কথা শোনার রাজনীতির শতবর্ষ
১৯১৭’য় গাঁধীজি চম্পারণে গিয়ে প্রতিটি নীল-চাষির দুর্দশার বৃত্তান্ত শুনেছিলেন, তা সে যত অগোছালো হোক না কেন। আজকের রাজনীতির লোকেরা সেই শুশ্রূষা অনুশীলন করলে দেশের মঙ্গল।
কুমার রাণা
১৯ মে, ২০১৬, ০০:০০:০০
শুশ্রূষা। রিচার্ড অ্যাটেনবরো-র ‘গাঁধী’ ছবির একটি দৃশ্য।
নি রানব্বই বছর আগে হাওড়া স্টেশন থেকে পটনার ট্রেনে উঠলেন রাজকুমার শুক্লা। সঙ্গে তাঁরই মতো গেঁয়ো চেহারার, খাটো ধুতি পরা, ইন্দ্রলুপ্ত, পঞ্চাশ ছুঁইছুঁই এক পুরুষ। লোকটাকে ধরবার জন্য কত চেষ্টাই না করেছেন রাজকুমার। এ চেষ্টা যতখানি বিহারি কৃষকের অদম্য জেদের ফল, তার চেয়ে বেশি বোধ হয় জন্ম-জন্ম ধরে অর্জিত লোকপ্রজ্ঞায় এই ‘লোকটিই ঠিক লোক’ বোধে উপনীত হওয়ার পরিণতি। ভরসা খুঁজে ফেরা রাজকুমার মানুষটিকে দেখে ভরসা পেয়েছেন।
বিহারের উত্তর-পশ্চিম প্রান্তে নেপাল সীমান্তবর্তী জেলা চম্পারণ, সেখানকার নরকটিয়াগঞ্জ স্টেশন থেকে সাত মাইল পথ হাঁটলে তাঁর গ্রাম মুরলি ভারওয়া। গ্রাম থেকে গেছেন লখনউ; কংগ্রেস অধিবেশনে, চম্পারণে রায়তদের উপর নীলকরদের ভয়াবহ অত্যাচারের সুরাহা খুঁজতে। তৎকালীন কংগ্রেসের দিকপাল সব নেতা, লোকমান্য টিলক, পণ্ডিত মদনমোহন মালব্য-র কাছে সবিনয় নিবেদন, চম্পারণের রায়তদের জন্য কিছু করুন। ‘আগে দেশের স্বাধীনতা, তার পর অন্য সমস্যার সমাধান, এখন এ সব শোনার সময় কোথায়?’ রাজকুমারের হতাশা শেষ সীমায় পৌঁছনোর আগে আগেই লোকটিকে দেখলেন। এঁর কথা খানিক শুনেছেন, গুরুত্ব দিয়ে ভাবেননি। কিন্তু, শীর্ণ, দেহাতি চেহারার, সাধারণের মধ্যে মিশে থাকার অসাধারণ বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল মানুষটিকে নিজের চোখে দেখার পর রাজকুমার নিশ্চিত হন, ‘এঁকেই দরকার’। সরাসরি সনির্বন্ধ অনুরোধ: চম্পারণের নীলচাষিদের দুর্দশার কথাটা আপনি জনসমক্ষে তুলে ধরুন। প্রত্যুত্তরে তিনি জানালেন, ‘নিজের চোখে না দেখে আমি কোনও কথা বলব না।’ ‘তা হলে নিজের চোখে দেখে আসবেন, চলুন।’ তিনি কথা দিলেন পরের বছর মার্চ-এপ্রিল নাগাদ চম্পারণ যাবেন। কিন্তু রাজকুমারের তর সয় না, তাঁর পিছু ধরে চললেন কানপুর, সেখান থেকে আমদাবাদ, অবশেষে কলকাতা থেকে তাঁকে সঙ্গে করে চলা। সে যাত্রা শুরু হল ৭ এপ্রিল ১৯১৭।
