Sunday, 23 September 2018

বই-ই শিল্প ফিনল্যান্ডে

বই-ই শিল্প ফিনল্যান্ডে

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুতে সাহিত্যে নোবেল এনেছিল এই দেশ। আজও বইকে ঘিরে চাঙ্গা ফিনল্যান্ড। বিশ্ব জুড়ে রমরমা বাণিজ্যও।

Frans Eemil Sillanpää and Sofi Oksanen

লেখক: ফ্রান্‌জ এমিল সিলানপা। ডান দিকে, সোফি ওকসানেন

ছোট্ট এক দেশ। পাহাড়, জঙ্গল, হ্রদে মোড়া। জনবসতি বড্ড কম, আরও কম তার শহুরে দিনযাপন। তিন দিকে ঘিরে থাকা সুইডেন, নরওয়ে, রাশিয়া আর বাল্টিক সাগরের জলপথ, এই সব মিলেমিশে গড়ে তুলেছে ফিনল্যান্ডের নিজস্ব সংস্কৃতি। নর্ডিক জীবনযাপনে দাগ কেটেছে স্ক্যান্ডিনেভিয়ার লালরঙা কাঠের বাড়ি কিংবা কফি-কার্ডামম বানের আড্ডা। রাশিয়া কিংবা বাল্টিক অঞ্চলের সংস্কৃতি বা রাজনীতির প্রভাবও কম নয়। ভাষা, সাহিত্য, শিল্প— ফিনল্যান্ড জুড়ে প্রভাব ফেলেছে বৈচিত্র। শতকের পর শতক পেরিয়ে এমন মিলমিশের সাক্ষী ফিনল্যান্ডের মানুষ।  
নব্বইয়ের দশকের শেষে বিশ্বে সাড়া ফেলল নোকিয়া মোবাইল ফোন। সৌজন্য ফিনল্যান্ড। দাপটে রাজত্ব করা সেই ফোনের দৌলতে চড়চড়িয়ে বাড়তে লাগল দেশের আয়। বাণিজ্যের একটা বড় অংশ জুড়ে রইল তার রফতানি। কিন্তু ব্যবসায় যেমন হয়, ২০০৭-এ প্রতিদ্বন্দ্বী এক ব্র্যান্ডের ফোন দখল নিল বিশ্বের বাজারের। ছোট্ট দেশটার অর্থনীতি ধাক্কা খেল। রাজকোষে তো বটেই, চোট আত্মবিশ্বাসেও। নতুন কিছু চাই, যার হাত ধরে ফের ঘুরে দাঁড়াবে ফিনল্যান্ড।
মন্দার বাজার তখন গোটা বিশ্বেই। তারই মধ্যে খুঁজে নিতে হবে তাকে, যাকে ঘিরে ফের চাঙ্গা হয়ে উঠবে দেশের বাণিজ্য। গোটা দেশ মাথা ঘামাল, আর বুঝেও ফেলল, দরকার শুধু উপযুক্ত ব্র্যান্ডিং। তাতেই হবে কেল্লাফতে। কিন্তু কী হতে পারে সেই জিনিস? প্রযুক্তি? সংস্কৃতি?
এর মধ্যেই চমক। ২০০৮, ফিনিশ-এস্টোনিয়ান লেখিকা সোফি ওকসানেন-এর উপন্যাস ‘পার্জ’ সাড়া ফেলে দিল সাহিত্যের দুনিয়ায়। সোভিয়েতের দখলে থাকা এস্টোনিয়ার দুই নারীর সংগ্রামের সেই কাহিনি যে শুধু ফিনল্যান্ডেরই পুরস্কার জিতে নিল তা-ই নয়, বিদেশেও জয় করল অজস্র খেতাব। বেগুনিরঙা বিনুনি আর পরিপাটি সাজগোজে, একের পর এক সাহিত্য সম্মেলনে নিজের বইয়ের প্রচার নিজেই করা ওকসানেন স্বয়ং হয়ে উঠলেন একটা ‘ব্র্যান্ড’। ৩৮টি ভাষায় তাঁর বইয়ের অনুবাদ, এবং বিপুল বাণিজ্য চোখ খুলে দিল দেশের। শুধু ফ্রান্সেই বিক্রি হল এক লক্ষ সত্তর হাজার কপিরও বেশি!
সবাই বুঝল, পৃথিবীর পাঠকের মনের মতো হয়ে ওঠার যোগ্য হয়েছে ফিনল্যান্ডের সাহিত্য। পরবর্তী ওকসানেন-এরও খোঁজ শুরু করে দিয়েছে বিশ্বসাহিত্যজগৎ। বুঝেশুনে, সাজিয়েগুছিয়ে তুলে ধরা গেলে সাহিত্যই হয়ে উঠতে পারে বিশ্বের বাজারে ফিনল্যান্ডের তুরুপের তাস। নড়েচড়ে বসল বইপাড়া।
ছোট্ট দেশটার সাহিত্যের ইতিহাস অবশ্য পুরনো। দ্বাদশ শতকের মাঝামাঝি থেকে উনিশ শতকের শুরু অবধি ফিনল্যান্ড সুইডেনের শাসনে। সুইডিশই ছিল উচ্চবিত্ত ফিনিশদের ভাষা। তবে গ্রামগঞ্জে ছড়িয়ে থাকা লোককথা— যার বেশির ভাগটাই পৌরাণিক বীরগাথা— ছিল  ফিনল্যান্ডের নিজস্ব। মালার মতো সেই ছড়া আর গান গেঁথেই অষ্টাদশ শতকের শেষ দিকে তৈরি হল ফিনল্যান্ডের মহাকাব্য ‘কালেভালা’।
উনিশ শতকে সুইডেন থেকে বেরিয়ে রাশিয়ার স্বশাসিত অংশ হল ছোট্ট দেশটা। সাহিত্যেও নিজস্বতা গড়ে তোলার ভাবনা জেগে উঠল তখনই। লেখার মাধ্যম যদিও সুইডিশ। জোহান লুডভিগ রুনবার্গ-এর লেখায় প্রথম জীবন্ত হয়ে উঠল ফিনল্যান্ডের প্রকৃতি আর জীবনযাপন। তার পর এলেন আরও ক’জন। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে আলেক্সিস কিভি-র লেখায় প্রাণ পেল ফিনল্যান্ডের সাহিত্য। কবিতা, গান, উপন্যাস, নাটক, বাড়তে লাগল সাহিত্যের পরিধি। পায়ে পায়ে ঢুকে পড়ল নরওয়ে-ফ্রান্সের প্রভাব— বাস্তবতা আর সমাজের আয়না হয়ে উঠল ফিনল্যান্ডের সাহিত্য। তাতে আধুনিক ধারা নিয়ে এলেন লেখিকা মিনা কান্থ ও অন্যেরা। স্ক্যান্ডিনেভিয়ান সাহিত্যের ধাঁচে এল বাস্তবের কথা, সমাজে মেয়েদের অবদমন আর শ্রমিক শ্রেণির দুর্দশার ছবি উঠে এল তাঁদের লেখায়। সমালোচিত হল চার্চের ভূমিকা।
উনিশ শতকের শেষ থেকেই সুইডিশ আর ফিনিশ ধারার ক্রমশ আলাদা হওয়া শুরু। বিশ শতকের শুরুতেই তাই দু’রকম ধাঁচে ভাগাভাগি হয়ে গেল ফিনল্যান্ডের সাহিত্যজগৎ। বছর গড়াল একের পর এক। দুই ধারার লেখকদের কলমে কবিতায়, গদ্যে, নাটকে, উপকথায়, গীতিকাব্যে এল আধুনিকতার নতুন স্বাদ। তাতে ঠাঁই পেল বাস্তব সমাজের কথা, ম্যাজিক রিয়েলিজ়ম, নর্ডিক ক্রাইম থ্রিলার, ব্লগ লেখনীর আঙ্গিক, নানা ধরনের নিরীক্ষামূলক বিষয়বস্তু। ইতিমধ্যে ফ্রান্‌স এমিল সিলানপা-র হাত ধরে ফিনল্যান্ডের মুকুটে এসে গিয়েছে নতুন পালক। প্রথম বার সাহিত্যে নোবেল— ১৯৩৯ সালে।
ফেরা যাক ২০০৮-এর গল্পে, ওকসানেনের তুমুল জনপ্রিয়তায় নড়েচড়ে বসা ফিনল্যান্ডে। নর্ডিক ক্রাইম থ্রিলারের চাহিদায় ভাটার টান চলছে বেশ ক’বছর হল। নতুন কোনও ধারাকে তুলে ধরার এই তো সময়! প্রাক্তন প্রকাশক এলিনা আলবাক-এর মাথায় এল আন্তর্জাতিক সাহিত্য এজেন্সি গড়ে তোলার প্ল্যান। সাহিত্যের প্রচারকে এত কাল বাঁকা চোখে দেখে আসা দেশটাকে তিনি বুঝিয়ে ছাড়লেন তার প্রয়োজনীয়তা। বললেন, সাহিত্যই হয়ে উঠতে পারে সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসা। বইয়ের রফতানি আগামী দশ বছরে বাড়তে পারে দশ গুণ।
কাজটা সহজ ছিল না। এলিনা ও তাঁর দলের অক্লান্ত পরিশ্রমে গড়ে উঠল এজেন্সি। তাবড় আন্তর্জাতিক প্রকাশনা সংস্থাগুলোর দোরে দোরে ঘুরে প্রচার চলল। গোলাপি স্যুট আর গোলাপি বিজ়নেস কার্ডে এলিনা হয়ে উঠলেন বিশ্বের তাবড় বইমেলার চেনা মুখ।
২০০৯-এ শুরু কর্মযজ্ঞ, আর ফ্রাঙ্কফুর্টের বিশ্বখ্যাত বইমেলায় ডাক এল ২০১৪ সালের অতিথি দেশ হিসেবে। মাঝের পাঁচটা বছরে নিজেকে আমূল বদলে ফেলল ফিনল্যান্ডের বইপাড়া। বাণিজ্যিক চুক্তি, ফরেন রাইটস, অন্য রকম ভাবনার সাহিত্য এবং স্লোগান ‘ফিনল্যান্ড। কুল’। তাতেই বাজিমাত!
অতিথি দেশ হিসেবে ফিনল্যান্ডের নাম শুনে যাঁরা ভুরু কুঁচকেছিলেন, বইমেলার শেষে তাঁরাই মানতে বাধ্য হলেন— দেশটার দম আছে! পাঠকের মুখে মুখে ফিরতে লাগল ফিনিশ সাহিত্যের স্বাদ। জার্মানি, অ্যাংলো-আমেরিকান দেশগুলো, যারা ক’বছর আগেও ছিল ফিনল্যান্ডের বইপাড়ার ধরাছোঁয়ার বাইরে, সেখানেই হইহই ফেলল ফিনল্যান্ডের একের পর এক নতুন লেখকের গল্প-উপন্যাস। হালে ২০১৫ সালে পেঙ্গুইন ক্লাসিকস-এও ঢুকে পড়েছে ফিনিশ উপন্যাস ‘আননোন সোলজার্স’। ফিনল্যান্ডের তিন গুণ বেড়ে যাওয়া বই-রফতানির খাতায় জার্মানিকেও টেক্কা দিয়েছে অ্যাংলো-আমেরিকান দেশের চাহিদা। নর্ডিক এজেন্সি হিসেবে একমাত্র আলবাক-এর এজেন্সিরই এখন নিউ ইয়র্ক এবং লস অ্যাঞ্জেলেস, দু’জায়গাতেই অফিস।
কেন এত জনপ্রিয় হয়ে উঠল ফিনল্যান্ডের সাহিত্য? পাঠক এবং প্রকাশক, দু’দলই একবাক্যে বলছেন— এ দেশটার সাহিত্য এক্কেবারে আলাদা স্বাদের, অদ্ভুত। আর সেটাই তার ইউএসপি। সঙ্গে ঝরঝরে লেখনী আর ঝকঝকে, টানটান প্লট। জোহানা সিনিসালো-র ‘দ্য কোর অফ দ্য সান’-এ স্বাবলম্বী নারীদের বন্ধ্যাত্বকরণ আর পায়ের নীচে শক্ত জমি না-থাকা মেয়েদের যৌনতায় ঘিরে রাখার এক নয়া ধাঁচের অবদমনের গল্প, পাজ়তিম স্তাতোভসি-র ‘মাই ক্যাট যুগোস্লাভিয়া’য় একেবারে অন্য চোখে যুগোস্লাভিয়ার পতনের কাহিনি কিংবা লরা লিন্ডস্টেট-এর ‘ওনেইরন’-এ এক অন্য জগতে সাত নারীর আলাপচারিতার মতো বিষয় মন টেনেছে সারা বিশ্বের পাঠকদের। 
ফিনল্যান্ডে সাক্ষরতার হার বরাবরই বেশি, বই পড়ার অভ্যাসও। তাই কলমও যে শক্তিশালী হবে, তাতে আর সন্দেহ কী! প্রকাশক, এজেন্সির ব্যাপক উদ্যোগের পাশাপাশি এখন মিলছে সরকারি সাহায্যও। আর তার জোরে ফিনল্যান্ডের সাহিত্যিকদের সেরা দশে থাকা জ্যানসন, ওকসানেন, লরা লিন্ডস্টেটরা তো বটেই, বছর আঠাশের স্তাতোভসি-র ঝুলিতেও ইতিমধ্যে দু’দুটো উপন্যাস! লিখছেন তৃতীয়টিও। কলম ধরছেন, খ্যাতি পাচ্ছেন আরও আরও নতুন মুখেরা।
লেখিকাদের আধিক্য এবং অদ্ভুত বিষয়বস্তু এখন ফিনল্যান্ডের সাহিত্য-বিপ্লবে দুই মূল অস্ত্র। বই-ই এখন নতুন ইন্ডাস্ট্রি, নিঃসন্দেহে!

https://www.anandabazar.com/supplementary/rabibashoriyo/how-books-became-key-economic-tool-in-finland-1.860832?ref=archive-new-stry

ইতিহাসে বাড়ি বদল (On the house of first widow-marriage)

ইতিহাসে বাড়ি বদল

রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতে ১৮৫৬ সালের ৭ ডিসেম্বর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের উপস্থিতিতে প্রথম বিধবাবিবাহের অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়। সম্প্রতি সেই ঐতিহাসিক বাড়ির খোঁজ করতে গিয়ে যে তথ্য পাওয়া গেল, তাতে বিধবাবিবাহের প্রথম বাড়ি-সংক্রান্ত ধারণার পুনর্বিবেচনা প্রয়োজন।

শেখর ভৌমিক
 
Vidyasagar

বিদ্যাসাগরের তৈলচিত্র।

নগরেতে হইয়াছে গেল গেল রব।
পলাইয়া ক্ষেত্রে যায় নরনারী সব।।
…কাহারো পলায়ে গেল বিধবা বহুড়ী।
এর বাড়ি তার বাড়ি খুঁজিছে শাশুড়ু।।

