অবিস্মরণীয় জ্যোতির্ময় বসু
কলকাতা রবিবার ১৭ই জানুয়ারি, ২০১৬ ইং
দিলীপ বন্দ্যোপাধ্যায়: জ্যোতির্ময় বসু ভারতের সংসদীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। জন্ম ১৮ ডিসেম্বর ১৯২০ সালে, কলকাতায়। মৃত্যু ১২ জানুয়ারি ১৯৮২, রাজস্থানের জয়পুরে, হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। ভারতীয় সেনাবাহিনীতে কমিশনড অফিসার ছিলেন। ১৯৫২–১৯৫৪ রাজকীয় গোলন্দাজ বাহিনীর কাজে লন্ডনে ছিলেন। এই সময়ে তিনি গ্রেট ব্রিটেনের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক হ্যারি পলিটের সঙ্গে পরিচিত হন। ১৯৫৫ সালে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সংস্পর্শে আসেন। ১৯৫৯ সালে তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সূচনা। ১৯৬৪ সালে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির (মার্কসবাদী) সদস্যপদ লাভ করেন। ১৯৬৭ সালে চতুর্থ সাধারণ নির্বাচনে ডায়মন্ডহারবার কেন্দ্র থেকে সি পি আই (এম) দলের প্রার্থী হয়ে লোকসভায় নির্বাচিত হন। এবং সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। পরবর্তীকালে ১৯৭১, ১৯৭৭ এবং ১৯৮০ সালে ওই কেন্দ্র থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৭৭ সালের নির্বাচনে তাঁকে পরাজিত করার জন্য স্বয়ং ইন্দিরা গান্ধী সবরকমভাবে চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। ১৯৭৫ সালের ২৫ জুন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী অভ্যন্তরীণ জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে বহু নেতা ও কর্মীকে ডি আই আর ও মিশায় গ্রেপ্তার করে বিনা বিচারে আটক করেন। জ্যোতির্ময় বসুকে এই সময় ১৯ মাস কারাবন্দী থাকতে হয়েছিল। তাঁর ওপর মানসিক নিপীড়ন করা হয়েছিল। নির্জন কারাকক্ষে রাখা হয়েছিল। যুক্তি তথ্যের জোরে ১৫ বছরের সংসদীয় জীবনে তিনি দক্ষ সক্রিয় সাংসদ হিসেবে অসাধারণ পারদর্শিতা দেখিয়েছেন। পঞ্চদশ লোকসভায় এমন দিন ছিল না, যেদিন লোকসভা রিপোর্টিং–এর শিরোনামে তিনি ছিলেন না। বিশিষ্ট সাংসদ অধ্যাপক হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের কথায় ‘জ্যোতির্ময় বসুর তুলনা নেই, সরকারকে শঙ্কিত করার নৈপুণ্যে তাঁর জুড়ি দেখা যায়নি।’ অনুসন্ধানী সাংসদরূপে তিনি বিশিষ্ট ছিলেন। আজকের দিনে সংসদের প্রতি সে মর্যাদাবোধ আর সাংসদদের প্রতি সে সম্মান নেই।
জ্যোতির্ময় বসু ১৯৭৩–১৯৭৫ লোকসভায় পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটির চেয়ারম্যান হয়ে কমিটির কার্যকারিতা সম্পর্কে জনসাধারণের মধ্যে শোরগোল ফেলে দিয়েছিলেন। ৮০টিরও বেশি রিপোর্ট লোকসভায় পেশ করে সংসদের ইতিহাসে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করেছিলেন। এগুলির মধ্যে ৪০টি রিপোর্ট–এ সরকারি আয়–ব্যয়ের ক্ষেত্রে অনিয়ম ছিল। আর একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কমিটি— পাবলিক আন্ডারটেকিং কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন ১৯৭৭–৭৯ পর্যন্ত। কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলির কার্যকলাপের তদারকি ও প্রয়োজনীয় সুপারিশ করাই এই কমিটির কাজ। এখানেও তিনি অনন্য। লোকসভায় তিনি সি পি আই (এম) দলের মুখ্য সচেতক