পটনায় উঠলেন বিখ্যাত উকিল ও কংগ্রেস নেতা রাজেন্দ্র প্রসাদের প্রাসাদোপম বাড়িতে। রাজকুমার ভেবেছিলেন, সেখানে তাঁদের আতিথ্য জুটবে, জুটেও ছিল, রাজেন্দ্র প্রসাদ বাড়িতে ছিলেন না যদিও। কিন্তু সেই আতিথ্যের সঙ্গে মিশে ছিল জাতপাত, শ্রেণি এবং পদমর্যাদাজনিত বিভাজনের অমানবিকতা। রাজকুমারের সঙ্গীর কাছে এগুলো নতুন নয়, গায়ে মাখেননি। তাঁর দরকার ছিল স্থানীয় কংগ্রেস নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ। রাজকুমারের ইচ্ছাশক্তি প্রবল, কিন্তু তাঁকে কেউ পাত্তা দেয় না— একে চাষি তায় আবার নেপাল সীমান্তের কোন এঁদো গাঁয়ের বাসিন্দা! অতএব ‘যা করার নিজেকেই করতে হবে’ বলে ধর্মাচরণে গোঁড়া হিন্দু মানুষটি আতিথ্য নিলেন বরিষ্ঠ কংগ্রেস নেতা মজহারুল হকের। ধর্মাচরণ ব্যক্তিগত ব্যাপার, সামাজিক পরিসরে তার অনুপ্রবেশ তাঁর কাছে অনাকাঙ্ক্ষিতই শুধু নয়, প্রতিরোধ্য একটা ব্যাপার। এই বোধেই অল্প কিছু দিন পর যখন চম্পারণে নীলচাষিদের কথা শোনা হচ্ছে, তখন সেখানে তিনি কংগ্রেস নেতাদের আলাদা আলাদা রান্নার ব্যবস্থা তুলে দিচ্ছেন: তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে অনেক কংগ্রেস নেতা-কর্মী হাজির হন চম্পারণে, কিন্তু তাঁদের অনেকেই সঙ্গে রান্নার ঠাকুর নিয়ে গিয়েছেন! জাতপাতের ভিন্নতাকে ভেঙে তিনি চালু করলেন এক হাঁড়িতে খাওয়ার ব্যবস্থা।
কিন্তু তিনি তো কেবল সমাজ সংস্কারক নন, আদ্যন্ত রাজনীতিকার। এবং রাজনীতিবিদ বা রাজনীতিজ্ঞই নন শুধু, ব্যবহারিক রাজনীতিই তাঁর জীবন। সে রাজনীতিকে তিনি উত্তীর্ণ করলেন প্রকৃতই লোক-রাজনীতির চূড়ায়। যে কালে বাগ্মিতাই জননেতা হওয়ার পূর্ব শর্ত, যিনি যত প্রলম্বিত/উত্তেজক/আবেগঘন ভাষণ দিতে পারেন, তিনি তত বড় নেতা, সেই সময়কে বিভাজিত করলেন এই আপাত-বৈশিষ্ট্যহীন চেহারার মানুষটি: তাঁর রাজনীতি আশ্রিত হল, বলা নয়, শোনার ওপর। ‘লোকেদের কথা শুনতে হবে, সে কথা যতই অগোছালো, পুনরাবৃত্তি বা অস্পষ্টতা দোষে দুষ্ট হোক না কেন।’ কথা শোনাটাই হয়ে উঠল একটা মস্ত অঙ্গীকার। জনসাধারণের দুঃখ-দুর্দশা, সুখ-আনন্দের অংশীদারির ভিতর দিয়ে তাঁদের দিশারি হয়ে ওঠার আত্মপ্রতিশ্রুতি। শ্রবণ একটি গুণমাত্র নয়, তা একটি শর্ত: দেশ-জাতির উন্নতি ঘটানো যদি রাজনীতির উদ্দেশ্য হয়, তা হলে দেশবাসীর কথা শুনতেই হবে। দেশ তো কোনও বিচ্ছিন্ন, বিমূর্ত সত্তা নয়, লক্ষ কোটি নিরন্ন, অবদমিত, প্রথা-শৃঙ্খলিত মানুষকে নিয়েই দেশ। সে দেশের স্বাধীনতা তো কেবল ক্ষমতার হস্তান্তর নয়, আসলে তো তা জনসাধারণের শৃঙ্খলমুক্তি। সে উদ্দেশ্য সাধনে, কান পেতে, মনোযোগ দিয়ে শোনার ভূমিকা যে কতটা নির্বিকল্প, তার ফলিত রূপ দেখা গেল ১৯১৭-র গ্রীষ্মে— চম্পারণে।