বিধবাদের জগন্নাথধাম ‘পালানো’ সম্পর্কে এই বর্ণনা পাওয়া যায় ১৮৪৯ সালের ‘সম্বাদ রসরাজ’ পত্রিকায়। উনিশ শতকে এমন পলায়ন সংবাদ রাশি রাশি। অষ্টাদশ শতকেই তো বিজয়রাম সেন বঙ্গবিধবাদের কাশীবাসের কথা লিখে গিয়েছেন, ‘‘কাশীর মধ্যেতে আছেন বিধবা জতেক/ সবাকারে দিলা কর্তা [জয়নারায়ণ ঘোষাল] তঙ্কা এক এক।’’ মনে হয়, দশাশ্বমেধ ঘাটে দাঁড়ানো ‘ঘৃষ্টগাত্রী বাঙালি তরুণী বিধবার দল’ কি এঁদেরই উত্তরসূরি? যাঁদের দেখে ‘মহাস্থবির জাতক’-এ প্রেমাঙ্কুর আতর্থী নিজেকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, সংসারের সব বাধা ছিন্ন করে রোজ সকালে তাঁরা কাকে প্রণাম করেন। লেখক নিজেই উত্তর দিয়েছেন, তাঁরা এখানে আসেন ‘মরবে’ বলে, কারণ এখানে মরলে আর জন্মাতে হয় না। আসলে বালবৈধব্য যন্ত্রণা, মদনদেবতার শর সইতে না পেরে অনেক সময় ‘গর্ভ’ হয়ে পড়া এবং তা ‘নষ্ট’ করতে গিয়ে ভবলীলা সাঙ্গ হওয়া (যেমনটা হয়েছিল চন্দ্রা নামের সেই মেয়ের, যাঁর কাহিনি অনেককাল আগে তুলে ধরেছিলেন রণজিৎ গুহ)— এ তো ছিল সে কালের নিত্যকার ঘটনা। বঙ্গবিধবা এগুলোকে অবশ্য ভাগ্য বলেই মেনে নিয়েছিলেন। তবে এক-আধটু আওয়াজ যে মাঝেমধ্যে ওঠেনি এমন নয়। নিজের শিশুকন্যার বালবৈধব্য ঘোচাতে রাজা রাজবল্লভ অনেক কাল আগে বিধবাবিবাহ প্রচলনে উদ্যোগী হয়েছিলেন, কিন্তু নবদ্বীপের পণ্ডিতসমাজের বিরোধিতায় তা বানচাল হয়ে যায়। ডিরোজিয়োপন্থীদের উদ্যোগের কথা ‘বেঙ্গল স্পেকটেটর’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৪২-এ। তার পর প্রায় এক দশকেরও বেশি সময় অতিক্রান্ত হয়েছে। শেষ পর্যন্ত এই উদ্যোগ সার্থক রূপ পেল বীরসিংহের ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের জ্যেষ্ঠ পুত্রটির মাধ্যমে— বাংলাদেশে যিনি করুণাসাগর বিদ্যাসাগর নামেই বেশি পরিচিত।
বিদ্যাসাগর প্রাথমিক ভাবে কেন বিধবাবিবাহ নিয়ে এগিয়ে আসেন তা নিয়ে উনিশ শতকে তাঁর দুই জীবনীকার বিহারীলাল সরকার এবং চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষ্য আলাদা। তাঁর ছোট ভাই শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্নের বক্তব্যটিই অনেকে বেশি গ্রহণযোগ্য মনে করেন (‘বিদ্যাসাগর-জীবনচরিত ও ভ্রমনিরাস’)। চণ্ডীচরণের মতে, সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপক শম্ভুচন্দ্র বাচস্পতির বালিকাবধূর অকালবৈধব্য বিদ্যাসাগরকে এই ‘মহৎ কর্মে ব্রতী’ হওয়ার জন্য প্রাণিত করে। বিহারীলাল লিখেছেন, বীরসিংহে বিদ্যাসাগরের এক বাল্যসহচরী ছিল। সে অকালে বিধবা হয়। এক দিন তিনি শুনলেন একাদশী বলে মেয়েটি সারা দিন খায়নি। আর শুনে তিনি কেঁদেই ফেললেন। তবে এই দুটো ঘটনাই তাঁর ছাত্রজীবনে ঘটা। আর শম্ভুচন্দ্র যা বলছেন তা তাঁর কর্মজীবনের শেষ দিকের। ঘটনা এ রকম যে, এক দিন বিদ্যাসাগর বাড়ির চণ্ডীমণ্ডপে বসে বাবার সঙ্গে স্থানীয় বিদ্যালয়গুলোর অবস্থা সম্পর্কে যখন আলোচনা করছেন, তখনই তাঁর মা ‘রোদন করিতে করিতে’ সেখানে এসে ‘একটি বালিকার বৈধব্য-সংঘটনের উল্লেখ করত,’ তাঁকে বললেন ‘তুই এত দিন যে শাস্ত্র পড়িলি, তাহাতে বিধবাদের কোনও উপায় আছে কিনা?’ তাঁর বাবাও তখন জানতে চাইলেন, ধর্মশাস্ত্রে বিধবাদের প্রতি শাস্ত্রকারেরা কী কী ব্যবস্থা করেছেন? এর পরই নাকি ‘শাস্ত্র-সমুদ্র মন্থন’ করে তিনি লিখলেন ‘বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা’ শীর্ষক প্রবন্ধটি, যা ১৮৫৪-র ফেব্রুয়ারিতে ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’-য় প্রকাশিত হয়। ১৮৫৫-র জানুয়ারিতে প্রকাশিত হল তাঁর ‘বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব।’ এর পরই সৃষ্টি হল প্রবল আলোড়ন। শেষে ১৮৫৬-র ২৬ জুলাই অনুমোদিত হল বিধবাবিবাহ আইন। আর চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘মাসত্রয় অতীত হইতে না হইতেই এ বৎসরের অগ্রহায়ণ মাসের ত্রয়োবিংশ দিবসে বিধবাবিবাহের অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়।’ ১৮৫৬-র ৭ ডিসেম্বর রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কলিকাতার অন্তঃপাতি সিমুলিয়ার সুকেস স্ট্রিটের ১২ সংখ্যক ভবন’-এ পটলডাঙার লক্ষ্মীমণি দেবীর দশ বছরের বিধবা কন্যা কালীমতির সঙ্গে প্রসিদ্ধ কথক রামধন তর্কবাগীশের কনিষ্ঠ পুত্র শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্নের বিবাহ হয়। রাজকৃষ্ণবাবু বিদ্যাসাগরের ‘আ-যৌবন সুহৃদ’। বৌবাজারে থাকাকালীন হৃদয়রাম ওরফে হিদারাম বাঁড়ুয্যের এই পৌত্রটির সঙ্গে বিদ্যাসাগরের পরিচয়। তাঁর কাছেই রাজকৃষ্ণবাবুর সংস্কৃত শিক্ষা।
‘সংবাদ প্রভাকর’-এ এই বিবাহ এবং তার পরবর্তী ঘটনাগুলোর বিস্তারিত বিবরণ প্রকাশিত হয়েছিল। ১৫ অগ্রহায়ণ বিয়ের দিন স্থির হলেও শ্রীশচন্দ্র নাকি ‘সময়কালে মাতৃপ্রতিবন্ধকের ছল করিয়া প্রতিজ্ঞাভঙ্গ’ করেন। পত্রিকায় আবার লিখেছে, ‘লোকে কহিতেছে’ পাত্রী বিধবা নয়, ন্যায়রত্ন মহাশয় অনেক টাকা দিয়ে কুমারী মেয়ে কিনে এনেছেন। শেষ অবধি অবশ্য ৭ ডিসেম্বর বিবাহটি হয়। বাবু রামগোপাল ঘোষ, রমাপ্রসাদ রায়, দিগম্বর মিত্র, প্যারীচাঁদ মিত্র বা কালীপ্রসন্ন সিংহের মতো সমকালীন কলকাতার তাবড় ‘সেলেব’রা সেখানে হাজির ছিলেন। ‘ভাস্কর সম্পাদক’ নাকি ‘নাকে চশমা দিয়া পাঁজি পুঁথি খুলিয়া উক্ত বিবাহ সমাজের মধ্যস্থলে বসিয়া ছিলেন।’ আর ‘রঙ্গতৎপর লোক সমারোহে রাজপথ আচ্ছন্ন হইয়াছিল, সারজন সাহেবরা পাহারাওয়ালা লইয়া জনতা নিবারণ করেন’। লক্ষ্মীমণি নাকি পাত্রের ‘চক্রাকার রূপচাঁদের মোহন মন্ত্রে মুগ্ধা’ হয়ে তাঁকে কন্যা সম্প্রদান করেন। আর ‘কড়ি দে কিনলেম্, দড়ি দে বাঁদলেম, হাতে দিলেম মাকু, একবার ভ্যা করতো বাপু’— মহিলাদের এ জাতীয় ‘প্রার্থনায়’ বরবাবাজি নাকি ‘ভ্যা ও করিয়া ছিলেন।’ পত্রিকা লিখছে, ‘এইক্ষণে বিদ্যাসাগর আনন্দসাগর সলিলে পরিপূর্ণ হইয়াছেন’ এবং এই বিবাহে ‘বাবু রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের গৃহ পবিত্র হইয়াছে।’
বৌবাজার ত্যাগ করে সুকিয়া স্ট্রিটে বাড়ি তৈরি করে রাজকৃষ্ণবাবুর বসবাসের কথা কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্যের স্মৃতিকথায় পাওয়া যায়। আর এই বাড়িতেই যে বিবাহটি অনুষ্ঠিত হয় তা নিয়েও সংশয় নেই। কিন্তু প্রশ্ন হল আজ সেই বাড়িটির অবস্থান কোথায়? ১৯৬১-তে শ্রীপান্থ লিখেছেন, সুকিয়া স্ট্রিটের এই অংশের নাম আজ কৈলাস বোস স্ট্রিট। বাড়ির সংখ্যাও আর ‘১২’ নেই। যদি কেউ বাংলার প্রথম বিধবাবিবাহ বাসরটি খুঁজে পেতে চান, তা হলে ‘‘এ দিকে সে দিকে ঘুরে তাঁকে দাঁড়াতে হবে ‘৪৮ এ’ এবং ‘৪৮ বি’ নম্বর আঁটা যমজ বাড়িটির সামনে।’’ পরবর্তী কালে সুনীল মুন্সি (১৯৭৪) এবং রাধারমণ মিত্রও (১৯৭৭) এই ‘৪৮’ সংখ্যক বাড়িটিকেই অতীতের ১২ নং বলে নির্দিষ্ট করেছেন।
ঠিকানা: প্রথম বিধবাবিবাহের বাড়ি হিসেবে চিহ্নিত ৪৮ কৈলাস বোস স্ট্রিট।
