই। বমি করে অজ্ঞান। জলটল দিয়ে তাঁকে সুস্থ করে তুলে বিকাশবাবু উত্তমকে ধমক দিলেন, ‘‘তুই তো ন্যাচারাল অ্যাকটিং করতে গিয়ে মেয়েটাকেই মেরে ফেলছিলি!’’ উত্তম বললেন, ‘‘সাবু, প্লিজ ক্ষমা করে দে।’’
ছবির কাজ যখন কমে এল, তখন বেশি বয়সে মঞ্চে গেলেন বিকাশ রায়। সে-ও অনেক সাধ্যসাধনার পরে। তরুণকুমার এবং সত্য বন্দ্যোপাধ্যায় এক রকম জোর করে রাজি করালেন তাঁকে। প্রথম নাটক ‘চৌরঙ্গি’। তিনি স্যাটা বোস। চলচ্চিত্রের দৌলতে উত্তমকুমারের স্যাটা বোস তত দিনে বাজার মাত করেছে। সেই চরিত্রকে মঞ্চে ফোটাতে গোড়ায় খুব আপত্তি ছিল বিকাশবাবুর। বলেছিলেন, ‘‘উত্তমকে পর্দায় দেখার পরে আমাকে দর্শক নেবেই না।’’ উত্তম তা শুনে বলেছিলেন, ‘‘তুমি নিজেকে এত কম ভাবছ কেন? আমি জানি, তুমি নিজের মতো করে চরিত্র ফোটাবে। আমি দেখতে যাব।’’ বিকাশবাবু উত্তরে বলেন, ‘‘দর্শক আসনে তোকে দেখলে আরও নার্ভাস হয়ে যাব রে!’’ উত্তমকুমার গিয়েছিলেন। না জানিয়ে অন্ধকারে হলে ঢুকে বসে পড়েছিলেন। পরে গ্রিনরুমে গিয়ে জড়িয়ে ধরেছিলেন তাঁর বিকাশদাকে। এর পরেও আরও কয়েকটি নাটকে অভিনয় করেন বিকাশ রায়। প্রায় সবই তরুণকুমার, সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়দের সঙ্গে।
কাজের জগতের বাইরে বিকাশ রায় ছিলেন একেবারেই পারিবারিক। স্বামী, বাবা, গৃহকর্তা ঠিক যেমনটি হন। তাঁর ছেলের কাছে শুনেছি, ওঁদের বাড়িতে ফিল্ম নিয়ে আলোচনা কার্যত নিষিদ্ধ ছিল। বাবার সহকর্মী বন্ধুদের আর পাঁচ জনের মতোই কাকা, জেঠু বলে সম্বোধন করতে হত। উত্তমকাকা, ভানুকাকা (বন্দ্যোপাধ্যায়), পাহাড়িজেঠু (সান্যাল), হেমন্তকাকা (মুখোপাধ্যায়), বসন্তকাকা (চৌধুরী) ইত্যাদি। তাঁরা কাজের সূত্রে বাড়িতেও আসতেন। কিন্তু সৌজন্যের বাইরে সেখানে ছোটদের প্রবেশাধিকার ছিল না।
বিকাশবাবুর বইয়ের প্রকাশক বামাচরণবাবু বলেছেন, তিনি বছর দশেক প্রায় নিয়মিত বিকাশ রায়ের যোধপুর পার্কের বাড়িতে যাতায়াত করলেও সিনেমার লোকজনকে বড় একটা দেখেননি। দেখেছেন এক নিপাট সাদামাঠা গৃহস্থ বিকাশবাবুকে। ছেলে দীর্ঘ দিন বিদেশে। মেয়ে বিবাহিত (পরে মারাও যান)। বাড়িতে সেই সময় শুধু স্ত্রী আর তিনি। কাজ না থাকলে তাঁর একমাত্র বিনোদন ছিল বই এবং গান শোনা।
সিগারেট খেতেন। বিদেশি গাড়ির শৌখিনতা ছিল। আর হয়তো বংশের ধারায় কোঁচানো ধুতি, গিলে করা পাঞ্জাবি পরতে পছন্দ করতেন। কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনচর্যায় অন্য কোনও উচ্ছ্বলতাকে প্রশ্রয় দেননি।
পড়ায় মগ্ন
আমেরিকা থেকে তাঁর ছেলে সুমিতবাবু জানিয়েছেন, ‘‘দেশ ছাড়ার আগে পর্যন্ত আমরা সাধারণত একসঙ্গে রাতের খাওয়া সারতাম। নিয়মটা বাবুই চালু করেছিলেন। তখন খাওয়ার টেবিলে বাবু, মা, আমি, বোন সবাই মিলে কথা হত। সারা দিন কে কী করলাম তা নিয়ে আলোচনা হত। বাবু লেখাপড়ার খোঁজ নিতেন।’’
হাঁপানির প্রকোপে গলার স্বর যখন ভেঙে গেল, তখন নিজেই সিদ্ধান্ত নিলেন— আর নয়। এ বার সরে দাঁড়াতে হবে। স্ত্রীকে বলেছিলেন, ‘‘যা দিতে চাই, তা দিতে পারব না। মানুষ যা চাইবে, পাবে না। এই অবস্থায় কাজ করলে দর্শকের সঙ্গে প্রবঞ্চনা করা হবে। সেটা সইবে না।’’
ছেলে চেয়েছিলেন, বাবা-মা তাঁর কাছে আমেরিকায় গিয়ে থাকুন। যাননি। নিজের শহর, চেনা পরিমণ্ডল তাঁকে পিছু টেনে ধরেছে। শেষ জীবনে তাঁর ৪৩১, যোধপুর পার্কের ভাড়াবাড়ির রাস্তার দিকের বারান্দায় আরামকেদারায় বসে চলমান জীবন দেখতেন। বই পড়তেন, অথবা আত্মমগ্ন হয়ে ভাবতেন। কোনও দিন কোনও অভিযোগ ছিল না। চাহিদাও ব্যক্ত করেননি।  জীবনের পাওয়া-না পাওয়া নিয়ে নীরবই থেকেছেন।
 কারও হয়তো মনে পড়তে পারে ‘বনপলাশীর পদাবলি’ ছবির সেই দৃশ্য। কর্মজীবনের শেষে আপন ঘরে ফিরে জগৎ ও জীবনকে যেন নতুন করে চিনলেন শিক্ষক গিরিজাপ্রসাদ। বড় বেদনার সেই অনুভব। ভাঙা মনে, ক্লান্ত পায়ে হেঁটে আসছেন তিনি। নেপথ্যে ভেসে আসছে সংগীত— ‘সাথীহারার গোপন ব্যথা, বলব যারে সে জন কোথা...’
১৯৮৭ সালে জীবনাবসান হয় বিকাশ রায়ের। বয়স তখন ৭১।

http://www.anandabazar.com/supplementary/patrika/actor-and-book-lover-bikash-roy-never-touched-alcohol-1.779088?ref=archive-new-stry