ছিলেন। তিনিই পথ দেখিয়েছিলেন বিরোধী দলের মধ্যে ঐক্য এনে শাসকদলের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আক্রমণ করা। জ্যোতির্ময় বসু পঞ্চম লোকসভায় (১৯৭১–১৯৭৭) জনজীবনের বিভিন্ন বিষয়ের ওপর গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার জন্য ৫০টি মুলতুবি প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন। যা স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বে একদলীয়–একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে চারবার অনাস্থা প্রস্তাব তুলেছিলেন। ১৯৭৪ সালের ২৩ জুলাই কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ এনে জ্যোতির্ময় বসু বলেছিলেন— ‘আমি বরাবরই বলে আসছি শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী এদেশে সমস্ত দুর্নীতির উৎস। Fountainhead of corruption. বলে ইন্দিরা গান্ধীকে বর্ণনা করেছিলেন। বক্তব্যের সমর্থনে তিনি অনেক প্রামাণ্য দলিল হাজির করেছিলেন। এইসব দলিলে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী ও তাঁর সরকারের দুর্নীতি, স্বজনপোষণ, স্বেচ্ছাচারিতা এবং জনবিরোধী কার্যকলাপের বহু চাঞ্চল্যকর তথ্য ছিল। সর্বভারতীয় সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছিল।
এই সময়ে তিনি দশটি বিশেষ বিষয়ের ওপর বিতর্কের সূত্রপাত করেছিলেন।
১৯৭২ সালে লোকসভায় জ্যোতির্ময় বসুই প্রথম ফাঁস করেছিলেন প্রধানমন্ত্রীর প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে ‘রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিসিস উইং (‘র’)’ নামে একটি গুপ্তচর সংস্থার কথা। বসু তাঁর ভাষণে বলেছিলেন যে, ‘র’–ই পশ্চিমবঙ্গে শত শত সি পি এম এবং বামপন্থী কর্মীকে গুপ্তভাবে এবং পাইকারি হত্যা করেছে। পশ্চিমবঙ্গে সেই সময় মস্তানবাহিনী ‘র’–এর কাছ থেকে নিয়মিত অর্থ পেত। ১৯৭২–র আগে এই ত্রাস সঞ্চারকারী গুপ্তচর সংস্থাটির অস্তিত্বের কথা সাধারণ মানুষ জানতেন না।
‘মিসা’ চারবার সংশোধন করা হয়েছে প্রশাসন ও পুলিসের হাতে ব্যাপক ক্ষমতা তুলে দেওয়ার জন্য।
১৯৭১ সালের ২৪ মে স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার দিল্লির পার্লামেন্ট স্ট্রিট শাখা থেকে রহস্যজনকভাবে প্রধানমন্ত্রীর নাম করে ৬০ লক্ষ টাকা উধাও হওয়ার ব্যাপারে একটি জালিয়াতি ধরা পড়ে। ‘র’–র গুপ্তচর রুস্তম নাগরওয়ালা জড়িত অভিযোগে মামলা হয় এবং নাগরওয়ালার কারাদণ্ড হয়। কারাগারে থাকাকালীন রহস্যজনকভাবে তাঁর মৃত্যু হয়। বসু বলেছিলেন নাগরওয়ালা প্রকৃত ঘটনা ফাঁস করে দিতে পারে ভেবে তাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। বসুর মতে, এই জালিয়াতির ব্যাপারে যাঁরা জড়িত তাঁরা সাধারণ ব্যক্তি ছিলেন না। ওয়াঞ্চু কমিটির রিপোর্ট–এ কালো টাকার ভয়াবহ বৃদ্ধিতে যে অন্তর্বর্তীকালীন কয়েকটি জরুরি সুপারিশ পেশ করা হয়েছিল তা ইন্দিরা গান্ধীর সরকার প্রকাশ করতে চাইছিল না। ১৯৭২ সালের ১০ আগস্ট সেই ‘অত্যন্ত গোপনীয়’ রিপোর্ট লোকসভায় ফাঁস করে দিয়ে জ্যোতির্ময় বসু চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিলেন। বসু বলেছিলেন কালো টাকা ইন্দিরা গান্ধীর শ্রীবৃদ্ধিতে সাহায্য করেছিল। কালো টাকা কীভাবে নির্বাচনী তহবিল ভর্তি করে সে সম্পর্কে অনেক তথ্য বসু দিয়েছেন। বর্তমানে চিটফান্ডের টাকা শাসকদলের নির্বাচনী কাজে লেগেছে। সে কথা সকলেই জানেন।