১৮৫৯-৬৯ সালের কলকাতার ‘স্ট্রিট ডিরেক্টরি’গুলোতে ‘১২’ সংখ্যক বাড়িতে রাজকৃষ্ণবাবুর নাম পাওয়া যাচ্ছে, এক বার তাঁর সঙ্গে পদ্মলোচনেরও নাম আছে। তার পুব দিকে ‘১৩’-তে ছিল থানা এবং ‘১৪’-র মুখে রঘুনাথ চট্টোপাধ্যায় স্ট্রিট। তখন এই রাস্তায় ২৩ নং বাড়ির অস্তিত্ব ছিল না। ১৮৬৯-৭০’এর মধ্যে পুরনো ১২ থেকে ১৪ নম্বরের জায়গায় অনেক নতুন বাড়ি ওঠে, এবং পুরসভার খাতায় নতুন নম্বর দাঁড়ায় ১২ থেকে ২৪। ১৮৭০-এর ডিরেক্টরিতে প্রথম ২৩ নম্বরে পাচ্ছি রাজকৃষ্ণবাবুকে। আর ১৮৭১-এ ১২ নম্বরের বাসিন্দা প্রিয়নাথ দত্ত। সম্ভবত রাজকৃষ্ণবাবু এই সময় ২৩ নম্বরে নতুন বাড়ি করে উঠে আসেন। ১৮৭০-৭১-এর ডিরেক্টরিতে ২৪ নম্বরে রয়েছে বিদ্যাসাগরের সংস্কৃত প্রেস ডিপজ়িটরি। ১৮৭২-এর ডিরেক্টরিতে দেখছি ২৪ সংখ্যক ভবনে বিদ্যাসাগর প্রতিষ্ঠিত ‘মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশন’। পূর্ণচন্দ্র দে কাব্যরত্ন, উদ্ভটসাগর ১৯৩০ নাগাদ লিখেছেন, ‘‘এখন সুকিয়া স্ট্রিটের পার্শ্বস্থিত স্বর্গত রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ের বাড়ির পূর্বদিকে লাহা-বাবুদের যে প্রাসাদ রহিয়াছে, ঠিক সেইখানেই বিদ্যাসাগর মহাশয়ের ‘মেট্রোপলিটন কলেজ’ ছিল।’’ ১৯১৫-র পি এম বাকচি-র ‘কলিকাতা স্ট্রিট ডাইরেক্টরি’তেও ২৩ নং বাড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়দের। আরও পরে এই ‘২৩’ সংখ্যক বাড়িটির পরিবর্তিত ঠিকানা দাঁড়ায় ‘৪৮’, যে কথা শ্রীপান্থ প্রমুখ লিখেছেন। বর্তমানেও ৪৮এ নং বাড়িতে বাস করেন রাজকৃষ্ণের উত্তরসূরিরাই।
৩২ কৈলাস বোস স্ট্রিট।
খটকা লেগেছিল কয়েক মাস আগে। বিদ্যাসাগর কলেজের আশপাশ চিনতে এই কলেজের ইতিহাস বিভাগের ছাত্রছাত্রীরা যখন এই অ়ঞ্চলটি পায়ে হেঁটে দেখতে বেরোয়, তখন ওদের সঙ্গে থাকার সুযোগ হয়েছিল। আর তখনই কিছু প্রশ্ন আসে। প্রথমত পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য মহাফেজখানায় রাখা ১৮৯৪ সালের এক জরিপ নকশায় (সমীক্ষা ১৮৮৭-৯৩) ‘১২’ সুকিয়া স্ট্রিটের যে অবস্থান, মদন মিত্র লেনের বিপরীতে, তার সঙ্গে এখনকার ৪৮এ/বি কৈলাস বোস স্ট্রিটে বিধবাবিবাহ বাসরের গল্পটা ঠিক মেলানো যাচ্ছে না। কারণ রাজকৃষ্ণবাবুর যে ‘২৩’ সংখ্যক বাড়ি (যা পরে ‘৪৮’ হয়েছে), তার অবস্থান মদন মিত্র লেনের মুখ থেকে অনেকটা পুবে, এর মাঝে অনেকগুলো ‘premises’ রয়েছে। অন্তত ১৮৭১-এর স্ট্রিট ডিরেক্টরি থেকে ১৮৯৩-তে প্রকাশিত প্যারীমোহন দাস-এর ‘কলিকাতা পথ-প্রদর্শক এবং ডাইরেক্টরি’ পর্যন্ত সুকিয়া স্ট্রিটে মদন মিত্র লেনটি যেখানে শুরু হচ্ছে, তার ঠিক দক্ষিণ দিকের বা বিধান সরণি দিয়ে ঢুকলে ডান দিকের বাড়ির (তখন ১২, বর্তমান ৩২ নং) বাসিন্দা (occupier) হিসেবে পাচ্ছি প্রিয়নাথ দত্তকে। কলকাতা পুরসভার ১৮৯০-৯২’এর নথি অনুযায়ী ১২ নং এই দোতলা বাড়ির মালিক ছিলেন মন্তাজি (মাহাতাজি) গয়ালি এবং লাগোয়া ১১ নং বাড়িও ছিল হীরালাল পাঠক গয়ালির (গয়ার পাণ্ডাদের ‘গয়ালি’ বলা হত)। ‘মনোমোহন বসুর অপ্রকাশিত ডায়েরি’তে প্রিয়নাথ দত্তকে ‘রাধাকৃষ্ণ মাহাতো (মাহাতা) নামক গয়ালীর গমস্তা’ হিসেবেই পরিচয় দেওয়া হয়েছে। ১৯১৫-য় এই বাড়ির বাসিন্দা নারায়ণলাল মহৎ। ১৯৩৬-এ ৩২ কৈলাস বোস স্ট্রিটের বাড়ির বাসিন্দা এন এল মাহাতা (N L Mahata)। অনুমান করা যায় নারায়ণলাল মহৎ ও এন এল মাহাতা একই ব্যক্তি। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে সে কালে অনেকেই গয়ার পাণ্ডাদের ঘরবাড়ি বা জমি দান করতেন। ৩২ নং বাড়ির মালিক বাস্তবিকই ছিল এই মাহাতা পরিবার। এর বর্তমান বাসিন্দা শিশু মণ্ডল বাড়ি হস্তান্তরের সময় গয়ার পাণ্ডারা এসেছিলেন বলে জানিয়েছেন। তথ্যটি সমর্থন করেছেন গয়ার কৃষ্ণদ্বারিকা মহল্লার বাসিন্দা, নারায়ণলালের অন্যতম অধস্তন পুরুষ অরুণলাল মাহাতা। পাশাপাশি তিনি আরও জানিয়েছেন ‘ঠনঠনের কোনও এক দত্ত’ নাকি এই বাড়ি তাঁদের দিয়েছিলেন। তা হলে কি রাজকৃষ্ণবাবুই ১৮৬৯-৭০-এর মধ্যে দত্তদের কাছে ওই ১২ নং বাড়িটি বিক্রি করেছিলেন?
শ্রীশচন্দ্র ন্যায়রত্ন   
মানচিত্র অনুযায়ী এটা স্পষ্ট যে, রাজকৃষ্ণবাবুর যে বাড়িতে (১২ নং সুকিয়া স্ট্রিট) প্রথম বিধবাবিবাহটি হয়েছিল তা কোনও মতেই আজকের ৪৮ নং কৈলাস বোস স্ট্রিট নয়। কারণ ১৮৫৯-র ‘ডিরেক্টরি’-তে ‘১২’-র যা অবস্থান, উনিশ শতকের প্রায় শেষ দিকের মানচিত্রে তার অবস্থানে বিশেষ বদল ঘটেনি। এটা বলা হচ্ছে কর্নওয়ালিস স্ট্রিট, রঘুনাথ চট্টোপাধ্যায় স্ট্রিট ও মদন মিত্র লেনের অবস্থানসাপেক্ষে। আজও মদন মিত্র লেনের মুখোমুখি ঠায় দাঁড়িয়ে ৩২ কৈলাস বোস স্ট্রিট, সে দিনের ১২ নং সুকিয়া স্ট্রিটের ‘premises’। ‘১২’ বদলে গিয়ে ‘২৩’ (পরবর্তী কালের ৪৮ কৈলাস বোস স্ট্রিট) হয়নি কারণ দু’য়ের মাঝে আজ প্রায় ছ’খানা বাড়ির দূরত্ব। সুতরাং এই ‘৪৮’ রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের দ্বিতীয় আশ্রয় বলেই ধরা যেতে পারে, প্রথম ভদ্রাসন এখানে ছিল বলে মনে হয় না। যাই হোক অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময় ধরে প্রচলিত ও এই বিধবাবিবাহের প্রথম বাড়ি-সংক্রান্ত ধারণার পুনর্বিবেচনা তাই প্রয়োজন।
রাজকৃষ্ণবাবুর বাড়ি থেকে যার সূচনা, তার সাফল্য কত দূর? মনে রাখতে হবে বিধবাবিবাহ নিয়ে আজও আমাদের ‘কেমন কেমন ভাব’টাকে। বিদ্যাসাগরের লড়াই ছিল সারা জীবনের। ‘শ্রীশচন্দ্রকে বৃক্ষে তুলিয়া দিয়া নিম্নে দণ্ডায়মান থাকিয়া সাহস প্রদান করিতেছেন’ বলে ‘প্রভাকর’-এর তির্যক মন্তব্যও সইতে হয়েছে তাঁকে। বালির কয়েক জন ভদ্রসন্তান ওই অনুষ্ঠানে কেবল দর্শক থাকার অপরাধেই অপদস্থ হন। আর ‘সুরধুনী কাব্য’য় উল্লিখিত ‘বিধবা সধবা করা পথ প্রদর্শক’ শ্রীশচন্দ্র তো স্ত্রীর মৃত্যুর পর প্রায়শ্চিত্ত করেই জাতে ওঠেন। আবার অন্য ছবিও ‘প্রভাকর’ই তুলে ধরেছিল— সিউড়ির শ্রীহরি চক্রবর্তী ‘জ্ঞাতি কুটুম্বের তাড়না’ সত্ত্বেও ‘বিধবাপত্নী ত্যাগপূর্বক প্রায়শ্চিত্ত করিয়া সমাজ ভুক্ত হইতে সম্মত’ হননি। তবে ‘বিধবার গর্ভ হওয়াতে সমাজ ভয়ে উহার আত্মীয়গণ ঔষধ প্রয়োগ বশত তাহা নষ্ট করে’— এ জাতীয় খবর উনিশ শতকের শেষ দিককার পত্রপত্রিকায়ও অজস্র। এমনকি হুগলিতে দুই যুবতী বিধবার মধ্যে সমকামী সম্পর্কের ইঙ্গিতও আছে ‘সম্বাদ রসরাজ’-এর মতো কাগজে। তা হলে কি বলব সার কথাটা অনেককাল আগেই বুঝে গিয়েছিলেন জানবাজারের ওই বুদ্ধিমতী মহিলাটি? ১২৮৬ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত ‘রাণী রাসমণির জীবনচরিত’-এ হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছিলেন, সহমরণ প্রথা উঠিয়ে দেওয়ার সংবাদে রাণীর প্রতিক্রিয়া ছিল— এটা ‘‘ভালই বটে, কিন্তু বঙ্গ বিধবাদের পরিত্রাণের অন্যবিধ উপায় রহিল না। তাহারা যে কত কলঙ্ক রাশিতে কলঙ্কিত হইবে বলা যায় না।’’ হেমচন্দ্র আরও বলছেন, ‘‘বিশ্বস্তসূত্রে অবগত হওয়া গিয়াছে যে, তিনি (রাসমণি) বিধবাবিবাহের উপসংহার ও বহুবিবাহ পুস্তকের অনেকাংশ শ্রবণ করিয়া সময়ে সময়ে অশ্রুবর্ষণ করিয়াছিলেন।’’