রাজকুমার শুক্লার সঙ্গীটি সে দিন বিখ্যাত কেউ নন, কিন্তু শুক্লা তাঁকে যে ভাবে চিনে নিয়েছিলেন, সে ভাবেই তাঁকে আপন মানুষ বলে চিনে নিল তিরহুত-এর জনতা। পটনা থেকে ট্রেনে মুজফ্ফরপুর নামামাত্রই জনতা হয়ে উঠল তাঁর সঙ্গী। সেখান থেকে মোতিহারি, তৎকালীন চম্পারণ জেলা সদর, অধুনা পূর্ব চম্পারণ জেলার মুখ্যালয়। দলে দলে রায়তদের আগমন, সারা দিন ধরে চলছে তাঁদের কথা শোনার কাজ, প্রায় সারা রাত ধরে চলছে সেই সব কথার পরীক্ষানিরীক্ষা, বিশ্লেষণ। বড় বড় উকিল, কংগ্রেস নেতা এবং অধ্যাপকরাও তাঁর সঙ্গী, স্বেচ্ছাসেবী। এ রাজনীতি শাসকের অজানা, এবং ভয়ঙ্কর বিপজ্জনক। এ রাজনীতি আপাত-নিষ্ক্রিয়, এতে সরকার বিরোধিতার কোনও উচ্চরব রণধ্বনি নেই, নেই সমালোচনায় বিদ্ধ করার প্রকরণ।
অজ্ঞাতপূর্ব এই অনুশীলনের প্রক্রিয়া, শুধু শুনে যাওয়া। অজানা বলেই শাসকের আতংক দ্বিগুণ হল, এবং অচিরে ঘোষণা করা হল, ‘লোকটাকে চম্পারণ ছাড়তে হবে, ওর এখানে থাকাটা বিপজ্জনক, যে কোনও সময় প্রজাবিদ্রোহ হতে পারে।’ এক পুলিশকর্তা তো বলেই বসলেন, ‘এই কথা-শোনার প্রক্রিয়া ‘শ্রেণিযুদ্ধের সূচনা করবে।’ আদালতে হাজিরা দিয়ে লোকটি শান্তকণ্ঠে জানিয়ে দিলেন, ‘আইন মেনে চলা নাগরিক হিসেবে আমার প্রথম বোধটা হচ্ছে, আমাকে সরকারি হুকুম মানতে হবে। কিন্তু এ কাজ করতে হলে আমি যাঁদের জন্য এসেছি তাঁদের প্রতি কর্তব্যবোধের বিরুদ্ধেই হিংসার প্রয়োগ ঘটাতে হবে।’ এবং যতক্ষণ পর্যন্ত না নীলচাষিদের অবস্থা বিষয়ে তাঁর তদন্ত শেষ হচ্ছে, তিনি চম্পারণ ছেড়ে নড়বেন না। এটা যদি আইন ভাঙা হয়, সরকার তাঁকে জেলে পুরুক, তিনি প্রস্তুত।
সে যাত্রায় সরকার পিছু হটে, তাঁকে গ্রেফতার করে না। গ্রেফতার করা কঠিন ছিল, কথা শোনাটাকে অপরাধ হিসেবে দেখানো সহজ ছিল না। অবশ্য যতক্ষণ তিনি কথা শুনছেন, ততক্ষণ সেখানে পুলিশের লোক উপস্থিত থেকেছে। কিন্তু তাতে তাঁর কিছু যায় আসে না, তিনি তো গোপনে কিছু করতে চাননি, বস্তুত রাজনীতির প্রকাশ্যকরণই তাঁর রাজনৈতিক শক্তি। পুলিশ যদি সেই প্রক্রিয়ার সাক্ষী থাকতে চায় থাক, তাতে তাঁর কোনও সমস্যা নেই। কিন্তু সমস্যায় পড়ল রাষ্ট্র, পুলিশ, ম্যাজিস্ট্রেট, সচিব— কেউই বুঝতে পারছে না এ লোকটাকে নিয়ে কী করা— সে নিজে তো কিছু বলছে না, কেবল শুনছে। এক বেতিয়াতেই পঁচিশ হাজার রায়তের বয়ান নথিভুক্ত হয়: দশ হাজারের সম্পূর্ণ, বাকিদের আংশিক। শুধু শিবিরে বসে নয়, শোনা হচ্ছে গ্রামে গ্রামান্তরে হেঁটে হেঁটে। বিহারের বৈশাখ মানে বাতাসে আগুন, সেই তাপপ্রবাহের ভিতর দিয়ে তিনি হেঁটে চলেছেন মাইলের পর মাইল, আর যেখানেই যাচ্ছেন, উতরোল হয়ে উঠছে জনতা, শুধুমাত্র তাঁকে এক বার চোখের দেখা দেখার জন্য। তত দিনে লোকে জেনেছেন, তাঁদের কথা শোনারও কেউ আছেন। এই প্রতীতিতে তাঁদের শত শত বছর ধরে জমে থাকা শাসক-ভীতি মুহূর্তে অবলুপ্ত। পুলিশের সামনে দাঁড়িয়ে তাঁরা গলা খুলে বলে যাচ্ছেন নীলকরদের অত্যাচারের কথা, এমনকী নীলকর সাহেবের সামনেও।