মারুতি মোটর গাড়ি নির্মাণের জন্য প্রধানমন্ত্রীর পুত্র সঞ্জয় গান্ধীকে সুযোগসুবিধা দেওয়ার জন্য সরকারি বিধিবিধান ভঙ্গ করে অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। এবং কৃষককে উচ্ছেদ করে জমি দখলের কেন্দ্রীয় আইন ভঙ্গ করে জলের দামে ওই কারখানা নির্মাণের জন্য জমি সংগ্রহ করে দেওয়া হয়েছিল। জ্যোতির্ময় বসুর পেশ করা সেই তথ্যও বিশেষভাবে জনমনে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। মারুতি মোটর গাড়ি নির্মাণের জন্য সমস্ত প্রচলিত আইনকানুন ন্যায়নীতি বিসর্জন দেওয়া হয়েছিল এই কারণে যে, মারুতির মালিক সঞ্জয় গান্ধী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর পুত্র। স্বজনপোষণ ও দুর্নীতির এটি চরম দৃষ্টান্ত। সমস্ত দেশের কলঙ্ক। জরুরি অবস্থাকালে সঞ্জয় গান্ধী প্রভূত পরিমাণ টাকার মালিক হয়েছিলেন। বসু তাঁর একাধিক ভাষণে দেখিয়েছেন কীভাবে মারুতি কোম্পানি কালোবাজারি চোরাচালানি এবং বৈদেশিক বিনিময় সংক্রান্ত নিয়মবিধি লঙ্ঘনকারীদের তীর্থস্থানে পরিণত হয়েছিল। অথচ মারুতি গাড়ি নির্মিত হয়নি। হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী বংশীলাল জমি জবরদখলে সাহায্য করেছিলেন।
জ্যোতির্ময় বসু ১৯৭১–এর ১৭ নভেম্বর লোকসভায় পশ্চিমবঙ্গের আইন ও শৃঙ্খলা পরিস্থিতির ক্রমাবনতিতে এবং সেখানে এক শ্রেণীর পুলিস, সি আর পি, প্রশাসনযন্ত্র এবং সমাজবিরোধীদের কার্যকলাপে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বক্তব্য পেশ করেন। ‘র’–এর পরিচালনায় ‘গণতন্ত্র ধ্বংস কর’ লক্ষ্য রেখে রাজ্যব্যাপী কায়েম করেছিল মস্তানের রাজত্ব। বক্তব্যের মধ্যে বেশ কিছু নৃশংসতার ঘটনা উল্লেখ করেছিলেন। তার মধ্যে সোনারপুর থানায় পুলিস প্রবীণ রাজনৈতিক কর্মী নারায়ণ রায়চৌধুরির মাথার পিছন দিকে ‘সি পি এম’ অক্ষর তিনটি খোদাই করে দিয়েছিল। আদালতে হাকিম এই অবস্থা দেখে পুলিসকে তিরস্কার করেন এবং বলেন, ‘আজ আমরা একটি পুলিস রাষ্ট্রে বাস করছি।’ ঢাকুরিয়ার নগেন্দ্র ঘোষ লেনের বাসিন্দা মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী সলিল ঘোষকে ১ অক্টোবর ১৯৭১ পুলিস গ্রেপ্তার করে সন্ধ্যায়। এ খবর শুনে সলিলের বাবা, মা, বোন থানায় ও সি–র সঙ্গে দেখা করলে ও সি বলেন, পরদিন সকালে ছেড়ে দেওয়া হবে। পরদিন থানায় সলিলের বাবা গেলে তাঁর সামনেই পুলিস নির্মমভাবে সলিলকে মারতে থাকে। সলিলের বাবা ফিরে এসে স্থানীয় সংগঠন কংগ্রেস নেতাকে বললে তিনি থানায় ফোন করেন। থানা থেকে বলা হয় সলিলকে বাঙুর হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। হাসপাতালে পৌঁছবার পর জানা গেল মৃত অবস্থায় সলিলকে থানা থেকে পাঠানো হয়েছিল। জ্যোতির্ময় বসু যখন একের পর এক ঘটনাগুলি বলছিলেন তখন সভা নিস্তব্ধ ছিল। স্তম্ভিত হয়ে সদস্যরা ঘটনাগুলি শুনছিলেন। জ্যোতির্ময় বসু শেষকালে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, ‘আপনি তো একজন মা’।