https://www.anandabazar.com/supplementary/rabibashoriyo/first-widow-remarriage-that-took-place-at-the-house-of-raj-krishna-bandhopadhyay-1.868868?ref=rabibashoriyo-new-stry

Sunday, 12 August 2018

‘নবভারত’ লিখতে চাই (On Tarashankar Bandopadhyay)

‘নবভারত’ লিখতে চাই

ভারতের নানান প্রদেশের এক জন করে লেখক লিখবেন বইয়ের এক-একটা পর্ব, ‘বঙ্গপর্ব’ লিখবেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। এমনটাই ভাবা ছিল। কিন্তু তার পর?

শিশির রায়
 
Tarasankar Bandyopadhyay

তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়।

মহাভারতের আদলে তিনি লিখতে চেয়েছিলেন ‘নবভারত’। ‘আদলে’ কথাটা ভুল হল। চিরন্তন মহাকাব্যের অনুকরণ-অনুসরণ নয়, আসলে লিখতে চেয়েছিলেন উনিশ ও বিশ শতকের ভারতের উত্তরণের কাহিনি। মহাভারতের মতোই, এই ‘নতুন’ ভারতেও তো কত ঘটনার ঘটা, কতশত চরিত্রের সমাবেশ! তাদের জীবন ও কীর্তি দেশকে উঠিয়েছে সভ্যতার উচ্চাসনে। এই আধুনিক ভারতকথা লেখা হোক, চেয়েছিলেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়।
নিজের লেখায় প্রস্তাবও দিয়েছিলেন এই মহাগ্রন্থের। ‘...শতবর্ষের ইতিহাস ও উপাখ্যান নিয়ে মহাভারতের মত নবভারত রচিত হোক। বিভিন্ন প্রদেশ নিয়ে বিভিন্ন পর্ব।’ বোঝাই যাচ্ছে, বইটি হবে বিপুলায়তন। লিখেছিলেন, ‘এ বিরাট কর্ম একজনের নয়— ভারতের বিভিন্ন ভাষায় প্রতিনিধিমণ্ডল নিয়ে বিচার করে এক একজনের উপর এক এক পর্বের ভার দেওয়া হোক।...নায়ক স্থির হোক। শেষ স্থির হোক।’
এ লেখা যখন লিখছেন তারাশঙ্কর, তখন বিশ শতকের অর্ধেক পেরিয়ে গিয়েছে। ভারত স্বাধীন। মহাত্মা গাঁধী নিহত। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধান্তে যেমন মহাভারতের ইতি, তেমনই মহাত্মার জীবনাবসানে নতুন ভারতকথার মহানাটকীয় ইতি, মনে হয়েছিল ‘গণদেবতা’-র লেখকের। সঙ্গে সঙ্গেই বলছেন, কী করেই বা বলি শেষ। কারণ দেশভাগ, অসংখ্য মানুষের ভিটেমাটিছাড়া হওয়ার ঘটনাও যে ঘটে গিয়েছে এরই মধ্যে। বহু সার্থকতার মধ্যে এই জ্বলজ্বলে অসার্থকতাটুকু মনে করিয়ে দিচ্ছে, সাফল্য-ব্যর্থতার এই নিরন্তর দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়েই বয়ে চলবে ভারতজীবন। এই দ্বন্দ্ব, এই অসমাপ্তিও ‘নবভারত’-এরই অংশ। এক-একটি প্রদেশের এক জন করে লেখক যদি সত্যিই লেখেন একটা করে পর্ব, তারাশঙ্কর লিখছেন, ‘এই মহাকাব্যের একটি অংশ লেখার ইচ্ছা আমার’।
এই ‘ইচ্ছা’র পিছনেও এক অন্য পটভূমি। জীবনভর বিস্তর লেখালিখির পরেও আসলে যে বইটা, যে একক অনন্য দুর্দান্ত বইটা লেখার ইচ্ছে মনের মধ্যে থাকে লেখক মাত্রেরই, সেই বই লেখার প্রসঙ্গেই তারাশঙ্করের এত কথা। প্রত্যেক লেখকের মধ্যেই থাকে একটা ‘যে বই লিখতে চাই’ সিনড্রোম। যে বই লিখলে আমার জীবন পূর্ণ, সার্থক হবে। যে বইয়ে ‘বর্তমান জগতের পটভূমিতে চরম ও পরম-সত্যকে উদ্‌ঘাটিত করতে হবে’। যা লিখলে আসবে খাঁটি পরিতৃপ্তি। তারাশঙ্কর বলছেন, ‘নবভারত’ তাঁর সেই ‘লিখতে চাওয়া’ বই। তিনি কল্পনা করেন, ‘একখানা নূতন কাগজ টেনে নিয়ে যত চমৎকার করে আমার সাধ্য আমি লিখব— নবভারত, বঙ্গপর্ব-রচয়িতা তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়’।
কিন্তু কেন লেখা হল না সেই বই? তারাশঙ্কর বলছেন তাঁর পড়া একটা বিদেশি ছোটগল্পের কথা। সুপণ্ডিত এক লেখক ঘোষণা করলেন, চিরস্মরণীয়, মহৎ এক বই লিখবেন তিনি। নতুন ঘর হল, নতুন কাগজ-কলম— বই লেখা হবে বলে। ঘরের মধ্যে স্বেচ্ছাবন্দি হলেন লেখক। দিন যায়। স্ত্রী এসে খাবারটুকু দিয়ে যান, দেখেন, রাশি রাশি বই স্তুপীকৃত পড়ে, বই লিখবেন বলে বই পড়ছেন লেখক স্বামী। মাস গড়ায়, উৎসুক সবাই জানতে চায়, কদ্দূর এগোলো? স্ত্রী বলেন, এই তো, শিগগিরই শেষ হবে। বছর ঘোরে, স্ত্রী দেখেন, আর বই পড়ে থাকে না মেঝেতে, পড়ে থাকে শুধু রাশি রাশি কাগজ, ছেঁড়া, দলা পাকানো। এক দিন ভারী কী একটা পড়ার শব্দে দৌড়ে এসে স্ত্রী দেখেন, লেখক পড়ে আছেন মেঝেতে। মৃত। সারা দেশ ভেঙে পড়ে বাড়িতে। কোথায় সেই ‘মাস্টারপিস’? সবাই আবিষ্কার করে, ঘর ভরা শুধু সাদা কাগজ। কেবল একটায় লেখা একটিমাত্র শব্দ— ‘কল্পনামৃত’! নীচে লেখক হিসেবে ওঁর নাম। ব্যস, এইটুকুই।
আসলে যে বই লিখতে চাই, তা তো লেখা হয় না কখনও। তাই ‘নবভারত’ও লেখা হয়নি। ‘জীবন শেষ হবে, সেদিন সকলে ছুটে আসবেন  বঙ্গপর্বের জন্য, খুঁজে দেখবেন; পাবেন শুধু শেষ লেখা কাগজ একখানি— তাতে লেখা আছে নবভারত বঙ্গপর্ব-রচয়িতা তারাশঙ্কর— বাকি কাগজগুলি সব সাদা— সব সাদা— সব সাদা।’

https://www.anandabazar.com/supplementary/rabibashoriyo/tarasankar-bandyopadhyay-wanted-to-write-stories-about-modern-india-1.839580?ref=strydtl-rltd-rabibashoriyo

চলে গেলেন বারেন্দ্র ইহুদি 

জন্ম, মৃত্যু কলকাতায়। ঢাকা টেলিভিশনের প্রথম ঘোষক। সিরাজউদ্দৌলা, সাগিনা মাহাতো-য় অভিনয়। বাংলা-গান-পাগল ইহুদির জীবন জুড়ে বাঙালিয়ানার আশ্চর্য উদ্‌যাপন।