শুনতে শুনতে তিনি শেখাচ্ছেনও, কী ভাবে শুনতে হয়। এক নীলকর ভেবেছিল রায়তরা তার সামনে অন্তত কোনও অভিযোগ আনবে না, এবং আরও নিশ্চিন্ত হওয়ার জন্য অসদুপায়ে কয়েক জনকে মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে প্রলুব্ধ করেছিল। সে ডাকে, ‘আসুন, নিজের কানে শুনে যান, আমি রায়তদের জন্য কত ভাল ভাল কাজ করেছি।’ আমন্ত্রণ গৃহীত হল। কথা শুরু হল স্তাবকতা দিয়ে, আর সঙ্গে সঙ্গে জনতা প্রতিবাদ করে উঠল, ‘মিথ্যা বলছে, ও যা বলছে তার মধ্যে এক ফোঁটাও সত্যি নেই।’ করজোড়ে জনতাকে থামালেন, ‘ওঁকে বলতে দিন। সকলেরই কথা বলার হক আছে। ওঁর কথা শোনার পরে আপনারা আপনাদের কথা বলবেন।’
শোনার পর্ব চলতে থাকল। যিনি প্রথমে ভেবেছিলেন, চম্পারণে কয়েকটা দিন মাত্র কাটাবেন, সেখানেই তাঁকে ভ্রাম্যমাণ ডেরা গড়তে হল কয়েক মাসের জন্য। ভারতবর্ষের রাজনীতি সাবালক হয়ে উঠল এই কথানুশীলনের প্রক্রিয়ায়।
আর গেঁয়ো চেহারার লোকটি হয়ে উঠলেন লোকনেতৃত্বের প্রতীক। মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধী থেকে ‘গাঁধীজি’তে পরিণত হওয়াটা বাস্তবিক তাঁর নয়, ভারতবর্ষের উত্তরণ। একশো বছর পরেও তাই চম্পারণ আন্দোলন সমান বা বেশি প্রাসঙ্গিক। আজ কথা শোনার অভ্যাসটাই যেহেতু ভয়ানক ভাবে আক্রান্ত, সেই প্রক্রিয়াটাকে বাঁচিয়ে রাখার দায়টাও অত্যন্ত বেশি। তেমনই জরুরি, মোহনদাসের ‘গাঁধীজি’ হয়ে ওঠার পিছনে রাজকুমার শুক্লার মতো বিহারি কৃষকদের ভূমিকা স্মরণ করা। সেই কৃষককে ঠিক মতো চিনে নেওয়ার ক্ষমতা, তাঁর কথার ভিতর দিয়ে, আচরণের মধ্য থেকে জনসাধারণের অন্তর্বেদনাকে বুঝে নিয়ে রাজনীতির পথ ঠিক করতে পারার ক্ষমতায় যদি গাঁধীজি লোকনেতা হয়ে থাকেন, তবে তাঁকে ভবিষ্যৎ নেতা হিসেবে চিনে নেওয়ার কৃতিত্বটাও রাজকুমার শুক্লার প্রাপ্য।
আজকের দুঃসময়ে, যখন বাঁ হাত টাকা নেয় আর ডান হাত ঘুষি মারে, কথা শোনাটা যখন বিলাসিতা, মেরে কাজ হাসিল করাটা যখন রাজধর্ম, তখন গাঁধীজি হওয়ার মতো কেউ আছেন কি না জানা নেই, কিন্তু রাজকুমার শুক্লারা তো আছেন। কথা শোনার রাজনীতিকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার গুরুদায়িত্ব পালনে তাঁরাই ভরসা জোগাতে পারেন। কথা শোনার ভিতর দিয়ে গড়ে তোলা যে সহিষ্ণুতায় গাঁধীজি জীবন ও মৃত্যু দিয়েছেন, তার পুনরাধিষ্ঠানে রাজকুমার শুক্লার উত্তরাধিকার ভারতবর্ষের জিয়নকাঠি।
ঋণ: গাঁধী ইন চম্পারণ, ডি জি তেন্ডুলকর। পাবলিকেশনস ডিভিশন, ভারত সরকার (১৯৫৭) ১৯৯৪
http://www.anandabazar.com/editorial/political-democracy-reaches-100-years-1.390193