এরপর পোস্টার কেলেঙ্কারির উল্লেখ করে বলেন, আর পি গোয়েঙ্কা ডানকান ব্রাদার্সের ম্যানেজিং ডিরেক্টর কলকাতার সরস্বতী প্রেসকে কংগ্রেস প্রার্থীদের জয়যুক্ত করার আহ্বান জানিয়ে, কংগ্রেসের প্রতীক এবং ইন্দিরা গান্ধীর ছবি–সহ ১৩ লক্ষ ৫০ হাজার পোস্টার ছাপানোর অর্ডার দেন এবং এর জন্য ৫ লক্ষ টাকা সরস্বতী প্রেসকে দেন। প্রথমে ইন্দিরা গান্ধী কংগ্রেসের পক্ষ থেকে ঘটনাটি অস্বীকার করেন। জ্যোতির্ময় বসু গোয়েঙ্কাদের দেওয়া অর্ডার, টাকা প্রদান–সহ যাবতীয় দলিলের ফটোকপি লোকসভায় পেশ করেন। শুধু তাই না, এই তথ্য ফাঁসের অভিযোগে সরস্বতী প্রেস কর্তৃপক্ষ প্রেসের একজন কর্মচারী বটকৃষ্ণ ধরকে ছাঁটাই করে। সে দলিলও লোকসভায় পেশ করা হয়েছিল। ফলে অস্বীকার করার কোনও কারণ দ্বিতীয়বার দেখা যায়নি।
পশ্চিমবঙ্গে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে ১৩ জন রাজ্য সরকারি কর্মচারী এবং ৩২ জন কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীকে সরাসরি বিনা নোটিসে বরখাস্ত করা হয়েছিল। স্বীকার করতেই হবে ভারতের সংসদীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে বিস্মৃতপ্রায় জ্যোতির্ময় বসুর অবদান অতুলনীয়।
জ্যোতির্ময় বসু ১৯৭৩–১৯৭৫ লোকসভায় পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটির চেয়ারম্যান হয়ে কমিটির কার্যকারিতা সম্পর্কে জনসাধারণের মধ্যে শোরগোল ফেলে দিয়েছিলেন। ৮০টিরও বেশি রিপোর্ট লোকসভায় পেশ করে সংসদের ইতিহাসে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করেছিলেন। এগুলির মধ্যে ৪০টি রিপোর্ট–এ সরকারি আয়–ব্যয়ের ক্ষেত্রে অনিয়ম ছিল। আর একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কমিটি— পাবলিক আন্ডারটেকিং কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন ১৯৭৭–৭৯ পর্যন্ত। কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলির কার্যকলাপের তদারকি ও প্রয়োজনীয় সুপারিশ করাই এই কমিটির কাজ। এখানেও তিনি অনন্য। লোকসভায় তিনি সি পি আই (এম) দলের মুখ্য সচেতক ছিলেন। তিনিই পথ দেখিয়েছিলেন বিরোধী দলের মধ্যে ঐক্য এনে শাসকদলের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আক্রমণ করা। জ্যোতির্ময় বসু পঞ্চম লোকসভায় (১৯৭১–১৯৭৭) জনজীবনের বিভিন্ন বিষয়ের ওপর গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার জন্য ৫০টি মুলতুবি প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন। যা স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বে একদলীয়–একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে চারবার অনাস্থা প্রস্তাব তুলেছিলেন। ১৯৭৪ সালের ২৩ জুলাই কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ এনে জ্যোতির্ময় বসু বলেছিলেন— ‘আমি বরাবরই বলে আসছি শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী এদেশে সমস্ত দুর্নীতির উৎস। Fountainhead of corruption. বলে ইন্দিরা গান্ধীকে বর্ণনা করেছিলেন। বক্তব্যের সমর্থনে তিনি অনেক প্রামাণ্য দলিল হাজির করেছিলেন। এইসব দলিলে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী ও তাঁর সরকারের দুর্নীতি, স্বজনপোষণ, স্বেচ্ছাচারিতা এবং জনবিরোধী কার্যকলাপের বহু চাঞ্চল্যকর তথ্য ছিল। সর্বভারতীয় সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছিল।
এই সময়ে তিনি দশটি বিশেষ বিষয়ের ওপর বিতর্কের সূত্রপাত করেছিলেন।