ঋজু বসু
 
Mordechai Cohen
কী  চোখে তোমায় দেখি বোঝাতে পারিনি আজও হয়তো, এ দেখাই শেষ দেখা নয় তো!’ খোলা গলায় মান্না দে ধরলেন মর্ডিকাই হাইম কোহেন, কলকাতার শেষ ইহুদিদের এক জন। মারণ কর্কট রোগে ৭৪ বছরের প্রবীণের শরীরটা তখন প্রায় ঝাঁজরা।
এমন সাহসী কিন্তু নরম মনের রোগী বড় একটা দেখেননি ডাক্তারবাবু, সোমনাথ সরকার। প্রস্টেটের ক্যানসার ধরা পড়েছিল, ফোর্থ স্টেজে। যন্ত্রণায় তখন নুয়ে পড়ছে শরীরটা। কিন্তু মর্ডির জীবন থেকে সুর কেড়ে নিতে পারেনি। রোগশয্যায় তাঁর সঙ্গী শরৎচন্দ্রের কোনও বই। আর সারা ক্ষণ গুনগুন চলছে। রেডিয়েশন নিতে হাসপাতালে এলে রোগী নিজেই ডাক্তারকে গানের টানে কাবু করতেন। কেবিনে তাঁদের ঘিরে তখন মান্না, হেমন্ত, মানবেন্দ্র, শ্যামল, কিশোর, ধনঞ্জয়রা। ডাক্তারের কাছে অলৌকিক কিছুর আশা ছিল না মর্ডির। কড়া কেমো-টেমোর দরকার নেই। হাসপাতালের আইসিইউ-তে থাকব না। শুধু যত দিন বাঁচব, একটু শান্তিতে বাঁচি যেন। আর দু’টি ছোট আবদার ছিল।
মৃত্যুর আগে এক বার ইজরায়েলে যেতে চেয়েছিলেন। সেটা ঠিক ইহুদি ধর্মের আঁতুড়ঘর বলে নয়। দুই ছেলে রাফায়েল ও মিখাইল, মেয়ে এমা, তাদের পরিবারসুদ্ধ কোহেন দম্পতি একজোট হবে বলে। কলকাতায় জন্মানো তিন সন্তান, একে একে ছিটকে যায় আমেরিকা-ইজরায়েলে। বুড়োবুড়ি মর্ডি আর জো শুধু এই শহরে পড়ে। ১৯৯২-এর পরে ছেলেমেয়েদের কখনও একসঙ্গে দেখা হয়নি। কোহেনদের সেই শেষ পারিবারিক পুনর্মিলন, ২০১৫-তে। ইজরায়েলে।
এর ঠিক বছর দেড়েক আগে আর একটি সফরে যেতেও মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন মর্ডি। ঢাকায়। ২০১৪-য় ঢাকা টেলিভিশনের সুবর্ণ জয়ন্তী। ঢাকার প্রথম টিভি ঘোষক এবং সংবাদ পাঠক মর্ডিই। তখন পাকিস্তান টিভি-র যুগ। ঢাকায় টিভি-র প্রথম শব্দটা বাংলায় মর্ডিই উচ্চারণ করেছিলেন। স্বাধীন বাংলাদেশ ভোলেনি তাঁকে। টিভি-র অর্ধ শতক পূর্তি উৎসবে ঢাকায় নেমন্তন্ন পান তিনি। মর্ডি কলকাতার জাতক। কিন্তু ইস্কুল, কলেজ রাজশাহীতে। ’৬৭-৬৮’তে আরব-ইজরায়েল যুদ্ধ শুরু না-হলে তিনি কখনও সে-দেশ ছাড়তেন না। প্রথম যৌবনেই কলকাতায় চলে আসতে হলেও বাংলাদেশ মর্ডির কাছে এক নাড়িছেঁড়া টানের চিহ্ন। সেই ভালবাসার দেশকে দেখতে চেয়েছিলেন! 
দীর্ঘদেহী সুপুরুষের হাড়ে হাড়ে তখন মারণ রোগে ঘুণ ধরছে। বিমানযাত্রার ধকল সইবে তো! এক বার হোঁচট খেলেই কেলেঙ্কারি। কিন্তু মর্ডির মুখ দেখে ডাক্তারবাবু না করতে পারেননি। ওষুধ, ইঞ্জেকশনের ডোজ পালটে শারীরিক অবস্থা স্থিতিশীল রাখার চেষ্টা হল। ডাক্তারবাবুর মনে পড়ে, কৃতজ্ঞ মর্ডি তাঁর হাতটা ধরেছেন। যাওয়ার আগে ঠোঁটে গান, ‘এ দেখাই শেষ দেখা নয় তো।’
ভালবাসা: কলকাতার নারকেলডাঙায় ইহুদি সমাধিক্ষেত্রে মর্ডির সমাধিফলকে বাংলার ছোঁয়া। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী
ইজরায়েল থেকে ফেরার পরে বড়জোর মাসখানেক বেঁচেছিলেন মর্ডি। এখন মনে হয়, শেষ দেখা দেখতে তাঁকে ফিরতেই হত এই বাংলায়। মর্ডির প্রজন্মের কলকাতার অন্য ইহুদিরা অনেকেই স্বজাতির ঘেরাটোপে বন্দি থেকেছেন। শেষ জীবনে ইজরায়েলে ফিরে ধর্মকর্ম করে পুণ্যভূমিতে মৃত্যুই ছিল তাঁদের পরম কাঙ্ক্ষিত। মর্ডি ঠিক উলটো। বাংলা বই, বাংলা গান, বাংলা কাগজ পড়া, বাংলায় আড্ডা— এ সব ছাড়া যেন হাঁসফাঁস করতেন। তাই দলে দলে ইহুদিরা মসৃণতর জীবনের আশায় কলকাতা ছাড়লেও মর্ডি সে দলে নাম লেখাননি। তাঁর জীবনদর্শন, আমার এই দেশেতে জন্ম, যেন এই দেশেতেই মরি! কলকাতার পার্ক লেনের বাসিন্দা মর্ডিকাই কোহেনের সান্নিধ্যে যাঁরা এসেছেন, তাঁরাই বাংলার প্রতি এই ভালবাসা টের পেয়েছেন। 
বছর পাঁচেক আগে এই শহরের আর এক স্মরণীয় ইহুদি, নিউ মার্কেটের কেক-বিপণির কর্তা ডেভিড নাহুমের স্মরণসভায় মর্ডিকে দেখে হাঁ হয়ে গিয়েছিলাম। তখনও তাঁর ক্যানসার ধরা পড়েনি। লালমুখো লম্বা ইহুদি প্রৌঢ় ঈষৎ খুঁড়িয়ে হাঁটছিলেন। আলাপ হতেই প্রশ্ন, ‘‘আমি কে জানো?’’ চুপচাপ তাকিয়ে আছি দেখে নিজেই বললেন, ‘‘আমি হলাম ‘বারেন্দ্র জু’।’’ এটা শুনে আরও ভ্যাবাচাকা খাওয়ার দশা। তখন মর্ডির ব্যাখ্যা, ‘‘আরে
বাবা, রাজশাহীকে বরেন্দ্রভূমি বলে জানো তো! ওখানেই আমার স্কুল, বড় হওয়া, সব।’’ তখন শাহবাগ আন্দোলন ঘিরে উত্তাল বাংলাদেশ। সেই প্রসঙ্গ টেনে বললেন, ‘‘কী যেন স্লোগানটা! পদ্মা, মেঘনা, যমুনা/ তোমার আমার ঠিকানা! আমি তো বাংলা মাধ্যমেই পড়েছি। সবটা আমার সঙ্গে মিলে যায়, বুঝলে!’’
মর্ডির স্ত্রী জো কার্শিয়াংয়ের কনভেন্টের ছাত্রী। আদতে লখনউয়ের ইহুদি কন্যা। জো ইংরেজি, হিন্দি বললেও মর্ডি বউয়ের সঙ্গেও প্রায়শই বাংলা চালাতেন। ‘‘সত্যি বলতে, ইহুদি পরিচয় নিয়ে তত মাথাব্যথা ছিল না ওর। নিজেকে বাঙালিই ভাবত মর্ডি,’’ স্বামীর স্মৃতিচারণ করছিলেন জো। সব চেয়ে ঝামেলা হত যখন ছেলেমেয়েরা কলকাতার স্কুলে বাংলা পড়ত। মর্ডি খানিক সাধুভাষার বাংলাপন্থী। বাচ্চাদের পড়াতে বসে ইস্কুলের বাংলা খাতা দেখে গজগজ করতেন।
জো-র মনে আছে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোয় সব সময়ে বাড়িতে অনাহূত অতিথির ভিড়। তখন সদ্য বিয়ে হয়েছে দম্পতির। চিলতে ফ্ল্যাটে কয়েক সেট বাড়তি গেঞ্জি, লুঙ্গি— সব সময়ে কেচেকুচে রেডি। সীমান্ত পার হয়ে কখন কে আসবে, ঠিক নেই।
সেই বন্ধুরা, রাজশাহীর রানিবাজারের রেজাউল করিম চৌধুরী ওরফে বাচ্চু, আব্দুল মালেক ওরফে পল্টুরা এখনও মর্ডিকে হৃদয়ের সব থেকে গভীর ভালবাসার ঘরে আগলে রেখেছেন। আর এক বন্ধু আলির মেয়ের অভিমান, ‘‘মর্ডিকাকু না-এলে আমি বিয়াই করব না।’’ পল্টু এই সে দিনও এসে মর্ডির কলকাতার বাড়িতেই উঠেছেন। শেষ বার ঢাকা সফরে এই সব মানুষের সান্নিধ্য অসুস্থ মর্ডিকে বিপুল অক্সিজেন জুগিয়েছিল।
১৫০ বছর আগে ইরানের ইস্পাহান থেকে ঢাকা হয়ে ক্রমশ বরেন্দ্রভূমেই থিতু হয়েছিলেন কোহেনরা। তবে মা কলকাতার ইহুদি বলে মর্ডির জন্ম বউবাজারে। রাজশাহীতে, কে না-চিনত কোহেনদের! মর্ডির বাবার সাইকেলের দোকান, সারাইয়ের গ্যারাজ। সাইকেল আর প্যাডেল রিকশাই সেই রাজশাহীর প্রধান যানবাহন। মর্ডির অবশ্য একটা মোটরসাইকেলও ছিল। বাইক হাঁকিয়ে টো-টো করে ঘুরতেন পদ্মাপাড়ে। গান গেয়ে আর ঘোড়ামারা ড্রামাটিক ক্লাবে পার্ট করে দারুণ আনন্দেই কেটেছিল সেই ছেলেবেলাটা।
বন্ধুরা বলেন, ওর সঙ্গে কোথাও বেরলে পৌঁছতে অবধারিত দেরি হয়ে যেত! সকলেই মর্ডির চেনা যে! ক্লাস টেনে রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলের ‘নীলদর্পণ’-এ মর্ডিই ডিরেক্টর। শহরের মেয়েরা তাঁর জন্য পাগল। নানা কাজকম্ম সেরে পড়াশোনার সময়টা একটু কমই পেতেন মর্ডি।
পরবর্তী কালে বাংলাদেশ টিভি-র ইঞ্জিনিয়ার বাচ্চুর মনে আছে, মর্ডির স্কুলের বোর্ড পরীক্ষার গল্প! লিখতে বসে বুঝলেন, একটা প্রশ্নও কমন পড়েনি। তাতে কী! মর্ডি অকুতোভয়। সে যুগের জনপ্রিয় বাংলা গানের লিরিক লিখেই খাতা ভরিয়ে দিয়েছিলেন সে দিন।
বাচ্চুকে মজা করে মর্ডি ডাকতেন ‘দেব আনন্দ’ বলে, আর মর্ডি হলেন ‘কিশোরকুমার’। যদিও বন্ধুর চোখে কিশোরের চেয়ে ঢের বেশি হ্যান্ডসাম মর্ডিই। প্রিয় বাংলা গানগুলোর ইংরেজি অনুবাদেও ঝোঁক ছিল ইহুদি ছেলেটির। মান্নার ‘আমি সাগরের বেলা, তুমি দুরন্ত ঢেউ, বারে বারে শুধু আঘাত করিয়া যাও’-এর ইংরেজি হল ‘আই অ্যাম দ্য বিচ অব দ্য সি, ইউ আর দ্য রেস্টলেস স্টর্ম, আগেন অ্যান্ড আগেন ইউ নক মি’। সুরে ফেলে মর্ডি ডেকে ডেকে শোনাতেন সবাইকে। বাচ্চু, পল্টুদের মুখে উজ্জ্বল কবেকার সেই সব স্মৃতি।
কয়েক দশক পার হয়ে তাঁর বার্ধক্যের কলকাতাতেও এই মর্ডি পাল্টায়নি। রোগশয্যায় ডাক্তারবাবুর সঙ্গে কথায় কথায় জবাব দিতেন বাংলা গানেই। পুরনো অনুরাগিণীদের প্রসঙ্গে রসিকতা, ‘রঙ্গিনী কত মন, মন দিতে চায়, কী করে বোঝাই কিছু চাই না, চাই না!’ কিংবা রোগীর শরীর নিয়ে ডাক্তারের দুশ্চিন্তায় সান্ত্বনা, ‘জীবনখাতার প্রতি পাতায় যতই লেখো হিসাবনিকাশ, কিছুই রবে না!’ উচ্চ মার্গের পণ্ডিতির বাইরে এক ধরনের আটপৌরে গেরস্ত বাঙালিয়ানায় মর্ডির ছিল বরাবরের অধিকার।
রাজশাহী, ঢাকার বন্ধুদের ছেড়ে কলকাতায় তাঁর বৃত্ত কিছুটা ছোট হয়ে এসেছিল। ঢাকায় ‘সিরাজউদৌল্লা’ ছবিতে সিরাজের ফরাসি সেনাপতি সিনফ্রে হয়েছিলেন মর্ডি। সিনেমা-জগতে যোগাযোগের সুবাদে পরে কলকাতায় তপন সিংহের ‘সাগিনা মাহাতো’-তেও একটা ছোট পার্ট করেন। কিন্তু ইজরায়েল-আরব যুদ্ধের পটভূমিতে পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি ভাল ঠেকছিল না ইহুদিদের জন্য। তাই ঢাকা টেলিভিশনের চাকরিটা মর্ডিকে ছাড়তে হল।
১৯৬৮ সালের কলকাতাতেও কিছু ইহুদি কোম্পানি টিকে ছিল। ন্যাশনাল টোব্যাকো, আগরপাড়া চটকলের সঙ্গে জড়িত বি এম এলিয়াসের কোম্পানিতে দ্রুত চাকরি হয় মর্ডির। পরে অন্য বেসরকারি সংস্থায় যোগ দেন। এই শহরে ইহুদি সমাজের ছোটখাটো হাউস-পার্টির অন্তরঙ্গতায় মানিয়ে নিয়েছিলেন মর্ডি। ময়রা স্ট্রিটের একটি বাড়িতে এমন আসরেই হবু স্ত্রী জো-কে খুঁজে পান তিনি।
তবে মর্ডির সঙ্গে বাংলাদেশের যোগ ফিকে হয়নি। ঢাকা থেকে বাচ্চু বলছিলেন, ‘‘মর্ডি কোন ধর্মের, কখনও টের পেতাম না। কয়েক বছর আগে কোরানের কয়েকটি সুরার ইংরেজি অনুবাদ করেও আমায় পাঠাল।’’
কলকাতার বাঙালিদের মধ্যে অনেকের অচেনাকে চেনার জড়তা থাকে, চেনা অলিগলির বাইরে অস্বস্তিতে পড়েন তাঁরা! আবার যাঁরা বাঙালি নন, তাঁরাও অনেকে এ শহরে আলগা ভাবে কাটিয়ে চলে যান। স্থানীয় ভাষা, সংস্কৃতির ধার ধারেন না। ‘বারেন্দ্র ইহুদি’র কাছে তাঁদের সবারই শেখার আছে। আজকের ভারত বা গোটা বিশ্বেই জাতিগত অস্মিতায় অনেকের মাটিতে পা পড়ছে না। ভিনধর্মী, উদ্বাস্তু, অভিবাসীরা— তাঁদের কাছে কেউ মানুষ নয়। সেখানে মর্ডির জীবন এক অন্য গল্প বলে। তিনি ধর্মে ইহুদি কিন্তু মনেপ্রাণে বাঙালি। একই সঙ্গে ভারতীয় অথচ বাংলাদেশপ্রেমী! জাত, ধর্ম, দেশ, বংশের চিরকেলে খোপগুলো টান মেরে উলটে-পালটে দিয়েছেন।
মর্ডির জীবদ্দশা আর কলকাতায় ইহুদিদের ২০০ বছরের ইতিহাসের শেষ অঙ্ক মিলে গিয়েছে। ১৭৯৮-এ এ বাগদাদ থেকে শহরের প্রথম ইহুদি ব্যবসায়ী শালোম কোহেনের আগমন। কলকাতাকে নানা স্থাপত্য-ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ করার পরে এখন জনা কুড়ি বুড়োবুড়ি টিকে। বছর দুয়েক আগে মর্ডিই শেষ ইহুদি যিনি কলকাতার জীবন থেকে ঝরে পড়েছেন।  দিনটা ২০১৫-র ১৬ ডিসেম্বর। যা আবার মর্ডির প্রিয় বাংলাদেশের বিজয় দিবসও!
আবার কলকাতার সঙ্গে ইহুদিদের সম্পর্কের এক নতুন অধ্যায়েরও সূচনা সে-দিন। নারকেলডাঙার ইহুদি সমাধিক্ষেত্রে এতদিন শুধু হিব্রু, ইংরেজির স্মৃতিফলক হত। এই ‘বারেন্দ্র ইহুদি’র সৌজন্যেই সমাধি-সৌধে প্রথম বাংলার ছোঁয়া। ইহুদি মর্ডির শেষকৃত্য সারতে বেঙ্গালুরু থেকে পুরোহিত বা র‌্যাবাইকে ডাকতে হয়েছিল। কিন্তু তাঁর কবরে বাংলাতেই লেখা হল, মর্ডির বাংলা ভাষা, কবিতা, গানকে ভালবাসার কথা। কলকাতার মাটির নীচে শুয়েই মর্ডি এখন তাঁর বাংলাকে দেখে চলেছেন।

https://www.anandabazar.com/supplementary/rabibashoriyo/mordechai-cohen-last-jews-of-kolkata-who-had-an-excessive-bong-connection-1.765155?ref=strydtl-rltd-rabibashoriyo

কলকাতাতেই রয়েছে ভারতের প্রাচীনতম নিলামঘর!

কলকাতাতেই রয়েছে ভারতের প্রাচীনতম নিলামঘর!

রাসেল স্ট্রিটের ‘দ্য রাসেল এক্সচেঞ্জ’-এ প্রতি রবিবার এখনও ভিড় করেন মানুষ। নিলামে ওঠে পুরনো গ্রামোফোন, ঝাড়বাতি, পালঙ্ক। সত্যজিৎ রায় এই দোকানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে তাঁর ছবির জন্য পছন্দসই জিনিস বাছতেন।

সায়ন্তনী সেনগুপ্ত
 
Russel Exchange

স্মৃতিময়: রাসেল এক্সচেঞ্জ-এর বিরাট ঘর জুড়ে এমনই নানান জিনিস নিলামে ওঠার অপেক্ষায়।

একটা নতুন সুটকেস, খুব ভাল কন্ডিশন। মাত্র এক হাজার টাকা! গলাটা একটু চড়ল, ‘‘এক হাজার টাকা!’’ পিছন থেকে এক জন বললেন, ‘‘দু’হাজার টাকা।’’ পুরনো জিনিসের গন্ধমাখা বিরাট দোকানটার মাঝখানে ডায়াস-এর ওপর রাখা উঁচু চেয়ারে বসা মহিলা টেবিলে হাতুড়িটা ফেলতে গিয়েও ফেললেন না। ‘‘তিন হাজার টাকা!’’ বলে উঠলেন আর এক জন। ‘‘সাড়ে তিন,’’ এ বার অন্য গলা! ‘‘ছয় হাজার।’’ ক্ষণিক নৈঃশব্দ্য। টেবিলে হাতুড়িটা মারলেন মহিলা। তৃপ্তির হাসি হেসে বললেন, ‘‘ইট শুড বি লাইক দিস। এই না হলে অকশন!’’
 ঝাঁ চকচকে এলাকায় রাস্তার উপরে দোকানটা একটু যেন বেমানান। মলিন সাইনবোর্ডে লেখা ‘দ্য রাসেল এক্সচেঞ্জ’। বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই, হাজার ঝড়ঝাপটা সহ্য করে কী ভাবে দেশের প্রাচীনতম অকশন হাউসটি আজও প্রাণপণে অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই লড়ে চলেছে। পুরনো অকশন হাউসগুলি ঝাঁপ ফেলে দিয়েছে কবে। আঠারো-উনিশ শতকের জনপ্রিয় অকশন হাউস ‘ম্যাকেঞ্জি লায়াল এন্ড কোং’— আফিম নিলামের জন্য যা বিখ্যাত ছিল— প্রথমে বন্ধ হয়ে যায়। পরে আস্তে আস্তে বন্ধ হয় রাসেল স্ট্রিটের ‘ডালহৌসি এক্সচেঞ্জ’, পার্ক স্ট্রিটের ‘চৌরঙ্গী সেলস ব্যুরো প্রাইভেট লিমিটেড’ এবং ‘ভিক্টর ব্রাদার্স’, ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের ‘স্টেইনার এন্ড কোং’-এর মতো বড় বড় অকশন হাউস। ধুঁকতে ধুঁকতে বেঁচে রইল রাসেল স্ট্রিটের তিনটি দোকান। তার মধ্যে ‘সুমন এক্সচেঞ্জ’ এবং ‘মডার্ন এক্সচেঞ্জ’ অনেক পরের দিকে তৈরি। নিয়মিত অকশন এরা বন্ধ করে দিয়েছে বহু দিন। ব্যতিক্রম ‘রাসেল এক্সচেঞ্জ’।
১৯৪০ নাগাদ আবদুল মাজিদ নামে বেরিলির এক যুবক তুখড় ব্যবসায়িক বুদ্ধি আর পুরনো জিনিসের প্রতি আকর্ষণ সম্বল করে কলকাতায় পা রাখেন। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা পৃথিবী জুড়ে। যুদ্ধে জড়িয়েছে ভারতও। টালমাটাল রাজনীতি প্রভাব ফেলেছে অর্থনীতিতেও। কলকাতার ধনী ও অভিজাত বাসিন্দাদের সঙ্গে যোগাযোগের সুবাদে আবদুল মাজিদ বুঝলেন, ইংরেজদের ব্যবহৃত জিনিসপত্র ও ফার্নিচারের প্রতি দারুণ আকর্ষণ এদেশীয়দের মধ্যে। কিন্তু শুধু সাধ থাকলেই তো হবে না। সে সব জিনিস তাঁদের নাগালের বাইরে। এ দিকে ক্রমাগত বদলি-সহ নানা কারণে কলকাতায় আসা-যাওয়া লেগেই ছিল তৎকালীন শাসকদের। যাঁরা চলে যাচ্ছেন, নিজেদের সাধের আসবাবপত্রগুলি নিয়ে পড়েছেন মহা চিন্তায়।
–– ADVERTISEMENT ––
এই সব দেখেশুনেই বেরিলির যুবকটির মাথায় অকশন হাউসের ভাবনা খেলে গেল। রাসেল স্ট্রিটে দোকান খুলে বসে, ইংরেজদের থেকে সস্তায় কিনে নিতে লাগলেন বিরাট পিয়ানো, ঝাড়লণ্ঠন, শ্বেতপাথরের টেবিল, নরম গালিচার মতো অজস্র জিনিস। ভেনিশিয়ান বা বোহেমিয়ান গ্লাস এর জিনিস, সতসুমা টি-সেট, অধুনা দুষ্প্রাপ্য ইংল্যান্ডের রয়্যাল ডালটন বোন চায়না, জার্মানির রোসেনথাল চায়না বা নারিটাকের পোর্সেলিনের জিনিসও আসতে লাগল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ইংরেজরা যখন দলে দলে দেশ ছেড়ে যেতে লাগলেন, আক্ষরিক অর্থেই ফুলেফেঁপে উঠল রাসেল এক্সচেঞ্জ। এত দিন দোকানে ইংরেজদের আনাগোনার জন্য দোকান থেকে একটু তফাতেই থাকতেন সাধারণ মানুষ। এ বার স্বপ্নের জিনিসগুলি হাতে পেতে একেবারে ঝাঁপিয়ে পড়লেন তাঁরা।
প্রতি রবিবার নিয়ম করে চালু হল নিলাম। রাসেল স্ট্রিট পার করে পার্ক স্ট্রিট পর্যন্ত চলে যেত দামি গাড়ির সারি। দোকানের বাইরে দল বেঁধে বাবুদের বাড়ি জিনিস নিয়ে যাওয়ার জন্য বসে থাকত কুলির দল। নিলামে পছন্দের জিনিস প্রতিদ্বন্দ্বীর থেকে ছিনিয়ে তৃপ্তমুখে দোকান থেকে বেরিয়ে এসে কুলির মাথায় সে সব চাপিয়ে দিতেন বাবুরা। শুধু ইগোর লড়াইয়েই অনেক সময় সাধারণ জিনিসেরও দাম বেড়ে যেত চড়চড় করে। তার পুরো ফায়দা নিত অকশন হাউস। মাল নিয়ে কুলিরা তা পৌঁছে দিতেন কলকাতার জমিদারবাড়িগুলির দরজায়, কখনও বা স্টেশনে। সেখান থেকে ট্রেনে জিনিস পাড়ি দিত মালদহ, মুর্শিদাবাদ, কোচবিহার বা দার্জিলিং।
আজকের রাসেল এক্সচেঞ্জ সে দিনের রাসেল এক্সচেঞ্জের ছায়ামাত্র। সেই সব সোনালি দিনের কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। এখনও অবশ্য প্রতি রবিবার নিয়ম করে নিলাম হয় এখানে। তবে অকশনে আসা মানুষ আর জিনিসপত্র, দুয়েরই চরিত্র বদলেছে আমূল। রবিবারের এমনই এক দুপুরে গিয়ে দেখা গেল, ভিড়ে ঠাসা দোকানে পা দেওয়ার প্রায় জায়গা নেই। অন্য দিনের নিঝুম অন্ধকার-মাখা দোকানটা যেন মন্ত্রবলে জেগে উঠেছে। হেলমেট, পুরনো ঘড়ি, সাইড ব্যাগ, ট্রলি ব্যাগ, হকি স্টিক, বাতিল হওয়া ইলেকট্রনিক গ্যাজেট, পোকায় খাওয়া বই-ম্যাগাজিন এমনকি খানদুয়েক পারিবারিক অ্যালবামও বিরাট একটা টেবিলের ওপর ডাঁই করে রাখা। সবই উঠবে নিলামে। বিক্রেতারা জিনিস নিয়ে এলে ভ্যালুয়েশন করে দামের একটা প্রাথমিক ট্যাগ দেয় দোকান। সেই দাম থেকে শুরু হয় নিলাম। জিনিস বিক্রি হলে তার কুড়ি শতাংশ কমিশন নেওয়া হয়। দোকানের লাভ ওইটুকুই।
এখানকার জিনিসপত্র বিচিত্র, বৈচিত্রময় ক্রেতারাও। দেখলে মনে হয় একটা ছোট কলকাতা হঠাৎ হাজির হয়েছে উঁচু খিলানওয়ালা পলেস্তরা-খসা মলিন ঘরটিতে। নিতান্তই নিম্নবিত্ত কিছু মানুষ ঝুঁকে পড়েছে টেবিলের ওপর। নষ্ট হয়ে যাওয়া গ্যাজেটগুলো মেরামত করে ফের বেচে দেবেন এঁরা। কপালজোরে কোনও দামি জিনিস কম দামে পেয়ে যাওয়ার আশায় ইতস্তত ঘুরে বেড়ানো মধ্যবিত্তের দলও আছে। বাড়ির কাজ সামলে হাঁপাতে হাঁপাতে এসে হাজির বেশ কয়েক জন গৃহবধূও। স্টিলের বাসনকোসন, ঘড়ি, ঘর সাজানোর ছোট জিনিস বেশ সস্তায় পাওয়া যায় এখানে। উচ্চবিত্ত স্বামী-স্ত্রী, বেশ কিছু অল্পবয়সি ছেলেমেয়ে হাজির নিতান্তই কৌতূহলে। হঠাৎ একটা শান্তিনিকেতনি ব্যাগে চোখ আটকে গেল এক ভদ্রলোকের। প্রয়াত স্ত্রীর ঠিক এমন ডিজাইনেরই একটা ব্যাগ ছিল। দুশো টাকা দিয়ে ব্যাগটা কিনতে পেরে মুখ উজ্জ্বল হয়ে গেল তাঁর। এক অকৃতদারের নেশা প্লেবয় ম্যাগাজিন পড়া। শতচ্ছিন্ন ম্যাগাজিনগুলি ৫০ টাকায় হস্তগত করলেন। অকশন হাউসে অনেক উচ্চবিত্ত আবার সরাসরি আসেন না। দোকানেরই কোনও পরিচিত কর্মী তাঁদের হয়ে নিলামে দর হাঁকেন। ভিড়ের প্রথম ধাক্কাটা সামলান মাজিদের মেয়ে সরফরাজ বেগম। দেশের প্রথম, এবং একমাত্র মহিলা অকশনিয়র ইনি। এর পরে এসে হাল ধরেন তারই ছোট ভাই আরশাদ সেলিম।
দোকানের অন্য একটা দিক এই ভিড়ভাট্টার দিনেও বড্ড চুপচাপ। অতীতের গন্ধমাখা। দোকানের সাধারণ ক্রেতা-বিক্রেতা কেউ পা দেন না এখানে। জায়গায় জায়গায় রং চটে যাওয়া গ্রামোফোন, কানন দেবীর গাওয়া গানের দুষ্প্রাপ্য রেকর্ড, সূক্ষ্ম কারুকাজ করা সুবিশাল সেগুন কাঠের পালঙ্ক,  প্রাচীন আরামকেদারা, লতাপাতার কাজ করা দেরাজ-আলমারি,  চার-পাঁচটা আয়না বসানো ড্রেসিং টেবিল, বেলোয়ারি কাঁচের ঝাড়লণ্ঠন, লণ্ঠন ধরে থাকা নারীমূর্তি, শ্বেতপাথরের টেবিল গা-ঘেঁষাঘেষি করে দাঁড়িয়ে। নিস্তব্ধ। ক্রেতার প্রয়োজন পাল্টে যাওয়ায় এগুলি সরাসরি বিক্রি হয় এখন। কলকাতার যে সব  বনেদি বাড়ি ভেঙে তৈরি হয়েছে ঝাঁ-চকচকে ফ্ল্যাট, তাদের বিস্মৃত বনেদিয়ানা এসে জড়ো হয়েছে দোকানের অন্দরে। যে সব বাড়িগুলি এখনও টিকে আছে তার বাসিন্দারাও পুরনো জিনিস বিক্রি করে দিচ্ছেন, জানালেন দোকানের এক কর্মচারী।
 মার্বেলের মূর্তি, লণ্ঠন, ঝাড়বাতি।
এই সব জিনিসের রক্ষণাবেক্ষণের খরচ অনেক। দেখাশোনা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করার জন্য আগে প্রচুর কর্মচারী থাকত। বাড়িগুলি থেকে সেই পাট উঠে গিয়েছে। এত বড় বড় আসবাব নতুন প্রজন্মেরও নাপসন্দ। আধুনিক ছিমছাম জিনিস জায়গা করে নিচ্ছে দ্রুত। ছেলেমেয়েরা বিদেশে চলে যাচ্ছে লেখাপড়া বা চাকরির সুবাদে, বাড়ির সব থেকে বয়স্ক মানুষটি মারা যাওয়ার পর তাঁর ব্যবহৃত জিনিসেরও ঠাঁই হচ্ছে নিলামঘরে। এখনকার মানুষের কাছে স্মৃতির থেকে জায়গা আর পয়সার মূল্য অনেক বেশি।
আরামকেদারা
যদিও এ সব আমাদের রুটিরুজি, তাও মাঝে মাঝে আমাদেরই খারাপ লাগে, একটু মনমরা গলায় বললেন কর্মচারীটি। তবে শহরের কোন কোন বনেদি বাড়ি থেকে জিনিস আসে, সে ব্যাপারে মুখ খুললেন না তিনি। মজার ব্যাপার, এক দিকে যখন বনেদি বড়লোকরা এই সব জিনিস বিক্রি করে দেন, অন্য দিকে কিছু নব্য বড়লোক আবার নিজেদের বাড়ি সাজানোর জন্য এগুলিই কিনে নিয়ে যান। বুটিক হোটেল, রেস্তরাঁগুলিতেও এই সব জিনিসের চাহিদা এখন তুঙ্গে। কলকাতার তো বটেই, রাজস্থানের বিভিন্ন হোটেল-হাভেলিগুলিও নিয়মিত খদ্দের। বিভিন্ন সিরিয়াল, পিরিয়ড ফিল্ম বানানোর জন্যও রাসেল এক্সচেঞ্জের এই সম্ভারের সাহায্য লাগে। সত্যজিৎ রায়, সন্দীপ রায় বহু বার এসেছেন এখানে। দোকানের আর এক পুরনো কর্মচারী স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বললেন, বাবার কাছে শুনেছি, ভীষণ খুঁতখুঁতে ছিলেন সত্যজিৎ রায়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা দোকানে বসে থেকে জিনিসপত্র নেড়েঘেঁটে মনমতো জিনিস নিয়ে যেতেন। ঋতুপর্ণ ঘোষও তাঁর ‘চোখের বালি’, ‘রেনকোট’ ছবির জন্য এই দোকানের শরণাপন্ন হয়েছেন। কিন্তু এখন লড়াইটা আরও কঠিন করে দিচ্ছে বাজার ছেয়ে যাওয়া চায়না প্রোডাক্ট। নিউমার্কেটে হুবহু এই নকশা আর ডিজ়াইনের চাইনিজ় জিনিস পাওয়া যাচ্ছে এখন। সেগুলো সস্তা, সহজলভ্য। ফলে সেই দিকে মানুষ ঝুঁকছে বেশি।
গ্রামোফোন
লড়াইটা অবশ্য সোজা ছিল না কোনও দিনই, বলছিলেন আরশাদ সেলিম। নিজেকে সেলিম জুনিয়র বলতে বেশি পছন্দ করেন। ‘অকশনিয়র’-এর চেয়ারে বসেন মাত্র সতেরো বছর বয়সে। দেশের কনিষ্ঠতম অকশনিয়র ছিলেন তিনি। দোকানের প্রতিটি খুঁটিনাটি তখন তাঁর নখদর্পণে। কিছু দিনের মধ্যেই ব্যবসায় শুরু হল দারুণ মন্দা। তত দিনে বহু বছর বিদেশে কাটিয়ে দেশে ফিরেছেন বড় ভাই আনোয়ার সেলিম। কলকাতার বড় বড় অকশন হাউসগুলি একে একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে তখন। খাঁড়া ঝুলছে রাসেল এক্সচেঞ্জের মাথাতেও। বিদেশের ব্যবসায়িক ধ্যানধারণা আর কলকাতায় দোকান চালানোর অভিজ্ঞতা নিয়ে দুই ভাইয়ের মধ্যে সংঘাত হল। রাসেল এক্সচেঞ্জে মূলত যা কিছু বিক্রি হয় সেগুলি সবই পিরিয়ড পিস। এগুলিকে ‘অ্যান্টিক’ বলা যায় না। কারণ কোনও জিনিসকে অ্যান্টিক হতে হলে তাকে কমপক্ষে ১০০ বছরের পুরনো হতে হবে। এই সব জিনিস রাসেল এক্সচেঞ্জে বিক্রি হয় না, জানালেন আরশাদ।
সরফরাজ বেগম ও আরশাদ সেলিম
এমন জিনিস বিক্রির প্রস্তাব কি আসে না? প্রায়ই আসে। কখনও বহুমূল্য পুরনো রোলেক্স ঘড়ি, কখনও বা বিখ্যাত মনীষীদের চিঠি বিক্রি করতে চান অনেকে। ঐতিহাসিক মূল্য আছে, এমন জিনিসের সন্ধান পেলে দোকানের তরফ থেকে সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলা হয়। এই ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত হওয়ার পরেই কর্মচারী এবং সরাসরি বিক্রির বিভাগ ঢেলে সাজানো হয়েছিল। জিনিসপত্র ভাড়া দেওয়াও শুরু হয়েছিল। ‘‘আমরা দুজনেই দুজনের কথা কিছু কিছু মানলাম, কারণ মতান্তর হলেও আমাদের উদ্দেশ্য ছিল একটাই— এই ঐতিহ্য যে ভাবেই হোক বাঁচিয়ে রাখা। এর পরও নানা ওঠাপড়ার মধ্যে দিয়ে গিয়েছে দোকান। অনেক বার ভেবেছি, এ বার বোধহয় আর পারব না। সব শেষ হয়ে গেল। আবার দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই শুরু করেছি। এই যুদ্ধটা সহজে হারব না আমরা।’’ সেলিম জুনিয়রের গলায় প্রত্যয়। রাসেল এক্সচেঞ্জের ঐতিহ্য ও ব্যবসা নিয়ে দুই ভাইয়ের দৃষ্টিভঙ্গির তফাত, তাঁদের মিঠেকড়া সম্পর্ক, এই সব নিয়েই লন্ডনের তথ্যচিত্র নির্দেশক এডওয়ার্ড ওলস্‌ ‘দি অকশন হাউস, আ টেল অব টু ব্রাদার্স’ নামে তথ্যচিত্র তৈরি করেছেন। পৃথিবীর বিভিন্ন ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে দেখানো হয়েছে তা।
বাইরের পৃথিবীটা আমূল বদলে গেলেও গত ৭৮ বছর ধরে শক্ত মুঠিতে সময় ধরে রাখার যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে রাসেল এক্সচেঞ্জ। ধুলোমাখা পরি, বিবর্ণ আসবাব এখন বিকিয়ে যায় এক দামে। ১০০ টাকার মিক্সির জন্য কাবারিওয়ালা, রিকশাওয়ালা আর গৃহবধূদের মধ্যে লড়াই চলে। প্রতি রবিবার রাসেল স্ট্রিটের ফাঁকা ফুটপাত ধরে চলতে চলতে শোনা যায়, শ্রীহীন একটা দোকানের ভিতর থেকে ভেসে আসছে মাইকের গমগমে স্বর, ‘বোলি লাগানোর’ আওয়াজ, হাতুড়ির গর্বিত আস্ফালন। আর দেখা যায় একটা ব্ল্যাকবোর্ড, যেখানে গত সাত দশকেরও বেশি সময় ধরে লেখা হয়ে আসছে— ‘অকশন হিয়ার টুডে’।