১৯৭২ সালে লোকসভায় জ্যোতির্ময় বসুই প্রথম ফাঁস করেছিলেন প্রধানমন্ত্রীর প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে ‘রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিসিস উইং (‘র’)’ নামে একটি গুপ্তচর সংস্থার কথা। বসু তাঁর ভাষণে বলেছিলেন যে, ‘র’–ই পশ্চিমবঙ্গে শত শত সি পি এম এবং বামপন্থী কর্মীকে গুপ্তভাবে এবং পাইকারি হত্যা করেছে। পশ্চিমবঙ্গে সেই সময় মস্তানবাহিনী ‘র’–এর কাছ থেকে নিয়মিত অর্থ পেত। ১৯৭২–র আগে এই ত্রাস সঞ্চারকারী গুপ্তচর সংস্থাটির অস্তিত্বের কথা সাধারণ মানুষ জানতেন না।
‘মিসা’ চারবার সংশোধন করা হয়েছে প্রশাসন ও পুলিসের হাতে ব্যাপক ক্ষমতা তুলে দেওয়ার জন্য।
১৯৭১ সালের ২৪ মে স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার দিল্লির পার্লামেন্ট স্ট্রিট শাখা থেকে রহস্যজনকভাবে প্রধানমন্ত্রীর নাম করে ৬০ লক্ষ টাকা উধাও হওয়ার ব্যাপারে একটি জালিয়াতি ধরা পড়ে। ‘র’–র গুপ্তচর রুস্তম নাগরওয়ালা জড়িত অভিযোগে মামলা হয় এবং নাগরওয়ালার কারাদণ্ড হয়। কারাগারে থাকাকালীন রহস্যজনকভাবে তাঁর মৃত্যু হয়। বসু বলেছিলেন নাগরওয়ালা প্রকৃত ঘটনা ফাঁস করে দিতে পারে ভেবে তাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। বসুর মতে, এই জালিয়াতির ব্যাপারে যাঁরা জড়িত তাঁরা সাধারণ ব্যক্তি ছিলেন না। ওয়াঞ্চু কমিটির রিপোর্ট–এ কালো টাকার ভয়াবহ বৃদ্ধিতে যে অন্তর্বর্তীকালীন কয়েকটি জরুরি সুপারিশ পেশ করা হয়েছিল তা ইন্দিরা গান্ধীর সরকার প্রকাশ করতে চাইছিল না। ১৯৭২ সালের ১০ আগস্ট সেই ‘অত্যন্ত গোপনীয়’ রিপোর্ট লোকসভায় ফাঁস করে দিয়ে জ্যোতির্ময় বসু চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিলেন। বসু বলেছিলেন কালো টাকা ইন্দিরা গান্ধীর শ্রীবৃদ্ধিতে সাহায্য করেছিল। কালো টাকা কীভাবে নির্বাচনী তহবিল ভর্তি করে সে সম্পর্কে অনেক তথ্য বসু দিয়েছেন। বর্তমানে চিটফান্ডের টাকা শাসকদলের নির্বাচনী কাজে লেগেছে। সে কথা সকলেই জানেন।
মারুতি মোটর গাড়ি নির্মাণের জন্য প্রধানমন্ত্রীর পুত্র সঞ্জয় গান্ধীকে সুযোগসুবিধা দেওয়ার জন্য সরকারি বিধিবিধান ভঙ্গ করে অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। এবং কৃষককে উচ্ছেদ করে জমি দখলের কেন্দ্রীয় আইন ভঙ্গ করে জলের দামে ওই কারখানা নির্মাণের জন্য জমি সংগ্রহ করে দেওয়া হয়েছিল। জ্যোতির্ময় বসুর পেশ করা সেই তথ্যও বিশেষভাবে জনমনে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। মারুতি মোটর গাড়ি নির্মাণের জন্য সমস্ত প্রচলিত আইনকানুন ন্যায়নীতি বিসর্জন দেওয়া হয়েছিল এই কারণে যে, মারুতির মালিক সঞ্জয় গান্ধী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর পুত্র। স্বজনপোষণ ও দুর্নীতির এটি চরম দৃষ্টান্ত। সমস্ত দেশের কলঙ্ক। জরুরি অবস্থাকালে সঞ্জয় গান্ধী প্রভূত পরিমাণ টাকার মালিক হয়েছিলেন। বসু তাঁর একাধিক ভাষণে দেখিয়েছেন কীভাবে মারুতি কোম্পানি কালোবাজারি চোরাচালানি এবং বৈদেশিক বিনিময় সংক্রান্ত নিয়মবিধি লঙ্ঘনকারীদের তীর্থস্থানে পরিণত হয়েছিল। অথচ মারুতি গাড়ি নির্মিত হয়নি। হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী বংশীলাল জমি জবরদখলে সাহায্য করেছিলেন।