https://www.anandabazar.com/supplementary/rabibashoriyo/oldest-auction-house-of-india-1.846303?ref=rabibashoriyo-new-stry

সতীনাথ ভাদুড়ীর হাত ধরেই ‘গানহী বাওয়া’কে চিনেছিল বাংলা সাহিত্য (On Satinath Bhaduri)

সতীনাথ ভাদুড়ীর হাত ধরেই ‘গানহী বাওয়া’কে চিনেছিল বাংলা সাহিত্য

শুধু সাহিত্য সৃষ্টি নয়, বরং জীবনের এক অন্য অর্থের খোঁজই করেছেন সতীনাথ ভাদুড়ী। তাঁর পথ চলা কোন খাতে, তারই সন্ধানের চেষ্টায় অর্ঘ্য বন্দ্যোপাধ্যায়

 
Satinath Bhaduri

হস্তান্তরিত হওয়ার পরে সতীনাথ ভাদুড়ীর বাসভবন

(১)
মাঝবয়সি এক বাঙালি ঘুরছেন ফ্রান্সের রাস্তায়। সিন নদীর পাড়ে পুরনো দোকানে প্রাণ ভরে গন্ধ নিচ্ছেন উইপোকায় খাওয়া বইয়ের। দেখছেন ফরাসিদের। আর তাদের দেশে আসা ধরাধামের লাখো মানুষকে। সেই প্রতিটি মানুষের দিকেই হয়তো ‘অনন্তযৌবনা প্যারিস পাতলা ফরাসি সিল্কের আধাঘোমটার ভিতর দিয়ে চোখ ইসারা করে।’— ‘ইসারা’য় ধরা দেন কেউ কেউ।
ধরা হয়তো দিতে চাইলেন ওই বাঙালি ভদ্রলোকটিও। এ ইশারার বার্তা এসেছে ফরাসি তন্বীরূপে নয়, বরং এক হিটলারি জার্মানি থেকে বিতাড়িত (সম্ভবত ইহুদি বলে) এক মহিলার চোখে। যাঁকে ওই বাঙালি দেখাতে চান তাঁর দেশ, মহা-ভারত। বাঙালিটি সতীনাথ ভাদুড়ী। মহিলাটি হোটেলের পরিচারিকা। নাম অ্যানি। অ্যানি এমন এক জন, যাঁর কথা ‘একসঙ্গে বেশিক্ষণ ভাবতে’ পারা যায়। ভাবনার সূত্রেই জড়িয়ে পড়ে ‘অবিচ্ছেদ্য’ সতীনাথ-কথাও।
কিন্তু দেশ দেখানো হল কই? সতীনাথ জানলেন, অ্যানির স্বামী-পুত্র নিয়ে ভরা সংসার। তবুও... নোটবইয়ের পাতায় অন্য অ্যানি বেঁচে থাকেন। পাতা ওল্টালে ভেসে আসে অ্যানির হাতের লেখা ঘরকন্নার গন্ধ। আর সতীনাথ প্রশ্ন করেন নিজেকেই, ‘মানুষ অতৃপ্ত— কী যেন খুঁজছে সারা জীবন— কী সেই জিনিস?’
(২)
এই ‘অতৃপ্তি’ কেন, তার খোঁজ সতীনাথ শুরু করলেন সেই ছেলেবেলা থেকেই।
সতীনাথের জন্ম বাংলা তারিখ ১১ আশ্বিন, ১৩১৩, বৃহস্পতিবারে। বিজয়া দশমী, মায়ের বিদায়ের দিন সন্ধেয়। চার দিকে উৎসব শেষের বিষণ্ণতা। তার মধ্যেই কোশী নদীর পাড়ে পূর্ণিয়ার ‘সবুজকুন্তলা’ ভাট্টাবাজারে ইন্দুভূষণ ভাদুড়ী ও রাজবালাদেবীর ঘরে এলেন ষষ্ঠ সন্তান সতীনাথ। হয়তো বা অদূরে বেলাশেষের গান গাইল গাছগাছালিতে ঘরে ফেরা পাখির দল। ঘটনাচক্রে সতীনাথের ‘জাগরী’ উপন্যাসের বিলুরও জন্ম ওই দশমীর দিনেই।
মায়ের আঁচলের খুঁট ধরে ঘোরাঘুরি। বড় হচ্ছেন সতীনাথ। বাবা ইন্দুভূষণ পূর্ণিয়া আদালতের ডাকসাইটে দেওয়ানি উকিল। তাঁর থেকে কেমন যেন দূরে দূরে থাকেন সতীনাথ।
বেশ চলছিল। আচমকা পড়়াশোনার পাট চলে এল। ভর্তি হলেন ভাট্টাবাজার লাগোয়া প্রাথমিক স্কুলে। সেখানে অবশ্য উপচে পড়া স্নেহ মিলল শিক্ষক দেবেন্দ্রনাথ মণ্ডলের কাছে। পরে বৃত্তি নিয়ে ভর্তি হলেন সদর হাসপাতালের কাছে পূর্ণিয়া জেলা স্কুলে। শিক্ষক-ভাগ্য ভালই। প্রধান শিক্ষক প্যারীমোহন মুখোপাধ্যায় আর সংস্কৃত পণ্ডিত তুরন্তলাল ঝা বেশ পছন্দ করেন এই ঝকঝকে ছেলেটিকে। পণ্ডিতজি তো নামই দিয়ে ফেললেন ‘ক্লাস কী রোশনি’। ক্লাসে সতীনাথ না এলে সহপাঠীরা মজা করে বলে, ‘ক্লাস আঁধিয়ালা হো গয়া’। আসলে ‘রোশনি’ই বটে। প্রতি শ্রেণিতেই যে প্রথম হন ওই সতীনাথ!
কিন্তু আর পাঁচটা ছেলের মতো  দামাল নয় ছাত্র সতীনাথ। সঙ্গী গুটিকয় বন্ধু। খেলাধুলোয় তেমন আগ্রহ নেই। কিন্তু স্কুল চত্বরেই অমন ছাতার মতো গুগগুল, পাইন, বট, অশ্বত্থের ভিড় কেমন যেন দিকশূন্যপুরের ডাক শোনায় সতীনাথকে। সেই ডাক শুনতে শুনতেই মাঝেসাঝে উঁকি দেন অদূরের প্ল্যান্টার্স ক্লাবে। এই ক্লাবই ‘আন্টা বাংলা’, ‘জাগরী’তে ফিরে আসবে নিজস্ব রূপ-রং নিয়ে।
স্কুলজীবন এটুকুই।
আসলে দিকশূন্যপুরের ডাক শোনা হোক বা ক্লাবে উঁকি, এর মধ্য দিয়ে সতীনাথ চাইছিলেন অজানাকে দেখতে। সেই কৌতূহল থেকেই হয়তো একদিন একটু সিদ্ধি চেখে দেখা! তার পরেই কয়েক দিন ঘরবন্ধ, অসুস্থ হয়ে পড়া।
(৩)
কিন্তু সিদ্ধি-পর্ব স্কুলজীবনের ওই কৌতূহলে মোটেই দাঁড়ি টানল না। বরং আইএসসি পড়তে মাখানিয়াকুঁয়ার বাঙালি মেসে ঠাঁই নেওয়া সতীনাথের কৌতূহল বেড়েই চলে। আর তাই পটনা সায়েন্স কলেজে বিজ্ঞান প়ড়েন বটে। কিন্তু নিয়মের বাঁধা জাল অপেক্ষা রং-তুলিতেই যেন প্রাণ খুঁজে পান সতীনাথ।
পূর্ণিয়া আদালত চত্বর
এর পরে পটনা কলেজ, অর্থনীতিতে বিএ। মেসজীবনও শেষ। বাক্স-প্যাঁটরা উঠল পটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহমেডান হস্টেলে। আশ্চর্য সমাপতন। সতীনাথ যে ঘরে উঠলেন, তার ঠিক পাশের ঘরেই এক সময় ছিলেন আরও এক জন, অন্নদাশঙ্কর রায়। যাঁর ঘরের বাইরে আবার লেখা, ‘ডোন্ট কোয়ার্ল উইথ ফ্যাক্টস’। বিএ-র পরে এমএ, স্বাভাবিক নিয়মেই। আর এই সময়েই ব্যক্তি-জীবনের প্রথম ‘নির্জনতা’র সঙ্গে পরিচিত হওয়া সতীনাথের।
এক সপ্তাহের ব্যবধান। মা রাজবালাদেবী ও বড় বোন করুণাময়ী মারা গেলেন। মাতৃহারা সতীনাথ যেন খানিক আলুথালু। মন চায়, সুদূর দক্ষিণ আমেরিকা পাড়ি দিতে। কিন্তু মায়েরা এত সহজে সতীনাথের জীবন থেকে বিদায় নেননি। পূর্ণিয়ার দাক্ষায়ণী দেবী, কুসুমকুমারী দেবীরা স্নেহ দিলেন। সতীনাথও এঁদের কথাই বুনছেন ‘অচিন রাগিণী’ বা ‘জাগরী’তে। এমএ-র পরে আইন পড়া, পৈতৃক পেশায় যোগ দিতে।
ওকালতির কাজে বাবার মুখরক্ষা করলেন সতীনাথ। সাত বছরের জন্য সহকারী হিসেবে নাড়া বাঁধলেন আইনজীবী বিশ্বনাথ মুখোপাধ্যায়ের কাছে। ‘মোতির দানা’র মতো অক্ষরে ইংরেজি, বাংলা বা কৈথিতে সতীনাথের লেখা সম্ভ্রম তৈরি করল। কোর্ট চত্বরে ফিসফাস, ‘এ তো আর একটা ইন্দুবাবু তৈরি হয়ে গেছে’!
কিন্ত বাবার সঙ্গে দূরত্ব বোধহয় কমল না। আর তাই বার-লাইব্রেরিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটালেও সকলে অবাক চেয়ে দেখে, ইন্দুবাবু আদালতে আসেন জুড়িগাড়ি চড়ে। আর তাঁরই ছেলে সাইকেলে, মানুষের সঙ্গে আলাপ করতে করতে।
এই সাত বছরে সতীনাথের রুটিন সকালে আইনের বই পড়া, দাদামশাই কেদারনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতে আড্ডা, দুপুরের খাওয়া শেষে খানিক বিশ্রাম। তার পরে বিকেলে হাঁটাহাটি, রাত ৯টা পর্যন্ত স্টেশন ক্লাবে টেনিস খেলা আর রাতে নিজের লেখালেখি।
লেখালেখি। এই সূত্রেই আর বোধহয় ভাল লাগে না ‘উকিলের কারবার’। কারণ তা যে মন নিয়ে নয়। ‘নবশক্তি’তে স্যাটায়ারধর্মী লেখায় হাত পাকালেন সতীনাথ। ‘পূর্ণিয়া দর্পণ’-এ লিখলেন কিছু চুটকি। খানিক বাদে ‘বিচিত্রা’য় প্রথম গল্প প্রকাশ পেল, ‘জামাইবাবু’।
কিন্তু শুধু মাত্র লেখালেখিতে বাঁধা পড়ার সময় তখনও আসেনি। অন্য কিছুর খোঁজ শুরু করে দিয়েছেন তত দিনে সতীনাথ।
(৪)
সেই অন্য কিছুর খোঁজেই শুরু হয়ে গিয়েছে ‘অন্য’ জীবনের প্রস্তুতি পর্ব। তাই দিনভর আদালতের কাজ সেরে রাতে লণ্ঠন হাতে সতীনাথ ঘুরে বেড়ান বই সংগ্রহের জন্য। আর সকলের সঙ্গে মিশে তৈরি করলেন পূর্ণিয়া পাবলিক লাইব্রেরি। পরে যার নাম ইন্দুভূষণ লাইব্রেরি। পূর্ণিয়ায় মহিলা সমিতি সংগঠন ও মন্দির তৈরি, পশুবলির বিরুদ্ধে জনমত সংগঠন— সব ভূমিকাতেই দেখা যেতে লাগল সতীনাথকে।
সবই হচ্ছে। কিন্তু ওই একলাপনার অভ্যেস যেন গা ছাড়া হয় না! আর তাই রাতে কাজ সেরে ব্যঙ্গ করেন নিজেকেই, ‘বাড়ি এসে নিজেরই হাসি আসে এসব তুচ্ছ ব্যাপারে মাথা ঘামানোর জন্য’।
আসলে সময়টাই ‘মাথা ঘামানোর’। মহাত্মা গাঁধী যে তত দিনে প্রান্তিক মানুষের ‘গানহী বাওয়া’ হয়ে উঠেছেন। ডাক দিয়েছেন অধীনতা থেকে মুক্তির।
গতানুগতিক জীবন আর পোষাল না। তেত্রিশ বছর বয়সে বাড়ি ছাড়লেন সতীনাথ। যোগ দিলেন পূর্ণিয়া থেকে প্রায় ২৫ মাইল দূরে কংগ্রেস নেতা বিদ্যানাথ চৌধুরীর টিকাপট্টি আশ্রমে। গায়ে উঠল খাদির ধুতি, চাদর, পাঞ্জাবি। শীতে গলাবন্ধ কোট, পায়ে চপ্পল। স্বাধীনতার খোঁজে সতীনাথ ছুটলেন গ্রাম থেকে গ্রামে। ‘অখ্যাত, অজ্ঞাত, অবজ্ঞাত গ্রামের লোক’দের গানহী বাওয়ার কথা বোঝাতে এবং ওই ‘বন্ধু’দের বুঝতে।
বাবা ইন্দুভূষণ সবই হয়তো দেখছিলেন, দূরে দাঁড়িয়েই। কিন্তু আর পারলেন না। প্রিয় সতু যাতে বাড়ি ফেরে, তার জন্য ছেলে ভূতনাথকে কলকাতায় টেলিগ্রাম করলেন বাবা।
সতুর দুই বন্ধু দ্বারিক সুর ও কমলদেও নারায়ণ সিংহের সঙ্গে দাদা ভূতনাথ গেলেন ভাইকে ফেরত আনতে। কিন্তু ভূতনাথের নিজেরই কথায়, ‘সে আমাকে ফিরিয়ে দিল’। ভূতনাথ দেখলেন, ভাইয়ের ফেরার পথ আপাতত বন্ধ। বিস্মিত হলেও স্বাগত জানালেন দাদামশাই। বুঝলেন, ‘সাধারণে যা করে তাতে মন সায় দেয় না’ যে ও ছেলের! মন সায় দেয় না আদর্শকে ফেলে আসতে। আর তাই আশ্রমিক পর্বে বাড়ি এলে সঙ্গী হয় দাঁতোয়ান। টুথপেস্ট-ব্রাশ... ও সব বিলিতি অভ্যেস যে! পাতে পড়ে দই, কাঁচকলা সিদ্ধ, আলু সিদ্ধ। আর বিলাসিতা এক চামচ মাখন!
কিন্তু শুধু কংগ্রেস স্কুলের মাস্টার হিসেবে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেবেন সতীনাথ, এমনটা হওয়ার নয়।
(৫)
সেটা হওয়ার নয় বলেই আশ্রমের চৌহদ্দি ডিঙিয়ে সতীনাথ দাঁড়ালেন খেটে খাওয়া ভারতবর্ষের সন্তান-সন্ততিদের দু’চোখের সামনে। কাজ করলেন তাৎমা, ধাঙ়ড় সম্প্রদায়ের মধ্যে। তাঁদের গলায় দিলেন মহা-ভারতের স্লোগান— ‘সরকার জুলুমকার। আংরেজ জুলুমকার।’ পিকেটিং করলেন ভাট্টাবাজারের বিলিতি মদের দোকানের সামনে। পুলিশ এল, মারমুখী পেয়াদা দেখে অনেকেই চম্পট দিলেন। কিন্তু ঠায় দাঁড়িয়ে রইলেন সতীনাথ।
কংগ্রেসকর্মী, নেতা থেকে জেলা সেক্রেটারি, বাগ্মী, তিন বার জেল খাটা (মতান্তরে চার বার), জেল ভাঙার চেষ্টা— অস্থির সময়ে নেতৃত্ব দেওয়ার যাবতীয় ‘গুণ’ সতীনাথের রাজনৈতিক ঝুলি কানায় কানায় পূর্ণ করে তুলল। সেই পূর্ণতার জন্যই ‘জল কাদা ভেঙে বিনা টর্চের আলোয় ১৫-২০ মাইল’ হাঁটা আদালত চত্বরের ছোটবাবু সতীনাথ হয়ে উঠলেন ‘ভাদুড়ীজি’।
’৪২-এর অগস্ট আন্দোলন। ফের সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়ার সময়। ইংরেজ সরকার ঘিরে ফেলল টিকাপট্টি আশ্রম। শুরু হল গণ অভ্যুত্থান। হরতাল, মিছিল, কিষাণগঞ্জ আদালতে রানির দেশের পতাকা টেনে নামানো, রেললাইন উড়িয়ে দেওয়া— সব হল। ‘জাগরী’র বিলু বা সতীনাথও শরিক হলেন ‘জনশক্তির প্রকৃত স্বরূপ’-এর সঙ্গে। আর তাই ‘জাগরী’ উৎসর্গীকৃত ‘যে সকল অখ্যাতনামা রাজনৈতিক কর্ম্মীর কর্ম্মনিষ্ঠা ও স্বার্থত্যাগের বিবরণ, জাতীয় ইতিহাসে কোনোদিনই লিখিত হইবে না, তাঁহাদের স্মৃতির উদ্দেশে—’
কিন্তু শুধু ‘অখ্যাতনামা’ নন, খ্যাতিমান অনেকের সঙ্গেই পূর্ণিয়া ও ভাগলপুর জেল বা রাজনৈতিক জীবন একসঙ্গে কাটল সতীনাথের। সেই তালিকায় ভিড় জমান জয়প্রকাশ নারায়ণ, বিহারের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী শ্রীকৃষ্ণ সিংহ-সহ একঝাঁক প্রথম সারির দেশনেতা। জেলের মধ্যেই দিনভর আলাপ চলতে থাকে দেশ-সমাজ-আন্দোলনের রূপরেখা নিয়ে।
সতীনাথের অবশ্য ও সব রূপরেখায় তেমন মন নেই। আর তাই জেলজীবনের কোনও পর্বে তাঁকে দেখা যায় লৌহকপাটের ফাঁক দিয়ে আসা সূর্যরেখায় তুলসীদাসের ‘রামায়ণ’ পড়তে। রপ্ত করতে উর্দু-ফারসি ভাষা। কখনও বা জেলের ‘টি’ সেলে স্বেচ্ছানির্বাসন নিয়ে দেখা যায়, খসখস করে ‘বেশ মোটা মোটা গাঢ় সবুজ রংয়ের দু’খানা খাতা’য় কী যেন লিখে চলেন সতীনাথ। ওই লেখাটিই ‘জাগরী’!
মাঝেসাঝে এই মানুষটিই সহ-আবাসিকদের পাউরুটি টোস্ট, ডিমের পুডিং বা ‘মোতঞ্জন’ (এক ধরনের পোলাও) রান্না করে চমকে দেন। আর ভলিবল খেলেন। ভলিবলে এক দলের ক্যাপ্টেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী কৃষ্ণবল্লভ সহায় (‌কেবি), অন্য দলের রণেন রায়চৌধুরী। সতীনাথ কেবি-র দলে। সতীনাথ খারাপ খেললেন। কেবি বললেন, ‘এ সাহব! কল সে আপ হমারে তরফ সে মত খেলিয়েগা। সমঝে?’ এর পরের দিনেই বদলে গেল খেলা। নেতার আর্জি, ‘হমারে সাইড সে খেলিয়ে কৃপা কর’।
ভাগলপুর সেন্ট্রাল জেলেই একটি ঘটনা সতীনাথের চরিত্রকে আরও সামনে আনে। সাক্ষী তাঁরই় ‘শিষ্য’, হিন্দি সাহিত্যিক ফণীশ্বরনাথ রেণু। ঘটনাটি—
‘লাহোর কংগ্রেস’-এর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ২৬ জানুয়ারি ‘পূর্ণ-স্বরাজ’ দিবস পালন করতেই হবে। এক সপ্তাহ আগে থেকে শুরু হল ব্রিটিশ জেল কর্তৃপক্ষের তানাশাহি। জাতীয় পতাকা, পোস্টারের জন্য রাখা লাল রং, সবুজ কাগজের খোঁজে ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে শুরু হল ব্যাপক তল্লাশি।
২৫ জানুয়ারি। জেল কর্তৃপক্ষ জানিয়ে দিলেন, ‘হল্লা’ হলেই চলবে লাঠি। সেই সঙ্গে ২৬ জানুয়ারি ওয়ার্ডের কপাট দিনভর বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। এ বার রাজবন্দিরা দু’ভাগ। এক দল বললেন, এই পরিস্থিতিতে কী ভাবে ‘পূর্ণ স্বরাজ’ দিবস পালন সম্ভব! অন্য দল অনড়। সতীনাথের সমর্থন দ্বিতীয় দলেই।
২৬ জানুয়ারি। সকাল থেকেই নিজের লেখায় মগ্ন সতীনাথ। ওয়ার্ডের দরজা বন্ধ। বাইরে রক্ষীদের জুতোর মচমচ। সতীনাথের ওয়ার্ডের কয়েক জন আচমকা স্লোগান দিলেন। শুরু হল ‘বন্দেমাতরম’ গাওয়া। গাঁধীবাদীরা বসে পড়লেন চরকা কাটতে। ‘হল্লা’র খবর পৌঁছল জেলকর্তাদের কাছে। ব্রিটিশ অফিসার চিৎকার করে ‘বেয়াদপি বন্ধের অর্ডার’ দিলেন। উঠে দাঁড়ালেন সতীনাথ।
শিষ্য ফণীশ্বরনাথ থমকে গেলেন। ক’দিন আগের লাঠিচার্জের ফলে ভাদুড়ীজির ঘাড়ের কাছে কালশিটেটা যে এখনও মেলায়নি। ফের যদি... সতীনাথ তত ক্ষণে দ্বিতীয় দলের এক্কেবারে গোড়ায় এসে আওয়াজ তুললেন ‘বন্দেমাতরম!’
সশস্ত্র ও নিরস্ত্র আন্দোলনে দেশ স্বাধীন হল ’৪৭-এ। একদিন দেখা গেল, ডক্টর রাজেন্দ্রপ্রসাদ এবং সস্ত্রীক আচার্য কৃপালনী সতীনাথের বাড়িতে এসে আতিথ্য গ্রহণ করলেন। খবর রটল, কংগ্রেস কোনও গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী করছে সতীনাথকে। কিন্তু সতীনাথ অন্য রকম।
(৬)
সতীনাথ অন্য রকম বলেই দেখা গেল, ১৯৪৮-এ দুম করে পূর্ণিয়া কংগ্রেসের সেক্রেটারির পদ ত্যাগ করলেন। স্পষ্ট বললেন, ‘কংগ্রেসের কাজ ছিল স্বাধীনতা লাভ করা, সে কাজ হাসিল হয়ে গেছে, রাজকাজ ছাড়া কোনো কাজ নেই আর।’ সেই ‘কাজ’ থেকে স্বাভাবিক ভাবেই দূরত্ব বজায় রাখলেন নির্জনতায় অভ্যস্ত সতীনাথ।
কিন্তু রাজনীতির মধ্য দিয়ে যাঁর মহা-ভারতকে চেনা, তাঁর পক্ষে বেশি দিন দূরে থাকাটাও সম্ভব হল না। আর তত দিনে মাথার মধ্যে গিজগিজ করছে কার্ল মার্ক্স থেকে মানবেন্দ্রনাথ রায়ের লেখা। বারবার ডাক আসে সোশ্যালিস্ট পার্টিতে যোগ দেওয়ার। তাতে বিশেষ লাভ হওয়ার নয়। শেষমেশ আর কারও ডাকে নয়, বরং নিজেই একদিন পার্টি অফিসে গিয়ে সোশ্যালিস্ট দলে নাম লেখালেন সতীনাথ। তাঁর সদস্যপদে প্রস্তাবক হিসেবে সই থাকল রেণুর। এ বার কলের মজুরদের জীবন নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি শুরু হল। হয়তো এই ঘাঁটাঘাঁটিই রূপ পেল ‘চিত্রগুপ্তের ফাইল’-এ। কিন্তু সোশ্যালিস্ট পার্টিতেও বেশি দিন মন টিকল না। কারণ তত দিনে সে দলে ভিড় দুর্নীতিগ্রস্ত ‘জমিদারনন্দনদের’।
এক নির্জন রাজনীতিকের দলীয় রাজনীতির খোঁজ এখানেই শেষ হল। আসলে ‘সহজ লোকের মতো কে চলিতে পারে’, রূঢ় বাস্তবের এই সংশয়ই নির্জন করে সতীনাথকে। কারণ তত দিনে রাজনৈতিক নেতাদের দলাদলি, ১৯৩৪-এ বিহার ভূমিকম্পের সময়ে এক শ্রেণির নেতার আখের গোছানোর চেষ্টা দলীয় রাজনীতি সম্পর্কে হয়তো প্রশ্ন তৈরি করেছে সতীনাথের মনে। তাই পরাজিত ‘ঢোঁড়াই’ যখন ‘সলন্ডর’ করে মহকুমাশাসকের অফিসে, তখন মনে হয়, এ আসলে অভিমানী সতীনাথেরই রাজনীতিকে বিদায় সম্ভাষণ।
আর তাই ‘লোকনায়ক’, ‘জনজাগৃতি’র মতো কথাগুলি শুনলে হাই ওঠে সতীনাথের!
(৭)
হাই ওঠারই কথা। কারণ রাজনীতি যে জন্য, সেই মহা-ভারতের পথ তত দিনে চেনা হয়ে গিয়েছে সতীনাথের। শুধু রাজনীতি নয়, তাঁর ‘অতৃপ্তি’ অধ্যাত্মবাদ নিয়েও। কিন্তু এই মানুষটিকেই আবার পাড়ি দিতে দেখা যাবে বৃন্দাবনে। তা অধ্যাত্মবাদের জন্য নয়, ‘দিগ্ভ্রান্ত’ লিখতে। আসলে অধ্যাত্মবাদের কাছে সমর্পণ তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি। তাই বউদি রেণুকাদেবীকে স্পষ্ট ভাবে বললেন, ‘কিছু মানতে পারলে হয়তো ভাল হত, তবু পারছি না যে মানতে।’
আর তাই এ বার পাড়ি দেওয়া প্যারিস, লন্ডন, জার্মানি... সে সব দেশের সাহিত্য, সংস্কৃতি, মানুষদের কাছ থেকে দেখা, তা-ও হল। দেখলেন ভ্যাটিকানের উৎসবে ‘সাদা, কালো, হলদে সব জাত’ এক হয়ে যাওয়ার আখ্যান। কিন্তু দেখা হল না, যা চেয়েছিলেন দেখতে। সেই সোভিয়েত রাশিয়া! পর্যটন জটিলতায় সে দেশে যাওয়া আটকে গেল। তবে পাঠক এই ভ্রমণপর্বের কানায় কানায় পূর্ণ বিবরণ পেলেন ‘সত্যি ভ্রমণকাহিনী’তে। এই লেখা প্রকাশের আগে ‘দেশ’ পত্রিকা বিজ্ঞাপন দিল, ‘ইহা ভ্রমণকাহিনী না উপন্যাস রসিক পাঠকেরাই বিচার করিবেন।’
কিন্তু লেখালেখির জগতেও সহজে প্রতিষ্ঠা হয়নি। সতীনাথের প্রথম উপন্যাস ‘জাগরী’র পাণ্ডুলিপি সজনীকান্ত দাস ফেলে রাখলেন পাঁচ-ছ’মাস। শেষমেশ সমবায় পাবলিশার্স তা প্রকাশ করে। প্রকাশ হতেই তাকে স্বাগত জানাল ‘দেশ’ ও ‘পরিচয়’ পত্রিকা। স্বাগত জানালেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘বইখানি পড়ে চমকে গেলাম। একেবারে নূতন কথা, নূতন সুর, নূতন সব মানুষের ভিড়, একেবারে সম্পূর্ণ নূতন মনোভাব।’
বিহার সাহিত্য ভবন থেকে এর হিন্দি অনুবাদ বেরোল। ভূমিকা লিখলেন সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়। পরে এর ইংরেজি অনুবাদ করবেন লীলা রায়। ইউনেস্কোর প্রযোজনায় যা এশিয়া পাবলিশিং হাউস থেকে ছাপা হবে ‘ভিজিল’ নামে। গল্প, ‘দেশ’ পত্রিকায় ‘ঢোঁড়াই চরিত মানস’ প্রকাশ... সতীনাথ লিখে চললেন। বাস্তবের ঢোঁড়়াই কিন্তু আসলে দুর্নীতিপরায়ণ। অথচ তাঁকেই ‘সারা দেশের সাধারণ লোকের’ প্রতিনিধি করে তুললেন সতীনাথ।
এ সব সাহিত্যসৃষ্টি আনল স্বীকৃতিও। কিন্তু সতীনাথ সে স্বীকৃতিতে থিতু হওয়ার লোক নন। ‘লেখকের লেখক’টি তখন প্যারিসে। দাদা ভূতনাথ টেলিগ্রামে খবর দিলেন, ‘রবীন্দ্র পুরস্কার’ প্রাপ্তি ঘটেছে। সতীনাথ খবরটা জানালেন প্রিয় অ্যানিকে। পুরস্কারের চেেয়ও বোধহয় বড় পুরস্কার এ বার মিলল। অ্যানি ‘ওলালা’ বলে উচ্ছল হয়ে ওঠেন। এই-ই ভাল লাগে সতীনাথের। কিন্তু অ্যানি অন্য রূপে নয়, বরং ধরা দিয়েছেন মাতৃরূপে। পুত্রহারা অ্যানির শোকজর্জর, কালো জালে ঢাকা মুখটিই বেশি মনে পড়ে...
বিভুঁইয়েও তাই অতৃপ্তি পিছু ছাড়েনি সতীনাথের।
(৮)
সেই অতৃপ্তি বুকে করেই সতীনাথ ফিরলেন প্রিয় পূর্ণিয়ায়। সঙ্গী পরিচারক বাবাজি আর ‘খাঁকি খাঁকি রং, পোড়া কালোমুখ, খাড়া কান, গুটনো লেজ’ওয়ালা কুকুর। নাম তার ‘পাহারা’। মাঝেসাঝে যান কলকাতায় নবকৃষ্ণ স্ট্রিটে দাদার বাড়িতে। মগ্ন থাকেন দেশ-বিদেশের বইয়ে। আর পূর্ণিয়ার সতীনাথকে দেখা যায় বাড়ির বাগানে খালি পায়ে ঘুরে বেড়াতে। ‘অচিন রাগিণী’র ‘বৃষ্টির পর মাটির গন্ধ বদলে’ যাওয়ার গল্প হয়তো তাই সতীনাথের নিজেরই পাওয়া। আসলে এই ‘অতৃপ্ত’ জীবনে খানিকটা হলেও বোধহয় তৃপ্তি এনেছিল প্রকৃতি।
তাই লেখা-রাজনীতি ছাড়া আর যে বিষয়ে বিশেষ যত্ন দেখা গেল সতীনাথের, তা হল ওই বাগান করায়। কেমন ধারার তা?
এক রাত্তিরে বাড়িতে এসেছেন গোপাল হালদার। দু’জনে গল্প চলে। এমন সময়ে হঠাৎ আসর থামালেন সতীনাথ। টর্চ হাতে পা টিপে টিপে বেরোলেন। কেন? সতীনাথ বলেন, ‘একটা ফুল ফুটতে আরম্ভ করেছিল, কতটা ফুটেছে’ তা দেখতেই আড্ডা ছে়ড়ে বেরোনো।
পরের দিন সকাল ৮টা-৯টা। বারান্দায় দু’জনে চা খাচ্ছেন। আলাপে ফের বাধা। ‘শুনছো’? কান পেতেও কিচ্ছুটি বোধহয় শোনা হল না গোপালবাবুর। বাড়ির অদূরের গাছে এসেছে এক বিশেষ পাখি। ওই পাখিই অমন ডাক পাড়ে। এ বার আরও চমকের পালা। সতীনাথ হিসেব দিলেন, গত বছরের তুলনায় ‘এ বার নয় দিন আগে এল’ পাখিটি! এই অন্য সতীনাথ ‘বাগানীয়া’, ‘গোলাপীয়া’, গোপালবাবুরই ভাষায়। তবে শুধু মগ্ন-নির্জনেই সতীনাথের প্রকৃতি-প্রেম শেষ নয়। আর তাই বনফুল হোন বা বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়, দেখা হলেই একটি উপহার বাঁধা— অর্কিড। বিলিতি এক লতার নাম রবীন্দ্রনাথ রেখেছিলেন, ‘নীলমণিলতা’। সতীনাথ ওই লতার নাম বদলে রাখলেন, ‘নীলমণি রবীন্দ্রাণী।’
এই বাগান, বাড়িই ‘অতৃপ্ত’ জাগতিক জীবনের শেষ ঠিকানা হল। ৩০ মার্চ, ১৯৬৫। সকালে লোকজনের সঙ্গে কথা বলছেন সতীনাথ। বাগানের রাস্তার ধারে পায়চারি করছেন ‘ভিজিল’ হাতে নিয়ে। পরিচারক বাবাজি বাজারে গিয়েছেন বাবুর জন্য পাবদা আনতে। আর সঙ্গে নতুন ধুতি।
বাবাজি ফিরলেন। দেখলেন, লাইব্রেরি ঘরের বারান্দায় টেবিলে আধখাওয়া জলখাবার। পাতকুয়োর পাশে পড়ে সতীনাথের দেহ। হৃদযন্ত্রে বাসা বাঁধা টিউমারটা বোধহয় ফেটে গিয়েছে। মুখ থেকে অল্প অল্প রক্ত ঝরছে। অদূরেই মুখ গুঁজে পাহারা!
কোশী নদীর তীরে কাপ্তানপুল শ্মশানঘাটে কাকাকে দাহ করলেন গৌতম ভাদুড়ী। গৌতমবাবু যেন ‘প্রথমবার পিতৃহারা’ হলেন। এই কাকার হাত ধরেই এক সময়ে যে গৌতমের গাছ চেনা হয়েছিল।
আসলে গাছ হোক বা দেশের মানুষ, লেখক ও মানুষ সতীনাথ তা-ই বিজনে আমাদের চেনাতে চেয়েছেন। তা আমরা চিনতে পেরেছি কি না, সে ‘খোঁজ’ উনি নিতে যাননি।

ঋণ: আনন্দবাজার আর্কাইভ; ‘দেশ’; ‘সতীনাথ গ্রন্থাবলী’ (সম্পাদনা: শঙ্খ ঘোষ, নির্মাল্য আচার্য); ‘সতীনাথ ভাদুড়ী’: সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায়; ‘সতীনাথ ভাদুড়ী’: স্বস্তি মণ্ডল; ‘সতীনাথ ও ফণীশ্বরনাথ ব্যক্তি ও শিল্পী’: নন্দকুমার বেরা; ‘দিবারাত্রির কাব্য’; ‘কোরক’। ছবি ঋণ: দিবারাত্রির কাব্য।

https://www.anandabazar.com/supplementary/patrika/a-write-up-of-satinath-bhaduri-1.842249?ref=patrika-new-stry