জ্যোতির্ময় বসু ১৯৭১–এর ১৭ নভেম্বর লোকসভায় পশ্চিমবঙ্গের আইন ও শৃঙ্খলা পরিস্থিতির ক্রমাবনতিতে এবং সেখানে এক শ্রেণীর পুলিস, সি আর পি, প্রশাসনযন্ত্র এবং সমাজবিরোধীদের কার্যকলাপে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বক্তব্য পেশ করেন। ‘র’–এর পরিচালনায় ‘গণতন্ত্র ধ্বংস কর’ লক্ষ্য রেখে রাজ্যব্যাপী কায়েম করেছিল মস্তানের রাজত্ব। বক্তব্যের মধ্যে বেশ কিছু নৃশংসতার ঘটনা উল্লেখ করেছিলেন। তার মধ্যে সোনারপুর থানায় পুলিস প্রবীণ রাজনৈতিক কর্মী নারায়ণ রায়চৌধুরির মাথার পিছন দিকে ‘সি পি এম’ অক্ষর তিনটি খোদাই করে দিয়েছিল। আদালতে হাকিম এই অবস্থা দেখে পুলিসকে তিরস্কার করেন এবং বলেন, ‘আজ আমরা একটি পুলিস রাষ্ট্রে বাস করছি।’ ঢাকুরিয়ার নগেন্দ্র ঘোষ লেনের বাসিন্দা মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী সলিল ঘোষকে ১ অক্টোবর ১৯৭১ পুলিস গ্রেপ্তার করে সন্ধ্যায়। এ খবর শুনে সলিলের বাবা, মা, বোন থানায় ও সি–র সঙ্গে দেখা করলে ও সি বলেন, পরদিন সকালে ছেড়ে দেওয়া হবে। পরদিন থানায় সলিলের বাবা গেলে তাঁর সামনেই পুলিস নির্মমভাবে সলিলকে মারতে থাকে। সলিলের বাবা ফিরে এসে স্থানীয় সংগঠন কংগ্রেস নেতাকে বললে তিনি থানায় ফোন করেন। থানা থেকে বলা হয় সলিলকে বাঙুর হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। হাসপাতালে পৌঁছবার পর জানা গেল মৃত অবস্থায় সলিলকে থানা থেকে পাঠানো হয়েছিল। জ্যোতির্ময় বসু যখন একের পর এক ঘটনাগুলি বলছিলেন তখন সভা নিস্তব্ধ ছিল। স্তম্ভিত হয়ে সদস্যরা ঘটনাগুলি শুনছিলেন। জ্যোতির্ময় বসু শেষকালে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, ‘আপনি তো একজন মা’।
এরপর পোস্টার কেলেঙ্কারির উল্লেখ করে বলেন, আর পি গোয়েঙ্কা ডানকান ব্রাদার্সের ম্যানেজিং ডিরেক্টর কলকাতার সরস্বতী প্রেসকে কংগ্রেস প্রার্থীদের জয়যুক্ত করার আহ্বান জানিয়ে, কংগ্রেসের প্রতীক এবং ইন্দিরা গান্ধীর ছবি–সহ ১৩ লক্ষ ৫০ হাজার পোস্টার ছাপানোর অর্ডার দেন এবং এর জন্য ৫ লক্ষ টাকা সরস্বতী প্রেসকে দেন। প্রথমে ইন্দিরা গান্ধী কংগ্রেসের পক্ষ থেকে ঘটনাটি অস্বীকার করেন। জ্যোতির্ময় বসু গোয়েঙ্কাদের দেওয়া অর্ডার, টাকা প্রদান–সহ যাবতীয় দলিলের ফটোকপি লোকসভায় পেশ করেন। শুধু তাই না, এই তথ্য ফাঁসের অভিযোগে সরস্বতী প্রেস কর্তৃপক্ষ প্রেসের একজন কর্মচারী বটকৃষ্ণ ধরকে ছাঁটাই করে। সে দলিলও লোকসভায় পেশ করা হয়েছিল। ফলে অস্বীকার করার কোনও কারণ দ্বিতীয়বার দেখা যায়নি।
পশ্চিমবঙ্গে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে ১৩ জন রাজ্য সরকারি কর্মচারী এবং ৩২ জন কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীকে সরাসরি বিনা নোটিসে বরখাস্ত করা হয়েছিল। স্বীকার করতেই হবে ভারতের সংসদীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে বিস্মৃতপ্রায় জ্যোতির্ময় বসুর অবদান অতুলনীয়।
http://aajkaal.in/editorial/%E0%A6%85%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%B8%E0%A7%8D%E0%A6%AE%E0%A6%B0%E0%A6%A3%E0%A7%80%E0%A7%9F-%E0%A6%9C%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A7%8B%E0%A6%A4%E0%A6%BF%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%AE%E0%A7%9F-%E0%A6%AC%E0%A6%B8/